Sudipta Mukherjee's Blog

Thursday, May 9, 2019

নবাবহাট ১০৮ শিব মন্দির ভ্রমণ >

নবাবহাটে ২৩০ বছরের ইতিহাস 




পশ্চিমবঙ্গের একটি ঐতিহাসিক জেলা হল বর্ধমান জেলা।  এই জেলার প্রতিটি  ইটের গায়ে  জড়িয়ে আছে কত ইতিহাসের গল্প, রাজা-রানীদের নানান কীর্তি। জেলার নানান স্থানে নানারকম স্থাপত্যকীর্তি ছড়িয়ে আছে। এখনো তার কিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়, আবার কিছু জরাজীর্ণ ও কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মা সর্বমঙ্গলা। তবে রাজ পরিবারের শিব ঠাকুরের প্রতি একটা আলাদা মোহ ছিল। এই জেলাকে শিব ঠাকুরের জেলা বললে ভুল বলা হয় না। সমগ্র জেলাজুড়ে অসংখ্য  শিব মন্দির রয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে  শিবঠাকুর বা মহাদেব পূজিত হয়ে থাকেন। কোথাও প্রতাপেশ্বর, কোথাও রাজেশ্বর, কোথাও পঞ্চানন, কোথাও বুড়োশিব, কোথাও বৈদ্যনাথ, কোথাও বুড়োরাজ নামে শিবঠাকুর পূজিত হন। শিবঠাকুরই এই জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবতা বলে মনে হয়। বর্ধমান জেলার সবচেয়ে বড় শিব ঠাকুর রয়েছে আলমগঞ্জের মোটা শিব নামে। এই শিবলিঙ্গটিকে বর্ধমানেশ্বর  বলে অভিহিত করা হয়। এই শিব লিঙ্গটির উচ্চতা প্রায় ৬ ফুট আর ওজন প্রায় ৩৬০ কিলোগ্রাম (৯ টন)।  শোনা যায় ১৯৭২ সালে মাটি খোঁড়ার সময় এই বিশালাকৃতি শিবলিঙ্গটি পাওয়া গিয়েছিল।

বর্ধমান জেলার বর্ধমান শহরের খুব কাছের  একটা ছোট্ট গ্রাম  হল নবাবহাট।  নবাবহাট অঞ্চলেই মুঘলদের সাথে নবাবদের যুদ্ধ হয়েছিল। মুঘল আমলে বর্ধমানের নাম ছিল শরিফাবাদ। আবুল ফজলের  লেখা "আইন ই আকবরী" বইতে এই নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়।

বর্ধমান জেলা হল  ভারতবর্ষের একমাত্র জেলা যেখানে দু-দুটো ১০৮ শিব মন্দির রয়েছে। ভারতবর্ষের আর কোথাও এরকম শিব মন্দিরের সারিকে দেখা যায় না। বর্দ্ধমানের মহারানী বিষ্ণুকুমারীদেবী সর্বপ্রথম নবাবহাটে ১৭৮৮ সালে একটি ১০৮ শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্ধমানের মহারাজ তেজবাহাদুর ১৮০৯ সালে জেলার কালনা শহরে আর একটা ১০৮ শিবমন্দির নির্মাণ করেন। কালনার এই শিবমন্দিরের সারিকে "নব-কৈলাশ শিবমন্দির" বলা হয়। আজ আমি নবাবহাটের শিবমন্দিরগুলোর কথা আপনাদের বলবো। প্রকৃতপক্ষে দুটি স্থানেই ১০৯ টি  করে শিবঠাকুরের মন্দির আছে।

একদা নাবাবহাট গ্রামে ভীষণ দুর্যোগ হয়, মন্বন্তরে  গ্রামটি প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। এই সময় মহারাজ তিলকচাঁদের মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র নাবালক থাকায় তিলকরাজের বিধবা পত্নী মহারানী বিষ্ণুকুমারীদেবী কিছুদিন রাজ সিংহাসনে বসেন। মহারানী বিষ্ণুকুমারীদেবীর সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ বাঁধে। ইংরেজরা রানীর বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে। মহারানী বিষ্ণুকুমারীদেবীর অনুগ্রহে নাবাবহাট গ্রামটি মন্বন্তরের হাত থেকে রক্ষা পায়। তিনি সর্বতোভাবে গ্রামবাসীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এই সময় অর্থাৎ ১৭৮৮ সালে তিনি মহারাজ তেজপালের দাক্ষিণ্যে গ্রামবাসীদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে নাবাবাহাটে  একটা ১০৮ শিবমন্দির নির্মাণ শুরু করেন। নবাবহাটের মন্দিরগুলোর  নির্মাণ কাজ ১৭৯০ সালে শেষ হয়েছিল।

আমি যখন গতবছর  এই মন্দির দর্শনের জন্য গিয়েছিলাম তখন এরকমই মে মাসের এক ভীষণ গরমের দিন ছিল। মন্দিরের চাতালে পা দেওয়া যাচ্ছিল না। খালি পায়ে ওই গরম পাথরের চাতালেই হেঁটে মন্দিরগুলো দর্শন করতে হল।   মূল মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে জুতো  রাখার লোহার একটা সুন্দর রেক রাখা আছে।  এই রেকে  জুতো রেখে তবে মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম।  এখানে জুতো রাখার জন্য সামান্য খরচা বহন করতে হয়।  জুতা রাখার পর একটা কল আছে সেখানে হাত ধুয়ে নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হল। মন্দিরে প্রবেশ করার পর দেখলাম ডানদিকে একটা দোতলা বাড়ি আছে, এই বাড়িতে তীর্থযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বাড়িটির এক তলায় একটা ছোট্ট অফিস ঘর রয়েছে। মন্দিরগুলোর বামদিকে একটা সুন্দর বাগান রয়েছে। সমগ্র মন্দির চত্বরটি সুন্দরভাবে ঘেরা রয়েছে। মন্দির চত্বরের পিছনদিকে পুবদিক ঘেঁষা একটা সুন্দর জলাশয় রয়েছে। জলাশয়ের জল অতটা  স্বচ্ছ বা  পরিষ্কার নয়, একটু হলদেটে ঘোলা জল। জলাশয়টির  জলে গাছপালা ও মন্দিরের প্রতিফলন পড়ছে দেখলাম। প্রতিফলনটা দেখতে মন্দ লাগলো না।  সমগ্র জলাশয়টি লোহার জাল  দিয়ে ঘেরা রয়েছে। সামনের দিকে শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। পুরো  জলাশয়টির  পাড় সুন্দর করে বাঁধানো আছে।  জলাশয়ে  প্রবেশ করার জন্য কয়েকটা লোহার গেট করা আছে। জলাশয়টি ঠিক  একদম গোলাকৃতি  নয়, একটু লম্বাটে ধরনের। জলাশয়টির গেটের পাশে একটা বিজ্ঞপ্তি লাগানো আছে "জল নেওয়ার প্রয়োজন হলে মালির কাছ থেকে চাবি আছে, চাবি চেয়ে নিয়ে জল নেবেন এবং চাবি যথাস্থানে ফেরত দেবেন"। দুটি সারিতে ১০৮টি ও আর একটা আলাদাভাবে শিব মন্দির রয়েছে। এখানে মোট ১০৯টি শিব মন্দির রয়েছে। একটা নাটমন্দিরও রয়েছে দেখলাম। একটা মন্দিরের সাথে আর একটা মন্দির গায়ে  লাগানো, দুটি মন্দিরের মধ্যে কোনো ফাঁক নেই।  সারা বছরই এখানে প্রচুর ভক্তের সমাগম হতে দেখা যায়।  মন্দির চত্বরের ভিতরে অফিস  ঘরের কাছে একটা জায়গায় লোহার ফ্রেমে ১০৮টি  ঘন্টা রাখা আছে। ঘণ্টাগুলো সম্পূর্ণ পিতলের তৈরী। ঘন্টাগুলি খুব বড় আকারের নয়, আবার একদম ছোটোও  নয়, মাঝারি মাপের।  সবাইকে দেখলাম  মন্দির দর্শন করার পর এখানে এসে এই  ঘণ্টাগুলো বাজাচ্ছে। ঘন্টা বাজনোয় অঞ্চলটিতে একটা মিষ্টি সুরেলা আবহাওয়া তৈরী করছে। কথিত আছে মন্দির দর্শনের পর এই ঘন্টা বাজালে নাকি মনস্কামনা পূরণ হয়।

কালনার নব কৈলাশ শিবমন্দিরের মতো এখানকার মন্দিরগুলো বৃত্তাকারে নয়, এখানে দুটি লম্বা সারিতে মন্দিরগুলোকে সাজানো হয়েছে। কালনার শিবমন্দিরগুলি যেন ফুলের মালায় ১০৮টি ফুলকে গেঁথে একটা মন্দিরমালা তৈরী করা হয়েছে। নবাবহাটের মন্দিরগুলো ঠিক ওইভাবে তৈরী নয়। এখানকার মন্দিরগুলো দুটি সারিতে সারিবদ্ধভাবে তৈরী করা হয়েছে।  মন্দিরগুলো আকারে বেশ ছোট। মন্দিরগুলোর উচ্চতা মোটামুটি পনেরো ফুটের মত হবে বলে আমার মনে হল। নাবাবাহাটের মন্দিরগুলি বাংলার আটচালা শিল্পরীতিতে তৈরী। সব কটা মন্দিরেই সামান্য টেরাকোটার কাজ রয়েছে। মন্দিরগুলির কোনোটাতে কোনো দরজা নেই। প্রত্যেকটা মন্দিরে শিব লিঙ্গ বিরাজ করছে। প্রতিটা শিবলিঙ্গই  কালো রঙের কোষ্ঠী পাথরের তৈরী।মন্দিরগুলো দেখলে বোঝা যায় সত্যিই  এক অসাধারণ শিল্পকীর্তি। মহারানী বিষ্ণুকুমারী দেবীর এক মহান কীর্তি এই শিবমন্দিরগুলো।  মন্দিরগুলো বর্ধমানের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।

 এককালে এই মন্দিরগুলো জরাজীর্ন অবস্থায় চলে গিয়েছিল। ১৯৬৫ সালে বিড়লা জনকল্যাণ ট্রাস্টের আর্থিক সহযোগিতায় মন্দিরগুলোকে সংস্কার করা হয়েছে।  ১৯৭৪ সালে একটা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে।  বর্তমানে মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষন থেকে নিত্যপূজা সবকিছুই এই ট্রাস্টিবোর্ড দেখাশোনা করে থাকে। প্রতিবছর শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে একটা বিশাল মেলা বসে।  সেই সময় এখানে নানান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে।  এই মেলায় প্রায় লাখ খানেক লোকের সমাগম হয়।

মন্দিরের প্রবেশদ্বারের পাশেই বাইরের দিকে কৃত্রিম পাহাড় তৈরী করা হয়েছে। এই  পাহাড়ের  উপর শিব-পার্বতী ও হনুমানজির মূর্তি রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গনটি ভীষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।  আমি যখন এই মন্দির দর্শনে যাই তখন একজন পুরোহিত মহাশয়কে দেখছিলাম অনেক খুঁজেও অন্যান্য মন্দিরের মত  কোনো পান্ডাকে এখানে  দেখতে পাইনি। পুরোহিত মহাশয় অন্যের পুজোয় ব্যস্ত থাকায় নিজের পুজো নিজেকেই দিতে হয়েছিল। এখানকার পরিবেশ আমার খুবই ভালো লেগেছিল। আপনারা বর্ধমান স্টেশন থেকে মাত্র দু-তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দিরটি দেখে আসতে পারেন। আশাকরি আমার মতো আপনাদেরও ভালো লাগবে।  মন্দির দেখার পর অবশ্যই বর্ধমানের বিখ্যাত মিহিদানা-সীতাভোগ খাবেন। বর্ধমানের এই  স্বাদ নিতে  ভুলবেন না।

মন্দিরগুলো সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত আর দুপুর তিনটে থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত সর্ব সাধারণের  জন্য খোলা থাকে। দেখছিলাম একটা বোর্ডে কিছু নিয়মকানুন লেখা আছে। মন্দিরের ভিতরে কোথাও বসবেন না। মন্দিরের ভিতরে বা আশপাশে কোনোরূপ অশালীন আচরন করবেন না বলে বোর্ডটিতে লেখা আছে। তবে কোথাও ছবি তোলায় কোনো বারণ আছে, এই ধরণের কোনো বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়লো না।  আমি তো ইচ্ছে-খুশী মতো এখানে ছবি তুলেছিলাম। মন্দিরগুলো ২৫০ বছর ধরে বর্ধমানের ঐতিহ্যকে  বহন করে চলেছে।


কিভাবে যাবেন :
হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে করে বর্ধমান স্টেশনে এসে নামুন। স্টেশনের বাইরে প্রচুর অটো ও টোটোগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে।  একটা গাড়ি বুক করে এখানে খুব সহজেই পৌঁছানো যাবে। গাড়ি করে আসলে বর্ধমান থেকে  জি টি রোড ধরে কিছুটাএগোলে ডানদিকে সিউড়ি রোড পড়বে।  এই সিউড়ি রোড ধরে সামান্য পথ এগোলেই এই মন্দিরগুলিকে দেখা যায়।




তারিখ : ১০-০৫-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো  লাগে, তাহলে   অবশ্যই   আপনার  মূল্যবান  মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

2 comments:

  1. ভারী ভালো লাগলো এই তথ্যবহুল লেখাটি পড়ে। কালনার লোক হিসেবেও ভালো লাগলো, বিশেষ করে প্রবাসীর চোখে। একটা প্রশ্ন--যে ট্রাস্টের কথা বলা হয়েছে, কৈ কখনও তো তাঁরা কালনা/বর্ধমান-বাসীদের কাছে চিঠি/ইন্টারনেট/ফেসবুক/বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পৌঁছোবার চেষ্টা করেননি?

    ReplyDelete