Sudipta Mukherjee's Blog

Friday, June 21, 2019

মাহেশের রথ>

মাহেশের রথ

দেখতে দেখতে প্রায় পাঁচ পাঁচটা শতক পেড়িয়ে গেছে।  ওখানকার মন্দিরের সেবাইতরা অবশ্য দাবি করেন ৬০০ বছর উর্ত্তীর্ন হয়ে গেছে। গত সোমবার তাঁর  প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো স্নানযাত্রার মাধ্যমে।  প্রথাগতভাবে জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রাকে স্নান করিয়ে  সুন্দরভাবে সাজিয়ে মন্দিরে এনে রাখা হয়। তারপর কিছুক্ষন মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয়।  পরে ভক্তদের দেখার জন্য মন্দির খোলা হয়।  আমার খুব পরিচিত শেওড়াফুলি রাজবংশের সদস্য শ্রী আশীষ রায় মহাশয় রুপোর ছাতা ঠাকুরের মাথায় ধরার জন্য প্রতিবছরের  ন্যায় এবছরেও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর এই ছবি দেখে বছর তিনেক আগে আমার দেখা মাহেশের রথযাত্রার কথা মনে পড়ছিল। আজ তার কিছু স্মৃতিকথা বলার চেষ্টা করছি। 

রথযাত্রা মানে উৎসব। রথযাত্রার কথা বললে সবাই আগে পুরীর রথযাত্রাকে মনে করে।  ওড়িশার মতো বাংলায় এই রথযাত্রা খুবই প্রাচীন উৎসব।  হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ বাংলার সবচেয়ে প্ৰাচীন রথ উৎসব।  শোনা যায় কমলাকার পিপিলাই ১৫৩৩ সালে এখানকার জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইত হন এবং তিনি নাকি প্রায় পাঁচ শত বছর পূর্বে প্রথম রথ উৎসবটি শুরু করেছিলেন। আষাঢ় মাসের শুক্লা পক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। সনাতন হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান উৎসব হল এই রথযাত্রা উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বর্তমানে এই উৎসব এক মিলনোৎসবে পরিণত হয়েছে।  এইদিন জগন্নাথ তাঁর ভাই বলরাম আর বোন সুভদ্রাকে নিয়ে মাসির বাড়ি যান। সাত দিন পরে অর্থাৎ উল্টোরথের দিন তাঁরা সকলে মাসি বাড়ি থেকে ফিরে আসেন।  এই উৎসব নিয়ে নানারকম পৌরাণিক গল্প রয়েছে, আজ আমি সেই গল্পের উপস্থাপন করে লেখাটিকে দীর্ঘায়িত করবো না।  আজ শুধু আমার স্মৃতিকথাই  আপনাদের জানাবো।

২০১৬ সালে রথের দিন সকালে বাজারে আমার বন্ধু  শঙ্করের সাথে দেখা হল।  দেখা হওয়ার পর ও মহেশের রথ দেখতে যেতে বলল।  আমি ওর কথায়  রাজি হয়ে গেলাম।  সকাল ১১টা  নাগাদ দুজনে যাত্রা শুরু করলাম।  সাড়ে বারোটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই শ্রীরামপুর যাওয়ার একটা ট্রেনও পেয়ে গেলাম। আধ ঘন্টার মধ্যে শ্রীরামপুরে পৌঁছে গেলাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু চা খেয়ে একটা অটো রিক্সা ধরে মাহেশে এলাম।  তখনও  রথের সাজগোছ চলছে। চারদিকে লোকে লোকারন্য।  অল্প সময়ের মধ্যেই রথ সাজানো শেষ হয়ে গেলো। ওখানকার সাংসদ শ্রী কল্যাণ ব্যানার্জী মহাশয় রথের দড়ি টেনে যাত্রার উদ্বোধন করলেন। একবার  উড়িষ্যার পুরীর রথ উৎসব দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।  এখানেও দেখলাম প্রায় সেরকম লোকের ভিড়, ঠ্যালা-ঠেলি চলছিল। মাঝে মাঝে দড়ির প্রাচীর গড়ে লোকের ভীড়কে সামাল দেওয়া হচ্ছিল। লোকের ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে যাচ্ছিল। কিছু করার ছিল না, এভাবেই এই নিয়ম মেনেই সবাইকে রথ দেখতে হচ্ছিলো। আমরাও এই ভাবেই নিয়ম মেনে রথের সাথে এগিয়ে চলতে থাকলাম। রথের কাছাকাছি পৌঁছানোর কোনো সুযোগ নেই। ভীড়ের কাছে হার মানতে হলো আমাদের। রথের ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারলাম না। রথের দড়িও টানা হলো না।  সুউচ্চ রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা বিরাজ করছেন।  অপরূপভাবে রথটিকে সাজানো হয়েছে। রথে উপবিষ্ট পুরোহিতরা মাঝে মাঝে বাতাসা ছুড়ে দিচ্ছিলেন ভক্তদের উদ্দেশ্যে।  আমাদের ভাগ্যেও একটা বাতাসা জুটে গিয়েছিল।   এইভাবে চলতে চলতে রাস্তার ধারে নির্মীয়মান একটা বাড়ির দোতলায় উঠে সব কিছু দেখছিলাম। জি টি রোড ধরে  প্রায় এক  কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে মাসির বাড়ি পৌঁছলো। রথের সমস্ত পরিক্রমাটা বেশ ভালোভাবে দেখলাম। বেশ ভালোই লাগলো।  এবার একটু মেলাটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম।  খুবই ছোট্ট মেলা।  রাস্তার দুধারে নানারকম সরঞ্জাম নিয়ে দোকান করা হয়েছে। খেলনা, জামাকাপড়, গৃহস্থালী সামগ্রী আর প্রচুর পাঁপড়, ফুচকা ও জিলিপির দোকান রয়েছে দেখলাম। রাস্তার ধারে বেলুন বিক্রি হচ্ছে, বাচ্ছাদের বায়না মেটাতে অভিভাকরা কিনছেন।   মেলাটা দিন সাতেক চলে। উল্টোরথের পর আর কারোকে বসতে দেওয়া হয় না। আমরাও প্রথমে গরম গরম জিলিপি ও পরে পাঁপড়ভাজা খেলাম।  বেশ কিছুক্ষন ঘুরে ঘুরে সমগ্র মেলাটা উপভোগ করলাম। মেলা দেখে একটু ফাঁকা জায়গায় একটা চায়ের দোকানে চা খেতে ঢুকলাম। বেশ বয়স্ক ও অভিজ্ঞ দোকানদারকে দেখে মেলার ইতিহাস জানার লোভ সামলাতে পারলাম না। ওনার নাম বললেন গোবিন্দ সরকার। ওনার কাছে ইতিহাস জানতে চাইতে উনি বেশ আনন্দ সহকারে সব কিছু জানাতে আরম্ভ করলেন।

জনৈক বাঙালি সাধু ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী চতুর্দশ শতকের কোনো এক সময় পুরীতে জগন্নাথ দর্শনের জন্য গিয়েছিলেন। জগন্নাথদেবকে দেখে তিনি খুবই প্রীত হয়েছিলেন।  তিনি মাহেশের গঙ্গার ধারে জগন্নাথ,  বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ একটা ছোট্ট কুটিরে স্থাপন করেন।  শেওড়াফুলির জমিদার শ্রী মনোহর রায় পরবর্তীকালে ওই স্থানে একটা মন্দির নির্মাণ করে দেন।  জমিদারের নির্মিত মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়লে কলকাতার নিমাইচাঁদ মল্লিকের  সহায়তায় ১৭৫৫ সালে একটা নতুন মন্দির তৈরী করা হয়। গোবিন্দবাবু বললেন জগন্নাথ মন্দিরের সাথে যেমন  কলকাতার নাম জড়িয়ে আছে ঠিক এখানকার রথের সাথেও কলকাতার নাম জড়িয়ে আছে। মাহেশের প্রথম রথটি কলকাতার জনৈক ব্যক্তি তৈরী করে দিয়েছিলেন।  তাঁর নামটা উনি মনে  পারলেন না।  এই রথটা জীর্ণ হয়ে যাওয়ায় কলকাতার কৃষ্ণরাম বসু পঞ্চচূড়াবিশিষ্ট একটা কাঠের রথ তৈরী করে দিয়েছিলেন।  ১৮৮৪ সালে ওই রথটি এক  বিভৎস্য অগ্নিকান্ডে সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। এই ঘটনায় শহরবাসীরা খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। কলকাতার কৃষ্ণচন্দ্র বসু, যিনি সেইসময় হুগলির দেওয়ান ছিলেন, তিনি এক লক্ষ টাকা ব্যয় করে মার্টিন বার্ন কোম্পানিকে দিয়ে সম্পূর্ণ লোহার তৈরী একটা রথ শ্রীরামপুরবাসীদের উপহার দিলেন।  ৫০ ফুট উচ্চতার রথটির ওজন প্রায় ১২৫ টন ও রথটিতে ১২টি চাকা রয়েছে। সেই রথ আজও চলছে। প্রতিবছর নিয়ম করে রথটিকে মেরামত এবং রঙ করা হয়। তিনি আরো জানালেন এই রথ দেখতে নাকি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব , মা সারদা দেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পদধূলি  মাহেশে পড়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "রাধারানী"  এখানকার মেলার পেক্ষাপটে লিখেছিলেন। গোবিন্দবাবু বলছিলেন এই রথকে কেন্দ্র করে সেকালে যেমন  উৎসাহ ছিল একালেও সমানভাবে  রয়ে গেছে। প্রতিবছর কত দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এই রথ দেখতে আসে। শুধু তাই নয় আমি অনেক বিদেশিকেও এই রথ দর্শনে আসতে দেখেছি। মাহেশ এখন আর গ্রাম নয়, শহর। ঐতিহ্যে এই রথের মেলা  যতটা প্রাচীন বর্তমানে আয়তনে ততটাই ছোট।  গোবিন্দবাবু বলছিলেন আগে এই মেলা বিরাট আকারে হতো, এখন নগরায়নের চাপে স্থান সংকুলানের  জন্য তা  দিনকে দিনকে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ওনাকে প্রণাম জানিয়ে আমরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম।

মাহেশের পর বাংলায় পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথযাত্রা খুব প্রাচীন রথ উৎসব।এছাড়া বর্ধমানের গুপ্তিপাড়া, কলকাতার ইস্কনের রথও খুব জনপ্রিয় রথ উৎসব। কিছুটা  হেঁটে  রিষড়া স্টেশান যাওয়ার জন্য একটা রিক্সা ঠিক করলাম। রিষড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে হাওড়া এলাম।




ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২৩-০৬-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০



 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




No comments:

Post a Comment