ভবানীপুর মল্লিক বাড়ির পূজা
- সুদীপ্ত মুখার্জী
দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত অঞ্চলের নাম ভবানীপুর। এককালে বর্ধিষ্ণু বাঙালির বাস ছিল এই অঞ্চলে, তবে বর্তমানে অঞ্চলটি সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। অঞ্চলটিতে রয়েছে বাঙালির সাথে বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন মানুষের সহাবস্থান। এই অঞ্চলেই একটা ছোট্ট গলিপথ রয়েছে। মোহিনী মোহন রোড। সেই গলিপথে বসবাস করে অঞ্চলের একটি প্রসিদ্ধ পরিবার। মল্লিক পরিবার। কলকাতার পারিবারিক দুর্গাপুজোর ইতিহাসে এই ছোট্ট গলিটার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই পরিবারের পূজা এবছর ৯৬ বছরে পদার্পন করবে।
১৯২৫ সালে মল্লিক পরিবারের সন্তান রাধামাধব মল্লিক বর্ধমান জেলার গুপ্তিপাড়া থেকে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছিলেন বর্ধমানের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। ইকমিক কুকারের আবিষ্কর্তা ইন্দুমাধব মল্লিক এই পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁরা তিন ভাই ছিলেন। ইন্দুমাধব, প্রিয়মাধব ও সুরেন্দ্র। সুরেন্দ্র ২৫ মোহিনী মোহন রোডে বাড়িটিতে একটি চণ্ডী মণ্ডপ তৈরী করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে সুরেন্দ্র নির্মিত চণ্ডীমণ্ডপটি ঠাকুর দালান বিশেষ ছিল। এই ঠাকুর দালানে প্রথমে দূর্গা নয় দেবী অন্নপূর্ণার পূজা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র ও পরিবারের অন্যান্যদের উদ্যোগে ঠাকুরদালানে দেবী দুর্গার আহ্বান করা হয়। সেই থেকে আজও পারিবারিক নিয়ম নীতি মেনে পূজাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তাঁরা কখনই পরিবর্তনের স্রোতে গা না ভাসিয়ে নিজেদের একটা স্বতন্ত্র বজায় রেখে এগিয়ে চলেছেন।
এঁনারা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত। ঠাকুরদালানেই দেবী প্রতিমা নির্মিতি হয়। জন্মাষ্ঠমীর দিন কাঠামো পূজা করা হয়। পরিবারের কুলদেবতা শ্রীধর নারায়ণ। সাবেকি একচালা বাংলা শৈলীর মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। ডাকের সাজে দেবীকে সজ্জিত করা হয়। এছাড়া আলাদা করে দেবীকে সোনা ও রুপার গহনা পড়ানো হয়। দেবীর বাহন সিংহ আধুনিক রূপের। প্রতিপদাদিকল্প অনুসারে পূজা হয়, তাই মহালয়ার পরের দিন থেকে আরম্ভ হয় বোধন। মহালয়ার পরবর্তী প্রতিপদ থেকে চণ্ডীর পূজা শুরু হয়। বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে এখানে পূজা করা হয়। ষষ্ঠীর দিন শুরু হয় দেবী দুর্গার বোধন। এই দিন থেকেই পরিবারের সদস্যদের পারিবারিক আড্ডা চলতে থাকে। ঠাকুর দালান সরগরম হয়ে ওঠে। ফল-ফুল ও মন্ত্রে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে সমগ্র ঠাকুরদালানটি। প্রতিদিন নতুন ফুলের মালা ও রুপোর ১০৮টি পদ্মমালায় দেবীকে সুসজ্জিত করে তোলা হয়। কুলদেবতা শ্রীধর নারায়ণকে দেবীর পাশে বসানো হয়। সপ্তমীতে কলাবৌ স্নান, অষ্টমীতে কুমারীপূজা, পুষ্পাঞ্জলি ও নবমীতে হোম যজ্ঞ সবটাই বৈষ্ণব মতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
এখানে দেবীকে কোনোরূপ অন্নভোগ দেওয়ার নিয়ম নেই। তার পরিবর্তে তাঁরা লুচি, নানারকম তরকারি, চাটনি, নানারকম ফল ও মিষ্টি ভোগ হিসেবে দেবীকে নিবেদন করে থাকেন। পূজার সবকটা দিনই দেবীকে নৈবেদ্য দেওয়ার প্রথা রয়েছে।
এই বাড়িরই সন্তান বিশিষ্ট অভিনেতা শ্রী রণজিৎ মল্লিক ও তাঁর কন্যা অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিক। তাঁরা পূজার কটাদিন সারাক্ষণই ঠাকুর দালানে উপস্থিত থাকেন। পরিবারের গৃহবঁধূ বিখ্যাত গায়িকা প্রমিতা মল্লিক। পূজার কটাদিন যেমন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত থাকেন তেমন এই কটাদিন বিনোদন জগতের বহু তারকাকেই উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। এককালে দশমীর দিন বিসর্জনের বিদায়ী সুরের সাথে ঠাকুরদালানে গান, নাটক ইত্যাদি পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হতো। পূজার বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকে নাটকের মহড়া চলতো। বর্তমানে তা আর অনুষ্ঠিত হয় না।
এঁনারা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত বলে পূজার কটা দিন নিরামিষ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। দেবী বিসর্জনের পর আমিষ খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সব পদই মল্লিক পরিবারের হেঁশেলে রান্না করা হয়। দশমীর দিন দেবীকে ভবানীপুরের আদি গঙ্গার বলরাম বোস রোড ঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয়। শহর কলকাতার বনেদি বাড়ির পূজাগুলোর মধ্যে ধীরে ধীরে দক্ষিণ কলকাতার মোহিনী মোহন রোডের মল্লিক পরিবারের পূজাটি বিশিষ্ঠ স্থান অর্জন করে চলেছে।
ছবি : লেখক
তারিখ : ২৫-০৯-২০২১
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment