তিলোত্তমাতে নীল বর্ণের দেবীর আরাধনা
- সুদীপ্ত মুখার্জী
বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে দুর্গোৎসব। দুর্গাপূজা মানে বাঙালির আবেগ, বাঙালির উচ্ছাস। দুর্গাপূজার সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গরিমা। এবছর ইউনেস্কো আবার দুর্গোৎসবকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই স্বীকৃতির ফলস্বরূপ আজ বাঙালির আবেগের বিশ্বজয় ঘটেছে।
আমরা জানি, পারিবারিক দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিল কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির আটচালায় আর জৌলুসের গোড়াপত্তন ঘটেছিল শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজায়। তারপর থেকে পূজাটি হয়ে ওঠে অভিজাত বাড়ির বৈভব প্রদর্শনীর অঙ্গ। সেই আমলে কোথাও সাজে আবার কোথাও নাচগানের আসরের জৌলুসে প্রত্যেক বাড়ি যেন একে অপরকে টেক্কা দিতে লাগলো। চলতো বৈভবের প্রতিযোগিতা।
বেশিরভাগ বনেদি বাড়িতে দেবীর গাত্রবর্ণ হলুদ রঙের হয়ে থাকে। তবে কোথাও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। বেলেঘাটার ভট্টাচার্য পরিবারের দেবীর গাত্রবর্ণ ঘন কালো অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণ। কলকাতার সাদার্ন এভিনিউতে ঘোষ রায় পরিবারের দেবীর গাত্রবর্ণ আবার নীল। গতবার কৃষ্ণবর্ণের পূজাটি নিয়ে বিশদে লিখেছিলাম। এবার ঘোষ রায় পরিবারের নীল রঙের দেবীমূর্তির কথা আপনাদের জানাবো।
ঘোষ রায় পরিবারের শ্রী প্রদীপ রায় ও শ্রীমতি শুভ্রা রায় জানালেন যে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে মহারাজ আদিশূর পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার জন্য কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাম্ভন ও পাঁচজন কায়স্থ সন্তান নিয়ে আসেন। এই পাঁচজন কায়স্তের মধ্যে সৌকালীন গোত্রীয় মকরন্দ বাংলায় এসেছিলেন। এই মকরন্দ হলেন ঘোষ বংশের প্রথম সন্তান। পরে ঘোষ বংশের একটা শাখা বাংলার নবাবের নিকট হতে অধুনা বাংলাদেশের বরিশালের নরোত্তমপুর গ্রামের জমিদারি পান এবং সাথে 'রায়' উপাধি পান। সেই সময় থেকে এই শাখাটি 'ঘোষ রায়' নাম পরিচিতি লাভ করে।
এই বংশের সুসন্তান কালীমোহন রায়ের স্ত্রী স্বপ্নাদেশে শ্যামরূপী দুর্গার পূজা করার আদেশ পান। সালটা ছিল ১৮২৭। নরোত্তমপুরে কালীমোহনবাবু ও তাঁর স্ত্রী বেশ আড়ম্বরের সাথে পূজাটি করেন। নীলবর্ণের দুর্গার আরাধনা আজও চলছে।
১৯৩৪ সালে বংশের পুত্র অবনীমোহন রায় কলকাতায় চলে আসেন। নীল দূর্গা পূজা তখনও বাংলাদেশে নরোত্তমপুর অনুষ্ঠিত হত। ১৯৩৮ সালে অবনীমোহনের চতুর্থ ভ্রাতা রোহিনীমোহন পরিবার নিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। সাদার্ন এভিনিউতে তিনি বাড়ি নির্মাণ করেন। অবনীমোহনের তৃতীয় ভাই মোহিনীমোহন ও ছোটভাই নলিনীমোহন কলকাতার প্রতাপাদিত্য প্লেসে ১৯৪৬ সালে নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ করেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত পূজাটি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর কলকাতার প্রতাপাদিত্য প্লেসের বাড়িতে চলে আসে। ১৯৭৭ সালে পূজাটি আবার স্থানান্তরিত হয়ে সাদার্ন এভিনিউ-এর বাড়িতে চলে আসে। সেই থেকে আজও পূজাটি এখানে বেশ আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
এখানকার প্রতিমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল গাত্রবর্ণ নীল ও দেবীর বামদিকে থাকেন সরস্বতী ও গণেশ এবং ডানদিকে থাকেন লক্ষ্মী ও কার্তিক। একচালা ডাকের সাজে পারিবারিক গহনায় দেবী সজ্জিত। চালচিত্রে শিবদুর্গার পট অঙ্কিত। পঞ্চমীর দিন কালীঘাটের পটুয়াপাড়া থেকে সকালে প্রতিমা নিয়ে আসা হয়। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বোধন বসে। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নানের পর দেবীর চক্ষুদান ও মূল পূজা শুরু হয়। ঘোষরায় পরিবার কায়স্থ বলে অন্নভোগ দেওয়া হয় না তবে অন্নভোগ রান্না করার জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন হয় সেইসব উপাদান দেবীকে নিবেদন করা হয়। বাইরের কোন প্রকার মিষ্টান্ন দেবীকে দেওয়া হয় না তবে মহাষ্টমীর সন্ধ্যারতির সময় লুচি, মিষ্টি, সুজি ইত্যাদি তৈরী করে মাকে নিবেদন করা হয়। সপ্তমীর দিন ২৭টি, অষ্টমীর দিন ৬৪টি এবং মহানবমীর দিন ২৭টি ভাগে নৈবেদ্য ভোগ নিবেদন করা হয়। এইসব ভোগে নানা রকমের ফলের সাথে বাড়ির তৈরী নারকেল নাড়ু থাকে। মহানবমীর দিন হোম হয়। পূর্বে পশুবলি দেওয়া হলেও বর্তমানে প্রতীকী বলিদানের প্রথা রয়েছে। পরিবারের রীতি মেনে নিজস্ব পুঁথিতে আজও পূজাটি হয়ে আসছে। দশমীর দিন সকালে দেবীর দর্পন বিসর্জনের পর অপরাজিতা পূজার চল রয়েছে। অপরাজিতা পূজার পর বাড়ির মহিলারা মাছ খেয়ে তবেই দেবীবরণ করতে পারে।
তারিখ :-০৫-১০-২০২২
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।