 |
ইছামতী |
নৌকো তার পাল তুলে ভেসে চলেছে, কারো মাথার ওপর ভারতের পতাকা, আবার কারো মাথায় উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছুটা খামখেয়ালীভাবে তারা ইছামতীর বুকে ভেসে চলেছে। মাতাল হাওয়ায় পতাকাগুলো পত্ পত্ করে উড়ছে। ওপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা আর এপারে আমাদের টাকী। দুই দেশকে ভাগ করেছে ইছামতীর বিস্তীর্ণ জলরাশি। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতীকে দেখেছিলেন এক প্রকৃতি প্রেমিকের চোখে আর আমি শহুরে চোখে নীল আকাশের নীচে তার অপরূপ শোভা দেখছি। বহমান জলের শোভা দেখতে দেখতে নদীর পাড় ধরে বাঁধানো রাস্তায় হেঁটে চলেছি। প্রকৃতির অপরূপ শোভা চাক্ষুষ করে মনটা আনন্দে ভড়ে উঠছে। আমাদের বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আর এক বাংলার দৃশ্য দেখা যেন এক পরম পাওনা হিসেবে ধরা দিচ্ছে। রোদের ঝলকানি আজ বড়ই কম, মেখলা আকাশে, মিষ্টিমধুর বাতাসে, মাটির সোঁদা গন্ধে ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। এখানে এক শান্তির পরিবেশ বিরাজ করছে। চারদিকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স আমাদের সুরক্ষা বর্ধন করে চলেছে। খেয়াল করিনি হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আমরা পৌঁছে গিয়েছি টাকীর বিখ্যাত পিকনিক স্পটে। শীতের সময় জায়গাটা বেশ জমজমাট থাকে। আজ কোনো মানুষের দেখা নেই, নেই কোনো কোলাহল, একদম শান্ত নিরিবিলি। কত দূর দূরান্ত থেকে শীতের সময় লোকেরা এখানে পিকনিক করতে আসে। টাকী পুরসভা বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে স্পটটি তৈরী করেছে। কয়েকটি চেয়ার ও একটা সুন্দর ভিউ পয়েন্ট তৈরী করে দিয়েছে।
 |
ঘোষ বাবুদের ঠাকুর দালান |
ওখান থেকে আমরা ঘোষবাবুদের পাড়ায় ঢুকে গেলাম। টাকীর জমিদার ছিলেন হরিনারায়ণ ঘোষ। তাঁর নামেই ঘোষ বাবুদের পাড়া। কিছুটা এগোতেই টাকীর বিখ্যাত ঠাকুর দালানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রসঙ্গক্রমে জানাই ১৯২৪ সালে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ঘোষবাবুদের আমন্ত্রণে এনাদের বসতবাড়িতে এসেছিলেন। এই দালানে ঢোকার জন্য একটা বিশাল কালো রঙের দরজা রয়েছে, সিংহ দরজা বলা চলে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে দরজাটিতে বহুকাল কোনো রঙের পোঁচ পড়েনি, তবে দরজাটি ঐতিহ্যের ম্মারক হয়ে এখনও বিরাজ করছে। দরজাটি দিয়েই ভিতরে আমরা চারজন অর্থাৎ আমি, বিনীতদা, সৌম্য ও তন্ময় ঢুকে পড়লাম। জনমানব শূন্য জায়গাটা। অসাধারণ কারুকাজ করা এক ঠাকুর দালান। রন্ধে রন্ধে তার প্রাচীনতার প্রমান দিচ্ছে। বয়স নাকি চার শতক পেরিয়ে গেছে। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে বড়ই ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে। উপরের ছাদ ধসে গেছে, দেওয়ালের গায়ে বট বৃক্ষ তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে, ঘুঘু তার বাচ্ছা নিয়ে বেশ সুখে-শান্তিতেই সংসার যাপন করছে। তবে প্রতিবছর এই দালানে দুর্গাপুজো হয়, সেই সময় অবশ্য বংশের সদস্যদের দেখা মেলে। এতো সুন্দর সৃষ্টির এই করুন অবস্থা দেখে মনটা বেশ বিমর্ষ হয়ে গেলো। এটাও হয়তো কালের বিবর্তনে একদিন হারিয়ে যাবে। একটু এগোতেই বাঁদিকে একটা পানাপুকুর আর ডানদিকে ঘোষবাবুদের বসত বাড়িটি রয়েছে। এই
 |
ঘোষবাবুদের ঠাকুর দালানের নকশা |
বাড়িটিও প্রায় কয়েক শত বছরের পুরোনো। বড় একটা সদর দরজা রয়েছে। দরজাটি বন্ধ থাকায় ভিতরে ঢুকে বাড়িটির বর্তমান অবস্থাটা পর্যবেক্ষন করতে পারলাম না, ভালো করে দেখাও হলো না। তবে বাইরে থেকে দেখে মনে হলো বেশ গাছ গাছালিতে ঘেরা একটা দোতলা বাড়ি। এখান থেকে বেরিয়ে একটু হাটঁতেই টাকীর বিখ্যাত রাষ্ট্রীয় মহাবিদ্যালয়টির সামনে এসে পৌঁছলাম। মহাবিদ্যলয়ের সামনে ছাত্রদের সাইকেল রাখার একটা জায়গা করা আছে। আজ রবিবার, তাই বন্ধ রয়েছে। ১৯৫০ সালে মহাবিদ্যালয়টি তৈরী হয়েছে। এবার একটা টোটো ভাড়া করে টাকীর বাকি দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে নেবো।
 |
রায়চৌধুরিদের বসতবাড়ি ও ঠাকুর দালান |
কলকাতা থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের কোলে অবস্থিত টাকী উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গ্রাম্যতায় মোড়া এক ছোট্ট গ্রাম্য শহর। এই শহরের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কত কথা, কত কাহিনী, কত কিংবদন্তী, কত ঘটনা। জমিদার প্রধান শহর টাকীতে আজ আর ঝাড়বাতির রোশনাই নেই। প্রাচীন রীতি মেনে সাবেকিয়ানায় শহরের জমিদার বাড়িগুলোতে আজও দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। টাকীর ইতিহাস ও জমিদার বৃত্তান্ত প্রায় সমার্থক। চারশো বছরের প্রাচীন শহরের মাটি এখানকার জমিদারির নীরব সাক্ষী।
 |
জোড়া শিব মন্দির |
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সেই সময়কার জমিদারি প্রথা আজ মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে।কয়েকটা পোড়ো বাড়ি শুধু আজ ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখনো এখানকার বাতাসে জমিদারি মেজাজের গল্প ভেসে বেড়ায়। পঞ্চদশ শতকে ইছামতীর তীরে, সুন্দরবনের দ্বারপ্রান্তে গড়ে ওঠে প্রাচীন জনপদ টাকী। ইছামতীর গর্ভেই চাপা পড়ে আছে টাকীর অজানা ইতিহাস। ট্যাঁক শব্দটি থেকে টাকী নামের উৎপত্তি। ট্যাঁক মানে সরু মুখযুক্ত নদীর তীর। টাকীর ইতিহাসে জমিদারদের প্রভাব ছিল বরাবর। টাকীর স্রষ্টা বলে ধরা হয় রায়চৌধুরী পরিবারকে। বিরাট গুহ ছিলেন এই পরিবারের আদিপুরুষ। রায়চৌধুরী তাঁদের পাওয়া পদবী। অষ্টাদশ শতকে রায়চৌধুরী পরিবারের কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী
 |
ত্রিমূর্তি মন্দির |
শ্রীপুর থেকে এসে টাকীতে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। এই বংশের কালীনাথ একজন সমাজসংস্কারক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি বারাসাত-টাকী এই ৩৩ মাইল রাস্তাটি ও টাকীতে একটা স্কুল তৈরী করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় টাকীর শিক্ষা ও সংষ্কৃতি বৃদ্ধিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই বংশেরই অষ্টাদশ পুরুষ রামসন্তোষের পুত্রগণ টাকীতে চারটি বাড়ি বানান। দয়ারাম করেন পুবের বাড়ি, শ্যামসুন্দর করেন পশ্চিমের বাড়ি, রামকান্ত করেন দক্ষিনের বাড়ি এবং গোবিন্দপ্রসাদ করেন উত্তরের বাড়ি। প্রায় সব কটা বাড়ির বেশিরভাগ অংশই আজ নদীগর্ভে চলে গেছে। বর্তমানের পুবের বাড়িটি নতুনভাবে তৈরী করেন সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী। এই পুবের বাড়িটিও অর্ধ ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে। ঘোষবাবুরাও টাকীর অন্যতম জমিদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঘোষবাবুদের আদিপুরুষ ছিলেন শ্রীশচন্দ্র ঘোষ। এই বংশের হরিনারায়ণ ঘোষের হাত ধরেই ঘোষ পরিবারের জমিদারির উন্নতি শুরু হয়। পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরসূরিরা জমিদারির আরো
উন্নতি ও সম্প্রসারিত করেন। শুনলাম বর্তমানে তাঁদের বসতবাড়ী আর বসবাসযোগ্য নেই , ঠাকুর দালানের অবস্থার বর্ননা আগে জানিয়েছি। অন্যান্য জায়গার মত টাকীতেও সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র, মামলা-মোকদ্দমা সবই চলেছে। টাকীর জমিদারি বৃত্তান্তে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়া দুই ধারার মেলবন্ধন ঘটতে দেখা গেছে। শহরবাসীদের মুখে একটা প্রবাদ শোনা যায় "টাকীর লাঠি, সাতক্ষীরার মাটি, গোবরডাঙার হাতি" - যা এক সময় গল্পগাথায় পরিণত হয়েছিল। টাকীর জমিদারদের বিখ্যাত লেঠেল বাহিনী, গোবরডাঙার জমিদারদের প্রচুর সম্পদ ও সাতক্ষীরার জমিদারদের প্রচুর ভূসম্পত্তি ছিল। বর্তমানে টাকী পুরসভা এই গ্রামটিকে দেখাশোনা করে। এখানকার পুরসভাও খুব প্রাচীন। ১৮৬৯ সালের ১লা এপ্রিল টাকী পুরসভাটি গঠিত হয়েছিল। পুরসভাটি ঘোষবাবুদের বসদবাড়িটি ভাড়া নিয়েও কিছুদিন চালানো হয়েছিল।
 |
কুলেশ্বরী কালীবাড়ি |
টোটো গাড়ি প্রথমে আমাদের রাজবাড়ী ঘাটে নিয়ে এল। টাকী পৌর সংস্থা বেশ সুন্দর করে ঘাটটিকে সাজিয়ে দিয়েছে। ঘাটটিতে ঢোকার জন্য একটা বড় প্রবেশ তোরণ করা আছে। ভিতরে বসে ইছামতীর শোভা উপভোগ করার জন্য অনেক বড় জায়গা নিয়ে অনেকগুলো চেয়ার পাতা আছে। নদীর ধার বরাবর লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা রয়েছে। এই ঘাটটির পাশেই এককালে শ্যামসুন্দর বাবুর তৈরী পশ্চিমের বাড়িটি ছিল, যা আজও টাকীবাসীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পুরসভা পুরো বাড়িটি ভেঙে সামান্য অংশ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছে। এখান থেকে আমরা চলে এলাম টাকীর বিখ্যাত জমিদার রায়চৌধুরীবাবুদের বসতবাড়ি ও ঠাকুর দালান দেখতে। এই বাড়িটি বেশ বড় জায়গার মধ্যে একটা সাধারণ দোতালা বাড়ির মতো, জমিদার বাড়ির গন্ধ এখানে মিলবে না। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত এখানে প্রতিবছর নিয়ম করে দুর্গাপুজো করা হয়। বাড়িটির ভিতর দিকে ঠাকুর দালানটি রয়েছে। বাড়িটির সামনে ও পাশে বিরাট জমি রয়েছে। জমিটিতে অনেক গাছ রয়েছে। পরিবেশটা বেশ শান্ত ও একদম নিরিবিলি। শুনলাম বংশের লোকেরা মাঝে মাঝে আসেন। কেয়ারটেকারের পরিবার এখানে দেখাশোনা ও বসবাস করে। মিনি সুন্দরবন যেতে গিয়ে পথে পড়ল "বিসর্জন" সিনেমার বাড়িটি। কি আশ্চর্য সিনেমাতে বাড়িটি দেখেছিলাম বাংলাদেশে কিন্তু এখানে এসে দেখলাম বাড়িটি ভারতবর্ষেই অবস্থিত। যাই হোক, টোটো থেকে নেমে বাড়িটি পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। ভাঙা চোরা একটা কুঁড়ে বাড়ি। পর্ণ কুটিরও বলা চলে। বাড়িটিতে কেউ বাস করে বলে মনে হলো না। এবার আমাদের দেখতে যাওয়ার পালা টাকীর মিনি সুন্দরবন। এটা নাকি টাকীর মুখ্য আকর্ষণ। আমাদের পৌঁছতে প্রায় মিনিট কুড়ি লেগে গেলো। সীমান্ত সুরক্ষাকারীদের কাছে আধার কার্ড দেখিয়ে ভারতীয় বলে প্রমান করতে হলো। প্রমাণিত হওয়ার পর তবে ভিতরে ঢোকার ছাড়পত্র পাওয়া গেলো। বিএসফের এই চেকপোস্টের একদম কাছেই নন্দদুলাল জীউর মন্দিরটি অবস্থিত। দেবকীনন্দনের প্রতিষ্ঠিত আসল মন্দিরটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তারপর এখানকার সেবাইতরা একটি চালাঘরে বিগ্রহ রেখে সেবা কার্য চালাচ্ছিলেন, একবার এক প্রবল ঝড়ে কাঁঠাল গাছ থেকে একটি ডাল ভেঙে মন্দিরের চালায় এসে পরে, এই ডালের আঘাতে ঘরটির সাথে বিগ্রহটির কিছু অংশ ভেঙে যায়। ভাঙা বিগ্রহ মন্দিরে রাখলে গ্রামের অমঙ্গল হবে বলে গ্রামবাসীরা মনে করলেন । বর্তমানের এই মন্দিরটি ও বিগ্রহটি গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে নির্মাণ করে দিয়েছেন। সেটা দেখে আর একটু এগোনোর পর মিনি সুন্দরবনে এসে পৌঁছলাম। টোটো রেখে দশ টাকার টিকিট কেটে হাঁটতে শুরু করলাম । বেশ সুন্দর গ্রাম্য
 |
বিসর্জন চলচ্চিত্রের শুটিং এই বাড়ীতে হয়েছিল |
পরিবেশ, পাকা সুন্দর সেতু রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে, রাস্তার দুধারে গোলপাতার গাছ ভর্তি রয়েছে, সাথে অনেক সুন্দরী গাছও আছে দেখলাম। চারদিকে নিঃস্তব্ধ, পাখির ডাক শুনতে শুনতে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম। রাস্তার শেষে একটা বিশ্রামাগার করা আছে। এখান থেকে কাঁচা পথ নেমে গেছে ইছামতীর বুকে। জায়গাটা ভালোই লাগল। গোলপাতার জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবন দেখে আবার রওনা দিলাম জোড়া শিব মন্দির দেখতে। টাকীর জমিদার রামকান্তের পুত্র গোপীনাথ রায়চৌধুরী প্রায় তিনশো বছর আগে উত্তরপল্লী অঞ্চলে একটা বিরাট পুকুর খনন করেন। এই পুকুরের পাড়েই তিনি শিব মন্দির দুটি প্রতিষ্ঠা করেন। পুকুরের এপার থেকে মন্দিরগুলো দেখলাম। মন্দির দুটিকে নতুনভাবে পুরসভা সংস্কার করে রঙ করে দিয়েছে। ওই মন্দির দুটো শিবানন্দ মন্দির নামে পরিচিত। শিব চতুর্থীতে এখানে মেলা বসে। এবার আমরা চললাম মোহনা। পদ্মা, কালিন্দী ও ইছামতীর মিলনস্থান। মোহনার একটু আগে দেখলাম একটা বিশাল হোটেল তৈরী হচ্ছে। আমাদের টোটো
 |
মোহনা ও বাংলাদেশের গোলপাতার জঙ্গল |
চালকভাইয়া জানালো এই হোটেলটি ইটিসি কোম্পানি বানাচ্ছে। মোহনার কাছ থেকে বাংলাদেশের গোলপাতার জঙ্গলটা দেখা যাচ্ছে। এই জায়গাটি থেকে ইছামতী ও বাংলাদেশের দৃশ্য দেখতে মন্দ লাগলো না। ফেরার পথে ইকো পার্কে ৩০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে ঢুকলাম। পার্কটি বেশ সুন্দর।পার্কে বোটিং করার সুব্যবস্থা রয়েছে। একটু এগোতে দেখতে পেলাম ত্রিমূর্তি মন্দিরটি। মন্দিরটি বেশী পুরোনো নয়। সুন্দরভাবে রঙ করা এক অপরূপ মন্দির। ত্রিমূর্তি মন্দিরটি দেখে চার শত বছর পুরনো টাকীর কুলেশ্বরী কালীবাড়িতে এলাম। টাকীর পাশ দিয়ে কোনো এক সময় ইছামতী ছাড়াও নাকি যমুনা নামে একটা নদী প্রবাহিত হতো বলে অনুমান করা হয়। সেই নদীর কুলেই এই কালিবাড়িটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। নদীর ঢেউয়ে পূর্বতন মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায়। জলের স্রোতে মূর্তিটি এই স্থানে চলে আসে। বর্তমানের সিমেন্টের মন্দির ও মূর্তিটি অমর রায়চৌধুরী তৈরী করে দিয়েছেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এখানে মেলা বসে। এই মেলায় অনেক লোকের সমাগম হয়। এবার আমরা চললাম টাকীর
 |
রামকৃষ্ণ মন্দির ও আশ্রম |
বিখ্যাত রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরটি দেখতে। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে মিশনটি গড়ে উঠেছে। মিশনের ভিতরে মন্দির ছাড়াও একটা আবাসিক স্কুল ও গ্রন্থাগার রয়েছে। মিশনটি ও স্কুলটি সম্ভবত ১৯৩১-৩২ সাল নাগাদ স্থাপিত হয়েছে।
সবশেষে টাকীর বিসর্জনের কথা না বললে টাকী ভ্রমণের কথা পরিপূর্ণতা পায় না। আমি বছর পাঁচেক আগে একবার দশমীর দিন বিসর্জন দেখতে এখানে এসেছিলাম। টাকীর পুজোর ইতিহাস প্রায় তিন-চারশো বছরের। শোনা যায় জমিদার জগৎবন্ধু রায়চৌধুরী প্রথম টাকীতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন। সেই ধারা এখনো বজায় আছে, তবে আগেকার সেই জৌলুশ আর নেই। একচালা ডাকের সাজের প্রতিমাই এখানে পুজো হয়ে থাকে। শুনেছি বংশ পরম্পরায় পুরোহিত, ঢাকি ও মৃৎশিল্পী কাজ করে চলেছে। দশমীর দিন এখানে সম্প্রীতি বন্ধনের এক মিলনমেলার প্রচলন ছিল। হিন্দু মুসলমান সব একাকার হয়ে যেত, ভারত বাংলাদেশ মিলেমিশে এক হয়ে যেত। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক এই দিন বিএসফের অনুমতি নিয়ে টাকী বেড়াতে আসত। বর্তমানে নিরাপত্তার কারণে আর তাদের আসার অনুমতি দেওয়া হয় না। ইছামতীর বুকে টাকীর বিসর্জন বিশ্ব বিখ্যাত। বিজয়া দশমীর দিন টাকী ও সাতক্ষীরায় দেবীকে বিসর্জন দেয় দুই বাংলার মানুষ। টাকীতে দেখেছি সকালে দুটি নৌকোর মাঝে বাঁশ বেঁধে দেবীকে বসানো হয়, সারাদিন ধরে মাকে নিয়ে নৌকো দুটি ইছামতীতে পরিক্রমা করে। সন্ধ্যের সময় অশ্রুসিক্ত চোখে মাকে বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয়। এই দিন বিসর্জনের দৃশ্য চাক্ষুষ করতে প্রায় হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়ে থাকে . এই দিন টাকী শহর ও ইছামতীকে কঠোর নিরাপত্তায় বেঁধে ফেলা হয়।
 |
ভাসানের উদ্দেশ্যে দেবীকে নৌকোয় তোলা হচ্ছে |
নদীজুড়ে বিএসফের বেশ কয়েকটি স্পীট বোর্ড, পুলিশের ও পুরসভার আরো কয়েকটি নৌকো নিরাপত্তায় থাকে। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের দল ও মেডিকেল দলকেও প্রস্তুত রাখা থাকে।
আজকের মতো আমাদের ঘোরা শেষ হয়ে গেলো, এবার ফেরার পালা। টোটো করে আমরা হাসনাবাদ স্টেশনে চলে এলাম। তখন সূর্য ডুবতে অনেকটা সময় বাকি। একটা ট্রেন স্টেশনে অপেক্ষা করছে, ছাড়ার সময় ৪-১৫ মিনিটে। আমরা উঠে পড়লাম। ট্রেনটি একদম ঠিক সময় ছেড়ে দিলো।
কিভাবে যাবেন :
শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদ লোকাল ট্রেন ধরুন। সময় মোটামুটি ঘন্টা দুয়েকে লাগবে, টাকী রোড স্টেশনে নামবেন। স্টেশনের বাইরে প্রচুর টোটো গাড়ি দেখতে পাবেন, ওই টোটো গাড়ি করে রাজবাড়ী ঘাটে চলে আসুন। ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ২০ টাকা। এছাড়া আপনি স্টেশন থেকেই সমগ্র টাকী বেড়ানোর জন্য টোটো গাড়ি ভাড়া নিয়ে নিতে পারেন। তাতে ভাড়া মোটামুটি চার-পাঁচ জনের জন্য ৫০০ টাকা লাগবে। একটু দরদাম করে নেবেন। পর্যটক দেখলে অনেক ভাড়া বেশি চাইবে। এছাড়া ধর্মতলা থেকে বাসে করে এখানে পৌঁছানো যায়। নিজস্ব গাড়ি করে এখানে খুব সহজেই আসতে পারবেন এবং সময়ও অনেকটা কম লাগবে।
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ২৪-০৬-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে জায়গাটা এবং তার ঐতিহ্যের ছবি সহ বর্ণনা দেওয়ার জন্য।
ReplyDelete