সচল বিশ্বনাথ
"দেখলাম সাক্ষাৎ বিশ্বনাথ তাঁহার শরীরটা আশ্রয় করে প্রকাশিত হয়ে রয়েছেন। তাঁর থাকায় কাশী উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। উঁচু জ্ঞানের অবস্থা। শরীরের কোনো হুশই নেই, রোদে বালি এমনি তেতেছে যে, পা দেয় কার সাধ্য - সেই বালির ওপরেই সুখে শুয়ে আছেন। পায়েস রেঁধে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম। তখন কথা কন না - মৌনী। ইশারায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঈশ্বর এক না অনেক? তাতে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন - সমাধিস্থ হয়ে দেখ তো এক, নইলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদি নানা জ্ঞান রয়েছে, ততক্ষন অনেক। তাঁকে দেখিয়ে হৃদেকে বলেছিলাম, একেই ঠিক ঠিক পরমহংস অবস্থা বলে।"
- ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব
"দেখলাম সাক্ষাৎ বিশ্বনাথ তাঁহার শরীরটা আশ্রয় করে প্রকাশিত হয়ে রয়েছেন। তাঁর থাকায় কাশী উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। উঁচু জ্ঞানের অবস্থা। শরীরের কোনো হুশই নেই, রোদে বালি এমনি তেতেছে যে, পা দেয় কার সাধ্য - সেই বালির ওপরেই সুখে শুয়ে আছেন। পায়েস রেঁধে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম। তখন কথা কন না - মৌনী। ইশারায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঈশ্বর এক না অনেক? তাতে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন - সমাধিস্থ হয়ে দেখ তো এক, নইলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদি নানা জ্ঞান রয়েছে, ততক্ষন অনেক। তাঁকে দেখিয়ে হৃদেকে বলেছিলাম, একেই ঠিক ঠিক পরমহংস অবস্থা বলে।"
- ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব
"সন্ন্যাসী হয়ে যদি উলঙ্গ থাকবে, তবে এই জনাকীর্ণ তীর্থস্থান ত্যাগ করে জঙ্গলে গিয়ে বাস করো।" মহিলাটি দীপ্তকণ্ঠে বেশ কয়েকবার কথাগুলো বলল তার সামনে দিয়ে আগত এক উলঙ্গ সন্ন্যাসীটিকে। কিন্তু তাতে সন্ন্যাসীটির কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এই উলঙ্গ সন্ন্যাসী তখন হনুমান ঘটে বাস করেন। এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মহারাষ্ট্রীয় মহিলা এই ঘাটের পথ ধরে বাবা বিশ্বনাথের পুজো দিতে রোজই যেতেন। একদিন এক সরু গলি দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি এই সন্ন্যাসীকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় দেখে উপরোক্ত শ্লেষপূর্ণ তিরস্কারে তিরস্কৃত করেছিলেন। মহিলাটির স্বামীর পেটে বিরাট ক্ষত, ডাক্তার বদ্যিরা সব তাদের অক্ষমতা জানিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর রোগমুক্তির আশায় তিনি রোজ্ গঙ্গা স্নান করে বাবা বিশ্বনাথের পুজো দিতে যেতেন। তিরস্কার করার দিন রাতে তিনি এক স্বপ্ন দেখেছিলেন যে স্বয়ং মহাদেব তাকে বলছেন, "যে উদ্দেশ্য নিয়ে তুই রোজ আমার পুজো করিস, তোর সেই উদ্দেশ্য আমি সফল করতে পারবো না।" আরো বললেন "আজ তুই যে উলঙ্গ মহাযোগীকে অপমান করেছিস তার কৃপা পেলেই তোর মনোস্কামনা পূর্ণ হবে।" পরদিন সকাল বেলায় মহিলাটি হনুমান ঘাটে গিয়ে মহাযোগীর পা ধরে ক্ষমা চাইলেন আর তার স্বামীর প্রাণভিক্ষাও চাইলেন। মহাযোগী তাকে ক্ষমা করলেন। স্বামীজী এক মুঠো ভস্ম তাকে দিয়ে বললেন স্বামীর দেহে পুরো ভস্মটি মাখিয়ে দিতে। এই ভস্ম মাখানোর পর তার স্বামী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন।
সেই প্রাচীন কাল থেকেই কাশীতে কত সাধক-মহাসাধকদের পদধূলি পড়েছে। নানা বইতে নানা আলোচনায় তাঁদের অলৌকিক মহিমার কথা উঠে এসেছে। মহাত্মা মহাযোগী তৈলঙ্গস্বামীর বহু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী এই দেবভূমি। প্রায় ১৫০ বছর তিনি কাশীতে বসবাস করেছেন। অলৌকিক শক্তির অধিকারী এক মহাযোগী। তাঁর সময় যত ভক্ত ও সাধক কাশীতে এসেছিলেন তাঁরা বাবা বিশ্বনাথ, দেবী অন্নপূর্ণা, মণিকর্ণিকা ঘাট ও দশাশ্বমেধ ঘাট দর্শন করার পর এই মহাত্মাকে দর্শন করে কাশী ত্যাগ করতেন। কাশীর অধিবাসীরা তাঁকে "সচল বিশ্বনাথ" নামকরণ করেছিলেন।
তৈলঙ্গস্বামীর সন্ন্যাস নেওয়ার পূর্বে নাম ছিল "শিবরাম" আর সন্ন্যাস নেওয়ার পর নাম হয়েছিল "গণপতি সরস্বতী"। তৈলঙ্গ দেশ থেকে আগত বলে তিনি কাশীর মানুষদের কাছে তৈলঙ্গস্বামী হিসেবে পরিচিত হলেন। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের হোলিয়া জনপদে এক রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নরসিংহ রাও ওই জনপদের রাজা ছিলেন। খুব সৎ ও ধর্মপরায়ণ রাজা ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বিদ্যাবতীও খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন। প্রতিদিন তাঁরা শিবের আরাধনা, ব্রাহ্মণ সেবা, দেবদেবীর পূজা করতেন। দীর্ঘদিন তাঁদের কোনো সন্তান হচ্ছিলো না, নরসিংহ বংশরক্ষার জন্য খুব চিন্তিত ছিলেন। একপ্রকার বাধ্য হইয়াই তিনি বিদ্যাবতীর অনুমতি নিয়ে দ্বতীয়বার বিবাহ করেন। দেবদেবীর কৃপায় ও মহাদেবের করুণায় ১৬০৭ সালের এক পুন্য লগ্নে নরসিংহের প্রথম স্ত্রী বিদ্যাবতী এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। শিবের পূজারী বিদ্যাবতী সন্তানের নাম রাখলেন "শিবরাম"। পরবর্তীকালে অবশ্য রাজা নরসিংহের দ্বিতীয় স্ত্রীও একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। সেই পুত্রের নাম ছিল শ্রীধর। বালক বয়স থেকেই শিবরাম মায়ের পুজোর সময় পাশে বসে সব লক্ষ্য করতেন। বালক বয়স থেকেই তিনি খুব গম্ভীর স্বভাবের ছিলেন। অন্যান্য বালকদের মত তাঁর খেলাধুলায় কোনোরূপ আগ্রহ ছিল না। শুধু বাল্যকাল নয়, কৈশোরে, যৌবনকালে সব ব্যাপারে তিনি সবসময় উদাসীন থাকতেন। বিষয়, সম্পত্তি ও সংসারের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। ৪০ বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান, ৫০ বছর বয়সে মাতাকেও হারান। মাকে হারানোর পর তিনি খুব ভেঙে পড়েন। তিনি সংসার ছেড়ে শ্মশানে এসে একটি পর্ণকুটির তৈরী করে বাস করতে থাকেন। ভ্রাতা শ্রীধর ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সকলেই তাঁকে কুটির ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। সকলের অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করে এই কুটিরেই বাস করতে লাগলেন। এই কুটিরেই একদিন পাঞ্জাবের বাস্তুর গ্রামের যোগগুরু স্বামী ভোগীরথানন্দ সরস্বতী আসলেন। পরবর্তীকালে এই যোগীর কাছ থেকে শিবরাম সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। সন্ন্যাস নেওয়ার পর তিনি গুরুর নির্দেশে পর্যটনে বাহির হলেন। রামেশ্বর, নেপাল, উত্তরাখন্ড, প্রয়াগ ঘুরে ১৮৪৪ সালে তিনি কাশীতে এসে পৌঁছলেন। কঠোর সাধনায় এবং গুরুর কৃপায় তিনি হয়ে উঠলেন মহাশক্তিধর যোগগুরু। কাশীতে এসে প্রথমে আসিঘাটে গোস্বামী তুলসীদাসের বাগানে বাস করতে আরম্ভ করলেন। তারপর হনুমান ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট আর সবশেষে পঞ্চগঙ্গা ঘাটে বাস করতে লাগলেন। তাঁর মুখে শিব আরাধনার স্ত্রোত্র শুনতে কাশীর ঘাটে প্রচুর লোক সমাগম হতো। কাশীর ঘাটে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে তাঁর মহিমা ছড়িয়ে আছে। তাঁর অলৌকিক কান্ডকারখানার সাক্ষী থাকতো কাশীর অধিবাসীরা। নগ্ন হয়েই তিনি ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর আরো দুটো -তিনটি অলৌকিক মহিমার গল্প আজ আপনাদের জনাব।
স্বামীজী যখন আসি ঘাটে বাস করতেন, তখন তিনি প্রায়ই লোলার্ক কুন্ডে যেতেন। একদিন তিনি ওখানে গিয়ে দেখেন ব্রহ্মসিংহ নামে আজমীরের এক বাসিন্দা কুষ্ঠরোগে পঙ্গু হয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করছেন। এই দৃশ্য দেখে মহাযোগীর করুণা হল, তিনি সস্নেহে একটা বেলপাতা ব্রহ্মসিংহকে দিয়ে বললেন "কোন চিন্তা করো না. তুমি লোলার্ক কুন্ডে স্নান করে এসে এই বেলপাতাটি মাথায় ধারণ করলে তোমার সব রোগ সেরে যাবে।" ব্রহ্মসিংহ স্বামীজীর কথা মতো লোলার্ক কুন্ডে স্নান করে এসে মাথায় বেলপাতা ধারণ করলেন এবং অচিরেই রোগমুক্ত হলেন।
মহাযোগী একদিন আসি ঘাটে পৌঁছে দেখলেন একজন তরুণী তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে উচ্চকন্ঠে কাঁদছেন। সাপের কামড়ে তার স্বামী মারা গেছেন। যেহেতু সাপে কাটা মৃতদেহকে শশ্বানে পোড়ানো হয় না, তাই তার আত্মীয়রা গঙ্গার ভাসানোর উদ্দেশ্যে আসি ঘাটে মৃতদেহটি নিয়ে এসেছে। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে পরম দয়ালু স্বামীজী মনে মনে খুব কষ্ট অনুভব করলেন। স্বামীজী নদীর ধার থেকে কিছুটা গঙ্গামাটি নিয়ে এসে মৃতদেহের ক্ষতস্থানে মাখাইয়া দিলেন। কিছুক্ষন পর সবাই দেখল আস্তে আস্তে দেহে প্রাণ সঞ্চার হতে লাগল। সবাই এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তরুণীটিও তার জীবনসাথীকে ফিরে পেল।
একবার এক বদমেজাজের নতুন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কাশীতে এলেন। তিনি একদিন নগর পরিক্রমায় বেড়িয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে তিনি এক উলঙ্গ স্বামীজিকে দেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। হাজতের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ও কয়েকজন রক্ষীকে ডেকে পাঠালেন এবং আদেশ দিলেন এই অসভ্য লোকটাকে ধরে হাজতে পাঠাবার জন্য। সবাই মিলে স্বামীজিকে ধরে হাজতে তালাবন্ধ করে রাখলেন। স্বামীজী তখন ভাবলেশহীন। পরদিন সকালে ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীজিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাঁর ঘরে গিয়ে দেখলেন যে ঘর ফাঁকা, স্বামীজী বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘরে যেমন তালা লাগানো ছিল, তেমনি লাগানো রয়েছে। তিনি ঘরটির দরজা, দেওয়াল ও তালা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন, সব ঠিকই রয়েছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারলেন না কিভাবে কয়েদি ঘরের বাইরে আসল। তিনি বেশ গম্ভীরভাবে স্বামীজিকে বললেন, "সাধু, তুমি সত্য কথা বল, কি করে তুমি হাজতের বাইরে এলে?" স্বামীজী সহজ সরল ভাষায় বললেন "প্রত্যুষে আমার বাইরে আসবার ইচ্ছে হয়েছিল। সেই ইচ্ছে হবার পরমুহূর্তে বাইরে এসে পড়লাম, কোনো বাধা কোথাও পেলাম না।" কয়েদির ঘরটি জলে জলময় হয়েছিল। মেজিস্ট্রেট স্বামীজীর কাছে জানতে চাইলেন এতো জল কিভাবে এখানে এলো। স্বামীজী বললেন, "রাতে আমার প্রস্রাবের বেগ হয়েছিল, দেখলাম দ্বার তালাবন্ধ, ঘরের বাইরে যেতে তখন ইচ্ছে হয়নি, তাই শায়িত অবস্থাতেই খানিকটা মূত্রত্যাগ করেছি। তারপর রাত হয়ে এলে, অন্ধকার ঘরটা তেমন আমার ভালো লাগছিল না , তাই মুক্ত হাওয়ায় এই বারান্দায় একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি।" মেজিস্ট্রেট ভীষণ রেগে গেলেন, তিনি স্বামীজিকে আবার হাজতে পুড়ে নিজের হাতে দু-দুটো তালা লাগিয়ে তার এজলাসে চলে এলেন। কিছুক্ষন পরে তিনি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন। তিনি যাকে নিজের হাতে তালাবন্ধ করে এলেন, সেই স্বামীজী তার এজলাসের এক কোনে বসে দুষ্টু বালকের মতো হাসছেন। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে মেজিস্ট্রেট হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। স্বামীজী আস্তে আস্তে তার সামনে এসে বললেন "সাহেব, তুমি অন্যান্য সাধারণ মানুষের মত শুধু জড় ও জড়ের শক্তিই বোঝো। এই জগতের মধ্যে ওতপ্রোত হয়ে আছে এক চৈতন্যলোক, তার খবর তোমার মোটেই জানা নেই, সেই চৈতন্যলোকের সঙ্গে যার যোগাযোগ সাধিত হয়েছে, কোনো বন্ধন বা কোনো বাঁধাই আর তার স্বেচ্ছাবিহারকে আটকাতে পারে না। ভারতের যোগীপুরুষদের শক্তির কাছে পৃথিবীর কোনো কার্যই কখনো অসাধ্য বলে গণ্য হয় না। বেটা, তাহলে বল দেখি , আমার মতো সাধু সন্ন্যাসীকে বিরক্ত করে কি লাভ ? তাছাড়া, সে শক্তিই বা তোর আছে কোই ?" মেজিস্ট্রেট তখন তার ভুল বুঝতে পারলেন এবং তিনি নির্দেশ দিলেন যে কাশী শহরে তৈলঙ্গস্বামী নিজের ইচ্ছামত যেখানে খুশি ঘুরতে পারবেন। তাঁকে কেউ বাধা দিতে পারবে না।
কখনো তাঁকে কাশীর গঙ্গায় ভাসমান আবার কখনো ডুবন্ত অবস্থায় দেখা যেত। গঙ্গার সাথে তাঁর যেন অন্তরের সম্পর্ক ছিল। এরকম বহু লীলা বা মহিমা স্বামীজী দেড়শো বছর ধরে দেবভূমিতে করে গেছেন। সাধারণ সাধু সন্ন্যাসীদের জীবন সাধারণত শিষ্যবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু তৈলঙ্গস্বামীর সে অর্থে কোন শিষ্য ছিল না। উমাচরণ মুখোপাধ্যায়ের নামই একমাত্র শিষ্য হিসেবে শোনা যায়, তবে তাঁর প্রচুর ভক্ত ছিলেন। । ১৮৮৭ সালের পৌষ মাসের শুক্লা একাদশীর পুন্য তিথিতে স্বইচ্ছায় ২৮০ বছর বয়সে তিনি যোগবলে দেহরক্ষা করেন অর্থাৎ প্রয়াত হন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ভক্তদের বলে গিয়েছিলেন তাকে চন্দনকাঠের বাক্সে ভোরে গঙ্গা সমাধি দেওয়ার কথা তাঁর ইচ্ছাই ভক্তগণ পূরণ করেন।
১৮৬৮ সালে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব কাশীতে যখন এসেছিলেন তখন তিনি তৈলঙ্গস্বামীর সাথে দেখা করেছিলেন এবং নিজ হাতে তৈরী করা পায়েস স্বামীজিকে খাইয়েছিলেন। যোগী শ্যামাচরণ লাহিড়ীও স্বামীজীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
মহাত্মা তৈলঙ্গস্বামী ছিলেন ভারতের সাধকদের মধ্যে একজন উজ্জ্বল জোতিস্ক। প্রথম বিস্ময় তাঁর দীর্ঘ আয়ু। আরো বিস্ময় অলৌকিক ক্ষমতাবলে মানবের জীবন দান ও হিতসাধন করা। তবে এটা চিরন্তন সত্য যে মানব কল্যানে ব্রতী হয়ে ভারতবর্যে যুগে যুগে ঈশ্বর বিভিন্ন অবতারের রূপ ধরে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। কখনও বুদ্ধ, কখনও যিশু আবার কখনও শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস। তেমনি তৈলঙ্গস্বামীকেও ভগবানের এক রূপ বলে মানব সমাজ মেনে নিয়েছে।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ২৫-০১-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
সেই প্রাচীন কাল থেকেই কাশীতে কত সাধক-মহাসাধকদের পদধূলি পড়েছে। নানা বইতে নানা আলোচনায় তাঁদের অলৌকিক মহিমার কথা উঠে এসেছে। মহাত্মা মহাযোগী তৈলঙ্গস্বামীর বহু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী এই দেবভূমি। প্রায় ১৫০ বছর তিনি কাশীতে বসবাস করেছেন। অলৌকিক শক্তির অধিকারী এক মহাযোগী। তাঁর সময় যত ভক্ত ও সাধক কাশীতে এসেছিলেন তাঁরা বাবা বিশ্বনাথ, দেবী অন্নপূর্ণা, মণিকর্ণিকা ঘাট ও দশাশ্বমেধ ঘাট দর্শন করার পর এই মহাত্মাকে দর্শন করে কাশী ত্যাগ করতেন। কাশীর অধিবাসীরা তাঁকে "সচল বিশ্বনাথ" নামকরণ করেছিলেন।
তৈলঙ্গস্বামীর সন্ন্যাস নেওয়ার পূর্বে নাম ছিল "শিবরাম" আর সন্ন্যাস নেওয়ার পর নাম হয়েছিল "গণপতি সরস্বতী"। তৈলঙ্গ দেশ থেকে আগত বলে তিনি কাশীর মানুষদের কাছে তৈলঙ্গস্বামী হিসেবে পরিচিত হলেন। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের হোলিয়া জনপদে এক রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নরসিংহ রাও ওই জনপদের রাজা ছিলেন। খুব সৎ ও ধর্মপরায়ণ রাজা ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বিদ্যাবতীও খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন। প্রতিদিন তাঁরা শিবের আরাধনা, ব্রাহ্মণ সেবা, দেবদেবীর পূজা করতেন। দীর্ঘদিন তাঁদের কোনো সন্তান হচ্ছিলো না, নরসিংহ বংশরক্ষার জন্য খুব চিন্তিত ছিলেন। একপ্রকার বাধ্য হইয়াই তিনি বিদ্যাবতীর অনুমতি নিয়ে দ্বতীয়বার বিবাহ করেন। দেবদেবীর কৃপায় ও মহাদেবের করুণায় ১৬০৭ সালের এক পুন্য লগ্নে নরসিংহের প্রথম স্ত্রী বিদ্যাবতী এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। শিবের পূজারী বিদ্যাবতী সন্তানের নাম রাখলেন "শিবরাম"। পরবর্তীকালে অবশ্য রাজা নরসিংহের দ্বিতীয় স্ত্রীও একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। সেই পুত্রের নাম ছিল শ্রীধর। বালক বয়স থেকেই শিবরাম মায়ের পুজোর সময় পাশে বসে সব লক্ষ্য করতেন। বালক বয়স থেকেই তিনি খুব গম্ভীর স্বভাবের ছিলেন। অন্যান্য বালকদের মত তাঁর খেলাধুলায় কোনোরূপ আগ্রহ ছিল না। শুধু বাল্যকাল নয়, কৈশোরে, যৌবনকালে সব ব্যাপারে তিনি সবসময় উদাসীন থাকতেন। বিষয়, সম্পত্তি ও সংসারের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। ৪০ বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান, ৫০ বছর বয়সে মাতাকেও হারান। মাকে হারানোর পর তিনি খুব ভেঙে পড়েন। তিনি সংসার ছেড়ে শ্মশানে এসে একটি পর্ণকুটির তৈরী করে বাস করতে থাকেন। ভ্রাতা শ্রীধর ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সকলেই তাঁকে কুটির ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। সকলের অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করে এই কুটিরেই বাস করতে লাগলেন। এই কুটিরেই একদিন পাঞ্জাবের বাস্তুর গ্রামের যোগগুরু স্বামী ভোগীরথানন্দ সরস্বতী আসলেন। পরবর্তীকালে এই যোগীর কাছ থেকে শিবরাম সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। সন্ন্যাস নেওয়ার পর তিনি গুরুর নির্দেশে পর্যটনে বাহির হলেন। রামেশ্বর, নেপাল, উত্তরাখন্ড, প্রয়াগ ঘুরে ১৮৪৪ সালে তিনি কাশীতে এসে পৌঁছলেন। কঠোর সাধনায় এবং গুরুর কৃপায় তিনি হয়ে উঠলেন মহাশক্তিধর যোগগুরু। কাশীতে এসে প্রথমে আসিঘাটে গোস্বামী তুলসীদাসের বাগানে বাস করতে আরম্ভ করলেন। তারপর হনুমান ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট আর সবশেষে পঞ্চগঙ্গা ঘাটে বাস করতে লাগলেন। তাঁর মুখে শিব আরাধনার স্ত্রোত্র শুনতে কাশীর ঘাটে প্রচুর লোক সমাগম হতো। কাশীর ঘাটে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে তাঁর মহিমা ছড়িয়ে আছে। তাঁর অলৌকিক কান্ডকারখানার সাক্ষী থাকতো কাশীর অধিবাসীরা। নগ্ন হয়েই তিনি ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর আরো দুটো -তিনটি অলৌকিক মহিমার গল্প আজ আপনাদের জনাব।
স্বামীজী যখন আসি ঘাটে বাস করতেন, তখন তিনি প্রায়ই লোলার্ক কুন্ডে যেতেন। একদিন তিনি ওখানে গিয়ে দেখেন ব্রহ্মসিংহ নামে আজমীরের এক বাসিন্দা কুষ্ঠরোগে পঙ্গু হয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করছেন। এই দৃশ্য দেখে মহাযোগীর করুণা হল, তিনি সস্নেহে একটা বেলপাতা ব্রহ্মসিংহকে দিয়ে বললেন "কোন চিন্তা করো না. তুমি লোলার্ক কুন্ডে স্নান করে এসে এই বেলপাতাটি মাথায় ধারণ করলে তোমার সব রোগ সেরে যাবে।" ব্রহ্মসিংহ স্বামীজীর কথা মতো লোলার্ক কুন্ডে স্নান করে এসে মাথায় বেলপাতা ধারণ করলেন এবং অচিরেই রোগমুক্ত হলেন।
মহাযোগী একদিন আসি ঘাটে পৌঁছে দেখলেন একজন তরুণী তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে উচ্চকন্ঠে কাঁদছেন। সাপের কামড়ে তার স্বামী মারা গেছেন। যেহেতু সাপে কাটা মৃতদেহকে শশ্বানে পোড়ানো হয় না, তাই তার আত্মীয়রা গঙ্গার ভাসানোর উদ্দেশ্যে আসি ঘাটে মৃতদেহটি নিয়ে এসেছে। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে পরম দয়ালু স্বামীজী মনে মনে খুব কষ্ট অনুভব করলেন। স্বামীজী নদীর ধার থেকে কিছুটা গঙ্গামাটি নিয়ে এসে মৃতদেহের ক্ষতস্থানে মাখাইয়া দিলেন। কিছুক্ষন পর সবাই দেখল আস্তে আস্তে দেহে প্রাণ সঞ্চার হতে লাগল। সবাই এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তরুণীটিও তার জীবনসাথীকে ফিরে পেল।
একবার এক বদমেজাজের নতুন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কাশীতে এলেন। তিনি একদিন নগর পরিক্রমায় বেড়িয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে তিনি এক উলঙ্গ স্বামীজিকে দেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। হাজতের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ও কয়েকজন রক্ষীকে ডেকে পাঠালেন এবং আদেশ দিলেন এই অসভ্য লোকটাকে ধরে হাজতে পাঠাবার জন্য। সবাই মিলে স্বামীজিকে ধরে হাজতে তালাবন্ধ করে রাখলেন। স্বামীজী তখন ভাবলেশহীন। পরদিন সকালে ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীজিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাঁর ঘরে গিয়ে দেখলেন যে ঘর ফাঁকা, স্বামীজী বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘরে যেমন তালা লাগানো ছিল, তেমনি লাগানো রয়েছে। তিনি ঘরটির দরজা, দেওয়াল ও তালা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন, সব ঠিকই রয়েছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারলেন না কিভাবে কয়েদি ঘরের বাইরে আসল। তিনি বেশ গম্ভীরভাবে স্বামীজিকে বললেন, "সাধু, তুমি সত্য কথা বল, কি করে তুমি হাজতের বাইরে এলে?" স্বামীজী সহজ সরল ভাষায় বললেন "প্রত্যুষে আমার বাইরে আসবার ইচ্ছে হয়েছিল। সেই ইচ্ছে হবার পরমুহূর্তে বাইরে এসে পড়লাম, কোনো বাধা কোথাও পেলাম না।" কয়েদির ঘরটি জলে জলময় হয়েছিল। মেজিস্ট্রেট স্বামীজীর কাছে জানতে চাইলেন এতো জল কিভাবে এখানে এলো। স্বামীজী বললেন, "রাতে আমার প্রস্রাবের বেগ হয়েছিল, দেখলাম দ্বার তালাবন্ধ, ঘরের বাইরে যেতে তখন ইচ্ছে হয়নি, তাই শায়িত অবস্থাতেই খানিকটা মূত্রত্যাগ করেছি। তারপর রাত হয়ে এলে, অন্ধকার ঘরটা তেমন আমার ভালো লাগছিল না , তাই মুক্ত হাওয়ায় এই বারান্দায় একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি।" মেজিস্ট্রেট ভীষণ রেগে গেলেন, তিনি স্বামীজিকে আবার হাজতে পুড়ে নিজের হাতে দু-দুটো তালা লাগিয়ে তার এজলাসে চলে এলেন। কিছুক্ষন পরে তিনি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন। তিনি যাকে নিজের হাতে তালাবন্ধ করে এলেন, সেই স্বামীজী তার এজলাসের এক কোনে বসে দুষ্টু বালকের মতো হাসছেন। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে মেজিস্ট্রেট হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। স্বামীজী আস্তে আস্তে তার সামনে এসে বললেন "সাহেব, তুমি অন্যান্য সাধারণ মানুষের মত শুধু জড় ও জড়ের শক্তিই বোঝো। এই জগতের মধ্যে ওতপ্রোত হয়ে আছে এক চৈতন্যলোক, তার খবর তোমার মোটেই জানা নেই, সেই চৈতন্যলোকের সঙ্গে যার যোগাযোগ সাধিত হয়েছে, কোনো বন্ধন বা কোনো বাঁধাই আর তার স্বেচ্ছাবিহারকে আটকাতে পারে না। ভারতের যোগীপুরুষদের শক্তির কাছে পৃথিবীর কোনো কার্যই কখনো অসাধ্য বলে গণ্য হয় না। বেটা, তাহলে বল দেখি , আমার মতো সাধু সন্ন্যাসীকে বিরক্ত করে কি লাভ ? তাছাড়া, সে শক্তিই বা তোর আছে কোই ?" মেজিস্ট্রেট তখন তার ভুল বুঝতে পারলেন এবং তিনি নির্দেশ দিলেন যে কাশী শহরে তৈলঙ্গস্বামী নিজের ইচ্ছামত যেখানে খুশি ঘুরতে পারবেন। তাঁকে কেউ বাধা দিতে পারবে না।
কখনো তাঁকে কাশীর গঙ্গায় ভাসমান আবার কখনো ডুবন্ত অবস্থায় দেখা যেত। গঙ্গার সাথে তাঁর যেন অন্তরের সম্পর্ক ছিল। এরকম বহু লীলা বা মহিমা স্বামীজী দেড়শো বছর ধরে দেবভূমিতে করে গেছেন। সাধারণ সাধু সন্ন্যাসীদের জীবন সাধারণত শিষ্যবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু তৈলঙ্গস্বামীর সে অর্থে কোন শিষ্য ছিল না। উমাচরণ মুখোপাধ্যায়ের নামই একমাত্র শিষ্য হিসেবে শোনা যায়, তবে তাঁর প্রচুর ভক্ত ছিলেন। । ১৮৮৭ সালের পৌষ মাসের শুক্লা একাদশীর পুন্য তিথিতে স্বইচ্ছায় ২৮০ বছর বয়সে তিনি যোগবলে দেহরক্ষা করেন অর্থাৎ প্রয়াত হন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ভক্তদের বলে গিয়েছিলেন তাকে চন্দনকাঠের বাক্সে ভোরে গঙ্গা সমাধি দেওয়ার কথা তাঁর ইচ্ছাই ভক্তগণ পূরণ করেন।
১৮৬৮ সালে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব কাশীতে যখন এসেছিলেন তখন তিনি তৈলঙ্গস্বামীর সাথে দেখা করেছিলেন এবং নিজ হাতে তৈরী করা পায়েস স্বামীজিকে খাইয়েছিলেন। যোগী শ্যামাচরণ লাহিড়ীও স্বামীজীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
মহাত্মা তৈলঙ্গস্বামী ছিলেন ভারতের সাধকদের মধ্যে একজন উজ্জ্বল জোতিস্ক। প্রথম বিস্ময় তাঁর দীর্ঘ আয়ু। আরো বিস্ময় অলৌকিক ক্ষমতাবলে মানবের জীবন দান ও হিতসাধন করা। তবে এটা চিরন্তন সত্য যে মানব কল্যানে ব্রতী হয়ে ভারতবর্যে যুগে যুগে ঈশ্বর বিভিন্ন অবতারের রূপ ধরে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। কখনও বুদ্ধ, কখনও যিশু আবার কখনও শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস। তেমনি তৈলঙ্গস্বামীকেও ভগবানের এক রূপ বলে মানব সমাজ মেনে নিয়েছে।
ছবি ও লেখার সত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ২৫-০১-২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment