কাশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা
সুদীপ্ত মুখার্জী
কাশী হল হিন্দুদের পবিত্র তীর্থভূমি এবং পৃথিবীর প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। বহু প্রাচীনকাল থেকেই পূণ্যকামী মানুষদের এই তীর্থে বারে বারে ছুটে আসতে দেখা যায়।প্রাচীন শৈব্যতীর্থ এই কাশীর আধুনিক নাম হয়েছে বারাণসী। হিমালয়ের বুকে উত্তরকাশীর দুপাশ দিয়ে বয়ে আসা দক্ষিণে অসি ও উত্তরে বরুণা নদী। বরুণা ও অসি এই দুই নদী প্রবাহিত হয়ে এসে কাশীর গঙ্গায় মিলিত হয়েছে। বরুণা ও অসি নদীর নাম একত্র করে বারাণসী নামের সৃষ্টি। পতিতপাবনী, জীবনদায়িনী ও স্রোতস্বীনি পবিত্র গঙ্গার তীরেই হিন্দুতীর্থ বারাণসীর অবস্থান। কাশী-বারাণসী নিজেই নিজের তুলনা। প্রাচীনত্বের নিরিখে কাশীর খ্যাতি জগৎজোড়া। এই তীর্থভূমিতে যেমন আছেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রথম লিঙ্গ বিশ্বনাথজী ঠিক তেমন রয়েছেন কাশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা অন্নপূর্ণা।
এখানকার বিশ্বনাথ মন্দির ও অন্নপূর্ণা মন্দির হিন্দুধর্মের পীঠস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম ও খুবই জনপ্রিয়। গঙ্গাতীরে দশাশ্বমেধ ঘাট মানেই কাশী, কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির, মা অন্নপূর্ণা হল কাশীবাসীদের কাছে সব। জনশ্রুতি অনুসারে এই স্থানেই বাবা বিশ্বনাথের সাথে দেবী অন্নপূর্ণার সহাবস্থান রয়েছে। এখানে বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের ঠিক পাশে রয়েছে দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির। দূরদূরান্ত থেকে অগণিত ভক্ত প্রতিদিন কাশীধামে আসেন এবং দেবী অন্নপূর্ণার প্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন।
অন্নদাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা বা অন্নদা দেবী যিনি দেবী দুর্গার এক রূপ। মূলত দেবী দ্বিভূজা হয়ে থাকেন। দ্বিভূজা দেবীর বামহস্তে অন্নপাত্র এবং ডানহাতে থাকে দরবিও অর্থাৎ চামচ বা হাতা। প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দেবী অন্নপূর্ণার বিশাল আয়োজনে পূজা করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে আমরা দেবী অন্নপূর্ণার উল্লেখ দেখতে পাই। আধ্যাতিক সাংস্কৃতিক নগরী কাশীর জগন্মাতা হলেন রাজরাজেশ্বরী অন্নাপূর্ণা। দেবী অন্নপূর্ণাকে ঘিরে নানারকম কাহিনীর কথা শোনা যায়। এইসব কাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাসদেবের কাশী প্রতিষ্ঠার উপাখ্যানও ।
আমরা জানি মুঘল আমলের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্রাট কাশীর একাধিক মন্দির চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে গেছেন। পরবর্তীকালে তা আবার কেউ না কেউ গড়ে দিয়েছেন। কথিত আছে, বাবা বিশ্বনাথ হলেন কাশীক্ষেত্রের নির্মাণকর্তা, কালভৈরব হলেন দ্বারপাল আর মা অন্নপূর্ণা হলেন কাশীক্ষেত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বিশ্বনাথ মন্দিরের ঠিক পাশে ও ঢুন্ডিরাজ গণেশের পরে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করে ডানদিকে পড়ে দেবী অন্নপূর্ণা মন্দিরের প্রবেশদ্বার। রূপোর কারুকার্য করা বিশাল দরজা হল প্রধান ফটক। এই প্রধান ফটক পেরোলেই মন্দিরসহ বিরাট নাটমন্দির অবস্থিত। গর্ভগৃহে রুপার আসনে উপবিষ্ট দেবী অন্নপূর্ণা। অপূর্ব মূর্তি। সোনার মুকুটে এখানে দেবী স্বর্ণময়ী, স্বর্নোজ্জ্বলা। সুন্দর শাড়ি পরে ফুলের মালায় ঢাকা মা উপবিষ্ট রয়েছেন। বেশ উজ্জ্বল মুখমন্ডল, টানা টানা চোখযুগল। ১৭২৫ সালে দক্ষিণের রাজা বিষ্ণুপন্থ গাজাবেদী পূর্বেকার মন্দিরটি ভেঙে নতুন মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। নতুন মন্দিরের তুলনায় পূর্বের মন্দিরটা বেশ ছোট ছিল। বিগ্রহটি সোনার পাত দিয়ে মোড়া। দেবী অন্নপূর্ণার পাথরের আদি বিগ্রহটি অতি জীর্ণ হয়ে যাওয়ায় এখন সর্বদাই মূর্তিটি ঢাকা থাকে সোনার আবরণে। মন্দির চত্বরে আরো কয়েকটি মন্দির রয়েছে। মূল মন্দিরের বাঁদিকে কুবেরেশ্বর, ডানদিকে সূর্যদেব। এছাড়া গণেশ, যন্ত্রেশ্বর বিগ্রহ রয়েছে। যন্ত্রেশ্বর বিগ্রহটির মাথায় খোদিত রয়েছে সুন্দরদেবী-যন্ত্রম। এটা খুবই প্রাচীন লিঙ্গ। এর পশ্চিম দিকে রয়েছে হনুমানজী দেবী মন্দিরের ঠিক সামনেই একটা আলাদা দালানের উপর রামচন্দ্রের মূর্তি। তীর্থযাত্রীদের নিকট যা সত্যনারায়ণ নামেই পরিচিত। এছাড়া ভবানীশঙ্করের একটা প্রাচীন মন্দির দালানে রয়েছে। কুবেরেশ্বররের ঠিক ওপরের ঘরে পূর্বেকার সোনার অন্নপূর্ণা বিগ্রহটি স্থাপিত রয়েছে। এই মূর্তিটি সবদিন দেখা যায় না, বিশেষ বিশেষ দিনে মূর্তিটিকে ভক্তদের দেখতে দেওয়া হয়। এই মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষেধ। তবে বিদেশী ও অহিন্দুদের জন্য নহবতখানা ঠিক উল্টোদিকে একটি ঝোলানো বারান্দা রয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে তারা দেবী অন্নপূর্ণাকে দর্শন করতে পারেন।
কাশীতে তৈরী হয়েছে "কাশী অন্নপূর্ণা অন্নক্ষেত্র ট্রাস্ট"। বিনা খরচে খাবার, অবৈতনিক শিক্ষা ও চিকিৎসা জনগণকে দেওয়া হল এই ট্রাস্টের প্রধান উদ্দেশ্য। এই ট্রাস্টের মাধ্যমেই দেবী অন্নপূর্ণাকে অন্ন উৎসর্গ করা হয়। তারপর সেই প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এখানকার ভোগ মন্দিরে বসেই খেতে হয়, তা মন্দির চত্বরের বাইরে আনা যায় না।
হিন্দু বিশ্বাস যে বাবা বিশ্বনাথের কাশীতে মা অন্নপূর্ণার কৃপায় কখনো কেউ অভুক্ত থাকে না। এই অন্নদায়িনী দেবী অন্ন দিয়ে দীন-দরিদ্র সকলেরই দুঃখ দূর করেন। দেবী অন্নপূর্ণার এক নাম ভবানী। কাশীতে ঘোরতর সংসারী হলেন বাবা বিশ্বনাথ। তাঁর স্ত্রী হলেন দেবী ভবানী। দেবী ভবানী বা অন্নপূর্ণা কাশীর নিত্যদেবী। কাশীতে ফুল-মালা, দীপ, ধূপ ও নৈবেদ্য সহকারে অর্চনা করলে সংসারে কোনোদিন খাদ্যের অভাব ঘটবেনা বলে বিশ্বাস রয়েছে।
পুরাণে বলা আছে, যে মহাদেবের সাথে দেবীর মতবিরোধ হওয়ার জন্য তিনি কৈলাশ ত্যাগ করেন। তাঁর কৈলাশ ত্যাগের কারণে চারদিকে মহামারি ও খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সেই সময় ভক্তদের ঠিক রাখার জন্য মহেশ্বর ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু দেবীর মায়ায় তাঁর ভিক্ষার অভাব ঘটে। তখন দেবাদিদেব মহাদেব জানতে পারেন যে কাশীতে এক নারী রয়েছেন যিনি সকলকে অন্ন দান করেন। এই কথা শুনে মহাদেব তাঁর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে কাশীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। এখানে তিনি দেবীর নিকট থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করে ভক্তদের বিপদ থেকে রক্ষা করলেন।
তারিখ :১০-০৪-২০২২
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment