Sudipta Mukherjee's Blog

Thursday, July 30, 2020

শতবর্ষের আলোকে সরবতের দোকান>P



শতবর্ষের আলোকে  সরবতের দোকান




সেই দিন হঠাৎ একটা বইয়ের খোঁজে কলেজ স্ট্রিট-এ গিয়েছিলাম।  গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্দুর। এ দোকান সে দোকান ঘুড়তে  ঘুড়তে  বইটা অবশ্য পেলাম। বইটা পেলে কি হবে, তার সন্ধান করতে গিয়ে আমার অবস্থা খুবই কাহিল হয়ে পড়লো।  ঘেমে নিয়ে একাকার হয়ে গেলাম। শরীরটা  একটু গাছের ছাওয়ায় স্নিগ্ধ হাওয়ায় নিরিবিলিতে একটু বিশ্রাম পেতে চাইছিলো।  কলেজ স্ট্রিটে এরকম জায়গা পাওয়া তো দুস্কর। প্রথমে কলেজ স্কোয়ারে গিয়ে একটা ছাওয়ায় বসলাম।  জায়গাটায় ছাওয়া থাকলেও রোদের ঝলকানি আর সাথে গরম হাওয়া দিচ্ছিল। সেখানে বেশিক্ষন বসা গেলো না।  সেখান থেকে উঠে পড়লাম।  এবার চললাম কলকাতার অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত শরবতের দোকানে। ওখানে একটু ঠান্ডা শরবত খেয়ে প্রাণটা  জুড়ানোই উদ্দ্যেশ্য। 

 ওখানে ঢুকে দেখলাম বেশ ভিড় রয়েছে, তবে কয়েকটা খালি জায়গা রয়েছে।  ওদের বিখ্যাত ডাবের শরবত দেওয়ার জন্য বললাম।  বসে বসে দোকানের ইতিহাসটা ভাবছিলাম।  কি ঐতিহ্য দোকানটির।  প্রায় একশত বছর অতিক্রান্ত  এক দোকান। ভাবা যায় একটা শরবতের দোকানের বয়স  শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। 

১৯১৮ সাল। অবিভক্ত বাংলার বরিশাল নিবাসী নীহাররঞ্জন মজুমদার কলকাতায় এসে দোকানটি  প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নাম দেন প্যারাডাইস। প্রতিষ্ঠানটা শুধু দোকান ছিল না।  দোকানের আড়ালে চলতো স্বদেশী আন্দোলনের কাজ কর্ম। নীহারবাবু নিজে ছিলেন একজন বিপ্লবী। এখানে তখন সতীন  সেন, বাঘাযতীন এরকম বহু স্বনামধন্য বিপ্লবীদের যাতায়াত ছিল।  এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও। শরবতের আড়ালেই চলতো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের গুপ্ত সমিতির কাজকর্ম। ব্রিটিশদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলতো  অনুশীলন সমিতির কাজ। কিন্তু তা বেশিদিন চালানো যায়নি।  তাদের কাজকর্মের খবর একদিন ব্রিটিশ সরকারের নজরে চলে আসে।  তারা এসে দোকানটিকে বন্ধ করে দেয়।  বেশ কিছু বছর পর দোকানটি আবার চালু করা হয়। সালটা ছিল সম্ভবত ১৯৩৭। তবে দোকানটির নাম পরিবতর্ন করে তখন করা হলো প্যারামাউন্ট। সেই থেকে এক রয়ে গেছে দোকানের চেয়ার-টেবিল।  শরবতেরও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, তার রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ আজও বহাল রয়েছে। চাওমিন, বিরিয়ানির যুগেও  বা কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডের যুগেও দোকানটি আট  থেকে আশি সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে।  


শরবতের যে কতরকম স্বাদ হতে পারে, কত রকম বৈচিত্র হতে পারে তা এখানে না আসলে জানা যায় না।  প্রত্যেকটির স্বাদই আলাদা, একের থেকে অন্যটি  ভিন্ন। কোকা মালাই, ম্যাংগো মালাই, কেশর মালাই, রোজ  মালাই, প্যাশন ফ্রউট, পাইনাপিল মালাই, ব্যানানা  মালাই, ভ্যানিলা মালাই ইত্যাদি নানারকম স্বাদের  শরবত    পাওয়া যায়।  এছাড়া নানারকম সিরাপও পাওয়া যায়।  

এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত শরবত হলো ডাবের শরবত। এই শরবত তৈরির নিয়ম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নীহারবাবুকে বলে গিয়েছিলেন। তিনি কিভাবে ডাবের শাঁসের সাথে সিরাপ মিশিয়ে একটা সুস্বাদু শরবত বানানো যায় তা শিখিয়ে গিয়েছিলেন। এদের এই রেসিপিটি জগৎ বিখ্যাত। ভারতীয় বিজ্ঞান আচার্যের সেই রেসিপি আজও সমান ভাবে চলে আসছে। যা একশো বছর ধরে ব্যাট করে চলেছে। শোনা যায়,  প্রতিদিনই প্রায় তার ব্যাট থেকে দু-তিন শতক রানের বন্যা বয়ে চলে। এই ডাবের শরবতের স্বাদ গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বদের পদধূলি বারংবার পড়েছে।  

এখানকার শরবতের টানে কাজী নজরুল ইসলাম, বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা, বিশিষ্ট লেখক শঙ্খ ঘোষ, স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, শচীন দেব বর্মন,  মহানায়ক উত্তমকুমার, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন, সিদ্ধার্থ শংকর রায়,  থেকে বহু ভারত বিখ্যাতরা  সুস্বাদু শরবতের টানে এখানে এসেছেন। বর্তমান দোকানের মালিকের সাথে কথা হচ্ছিল এঁনারা  টিভি বা কোনো কাগজ বা পত্রিকাতে কোনোরকম বিজ্ঞাপন দেন না , শতবর্ষ ধরে এদের বিজ্ঞাপন লোকের মুখে মুখেই  চলে আসছে। 

 
বাঙালির শরবত চর্চার ইতিহাসে, খাদ্য রসিক বাঙালির রসনা তৃপ্তির ক্ষেত্রে শতাব্দী প্রাচীন দোকানটি তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।  গরমের সময়  ক্লান্ত শরীরে  এখানকার শরবতে  এক চুমুকে চমক এনে দেয়। 




ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ৩০-০৭-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 





Tuesday, July 14, 2020

শব্দসুরের জাদুকর>P



 শব্দসুরের জাদুকর  


পঞ্চাশের দশকের প্রায় শেষের দিকে পদার্থ বিজ্ঞানের এক ছাত্র গান শুনবেন বলে একটা ভালো মিউজিক সিস্টেম কিনলেন। ছাত্রটি তখন প্রবাসে ম্যাসাচুসেটস  ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়াশোনা করছেন। এই মিউজিক সিস্টেমে গান শুনে তার মন ঠিক মতো ভরছিল না।  কোনো অডিটোরিয়ামে বসে গান শোনা আর এই মিউজিক  সিস্টেমে গান শোনার মধ্যে অনেকটাই ফারাক সে অনুভব করতে লাগল। সে এই ফারাকটাকে ভরাট করার জন্য পদার্থ বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে গবেষণা শুরু করলো। পদার্থ বিদ্যার জ্ঞানকে সূত্র করে সে নতুন মিউজিক সিস্টেম তৈরী করতে লাগলো।

এই বাঙালি ছাত্রটির নাম অমর গোপাল বোস। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সবটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ার ফিলাডেলফিলায়।  তার মা ছিলেন আমেরিকান কিন্তু বাবা ছিলেন বাঙালি। তার বাবা ননী গোপাল বোস একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ছিলেন।  কয়েকবার কারাবাসও করেছেন।  ১৯২০ সালে গ্রেফতারের ভয়ে তিনি আমেরিকায় পালিয়ে যান। 

অমর গোপাল বোস পেনসেলভালিয়ার অ্যাবিংটন সিনিয়র হাইস্কুল থেকে পাশ করার পর তিনি ম্যাসাচুসেটস  ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হন।  ১৯৫০ সালের শুরুতে তিনি সেখান থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক হন।  এরপর বোস নেদারল্যান্ডের এইডোভেন এ এনভি ফিলিপস ইলেক্ট্রনিকস এর গবেষণা ল্যাবে এক বছর কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি ফুলব্রাইট রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসাবে দিল্লিতে এক বছর কাটান এবং এখানেই তার হবু স্ত্রী প্রেমার সাথে পরিচয় হয় (বর্তমানে তার সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে)। তিনি এমআইটি থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি সম্পন্ন করেন; তার অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু ছিল নন-লিনিয়ার সিস্টেমস। 

ছোটবেলা থেকেই  তিনি খুব কৌতূহলী ছিলেন। যেকোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে তার সম্বন্ধে জানার কৌতূহল ছিল তার সহজাত গুন।  

মাত্র তের বছর বয়সেই তিনি তার প্রতিভার পরিচয় দেন।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ  চলাকালীন সময়ে পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের যোগান দিতে তিনি তার স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে মেরামতের একটি ছোট  ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। লোকের বাড়িতে গিয়ে তারা নষ্ট হয়ে যাওয়া খেলনা ট্রেন ও রেডিও সারাই করে দিতো। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তার বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।  তার পরিবার খুবই অর্থকষ্টে পড়ে। তখন তিনি তার পিতা  ননী গোপালকে বললেন বিভিন্ন দোকানে গিয়ে জানিয়ে আস্তে যে তারা পুরোনো রেডিও সারাই করে।    তার পিতা  সারাদিন দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে খারাপ  হয়ে যাওয়া রেডিও সারাই করার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসতো। স্কুল থেকে ফিরে অমর সেই রেডিওগুলো সারাই করে দিতো।  এইভাবেই সে তার পারিবারিক আর্থিক অনটনের পিতার পাশে দাঁড়ান। যুদ্ধের পর অমর রেডার টিউব ও ট্রান্সফরমার দিয়ে একটা টেলিভিশন বানিয়ে ফেলে।  তার বুৎপত্তি দেখে পিতা  তাকে আমেরিকার সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় পোড়ানোর কথা ভাবলেন। কয়েকজনের কাছ থেকে  ঋণ  নিয়ে তিনি ১৯৪৭ সালে ম্যাসাচুসেটস  ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ছেলেকে ভর্তি করে দেন।  

 স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর  সম্পন্ন করার পর অমর বসু এমআইটিতে  অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। তিনি একুইস্টিকস এ তার গবেষণা নিবদ্ধ করেন এবং ফলশ্রুতিতে তিনি এমন একটি স্টিরিও  লাউড স্পীকার আবিষ্কার করেন যা ঘরের ভেতর কনসার্ট হলের মত জোরালো প্রতিধ্বনিত শব্দক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। ১৯৬৪ সালে তিনি উন্নত মানের স্পিকার বানানোর জন্য একটা  প্রতিষ্ঠানা গড়ে তোলেন। অন্য দেন "বোস কর্পোরেশন"। তাঁর উদ্ভাবন রাতারাতি বাজারে আলোড়ন ফেলে দিলো।  তার নির্মিত স্পিকারটি আসলে  ছোটো ও বড়ো কয়েকটির স্পিকারের  সমষ্টি। তিনি এই সমষ্টিতে রাখলেন উফারস টুইটার্স ছাড়াও একটি সক্রিয় ইকোয়ালাইজার দিলেন।  তার ফলে হল ঘরে দুই কোনে  দুটি স্পিকার বসিয়ে দিলে কনসার্টের মতো আমেজ পাওয়া যেতে লাগলো। তার এই আবিষ্কার তাঁকে  ও তাঁর বোস কর্পোরেশনকে বড়লোক বানিয়ে দিলো।  সেই থেকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠ স্পিকার সিস্টেমগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠানই তৈরি হতে লাগলো।

তিনি শুধু বড় বড় হল ঘর নয় বাড়িতে বসেও যাতে লোকে সুন্দর শব্দ-সুধা পান করতে পারে তার ব্যবস্থা করলেন।  বিমানে বসে শোনার জন্য একপ্রকার হেডফোন আবিষ্কার করলেন। ১৯৮০ সালে তিনি গাড়িতে বসে গান শোনার কথা চিন্তা করলেন।  অচিরেই তিনি কার সিস্টেম আবিষ্কার করে ফেললেন। বর্তমানে সারা বিশ্বেই এখন বোস করপোরেশনের অফিস ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। প্রায় সাড়ে নয় হাজার কর্মী সেখানে কাজ করেন। আমৃত্যু নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তার কাজ তিনি নিজে করেছেন। তিনি ছিলেন প্রভূত সম্পদের অধিকারী। ২০১১ সালে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি।

৮৩ বছর বয়সে ২০১২ সালের  ১২ জুলাই  এই শব্দের জাদুকর মারা যান। এই শব্দসুরের জাদুকর দুটি বিবাহ করেন তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন প্রেম আর দ্বিতীয় স্ত্রী  ছিলেন উরসুলা। তাঁর ভানু বসু ও মায়া বসু নামে এই দুটি সন্তান রয়েছে। তিনি ব্যাডমিন্টন খেলতে আর বেহালা বাজাতে খুব ভালোবাসতেন।  





ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ৩০-০৭-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Sunday, July 5, 2020

এক রূপকথার গল্প>P

 এক রূপকথার গল্প 



ধুলায় মিশে যাওয়া জীবনকে কি করে সম্মানের আসনে বসাতে হয়, তা বোধহয় একমাত্র বাঙালি মেয়ে বেবীই  জানে।  বাবুর বাড়ি বাসন মেজে যার জীবন চলতো আজ তার লেখা বই বেস্ট সেলার হয়।  নাম তার বেবী হালদার। জীবন যুদ্ধে অমানুষিক লড়াই চালিয়ে আজ সে সব কিছুকে হারিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধে তাকে বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে। চলার পথের অলিতে-গলিতে কাঁকর বিছানো পথে  তাকে বার বার হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়েছে। এই পড়া থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করে আবার চলা শুরু করেছে, নিজেকে পরিপক্ক করে তুলেছে। তার জীবন সংগ্রাম যেন এক রূপকথার গল্প।  

 বেবী ১৯৭৩ সালে কাশ্মীর উপতক্যায় জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা সেনাকর্মী ছিলেন।  মদ্যপ অবস্থায় বাবা তার মার ওপর অত্যাচার করতো।  এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার মা তাকে ও তার বোনকে নিয়ে মুর্শিদাবাদে তাদের মামার বাড়িতে চলে আসে। এখানে তার মা দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ছোট্ট বেবীর জীবন সৎ বাবার সংসারে ভালোই চলছিল।  যখন সে ক্লাস সিক্সে পড়ে সেই সময় তার বাবা তাকে বিবাহ দিয়ে দেয়,  হারিয়ে যায় তার স্বাদের লেখাপড়া, হারিয়ে যায় তার শৈশব।  বিবাহের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর আর তার স্বামীর বয়স ছিল ২৬।  বিয়ের প্রথম রাত  থেকেই তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়।  তার স্বামী তাকে রান্না করা আর সন্তান ধারণ করা ছাড়া আর কিছু ভাবতো না।  এই ভাবেই বাঙালি মেয়েটি তার জীবন অত্যাচারের মাধ্যমেই ধারণ করতে লাগলো।  তার বয়স যখন বছর কুড়ি  তখন সে তিন তিনটি সন্তানের মাতা।  ১৯৯৯ সাল তার বয়স যখন বছর পঁচিশ তখন সে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দিল্লিগামী ট্রেনে  উঠে পরে। তার  সন্তানদের পিতৃপরিচয়ের কথা তোয়াক্কা না করে স্বামীর বাড়ির চৌকাঠ ছেড়ে চলে আসে। নিজের পরিচয় সন্তানদের বড় করার ব্যাপারে মনস্থির  করে নেয়। কোথায় যাবে কি করবে কিছুই তার জানা নেই, সে চায় না তার মতো তার সন্তানদের জীবন যেন না হয়।  সে তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চায়।  

দিল্লিতে এসে পরিচারিকার কাজ নেয়।  বেশ কয়েকটি বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে লাগলো।  অল্প বয়সের যুবতী নানা রকম কুপ্রস্তাবও আস্তে লাগলো। এখানে সে ঘর ঝাড় দিয়েছে, বাসন মেজেছে অর্থাৎ একজন পরিচারিকার যা কাজ সবটাই করেছে। বহুজনের কাছ থেকে ভালো ও খারাব দুরকম ব্যবহার সে পেয়েছে।সন্তানদের কথা ভেবে কোনোদিন সেভাবে প্রতিবাদ করেনি, সব কিছু মেনে নিয়েছে।    সে তার কর্তব্যে স্থির থেকে এগিয়ে যেতে লাগলো।  এই ভাবে চলতে চলতে সে একদিন অধ্যাপক প্রবোধ কুমারের বাড়িতে কাজ পেলো। বেবি তাদের বাড়িতে থেকে সব কাজ করে দেবে।  বেবির সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে প্রবোধ বাবু রাজি হলেন।  প্রবোধবাবু মুন্সি প্রেমচাঁদের নাতি ও অধ্যাপক হওয়ায় পড়াশোনার ব্যাপারে তার অগাধ আগ্রহ ছিল। তার বাড়িতে বহু রকমের বই ছিল   তিনি ধীরে ধীরে বেবীকে নিজের মেয়ের মতো ভালো বাসতে  লাগলেন।  বেবীও তাঁকে পিতার মতো সম্মান করতে লাগলো।  তাঁকে  তাতুস বলে ডাকতো। তাতুস শব্দের অর্হ পিতা।  প্রবোধবাবুর বাড়িতে কাজে ঢোকার পর বেবীর  গতানুগতিক জীবন  একটু অন্য দিকে বাঁক নেয়। জীবনের কানা গলি থেকে বেরিয়ে যেন এবার সে সঠিক গলির  সন্ধান পেল।   

 বেবী বইয়ের তাক ঝাড়পোছ করতে করতে মাঝে মাঝে কোনো বই নিয়ে পাতা ওল্টাতো। বইয়ের কিছুটা অংশ পড়তো, আবার যথাস্থানে বইটা রেখে দিতো।  এই দৃশ্য গৃহকর্তা প্রবোধবাবুর দৃষ্টি এড়ায় নি। একদিন বইয়ের তাক ঝাড়তে গিয়ে সে  তসলিমা নাসরিনের "আমার মেয়েবেলা" বইটা  পায়।  তিনি বেশ আগ্রহের সাথে বইটা পড়তে লাগল। এ যেন তারই জীবন কাহিনী লেখা রয়েছে।  প্রমথবাবু বেবীকে খাতা ও পেন্সিল এনে দিয়ে বলেন রোজ এক দু পাতা করে লিখতে।  বেবী জানতে চায় কি লিখবো। তিনি বলেন তার যা মনে হয় তাই লিখতে বা তার জীবনের কাহিনীটাও লিখতে পারে। 

কাজের অবসরে বেবী রোজ এক পাতা দু পাতা করে লিখতে শুরু করে।  ধীরে ধীরে লিখলো  তার শৈশবের কথা, তার বিবাহের কথা, তার সন্তান ধরণের কথা, তার অত্যাচারিত হওয়ার  কথা।  এই সময় বেশ কিছুদিনের জন্য গৃহকর্তা দক্ষিণ ভারতে যান, ফিরে  এসে দেখেনবেবী  ততদিনে একশো পাতা লিখে ফেলেছে। লেখাটি পরে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান।  তিনি তার বেশ কয়েকজন বন্ধুকেও লেখাটি পড়ান। সবাই একবাক্যে লেখাটির তারিফ করে। তাঁরা অনেকে এনি ফ্রাঙ্কের ডায়েরির সাথে লেখাটিকে তুলনা করেছিলেন।  

প্রবোধবাবু নিজ উদ্যোগে লেখাটিকে বইয়ের আকারে প্রকাশ করেন। বইটির নাম হয়  "আলো -আঁধারি"।  এভাবেই দু- মলাটে তিনি বেবীর জীবনকে ধরে ফেললেন।  পরবর্তী কালে এই বইটা ইংরেজিতে ও আরো ১২ টি  ভাষায় অনুবাদ হয়।  .পরে তিনি "ইসস্থ রূপান্তর" ও "ঘরে ফেরার পথ" নামে  আরো দুটি বই লিখেছেন। সব কটা বইতেই সে  তার শৈশব ও কৈশোরকে অক্ষরবৃত্তে ধরেছেন। 

হটটকের  মতোই তার জীবনের গল্প বিক্রি হতে লাগলো।  তিনটি  বই বেস্ট সেলার হয়।  বেবী হয়ে ওঠে পরিচারিকা  থেকে লেখিকা। তার চলা শুরু হয় গলি পথ থেকে রাজপথে। 



লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ :০৫-০৭-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।