Sudipta Mukherjee's Blog

Wednesday, October 5, 2022

তিলোত্তমাতে নীল বর্ণের দেবীর আরাধনা

তিলোত্তমাতে নীল বর্ণের দেবীর আরাধনা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 





বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে দুর্গোৎসব।  দুর্গাপূজা মানে বাঙালির আবেগ, বাঙালির উচ্ছাস। দুর্গাপূজার সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গরিমা। এবছর ইউনেস্কো আবার দুর্গোৎসবকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই স্বীকৃতির ফলস্বরূপ আজ বাঙালির আবেগের বিশ্বজয় ঘটেছে। 

আমরা জানি, পারিবারিক দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিল কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির আটচালায় আর জৌলুসের গোড়াপত্তন ঘটেছিল শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজায়। তারপর থেকে পূজাটি হয়ে ওঠে অভিজাত বাড়ির বৈভব প্রদর্শনীর অঙ্গ। সেই আমলে  কোথাও সাজে আবার কোথাও নাচগানের আসরের জৌলুসে প্রত্যেক বাড়ি যেন একে অপরকে টেক্কা দিতে লাগলো। চলতো বৈভবের প্রতিযোগিতা। 

বেশিরভাগ বনেদি বাড়িতে দেবীর গাত্রবর্ণ হলুদ রঙের হয়ে থাকে। তবে কোথাও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। বেলেঘাটার ভট্টাচার্য পরিবারের দেবীর গাত্রবর্ণ ঘন কালো অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণ। কলকাতার সাদার্ন এভিনিউতে ঘোষ রায় পরিবারের দেবীর গাত্রবর্ণ আবার নীল।  গতবার কৃষ্ণবর্ণের পূজাটি নিয়ে বিশদে লিখেছিলাম।  এবার ঘোষ রায় পরিবারের নীল রঙের দেবীমূর্তির কথা আপনাদের জানাবো।  

ঘোষ রায়  পরিবারের শ্রী প্রদীপ রায় ও শ্রীমতি শুভ্রা রায় জানালেন যে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে মহারাজ আদিশূর পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার জন্য কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাম্ভন ও পাঁচজন কায়স্থ সন্তান নিয়ে আসেন।  এই পাঁচজন কায়স্তের মধ্যে সৌকালীন গোত্রীয় মকরন্দ বাংলায় এসেছিলেন।  এই মকরন্দ হলেন ঘোষ  বংশের প্রথম সন্তান। পরে ঘোষ বংশের একটা শাখা বাংলার নবাবের নিকট হতে অধুনা বাংলাদেশের বরিশালের নরোত্তমপুর গ্রামের জমিদারি পান এবং সাথে 'রায়'  উপাধি পান। সেই সময় থেকে এই শাখাটি 'ঘোষ রায়' নাম পরিচিতি লাভ করে। 

এই বংশের সুসন্তান কালীমোহন রায়ের স্ত্রী স্বপ্নাদেশে শ্যামরূপী দুর্গার পূজা করার আদেশ পান। সালটা ছিল ১৮২৭। নরোত্তমপুরে কালীমোহনবাবু ও তাঁর স্ত্রী বেশ আড়ম্বরের সাথে পূজাটি করেন।  নীলবর্ণের দুর্গার আরাধনা আজও  চলছে।  



১৯৩৪ সালে বংশের পুত্র অবনীমোহন রায় কলকাতায় চলে আসেন। নীল দূর্গা পূজা তখনও বাংলাদেশে নরোত্তমপুর অনুষ্ঠিত হত। ১৯৩৮ সালে অবনীমোহনের চতুর্থ ভ্রাতা রোহিনীমোহন পরিবার নিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন।  সাদার্ন এভিনিউতে তিনি বাড়ি নির্মাণ করেন।  অবনীমোহনের তৃতীয় ভাই মোহিনীমোহন ও ছোটভাই নলিনীমোহন কলকাতার  প্রতাপাদিত্য প্লেসে ১৯৪৬ সালে নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ করেন।  ১৯৪৫ সাল  পর্যন্ত পূজাটি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর কলকাতার প্রতাপাদিত্য প্লেসের বাড়িতে চলে আসে।  ১৯৭৭ সালে পূজাটি আবার স্থানান্তরিত হয়ে সাদার্ন এভিনিউ-এর বাড়িতে চলে আসে। সেই থেকে আজও পূজাটি এখানে বেশ আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। 

এখানকার প্রতিমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল গাত্রবর্ণ নীল ও দেবীর বামদিকে থাকেন সরস্বতী ও গণেশ এবং ডানদিকে থাকেন লক্ষ্মী ও কার্তিক। একচালা ডাকের সাজে পারিবারিক গহনায় দেবী সজ্জিত। চালচিত্রে শিবদুর্গার পট অঙ্কিত। পঞ্চমীর দিন কালীঘাটের পটুয়াপাড়া থেকে সকালে প্রতিমা নিয়ে আসা হয়।  ষষ্ঠীর  সন্ধ্যায় বোধন বসে। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নানের পর দেবীর চক্ষুদান ও মূল পূজা শুরু হয়। ঘোষরায় পরিবার কায়স্থ বলে অন্নভোগ দেওয়া হয় না তবে অন্নভোগ রান্না করার জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন হয় সেইসব উপাদান দেবীকে নিবেদন করা হয়। বাইরের কোন প্রকার মিষ্টান্ন দেবীকে দেওয়া হয় না তবে মহাষ্টমীর সন্ধ্যারতির সময় লুচি, মিষ্টি, সুজি ইত্যাদি তৈরী করে মাকে  নিবেদন করা হয়। সপ্তমীর দিন ২৭টি, অষ্টমীর দিন ৬৪টি এবং মহানবমীর দিন ২৭টি ভাগে নৈবেদ্য ভোগ নিবেদন করা হয়। এইসব ভোগে নানা রকমের ফলের সাথে বাড়ির তৈরী নারকেল নাড়ু থাকে। মহানবমীর দিন হোম হয়।  পূর্বে পশুবলি দেওয়া হলেও বর্তমানে প্রতীকী বলিদানের প্রথা রয়েছে।  পরিবারের রীতি মেনে নিজস্ব পুঁথিতে আজও পূজাটি হয়ে আসছে।  দশমীর দিন সকালে দেবীর দর্পন বিসর্জনের পর অপরাজিতা পূজার চল রয়েছে।  অপরাজিতা পূজার পর বাড়ির মহিলারা মাছ খেয়ে তবেই দেবীবরণ করতে পারে। 

 তারিখ :-০৫-১০-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 












Tuesday, October 4, 2022

নেতাজীর পৈতৃক বাড়ির দুর্গাপূজা

নেতাজীর পৈতৃক বাড়ির দুর্গাপূজা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 


দেবী মূর্তি 



দুর্গাপূজা বাঙালির জীবনের সবচেয়ে প্রিয় উৎসব। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে বাঙালির সংস্কৃতিতে উৎসবটি এক বিশেষ স্থান লাভ করে আছে।  বাংলায় দুর্গাপূজা কবে প্রচলিত হয়েছিল, এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত  রয়েছে। সেই মতামত যাই থাকুক সেটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয়ে থাকে তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। বর্তমানে বঙ্গীয় শারদীয়া মহাপূজা একটি জাতীয় উৎসব হিসেবে মহান ঐতিহ্যের আধার হয়ে উঠেছে। সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাংস্কৃতিক (উনেস্কো)  বিবেচনায়  দুর্গোৎসব আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।  

বাংলায় দুর্গাপূজার ঐতিহ্যতে বারোয়ারি পূজার রমরমার সাথে সমান্তরালভাবে পরিবার কেন্দ্রিক পূজাগুলোও স্থান করে নিয়েছে।  যদিও পারিবারিক পূজাগুলো আগে শুরু হয়েছিল, তার অনেক পরে  বারোয়ারি পূজার প্রচলন হয়েছিল। পারিবারিক পূজাগুলোকে বনেদি বাড়ির পূজা বলেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সেরকম একটি পরিবারের পূজার আজ কথা  আমার কলমে ধরার চেষ্টা করলাম। 

ঠাকুরদালান 


পরিবারটি হল ভারতবর্ষের অন্যতম  ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবার। পরিবারের সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু, জানকীনাথ বসুর নাম ভারতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বরাবর গণ্য হয়ে এসেছে।  বসু বংশের আদিপুরুষ হলেন দশরথ বসু। তাঁর অধস্তন গোপীনাথ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুরবন্দর  নামক একটা জায়গা জায়গীর হিসেবে পান। পুরবন্দর থেকে সামান্য দূরে মাহীনগর গ্রামে তাঁরা বাস করতেন। মাহীনগরে মহামারী দেখা দিলে ওই গ্রাম পরিত্যাগ করে বসু পরিবার কোদালিয়ায় বসতি গড়ে তোলেন। বংশের সুসন্তান যাদবেন্দ্রনাথ ১৮২০ সালে কোদালিয়ায় দুর্গাপূজা শুরু করেন। পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরপুরুষ রামহরির পৌত্র হরনাথ বেশ জাঁকজমকের সাথে পূজাটি পরিচালনা করেন। তিনি বেশ কিছু বছর পূজার দায়িত্বে ছিলেন।  তারপর হরনাথের পুত্র জানকীনাথের উপর পূজা পরিচালনার  দায়িত্ব পড়ে।

বসত বাড়ির একাংশ 


তিনি যখন কটকে আইন ব্যবসায় নিযুক্ত হন তখন তাঁর  বড়ভাই যদুনাথ পূজার কাজ চালাতেন। তাঁর অর্থাৎ জানকীনাথের মৃত্যুর পর নেতাজীর মাতা প্রভাবতী দেবী পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।  প্রায় প্রতিবছর সুভাষচন্দ্র পূজার সময় এখানে আসতেন। তিনি করজোড়ে দুর্গাদালানে বসে থাকতেন। একাগ্রচিত্তে চন্ডীপাঠ শুনতেন। দেবীর চরণে অঞ্জলি প্রদান করতেন বলে পরিবারের এক সদস্যের কাছ থেকে জানতে পারলাম।   তিনি আরো জানালেন যে ১৯৩৯ সালে নেতাজী  শেষবারের মত এই বাড়িতে এসেছিলেন। 

গ্রামবাসী শ্রী দেবজিৎ রায় জানালেন পরিবারের পূজার জৌলুস পূর্বের মত  আজ অমলিন।  পূজার নিয়ম যতটা সম্ভব পূর্বের মত  পালন করার চেষ্টা করা হয়। আগে পূজার কটাদিন সমগ্র গ্রামবাসী একসাথে খাওয়া-দাওয়া করতো। নারকেল নাড়ু বিলানো হত। বর্তমানে একসঙ্গে আর খাওয়া-দাওয়া হয় না তবে ভোগ বিলানো হয়। এছাড়া দরিদ্রনারায়ণ সেবা করানো হয়। সাবেকি দিনের একচালা প্রতিমা। দেবীর অঙ্গসজ্জা সেরকম নেই। 

আজও  অষ্টমীর অঞ্জলি ও সন্ধিপূজার বেশ ঘটা করে করা হয়। এইদিন এখানে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে বহু আত্মীয় আজও  সমবেত হয়।  তাঁদের অনেকেই সন্ধিপূজার সময় উপস্থিত থাকেন। 

পারিবারিক রীতি মেনে পুরানো কাঠামোতে একচালা দেবী মূর্তি তৈরী করা হয়। কাঠামোটিকে বিসর্জনের পর ঠাকুরদালানে রেখে দেওয়া হয়। পূজাটি বসু বাড়ির ঠাকুর দালানেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত  হয়ে থাকে। ঠাকুর দালানের সামান্য দূরে রয়েছে পরিবারের আদি বাড়িটি। বর্তমানে বাড়িটি কেন্দ্রীয় সরকারের পুরাতত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে।  এখানে তারা একটা সংগ্রহশালা নির্মাণ করবে বলে জানতে পারলাম।  

বসু বাড়ির পূজাতে অন্যান্য বনেদি বাড়ির মত চাকচিক্য হয়তো দেখতে পাবেন না কিন্তু পূজাটি বেশ  নিষ্ঠার সাথে আজও অনুষ্ঠিত হতে দেখলাম। প্রচুর গ্রামবাসীকে  এখানে অঞ্জলি দিতে দেখলাম। 



তারিখ :-০৪-১০-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 






Saturday, October 1, 2022

অকালবোধন>P

                               অকালবোধন 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 





দেবী দূর্গা  হলেন হিন্দুদের খুবই জনপ্রিয় দেবী। হিন্দুরা তাঁকে শক্তির দেবী হিসেবে মনে করলেও মাতৃজ্ঞানে  সম্মান করে।  পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের পত্নী পার্বতী। দেবী আবির্ভূত হন শক্তিরূপে। মহাশক্তি দূর্গা মহাবিশ্বের অধীশ্বরী। সুপ্রাচীন কাল থেকেই মায়ের মৃন্ময়ী রূপকে চিন্ময়ী জ্ঞানে আমরা আরাধনা করে আসছি। 

দেবীপূজার মহাক্ষণ আসন্ন।  দশপ্রহরণধারিনী দেবী একাধারে  আমাদের জননী আবার কন্যাও।  দেবীকে নিয়ে আমাদের কত মান-অভিমান। পরমাশক্তি দেবী দূর্গা একদিকে রণরঙ্গিনী ও ভয়ঙ্করী এবং অন্যদিকে প্রসন্ন ও বরদায়িনী। একাধারে রনংদেহি মূর্তি ফুটে ওঠে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমায় আবার অন্যধারে তাঁর চোখ থেকে বর্ষিত হয় করুণাধারা।  পূরাণের পাতা ওল্টালে দেখা যায় যেমন তত্ত্বের বর্ণচ্ছটায় দেবী মাহাত্বের কথা তেমন ইতিহাসের পাতায়  বর্ণিত আছে উৎসবের পরম্পরায় তাঁর আরাধনার কথা। ভারত তথা বিশ্বে  বৎসরান্তে হয় তাঁর আগমন, আগমনী গানে তাঁর পূজার আয়োজন। আমাদের জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। 

বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠ পার্বণ হল শরৎকালের দুর্গাপূজা। এতো শুধু পূজা নয় - এতো মহাযজ্ঞ। আমাদের দেশে বছরে দুই বার দুর্গাপূজা করা হয়। একবার শীতের পর বসন্তকালের চৈত্র মাসে আর একবার বর্ষার অন্তে শরৎকালের আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষে।  রাজা সুরথ বসন্তকালে  প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। শ্রী শ্রী চন্ডীতে রাজা সুরথের নাম  মর্ত্যে  দেবী দুর্গার প্রথম পূজারী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। বসন্তকালে যে পূজা করা হয় তাকে দুর্গাপূজা না বলে 'বাসন্তী পূজা' নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এই পূজা অনেক জায়গায় বারোয়ারি পূজা হিসেবে করা হয়। অল্প কিছু  বাড়িতেও বাসন্তী পূজা করার চল রয়েছে।  

শরৎকালে দূর্গা মায়ের আরাধনাকে দুর্গাপূজা বলা হয়।  যেহেতু পূজাটি শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় তাই অনেকে 'শারদোৎসব' বলে থাকে। শরৎকালের এই পূজাটি সমাজে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা ও প্রসিদ্ধি  লাভ করেছে।  পূজাটিকে অকালবোধন বলা হয়।  রাবণ বধের পূর্বে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে অর্থাৎ অ-কালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন। 

হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রারম্ভে অকালবোধন  অনুষ্ঠিত হয়।  বোধন শব্দটির অর্থ হল জাগরণ বা জাগানো।  বিখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রদ্ধেয় অতুল সুর মহাশয় বলে গেছেন - 'দুর্গাপূজাই বাঙালির সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব। শরৎকালে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় বলে একে শারদীয়া পূজা বলা  হয়।  আষাঢ়  থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত দেবতাদের নিদ্রাকাল এবং এই অসময়ে দেবীর পূজা করা হলে বোধন করা  হয় বলে একে অকালবোধনও বলা হয়। কথিত যে, পুরাণ অনুযায়ী রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় রামের প্রতি দেবীর অনুগ্রহ আকর্ষণ করবার উদ্দেশ্যে  ব্রহ্মা দেবীর বোধন করেছিলেন।  কৃত্তিবাসী  রামায়ণ অনুযায়ী রাম নিজেই যুদ্ধের পূর্বে দেবীর বোধন করেছিলেন, বাল্মীকির রামায়ণে কিন্তু এসব কথা কিছু নেই। মহর্ষি  বাল্মীকি তাঁর রচিত সংস্কৃত রামায়ণে সূর্য্য ও অন্যান্য দেবতাদের পূজার কথা বলেছিলেন।  ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস ওঝা বাল্মীকি রামায়ণের অনুকরণে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। তাঁর রচিত রামায়ণে শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের দেবীপূজার কথা উল্লেখ রয়েছে।  বাংলা রামায়ণে কবি কৃত্তিবাস শ্রীরামচন্দ্রের দেবীপূজা সম্বন্ধে বলেছেন - 

                                               "বিধাতা কহেন প্রভু এক কর্ম কর বিভু 
                                                          তবে হবে রাবণ-সংহার। 
                                               অকালবোধন করি পূজা দেবী মহেশ্বরী 
                                                         করিবে হে ঐ  দুঃখ-পাথর।"

কবিচিত্তের কল্পনায় বীর হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম সংগ্রহ করলেন, কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র একে একে ১০৭ টি পদ্ম মাতৃচরণে অঞ্জলি দিলেন। কিন্তু দেবী ছলনা করে একটি পদ্ম সরিয়ে রাখলেন। শ্রীরামচন্দ্র যখন ধনুর্বান দিয়ে নিজের একটি চক্ষু উৎপাটন করে মাতৃচরণে অঞ্জলি দিতে উদ্যত হলেন  ঠিক সেই সময় দেবী সহাস্যে তাঁকে  নিবৃত্ত করলেন। দেবীপূজা সমাপ্ত হল এবং শ্রীরামচন্দ্র দশাননকে  বধ করলেন। তবে প্রজাপতি ব্রহ্মার পরামর্শে ও সাহায্যেই তিনি দেবীকে ঘুম থেকে তুলে পূজা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি শরৎকালে দেবীকে জাগরণ পূর্বক তাঁর পূজা সম্পন্ন করে রাবণ বধে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বীয় পত্নীকেও লাভ করেছিলেন। 

বাংলা সনাতন বর্ষপঞ্জি অনুসারে একটি বছরকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটির একটি হল উত্তরায়ণ আর অপরটি হল দক্ষিণায়ন।  সূর্য যখন পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে উত্তরায়ণ কাল বলা হয় আর সূর্য যখন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে উত্তরায়ণ কাল বলা হয়। আর সূর্য যখন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে দক্ষিণায়ন কাল বলা হয়। মহাকবি কৃত্তিবাস তাঁর রচিত রামায়ণে বলে গেছেন বাংলা বর্ষপঞ্জির মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ এবং  আষাঢ় এই ছয় মাস হলো উত্তরায়ণ কালের অন্তর্গত।  বাকি ছয় মাস হল দক্ষিণায়ন কালের অন্তর্গত। এই ছয় মাস হল শ্রাবণ, ভাদ্র, অশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, ও পৌষ। 

উত্তরায়ণ কালে দেব-দেবীরা  জাগ্রত থাকেন।  এই সময়টাই দেবী আরাধনার প্রকৃত সময়।  তাই উত্তরায়ণ কালে দেবী আরাধনা করা হলে দেবীকে জাগাতে হয় না।  রাজা সুরথ বসন্ত কালে দেবীর আরাধনা করেছিলেন, যা বাসন্তী পূজা হিসেবে পরিচিত। তাই বাসন্তী পূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না।  অপরদিকে দক্ষিণায়ন কালের সময় দেব-দেবীদের নিদ্রার সময়। এই সময় পূজা করা হলে দেব-দেবীদের প্রথমে বোধন অর্থাৎ জাগ্রত করতে হয়। তারপর মূল পূজা শুরু হয়।  

শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের কথা শুধু কৃত্তিবাসী রামায়ণের পাওয়া যায় তা নয়, অকালে দশভূজার আবির্ভাবের  বিবরণ কয়েকটি পুরাণে পাওয়া যায়।  অকালবোধনই বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় উৎসব। শরতে প্রকৃতির মনোমোহিনী রূপের মধ্যে আগমন ঘটে মা দুর্গার।  দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, পাড়ায় পাড়ায়  শুরু হয় দেবীর অকালবোধন। হানাহানি, রেষারেষি ভুলে সবাই উৎসবের মেতে ওঠে। 




তারিখ :-০১-১০-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।