সেদিন মলয়ের দোকানে একটু আড্ডা মারার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। মলয় মানে আমার বন্ধু মলয় সোম। আড্ডা দিতে দিতে ও হঠাৎ বললো ভালোপাহাড় যাবে নাকি, আমি ২০ তারিখে যাচ্ছি। তখন ভালোপাহাড় সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা ছিল না। মলয় জানালো পাহাড় বলতে আমাদের যা ধারণা তার সাথে এখানে কোনো মিল নেই, এটা একটা ম্যান মেড অরণ্য। তবে ছোট ছোট পাহাড়তো অবশ্যই দেখতে পাবে। পাহাড় ও অরণ্যের মাঝে মানুষের তৈরী আর এক অরণ্য। এই সামান্য কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম। যাই হোক ২০ তারিখে সকাল ৭ টায় ইস্পাত এক্সপ্রেসএ টিকিট কাটা হলো। মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন কিলবিল করতে লাগলো ভালোপাহাড়টা কে বা কারা তৈরী করেছে, কোথায় এর অবস্থান। সেই মানুষটার বা মানুষগুলোর নামই বা কি? মলয় কোনোটারই উত্তর দিতে রাজি হলো না, বললো আগে থেকে সব বলে দেওয়া যাবে না, ওখানে গিয়ে সব কিছু চাক্ষুষ করে মজা উপভোগ করবে। মনে মনে বললাম তবে তাই হোক।
পরের রবিবার ২০ তারিখে ইস্পাত এক্সপ্রসে টিকিট কাটা হল। যথারীতি ২০ তারিখ সকাল ৬ টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ট্রেন প্রায় দেড় ঘন্টা দেরিতে ছাড়লো। আমরা ১২টা নাগাদ গালুডি স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ওখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভালোপাহাড়। অটো রিক্সা বলা ছিল। দীপকের অটো করে মিনিট ৪৫-এর মধ্যে আমরা ভালোপাহাড়ে পৌঁছে গেলাম।
পরের রবিবার ২০ তারিখে ইস্পাত এক্সপ্রসে টিকিট কাটা হল। যথারীতি ২০ তারিখ সকাল ৬ টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ট্রেন প্রায় দেড় ঘন্টা দেরিতে ছাড়লো। আমরা ১২টা নাগাদ গালুডি স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ওখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভালোপাহাড়। অটো রিক্সা বলা ছিল। দীপকের অটো করে মিনিট ৪৫-এর মধ্যে আমরা ভালোপাহাড়ে পৌঁছে গেলাম।
শ্রদ্ধেয় শ্রী কমল চক্রবর্তী |
ওখানে পৌঁছে দেখলাম রাস্তার ধারে বিশাল একটা লোহার দরজা, দরজার ওপরে বড় বড় হরফে "ভালোপাহাড়" কথাটা লেখা আছে, গেটের পাশের দেওয়ালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্যাসাগরের বাণী লেখা রয়েছে। ভিতরে ঢুকে কি দেখবো তাই নিয়ে আমার মনটা ছটফট করছে। ভিতরে ঢুকে সবুজ অরণ্য দেখে মনটা স্নিগ্ধ ও শান্ত হয়ে গেলো। ভালোপাহাড় হলো পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ানে অবস্থিত একটা সোসাইটি। এক পঞ্চপাণ্ডবের সোসাইটি। যাদের মূলমন্ত্র প্রচুর গাছ লাগানো ও মানব সেবা। ভিতরে গিয়ে আলাপ হল এক বিশাল মজার মানুষ বৃক্ষের পূজারী শ্রদ্ধেয় শ্রী কমল চক্রবর্তী মহাশয়ের সঙ্গে। প্রথম আলাপেই কথার ভাঁজে উনি আমাদের মাতিয়ে দিলেন ।
![]() |
বাচ্ছারা স্কুলে যাচ্ছে |
ভালোপাহাড় সম্বন্ধে জানতে হলে বছর পঁচিশ আগে ফিরে যেতে হবে। সালটা ছিল ১৯৯৬। পাঁচ বন্ধু মিলে তখন টাটা বাবাজির শহরে বসে সাহিত্য চর্চা করতেন। "কৌরব" নামে একটা বাংলা পত্রিকা চালাচ্ছিলেন। সবাই তখন বেকার। আড্ডা, কবিতা, গল্প, নাটক, গান ও বিখ্যাত সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য সভা করতেন। ১৯৬৮ সাল নাগাদ কমল চক্রবর্তী, সুভাষ ভট্টাচার্য, অরুন আইন, শক্তিপদ হালদার ও বারীন ঘোষাল জামশেদপুরের এই পাঁচজন একত্রিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দেবজ্যোতি দত্ত এঁদের সাথে যুক্ত হন। এরা সেই সময় কবিসঙ্গ লাভ ও প্রকৃতিকে দেখার জন্য সারা পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন। শান্তিনিকেতনের পান্নালাল দাসগুপ্তের তৈরী "টেগোরে সোসাইটি" দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, পঞ্চপাণ্ডবের মাথায় তখন কিছু একটা করার জন্য বাসনা জাগলো। ঠিক করলেন কিছু একটা করতেই হবে। ১৯৭১ সালে তারা প্রথম কৌরব নামে পত্রিকাটি বের করেছিলেন, যা আজও চলে আসছে।
![]() |
ভালোপাহাড়ের পিছনের দৃশ্য |
এই পঞ্চপান্ডবের দল একটা ভালো জমি কিনতে চান, যেখানে চাষ বাস করা যাবে। তাঁদের পরিচিত শচীন দত্ত মহাশয় জানালেন জামশেদপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বান্দোয়ানে ৪০ বিঘা জমি তাঁর রয়েছে যেটা তিনি বিক্রি করতে চান। জমিটি বড় রাস্তার ধারে অনাবাদি পাথুরে জমি। জমিটি তাঁদের পছন্দও না হলেও তাঁরা কষ্ট করে জমিটি কিনলেন। ১৯৯৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর "ভালোপাহাড়" নাম দিয়ে একটা সোসাইটি গঠন করা হলো। সেই থেকে দলমা ও রুমাই পাহাড়ের পাদদেশে ভালোপাহাড়ের চলা শুরু হল। "ভালোপাহাড়" আসলে একটা নন-প্রফিট এনজিও। পরবর্তীকালে তাঁরা আরো প্রায় ৮০ - ৯০ বিঘে জমি কেনে।
![]() |
ধানক্ষেত |
পুরুলিয়ার রুক্ষ - পাথুরে ভূমিকে অনেক কষ্ট করে পাথর কেটে জমির মাটি বের করে গাছ লাগানো হয়েছিল। বর্তমানে যেন এক সবুজ মন্দির, যেখানে বাস করে বৃক্ষনাথ, আর বৃক্ষের পূজারীরা। এক স্বাধীন বাঁধনহারা অরণ্য যেখানে গাছেদের লম্বা লম্বা হাত যেন জড়িয়ে ধরে। চারদিকে প্রচুর গাছ। কয়েক লক্ষ গাছ হবে। বর্ষার শেষে ডালে ডালে কচি পাতার ঝালর। জানা ও অজানা কতরকম ফুলে ভর্তি। গঙ্গাফড়িং লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। গাছে গাছে নানারকম পাখির দল খেলে বেড়াচ্ছে। পাতি হাঁস, রাজ হাঁস ও মুরগিও খেলে বেড়াচ্ছে। সূর্যদেবতা পাটে গেলে একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া খেলে বেড়ায়।
![]() |
গোয়াল ঘর |
![]() |
খাবার জায়গা |
![]() |
রান্নাঘর |
সবুজায়ন প্রধান হলেও এখানে দু-একদিন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে রান্না করা হয়ে থাকে খোলা উনুনে কাঠের আগুনে। রান্নাও সম্পূর্ণ ঘরোয়া পদ্ধতিতে করা হয়, কোনোপ্রকার আড়ম্বর এখানে দেখা যায় না। থাকার জন্য চার-পাঁচটি ঘর রয়েছে। ঘরগুলো খুবই সুন্দর। এদের নিজস্ব সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার দিলীপ মাহাতো, প্রদীপ পাত্র, দীপক দত্ত, শিবু তন্তুবায়, জয়তীদেবী ও দেবেনের ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। সবাই সদা হাস্যময়, সেবায় সবসময় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে।
![]() |
টটকো বাঁধে সূর্য্যাস্ত |
জয় বৃক্ষনাথের জয়
কিভাবে যাবেন :
সকলের ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরে গালুডি স্টেশনে এসে নামুন। ওখান থেকে ভালোপাহাড় যাওয়ার অটো পেয়ে যাবেন। তবেএখানে থাকতে হলে আগে থেকে নীচের ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করে আসতে হবে, না হলে থাকার জন্য কোনো ঘর পাওয়া যাবে না।
ঠিকানা :
কমল চক্রবর্তী , "ভালোপাহাড়", কুঁচিয়া, বান্দোয়ান, পুরুলিয়া, পিন ৭২৩১২৯
ফোন নাম্বার :
৯৪৭৪৪৬২২৩৮ এবং ৯৪৩১১৮৬২৫০
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ :২৩-১০-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment