Sudipta Mukherjee's Blog

Saturday, August 8, 2020

অস্তাচলে রবি> P

অস্তাচলে রবি 

সুদীপ্ত মুখার্জী 



নিমতলা মহাশ্মশান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাধিস্থল 






"সম্মুখে দেখছি অপরাহ্নের সূর্য শেষ বিদায়ের পথ নিচ্ছে - ভাগীরথীর গৈরিক জলপ্রবাহে উঠেছে এক করুন তাপ - আজ সমস্ত বাংলার বুকে দীর্ঘশ্বাসের ওঠা-পড়া - বাতাসে হাহাকার - বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ আর নেই।  রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের জানি, কিন্তু তিনি বাঙালির রবিঠাকুর, বাঙালির গৌরব, বাঙালির প্রাণের প্রাণ, একটি আপনজন। - আজ সূর্যকে কি বিসর্জন দিয়ে চিররাত্রির অন্ধকারের মধ্যে বাঙালি জাতি আত্মগোপন করবে - না আবার সে নবসূর্যের আলোক সভাতলে জ্যোতির সমুদ্রে স্নান করতে পারবে ? সমগ্র বাঙালির মনে এই প্রশ্ন উঠছে বার বার, আজ তাই সকলের মনে এই প্রার্থনা জেগে উঠছে, হে কবি, হে পুরাতন, হে চিরনূতন - রাত্রির অবসান ক্ষণিক হোক - আগামীকালের নবপ্রভাতে নূতনরূপে তুমি দেখা দাও, - দেখা দাও আবার হে নুতন। "  - শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র 


বৃহস্পতিবার ৭ই আগস্ট, ১৯৪১ সাল  (২২শে  শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ঘড়িতে তখন দুপুর ১২টা  বেজে গেছে হঠাৎ সকলকে শোকাতুর করে চলে গেলেন বিশ্বের কবি, বাঙালির প্রাণের কবি। ৮০ বছর ৩ মাস বয়সে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। 
 
কবি তাঁর শেষ দিনগুলোতে খুবই ভুগছিলেন।  শান্তিনিকেতনে কবিরাজি ও এলোপ্যাথি উভয় পদ্ধতিতে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু কোনো চিকিৎসাতেই তিনি সুস্থ হচ্ছিলেন না। শরীরে একটা ছোট অস্ত্রপ্রচারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কবিগুরুর মন একদমই চাইছিলো না শেষ বয়সে এসে এই কাটা ছেঁড়া করাটা। 

মৃত্যুর সপ্তাহ দুই পূর্বে ২৫শে জুলাই কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে অসুস্থ শরীরে চিকিৎসার সুবিধার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসতে হয়েছিল। কবিকে ছেড়ে আসতে  হয়েছিল তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের ও শান্তিনিকেতনকে।  সেদিন দুপুর ৩টা ১৫ নাগাদ তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এসে পৌঁছলেন। ৩০শে জুলাই তাঁর অস্ত্রপ্রচার হওয়ার কথা। ৩০শে জুলাই  যথাসময়ে তাঁর  অস্ত্রপ্রচার হয়। সেইদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি অসুস্থ শরীরেই একটি বড় কবিতা লিখলেন ও তাঁর স্নেহের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে একটা চিঠিও  লিখলেন।  সকাল  ১১টা  নাগাদ তাঁকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে আসা হলো, মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে অপেরেশনটি  শেষ হয়ে যায়। অপারেশন করলেন বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ডাক্তার ললিত ব্যানার্জী।  অপেরেশনের পর থেকে তাঁর শরীরটা আরো ভেঙে গেলো। শরীরে তাপমাত্রা ও ভারসাম্যের হেরফের হতে লাগলো। ৬ই আগস্ট ঠাকুরবাড়িতে উৎসুক মানুষের ভিড়। কবির শরীর আর ডাক্তারের আয়ত্তের মধ্যে থাকছিল না। কবির তখন হিক্কা উঠছিল।  ২২শে শ্রাবণ (৭ই আগস্ট) ভোররাত্রি থেকেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মোটর গাড়ির  আনাগোনা চলছিল।  নিকট আত্মীয়, বন্ধু,  প্রিয়জন সব দলে দলে আসছেন। সকাল  থেকেই ভক্তরা জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জমায়েত হতে লাগল। বেলা ১২টা নাগাদ তাঁর নিঃশ্বাস কম হতে লাগলো। শরীরের উষ্ণতা কমে আস্তে লাগল। তাঁর শরীরের তখন  আরো অবনতি হল। ধীরে ধীরে শেষের সেই সময় আসতে লাগলো। ১২টা ১০ মিনিট, কবির শেষ  নিঃশ্বাস পড়লো।  একেবারেই তা থেমে গেলো। তিনি  চির বিদায় নিলেন।  বাংলার আকাশে সেই সময় হঠাৎই যেন সূর্যাস্ত হয়ে গেলো। সূর্য্যের মতোই যিনি জ্বলজ্বলে মূর্তিতে দীপ্যমান থেকে চিরকাল জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি  তাঁর লেখনীতে সকল বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে গেছেন, এই সেই রবি যা আজ অস্তাচলে। রবি ঠাকুর অমৃতলোকে যাত্রা করলেন।  বাইরে জনতার কোলাহল শুরু হয়ে গেলো। সবাই একবার তাদের প্রাণের গুরুদেবকে শেষবারের মত  দেখতে চায়।

রানী চন্দ্রের বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই - "গুরুদেবকে সাদা বেনারসী  জোড় পরিয়ে সাজানো হল।  কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, পাট-করা চাদর গলার নীচ থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো, কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা, দুপাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল রজনীগন্ধা। বুকের ওপর রাখা হাতের মাঝে একটি পদ্মকোরক ধরিয়ে দিলাম; দেখে মনে হতে লাগল যেন রাজবেশে রাজা ঘুমোচ্ছেন রাজশয্যার উপরে। ক্ষণকালের জন্য যেন সব তন্ময় হয়ে রইলাম। একে একে  এসে প্রণাম করে যেতে লাগল নারীপুরুষে।  ব্রহ্মসংগীত হতে লাগল এক দিকে শান্তকণ্ঠে। 

ভিতরে উঠোনে নন্দদা সকাল থেকে তাঁর নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন। নকশা এঁকে মিস্ত্রি দিয়ে কাঠের পালঙ্ক তৈরী করালেন। গুরুদেব যে রাজার রাজা, শেষ-যাওয়াও  তিনি সেইভাবেই তো যাবেন।
 
তিনটে বাজতে হঠাৎ এক সময়ে গুরুদেবকে সব্বাই মিলে  নীচে নিয়ে গেল।  দোতলার পাথরের ঘরের পশ্চিম বারান্দা হতে দেখলাম - জনসমুদ্রের উপর দিয়ে একখানি ফুলের নৌকো নিমেষে বাইরে ভেসে চলে গেল।"

 
শোকার্ত বিহ্বল মানুষের উন্মাদনা ব্যাথার আগুনে পরিণত হল।  দিকে দিকে জমাট বাঁধা কান্নার রোল উঠতে লাগল। জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে নিমতলা পর্যন্ত সমগ্র রাস্তা  জনসমুদ্রে পরিণত হতে লাগল। সূর্যের দাবদাহে তপ্ত হয়ে ওঠা প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে চলেছে শোকাতুর মানুষের মিছিল। অচিরেই রাস্তাগুলোতে তৈরী হয়ে উঠলো জনসমুদ্র।  ধীরে ধীরে ওই জনসমুদ্র অতিক্রম করে কবিগুরুর নশ্বর দেহ বিকেল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট নাগাদ  নিমতলা শ্মশানঘাটে এসে পৌঁছলো।  উপস্থিত সকলের চোখে তখন বাঁধনহারা চোখের জল। সকলেই চোখের জলে নতমুখে কবিকে চিরবিদায় জানালেন।  

আকাশবাণী কেন্দ্র পনেরো মিনিট অন্তর  কবির অন্তিম যাত্রার ধারা বিবরণ দিচ্ছিল।   বীরেন্দ্রাকৃষ্ণ ভদ্র  তার আবেগঘন  কণ্ঠে এই দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমার লেখার প্রথম স্তবকে রয়েছে  আকাশবাণী থেকে প্রচারিত কবির শেষ যাত্রার বিবরণ। এই ধারাভাষ্যটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দেওয়া। 

চিত্র ও লেখা " সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২২শে শ্রাবণ , ১৪২৭ (ইং. ০৭-০৮-২০২০)
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪ ২০৭৫০ 



👉 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।  পরবর্তী লেখাগুলো পেতে বগতিকে ফলো করে রাখুন।  

No comments:

Post a Comment