Tuesday, June 14, 2022

ঘূর্ণি

ঘূর্ণি পুতুলপট্টি 






পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার সদর শহর হল কৃষ্ণনগর। কালীভক্ত ও বিদ্যোৎসাহী রাজা ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। শিল্পের প্রতি তাঁর  আগ্রহ ছিল।  তাঁরই নামানুসারে শহরটির নামকরণ করা হয়েছিল। পূর্বে জায়গাটির নাম ছিল রেউই।  কৃষ্ণনগরের একটি অঞ্চলের নাম ঘূর্ণি। এই ঘূর্ণির মাটির পুতুল ও মূর্তির খ্যাতি জগৎজোড়া। এখানকার মৃৎশিল্পীদের সূক্ষ্ম হাতের কাজ দেখার মত। এখানকার সূক্ষ্ম শৈলী কৃষ্ণনগর ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না।  এখানকার মাটির কাজ পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ কুটির শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম।  কথিত আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে এখানে এই শিল্পের সূচনা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন বাংলাদেশের নাটোর প্রদেশ থেকে কয়েকজন মৃৎশিল্পী এখানে এসে মাটির পুতুল নির্মাণ শুরু করে। এরপর এখানে ধীরে ধীরে অন্যান্য জায়গা থেকে আরও মৃৎশিল্পী  এসে বসবাস শুরু করে। সেই থেকেই এখানে মৃৎ শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং ব্যাপকতা লাভ করে।  ক্রমেই এই শিল্প বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে পড়ে। 





কৃষ্ণনগর শহরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে জলঙ্গি নদী বয়ে চলেছে।  এই নদীর কাছেই ঘূর্ণির মৃৎশিল্পের উপনিবেশটি গড়ে উঠেছে। এই নদী তীরে মাটির নৌকা এসে ভেড়ে। সেই মাটি সংগ্রহ করে মৃৎশিল্পীরা বছরের পর বছর ধরে তাদের সুক্ষ্ম কারুকাজ ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বজায় রেখে চলছেন।   


এখানে মাটি খুব সহজলভ্য। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা রাজমহলের মাটি নিয়ে কাজ করে। এখানে  বেলে  ও দো-আঁশ মাটির মিশ্রনের সাথে পরিমাণ মতো এঁটেল মাটি ব্যবহার করে পুতুলগুলো নির্মাণ করা হয়। এখানে ছাঁচের পুতুল ছাড়াও হাত দিয়ে তৈরী নানারকম পুতুল গড়া হয়ে থাকে।  মাটি ছাড়াও ফাইবারের তৈরী বিভিন্ন পুতুলও নির্মিত হয়। 


কৃষ্ণনগর পৌরসভা এলাকার তিনটে অঞ্চলে মৃৎশিল্পীদের সুদীর্ঘকালের বসতি গড়ে উঠেছে। শহরের উত্তর-পূর্ব  উপকণ্ঠে ঘূর্ণিতে, শহরের দক্ষিণে নতুনবাজার রথতলা অঞ্চলে আর তৃতীয়টি হল ঘূর্ণির সংলগ্ন কুমোরপাড়া-ষষ্ঠীতলা। এই শিল্পের সাথে এখানে প্রায় তিনশো জন নারী-পুরুষ ও কিশোর জড়িত রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় নব্বই শতাংশ জাতিতে কুমোর। এছাড়া বাকি দশ শতাংশ অন্যান্য জাতি  এই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। 





শুধু মাটির পুতুল নয় এখানকার দূর্গা প্রতিমাও খুবই বিখ্যাত। কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল যারা তৈরী  করে তারা সাধারণত বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন।  শুধু আমাদের দেশ নয় তাঁদের অনেকেই বিশ্বের দরবারেও সম্মান অর্জন করেছে অর্থাৎ তাঁরা আন্তর্জাতিক স্তরে  সম্মানিত হয়েছেন। কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের মধ্যে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান ও পদক পান শ্রীরাম পাল। তাঁকে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প শৈলীর আদিপুরুষ বলা হয়। পরবর্তীকালে শ্রী মতিলাল পাল, শ্রী সুবীর পাল  ও আরো অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। কৃষ্ণনগরের সবচেয়ে যশস্বী কারুকার ছিলেন যদুনাথ পাল।  যদুনাথ পালের পর সাফল্য ও জনপ্রিয়তায় উল্লেখযোগ্য ছিলেন গোপেশ্বর পাল। কিশোর বয়সেই তিনি অবশ্য কলকাতার কুমোরটুলিতে চলে আসেন।  এছাড়া কার্তিক পাল,  বাদল পাল,  শংকর সরকার, গৌতম পাল ইত্যাদি কয়েকজন আজও এখানকার ঐতিহ্যমন্ডিত মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন।   রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায় ও গগনেন্দ্রনাথ  ঠাকুর এখানকার মৃৎশিল্পীদের সমাদর করেছেন। তাঁরা এই শিল্পের গুনগ্রাহী ছিলেন।  

কিভাবে যাবেন : 

শিয়ালদহ  স্টেশন থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে কৃষ্ণনগর স্টেশনে নামুন। সময় লাগবে ঘন্টা আড়াই। কৃষ্ণনগর  স্টেশন থেকে টোটো গাড়ি করে ঘূর্ণি পুতুলপট্টিতে চলে আসুন। 





তারিখ :১৫-০৬-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।