শতবর্ষের আলোকে সরবতের দোকান
সেই দিন হঠাৎ একটা বইয়ের খোঁজে কলেজ স্ট্রিট-এ গিয়েছিলাম। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্দুর। এ দোকান সে দোকান ঘুড়তে ঘুড়তে বইটা অবশ্য পেলাম। বইটা পেলে কি হবে, তার সন্ধান করতে গিয়ে আমার অবস্থা খুবই কাহিল হয়ে পড়লো। ঘেমে নিয়ে একাকার হয়ে গেলাম। শরীরটা একটু গাছের ছাওয়ায় স্নিগ্ধ হাওয়ায় নিরিবিলিতে একটু বিশ্রাম পেতে চাইছিলো। কলেজ স্ট্রিটে এরকম জায়গা পাওয়া তো দুস্কর। প্রথমে কলেজ স্কোয়ারে গিয়ে একটা ছাওয়ায় বসলাম। জায়গাটায় ছাওয়া থাকলেও রোদের ঝলকানি আর সাথে গরম হাওয়া দিচ্ছিল। সেখানে বেশিক্ষন বসা গেলো না। সেখান থেকে উঠে পড়লাম। এবার চললাম কলকাতার অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত শরবতের দোকানে। ওখানে একটু ঠান্ডা শরবত খেয়ে প্রাণটা জুড়ানোই উদ্দ্যেশ্য।
ওখানে ঢুকে দেখলাম বেশ ভিড় রয়েছে, তবে কয়েকটা খালি জায়গা রয়েছে। ওদের বিখ্যাত ডাবের শরবত দেওয়ার জন্য বললাম। বসে বসে দোকানের ইতিহাসটা ভাবছিলাম। কি ঐতিহ্য দোকানটির। প্রায় একশত বছর অতিক্রান্ত এক দোকান। ভাবা যায় একটা শরবতের দোকানের বয়স শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে।
১৯১৮ সাল। অবিভক্ত বাংলার বরিশাল নিবাসী নীহাররঞ্জন মজুমদার কলকাতায় এসে দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নাম দেন প্যারাডাইস। প্রতিষ্ঠানটা শুধু দোকান ছিল না। দোকানের আড়ালে চলতো স্বদেশী আন্দোলনের কাজ কর্ম। নীহারবাবু নিজে ছিলেন একজন বিপ্লবী। এখানে তখন সতীন সেন, বাঘাযতীন এরকম বহু স্বনামধন্য বিপ্লবীদের যাতায়াত ছিল। এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও। শরবতের আড়ালেই চলতো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের গুপ্ত সমিতির কাজকর্ম। ব্রিটিশদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলতো অনুশীলন সমিতির কাজ। কিন্তু তা বেশিদিন চালানো যায়নি। তাদের কাজকর্মের খবর একদিন ব্রিটিশ সরকারের নজরে চলে আসে। তারা এসে দোকানটিকে বন্ধ করে দেয়। বেশ কিছু বছর পর দোকানটি আবার চালু করা হয়। সালটা ছিল সম্ভবত ১৯৩৭। তবে দোকানটির নাম পরিবতর্ন করে তখন করা হলো প্যারামাউন্ট। সেই থেকে এক রয়ে গেছে দোকানের চেয়ার-টেবিল। শরবতেরও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, তার রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ আজও বহাল রয়েছে। চাওমিন, বিরিয়ানির যুগেও বা কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডের যুগেও দোকানটি আট থেকে আশি সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে।
শরবতের যে কতরকম স্বাদ হতে পারে, কত রকম বৈচিত্র হতে পারে তা এখানে না আসলে জানা যায় না। প্রত্যেকটির স্বাদই আলাদা, একের থেকে অন্যটি ভিন্ন। কোকা মালাই, ম্যাংগো মালাই, কেশর মালাই, রোজ মালাই, প্যাশন ফ্রউট, পাইনাপিল মালাই, ব্যানানা মালাই, ভ্যানিলা মালাই ইত্যাদি নানারকম স্বাদের শরবত পাওয়া যায়। এছাড়া নানারকম সিরাপও পাওয়া যায়।
এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত শরবত হলো ডাবের শরবত। এই শরবত তৈরির নিয়ম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নীহারবাবুকে বলে গিয়েছিলেন। তিনি কিভাবে ডাবের শাঁসের সাথে সিরাপ মিশিয়ে একটা সুস্বাদু শরবত বানানো যায় তা শিখিয়ে গিয়েছিলেন। এদের এই রেসিপিটি জগৎ বিখ্যাত। ভারতীয় বিজ্ঞান আচার্যের সেই রেসিপি আজও সমান ভাবে চলে আসছে। যা একশো বছর ধরে ব্যাট করে চলেছে। শোনা যায়, প্রতিদিনই প্রায় তার ব্যাট থেকে দু-তিন শতক রানের বন্যা বয়ে চলে। এই ডাবের শরবতের স্বাদ গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বদের পদধূলি বারংবার পড়েছে।
এখানকার শরবতের টানে কাজী নজরুল ইসলাম, বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা, বিশিষ্ট লেখক শঙ্খ ঘোষ, স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, শচীন দেব বর্মন, মহানায়ক উত্তমকুমার, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন, সিদ্ধার্থ শংকর রায়, থেকে বহু ভারত বিখ্যাতরা সুস্বাদু শরবতের টানে এখানে এসেছেন। বর্তমান দোকানের মালিকের সাথে কথা হচ্ছিল এঁনারা টিভি বা কোনো কাগজ বা পত্রিকাতে কোনোরকম বিজ্ঞাপন দেন না , শতবর্ষ ধরে এদের বিজ্ঞাপন লোকের মুখে মুখেই চলে আসছে।
বাঙালির শরবত চর্চার ইতিহাসে, খাদ্য রসিক বাঙালির রসনা তৃপ্তির ক্ষেত্রে শতাব্দী প্রাচীন দোকানটি তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। গরমের সময় ক্লান্ত শরীরে এখানকার শরবতে এক চুমুকে চমক এনে দেয়।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ৩০-০৭-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
তারিখ : ৩০-০৭-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment