Sudipta Mukherjee's Blog

Monday, June 3, 2019

স্মরণিকায় কিছুক্ষন >

 কলকাতা 

স্মরণিকায় কিছুক্ষন........

স্মরণিকা মিউজিয়াম 
ট্রাম এই নামটার সাথে জড়িয়ে আছে শহরবাসীর নানারকম স্মরণীয় মুহূর্তের কত কথা।  আমাদের শহরের সাথে ট্রামের একটা নাড়ির টান রয়ে গেছে, এ যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। "চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন" - এরকম কত গানে বা কবিতায় ট্রামকে নিয়ে কত ভালোলাগার কথা সেই ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি । বাস্তবেও এই ধীর গতির ট্রাম শুধু একটা পরিবহনের বস্তু নয়, এ তিলোত্তমার এক আবেগ। ট্রাম ছাড়া আমাদের শহরকে ভাবা যায় না। শহরের ঐতিহ্যের সাথে যানটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বের অনেকগুলো শহরেই ট্রাম চলাচল করত। যা আজ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন  ও  মাত্র দু একটি শহরে চলতে দেখা যায়।  আমাদের শহরে ২৪শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৭৩ সালে সর্বপ্রথম ট্রাম পরিষেবা চালু করা হয়। আর্মেনিয়ান ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত প্রথম ট্রামটি চালানো হয়েছিল। প্রথম ট্রামটি ঘোড়ায় টানা ট্রাম ছিল।  এটাই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ট্রাম পরিষেবা ছিল। কিছুদিন পরে এই পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১লা নভেম্বর, ১৮৮০ সালে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপন আবার ট্রাম যাত্রার  উদ্বোধন করেন। এরপর "ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি" নামে  একটি সংস্থা তৈরী করা হয়।  এই সংস্থা তখন থেকেই কলকাতাতে  ট্রাম চালানোর দায়িত্ব নেয়। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ট্রামের  কোম্পানিটিকে অধিগ্রহণ করে। প্রথমদিকে ঘোড়ায় টানা ট্রাম বেশ কিছু বছর চালানো হয়েছিল  পরবর্তীকালে স্টিম ইঞ্জিনের মাধ্যমে ট্রামকে চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। ১৯০২ সালে ট্রামকে বৈদ্যুতিকরণ করা হয়। এটাই এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা ছিল।

গত ৩১শে মে গ্রীষ্মের এক তপ্ত দগ্ধ দুপুরে খিদিরপুর অঞ্চলে একটা কাজের জন্য যাই। কাজটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যাওয়ায় হাতে অঢেল সময় উৎবিত্ত হয়ে যায়।  মনটাও বাড়ি ফিরে আসতে  চাইছিল না। বাস স্টপেজে এসে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়।  সামনে দিয়ে একটা ট্রাম চলে গেলো। সেই ট্রাম দেখে আমার  ট্রাম চড়ার শখ জন্মালো। বহুকাল ট্রাম  চড়া হয়নি। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর সুন্দর চাকচিক্য মার্কা একটা ট্রাম এল।  ট্রামটি ধর্মতলাতে যাচ্ছে। দেরী  না করে ট্রামটির প্রথম কামরাতে উঠে পড়লাম। জানলার ধারে একটা বসার সিটও মিলে গেলো। ব্রিজ পাড় করে গড়ের মাঠের সবুজকে চিড়ে দুরক্ত গতিতে ট্রামটি চলছিল। এই রাস্তায় ট্রামে করে গেলে "ধীর গতির যান" এই কথাটা ভুলে যেতে হবে। বাঁদিকে সুন্দর রাস্তা আর ডানদিকে সবুজ মাঠ। মাঠে বাচ্ছা ও  যুবকদের ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম, বেশ উপভোগও করছিলাম। মাঝে মাঝে কন্ডাক্টারের বেলের টুং টুং শব্দের আওয়াজে  মনটাও ভরিয়ে তুলছিল। এইভাবেই চলতে চলতে ট্রাম ধর্মতলাতে এসে পৌঁছল। ট্রাম থেকে নেমে পড়লাম।  মনটা  তখন একটু চা চা করে ডাক পাড়ছিল।  চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম, কিছুটা এগোনোর পরই  হঠাৎ করে রাস্তায় আমার এক পুরোনো স্কুলের বন্ধু শুভাশিসের  সাথে দেখা হয়ে গেলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। আমি ওকে বললাম চল একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে কথা  বলি। শুভাশিস আমায় বললো এখানকার কোনো চায়ের দোকানের চা খেয়ে মন ভরবে না।  বরঞ্চ চল স্বরণিকাতে যাই। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল স্মরণিকা হয়তো কোনো রেস্টুরেন্ট  হবে। পৌঁছে দেখলাম ও আমায় ট্রামের মিউজিয়ামে নিয়ে এসেছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এরকম একটা ক্যাফেটেরিয়া সমেত ট্রামের মিউজিয়াম আছে বলে  আমার জানা ছিল না। স্মরণীয় যানের সংগ্রহশালার নাম "স্মরণিকা" আমার মনে হলো একদম সার্থক নামকরণ। যাই হোক ২০ টাকা দিয়ে ও দুটো টিকিট কাটলো। টিকিট দেখিয়ে আমরা একটা বাতানুকূল দু-কামরার ট্রামের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তপ্ত গরম থেকে এসে এই বাতানুকূল পরিবেশ মন্দ লাগছিল না।

এক কামরা বাতানুকুল ট্রাম 
ধর্মতলা ট্রাম ডিপোর সাথেই  ট্রামের দুটি কামরাকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই মিউজিমটিকে। ভিতরে প্রবেশ করার পর দেখলাম প্রথম কামরাটিতে  একটা ক্যাফেটেরিয়া  আর দ্বিতীয় কামরাটিতে একটা মিউজিয়াম তৈরী করা হয়েছে। প্রথম কামরার ক্যাফেটেরিয়াতে অনেকগুলো বসার জায়গা রয়েছে, বেশিরভাগ জায়গাতেই অনেকে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমরাও একটা বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। ক্যাফেটেরিয়াতে বিস্কুট, চিপস ও কফি পাওয়া যায়।  আমরা একটা চিপসের প্যাকেট ও দুটো কফির অর্ডার দিলাম।  কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। বেশ কিছুক্ষন আমি আর শুভাশিস কফি খেতে খেতে নানারকম সুখ-দুঃখের গল্প করছিলাম। কফি খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর আমরা দ্বিতীয় কামরায় মিউজিয়ামটি দেখতে
প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম 
গেলাম।  ট্রামের ইতিহাসকে খুব সুন্দর করে  এখানে দেখানো হয়েছে নানারকম আলোকচিত্রের মাধ্যমে। পুরোনো কলকাতা ও ট্রামের বিবর্তন সবটাই এইসব আলোকচিত্রের বিষয়বস্তু। নীচের দিকে ছোট ছোট কাঁচের বাক্সের মধ্যে ট্রাম গাড়ির বিবর্তনের রেপ্লিকা করে রাখা আছে।  এছাড়া পণ্য পরিবহন ট্রামের রেপ্লিকাও আছে। ট্রামের জন্মলগ্ন থেকে ব্যৱহৃত  বিভিন্ন রকমের মুদ্রা ও টিকিট রাখা আছে। ট্রাম কোম্পানির কোষাগারে রাখা স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তরকালের ব্যৱহৃত টিকিট ও আনা পয়সা, টাকা, নয়া পয়সার বাতিল করা নমুনা এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। ট্রাম কোম্পানিতে ব্যৱহৃত ডোবানো নিবের কলম, ফাউন্টেন পেন , কাঁচের কলম ও দোয়াতদানও রাখা আছে।  ১৯২০ সালে ট্রাম কোম্পানি বাস চালু করেছিল। বাসগুলো সবই ট্রনিক্রফ্ট এন্ড কোম্পানির তৈরী ছিল।  ১৯২৫ সাল পর্যন্ত এই বাস পরিষেবা চালু ছিল।  সেই বাসের  একটা নমুনা মডেল হিসেবে রাখা আছে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ টিকিট নানা সময় ব্যৱহৃত হয়েছিল যেমন দৈনিক টিকিট, মাসিক টিকিট ও তার হোল্ডার, ছাত্রদের জন্য
 বিভিন্ন রকমের ব্যাজ 
বিশেষ ছাড়ের কুপন, খুচরোর পরিবর্তে ডিউ  কুপন ইত্যাদির নমুনা প্রদর্শিত হয়েছে। দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে কন্ডাক্টরদের টুপি, বাহুবন্ধ, ব্যাজ, বেল্ট ইত্যাদি। এগুলো দেখতে দেখতে পড়ন্ত বিকেলে আমি কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে পড়ছিলাম। মনের জানালা দিয়ে পুরোনো স্মৃতিগুলো উঁকি দিচ্ছিল।

বাঙালির নস্টালজিক আবেগটাকেই ট্রাম কোম্পানি তুরুপের তাস করেছে। শুনলাম এই মিউজিয়ামে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭৫ থেকে ১০০ জন দর্শক   আসে। কোম্পানি এই জাদুঘরটিকে আয়তনে ও বৈচিত্রে আরো বাড়াবার পরিকল্পনা করছে। ট্রাম তো শুধু আবেগ নয়, বাঙালির অহংকার, তিলোত্তমার গর্ব। এখানে এসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ইতিহাসের সঙ্গে কিছু মুহূর্ত কাটাতে মন্দ লাগলো না।


সময়সূচি ও টিকিট :
বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিকটা দিন মিউজিয়াম খোলা থাকে দুপুর ১টা থেকে রাত  ৮টা পর্যন্ত।  টিকিটের মূল্য ১০ টাকা জন প্রতি।

ঠিকানা :
৬ নং সিদু কানু ডহর, ধর্মতলা, কলকাতা ৭০০ ০৬৯

কিভাবে যাবেন :
যেকোনো গাড়ি ধরে ধর্মতলায় চলে আসুন।  ধর্মতলা ট্রাম ডিপোর মধ্যেই এই সুন্দর মিউজিয়ামটি রয়েছে।

কিছু তথ্য :
এখানে কোনো ক্যামেরা ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না, তবে আপনি আপনার মোবাইলের ক্যামেরা ব্যবহার করে ছবি তুলতে পারবেন।  মোবাইল ব্যবহারের উপর কোনো বাঁধা নিষেধ নেই।  এখানকার ক্যাফেটেরিয়াতে শুধু চা, কফি, বিস্কুট ও চিপস কিনতে পারবেন, অন্য কিছু এখানে পাওয়া যায় না। খাবার সামগ্রীগুলো পয়সা দিয়ে কিনতে হবে।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০৩-০৬-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


No comments:

Post a Comment