ভ্রমণ সব সময়ই আনন্দদায়ক। তা সে নিকটবর্তী স্থান বা দুর ভ্রমণ হোক। একঘেয়ে জীবনযাত্রার থেকে বেরিয়ে একটু বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য দু দিনের ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়া। ব্যস্ত জীবনে বা সংসারের যাঁতাকল থেকে একটু মুক্তি, একটু অন্যরকম আনন্দ খুঁজে নেওয়ার জন্য দুই বন্ধু অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। কোথায় যাবো, কোন ঠিকানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেব, কিছুই ঠিক না করে সকাল সকাল হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। স্টেশনের বোর্ডে দেখলাম ৬.৫৫ মিনিটে ইস্পাত এক্সপ্রেস ছাড়বে। মলয় বললো চলো এটাতে করে টাটানগর যাই, ফেরার পথে গালুডি বা ঘাটশিলা যাবো। কিছু না ভেবে টাটানগর পর্যন্ত দুটো টিকিট কেটে দুজনে ট্রেনে উঠে পড়লাম। মলয় বললো টাটানগর প্রথম যাই, ওখানে একরাত্রি থেকে পরের দিন গালুডি বা ঘাটশিলা ঘুরে হাওড়া ফিরে আসবো। ওর মতামতে আমি রাজি হতে পারলাম না। ওকে বললাম, মাত্র দুটো দিন অর্থাৎ ৪০ ঘন্টা ভ্রমণের সময়, তার মধ্যে তিন -সাড়ে তিন ঘন্টা করে ট্রেনে যাওয়া ও আসা, ঘন্টা আট -নয় রাতে ঘুমোনো বাদ দিলে হাতে ঘোরার জন্য থাকলো মাত্র ২৪-২৫ ঘন্টা। এতো কম সময় দু-জায়গায় ঘুরতে গেলে কোনোটাই ভালোভাবে দেখা হবে না, ঘোরার আনন্দটাই বিফলে যাবে। আমার মনে হয় তার চেয়ে ভালো আমরা ঘাটশিলাতেই নেমে মেঠো পথ ও পাহাড়ি ঝর্ণা দেখে দুটো দিন কাটিয়ে দেবো। মলয় আমার কথা ফেলতে পারলো না। দুজনের মতের মিলে অবশেষে পথের ঠিকানা মিলল। ঠিক হলো আমরা ঘাটশিলাতেই এবারের ছুটিটা উপভোগ করবো। আমরা সাড়ে দশটা নাগাদ ঘাটশিলা পৌঁছলাম। স্টেশনের পাশেই একটা হোটেল ঠিক করে ব্যাগ পত্তর রেখে, একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ঘাটশিলা পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলার একটি সুন্দর ছোট্ট শহর। শহরটি সুবর্ণরেখা নদীর তীরে অবস্থিত পাহাড়ে ঘেরা বনভূমি অঞ্চল। বাঙালিদের কাছে বরাবর খুবই আকর্ষণীয়, বর্তমানে বাঙালি পর্যটকদের কাছেও সমান আকর্ষণীয় স্থান। চারধারে অনুচ্চ পাহাড়, মাঝে আপনবেগে বয়ে চলা পাগলপারা সুবর্ণরেখা নদী। তার সাথে বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের স্মৃতিমাখা পথ ঘাট। অতীতে বহু বাঙালি স্বাস্থ্যউদ্ধারের উদ্দেশ্যে এখানে এসে বেশ কিছুদিন করে বসবাস করতো। অতীতে এখানেই ধলভূম রাজ্যের রাজধানী ছিল।
আমরা প্রথমে রাস্তায় একটু জলখাবার ও চা খেয়ে একটা অটো ভাড়া করে চললাম দাহিঘরা অঞ্চলে অবস্থিত রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমে। বেশ সুন্দর নিরিবিলি স্থানটি। মিশনের অন্যান্য আশ্রমগুলির পরিবেশ যেরকম থাকে, এখানেও ঠিক সেরকম পরিবেশই বজায় রয়েছে। আশ্রমটি ১৯৩৫ সালে তৈরী করা হয়। ২০০৪ সালে এটি বেলুড় মঠ ও মিশনের অধীনে আসে। ঢুকতেই সামনে একটি ছোট্ট সুন্দর মন্দির পড়ল, মন্দিরে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের মূর্তি বিরাজ করছে। এদের কর্মযজ্ঞের মধ্যে দেখলাম বিনামূল্যে দুস্থদের চিকিৎসা কেন্দ্র, গদাধর অব্যুধ্যয় প্রকল্পে তৈরী কম্পিউটার শিক্ষা কেন্দ্র, ফিজিওথেরাপি কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া এখান থেকে নানারকম অনুষ্ঠান করা হয়। গরিব দুঃখীদের কম্বল, ঔষধ, জামাকাপড় ইত্যাদি প্রয়োজনে বিনামূল্যে দান করে থাকে। এবার আমাদের যাওয়ার কথা গৌরীকুঞ্জ।
পৌঢ় বয়সে বিভূতিভূষণ রমাদেবীকে বিবাহ করলেও তাঁর প্রথমা স্ত্রী গৌরীদেবীকে তিনি ভুলতে পারেননি। ঘাটশিলার সুবর্ণরেখা নদীর কূলে তিনি একটা ছোট্ট কুটির কিনে তার নাম রেখেছিলেন গৌরী দেবীর নামে। তিনি কুটিরটির নাম "গৌরীকুঞ্জ" রেখেছিলেন।
গৌরীকুঞ্জ হলো সেই বাড়ি যেখানে বিভূতিভূষণের স্মৃতিমাখা সংগ্রহশালাটি রয়েছে আমাদের অটো ঘুরিয়ে নিয়ে কিছুটা পথ এগোতেই একটা ছোট রাস্তা একটু নিচের দিকে নেমে গেছে, এই রাস্তাটির নামটা ভারী সুন্দর। বিভূতিভূষণের স্মৃতিজড়ানো নাম "অপুর পথ", নামটা আমার বেশ লাগলো। গৌরীকুঞ্জে ঢোকার পর প্রথমেই দেখলাম পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। ভিতরে ঢোকার জন্য একটা বড় প্রবেশদ্বার তৈরী করা আছে। প্রবেশদ্বারের ভিতরে সাহিত্যিকের একটা মর্মর মূর্তি স্থাপন করা আছে। বাড়ির শেষ প্রান্তে "অপুর পাঠশালা" নামে একটা বাংলা শিক্ষার পাঠশালা গড়ে তুলেছে গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি। ঝাড়খণ্ডের বাঙালি সন্তানদের বাংলা শেখার কোনো সুযোগ না থাকার কারণে পাঠশালাটি গড়ে তোলা হয়েছে। এটা ঠিক প্রথাগত শিক্ষা কেন্দ্র নয়, বাংলাশিক্ষার কোনো কোর্স নেই। বাচ্ছারা যাতে মনের আনন্দে বাংলা শিখতে পারে সেটাই লক্ষ্য পাঠশালাটির। এখানে বর্ণপরিচয়, সহজ পাঠ যেমন শেখানো হয় তেমন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এরকম দিক্পালদের রচিত উপন্যাস ও ছোট গল্পও গল্পের মাধ্যমে পড়ে শোনানো হয়। পাঠশালার আসল উদ্দেশ্য হলো বাংলা সাহিত্যের প্রতি উৎসাহ তৈরী করা। এই পাঠশালার পাশেই সাহিত্যিকের পুত্র তাড়াদাসের নামে নামাঙ্কিত একটা মঞ্চ রয়েছে। ভিতরে দুটি ঘর নিয়ে তৈরী সংগ্রহশালায় দেখলাম সাহিত্যিকের ব্যৱহৃত সব সামগ্রীগুলোকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে। তাঁর ব্যৱহৃত জামা-কাপড়, কলম, পাণ্ডুলিপি অনেককিছু রয়েছে। দুটি ঘর, প্রশস্থ বারান্দা, গাছ-গাছালিতে ঘেরা সুনিবিড় এক শান্তির নীড়। সংগ্রহশালার ঘর দুটিতে পা
ছোঁয়াতেই বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা আমার অজান্তেই নুইয়ে পড়ল। প্রকৃতির সাধক ব্যক্তিগত জীবনে কত অনাড়ম্বরভাবে জীবন কাটাতেন, তাই লক্ষ্য করছিলাম। অপু-দুর্গার স্রষ্টা, প্রকৃতি প্রেমিক, প্রকৃতির বুকেই কিভাবে জীবন পরিচালনা করতেন, তাই দেখছিলাম। তাঁর কলম তুলিতে আঁকা প্রকৃতিকে তো আমরা চিনতে শিখেছি তাঁরই গল্পের মাধ্যমে। জীবনের অনেকটা সময় তিনি এখানে অতিবাহিত করেছেন। এখানেই ১৯৫০ সালে তাঁর জীবন সংগ্রামের ইতি ঘটেছে।
এখান থেকে আমরা রওয়ানা দিলাম এখানকার বিখ্যাত রঙ্কিনী মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে মন্দির যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে একটা হোটেলে দুপুরের আহারটা সেরে নিলাম। বিস্তীর্ণ একটা চত্বরের মধ্যে লাল রঙের একটা মন্দির। গর্ভগৃহে অষ্টভুজা মূর্তি বিরাজ করছে, পাদপ্রদীপে শিবমূর্তি রয়েছে। চত্বরের মধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গায় হাড়িকাঠ রয়েছে। বেশ জাগ্রত মন্দির। ভয়ঙ্করী দেবী বলে সকলে তাঁকে ভয় করেন আবার বিপদে আপদে তাঁকেই স্মরণ করেন। জন্মাষ্টমীতে বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। শুনলাম অষ্টমী ও নবমীতে এখানে খুব ঘটা করে মোষ বলি দেওয়া হয়। বর্তমানে পশুবলি সারা দেশে যখন আইনত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন কি করে এখানে পশুবলি দেওয়া হয়, ঠিক বুঝতে পারলাম না ও বিশ্বাসও করতে পারলাম না। যাই হোক, মন্দিরটা খুব ভালো লাগলো। আনুমানিক তেরোশো খ্রীষ্টাব্দের কথা, তখন পরম শক্তিশালী রাজা ছিলেন জগৎ দেব। কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি তাঁর রাজধানী এখানকার জঙ্গলে স্থানান্তরিত করেন। এখানেই তিনি তাঁর গড় প্রতিষ্ঠা করেন এবং নাম দেন ধলভূমগড়। কথিত আছে দেবী রঙ্কিনীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি গালুডির শালবনে রঙ্কিনী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে সেই মন্দির স্থানান্তরিত করা হয় ঘাটশিলায়।
ওখান থেকে এবার আমাদের গন্তব্য গালুডি বাঁধ। ঘাটশিলা থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে এই বাঁধ। প্রকৃতির বৈচিত্রে ভরা অঞ্চল হল গালুডি। এটাও বাঙালিদের স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য আদর্শ জায়গা, প্রকৃতির কোলে দু-একদিন থাকলে স্বাস্থ্য ও মন দুটোই ভালো হতে বাধ্য। গালুডি স্টেশন পার হয়ে কিছুটা এগোতেই এই বাঁধের ধারে আমরা পৌঁছে গেলাম। সূর্যিমামা তখন সুবর্ণরেখার জলে ডুব দিয়ে দিয়েছে। শক্ত পোক্ত বাঁধের ওপর বেশ চওড়া রাস্তা এপার থেকে ওপার চলে গেছে। সুবর্ণরেখা ফুঁসছে তাকে বেঁধে রাখার
ক্ষোভে। তারই মাঝে একদল লোক খেপলা জাল দিয়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত। পাহাড়ের লাল আভা মাখা রূপ ও প্রকৃতির অপরূপ রূপ আমাকে মুগ্ধ করে দিল। প্রকৃতি ও আধুনিক সভ্যতা যেন এখানে অঙ্গাঙ্গিভাবে একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে।মন ভোলানো দৃশ্য কিছুক্ষন হারিয়ে যাওয়ার জন্য যেন অপেক্ষা করে রয়েছে। এবার আজকের মত আমাদের ঘোরা শেষ হয়ে গেলো এবার ফেরার পালা।
হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরোলাম। প্রথমে একটু চা ও সিঙ্গারা খেলাম। তারপর এখানকার জনবাসীদের জীবনযাত্রার একটা ছবি মনে গেঁথে রাখতে বাজার এলাকাটা একটু ঘুরলাম। নানারকম পসরার দোকান রয়েছে, তবে দোকানগুলো কয়েকটা ছাড়া খুব একটা সাজানো নয়, তবে ক্রেতার কোনো অভাব আছে বলে মনে হলো না। বেশিরভাগ দোকানগুতেই অল্প হলেও ক্রেতা রয়েছে। বাড়িগুলো বেশ পুরোনো। একটা বেশ বড় বাড়ি ( সাত কি আট তলা হবে ) দেখতে পেলাম, সেই বাড়িটার তলায় বেশ বড় একটা জামা-কাপড়ের দোকান ঝলমল করছে। বাজারে বেশ কিছুক্ষন কাটানোর পর আমরা স্টেশনে অনেকটা সময় কাটালাম। স্টেশনটা পুরোনো আমলের বাড়ি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তবে স্টেশন চত্বরে আলোর বড়োই অভাব রয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে দশটার মধ্যে হোটেলে ঢুকে গেলাম।
পরেরদিন সকাল ৯ টার মধ্যে হোটেল ছেড়ে দিতে হল। হোটেল ছেড়ে জলখাবার খেয়ে আবার একটা অটো ভাড়া নিয়ে চললাম ছোটবেলায় পড়া ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ফুলডুঙরি পাহাড়ে পাণ্ডবদের অভিযান গল্পের কথা ভাবতে ভাবতে ফুলডুঙরির পথে। ঘাটশিলার কাছেই রহস্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে এই ফুলডুঙরি পাহাড়। শাল, পিয়াল, মহুয়া ও কত জানা অজানা বিশাল বিশাল গাছে পরিবেষ্টিত এই মাঝারি মাপের পাহাড়টি। বেশ একটা আরণ্যক পরিবেশ। ছায়ামাখা পথ টিলা ঘিরে উঠেছে, সঙ্গী করেছে সবুজ বনানীকে। পাহাড়ের ওপর থেকে শহরটি দেখা মনোমুগ্ধকর লাগলো। এই পাহাড় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের খুবই প্রিয় ছিল। তাঁর অনেক সৃষ্টির মধ্যে পাহাড়টিও অমর হয়ে রয়েছে। এবার ঘাটশিলার সবচেয়ে মনোরম জায়গা বুরুডি লেক ও ধারাগিরি ঝর্ণা দেখতে চললাম।
পাকা রাস্তা ছেড়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তা এঁকে বেঁকে চলেছে, রাস্তাটিতে অজস্র গরু, মোষ, ছাগলের চলাফেরা রয়েছে, তাদের কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। তিনদিকে পাহাড়ে ঘেরা মাঝখানে এই সৌন্দর্য্যে মোড়া জলাশয়টি। পাহাড়ি ঝোরার জল ধরে তৈরী হয়েছে সরোবরটি। নীলচে-সবুজ জল। বিস্তীর্ণ উপত্যকা, চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা। রোদে ঝলমল করছে জলরাশি, তার মধ্যে পাহাড়ের ছায়া, পাহাড়ের ছায়াগুলো জলে পড়ায় দারুন লাগছে। প্রথম দেখাতেই এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কি সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য। কি অপূর্ব জলরাশি, পাহাড়ের কোলে বাতাসে দুলে দুলে উঠছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি রঙিন প্যাডেল বোট চলাফেরা করছে। বহু পর্যটক এই বোটগুলো ভাড়া করে কিছুক্ষন ঘুরে ঘুরে সমগ্র প্রাকৃতিক পরিবেশটা উপভোগ করছে। আমরাও একটা বোট ভাড়া নিয়ে কিছুক্ষন পরিবেশের সাথে নিজেদের শহুরে শরীরটাকে একটু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম এবার ধারাগিরির ধারা দেখবো।
গিরিখাতের মাঝ দিয়ে জলের ধারা এসে এক অপরূপ ঝর্ণার সৃষ্টি করেছে। বুরুডি থেকে ধারাগিরি রাস্তাটা পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে বলে অটো চালক ভাইয়া জানালো। দুপাশে পাহাড় আর মাঝখানে ঝর্ণার মৃদু মন্দ জলের আওয়াজ আর মাঝে মাঝে পাহাড়ি পাখিদের ডাক এক কথায় অসাধারণ। যাওয়ার পথে দেখছিলাম পাহাড়ের গায়ে আদিবাসীরা চাষ করছে। এখানকার জল সরকারিভাবে পরিশুদ্ধ করে কাছের গ্রামগুলোতে সরবরাহ করা হয়। অটো ভাইয়া আমাদের বললো পেট ভরে জল পান করে নিন, এই জল হজমের পক্ষে খুবই ভালো। আমরা পেট ভরে জল পান করে নিলাম। এবার আমাদের ফেরার পালা, কারণ দুপুর সাড়ে তিনটের সময় আমাদের ট্রেন তার মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে হবে। সেই কারণে হাতে আর সময় নেই। তাড়াতাড়ি করে ফিরে আসলাম।
দুটো দিন কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না , নির্ভেজাল অক্সিজেন দুদিন ধরে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসলাম। মনে এক রোমাঞ্চকর আবেগ বেশ কিছুদিন ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। এখানকার স্মৃতি সত্যিই ভোলার নয়। এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
কিভাবে যাবেন :
ঘাটশিলা পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলার একটি সুন্দর ছোট্ট শহর। শহরটি সুবর্ণরেখা নদীর তীরে অবস্থিত পাহাড়ে ঘেরা বনভূমি অঞ্চল। বাঙালিদের কাছে বরাবর খুবই আকর্ষণীয়, বর্তমানে বাঙালি পর্যটকদের কাছেও সমান আকর্ষণীয় স্থান। চারধারে অনুচ্চ পাহাড়, মাঝে আপনবেগে বয়ে চলা পাগলপারা সুবর্ণরেখা নদী। তার সাথে বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের স্মৃতিমাখা পথ ঘাট। অতীতে বহু বাঙালি স্বাস্থ্যউদ্ধারের উদ্দেশ্যে এখানে এসে বেশ কিছুদিন করে বসবাস করতো। অতীতে এখানেই ধলভূম রাজ্যের রাজধানী ছিল।
![]() |
ঘাটশিলা রামকৃষ্ণ মিশন |
পৌঢ় বয়সে বিভূতিভূষণ রমাদেবীকে বিবাহ করলেও তাঁর প্রথমা স্ত্রী গৌরীদেবীকে তিনি ভুলতে পারেননি। ঘাটশিলার সুবর্ণরেখা নদীর কূলে তিনি একটা ছোট্ট কুটির কিনে তার নাম রেখেছিলেন গৌরী দেবীর নামে। তিনি কুটিরটির নাম "গৌরীকুঞ্জ" রেখেছিলেন।
![]() |
বিভূতিভূষণের বাড়ি |
![]() |
অপুর পাঠশালা ও তারাদাস মঞ্চ |
এখান থেকে আমরা রওয়ানা দিলাম এখানকার বিখ্যাত রঙ্কিনী মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে মন্দির যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে একটা হোটেলে দুপুরের আহারটা সেরে নিলাম। বিস্তীর্ণ একটা চত্বরের মধ্যে লাল রঙের একটা মন্দির। গর্ভগৃহে অষ্টভুজা মূর্তি বিরাজ করছে, পাদপ্রদীপে শিবমূর্তি রয়েছে। চত্বরের মধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গায় হাড়িকাঠ রয়েছে। বেশ জাগ্রত মন্দির। ভয়ঙ্করী দেবী বলে সকলে তাঁকে ভয় করেন আবার বিপদে আপদে তাঁকেই স্মরণ করেন। জন্মাষ্টমীতে বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। শুনলাম অষ্টমী ও নবমীতে এখানে খুব ঘটা করে মোষ বলি দেওয়া হয়। বর্তমানে পশুবলি সারা দেশে যখন আইনত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন কি করে এখানে পশুবলি দেওয়া হয়, ঠিক বুঝতে পারলাম না ও বিশ্বাসও করতে পারলাম না। যাই হোক, মন্দিরটা খুব ভালো লাগলো। আনুমানিক তেরোশো খ্রীষ্টাব্দের কথা, তখন পরম শক্তিশালী রাজা ছিলেন জগৎ দেব। কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি তাঁর রাজধানী এখানকার জঙ্গলে স্থানান্তরিত করেন। এখানেই তিনি তাঁর গড় প্রতিষ্ঠা করেন এবং নাম দেন ধলভূমগড়। কথিত আছে দেবী রঙ্কিনীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি গালুডির শালবনে রঙ্কিনী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে সেই মন্দির স্থানান্তরিত করা হয় ঘাটশিলায়।
![]() |
গালুডি বাঁধের রাস্তা |
![]() |
গালুডি বাঁধে সূর্যাস্ত |
হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরোলাম। প্রথমে একটু চা ও সিঙ্গারা খেলাম। তারপর এখানকার জনবাসীদের জীবনযাত্রার একটা ছবি মনে গেঁথে রাখতে বাজার এলাকাটা একটু ঘুরলাম। নানারকম পসরার দোকান রয়েছে, তবে দোকানগুলো কয়েকটা ছাড়া খুব একটা সাজানো নয়, তবে ক্রেতার কোনো অভাব আছে বলে মনে হলো না। বেশিরভাগ দোকানগুতেই অল্প হলেও ক্রেতা রয়েছে। বাড়িগুলো বেশ পুরোনো। একটা বেশ বড় বাড়ি ( সাত কি আট তলা হবে ) দেখতে পেলাম, সেই বাড়িটার তলায় বেশ বড় একটা জামা-কাপড়ের দোকান ঝলমল করছে। বাজারে বেশ কিছুক্ষন কাটানোর পর আমরা স্টেশনে অনেকটা সময় কাটালাম। স্টেশনটা পুরোনো আমলের বাড়ি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তবে স্টেশন চত্বরে আলোর বড়োই অভাব রয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে দশটার মধ্যে হোটেলে ঢুকে গেলাম।
পরেরদিন সকাল ৯ টার মধ্যে হোটেল ছেড়ে দিতে হল। হোটেল ছেড়ে জলখাবার খেয়ে আবার একটা অটো ভাড়া নিয়ে চললাম ছোটবেলায় পড়া ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ফুলডুঙরি পাহাড়ে পাণ্ডবদের অভিযান গল্পের কথা ভাবতে ভাবতে ফুলডুঙরির পথে। ঘাটশিলার কাছেই রহস্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে
![]() |
প্যাডেল বোর্ড ও বুরুডি জলাশয় |
![]() |
বুরুডি লেক |
গিরিখাতের মাঝ দিয়ে জলের ধারা এসে এক অপরূপ ঝর্ণার সৃষ্টি করেছে। বুরুডি থেকে ধারাগিরি রাস্তাটা পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে বলে অটো চালক ভাইয়া জানালো। দুপাশে পাহাড় আর মাঝখানে ঝর্ণার মৃদু মন্দ জলের আওয়াজ আর মাঝে মাঝে পাহাড়ি পাখিদের ডাক এক কথায় অসাধারণ। যাওয়ার পথে দেখছিলাম পাহাড়ের গায়ে আদিবাসীরা চাষ করছে। এখানকার জল সরকারিভাবে পরিশুদ্ধ করে কাছের গ্রামগুলোতে সরবরাহ করা হয়। অটো ভাইয়া আমাদের বললো পেট ভরে জল পান করে নিন, এই জল হজমের পক্ষে খুবই ভালো। আমরা পেট ভরে জল পান করে নিলাম। এবার আমাদের ফেরার পালা, কারণ দুপুর সাড়ে তিনটের সময় আমাদের ট্রেন তার মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে হবে। সেই কারণে হাতে আর সময় নেই। তাড়াতাড়ি করে ফিরে আসলাম।
দুটো দিন কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না , নির্ভেজাল অক্সিজেন দুদিন ধরে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসলাম। মনে এক রোমাঞ্চকর আবেগ বেশ কিছুদিন ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। এখানকার স্মৃতি সত্যিই ভোলার নয়। এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
কিভাবে যাবেন :
হাওড়া থেকে প্রতিদিন সকাল ৬-৫৫ মিনিটে ছাড়ছে হাওড়া-তিতলাগড় ইস্পাত এক্সপ্রেস।ঘাটশিলায় পৌঁছয় বেলা ৯-৫৪ মিনিটে। ১২৮৬৫ আপ লালমাটি এক্সপ্রেস মঙ্গল ও শনিবার সকাল ৮-৩০ মিনিটে ছেড়ে ঘাটশিলায় পৌঁছয় ১১-৩৮ মিনিটে। ১২৮১৩ স্টিল এক্সপ্রেস বিকাল ১৭-৩০ মিনিটে হাওড়া ছেড়ে ঘাটশিলায় পৌঁছয় রাত ২০-৩৬ মিনিটে। এ ছাড়াও সকাল ৯-৩০ মিনিটে হাওড়া ছেড়ে একটি লোকাল ট্রেন ঘাটশিলা যাচ্ছে ১৩-৪০ মিনিটে। খড়্গপুর থেকেও ট্রেনে ঘাটশিলা যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন:
ঘাটশিলা স্টেশনের কাছে অজস্র হোটেল রয়েছে। দরদাম করে একটাতে উঠে পড়লেই হল। তবে আমার মতে সবথেকে ভালো হয় যদি রামকৃষ্ণ মিশনে আগে থেকে ব্যবস্থা করে থাকা যায়।
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ ১০- ১১-২০১৯
তারিখ ১০- ১১-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment