Sudipta Mukherjee's Blog

Saturday, January 11, 2020

মন্দারমণি>P

 লাল কাঁকড়ার দেশে 




অফিসে দু-তিনদিন ছুটি পেলেই বাঙালি মন ঘরে টিকতে চায় না।  কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য মন ছটফট করতে থাকে, আর যদি সেটা হয় শীতকাল, তবেতো কোনো কথাই নেই, ঘর ছেড়ে বেরোতেই হবে। অল্প সময়ের ছুটিতে ভ্রমনরসিকরা কাছাকাছি পাহাড়, জঙ্গল বা সমুদ্রের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। ভ্রমণের ব্যাপারে বাঙালির যে একটা প্রসিদ্ধি আছে, ভারতের অন্য রাজ্যের অধিবাসীদের বোধহয় সেটা নেই। ভ্রমণটা বাঙালির মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে রয়েছে। তেমনি এক অল্প শীতের ছুটির মুহূর্তে আমি সপরিবারে পাড়ি জমালাম পূর্ব মেদিনীপুরের এক সৈকতে।  বৈচিত্রময় পৃথিবীর দুটো জিনিস মানুষকে সবসময় অভিভূত করে। আকাশ আর সমুদ্র, দুটোই বিশাল আর অসীম। পার্থক্য হল, আকাশকে স্পর্শ করা যায় না, আর সমুদ্রকে শুধু স্পর্শ নয়, সর্ব শরীরকে তার কোলে নিমজ্জিত করা যায়।

 সূর্য্যোদয় 

পূর্ব মেদিনীপুরে বঙ্গোপসাগরের বুকে অনেকগুলো সৈকত রয়েছে, তাজপুর আর মন্দারমণি ছাড়া সব কটাই আমার দেখা হয়ে গেছে। তাই এবার চললাম লাল কাঁকড়ার দেশ মন্দারমণিতে। ব্যস্ত জীবনে একটু বিশ্রাম, একটু মুক্তির স্বাদ, আর সমুদ্রের মাতাল হাওয়ায় নিজেকে মাতাল করে তোলা। হালকা শীতল আবহাওয়া, সমুদ্রের শান্ত ঢেউ, মৃদু গর্জন, সেটা তো বিশ্রাম ও শান্তির আর এক নাম। দুচোখ ভরে শুধু দেখে যাওয়া আর মন ভরে শুধু বিশুদ্ধ নিশ্বাস নেওয়া।

শীতের এক সকালে ধর্মতলা থেকে দিঘাগামী বাস ধরে চাউলখোলাতে পৌঁছলাম। প্রায় ১৮০ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে ঘন্টা চারেক সময় লাগলো।  এখান থেকে ভ্যান রিক্সা ধরে মন্দারমণি আসলাম।  রাস্তার ধারে অজস্র হোটেল। একটু ঘোরাঘুরি করে একটা হোটেলে সমুদ্রের দিকে একটা ভালো ঘর পেয়ে গেলাম।  ঘরে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়েই ছুট লাগলাম সৈকতে।  সামনে দিগন্ত বিস্তীর্ন ঘন নীল আকাশ, বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশি, ঝাউয়ের হাতছানি  আর নিরালা সাগরবেলা।  সমুদ্র উপকূলের নয়নাভিরাম দৃশ্য সার্বিকভাবে আমাদের মন ভরিয়ে দিল। এখানকার সমুদ্রতট সমান হওয়ার জন্য দেখলাম দুদিকেই বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। তটটিও বেশ  পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

মাছ ধরার নৌকো 

হোটেলে ফিরে  দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফিরে এলাম তটভূমিতে। তখন ভাটা  চলছে, সৈকতের বেশিরভাগ অঞ্চলটাই দৃশ্যমান, বালুকাতটে লাল কাঁকড়ার মিছিল, দূর থেকে মনে হচ্ছে অনেকটা জায়গা জুড়ে কে যেন টকটকে লাল আবির  ছড়িয়ে দিয়েছে।  সামান্য পায়ের আওয়াজেই তারা বালির গর্তে লুকিয়ে পড়ছে, চলছে তাদের লুকোচুরি খেলা।  সমুদ্রের তটভূমি  ধরে বেশ কিছুক্ষন হাঁটলাম।  রোদ ঝলমলে দুপুরের পর সৈকতে বিকেলের পড়ন্ত রোদ এসে পড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে আলো কমে আসতে লাগল, লালচে আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সমগ্র সৈকতজুড়ে, সূর্য্যিমামাও পশ্চিমপাড়ে ঝাউয়ের বনে ঢোলে পড়লো। অনেক্ষন হাঁটার ফলে আমরাও কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। দীঘার থেকে ঝাউয়ের বন এখানে একটু কম বলেই আমার মনে হলো, তও যা রয়েছে তা এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে। আমরা পাকোড়া ও চা খেয়ে অঞ্চলটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, সৈকতের ধারেই বেশ বড় একটা বাজার রয়েছে যেখানে নানারকম খেলনা, শামুকের তৈরী মূর্তি, কাপড়ের ব্যাগ আরো অনেক কিছু বিক্রি হচ্ছে, বিক্রি হচ্ছে মেয়েদের অলংকারও। সব সমুদ্র সৈকতের মতো এখানেও  ভাজা মাছ বিক্রি চলছে। বহু স্থানীয় বাসিন্দাদের দেখলাম তেলেভাজা ও মুড়ি কিনছে। ওদের দেখা দেখি কয়েকজন পর্যটকও গরম গরম তেলেভাজার স্বাদ নিচ্ছে। বহু পর্যটককে দেখলাম নানারকম জিনিস কিনছে। এখানে বিকি-কিনি বেশ ভালোই হচ্ছে বলে আমার মনে হলো। আমার গিন্নি  একটা সুন্দর পুঁথির মালা ও কানের দুল কিনলো, জানিনা নিজের জন্য না অন্য কারোকে উপহার দেবে।  এবার হোটেলের পথ ধরলাম।

সৈকত 

ঘর থেকেই দেখছিলাম চাঁদের আলোয় বেলাভূমির বালিগুলো হীরের মতো চিক্চিক করছে। ভাবছিলাম জ্যোস্না রাতে বেলাভূমিটি নিশ্চয় আরো ঝিকমিক করে, তখন নিশ্চয় আরো অপরূপা লাগে। জ্যোস্ন্যা রাতের সমুদ্রের সৌন্দর্য্য পৃথিবীর যে কোনো সৌন্দর্যকে হার মানায়। রাত যত বাড়ছে সমুদ্রের গর্জন তত হুঙ্কার ছাড়ছে। যদিও দীঘা বা পুরীর তুলনায় সেটা অনেকটাই কম। দীঘার কোলাহল পরিবেশ আর এখানকার শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ দুটো পাশাপাশি সৈকতের মধ্যে কতটা ফারাক। এখানকার পরিবেশের সাথে ঈশ্বর যেন এখানকার ঢেউগুলোকেও শান্ত করে দিয়েছে। মন্দারমণি ও তাজপুর পশ্চিমবঙ্গের নতুন আবিষ্কৃত সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম। মন্দারমণির সৈকত বেশ শক্ত, পূর্বে এই সৈকত ধরে গাড়ি যাতায়াত করতো, বর্তমানে  সরকারি তরফ থেকে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

মোহনায় বাঁক কাঁধে জেলে 

ছোট ছোট চারটি গ্রাম নিয়ে তৈরী এই মন্দারমণি। .সমুদ্রতীরবর্তী গ্রামগুলোতে এককালে নোনা জলের বেশ কিছু ভেড়ি ছিল। এইসব ভেরিগুলোতে জেলেদের ও মাছের ব্যবসাদারদের আনাগোনা বরাবরই ছিল, কিন্তু ছিল না তাদের বসবাসের কোনোরূপ আস্তানা। এই মাছ ব্যবসায়ীদের উৎসাহে প্রথম এখানে হোটেল তৈরী হয়, পরবর্তীকালে পর্যটকদের অগমনে হোটেল ব্যবসা ও হোটেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।  মন্দারমণি এই নাম নিয়ে অনেকরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কেউ বলে অঞ্চলটি মন্দার গাছে ঘেরা ছিল বলে এই নামকরণ আবার কারো কারো মতে বিশাল সৈকতে হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার দলবদ্ধ দৌড় দেখে কোনো এক সময়ে এখানকার উচ্চপদস্থ কোনো সরকারি আধিকারিক মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর চোখে দৃশ্যটা মন্দার ফুলের মতো লেগেছিল বলে তিনি নাকি এইরূপ নামকরণ করেছিলেন। প্রথমদিকে জায়গাটির নাম ছিল মন্দারবনি, পরবর্তীকালে মদার মণি আর বর্তমানে মন্দারমণি হয়েছে।  বছর কুড়ি আগে জায়গাটা পূর্ব মেদিনীপুরের এক অখ্যাত গ্রাম ছিল।  তার আপন রূপের কারণেই সে আজ সকলের মন জয় করে নিয়েছে।

সৈকত 

পরেরদিন কাক ভোরে উঠে বেলাভূমিতে গেলাম। আবছা আলোয় হাঁটতে থাকলাম। আলো-আধারিতে বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, সারি সারি ঝাউ গাছ, সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউ, পশ্চিমপাড়ে সারিবদ্ধভাবে হোটেল, দিগন্তে জলরাশি ভেদ করে রক্তবর্ণের এক থালা ছোট থেকে বড় হতে লাগল, ধীরে ধীরে তার উজ্জ্বলতা বাড়তে লাগলো, চারপাশের লাল আভা আস্তে আস্তে সাদা হতে লাগল। একটার পর একটা ক্লান্তিহীন ঢেউ বালিয়াড়িতে আছড়ে পড়ছে, জলে পা ভিজিয়ে হেঁটে যাওয়া, এক মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভেসে যাওয়া। জলখাবার খেয়ে হোটেলের ঘরে একটু বিশ্রাম নিয়ে তোয়ালে কাঁধে সমুদ্র স্নানের উদ্দেশ্যে চললাম।

শরীরটাকে কিছুটা নিমজ্জিত করে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকলাম, ক্ষনে ক্ষনে শীতল ঢেউ সমগ্র শরীরকে ভিজিয়ে যাচ্ছে, অনুভব করছি সমুদ্র স্নানের তৃপ্তি। ঢেউগুলো যেন বহুদূর থেকে উড়ে আসা একরাশ শিমুল তুলো, আমি যেন এক ধুনুরির ধনুক, সমানে বুনে চলেছি নকশিকাঁথার বালুচর। আমি আর নেই আমাতে, মিশে গেছি নীল সাগরের অতল জলে।  যতদূর চোখ যায় শুধু ঢেউ আর ঢেউ। ঢেউয়ের তালে তালে আমিও কখনও  এগিয়ে যাচ্ছে আবার কখনও  পিছিয়ে যাচ্ছি, এক মিনিটের জন্য এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছি না। নীল জলের গহন রহস্যে নিজেকে সমানে সামলে চলতে হচ্ছে। আমার মতো অনেকেই স্নান করছে।  লাফালাফি, ঝাপাঝাপি, বেলেল্লেপনা সবই চলছে, চলছে যুবক যুবতীদেরদের বাঁদরামীও। সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ে মনে চলছে অনাবিল আনন্দের ঢেউ। বাচ্ছা বুড়ো সবার মুখেই সেই আনন্দের অভিব্যক্তি ফুটে উঠছে। দুটো পয়সার আশায় কয়েকজন আলোকচিত্রীও ছোটাছুটি করে এইসব দৃশ্যের ছবি তুলছে।

মোহনায় সূর্যাস্ত 


হোটেলে  দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে একটা অটো  ভাড়া নিয়ে চললাম মোহনা দেখতে।  মন্দারমণি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে এই মোহনা অবস্থিত। বিচের শেষে জলধা খতি নদীর কূলে এখনকার মোহনা। মোহনার বালিয়াড়ি খুব নরম।  দীঘার মোহনার মতো এখানে কোনো মাছের আড়ৎ নেই, মাঝে মাঝে ছোট ছোট মাছ ভর্তি নৌকো এসে ভিড়ছে।  জেলেরা বাঁক কাঁধে সেই মাছ নিয়ে ছোটগাড়িতে তুলছে। শুনলাম এই মাছ চলে যাচ্ছে দীঘা মোহনার বাজারে।  মাছ আর মাঝিভাইদের আনাগোনায় জায়গাটা বেশ মনোরম লাগছিলো। এখানেই একটু অপেক্ষা করে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। পড়ন্ত বিকেলে আকাশকে চিরে সূৰ্য্যিমামা চারদিক লাল-কমলায় রাঙিয়ে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। আজকের মতো তার কাজ শেষ। রাতটুকু চাঁদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে যেন তার এই গমন। এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত দৃশ্য বিস্ময়ে  বিমুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকলাম। গভীর আবেশে মন প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। জলধা খতি নদীর একপাশে মন্দারমণির মোহনা আর অপরপাড়ে তাজপুর। দূরে বঙ্গোপসাগর।

.রাতে খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। পরেরদিন সকালে আবার সৈকতের বুকে সূর্য্যোদয়  উপভোগ করলাম। শান্ত নির্জন সৈকতে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগলো। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বেশিক্ষন থাকা গেলো না ফেরার তারায়।  আজ আমাদের ফেরার পালা, দুপুরের খাবার খেয়ে একটা অটো  ধরে কাঁথি স্টেশানে চলে এলাম। এখান  থেকেই ট্রেন ধরে কলকাতার উদ্যেশ্যে রওয়ানা দিলাম।


নিরালা  পরিবেশে মন্দারমণি ঘোরা সত্যি মনোরম। দুটো দিন এই নিরিবিলি জায়গায় কাটাতে মন্দ লাগলো না। শান্ত, নির্জন সমুদ্রে মন পেল বিশ্রাম, প্রাণ পেল আরাম। যেন এক ক্যানভাসে আঁকা কোনো শিল্পীর তুলিতে উঠে আসা সব দৃশ্য। যা নির্ভেজাল ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা। দীঘার  ভিড় এড়িয়ে সমুদ্র ভ্রমণের অবশ্যই আদর্শ ঠিকানা এই শান্ত সৈকতটি। সমুদ্রের পেট চিরে সূর্য্যের উদয় হওয়া  আর পশ্চিমপাড়ে সূর্য্যের হারিয়ে যাওয়ার মনভোলানো দৃশ্য যা আমার কাছে সারাজীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। সমুদ্রকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার জন্য এখানকার নিরিবিলি পরিবেশে  দুটো দিন কাটাতে আপনারও বেশ ভালো লাগবে।



কিভাবে যাবেন :
কলকাতার ধর্মতলা থেকে দীঘাগামী বসে করে এসে চাউলখোলাতে নামুন। ওখান থেকে অটো করে অনায়াসে পৌঁছে যাবেন। অথবা হাওড়া থেকে দীঘার ট্রেন ধরে রামনগর বা কাঁথি স্টেশনে নামুন।  ওখান থেকে অটো ধরে মন্দারমণি চলে আসুন।

কোথায় থাকবেন :

অনেক হোটেল রয়েছে, তবে আগে থেকে বুক করে যাওয়া ভালো।

কোথায় কোথায় ঘুরবেন :

মন্দারমণি থেকে আপনি দীঘা, তাজপুর, শংকরপুর, দীঘার  মোহনা অটো ভাড়া করে দেখে আসতে  পারেন।


ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ১১-০১-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




No comments:

Post a Comment