Sudipta Mukherjee's Blog

Wednesday, October 23, 2019

ভালোপাহাড় >

ভালোপাহাড়  
রূপকথা না বাস্তব  





প্রবেশ দ্বার 

সেদিন মলয়ের দোকানে একটু আড্ডা মারার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। মলয় মানে আমার বন্ধু  মলয় সোম।  আড্ডা দিতে দিতে ও হঠাৎ বললো ভালোপাহাড় যাবে নাকি, আমি ২০ তারিখে যাচ্ছি। তখন ভালোপাহাড় সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা ছিল না। মলয় জানালো পাহাড় বলতে আমাদের যা ধারণা তার সাথে এখানে কোনো মিল নেই, এটা একটা ম্যান মেড অরণ্য। তবে ছোট ছোট পাহাড়তো অবশ্যই দেখতে পাবে। পাহাড় ও অরণ্যের মাঝে মানুষের তৈরী আর এক অরণ্য।  এই সামান্য কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম। যাই হোক ২০ তারিখে সকাল ৭ টায় ইস্পাত  এক্সপ্রেসএ টিকিট কাটা হলো। মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন কিলবিল করতে লাগলো ভালোপাহাড়টা কে বা কারা তৈরী করেছে, কোথায় এর অবস্থান। সেই মানুষটার বা মানুষগুলোর নামই বা  কি? মলয় কোনোটারই উত্তর দিতে রাজি হলো না, বললো আগে থেকে সব বলে দেওয়া যাবে না, ওখানে গিয়ে সব কিছু চাক্ষুষ করে মজা উপভোগ করবে। মনে মনে বললাম তবে তাই হোক।

পরের রবিবার ২০ তারিখে ইস্পাত এক্সপ্রসে টিকিট কাটা হল। যথারীতি ২০ তারিখ সকাল ৬ টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।  ট্রেন প্রায় দেড় ঘন্টা দেরিতে ছাড়লো।  আমরা ১২টা  নাগাদ গালুডি স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।  ওখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভালোপাহাড়।  অটো রিক্সা বলা ছিল। দীপকের অটো করে মিনিট ৪৫-এর মধ্যে আমরা ভালোপাহাড়ে পৌঁছে গেলাম।

শ্রদ্ধেয় শ্রী কমল চক্রবর্তী 

ওখানে পৌঁছে দেখলাম রাস্তার ধারে বিশাল একটা লোহার দরজা, দরজার ওপরে বড় বড় হরফে "ভালোপাহাড়" কথাটা লেখা আছে, গেটের পাশের দেওয়ালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  ও বিদ্যাসাগরের বাণী লেখা রয়েছে। ভিতরে  ঢুকে কি দেখবো তাই নিয়ে আমার মনটা ছটফট করছে। ভিতরে ঢুকে সবুজ অরণ্য দেখে মনটা স্নিগ্ধ ও শান্ত হয়ে গেলো।  ভালোপাহাড় হলো পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ানে অবস্থিত একটা সোসাইটি। এক পঞ্চপাণ্ডবের সোসাইটি। যাদের মূলমন্ত্র প্রচুর গাছ লাগানো ও মানব সেবা। ভিতরে গিয়ে আলাপ হল এক বিশাল মজার মানুষ বৃক্ষের পূজারী শ্রদ্ধেয় শ্রী কমল চক্রবর্তী   মহাশয়ের সঙ্গে।  প্রথম আলাপেই কথার ভাঁজে  উনি আমাদের মাতিয়ে দিলেন ।


বাচ্ছারা স্কুলে যাচ্ছে 

ভালোপাহাড় সম্বন্ধে জানতে হলে বছর পঁচিশ আগে ফিরে যেতে হবে।  সালটা ছিল ১৯৯৬।  পাঁচ বন্ধু মিলে  তখন টাটা বাবাজির শহরে বসে সাহিত্য চর্চা করতেন। "কৌরব" নামে  একটা বাংলা পত্রিকা চালাচ্ছিলেন। সবাই তখন বেকার। আড্ডা, কবিতা, গল্প, নাটক, গান ও বিখ্যাত সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য সভা করতেন। ১৯৬৮ সাল  নাগাদ কমল চক্রবর্তী, সুভাষ ভট্টাচার্য, অরুন আইন, শক্তিপদ হালদার ও বারীন ঘোষাল জামশেদপুরের এই পাঁচজন একত্রিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দেবজ্যোতি দত্ত এঁদের সাথে যুক্ত হন। এরা সেই সময় কবিসঙ্গ লাভ ও প্রকৃতিকে দেখার জন্য সারা পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন।  শান্তিনিকেতনের পান্নালাল দাসগুপ্তের তৈরী "টেগোরে সোসাইটি" দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, পঞ্চপাণ্ডবের  মাথায় তখন  কিছু একটা করার জন্য বাসনা জাগলো।  ঠিক করলেন কিছু একটা করতেই  হবে। ১৯৭১ সালে তারা প্রথম কৌরব নামে পত্রিকাটি বের করেছিলেন, যা আজও চলে আসছে।

ভালোপাহাড়ের পিছনের দৃশ্য 

এই পঞ্চপান্ডবের দল একটা ভালো জমি কিনতে চান, যেখানে চাষ বাস করা যাবে।  তাঁদের পরিচিত শচীন দত্ত মহাশয় জানালেন জামশেদপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বান্দোয়ানে  ৪০ বিঘা জমি তাঁর রয়েছে যেটা তিনি বিক্রি করতে চান।  জমিটি বড় রাস্তার ধারে অনাবাদি পাথুরে জমি।  জমিটি তাঁদের পছন্দও না হলেও তাঁরা কষ্ট করে জমিটি কিনলেন। ১৯৯৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর "ভালোপাহাড়" নাম দিয়ে একটা সোসাইটি গঠন করা হলো। সেই থেকে দলমা  ও রুমাই পাহাড়ের পাদদেশে ভালোপাহাড়ের চলা শুরু হল। "ভালোপাহাড়" আসলে একটা নন-প্রফিট এনজিও। পরবর্তীকালে তাঁরা  আরো  প্রায়  ৮০ - ৯০ বিঘে জমি কেনে।

ধানক্ষেত 

পুরুলিয়ার রুক্ষ - পাথুরে ভূমিকে  অনেক কষ্ট করে পাথর কেটে জমির মাটি বের করে গাছ লাগানো হয়েছিল। বর্তমানে যেন এক সবুজ মন্দির, যেখানে বাস করে বৃক্ষনাথ, আর বৃক্ষের পূজারীরা। এক স্বাধীন বাঁধনহারা  অরণ্য যেখানে গাছেদের  লম্বা লম্বা হাত যেন জড়িয়ে ধরে।   চারদিকে প্রচুর গাছ। কয়েক লক্ষ গাছ হবে। বর্ষার শেষে  ডালে ডালে কচি পাতার ঝালর। জানা ও অজানা কতরকম  ফুলে ভর্তি।  গঙ্গাফড়িং লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।  গাছে গাছে নানারকম পাখির দল  খেলে বেড়াচ্ছে।  পাতি হাঁস, রাজ হাঁস ও মুরগিও খেলে বেড়াচ্ছে। সূর্যদেবতা পাটে  গেলে একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া খেলে বেড়ায়। 

গোয়াল ঘর 

চারদিকে একটা জমজমাট নিঃশব্ধতা বজায় রয়েছে। গাছের পাতায় পাতায় শুধু জোনাকির আলো মিটিমিটি করে জ্বলছে। বৃক্ষগুলো জোনাকির আলোতে যেন  জলসার আসর বসিয়েছে। হওয়ার দোলায় তাদের মৃদুমন্দ আওয়াজ মন ভরিয়ে তুলছে।  এ যেন বৃক্ষ দেবতা, বৃক্ষনাথের মন্দির। দিব্য দর্শনে অনুভব করা  বৃক্ষনাথের শোভা। ঘুম ভাঙতে ভোরের আলোতে পাখিদের গান মনে উদ্দীপনা তৈরী করে দিল। সোনাঝুরি, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অশ্বত্থ, বট, শাল, সেগুন, শিমুল, গামার, তেতুল, কাঁঠাল, রুদ্রাক্ষ, চেরি, আপেল, আমলকি, আমড়া, চালতা, কারিপাতা এরকম কত শত বড় বড় সব গাছ রয়েছে। কয়েক বিঘে জমিতে চাষের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে  প্রায় ২৮ রকমের দেশীয় ধান চাষ করা হয়, যেগুলো আজ প্রায় অবলুপ্ত। তাছাড়া বহু রকমের সবজি চাষ করা হয়। এইসব চাষে কোনোরকম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না, সম্পূর্ণ জৈব সার ব্যবহার করে চাষ-আবাদ করা হয়।  গোয়াল ঘরে প্রায় ৪০ টা দেশি গরু রয়েছে ।  জল ধরে রাখার জন্য একটা কয়েক বিঘের  পুকুর কাটা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদিত একটা বাচ্ছাদের স্কুল রয়েছে। স্কুলটি ২০০৪ সালে তৈরী করা হয়।   এই স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত আদিবাসীদের গ্রামগুলো থেকে বাচ্ছারা এখানে পড়তে আসে।  স্কুলে প্রায় ২০০ টি বাচ্ছা  নিয়মিত লেখা-পড়া করে। বাচ্ছাদের শিক্ষার মধ্যে নিজেদের সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে চেনানোও এদের শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে রয়েছে।  বাচ্ছাদের স্কুলে আনা নেয়ার জন্য দুটো স্কুল বাস রয়েছে।  স্কুলে পাঁচজন মাস্টারমশাই রয়েছেন।  মাস্টারমশাই  ও বাচ্ছাদের জন্য নিয়মিত দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। হলুদ - মেরুন ইউনিফর্মে বাচ্ছাগুলো যখন দল বেঁধে স্কুলে আসে, তখন দেখতে  খুব সুন্দর লাগে। বাচ্ছাগুলোর মধ্যে দেখলাম খুবই শেখার অগ্রহ রয়েছে। স্কুলে খুবই ডিসিপ্লিন বজায় আছে। শুনলাম কোনো এক বছরে এই স্কুলটা সামগ্রিক বিচারে পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিরোপা পেয়েছিল। এছাড়া কমিউনিটি ডেভেলপমেনন্টের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। গ্রামের বহু গরিবদের বিনামূল্যে জামা-কাপড় ও কম্বল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।   ২০০৬ সালে একটা দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। দু-একজন দক্ষ চিকিৎসক নিয়মিত চিকিৎসা করে থাকেন।  গ্রামের হতদরিদ্র্যদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। সল্পমূল্যে ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে।

খাবার জায়গা 
রান্নাঘর 

সবুজায়ন প্রধান হলেও এখানে  দু-একদিন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।  এখানে রান্না করা হয়ে থাকে খোলা উনুনে কাঠের আগুনে। রান্নাও সম্পূর্ণ ঘরোয়া পদ্ধতিতে করা হয়, কোনোপ্রকার আড়ম্বর এখানে দেখা যায় না।  থাকার জন্য চার-পাঁচটি ঘর রয়েছে।  ঘরগুলো খুবই সুন্দর। এদের নিজস্ব সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার দিলীপ মাহাতো, প্রদীপ পাত্র, দীপক দত্ত, শিবু তন্তুবায়, জয়তীদেবী  ও দেবেনের ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। সবাই সদা হাস্যময়, সেবায়  সবসময় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে।
টটকো বাঁধে সূর্য্যাস্ত 

 ভালোপাহাড়ের থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটা সুন্দর গ্রাম রয়েছে।  এছাড়া এখন থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে টটকো বাঁধ (ভেলু  ড্যাম) রয়েছে। এই ড্যামে সূর্যাস্তের দৃশ্য খুবই মনোরম। ঝাড়খণ্ডের সাতগুরুং নদী ও মনোরম দলমা পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে বেশ ভালো লাগে। পশ্চিমবঙ্গের দুয়াসিনি পেরিয়ে বান্দোয়ানে যেতে হয়।  দুয়ারসিনির কাছেই সাতগুরুং নদীটি তির তির করে বয়ে চলেছে। আপনি ইচ্ছে করলে এই নদীর তীরে বা দলমার কোলে কিছুক্ষন সময় অতিবাহিত করতে পারেন।  প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যেতে চাইলে এখানে অবশ্যই দুটো দিন কাটিয়ে যেতে পারেন। ভালোপাহাড় হলো একটা নেশা।  এখানে আসলে আপনিও এই নেশায় বুদ্ হয়ে যাবেন। নেশার টানে বার বার এখানে আসতে মন চাইবে। রাস্তার নৈসগ্রিক দৃশ্য আপনাকে বারবার হাতছানি দেবে।

জয় বৃক্ষনাথের জয় 


কিভাবে যাবেন :
 সকলের ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরে গালুডি স্টেশনে এসে নামুন।  ওখান থেকে ভালোপাহাড় যাওয়ার অটো পেয়ে যাবেন। তবেএখানে থাকতে হলে আগে থেকে নীচের ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করে আসতে হবে, না হলে থাকার জন্য কোনো ঘর পাওয়া যাবে না।

ঠিকানা :
কমল চক্রবর্তী , "ভালোপাহাড়", কুঁচিয়া, বান্দোয়ান, পুরুলিয়া, পিন ৭২৩১২৯

ফোন নাম্বার :
৯৪৭৪৪৬২২৩৮ এবং  ৯৪৩১১৮৬২৫০


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :২৩-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

No comments:

Post a Comment