Sudipta Mukherjee's Blog

Sunday, April 21, 2019

ঢাকুরিয়া লেক Lake >

প্রেমিক প্রেমিকাদের নিজস্ব ঠিকানা 


লেক ও রাস্তা 
আমাদের তিলোত্তমার শ্বাসযন্ত্র। কলকাতার ফুসফুস।  প্রেমিক-প্রেমিকাদের একান্ত ঠিকানা। যুগলদের স্নিগ্ধ বাতাসে বসে একান্তে কিছুটা সময় গল্প করে কাটানোর নিজস্ব জায়গাই হল  দক্ষিণ  কলকাতার বুকে গড়ে তোলা এই কৃত্রিম হ্রদটি। হ্রদটির পূর্বের নাম ছিল ঢাকুরিয়া লেক বর্তমানে অবশ্য  রবীন্দ্র সরোবর নামে  পরিচিত। এটি শহরের এক অন্যতম  বিনোদন পার্ক।  

দুরন্ত গতিতে চলা আমাদের ঐতিহ্যশালী তিলোত্তমা কলকাতা। বায়ুদূষণে যখন আমাদের তিলোত্তমাবাসীদের অবস্থা কাহিল, তখন তরতাজা নির্মল নিশ্বাস নেওয়ার জন্য এই হৃদটিতে এসে মন প্রাণ ভরে  তুলতে পারেন। এক টুকরো আকাশ, সুদীর্ঘ জলরাশি, প্রচুর গাছ দিয়ে সাজানো গোছানো এক মনোরম পরিবেশ যা আপনার জন্যই  অপেক্ষা করে রয়েছে।
লেকের রাস্তা 

উনিশ শতকের প্রথমদিকে কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলটির বেশিভাগ জায়গাই জলে-জঙ্গলে ভর্তি ছিল। বসবাসের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। ১৯২০ সালে কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলের উন্নতিকল্পে রেল লাইনের ধার বরাবর ঢাকুরিয়া, লেক গ্রার্ডেন্স, টালিগঞ্জের বেশ কিছুটা অঞ্চলকে নিয়ে ১৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। রাস্তাঘাট তৈরী, নীচু  জমি উঁচু করে  বসবাসযোগ্য করে তোলাই ছিল তাদের  এই  জমি  অধিগ্রহনের একমাত্র কারণ। এই অধিগৃহীত জমির জঙ্গল পরিষ্কার করে ৭৩ একর জায়গা নিয়ে তারা একটি  বৃহৎ হ্রদ খনন করে। বাকি অংশটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়। এই বৃহৎ হৃদটিই আজকের রবীন্দ্র সরোবর। আমাদের শহরের প্রাণভ্রমরা।

হ্রদটি প্রথম থেকেই ঢাকুরিয়া লেক বলে পরিচিত ছিল। ১৯৫৮ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নামানুসারে কে আই টি হ্রদটির নামকরণ করে। জলাশয়টি ছাড়া এখানে তারা তৈরী করে ফুটবল স্টেডিয়াম, মুক্তমঞ্চ, ঝুলন্ত সেতু। এছাড়া এখানে বৌদ্ধ মন্দির, মসজিদ ও একটা গ্যালারিও রয়েছে। জলাশয়টিকে ঘিরে সুন্দর রাস্তা ও বসার জন্য বেশ কিছু চেয়ার তৈরী করা আছে।

ফুটবল স্টেডিয়ামটির নামও বিশ্বকবির নামে  নামাঙ্কিত। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামটি ১৯৫০ সালে হ্রদটির উত্তরদিকে তৈরী করা হয়েছিল। ছাব্বিশ হাজার আসনবিশিষ্ট এক সুন্দর ফুটবল স্টেডিয়াম।  অডিও -ভিসুয়ালের সুবিধাযুক্ত এটিই  কলকাতার প্রথম স্টেডিয়াম।
সূর্যাস্তের আলোকচ্ছটা 

হ্রদটির উত্তরদিকে কেয়াতলার কাছে বিদ্রোহী কবি নজরুলের নামে  একটা বিশাল মুক্ত মঞ্চ রয়েছে। এই মঞ্চটিতে প্রায় তিন  হাজার দর্শকের বসার ব্যবস্থা আছে। এখানেই পৃথিবী বিখ্যাত ডোভার লেন মিউজিক উৎসবটি প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়।  এছাড়া সারা বছরই নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

হ্রদটির দক্ষিণদিকে গোলপার্কের ঠিক পিছনে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের ঐতিহ্যশালী বাড়িটি রয়েছে। এখানে বড়দের ও শিশুদের দুটি  পাঠাগার, দেশী ও বিদেশী ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র, মিউজিয়াম, প্রার্থনা ঘর, প্রকাশনা বিভাগ  ও  পুস্তক বিপনী রয়েছে। রামকৃষ্ণ মঠের এই শাখা কেন্দ্রটি শিক্ষা ও সংস্কৃতির  এক অসাধারণ চর্চা কেন্দ্র।

জাপানি বৌদ্ধ মন্দির
জলাশয়টির দক্ষিণদিকে ঢাকুরিয়া চৈতন্য মহাপ্রভু সেতুর পাশে অবস্থিত অসাধারণ একটি বৌদ্ধ মন্দির। আন্তর্জাতিক সংগঠন নিপ্পনজান মোয়োহোজির প্রতিষ্ঠাতা নিচিদাৎসু ফুজি কলকাতার একমাত্র জাপানি বৌদ্ধ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৫ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখানে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় বেশ ভক্তিভরে প্রার্থনা করা হয়।

হ্রদটির দক্ষিণদিকে একটা সুন্দর ঠাকুরের গ্যালারী রয়েছে। এই গ্যালারীতে বিখ্যাত বেশ কিছু সার্বজনীন দূর্গা পুজোর পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিমাগুলো কে সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। ২০১২ সালে এই গ্যালারীটিকে তৈরী করা হয়েছে।

 জলাশয়টির দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে বেশ কয়েকটা সাঁতার ও রোয়িং প্রশিক্ষণের কেন্দ্র রয়েছে। এইসব প্রশিক্ষণ  কেন্দ্রগুলো বহু পুরোনো।  এখান থেকে বহু শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করে।

সেই ঐতিহাসিক কামান 
১৯২০ সালে যখন হ্রদটির  খননকার্য চালানো হচ্ছিলো  তখন ইংরেজ আমলে তৈরী  কতকগুলি কামান এখানে  পাওয়া গিয়েছিল। সেই কামানগুলি দূর্গা গ্যালারীর  কাছে আজও সগৌরবে বিরাজ করছে।

হ্রদটির দক্ষিণদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা পূর্ণবয়ব ভাস্কর্য রয়েছে। প্রতি বছর  রবীন্দ্রনাথের  জন্ম ও মৃত্যুরদিন সকালে ফুল-মালা দিয়ে কবিকে সম্মান জানানো হয়।

হ্ৰদটির  মধ্যভাগে একটা ছোট্ট সুন্দর দ্বীপ  রয়েছে। এই দ্বীপটির মধ্যে একটা মসজিদ আছে।  এই মসজিদটি হ্রদটি খনন করার পূর্ব থেকেই রয়েছে।  এই দ্বীপটিতে যাওয়ার জন্য ভারী সুন্দর একটা ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। ১৯২৬ সালে
ঝুলন্ত সেতু 
সেতুটিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেতুর ওপর থেকে জলে খেলে বেড়ানো মাছেদের জলকেলির দৃশ্যটি খুব মনোরম লাগে।

শাল, সেগুন, আম, অশ্বত্থ, বট প্রভৃতি বড় বড় গাছ সমগ্র হৃদটিকে ঘিরে রেখেছে।  শোনা যায় প্রায় পঞ্চাশ রকমের গাছ এখানে রয়েছে, তারমধ্যে বেশ কিছু গাছের বয়স শতবর্ষ  পেড়িয়ে গেছে।  গাছগুলি ঐতিহ্যশালী হ্রদটির পরিবেশকে সবুজ ও মনোরম করে তুলেছে। বেশ কিছু বিলুপ্তপ্রায় গাছ এখানে দেখা যায়। হ্রদের জলে রাজহাঁসের খেলে বেড়ানোর দৃশ্যও মন ভরিয়ে দেয়।

সরোবরটিতে  পাঁচটি প্রবেশ পথ রয়েছে।  প্রবেশ পথগুলির টাইলসে রবীন্দ্রনাথের লেখনী দিয়ে চিত্রিত করা আছে।  সরোবরের জলাশয়টির পাশের রাস্তাগুলোকে  টাইলস দিয়ে সুন্দর করে বাঁধানো হয়েছে।  জলাশয়ের রেলিংগুলোতে বোলার্ড লাগানো হয়েছে।  বোলার্ড হচ্ছে আবহাওয়া প্রতিরোধকারী এক প্রকার দর্শনীয় সৌর আলো।  সন্ধ্যের সময় যখন আলোগুলো জ্বলে ওঠে তখন লেকের সৌন্দর্য দ্বিগুন  করে তোলে। নিরাপত্তার করণে চারদিকে আরো কিছু অন্য ধরণের আলো দিয়ে সাজিয়ে  তোলা হয়েছে। লেকের দেয়ালগুলোতেও  বেশ কিছু জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের চিত্র চিত্রিত করা হয়েছে। সব সময় এখানে  পাখীদের কলতানে ভরে থাকে।  শীতকালে এখানে বেশ কিছু অতিথি পাখীদের দেখা মেলে। প্রতিদিন ভোরবেলা  ও সন্ধ্যের সময় বহু স্থানীয় বাসিন্দাদের এখানে ভ্রমণ করতে দেখা যায়।

বিশ্বকবির ভাস্কর্য 
বর্তমানে সরকারি তরফ থেকে রবীন্দ্র সরোবরের সৌন্দর্যায়নের জন্য নতুন  একগুচ্ছ পরিকল্পনা করা হয়েছে।  সরোবরের চারদিকে বসার জন্য নতুন করে বেশ কিছু বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে।  আগের শিশু উদ্যানের মতো একটা নতুন শিশু উদ্দ্যান তৈরী করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। হ্রদের জলকে পরিষ্কার করে পরিবেশের সঙ্গে মানানসই করা হচ্ছে।  ছট পুজো করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কুকুর নিয়ে এই সরোবরে ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত করার চেষ্টা চলছে। এইসব সৌন্দর্যায়নের কাজে প্রাতঃভ্রমণকারীদের সংগঠন সর্বতোভাবে  সহযোগিতা করছে।  "ত্রুমিত্র" নামে এক প্রকল্পের মাধ্যমে এখানকার বিশাল বিশাল গাছগুলোকে দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।  এই প্রকল্পে নতুন নতুন গাছও  বসানো হচ্ছে।

দূর্গা গ্যালারির প্রতিমা 
আধুনিক সাজসজ্জা , বর্ণিল আলোকচ্ছটা, হ্রদের জলে সূর্যাস্তের রঙে রঙিন হয়ে ওঠা, গাছের ফাঁকে আলো-আঁধারি খেলা, এই আবছা আলোয় যুগলের গল্পে মশগুল থাকা, বাচ্ছাদের দুরন্তপণা  সবমিলে এখানকার স্নিগ্ধ, সুমধুর পরিবেশ শহরবাসীকে সবসময় প্রলুব্ধ করে চলেছে। এখানে আসলে একান্তে নিরিবিলি পরিবেশে  বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করা যায়। দৈনন্দিন কাজের পরিশ্রম  থেকে  কিছুটা সময় বের করে এখানে কাটাতে পারলে পরেরদিন নতুন উদ্দ্যমে নতুনভাবে কাজে মন দিতে সুবিধা হয়।




তারিখ : ২১-০৪-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

1 comment: