Sunday, February 24, 2019

ঋতুরাজ (Rituraj)>

ঋতুরাজ 




ফুল ফুটুক  না ফুটুক আজ বসন্ত 

উপরিউক্ত উক্তিটি বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বসন্তকাল সম্বন্ধে তাঁর এক জনপ্রিয় কবিতায় বলে গেছেন।  বসন্তকাল বাংলার ঋতুচক্র আবর্তনের সর্বশেষ ঋতু।  শীতের রুক্ষতার পর মাঘের সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়ে, তখন পূর্বে বসন্তের সূর্যের আগমন ঘটে।  পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, অশোক প্রকৃতিকে রাঙিয়ে তোলে। গাছে গাছে কিশলয় তাদের উজ্জ্বল রঙ প্রকৃতির ঔজ্জ্বল্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

কত কবির কলমে বসন্তকে নিয়ে কত কবিতা লেখা হয়েছে। কত সংগীতজ্ঞ তাঁদের গানে বসন্তকে তুলে ধরেছেন।  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলে গেছিলেন "নীল দিগন্তে, ওই ফুলের আগুন লাগলো, বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল"। যখন বাংলার বুকে ঋতুরাজ বসন্তের বর্ণময়, সুরভিত ও রোমাঞ্চকর আবির্ভাব ঘটে, তখন সবার মনও আন্দোলিত হয়ে ওঠে। কোকিলের কুহু কুহু রব ও বিভিন্ন ফুলের প্রাচুর্য প্রকৃতিকে যেন রাজকীয় বেশে সাজিয়ে তোলে।   

বনে বনে হিম -শীতল উত্তরে বাতাসের বিদায়বার্তা ঘোষিত হয়ে যায় চারিদিকে। উত্তর দিক ছেড়ে তখন দক্ষিণদিক থেকে মনরোম মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করে দেয়। মৌমাছিদের ক্লান্তিবিহীন গুঞ্জরণে, কোয়েল-দোয়েলের বিরামহীন গানের সুরে, বনে  বনে অশোক, শিমুল, পলাশ ও কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম উচ্ছাসে  উথাল -পাতাল করা ফুলের গন্ধের সৌরভ প্রকৃতিকে ভরিয়ে তোলে।  তাই বসন্তকে ঋতুদের রাজা "ঋতুরাজ" বলে অভিহিত করা হয়।  

আগুনরঙা পলাশই বসন্তের পূর্ণতা বয়ে আনে। তার ডালে ডালে রক্তরাঙা ফুলগুলোকে দেখলে সবাই মনে মনে গুণ গুণিয়ে ওঠে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান "আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে " বা "ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে - ডালে ডালে, বনে বনে  পাতায় পাতায় রে আড়ালে আড়ালে কোণে   কোণে "।  এগুলো না হলে কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত সাঁওতালি গান "হলুদ গাদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল, এনে দে, এনে দে, নইলে বাঁধব না, বাঁধব না চুল"। মনও  যেতে চায় পুরুলিয়ায় বা নিদেনপক্ষে কবিগুরুর শান্তিনিকেতনের পলাশ ফুলের  বনে। সেখানকার পলাশ গাছের তলায় পলাশের  বিছানো ফুলের চাদরে বাচ্ছাদের ফুল তোলার ছবি একটা উপরি পাওনা হয়ে দেখা দেয়।বসন্ত মানেই যেন পূর্ণতা, বসন্ত মানেই যেন নতুন প্রাণের কলরব।  বসন্ত মানেই যেন একে অপরের হাত ধরে চলা।

শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসবে নাচ

দোল বা হোলি উৎসব এই সময়ই অনুষ্ঠিত হয়।  ফালগুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা হয়।একে রবীন্দ্রনাথ 'বসন্তোত্‍সব'  নামকরন  করেছিলেন। যদিও হিন্দু-বৈষ্ণব উৎসব বলে দোল উৎসব বিবেচিত হয়। কিন্তু তা আজ আর কোন ভাষা, গোষ্ঠী বা ধর্মের গন্ডিতে আবদ্ধ নয়। সর্ব মানুষের, সর্ব  ধর্মের সমন্বয়ের  উৎসবের নাম দোল উৎসব বা বসন্ত উৎসব। পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ এই পূর্ণিমার দিনই  গোপিনীদের সাথে রঙ খেলায় মেতে উঠেছিলেন । এই উৎসবে শিশু থেকে বয়স্ক সব বয়সী নারী-পুরুষ পরস্পরকে বিভিন্ন রঙের আবির দিয়ে একে অপরকে রাঙিয়ে দেয়।


শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব বাংলার বুকে সবচেয়ে  জনপ্রিয় ও বিখ্যাত।  এখানকার  বসন্ত উৎসব পালনের রীতি আজ প্রায় পঁচাত্তর বছর পাড় হয়ে গেলো। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৫ সালে এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন।  এই উৎসবের মূল সুর সেই সময় থেকেই এখানে তৈরী হয়ে গেছিল, যা আজও  সমান তালে বেজে চলেছে। রঙ আর আবিরে রাঙিয়ে দেওয়া হয় বিশ্বকবির শান্তিনিকেতনকে।  এখানকার আদিবাসীদের সাথে, দেশ বিদেশের অতিথিরা ও পর্যটকরা  
শান্তিনিকেতনে আবির নিয়ে খেলা
একসাথে  সমানভাবে এই উৎসবে মেতে ওঠে  । সবাই একসাথে গেয়ে ওঠে  "ওরে গৃহবাসি, খোল, দ্বার খোল, লাগল যে দোল। দ্বার খোল, দ্বার খোল। রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে, রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে, নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল। দ্বার খোল, দ্বার খোল"।  এই গানটিকে দিয়েই মূল অনুষ্ঠানটি শুরু করা হয়। বিশ্বভারতীর মূল চত্বরে। এখানকার উৎসবটা .সরকারিভাবে হয়ে থাকে। এই উৎসবে যেমন এখানকার ছাত্র-ছাত্রী ও অশ্রমের  বাসিন্দারা অংশগ্রহণ করে, তেমন বহু দেশি-বিদেশী পর্যটকও  অংশগ্রহণ করে থাকে। বিশেষ নৃত্য ও সংগীতের  মাধ্যমে উৎসবটি খুব সুন্দরভাবে  পালন করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে সবাই মিলে  একসাথে গেয়ে ওঠে "রাঙিয়ে দিয়ে যাও , যাও য়াও  গো এবার যাওয়ার আগে।" গানটি। সন্ধ্যায় গৌড় প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের নাটক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া প্রথা অনুযায়ী আরো কয়েকটি জায়গায় নানারকম সংকৃতিক  উৎসব হয়ে থাকে। এই বসন্ত উৎসবের দিন এখানে প্রায়  দু-তিন লাখ  লোকের সমাগম হয়। বোলপুর-শান্তিনিকেতন এই দিন জনসমুদ্রের  রূপ নেয়।

বর্তমানে নিউটাউনের রবীন্দ্রতীর্থে ও  গল্ফগ্রীনেও  খুব ঘটা করে দোল উৎসব আয়োজন  করা  হয়।  এখানেও অবিরের রঙে উৎসবের  আবহাওয়া তৈরী হয়। রবীন্দ্র নৃত্য ও গান দিয়ে সমগ্র অনুষ্ঠানটা সাজিয়ে তোলা হয়। এই  জায়গাটাও নাচে -গানে সব বয়সের মানুষকে মাতিয়ে তোলে।


কলকাতা বিশ্বভারতীতে বসন্তউৎসবে ছাত্রীরা 


কলকাতার রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্বাবিদ্যালয়টিতেও প্রতিবছরই বেশ ঘটা  করে  বসন্ত উৎসব  পালন করা হয়। তবে এই অনুষ্ঠানটি দলের দু-একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয়। নানা রঙে সেজে ওঠে এখানকার  চত্বরটা। ছাত্ররা নানা রঙের পাজামা পাঞ্জাবি আর ছাত্রীরাও  সুন্দর সুন্দর  শাড়ি পরে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়।  এই দিন এখানে অগুনতি আলোকচিত্রীদেরও  উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা নানারকম রঙ মেখে নানা ভঙ্গিমায় এইসব আলোকচিত্রীদেরকে দিয়ে ছবি তোলায়। এখানকার মাঠে রবীন্দ্র নৃত্য ও গান পরিবেশন করা হয়। সবাই একসাথে এখানকার সাংকৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে। বর্তমানে এখানেও শান্তিনিকেতনের মতই  ভীড়  উপচে পড়তে দেখা যায়।  

শান্তিনিকেতনের মত  করে বসন্ত উৎসব আজকাল কলকাতার পাড়ায় পাড়ায়  অনুষ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। বাঙালিদের কাছে দিনকে দিন এইসব অনুষ্ঠানগুলোও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সব পাড়ারই যেন  পলাশের রঙের সাথে ফাগের রঙ  মিলেমিশে এক করে দিচ্ছে। কলকাতার বাঙালিরা প্রতিবছর এখানকার এই বসন্ত উৎসবগুলোতেও   ভীড় জমাচ্ছে। বহু প্রাচীনকাল থেকেই নবদ্বীপ, মায়াপুর, শান্তিপুর ও আম্বিকা কালনাতে দোল উৎসবের প্রচলন আছে।

দোলের আগেরদিন সারাদিন ধরে গাছের  শুকনো পাতা, খড়, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে একটা ঘর বানানো হতো। আমরা ছোটবেলায় একে "বুড়ীরঘর" বলতাম।  সন্ধ্যার সময় সেই ঘরে আগুন লাগিয়ে  "হোলিকাদহন" বা "নেড়াপোড়া" উৎসব পালন করা হত।  বর্তমানে এই উৎসব আজ আর কোথাও হতে খুব একটা দেখা যায় না। 

এক একটা বছর বদলায়, এক এক জায়গায়, এক একরকমভাবে বসন্ত উৎসব পালিত হতে দেখা যায় কিন্তু বাঙালীরা কোন উৎসবে ফাঁকি পড়তে রাজি নয়।  তারা  সব উৎসব থেকেই সমানভাবে আনন্দ নিতে আগ্রহী হয়।



তারিখ : ২৪-০২-২০১৯

 ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Wednesday, February 20, 2019

বুদ্ধগয়া ভ্রমণ (Buddha Gaya) >

 বুদ্ধগয়া 


তরুণ সন্ন্যাসী রাজপুত্র সিদ্ধার্থ আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে তাঁর ভরা যৌবনে সমস্ত রাজসিক সুখ ত্যাগ করে উরুবেলায় এসেছিলেন।  এই উরুবেলাই বর্তমানের বুদ্ধগয়া। আমরা জানি নেপালের লুম্বিনীতে রাজপুত্র গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। উত্তরপ্রদেশের বেনারসের কাছে ইসিপতনে (বর্তমান সারনাথ) তিনি তাঁর পাঁচ শিষ্যকে প্রথম ধর্মোপদেশ শুনিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশেরই কুশীনগরে ৮০ বছর বয়সে তাঁর মহাপরিনির্বাণ হয়। আমরা এও জানি যে এই উরুবেলাতেই তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। 

বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে মাত্র ১১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পূর্বের উরুবেলা বর্তমানের বুদ্ধগয়া। তখনকার উরুবেলা জায়গাটার জমি খুবই উর্ব্বর ছিল। সবসময় সবুজ শষ্যে ভরা থাকত। উরুবেলার পাশ দিয়েই বয়ে চলত ফল্গু নদী (নৈরঞ্জনা)। তরুণ সিদ্ধার্থ সাধনায় আত্মিনিয়োগ করার জন্য এরকমই একটা নির্জন নিস্তব্দ স্থানের সন্ধান করছিলেন। তিনি বহু নগর-গ্রাম, নদী-পর্বত পাড় হয়ে এখানে এসে পৌঁছেছিলেন। চলার পথে বহু বাঁধা-বিঘ্ন এবং কঠোর কৃচ্ছসাধন করে তবেই তিনি এই স্থানে আসতে পেরেছিলেন। এখানে আসার পর সিদ্ধার্থ এখানকার এক বটবৃক্ষের তলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।  সেইসময় এই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা সুজাতা একটা সোনার বাটিতে পায়েস রান্না করে সিদ্ধার্থকে খাওয়ান।  ক্ষুদার জ্বালায় সিদ্ধার্থ সম্পূর্ণ পায়েস খেয়ে নিয়েছিলেন। সুজাতা কুমারী  থাকাকালীন এই বটবৃক্ষের কাছে এসে বৃক্ষদেবতার কাছে মানত করেছিলেন যদি তার উপযুক্ত ও সমগোত্র সম্পন্ন পাত্রের সাথে বিবাহ হয় এবং প্রথম সন্তান যদি ছেলে হয়, তাহলে সে এই বটবৃক্ষের তলায় তিনি পুজো দেবে। সৌভাগ্যবশত তার আশা পরিপূর্ণ হওয়ায় তার শশুরবাড়ি বেনারস থেকে এসে তিনিএই বটবৃক্ষের তলায় পুজো দিতে এসেছিলেন।  আহার শেষ করার পর সিদ্ধার্থ বৃক্ষের তলায় কিছুক্ষন বিশ্রাম করে স্রোতসিনী নৈরঞ্জনা নদী পাড় করার উদ্দেশ্যে জলে নামেন। অগভীর জলে হেঁটে তিনি নদীর মাঝখানে এসে সোনার বাটিটিকে জলের ওপর রেখে দিলেন, আর বললেন "যদি আমি বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারি তাহলে বাটিটি স্রোতের বিপরীত দিকে ভেসে যাবে, আর যদি বুদ্ধত্ব লাভ করতে অসমর্থ হই  তাহলে বাটিটি  স্রোতের অনুকূলে যাবে"। একথা বলার পর সিদ্ধার্থ দেখলেন যে বাটিটি স্রোতের বিপরীতদিকে চলে যাচ্ছে। তখন তাঁর মনে বিশ্বাস আসলো যে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন। এরপর তিনি নদী পাড় করে একটা অশ্বথ গাছের তলায় আসলেন। এই গাছের তলাতেই তিনি কঠিন তপস্যায় বসলেন। এই জায়গাটিই গৌতম বুদ্ধের  বুদ্ধত্ব লাভের স্থানরূপে চিহ্নিত হয়ে গেছে।  বৌদ্ধদের কাছে জায়গাটি খুবই পবিত্র স্থান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধদের আর্থিক সাহায্যে এখানে অসখ্য মন্দির, ধর্মশালা, বিহার ও সাধনাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে যা বুদ্ধগয়াকে একটা আন্তর্জাতিক নগরীতে পরিণত করেছে।\


দর্শনীয় স্থান : 


মহাবোধি বিহার :
 মহাবোধি বিহার মন্দিরটি মঠের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।  মন্দিরটি অপূর্ব শিল্প নৈপুণ্যে নির্মিত।  দ্বিতল মন্দিরটির নীচের  অংশ ৪০ বর্গফুট আর উচ্চতা ১৭০ ফুট।  চতুস্কোনাকৃতি  মন্দিরটি নীচের  থেকে ক্রমশ উপরের দিকে সূক্ষ্ম হয়ে গেছে। মন্দিরটির ভিতরে নীচের তলায় একটি সুন্দর একটি বুদ্ধদেবের  মূর্তি রয়েছে।  উপরের তলায় বুদ্ধদেবের মাতৃদেবী  মায়াদেবীর মূর্তি আছে। মঠের চারদিকেই পুণ্যার্থীরা ধ্যান বা প্রার্থনার মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে দেখা যায়। মন্দিরটি সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন। বুদ্ধগয়ার এই মহাবোধি বিহার বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র ও শ্রেষ্ঠতম তীর্থ স্থান হিসেবে পূজিত হয়। সারা বিশ্বের সকল বৌদ্ধ ও নির্বাণকামী মানুষ এই স্থানে  এসে তীর্থদর্শন করেন   ও তাদের মনোবাঞ্ছা পুরণার্থে ধ্যান-সমাধি করেন ও পূজা দিয়ে থাকেন।

বোধিবৃক্ষ 
পরম পবিত্র বোধিবৃক্ষটি বুদ্ধগয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। এই বৃক্ষের শান্ত সুশীল ছায়ায় বসেই সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব বা জ্ঞানলাভ করেছিলেন।  এই বোধিবৃক্ষটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বৃক্ষরূপে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।  শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রচুর ঝড়-ঝাপটা ও মানুষের অত্যাচার  সহ্য করে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। বৃক্ষের এই জায়গাটিকে তীর্থযাত্রীরা পরম শ্রদ্ধার সাথে দর্শন করে।

সুজাতা কুঠি 
মহাবোধি বিহার মন্দিরটির থেকে নৈরঞ্জনা নদী  পাড়  হয়ে কিছুটা গেলে একটা মাটির স্তুপ দেখা যায়।  এই স্তূপটিই হল সুজাতার পৈতৃক বাস্তুভিটা।  বৌদ্ধ যাত্রীরা এই  স্থানে গিয়ে মাটির স্তূপটিকে শ্রদ্ধা জানান।

মুচলিন্দ্র সরোবর 
মহাবোধি মন্দিরের দক্ষিণদিকে একটা পুকুর দেখা যায়, সেটাই মুচলিন্দ্র   হ্রদ বা সরোবর। এই হ্রদের তীরে বসেই ছয় সপ্তাহ ধরে ভগবান বুদ্ধ শাক্যমুনি ধ্যানমগ্ন ছিলেন। এই জায়গাটিতে ভগবান যখন আধ্যাতিক চিন্তায় মগ্ন ছিলেন,  তখন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। ভগবান বুদ্ধকে ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নাগরাজ মুচলিন্দ্র নিজের শরীর দিয়ে ভগবানকে ঘিরে রেখেছিলেন এবং তার ফণা দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছিলেন।  এইভাবে  ছয় সপ্তাহ ধরে তিনি ভগবানকে রক্ষা করেছিলেন। এজন্য এই পুকুরটিকেই মুচলিন্দ্র হ্রদ বা সরোবর বলা হয়।  পূর্বে হিন্দুরা এখানে ব্রাহ্মণদের  সাহায্যে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের পিন্ডদান করত। এই কারণে এটাকে অনেকে বোধিকুণ্ডও বলে থাকে। ব্রম্ভদেশের পুণ্যাথীরা পুকুরটির মাঝখানে একটা বুদ্ধদেবের মূর্তি ও মূর্তিটির মাথার ওপর  নাগরাজের ফণা বিস্তিত রয়েছে, এমন একটা মূর্তি তৈরী করে দিয়েছেন।

আশি ফুট বুদ্ধ মূর্তি 
এই মূর্তিটি স্থাপন করার  পর থেকে বুদ্ধগয়ার আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে গেছে। মূর্তিটি জাপানি ভক্তরা তৈরী করে দেন। মূর্তিটির দুপাশে দাঁড়ানো অন্যান্য  প্রখ্যাত বুদ্ধভক্তদের মূর্তিও রয়েছে। মূর্তিটি জাপানি মন্দির সংলগ্ন স্থানে পূর্বমুখ করে খোলা আকাশের নীচে স্থাপন করা হয়েছে।  

থাই মন্দির 
অনন্য শিল্প নৈপুণ্যে সমৃদ্ধ থাই মন্দিরটি।  ১৯৫৬ সালে ১১ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে থাই সরকার মন্দিরটি স্থাপন করে দেন  থাই ভক্তদের জন্য। মন্দিরটি বিশাল জায়গা  নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে।  এই মন্দিরের ভিতরে অষ্টধাতুর একটা বুদ্ধ মূর্তিটি রয়েছে।  মূর্তিটি খুবই সুন্দর।  

তিব্বতি মন্দির 
এই মন্দিরটি শ্রীলংকা ধর্মশালার উত্তর পাশে রয়েছে।  এই মন্দিরে ১৯৩৮ সালে লাদাখের বিখ্যাত লামা খনগো  ওবংগ সোমন তিব্বত ও লাদাখবাসীদের অর্থানুকূল্যে স্থাপন করেন।  অপরূপ সাজে সজ্জিত মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের প্রতিমূর্তি রয়েছে  মন্দিরটিতে।  দ্বিতীয় তলায় অসংখ্য ধর্মীয় উপকরণ ও পুস্তকের পাণ্ডুলিপিও রয়েছে।  প্রথম তলায় একটা বিশাল আকারের ২০ টনের বেশি একটি ঘন্টাকৃতির বিরাট চক্র রয়েছে। 

জাপানি মন্দির 
মহাবোধি মন্দিরের দক্ষিণ -পশ্চিমে দুটি মন্দির রয়েছে, . এই মন্দির দুটি হল পুরাতন ও নতুন জাপানি মন্দির।  মন্দির দুটিতে ভূমি স্পর্শ মুদ্রায় দুটি বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। জাপানি শিল্পরীতিতে মূর্তিগুলো ও মন্দিরটি তৈরী করা হয়। 





কিভাবে যাবেন : 
বুদ্ধগয়ার নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন হল গয়া।  হাওড়া থেকে দিল্লিগামী যে কোন ট্রেনই গয়া হয়ে যায়। তাই গয়া পৌঁছোবার জন্য প্রচুর ট্রেন রয়েছে। গয়া থেকে বুদ্ধগয়ার দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার।গয়া রেল স্টেশনের ঠিক বাইরে থেকে শেয়ার অটো ধরতে পারেন অথবা অটো রিজার্ভ করেও যেতে পারেন। এছাড়া গয়া স্টেশন থেকে বাসও যাচ্ছে বুদ্ধগয়াতে। গোয়া থেকে বুদ্ধগয়া যেতে অটোতে মিনিট কুড়ি সময় লাগে। 



তারিখ : ২০-০২-২০১৯


 ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 








Saturday, February 16, 2019

কামারপুকুর-জয়রামবাটি ভ্রমণ kamarpukur jayrambati >

 পুণ্যের খোঁজে ঠাকুরের দেশে 


উনিশ শতকের জাগরণ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়। এই জাগরণই আমাদের পরাধীনতার  নাগপাশ থেকে মুক্তি দিয়েছিল।  এই জাগরণ বাংলার ধর্মে, সাহিত্যে, শিল্পকলায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। এই সময়ই অর্থাৎ ১৮৩৬ সালের ১৮ই ফ্রেব্রুয়ারী সুখলালগঞ্জে গদাধর নামে এক বালক জন্মগ্রহণ করেন।  হুগলী  জেলার আরামবাগ মহকুমাধীন গোঘাট থানার একটি ছোট্ট  গ্রাম এই সুখলালগঞ্জ। অতীতের  সুখলালগঞ্জই বর্তমানের  কামারপুকুর। 

আজ আমি ও আমার তিন বন্ধু সোম শঙ্কর, হারাধন ও চাঁদদা একটা গাড়ী  ভাড়া করে একটু পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে কামারপুকুর ও জয়রামবাটি ঘুরতে চললাম। আমাদের গাড়ী ঠিক সকাল ৬টায় কসবা থেকে ছাড়লো। রাস্তায় একটু চা ও জলখাবার খেয়ে নিলাম। তারকেশ্বর, আরামবাগের ওপর দিয়ে বেশ দ্রুতগতিতেই চালাচ্ছিল চালক ছেলেটি। আমোদর নদী পার করে সকাল ৯টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম কামারপুকুরে। প্রথমেই দুপুরের প্রসাদ নেওয়ার জন্য কুপন নিলাম। তারপর শ্রী রামকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে দেখলাম।  জায়গাগুলোর কথা পরে জানাব, তার আগে একটু কামারপুকুরের বর্ননা দিয়ে রাখি।  

আগেই বলেছি কামারপুকুর গ্রামটি হুগলী  জেলার একটা ছোট্ট  গ্রাম।  তবে প্রাচীন গ্রন্থে কামারপুকুর গ্রামের কোনো নাম পাওয়া যায় না।  কামারপুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গড় মান্দারণ বলে একটা গ্রাম ছিল। এই গড় মান্দারণ একটা ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। এই স্থানের ওপর ভিত্তি করেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "দুর্গেশনন্দিনী" লিখেছিলেন।  প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত এই গড় মান্দারণ দুর্গের ভগ্ন তোরণ, স্তুপ ও একটু দূরে অবস্থিত শৈলেশ্বর শিব মন্দিরটি  আজও রয়েছে। ক্ষীণতোয়া আমোদর নদী ও অপরপ্রান্তের জঙ্গলাকীর্ণ স্তুপ আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।  এই গড় মান্দারণ কামারপুকুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। একটু বেলাইন হয়ে গিয়েছিলাম, যাইহোক, হুগলী  জেলার উত্তর পশ্চিমাংশে যেখানে বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলা মিশেছে, ঠিক সেই জায়গাতেই কামারপুকুর গ্রামটি অবস্থিত। শ্রী রামকৃষ্ণের স্মৃতি শ্রীপুর, মুকুন্দপুর ও কামারপুকুর পাশাপাশি অবস্থিত এই তিনটি গ্রামেই লুকিয়ে আছে। এই তিনটি গ্রামই ঠাকুরের লীলাক্ষেত্র ছিল।  এই  গ্রাম তিনটিকে একত্রে বৃহৎ কামারপুকুর হিসেবে বর্তমানে ধরা হয়।

কামারপুকুর মঠের  প্রবেশদ্বার 
এইসব গ্রামের অধিবাসীরা বরাবরই খুব ধার্মিক প্রকৃতির  ছিলেন। সেই প্রাচীনকাল থেকেই  প্রায় প্রতিটি ঘরেই নানারকম দেব-দেবীর পূজাচ্চচর্না করা হত। শ্রী রামকৃষ্ণের জনক শ্রী ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় তাঁদের পৈতৃক ভিটা থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর এই কামারপুকুরে এসে বসবাস শুরু করেন। ক্ষুদিরামের পরিবার বরাবরই শ্রী রামচন্দ্রের উপাসক ছিলেন। এই গ্রামটি ঠাকুর শ্রী  শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মস্থান বলে তাঁর অনুরোগীদের কাছে খুবই পবিত্র স্থান। আজ সারা পৃথিবীর মানুষই এই গ্রামটির সাথে পরিচিত।

শ্রী শ্রী সারদা মায়ের জীবদ্দশাতেই কামারপুকুরে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর জন্মভিটায় একটা স্মৃতি মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। রামকৃষ্ণ মিশনের তৈরী করা এই মন্দিরটি ১৯৫১ সালে উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া কামারপুকুরে ও তার আশপাশে আরো বহু মন্দির রয়েছে,  সব মন্দির আমাদের দেখা হয়ে ওঠেনি। ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত যে কটা স্থান ও মন্দির দেখেছি ও  তাদের  সম্মন্ধে যতটা জানতে পেরেছি তা আপনাদের  জানাব।



কামারপুকুরের দ্রষ্টব্য স্থান  : 

রামকৃষ্ণ মঠ :  ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব বসতবাড়ির ঢেঁকিশালে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।  ঠিক সেই জায়গাতেই অর্থাৎ ঢেঁকিশালের  জায়গাতেই বর্তমান  মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে।  মন্দিরটির ভিতরে একটা বেদী  রয়েছে।  বেদীটির ওপরেই প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতায় ঠাকুরের সমাধিমগ্ন মর্মর মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটির সামনে একটা নাটমন্দিরও আছে।  রামকৃষ্ণ মিশন ঠাকুরদের এই  পৈতৃক জায়গা ছাড়াও পরবর্তীকালে আরো প্রায় ৮৪ বিঘা জমি কিনেছে। ১৯৪৯ সালের ১লা মার্চ বিখ্যাত শিল্পী শ্রী নন্দলাল বসু পরিকল্পিত স্মৃতি মন্দিরটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল।

ঠাকুরের বাসভবন :  দুটি কুটির নিয়ে তৈরী ঠাকুরের বাসভবন।  একটিতে ঠাকুর থাকতেন, আর একটি কুটিরে ঠাকুরের মধ্যমভ্রাতা রামেশ্বর তার পুত্র কন্যা নিয়ে বাস করতেন। এই কুঠিটি দ্বিতল। বর্তমানে এই দ্বিতল কুঠিটি মন্দিরের ভাড়ারঘর হিসেবে ব্যৱহৃত হয়।  ঠাকুরের বাসগৃহটি যথাযথ ভাবে একইরকম রেখে সুরক্ষা করা হয়েছে।  এই গৃহে ঠাকুরের একটা প্রতিকৃতিও  রাখা আছে।

রঘুবীরের মন্দির : ঠাকুরের বাসগৃহের সামনে এই মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরে রঘুবীর শিলা, শীতলাদেবীর ঘট, রামেশ্বর শিব পূজিত হয়।  এছাড়া ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মীদেবীর গোপাল ও নারায়নশীলের পুজোর  ব্যবস্থা রয়েছে।  ঠাকুরের উপনয়নের পর ঠাকুর এখানে রঘুবীরের পুজো করেছিলেন। বর্তমানে এই মন্দিরটি রামেশ্বরের বংশধরগণের তত্ত্বাবধানে আছে।  তারাই এখানকার পূজার্চ্চনা করে থাকে। মঠ থেকে পূজা ও ভোগের সব সামগ্রি দেওয়া হয়।

আম্রবৃক্ষ : ঠাকুরের বাস্তুভিটার সদর ঘরের পূর্বদিকে এই আম্রবৃক্ষটি  আছে।  ঠাকুর স্বহস্তে গাছটি রোপন করেছিলেন।

যুগিদের শিবমন্দির :  ঠাকুরের বাসভবনের উত্তরদিকে রাস্তার পাশে এই মন্দিরটি আছে। যুগিবংশের রামানন্দ যুগি মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পূর্বমুখী আটচালা-বিশিষ্ট মন্দিরটি ছোটর ওপর বেশ সুন্দর। মন্দিরটির গায়ে পোড়া মাটির কাজ করা কিছু শিল্পকলাও আছে। এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবের নাম শান্তিনাথ।.বর্তমানে মন্দিরটি রামকৃষ্ণ মঠের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখানকার এক  মহিলার কাছে শুনলাম এই মন্দিরেই ঠাকুরের মাতৃদেবী চন্দ্রমণি দেবী  প্রার্থনা করেছিলেন। মন্দিরটির  থেকেই এক দিব্যজ্যোতি চন্দ্রমণি দেবীর  দেহে প্রবেশ করেছিল। এই ঘটনার পরেই ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। 

হালদার পুকুর: যুগিদের শিবমন্দিরের উত্তরদিকে রাস্তার ধারে এই বিশাল পুকুরটি রয়েছে। পুকুরটিকে হালদার পরিবারের ছোট ছেলে খনন করেছিলেন। ঠাকুরের পিত-মাতা ও ঠাকুর স্বয়ং পুকুরটি ব্যবহার করতেন। পরবর্তীকালে মা সারদাদেবীও পুকুরটি ব্যবহার করেছেন। পুকুরটি রামকৃষ্ণ মঠ  কিনে নিয়েছেন এবং তারাই পুকুরটির  রক্ষনাবেক্ষন করেন।

লক্ষ্মীজলা : এই 
 জমিটিকে ভিত্তি করেই কামারপুকুর গ্রামে ক্ষুদিরামের বসবাসের সূচনা হয়েছিল।  হালদারপুকুরের পশ্চিমদিকে জমিটির অবস্থান। ক্ষুদিরাম এই জমিতেই চাষবাস আরম্ভ করেছিলেন। বর্তমানে মঠের কৃষিবিভাগ এই জমিতেই চাষ করে। এখানকার ধানেই আজও রঘুবীরের সেবা হয়ে থাকে।

ঠাকুরের পাঠশালা 


রামকৃষ্ণ পাঠশালা : রামকৃষ্ণ মন্দিরটির পূর্বদিকে লাহাবাবুদের চন্ডীমণ্ডপটি রয়েছে। এই চণ্ডীমণ্ডপের ঠিক সামনে অবস্থিত আটচালাটিই ঠাকুরের পাঠশালা। এই পাঠশালাতেই বালক গদাধর পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি হন। সেই আমলে আটচালাটি খড়ের ছাউনি দেওয়া ছিল।  পরে টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া হয়।  ছাপান্নটি কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরী সাবেক আটচালার কাঠামোটি। এখনও আটচালাটি অক্ষুন্ন আছে। এই পাঠশালাতেই গদাধরকে পড়িয়েছিলেন যদুনাথ সকার, রাজেন্দ্রনাথ সরকার এবং তাঁর  সহপাঠী ছিলেন গঙ্গাবিষ্ণু ও হারাধন।

 লাহাদের চণ্ডীমণ্ডপ :  এই চন্ডীদালান বা দুর্গামন্দিরটি পূর্বমুখী। ১২৫৭ বঙ্গাব্দে ধর্মদাস লাহা মন্দিরটি পাকা করেন।  বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই মন্দিরে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে।

লাহাদের বাড়ি :  ধর্মদাস লাহা ছিলেন একজন ধনী ব্যক্তি।  তিনি ঠাকুরের পিতা  ক্ষুদিরামের পরম বন্ধু ছিলেন।  লাহা ও চট্ট্যোপাধ্যায় পরিবারের মধ্যেও একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ঠাকুরের  বাসভবনের দক্ষিণদিকে লাহাদের প্রাসাদোপম অট্টালিকাটি রয়েছে।  ওই আমলে এই প্রাসাদের এক কোনে  একটা পান্থনিবাস ছিল। সেখানে সাধুরা এসে বিশ্রাম নিতেন। এই পান্থনিবাসেই ঠাকুর সাধুদের সেবা করতেন। শুনলাম পাঠশালার উত্তরদিকে লাহাদের একটা রাসমঞ্চ ছিল, যা  ধ্বংস হয়ে গেছে।

পার্বতীনাথ মন্দির : এই আটচালা শৈলীর মন্দিরটি পাঠশালার উত্তর-পূর্ব কোনে অবস্থিত। ধর্মদাস লাহার কন্যা প্রসন্নময়ী দেবী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।  মন্দিরটির বিগ্রহ হলেন বাবা মহাদেব।

দামোদর বা বিষ্ণুমন্দির :  জগন্নাথ লাহা মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।  তিন খিলানযুক্ত  বারান্দাসহ মন্দিরটি ঠাকুরের মন্দিরের পূর্ব-দক্ষিণ কোনে অবস্থিত। মন্দিরটির গর্ভগৃহের সংহাসনে দামোদরশিলা  আসীন আছেন।

পাইনবাড়ি : ঠাকুরের মন্দিরের ডানদিকে সতীনাথ পাইন ও দুর্গাদাস পাইনের বসতবাড়ীটি অবস্থিত।  এই বাড়ীতে গদাধরের অবাধ যাতায়াত ছিল। এই গৃহেই ঠাকুর তাঁতিবউ সেজে অন্দরমহলে প্রবেশ করে দুর্গাদাস পাইনের দর্পচূর্ণ করেছিলেন। এই বাড়ীরই সন্তান লক্ষণ পাইন যখনই কলকাতা থেকে দেশের বাড়ি ফিরতেন তখনই তিনি দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে গিয়ে ঠাকুরের সাথে দেখা করে তবে ফিরতেন। এই বাড়িটির মধ্যেই পাইনদের একটা বিষ্ণুমন্দির ছিল। এই মন্দিরটির সামনেই কিশোর বয়সে ঠাকুর যাত্রায় শিবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ঠাকুরের স্মৃতিমাখা সেই বিষ্ণুমন্দিরটি আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত।

চিনু শাখারীর ভিটা :  ঠাকুরের বাসভবনের পূর্বদিকে সামান্য দূরে চিনু ওরফে শ্রীনিবাস শাঁখারির বসতবাড়ীটি রয়েছে। এই চিনু শাঁখারিই সর্বপ্রথম বালক গদাধরকে দেখে অবতাররূপে চিহ্নিত করেছিলেন।  ঠাকুরের সাথে তাঁর "চিনুদাদা"-র  খুব সুনিবিড় সম্পর্ক ছিল।  চিনুর বাস্তুভিটায় ঠাকুরের যাতায়াত ছিল।  বর্তমানে চিনুদের এই বাস্তুভিটাটিও  রামকৃষ্ণ মঠ  ও মিশনের অন্তর্ভুক্ত।

শান্তিনাথ শিবমন্দির : চিনু শাঁখারির বাড়ির পূর্বদিকে ঘোষপাড়ায় এই প্রাচীন  শিবমন্দিরটি রয়েছে। ভরত  ঘোষ ও তার পুত্র অর্জুন ঘোষ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। টেরাকোটার কাজ করা মন্দিটির উচ্চতা ২৫ ফুট আর প্রস্থ ১৫ ফুট।  মন্দিরটিতে এখনও নিত্য পূজা ও শিবরাত্রির দিন বিশেষ পূজা করা হয়ে থাকে।

গোপীশ্বরের মন্দির : ঠাকুরের পাঠশালার পূর্বদিকে এই প্রাচীন মন্দিরটি অবস্থিত। ঠাকুরের পিতা  ক্ষুদিরামের আশ্রয়দাতা সুখলাল গোস্বামীর পূর্বসূরি গোপিলাল গোস্বামীর নামানুসারেই মন্দিরটি পরিচিত। মন্দিরটিতে শিবের অধিষ্ঠান আছে। শুনলাম এই মন্দিরের সাথে পূর্বে একটা নাটমন্দির ছিল, যা এখন আর নেই। 

ধনীমাতার মন্দির : লাহাবাবুদের চণ্ডীমণ্ডপের দক্ষিণদিকে এই মন্দিরটির অবস্থান। মন্দিরের বেদীতে একটা রঙিন পট এবং এই পটটির  পিছনদিকে ঠাকুরের একটা তৈলচিত্র রয়েছে। কলকাতার  বৌবাজারের রাধারমণ দাস মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ভূতির খালের শ্বশান : শ্রী রামকৃষ্ণ মন্দিরের পশ্চিমপারে এই শ্বশানটি ছিল। এই শ্বশানের বটবৃক্ষের তলায় ঠাকুর বহুবার ধ্যানে বিভোর হয়েছিলেন। এখানে ঠাকুর স্বহস্তে একটা বেলগাছ রোপন করেছিলেন, কিন্তু তা আজ আর নেই। বর্তমানে  শ্বশানের মাঠটি খালার মাঠে পরিণত হয়েছে।  এই মাঠটির পশ্চিমদিকে শিশু উদ্দ্যান আর দক্ষিণদিকে যাত্রীনিবাস তৈরী করা হয়েছে। ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই শ্বশানে প্রতিবছর শ্রী রামকৃষ্ণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শুনলাম এখানেই ১৯৩৬ সালে বেলুড় মঠ  শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মশতবর্ষের  সূচনা করেছিলেন। 


এই মন্দিরগুলো ছাড়াও কামারপুকুর আরো কয়েকটা মন্দির রয়েছে, সময়ের অভাবে সেগুলো আমাদের আজ আর দেখা হয়ে উঠল না।  ভবিষ্যতে আবার একবার এসে মন্দিরগুলো দেখার ইচ্ছা রয়ে গেল। মন্দির দর্শন করতে করতে কোথা থেকে যে তিন ঘন্টা সময় কেটে গেছে খেয়াল করতে পারিনি। ঘড়িতে তখন ১২টা বাজে। আমরা মিশনের বইয়ের দোকানে একটু বই দেখে  প্রসাদ নেওয়ার জন্য খাবার ঘরে এসে পৌঁছলাম।   খাবার ঘরটিতে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম কি বিশাল ঘর আর বহু স্টিলের বেঞ্চ দিয়ে সাজানো রয়েছে ঘরটি।  আমার মনে হল সাত-আটশো লোক একসাথে বসে এখানে খেতে পারবে।  যাইহোক, আমরা হাত-মুখ ধুয়ে একটা বেঞ্চে এসে বসলাম। প্রথমেই গরম গরম ভাত, তার সাথে একে একে পাঁচ-মিশালী তরকারি, ডাল, চাটনি এবং সবশেষে পায়েস পরিবেশন করা হল।  সবকটা রান্নাই স্বাদে অতুলনীয়।  খিদের মুখে এরকম গরম গরম সুন্দর খাবার পেয়ে আমরাও পেট ভরে খেয়ে নিলাম। মন্দিরের উল্টোদিকে গেস্ট হাউসের পাশে রাস্তার ধারে একটা সুন্দর বিশ্রামাগার রয়েছে। খাওযার পরে ওই বিশ্রামাগারে আমরা কিছুক্ষন বিশ্রাম করে নিলাম। বিশ্রামের পর আমরা আর এক পুণ্যভূমি জয়রামবাটির মন্দিরগুলো দেখতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিলাম।



রামকৃষ্ণদেবের জন্মভুমি কামারপুকুর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে জয়রামবাটী গ্রামটি অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার কোতলপুর থানার অধীনে একটা ছোট্ট গ্রাম হল এই জয়রামবাটি। এই গ্রামেরই এক গরীব মুখোপাধ্যায় পরিবারে ১৮৫৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর সারদাদেবী  জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯২০ সালের ২০শে  জুলাই দেহত্যাগ করেছিলেন।১৮৫৯ সালের মে মাসে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের  সাথে তাঁর  বিবাহ হয়। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্তদের কাছে তাই এই গ্রামটিও একটা তীর্থক্ষেত্ররূপে পরিগণিত হয়েছে।  সারদাদেবীর বাসভনটিও রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধীনে রয়েছে। তারা এই বাসভবনেই বিরাট একটা মাতৃমন্দির নির্মাণ করেছে।

জয়রামবাটির দ্রষ্টব্য স্থান :

মাতৃমন্দির :  এই মন্দিরটি মঠের কেন্দ্রস্থলে তৈরী করা হয়েছে।  মন্দিরটিতে ১৯৫৪ সালে  সারদা মায়ের একটি শ্বেতপাথরের মূর্তি বসানো হয়েছে তাঁর জন্মশতবর্ষপূর্তির সময়। তার আগে একটা তৈলচিত্র ছিল।,এই তৈলচিত্রকেই তখন পূজা করা হত। বর্তমানে ওই তৈলচিত্রটি বেলুড় মঠে  রামকৃষ্ণ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত করা আছে। ১৯৩২ সালের ১৯শে এপ্রিল স্বামী সারদানন্দ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানের শ্বেত পাথরের মূর্তিটির তলায় শ্রী শ্রীমার দেহাবশেষ রাখা আছে। মন্দিরটির সামনে একটা বিরাট প্রার্থনা কক্ষ আছে। মন্দিরটির ওপরে অর্থাৎ চূঁড়ায় "মা"  শব্দটি  রয়েছে ও  একটা পতাকা সবসময় উড়ছে ।

মায়ের পুরোনো বাড়ি  : মঠের প্রবেশদ্বারের বাঁদিকে এই বাড়িটি রয়েছে। ১৯১৫ সাল পর্যন্ত মা  সারদা দেবী এই  বাড়িতেই বসবাস করতেন।  এই বাড়িতে তিনি তাঁর ভক্তদের দীক্ষা দিতেন।

মায়ের নতুন বাড়ি  : এই নতুন বাড়ীটিও মঠের মধ্যে অবস্থিত। প্রবেশদ্বারের পাশে একটা ছোট দরজা দিয়ে এই বাড়ীতে প্রবেশ করতে হয়।  এই বাড়ীতেই  সারদাদেবী  ১৯১৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বসবাস করতেন। এই বাড়ীতেও  তিনি অনেক ভক্তদের দীক্ষা দিয়েছিলেন।

পুন্যিপুকুর : মাতৃমন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে এই পুকুরটি আছে। সারদাদেবী এই পুকুরটি ব্যবহার করতেন।  তাই ভক্তদের কাছে পুকুরটি খুবই পবিত্র।

ধর্মঠাকুরের মন্দির : পুন্যিপুকুরের পাশেই এই মন্দিরটি আছে। মন্দিরটি সারদা মায়ের পরিবারের গৃহদেবতা  সূর্যনারায়ণ ধর্মঠাকুরের মন্দির। এখানে নিয়মিত তাঁর পুজো করা হয়।   

সিংহবাহিনী মন্দির : মঠের কাছেই এই মন্দিরটি অবস্থিত।  সিংহবাহিনী হল মা দুর্গার একটি রূপ এবং এটি  জয়রামবাটি গ্রামের দেবতা। মন্দিরটিতে সিংহবাহিনী, মহামায়া, চন্ডী  ও মনসার ধাতব মুখ রয়েছে, তবে কোনো সম্পূর্ণ মূর্তি নেই। সারদা দেবী বহুবার এই মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন। এখানকার লোকেরা এই মন্দিরের মাটিকে খুব পবিত্র হিসেবে ধরে এবং তারা এই মাটিকে ঔষধ হিসাবেও ব্যবহার করে থাকে।


কামারপুকুর বা জয়রামবাটি এই দুটি জায়গাতেই এখানকার বিখ্যাত সাদা বোঁদে খেতে ভুলবেন না।  ঠাকুর ও সারদাদেবী  এই বোঁদে দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল। এই বোঁদে পশ্চিমবঙ্গের স্বতন্ত্র ঐতিয্যবাহী একপ্রকার  মিষ্টান্ন। এই বোঁদে কবে কে কবে প্রথম তৈরী করেছিলেন তার তথ্য পাওয়া যায় নি।  তবে ঠাকুরের বাড়ির পাশেই মোদক পরিবারের মিষ্টির দোকান ছিল ঠাকুর এই দোকান থেকে বোঁদে  কিনে খেতেন।  


কিভাবে যাবেন :  কলকাতার ধর্মতলা থেকে সরকারি/বেসরকারি বাসে  করে সরাসরি যেতে পারেন , এছাড়া ট্রেনে করে আরামবাগ স্টেশন পৌঁছে বাস বা গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন।  
   

তারিখ : ১৬-০২-২০১৯

 ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০



 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Wednesday, February 13, 2019

স্মরণে: বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র Birendra Krishna Bhadro>

বাজলো তোমার আলোর বেনু....






আমার ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় ঠাকুর তৈরী করা হতো, প্রতিদিন তিন থেকে চারবার তা দেখতে যেতাম , কতটা তৈরী হলো আর কতটাই বা বাকি রয়ে গেলো, তা নিয়ে সারাক্ষণই মনের মধ্যে গবেষণা চলতো । এই ঠাকুর দেখেই আমি মায়ের আগমন অনুভব করার চেষ্টা করতাম। যেহেতু আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা সবটাই শহর কেন্দ্রিক, তাই শিউলির গন্ধ বা কাশের দোলা দেখার সুযোগ আমার ছিল না। মহালয়ের প্রভাতে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বলিষ্ঠ উদাত্ত কণ্ঠের স্তোত্রপাঠ ও "জাগো, তুমি জাগো, জাগো দশ প্রহরণ ধারিণী" দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গুরু গম্ভীর গলায় গাওয়া গান কানে পৌঁছনোর পরই "মা আসছে" এই শব্দটা যেন শরীরের শিরা-উপশিরায় পৌঁছে যেত, সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে যেত। মহালয়া ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যেন একে ওপরের পরিপূরক। তিনি ছিলেন বাঙালিয়ানার প্রতীক।  

উত্তর কলকাতার মাতুলালয়ে ১৯০৫ সালের ৪ঠা  আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ আর মাতা ছিলেন সরলাদেবী।  তাঁর পিতা বহুভাষায় বিশারদ ছিলেন।  তিনি ১৪টি ভাষা জানতেন। নিম্ন আদালতে দোভাষীর কাজ করতেন। তিনি লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯২৭ সালে "রায়বাহাদুর" খেতাবটি পান। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের দাদামশাই ছিলেন পুলিশ কোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। প্রথমে তাঁর পরিবার উত্তর কলকাতার এক ভাড়াবাড়িতে বসবাস করতেন। পরবর্তীকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঠাকুমা শ্রীমতি যোগমায়াদেবীর কেনা ৭ রাধারমণ মিত্র লেনের বাড়িতে তাঁরা সপরিবারে উঠে আসেন। ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ নামে তাঁর আর এক ভাই ছিলেন। প্রথমে তিনি রেলের  চাকরি করতেন। তারপর রেলের চাকরি ছেড়ে তিনি আকাশবাণীতে যোগ দেন।  

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ১৯২৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। ১৯২৯ সালে তিনি আকাশবাণীতে যোগদান করেন। ১৯৩১ সালে প্রথম "মহিষাসুরমর্দ্দিনী " সংগীতালেখ্যটি প্রচার হয়, যা আজও সবার কাছে সমান জনপ্রিয়। রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ও মাতা সরলাদেবীর কনিষ্ঠ সন্তানকে এই গীতিআলেখ্যটি খ্যাতির উচ্চসীমায় পৌঁছে দেয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুধু বেতার সম্প্রচারক ছিলেন না, তিনি নাট্যকার, নাট্য প্রযোজক, ও অভিনেতাও ছিলেন। "হিতোপদেশ". " বিশ্বরূপ দর্শন". "রানা-বেরানা" প্রভৃতি বই তিনি লেখেন। "বিরূপাক্ষ" এই ছদ্মনামেও তিনি  অনেকগুলো রম্য রচনাও লিখেছিলেন। এছাড়া ১৯৫৫ সালে তিনি "নিষিদ্ধ ফল" নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেন, বিমল মিত্রের "সাহেব বিবি গোলাম" উপন্যাসটি মঞ্চায়িত করেন, ১৯৫২ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের "সুবর্ণ গোলক " গল্পটিকেও নাট্যায়িত করেন। 

বেতারে প্রতি বছর প্রচারিত মহালয়ার প্রভাতে মহিষাসুরমর্দিনী সংগীতালেখ্যটি বীরেন্দ্র কৃষ্ণকে  সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছে।মহিষাসুরমর্দিনী সেই ১৯৩১ সালে আকাশবাণীতে প্রথম প্রচার হয় মহালয়ের পুন্য প্রভাতে। তখন নাম ছিল "প্রত্যুষ প্রোগ্রাম" পরের বছর ওই দিনে ওই প্রোগ্রামটা আবার প্রচারিত হয়, কিন্তু নামটির পরিবর্তন করে করা হয় "প্রভাতী অনুষ্ঠান" এই নামে  অনুষ্ঠানটা আরো দুবছর চলার পর আবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "মহিষাসুর বধ"  কিন্তু এতেও অনুষ্ঠান কর্তারা সন্তুত  হতে পারলেন না,  তারা পরের বছর আবার নামটির পরিবর্তন ঘটান, এবার তারা নাম দেন :"মহিষাসুরমর্দিনী"  এই মহিষাসুরমর্দিনী হল শ্রী শ্রী চন্ডীর স্তোত্র বা চন্ডীপাঠ, বাংলা ভক্তিগীতি ধ্রপদী সংগীত এবং পৌরাণিক কাহিনীর এক অসামান্য নাট্যরূপ। যা রচনা করেছিলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুরে আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অনবদ্য গ্রন্থনা ও শ্লোকপাঠে বেতারের এই মহিষাসুরমর্দিনী সংগীতালেখ্যটি  আজও অর্থাৎ রচনার প্রায় ৯০ বছর পার করেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভ্রদ্রকে অবিস্মরনীয় করে রেখেছে। এখনো তার জনপ্রিয়তা বা মহিমায় এতটুকু ভাটা  পরেনি।  দেবীপক্ষের সূচনায় মহালয়া অমবস্যা ও দুর্গা পুজোর সাথে এই অনুষ্ঠানের  যেন নাড়ির যোগ রয়েছে। এখনো মানুষের মনে বীরেন্দ্র কৃষ্ণের অসাধারণ গুরুগম্ভীর কণ্ঠের সেই  শ্লোক ও  স্ত্রোত্রের  পাঠ কানে না পৌঁছলে যেন শারদীয়া উৎসবের আমেজ মনে আসে না। 


প্রসঙ্গক্রমে একটা ঘটনার কথা বলি,  ১৯৭৬ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে না জানিয়ে আকাশবাণীর কর্তারা একটা গোপন বৈঠক করে ঠিক করেন, এই বছর মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের বদলে মহালয়ার প্রভাতে  তারা  "দেবী দুর্গতিনাশিনী " নামে  একটা অনুষ্ঠান করবেন। যেমন ভাবনা ঠিক তেমন কাজ। তারা অনুষ্ঠানটি লেখার জন্য বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর গোবিন্দ গোপাল মুখার্জী মহাশয়কে ঠিক করলেন।  ভাষ্যপাঠের জন্য মহানায়ক উত্তমকুমারকে দায়িত্ব দিলেন।  মহানায়ক প্রথমে এই দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিলেন  না। অবশেষে বিভিন্নজনের  চাপাচাপিতে তিনি কিছুটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই রাজি হলেন। আকাশবাণীর এই কাজে তিনি যথেষ্ট বিব্রত বোধ করেন। এই ভাষ্যপাঠ রেকর্ডিং করার আগে তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়িতে গিয়ে তার অয়োগ্যতা ও অস্বস্তির কথা জানান।  সহজ সরল মানুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাকে উৎসাহ দেন ও বলেন কোনো চিন্তা না করতে সব ঠিক হয়ে যাবে। যথারীতি নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠানটা আকাশবাণী থেকে পরিবেশন করা হল।  বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বাড়িতে বসে অনুষ্ঠানটার সবটা শুনছিলেন। অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি শুধু বলেছিলেন " লোকে যদি নেয় তাহলে নিক" কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে বাদ দিয়ে  এই অনুষ্ঠানটা বাংলার মানুষ মেনে নিতে পারেনি।  এই নিয়ে আকাশবাণী ভবনে বিক্ষোভ দেখান বেশ কিছু মানুষ।  আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই সেই বছর ষষ্ঠীর প্রভাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের "মহিষাসুরমর্দিনী" সংগীতালেখ্যটি আবার প্রচার করে।   


শ্রী অজিত বসু তাঁর বইতে এক জায়গায় শ্রী বীরেন্দ্রকুমার ভদ্রের একটা লেখা দিয়েছেন যে "২২শে শ্রাবনের মধ্যাহ্নে সজনীকান্ত দাস জোড়াসাঁকো থেকে সর্বাগ্রে খবর পাঠালেন যে রবীন্দ্রনাথ  প্রয়াত  হয়েছেন। সঙ্গে  সঙ্গেই সেই সংবাদ কলকাতা বেতারে  প্রচার করেই আমি ছুটে গেলাম জোড়াসাঁকো। বেতারের যন্ত্রপাতি ও ইঞ্জিনিযারদের নিয়ে শ্বশান ঘাটে ছুটে গেলাম আমরা, আমার সঙ্গী ছিলেন মনমোহন ঘোষ (চিত্রগুপ্ত), দুজনে সেখানকার ব্যবস্থা ঠিক করেই   ছুটলাম জোড়াসাঁকোয়।  লোকে লোকেলোকারণ্য। গেটের মধ্যে জোর করে ঢুকে কবিকে শেষ দর্শন করার জন্য অগণিত জনতা গেটে ধাক্কা দিচ্ছে - তার ফলে একটি গেট ভেঙে গেলো। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ভিতরে প্রবেশাধিকার পেলেন না বা পাওয়া সম্ভবও  ছিল না।  ঠাকুর বাড়িতে শবদেহ বেশিক্ষন রাখার রীতি নেই, বিশেষত মধ্যাহ্নে যিনি মহাপ্রয়াণ করেছেন, তাঁকে বিকেলের মধ্যেই নিয়ে যেতে হবে।  অগণিত জনতা রবীন্দ্রনাথের শ্বাশানুগমন করতে থাকে। আমরাও সংবাদ সংগ্রহ করতে নিমতলা শ্বশান ঘাটে উপস্থিত হই। তিলধারণের স্থান নেই, একটি মই সংগ্রহ করে শ্বশান ঘাটের একটি চূড়ায় উঠলাম আমি, তারপর নামলাম একটি ভগ্ন আলসের ওপরে, হাত দিয়ে ধরবার মতো কোনো জিনিস সেখানে ছিল না এবং সেখানে বিপদ তুচ্ছ করে বসে এক হাতে মাইক্রোফোন ধরে রেকর্ড করতে লাগলাম রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্যের সংবাদ। দুঃখের বিষয় সেদিন যে আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে আমি ধারাবিবরণী রেকর্ড করেছিলাম সেই রেকর্ডটি বেতারে আর নেই।   সহস্র রেকর্ডের সঙ্গেই ভগ্ন হয়ে গেছে, তার কোনো নকল করেও রাখা হয়নি। 

সেই ধারাবিবরণী শুনে একদিন রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী শ্রীমতি সরলা দেবী স্বয়ং বেতার অফিসে এসে আমাকে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন। সমগ্র বাঙালির জাতির মনে যে দুঃখের ঝড় সেদিন বয়েছিল তারই সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে পেরেছিলুম - " সমুখে দেখছি অপরাহ্নের সূর্য শেষ বিদায়ের পথ নিচ্ছে - ভাগীরথীর গৈরিক জলপ্রবাহে উঠেছে এক করুন তাপ - আজ সমস্ত বাংলার বুকে দীর্ঘশ্বাসের ওঠা-পড়া - বাতাসে হাহাকার - বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ আর নেই।  রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের জানি, কিন্তু তিনি বাঙালির রবিঠাকুর, বাঙালির গৌরব, বাঙালির প্রাণের প্রাণ, একটি আপনজন। - আজ সূর্যকে কি বিসর্জন দিয়ে চিররাত্রির অন্ধকারের মধ্যে বাঙালি জাতি আত্মগোপন করবে - না আবার সে নবসূর্যের আলোক সভাতলে জ্যোতির সমুদ্রে স্নান করতে পারবে ? সমগ্র বাঙালির মনে এই প্রশ্ন উঠছে বার বার, আজ তাই সকলের মনে এই প্রার্থনা জেগে উঠছে, হে কবি, হে পুরাতন, হে চিরনূতন - রাত্রির অবসান ক্ষণিক হোক - আগামীকালের নবপ্রভাতে নূতনরূপে তুমি দেখা দাও, - দেখা দাও আবার হে নুতন। "

উত্তমকুমারের  মৃত্যুর পরও তাঁর  অন্তিম যাত্রার ধারাবিবরণী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র দিয়েছিলেন। তিনি ভাষা ও কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করেছিলেন, তা শোকাতুর বাঙালির চোখের জলের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিলো।


তিনি খুব অভিমানীও ছিলেন। চাদর ও উত্তরীয় ছাড়া কোনো সরকারি খেতাব বা সম্মান তার জোটেনি।






তারিখ : ১৩-০২-২০১৯
লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া



যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

গুপ্তিপাড়া ভ্রমণ Guptipara >

  গুপ্ত গল্পের সন্ধানে গুপ্তিপাড়ায়


                                 "আমি সেই  ভোলানাথ নইরে,  আমি সেই  ভোলানাথ নই  
                                    আমি ময়রা ভোলা ভিয়াই খোলা বাগবাজারে রই "

সেদিন দুপুরবেলায় বাড়িতে বসে ইউটিউবে পুরোনো বাংলা সিনেমা দেখার জন্য বসলাম। ওল্ড  বেঙ্গলী মুভিস লিখতেই "এন্টনি ফিরিঙ্গি" সিনেমাটা প্রথমেই এলো।  যদিও বহুবার দেখা সিনেমাটাই আবার দেখতে বসলাম। সিনেমাটির কবির লড়াইয়ের দৃশ্যে  উত্তমকুমারের সাথে ভোলা ময়রার লড়াই দেখছিলাম। এই লড়াই দেখতে দেখতে ভোলা ময়রার সম্বন্ধে একটু জানতে আগ্রহ হল। তাই  সিনেমাটা শেষ হওয়ার পর উইকিপিডিয়ায় একটু  উঁকি মারলাম।  ওপরের উক্তিটি থেকে আমার ধারণা ছিল ভোলা ময়রার জন্ম-কর্ম সবই কলকাতার বাগবাজারেই। কিন্তু আমার ধারণাটা ভুল প্রমাণিত হলো উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে।  উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে ওনার জন্ম হুগলী  জেলার গুপ্তিপাড়ায় আর কর্ম কলকাতার  বাগবাজারে। যাইহোক, গুপ্তিপাড়ার গল্প বহুবার বহুজনের কাছ থেকে শুনেছিলাম আর ফেসবুকে তো ছবির ছড়াছড়ি।  আগে কখনো গুপ্তিপাড়ায় আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি।  তাই পরের দিন এক বন্ধুকে নিয়ে এই গুপ্ত গল্পের সন্ধানে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। ৯টার ট্রেন ধরার জন্য যথাসময়ে হাওড়া স্টেশনে  পৌঁছে গেলাম।  টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লাম। যথাসময়ে ট্রেন ছেড়ে দিল।  ঘন্টা  দুয়েক বাদে আমরা  গুপ্তিপাড়ায় পৌঁছে গেলাম।  

স্টেশন থেকে বাইরে আসার পর দেখলাম কয়েকজন রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়। একজন যুবক রিক্সাওয়ালার কাছে গিয়ে গুপ্তিপাড়ার সব ঘোরাতে কত নেবে জানতে চাইলাম। সে আমাদের বললো সব দেখিয়ে দেবে  আর সাথে সেইসব জায়গার ইতিহাসও আমাদের জানাবে। যাওয়ার আগে এক বন্ধুর কাছ থেকে জেনেছিলাম রিক্সা ভাড়া মোটামুটি ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা নেয়। কিন্তু  যুবকটি ৩০০ টাকা চাইলো। আমি তাকে বললাম ১৫০ টাকা ভাড়া তো, তুমি এতো বেশি  চাইছো কেন ? সে বলল হ্যা আপনি খানিকটা ঠিকই বলেছেন, তবে ওটা  ১৫০ টাকা নয় ২০০ টাকা আর আমি যে আপনাদের ইতিহাস জানাবো তাই ১০০ টাকা বেশি চাইলাম।  আপনারা ২০০ টাকায় শুধু মন্দিরগুলো দেখতে পারবেন কিন্তু  ইতিহাস জানতে পারবেন না।  শুধু দেখার সাথে যদি  ইতিহাসও জানা যায় তবে  মন্দ হয় না।  ইতিহাস জানাটাও জরুরি বলে আর কথা না বাড়িয়ে ওর কথায় রাজি হয়ে গেলাম।  তার নাম জানতে চাইলে সে  জানালো তার নাম গণেশ।
গুপ্তিপাড়ার গ্রাম্য রাস্তা 

যেতে যেতে গণেশ গুপ্তিপাড়ার ইতিহাস বলছিল। গুপ্তিপাড়া হলো হুগলি জেলার একটা প্রাচীন জনপদ। ১৭৭৯ সালের বেনেলের মানচিত্রে দেখানো আছে গুপ্তিপাড়ার পাশ দিয়ে বেহুলা নামে একটা নদী প্রবাহিত হয়ে গঙ্গায় গিয়ে মিশেছিল। এখানে প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষার টোল ছিল। টোলের পন্ডিতরা  বেশিরভাগ  এখানেই বসবাস করতেন।  এই সংক্রান্ত সব নথি  এখানকার সরকারি গ্রন্থাগারে এখনো  সংরক্ষিত আছে। গুপ্তিপাড়ার অলিতে গলিতে ইতিহাসের ছড়াছড়ি। শুধু ভোলা ময়রা নয়  বাংলার শেষ নবাব সিরাজদুল্লার প্রধান সেনাপতি ছিলেন মোহনলাল ও রাজা রামমোহনের সংগীত শিক্ষাগুরু কালী মির্জাও এখানে জন্মেছিলেন। আমরা এখন যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি এই রাস্তাতেই রথের সময় বিরাট মেলা বসে। গণেশ বললো বাবু কলকাতা যাওয়ার সময় একটু গুঁপো  সন্দেশ বাড়ির জন্য নিয়ে যাবেন। সে আমদের রথের সময় একবার আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালো।

 গুপো সন্দেশ গুপ্তিপাড়ার শুধু নয় পশ্চিমবঙ্গের এক  অন্যতম জনপ্রিয় মিষ্টি।  সম্পূর্ণ গরুর দুধ থেকেই এটাকে  তৈরী করা হয়।  পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ব্যান্ডেড মিষ্টিই  হলো এই গুপো সন্দেশটি। এই সন্দেশটির সৃষ্টিকর্তা বা জন্মসাল কারোর জানা নেই। সে আরো জানালো যে গুপ্তিপাড়াতেই প্রথম সন্দেশের জন্ম হয়। তবে এই সন্দেশটিকে অনেকে গুঁফো সন্দেশ বলে থাকে।  খুবই সুস্বাধু মিষ্টি, বাড়ির জন্য নিয়ে গেলে সবাই খুব খুশি হবে। এই অসাধারণ স্বাদের মিষ্টি আপনি কলকাতার কোথাও পাবেন না। আমার বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করলো তুমি এতো সব শিখলে  কিভাবে? তুমি লেখা-পড়া করেছো? সে বললো বাবু আমি মাধ্যমিক পাশ করেছি। এখানকার সব ইতিহাস আমার এক মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে  জেনেছি।

প্রথমে সে আমাদের দেশ কালী মন্দিরে নিয়ে এলো।  দেখলাম গাছ-গাছালিতে ভরা একটা সুন্দর জায়গা। এখানেই একটা ছোট্ট সুন্দর একটা মন্দির রয়েছে।  মন্দিরটির সামনে আসার পর দেখলাম
দেশ কালী মাতার মন্দির 

একটা অন্ধকার ঘর।  কিন্তু ঘরটির মধ্যে কোনো বিগ্রহ নেই। গণেশ জানালো এখানে শুধু কালীপুজোর দিনটিতেই  মাটির মূর্তি এনে পুজো করা হয়। পুজোর পর শুক্লা  দ্বিতীয়ার দিন মূর্তিটির কেশ ও আরো দু-একটা অংশ কেটে বাকি মূর্তিটিকে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। কাটা অংশগুলোকে অন্ধকারে রেখে তান্ত্রিক মতে সারা বছর পুজো করা হয়।  কোনো মন্দিরে বিগ্রহকে নিয়ে এরকম হতে পারে সে সম্বন্ধে আগে আমার কোনো ধারণা ছিল না।
দেশ কালী মন্দিরটি দেখে সামান্য এগোতেই দেখলাম রাস্তাটি ডানদিকে ঘুরে গেছে। এই ঘোরার মুখেই বাঁদিকে  একটা ছোট মাঠে বেশ উঁচু টিনের একটা মন্দিরের মতো করা আছে।  কিন্তু মিন্দিরটিতে ঢোকার জন্য কোনো দরজা দেখা যাচ্ছে না।  বেশ কৌতূহল নিয়েই গণেশের কাছে জানতে চাইলাম এটা কি? ও জানালো এটাই গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত রথ।   রথটিকে সারা বছর এভাবেই রাখা হয়। সে আরো
দূরের টিনের ঘরটিতেই রথটি রাখা আছে  
জানালো রথের উৎসব গুপ্তিপাড়ার প্রধান উৎসব।  প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন বৃন্দাবনচন্দ্রের এই  রথ উৎসবটি। এখানকার  রথ উৎসবটিই  পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন রথ উৎসব।  রথের সময় প্রায় এক মাইল রাস্তার  দুধারে বেশ জমজমাট মেলা বসে।  দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসে এখানকার রথ দেখতে ও রথের দড়ি টানতে। রথের দিন  প্রায় লাখ  খানেক লোকের সমাগম হয় গুপ্তিপাড়ায়।  উল্টো রথের দিন "ভান্ডার লুঠ"  উৎসব হয়। ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন করার পর মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয় ভক্তদের জন্য। সেই সময় ভক্তরা ওই নিবেদিত ভোগ লুঠ করে।  এই "ভান্ডার লুঠ" উৎসবটি বেশ ধুমধামের সাথেই পালিত হয়। রথযাত্রা এখানকার প্রধান উৎসব হলেও রাস , দোল, জগদ্বাত্রীর পুজোও বেশ উৎসাহের সাথেই এখানে পালন করা হয়।
দূরের মন্দিরগুলোই গুপ্তিপাড়া মঠ 

এই টিনের ঘরের ঠিক পাশেই গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত "গুপ্তিপাড়া মঠ" রয়েছে। চৈতন্যদেব, কৃষ্ণচন্দ্র, বৃন্দাবনচন্দ্র ও রামচন্দ্রের নামে  চারটি মন্দির একই প্রাঙ্গনে অবস্থিত। এই চারটি মন্দিরের সমষ্টিকেই  "গুপ্তিপাড়ার মঠ " বলা হয়। এরপর গণেশ আমাদের "গুপ্তিপাড়ার মঠের দরজার সামনে এসে রিক্সা দাঁড় করল ।

বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির গুপ্তিপাড়ায় ছোট বড় অনেক মন্দির আছে তার মধ্যে এই মন্দিরটিই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। আটচালা শৈলীর এই মন্দিরটি সম্পূর্ণ ইটের তৈরী।  মন্দিরটি আকারে বেশ বড়।  মন্দিরটির গঠনের নকশাটি সবাইকে মুগ্ধ  করে।  মন্দিরটির বাইরের দিকে খুব একটা পোড়ামাটির ভাস্কর্য দেখতে পেলাম না। শুধু তিনটি খিলান ও স্তম্ভগুলোতে সামান্য লতা-পাতার ও ফুলের কারুকাজ রয়েছে। প্রায় আট ফুট উঁচু একটা বেদির ওপর মূল মন্দিরটি রয়েছে। গণেশ  জানালো  মন্দিরের  চূড়াগুলো  নাকি গঙ্গার ওপার
বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির

মন্দির মঠের প্রবেশ দ্বার 
অর্থাৎ  শান্তিপুর থেকে  নাকি দেখা যায়।  গর্ভগৃহের কাঠের দরজাটিতেও সুন্দর কাজ করা আছে।  মন্দিরটিতে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ অধিষ্ঠিত আছে।  গণেশ বললো  আগের মন্দিরটি ভগ্ন হয়ে যাওয়ায় এই নতুন মন্দিরটি ১৮৩৮ সালে কলকাতার বাগবাজারের শ্রী গঙ্গানারায়ণ সরকার মহাশয় তৈরী করে দিয়েছিলেন।  বিগ্রহটি মোহান্ত রামানন্দ স্বামী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  রাজা বিশ্বেশ্বর রায় মহাশয়  জমিটি দান করেছিলেন। এই মন্দিরটি তারকেশ্বর মঠের  অধীনে রয়েছে।



চৈতন্যদেবের মন্দির :   এই মন্দিরটি ১৬৫০ সালে তৈরী হয়েছিল।  সেই সময় দেশে আকবরের শাসন চলছিল। মন্দিরটি নির্মাণ করেন রাজা বিশ্বেশ্বর  রায়।  মন্দিরটিতে শ্রী গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দের মূর্তি রয়েছে।  বিগ্রহ দুটি খুবই সুন্দর দেখতে। প্রাচীন  শৈলীতে তৈরী এই মন্দিরটি এখন প্রায় ভগ্নঅবস্থায় রয়েছে। ভারতীয় পুরাকীর্তি আইনে সমগ্র মঠটি সংরক্ষণ করা হয়, কিন্তু এই মন্দিরটিতে রক্ষনাবেক্ষনের অভাব রয়েছে দেখলাম।  মন্দিরটি এই মঠের সবচেয়ে পুরোনো স্থাপত্য।

রামচন্দ্র  মন্দির 

রামচন্দ্র মন্দির :
এই মন্দিরের গায়ের  পোড়ামাটির কাজকে পশ্চিমবাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ  বলা হয়। এই মন্দিরটিও বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের মত  তারকেশ্বর মঠের অধীনে রয়েছে। অতীতে গুপ্তিপাড়ায় দশমহাবিদ্যার পুজো করা হতো।  কিন্তু বর্তমানে সে পুজো আর করা হয় না।  মন্দিরটি একচূড়া বিশিষ্ট চারচালা শৈলীতে তৈরী।  পাঁচ ফুট উঁচু বেদির ওপর মন্দিরটির অবস্থান। এই মন্দিরের কারুকাজের মতো কাজ হুগলি জেলায় আর কোনো ,মন্দিরে দেখা যায় না।

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির :  এই মন্দিরটিও তিনটি খিলান বিশিষ্ট আটচালা মন্দির। মন্দিরটি অন্যান্য মন্দিরের মতো উঁচু বেদির উপর স্থাপিত। শ্রী রাধাকৃষ্ণ,  চন্দ্র ও রাধিকার বিগ্রহ রয়েছে গর্ভগৃহে।  দন্ডি মধুসূদন ১৭৪৫ সালে মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।

গুপ্তিপাড়ার মঠের মন্দিরগুলো দেখানোর পর সে আমাদের প্রাচীন বিন্ধ্যবাসিনীতলায় নিয়ে আসলো। বিন্ধ্যবাসিনীতলা হচ্ছে সেই বিখ্যাত জায়গা যেখান থেকে আমরা কিভাবে সবাই একসাথে মিলেমিশে একটা পুজোর রূপ দিতে হয় শিখেছিলাম। গণেশ আমাদের বেশ গর্বের সাথে এখানকার গল্পটা বলছিলো।  ১৭৭০ সালে এখানকার বর্ধিষ্ণু সেন পরিবারের দুর্গাপুজো চলছিল তাদের বিশাল বাড়িতে।  পাড়ার কতগুলো যুবক এই পুজো দেখতে এসেছিলো।  তারা নিজেদের মধ্যে বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছিলো। তাদের কথা বলার আওয়াজে  পুজোমণ্ডপটিতে কোলাহল তৈরী করছিলো, এই অপরাধে সেন বাড়ির দারওয়ান যুবকগুলোকে পুজো মণ্ডপ থেকে বের করে দিয়ে প্রবেশদ্বারটি  বন্ধ করে দিয়েছিল। এই ঘটনায় যুবকগুলো খুব অপমানিত বোধ করে।  তারা বারোজন বন্ধু মিলে মনস্থির করল বৃন্ধ্যবাসিনিতলায় তারা আলাদা করে পুজো করবে। তাদের এই পুজোয় সবার অবাধ যাতায়াত থাকবে। বিন্ধ্যবাসিনীতলার  জঙ্গল পরিষ্কার করে পুজোর জন্য প্রস্তুত করতে লাগলো। যেহেতু তখন দুর্গাপুজো শেষ লগ্নে এসে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই তারা ঠিক করলো  দুর্গাপুজো না করে জগদ্ধার্ত্রী পুজো করবে। এই বারো-ইয়ার অর্থাৎ বারোজন বন্ধু একসাথে মিলে  যে জগদ্ধার্ত্রী পুজো করেছিল, সেই পুজোটিই  বাংলার বুকে প্রথম বারোয়ারি  পুজো বা সার্বজনীন পুজো বলে স্বীকৃতি  লাভ করে।

এটা দেখানোর পর গণেশ জানালো আর কিছু দেখানোর নেই, এবার সে আমাদের স্টেশনে পৌছে দেবে।  আমি গণেশকে বললাম সব তো দেখালে কিন্তু ভোলা ময়রার বাড়িটা তো আমাদের দেখালে না।  ওটা একবার দেখিয়ে দাও তাহলে আমাদের  ষোল কলা পূর্ণ হবে যাবে। তখন সে বলল গুপ্তিপাড়ায় ভোলা ময়রার এখন কোনো বাড়ি আর নেই। কোনো একসময় ছিল বলে আপনাদের মত আমিও বড়দের কাছ থেকে শুনেছিলাম । ভোলা ময়রার কোনো স্মৃতি এখন আর এখানে নেই। শুনেছিলাম তিনি নাকি কবিগানের টানে গুপ্তিপাড়ার আদিবাড়ি ছেড়ে কলকাতার বাগবাজারে গিয়ে বসবাস করতেন। সারা জীবন তিনি বাগবাজারেই কাটিয়ে ছিলেন।  

গণেশ নরসিংহ মিষ্টান্ন ভান্ডার নামে  একটা মিষ্টির দোকানের সামনে তার রিকশাটি দাঁড় করিয়ে দিল এবং বললো এখান থেকে বাড়ির জন্য গুঁপো সন্দেশ কিনে নিয়ে যেতে। আগে  সে আমাদের গুপো সন্দেশের ইতিহাসের কথা বলছিল। সে বলল ভোলা ময়রার কোনও চিহ্ন গুপ্তিপাড়া ধরে রাখতে না পারলেও, গুপ সন্দেশের ঐতিহ্যকে কিন্তু এখনো  ধরে রেখেছে।  





কী ভাবে যাবেন:
হাওড়া থেকে গুপ্তিপাড়া মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে।  কাটোয়া লোকালে উঠে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে গুপ্তিপাড়া স্টেশনে পৌঁছনো যাবে। স্টেশনের বাইরেই  রিক্সা স্ট্যান্ড রয়েছে।  রিক্সা ভাড়া করে সবকটা মন্দির দেখা যাবে।  শিয়ালদহ স্টেশন থেকেও ট্রেনে গুপ্তিপাড়া আসা যায়।  এছাড়া গাড়িতে জি টি রোড বা দিল্লি রোড ধরে এসে তারপর ৬ নং  জাতীয় রাজ্য সড়ক ধরে গুপ্তিপাড়ার  রথতলায় আসতে পারেন। সব মন্দিরে এই রথতলা অঞ্চলেই  অবস্থিত।  তবে রথের সময় আসলে রথতলাতে কোনো গাড়ি যেতে দেবে না, বেশ কিছুটা আগেই গাড়ি রাখতে হবে।  আরেকভাবেও গুপ্তিপাড়া যাওয়া যায়, ট্রেনে করে শান্তিপুর গিয়ে সেখান থেকে ভেসেলে গঙ্গা পার হয়ে যাওয়া যেতে পারা যায়। শান্তিপুর-গুপ্তিপাড়া গঙ্গা  পারাপারের জন্য নিয়মিত এই ভেসেল চলাচল করে। 

তারিখ : ১৩-০২-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী 
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Tuesday, February 12, 2019

স্মরণে : পান্নালাল ভট্টাচার্য Pannalal Bhatacharyya>


আমার সাধ না মিটিল....





আজ কালীপুজো, পাড়ায় পাড়ায় মাইকে বাজছে সেই অতি পরিচিত কণ্ঠের ভক্তিমাখা শ্যামাসংগীত। শ্যামাসংগীত হচ্ছে কালি বিষয়ক বাংলা ভক্তিগীতির এক জনপ্রিয় ধারা। এই ধারায় বাংলার এক সন্তান নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন।

আপনারা নিশ্চয় ধরে ফেলেছেন আমি কার কথা বলতে চাইছি , যার গাওয়া গান ছাড়া বাংলার বুকে শ্যামা মায়ের আরাধনা করার কথা ভাবা যায় না । সেই শিল্পী হলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য । তিনি বিখ্যাত গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। পান্নালালের শৈশব জীবন সম্বন্ধে  খুব একটা কিছুই জানা যায় না। তিনি জন্মগ্রহণ করেন হাওড়া  জেলার বালি অঞ্চলের বরেন্দ্রপাড়ায়।  তার জীবনের বেশিরভাগ সময় এখানেই কেটেছে। ১৯৪৭ সালে আর এক বিখ্যাত গায়ক সনৎ সিংহের সাথে গান গাওয়া শুরু করেন।     মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতে শুরু করেন । খুব স্বাদ ছিল দাদার মতো তাঁরও গাওয়া গান রেকর্ড হয়ে বেরোক। তাই তিনি তাঁর  গান রেকর্ড করার জন্য গ্রামোফোন কোম্পানির পরীক্ষায় বসেন, কিন্তু সেই পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে পারলেন না । হিস্ মাস্টার্স ভয়েস জানালেন তার কণ্ঠ এখনো অপরিণত রয়েছে। এই ঘটনায় তিনি যথেষ্ট ভেঙে পড়লেন। যাই হোক পরবর্তীকালে মেগাফোন কোম্পানি এগিয়ে এসে তাকে দিয়ে আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড বের করে । প্রথমদিকে পান্নালাল আধুনিক বাংলা গান গাইতেন। সনৎ সিংহের এক বন্ধু পান্নালালকে দিয়ে "আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা " শ্যামাসংগীতটি গাওয়ান।  যা আপামর বাঙালিকে চমকে দেয়, তার গায়কিতে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়।এই গানটি বাংলা সঙ্গীত জগতে আজও সমানভাবে সমাদর পায়।  এরপর আরো অনেক গান তিনি রেকর্ড করেন। তার উচ্চারণের মধ্যেই একটা অদ্ভত মায়া জড়ানো থাকতো, তার গান শোনা শেষ হয়ে গেলেও যেন মনের মধ্যে একটা রেশ থেকে যায়।

তিনি বহু বিখ্যাত সব ভক্তিগীতি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন, যা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। "মায়ের পায়ে জবা হয়ে", "সকলই তোমারি ইচ্ছা", "আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা" এইসব কালজয়ী গানগুলো অসংখ্য কালীভক্তের মন জয় করে নিয়েছিল । তিনি ভক্তিগীতি গাইতে গাইতে নিজে যে কবে কালীভক্তে পরিণত হয়ে গেছিলেন তা বুঝতে পারেননি।

তিনি গেয়ে গেছেন " আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিলো" । সত্যি হয়তো তার নিজের সাধ মেটেনি ও আশাও হয়তো পূর্ণতা লাভ করেনি । জীবনের শেষদিকে তিনি ভীষণ মন মরা হয়ে থাকতেন, সবসময় কোনো চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। দিনের পর দিন তিনি শ্মশানে সময় কাটাতেন। ১৯৬৬ সালের ২৭শে মার্চ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সব গুনমুগ্ধ শ্রোতাদের কাঁদিয়ে বালিগঞ্জের বাড়িতে তিনি আত্মহত্যা করেন। ‘ও পার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে’!— এটাই ছিল তাঁর গাওয়া শেষ গান। তিনি তিন কন্যা ও স্ত্রীকে রেখে গিয়েছিলেন । তিনি হয়তো চলে গেছেন কিন্তু তার গান অমরত্ব লাভ করেছে ।


তিনি ও বাঙালির কালীপুজো মিলে মিশে এক হয়ে গেছে ।তার মৃত্যুর ৫২ বছর পরও তার গান, তার গায়কী আমাদের মোহিত করে রাখে।













তারিখ : ১৩-০২-২০১৯

ছবি : সংগৃহীত 

লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Sunday, February 10, 2019

স্মরণে: মৃণাল সেন Mrinal Sen>

স্মরণে মৃণাল সেন

ত্রয়ী শব্দটা বাংলার সংস্কৃতি জগতে বার বার আলোচিত হয় । সাহিত্যের ত্রয়ী হলেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায় - বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশঙ্কর। তেমনি নাট্য জগতে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, আর অজিতেশ বন্দ্যেপাধ্যায়। চলচ্চিত্র জগতের হলেন তিন দিকপাল পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেন। এই তিন জনের হাত ধরেই ভারতীয় তথা বাংলা চলচ্চিত্র বিশ্ব দরবারে বার বার উজ্জ্বল হয়েছে । বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসরে বরাবরই তাঁদের গৌরবময় অবস্থান ছিল। তাঁরা মোটামুটি একই সময় চলচ্চিত্র শিল্পে পা রাখেন। তাঁরা আজ সবাই চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাঁদিয়ে চলে গেছেন । ৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৬ সালে ঋত্বিক ঘটক, ২৩শে এপ্রিল, ১৯৯২ সালে সত্যজিৎ রায় আর আজ অর্থাৎ ৩০শে ডিসেম্বর, ২০১৮ তে শেষ নক্ষত্রের পতন হলো। তিনি হলেন মৃণাল সেন । তাঁকে আর নীল আকাশের নীচে ধরে রাখা গেলো না । বছরের শেষে এসে মৃণাল সেনের মতো ব্যাক্তিত্বর চলে যাওয়া সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। শেষ হয়ে গেল বাংলা চলচ্চিত্রের একটি স্বর্ণযুগের।

যখন সারা দেশে স্বাধীনতার উত্তাল আন্দোলন চলছে, তখন অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর নামে এক ছোট শহরে মৃণাল সেন জন্মগ্রহণ করেন । সালটা ছিল ১৯২৩ এর ১৪ই মে। তাঁর পিতা উকিল হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আদালতে যুদ্ধ চালাতেন। সেইসূত্রে ছোট্ট বয়স থেকেই মৃণাল সেন সুভাষচন্দ্র বসু, বিপিন পাল থেকে আরো কতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তাঁর বাড়িতে যাতায়াত করতে দেখেছেন । তিনি তাঁর স্কুলের শিক্ষা ফরিদপুরে শেষ করে ,কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়তে আসেন। মেসে থাকাকালীন তিনি পদার্থবিদ্যার সাথে কবিতা ও রাজনীতির চর্চ্চা শুরু করেন। আস্তে আস্তে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্কৃতি বিভাগের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন।

তিনি তাঁর পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে দু-চারটা টিউশনি, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা-লেখির মাধ্যমে সামান্য আয় করতে লাগলেন। ১৯৫০ সালে মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভের চাকরি নিয়ে কিছু দিনের জন্য কানপুরে চলে গেলেন। কিন্তু এই কাজে তাঁর মনের শান্তি আসলো না। তিনি চাকরি ছেড়ে আবার কলকাতায় ফিরে এলেন। বেকার অবস্থায় ঘোরা-ঘুরি করতে করতে একদিন এক চায়ের আড্ডায় চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তের সাথে আলাপ হলো। তাঁর হাত ধরে তিনি চলচ্চিত্রের জগতে পা রাখলেন। চিত্রনাট্য লেখা, সহযোগী পরিচালনার কাজ করে নতুনভাবে জীবনটা চলে যাচ্ছিলো ও চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় হচ্ছিলো।

এইভাবে চলতে চলতে ১৯৫৫ সালে তিনি "রাত ভোর" নামে একটা ছবি তৈরী করে ফেললেন । কিন্তু ছবিটা সেভাবে দর্শকরা নিলো না । তিনি এই ছবিটা সম্বন্ধে পরবর্তীকালে বলেছিলেন " সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি, পৃথিবী কাঁপানো ছবি, আর আমার প্রথম ছবি আমাকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে"। তারপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজনায় "নীল আকাশের নিচে" তৈরী করলেন। এই ছবিটার থেকে তিনি আর্থিক দিক দিয়ে শক্ত জমিতে পা রাখতে পেরেছিলেন, কিছুটা পরিচিতিও আনতে পেরেছিলেন। তারপর "বাইশে শ্রাবন" তাঁকে কিছুটা আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয়। ১৯৬৯ সালে তৈরী করেন "ভুবন সোম"। এই ভুবন সোম সিনেমাতেই অমিতাভ বচ্চন নেপথ্যে তাঁর জীবনের প্রথম কণ্ঠ দিয়েছিলেন।

তারপর থেকে মৃণাল সেন ইন্টারভিউ, ক্যালকাটা ৭১, পদাতিক, একদিন প্রতিদিন, মৃগয়া, খারিজ ইত্যাদি চলচ্চিত্র তৈরি করেন । এছাড়া তেলেগু ভাষায় " ওকা উড়ি কথা", ওড়িয়ায় "মাটির মনীষা", "জোড়া দিঘির চৌধুরী পরিবার" ও হিন্দিতেও কয়েকটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। তিনি মোট ২৭টা পূর্ণ দৈঘ্যের কাহিনিচিত্র, ১৬টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ও ৪টি তথ্যচিত্র তৈরি করেন।

সিনেমায় তার অসামান্য অবদানের জন্য বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি মস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল -এ সিলভার পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৭৫-এ কোরাস-এর জন্য আর ১৯৭৯ পরশুরামের জন্য। কার্লোভী ভ্যারি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল -এ স্পেশাল জুড়ি পুরস্কার পান ১৯৭৭ সালে ওকা উড়ি কথা ছবির জন্য। বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ ইন্টারফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পান ১৯৭৯- এ পরশুরাম আর ১৯৮১-তে অকালের সন্ধানের জন্য। ১৯৮১ সালেই তিনি অকালের সন্ধানের জন্য জুড়ি পুরস্কারও পান। কান ফিল্ম ফেস্টিভালে খারিজ সিনেমার জন্য ১৯৮৩ সালে জুরি পুরস্কার পান। ভেনিস ফিল্ম ওসিআইসি অ্যাওয়ার্ডস, অনারেবল মেনশন ১৯৮৯ সালে পায় তার একদিন অচনাক সিনেমাটি।

১৯৮১ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রদান করে। ২০০৫ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার "দাদা সাহেব ফালকে " পান। ১৯৯৮ - ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্বারা নির্বাচিত সংসদের সাম্মানিক সদস্য পদ লাভ করেন। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে "অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ " সম্মানে ভূষিত করেন। ফরাসি সরকার তাদের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান "কমান্ডার অফ টি আর্টস এন্ড লেটার্স" এ তাকে ভূষিত করেন।

নিয়ম ভেঙে ছবি বানানোতেই মৃনাল সেন সবচেয়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এভাবে চলচ্চিত্র বানাতে তিনি খুব আনন্দ পেতেন । বাংলা ছবির ধারাকে তিনি পাল্টে দিয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের আধুনিক রূপরেখাও দিয়েছিলেন তিনি।

তারিখ : ১০-০২-২০১৯

ছবি : সংগৃহিত

লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া



 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।