Sudipta Mukherjee's Blog

Sunday, March 31, 2019

ভিস্তি Visti>

আজও ভিস্তিওলার দেখা মেলে 




"ন্যাড়া যায় বেলতলাতে"।  ন্যাড়া যে বেলতলাতে যায় সবাই সেকথা জানে এবং পুঁথিতেও  লেখা আছে কিন্তু কোথাও লেখা নেই বা কারো জানা নেই যে ন্যাড়া বেলতলাতে "কবার যায়?" এই প্রশ্নে "আবোল তাবোল"এর লেখক সুকুমার রায় বেশ চিন্তায় পরে গিয়েছিলেন। কেউই তাঁকে সদুত্তর দিতে পারছিলেন না। এমন সময় এক ভিস্তিওলার আবির্ভাবে তিনি চিন্তামুক্ত হলেন। 
                       
                                                লাখোবার যায় যদি সে      যাওয়া তার ঠেকায়  কিসে?
                                                   ভেবে তাই পাই না দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?
                                                      এ কথাটা যেমনি বলা     রোগা  এক ভিস্তিওলা
                                                     ঢিপ করে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তাঁর।
                                              হেসে বলে, আজ্ঞে সে কি?     এতে আর গোল হবে কি?
                                                   নেড়াকে  তো নিত্য দেখি      আপন চোখে পরিষ্কার - 
                                                      আমাদেরি বেলতলা যে      নেড়া  সেথা খেলতে আসে 
                                                        হরে দরে হয় ত মাসে       নিদেন পক্ষে পঁচিশ বার।"

বিখ্যাত লেখক সুকুমার রায় এইভাবেই আমাদের সাথে ভিস্তিওলাদের পরিচয় করে দিয়েছিলেন। যে ব্যক্তি  মশকে করে  জল বহন  ও সরবরাহ  করে তাকেই  ভিস্তিওলা বলা হয়। এই পেশাটি   পুরোনো কলকাতার প্রায় বিলুপ্ত এক পেশা। 

গতকাল  বিকেলের   দিকে  আমি ইলিয়ট  রোড  ধরে হেঁটে   ফিরছিলাম।  হঠাৎই   দেখলাম    একজন ভিস্তিওলা রাস্তার কল থেকে তার মশকে জল ভরছে। এই  দৃশ্য দেখে আমার  ছোটবেলার স্মৃতিটা মনে  উদয়  হল। আমি ছোটবেলায়  গড়িয়াহাট  অঞ্চলে কতবার  এই ভিস্তিওলাদের দেখেছি।  দেখেছি  তারা এরকমই মশকে  রাস্তার কল থেকে  জল ভরছে ,  দেখেছি  তাদের এই মশকের  জল  দিয়ে রাস্তা  ধুয়ে দিতে

আগেকার  দিনে যুদ্ধের সময়  এই মশকের  ব্যবহার খুব বেশি পরিমানে  ছিল।  মশকে করে জল ভরে টম টম  গাড়িতে  করে  ব্রিটিশ সেনা  ছাউনিগুলোতে সরবরাহ করা  হত। দিল্লি ও ঢাকাতেও এককালে প্রচুর  ভিস্তিওলা ছিল  বলে শুনেছিলাম।  কলকাতা    শহরের   সাথে এই   ভিস্তিওলাদের   সম্পর্ক কিন্তু  বহুদিনের।     প্রতিদিন ভোরবেলায় তারা রাস্তার কল  থেকে তাদের মশকে জল ভর্তি করে মহানগরীর রাস্তা ধুয়ে  দিত।    

বিশ   শতকে   কলকাতা   পুরসভা   এই   ভিস্তিওলাদের   রাস্তা  ধোয়ার  কাজে  ব্যবহার করত বড়দের  মুখে শুনেছিলাম  আর্থিক  সচ্ছল   পরিবারের   লোকেরা   এরকম  ভিস্তিওলাদের  কাছ থেকে  ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে  টাকা   দিয়ে  জল  কিনত। এখন অবশ্য এই  কাজে  সব  জায়গাতেই  মশকের  বদলে বালতি   বা  ড্রামে  করে    জল   ভরে  সরবরাহ   করতে  দেখা   যায় ।  তাদের  অবশ্য  ভারী  বলা  হয় ।ভিস্তিওলাদের   কাঁধে ঝোলানো  লম্বা  ছাগলের  চামড়ার ব্যাগ  থাকতো।  এই  চামড়ার   ব্যাগগুলিকেই  মশক বলা  হয়।  সেই  সবসময়  কলকাতা  শহরে  এই  পেশাতে  প্রচুর লোককে  দেখা  যেত।  যতদিন  যাচ্ছে  আস্তে  আস্তে এই পেশাটা  অবলুপ্তির  পথে চলে  যাচ্ছে।  আজ  যে  ভিস্তিওলার  দেখা  পেলাম  তার  নাম   রাজু  হাসান।  তার  সাথে   কথা   বলে  জানতে  পারলাম  এই   পেশাতে  সে  বহুদিন ধরেই   রয়েছে।  তার পিতা এই পেশায় দীর্ঘদিন ছিলেন। সে বললো এখন এক ভিস্তি জলের দাম পাই মাত্র ১০ থেকে ১২  টাকার মত।  সকাল ও  বিকেল  মিলে প্রায় ৩০ ভিস্তি জল দিতে পারি। তবে  এখন সেরকম চাহিদা না থাকায় সারাদিনে মাত্র ১৫ -২০  ভিস্তির মত জল দেওয়া যায়। বেশিরভাগ জায়গাতেই আজ আর জলের প্রয়োজন হয় না।  অনেক ভিস্তিওলা কলকাতা ছেড়ে দেশে ফিরে গেছে। আবার অনেকে  অন্য  পেশায়  চলে  গেছে।  সে  আরো  জানালো  জানবাজার  অঞ্চলে  অবশ্য  কয়েকজন  ভিস্তিওলা এখনও  আছে। তারা  বেশিরভাগই বিহারের বাসিন্দা। সে অবশ্য জানবাজারে  থাকে  না,   তপসিয়াতে  সে থাকে।  কথা  প্রসঙ্গে সে  জানালো মশকে  প্রায়  ২০ লিটার  মত  জল  ধরে।  তার  কাছে   জানতে  চাইলাম  তার  ছেলে  কি এই  পেশায়  আসতে  চায়  কিনা।   সে বললো একদমই  চায়  না। সে  উল্টে আমাকেই  প্রশ্ন করল যে এই  পেশায় আসলে তার ছেলে কি  খেতে পাবে ?  তার ছেলে  কাঠের কাজ  শিখে  কাঠের মিস্ত্রির  কাজ  করে।  সে  ইলিয়ট  রোড , রাফি  আহমেদ   কিদোয়াই  রোড , মারকুইস  স্ট্রিট  এইসব অঞ্চলেই জল সরবরাহ করে। 

বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল যুগে পৌঁছে আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো এরকম বহু পেশা  আজ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। 

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 

তারিখ : ৩১-০৩-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০



 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

3 comments: