Sunday, November 22, 2020

কলকাতার চীনা কালী মন্দির>P

কলকাতার চীনা কালী মন্দির




আমরা প্রায়ই চীনা  খাবার খেতে ট্যাংরার চায়না টাউনে  যাই, কিন্তু  ভুলেও কেউ দেখতে যাই না ওই পাড়ার বিখ্যাত চীনা কালী মন্দিরটিকে। শহরবাসীর কাছে অঞ্চলটি শুধু পানশালা ও মনোরম চাইনিজ খাবারের জন্য বিখ্যাত।  এই চীনা পাড়াতেই রয়েছে বহু প্রাচীন ও সুবিখ্যাত চীনা কালী মন্দির। এই মন্দিরে পূজিতা হন দেবী কালী, যা হিন্দুদের কাছে যেমন জাগ্রত ঠিক তেমন অঞ্চলের চীনা পরিবারগুলোর কাছেও সমানভাবে সমাদৃত। 

আমরা জানি শহর কলকাতার কাছে বজবজে প্রথম চীন দেশ থেকে টং অছি নামে  এক চীনা ভদ্রলোক একটা চিনি কল স্থাপন করেন।  তিনি তার কলে উৎপাদিত চিনি  বিক্রির উদ্দেশ্যে এই শহরে পাড়ি জমান।  চিনি শিল্পের হাত ধরে তার আগমন ঘটলেও চীনারা পরবর্তী সময়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন।  তারা বাঙালি সংস্কৃতির সাথে মিলে মিশে যায়।  তারই ফলস্বরূপ এক চীনা অধিবাসী অধুনা চীনা পাড়ায়  গড়ে তোলেন এই চীন কালী মন্দিরটি। যা আজ প্রায় ষাট  বছর অতিক্রম করে গেছে।  




বছর ষাটেক পূর্বে স্থানীয় অধিবাসীরা একটি নিম  গাছের তলায় দুটি  কালো পাথরে সিঁদুর মাখিয়ে পূজা করতো। পরবর্তীকালে অঞ্চলে একজন চীনা অধিবাসী সেটিকে অনুসরণ করতে থাকেন।  তিনি জাতে ও ধর্মে ভিন্ন হলেও হিন্দু দেবতারূপে পাথরটিকে সমানভাবে মান্যতা দিতেন ও খুব নিষ্ঠা সহকারে পূজা করতেন।  ধীরে ধীরে আরো কয়েকজন চীনা অধিবাসী তাকে অনুসরণ করতে লাগলো। সব কিছু দেখে পরবর্তীকালে জনৈক চীনা ভদ্রলোক সেই গাছকে ও কালো পাথর দুটিকে নিয়ে একটি ছোট্ট মন্দির নির্মাণ করে দেন। 

 কথিত রয়েছে এক চীনা  দম্পতির সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।  তখন তারা ওই গাছের কালো পাথর দুটিকে ভক্তি ভরে আরাধনা করেছিলেন। সেই আরাধনার ফলে তাদের সন্তান সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।  সেই বিশ্বাসে তাঁরা এখানকার এই মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন ও মাটির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে দেন।  পরবর্তীকালে আবশ্য সেই মাটির মূর্তিটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুনভাবে মূর্তিকে অষ্টধাতুতে নির্মিত করা হয়েছে।  


মন্দিরে অবস্থিত রয়েছেন দেবী কালিকা  ও মহাদেব।  সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হিন্দু ধর্ম মতে এখানে নিয়মিত পুজার্চ্চনা করা হয়ে থাকে।  এখানকার দেবী আরাধনার দায়িত্বে রয়েছেন হিন্দু পুরোহিত। দীপাবলির দিন বহু চীনা ও বাঙালি ভক্তের সমাগম হতে দেখা যায়।  সকলেই পূজা ও পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে থাকে। এখানকার ভোগ হিন্দু  ও চাইনিজ সংস্কৃতির মিশ্রনে হয়ে থাকে। দেবীর নৈবেদ্যতে যেমন থাকে হিন্দুদের মতো খিচুড়ি, তরকারি, ফল, মিষ্টি তেমন চাউমিন ইত্যাদি কয়েকপ্রকার চাইনিজ খাবারও  থাকে। শোনা যায় মন্দিরে যে ধূপ ব্যবহার করা হয় তা চীন দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়।  

আমাদের শহর বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র।  তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো এই চীনা কালী মন্দিরটি। যা এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কলকাতার বুকে।  মা সবার, সবার তাকে আরাধনা করার অধিকার  রয়েছে। 

তারিখ : ২২-১১-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Sunday, November 15, 2020

উত্তর কলকাতার গিন্নি>P


উত্তর কলকাতার গিন্নি 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 




সনাতন ধর্ম মতে কালী বা কালিকা হলেন শক্তির দেবী।  হিন্দু দেবী।  দেবীর ওপর নাম শ্যামা। কাল শব্দিটির অর্থ হলো মৃত্যুরোধক অর্থাৎ মৃত্যুর সময় আসন্ন, বলা হয় মহাকাল এসে গেছে।  দেবীর নাম মহাকালী। শিবের ওপর নাম কাল।  কালী হচ্ছেন কাল কথাটির স্ত্রীলিঙ্গ বোধক।  কালী হচ্ছেন দেবী দুর্গার বা পার্বতীর ভয়াল রূপ।  তিনি কৃষ্ণবর্ণা ও ভয়ঙ্করা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবীর ভয়ঙ্করা রূপের পূজা করে থাকেন। তিনি অশুভ শক্তির বিনাশ করেন। তাঁর এই সংহারী রূপের পরেও আমরা তাঁকে মাতা হিসেবে সম্বোধন করে থাকি।  তিনি কল্যাণময়ী ও মঙ্গলময়ী মাতাও। তন্ত্র অনুসারে দেবী কালী হলেন দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী।  



কলকাতা শহরের উত্তর দিকের কুমারটুলি অঞ্চলটিকে  আমরা সবাই ঠাকুর তৈরির  পাড়া  হিসেবেই জানি।  কিন্তু এই পাড়াতেই  একটি বহু প্রাচীন কালী মন্দির রয়েছে। মন্দিরটি কত প্রাচীন তার কোনো হদিস আজও পাওয়া যায়নি।  আজ থেকে প্রায় ৪০০ - ৫০০ বছর পূর্বে উত্তর কলকাতার কুমারটুলি ও বাগবাজার অঞ্চলটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। তখন অঞ্চলটি সুতানুতি নাম পরিচিত ছিল। জঙ্গলের    চারদিকে বেত ও নানারকম গাছে ভরা, ঘুরে বেড়াতো ডাকাত ও ঠ্যাঙারের দল।  কোনো জনবসতি গড়ে ওঠেনি।   সেই সময় উত্তর ভারতের হিমালয় থেকে  কালীবর নামাঙ্কিত এক তপস্বী সাধক স্বপ্নাদেশ পেয়ে দক্ষিণদিকে যাত্রা শুরু করেন। ভুলবশত তিনি গঙ্গার ধারে অর্থাৎ ভাগীরথীর তীরে আজকের বাগবাজার অঞ্চলে একটি মায়ের মূর্তি তৈরী করে গভীর সাধনায় নিমগ্ন হন, গড়ে তোলেন তার সাধনার পীঠ।  সাধনা করে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন এবং মাতৃ দর্শন লাভ করেন। শোনা যায়, এই স্থানে তিনি বেত ও হোগলা পাতা দিয়ে একটি ঘরও  তৈরী করেন।  সেই ঘরে দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তাঁর সাধনার সময় ও মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে বহু মতান্তর রয়েছে। সেই সন্ন্যাসী  চলে যাওয়ার পর এক কাপালিক বিগ্রহটির পূজা শুরু করেন।   কথিত রয়েছে, সেই আমলে নাকি নন্দ ডাকাত নামে  এক ডাকাত এই অঞ্চলে দেবী কালির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরটি তার আশ্রম  ছিল।  গোপবংশীয় ডাকাত নন্দরাম ঘোষ দেবী সিদ্ধেশ্বরীর সামনে নরবলি দিতেন।  ডাকাতের দলে ছিল হাড়ি, বাগদি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, মুসলমান সহ নানা রকম ধর্মের মানুষ।  দলের সকলেই মাতৃ আরাধনায় অংশ নিতো।    প্রায় প্রতিদিন ডাকাত তার মন্দিরে নরবলি দিয়ে তবে ডাকাতি করতে বেরতো। পরবর্তীকালে  ইস্ট ইন্ডিয়া  নরবলি বন্ধ করে দেয়।  পরবর্তী সময় এই অঞ্চলে তৎকালীন জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র ১৭৩০-৩১ সাল  নাগাদ একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন। মন্দিরের চূড়া আজকের শহীদ মিনারের চেয়েও উঁচু ছিল।  ১৭৩৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সেটি ভেঙে পড়ে।  জমিদারের মন্দিরটিকে সাহেবরা "মিত্র প্যাগোডা" বা "ব্ল্যাক প্যাগোডা" বলে অভিহিত করতো। 

পরে কাঁটাপুকুর অঞ্চলের রামসন্তোষ ঘোষ নাম একজন সম্পন্ন ও প্রভাবশালী ব্যক্তি এখানে এসে বসবাস শুরু করেন।  তিনি ডাকাতদলের নিত্যনৈমিত্তিক কাজে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।  শোনা যায় , এক অমাবস্যার  রাতে দুটো বালককে বলি দেওয়ার জন্য ডাকাতদল ধরে নিয়ে এসেছিলো।  সিদিন সন্ধ্যে থেকে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতহচ্ছিল। রামসন্তোষের স্ত্রী শিবানী দেবী তার ঘরে পূজাতে বসেছিলেন সেই সময় দরজায় কেউ ধাক্কা দিতে থাকে। তিনি দরজা খুলে দেখেন সম্মুখে দুটি বালক দাঁড়িয়ে আছেন।  একটি বালক ঠক ঠক করে কাঁপছে আর একটি বালক তার পায়ে লুটিয়ে পরে আশ্রয় ভিক্ষা করছে।  বালকটি শিবানীদেবীকে বলল যদি আশ্রয় না দেওয়া হয় ডাকাতরা তাদের দুজনকে বলি দিয়ে দেবে।  কোনোক্রমে ডাকাতদের চোখ এড়িয়ে তারা পালিয়ে এসেছে।  সেই রাতে রামসন্তোষ তার স্ত্রীর কাছ থেকে সব ঘটনা শুনে পরদিন সকালে ডাকাত সর্দারকে ডেকে পাঠান। ডাকাত সর্দার নন্দ  তাকে পাত্তা দিলেন না, উপরন্তু তাকে হুমকি দিলেন। রামসন্তোষ পরদিন গ্রামের সকলকে ডেকে মন্দিরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন একটি মানুষের কাটা মুন্ডু  পড়ে  রয়েছে।  ডাকাতরা  আগেরদিন রাতে জনৈক কোনো ব্যক্তিকে বলি দিয়েছিল।  এরপরই রামসন্তোষের বাহিনী ডাকাতকে গুলি করে মারে।  তারপর থেকে অঞ্চলে উৎপাত বন্ধ হয়।   


বর্তমানে কুমারটুলি অঞ্চলে বাগবাজারের কাছে ট্রাম লাইনের পাশে  সুপ্রাচীন মন্দিরটি অবস্থিত। রবীন্দ্র সারণি ও মদন মোহনতলা স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থিত মন্দিরটির  ঠিকানা হলো- ৫২০, রবীন্দ্র সারণি, কুমারটুলি, কলকাতা- ৭০০০০৫। মন্দিরটি খুবই ছোট।  রাস্তা থেকেই দেবী মূর্তি দেখা যায়।  মন্দির সংলগ্ন একটি দালান রয়েছে।  মূর্তি পশ্চিমাস্যা।  মন্দিরের বারান্দার নিচে ফুটপাতের উপরেই বলিদানের মঞ্চ রয়েছে।মন্দিরটিতে একটি  সুন্দর সিদ্ধেশ্বরী মাতার মূর্তি বিরাজিত। দেবী এখানে মৃন্ময়ী বসন ও স্বর্ণালংকারে ভূষিত। দেবীর পদতলে শ্বেত  মহাদেব শায়িত রয়েছে। প্রতিদিন নিত্যপূজা হয়। কালী পূজার দিন ও বিশেষ বিশেষ তিথিতে বেশ সমারোহে দেবী পূজিত হন। সেই সব দিনগুলোতে  এখানে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। কালীপুজোর দিন দেবীর বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা করা হয়।   সাধারণত তাতে  খিচুড়ি, সাদা ভাত, পাঁচ রকমের ভাজা, দুরকমের তরকারি, মাছের ঝোল, চাটনি ও পায়েস থাকে। এছাড়া নানারকম ফল ও  মিষ্টান্ন তো থাকে।  খুবই নিষ্ঠা সহকারে দেবী পূজিত হন। কার্তিকী অমাবস্যা, বুধ পূর্ণিমায় ফুলদল ও জ্যৈষ্ঠ মাসের ফোলহারিণী কালীপূজা সাড়ম্বরে পালিত হয়।  রাজা নবকৃষ্ণের নির্দেশে সেই কাল থেকে আজ মন্দিরের ভোগের জন্য শোভাবাজার বাজার থেকে সবজি আসে।  





কথিত রয়েছে শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব পরমহংসের পদধূলি এই দেবী মন্দিরে পড়েছিল। যখন কেশবচন্দ্র সেন  অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন ঠাকুর মায়ের কাছে ডাব  ও চিনি মানত করেন।  তিনি বলতেন  - "ওরে এই মা সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন, তোদের যা যা কামনা তাই তিনি পূর্ণ করতে পারেন"। একবার তিনি বসুমতি সাহিত্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন - "উপেন যা।  সিদ্ধেশ্বরীর কাছে মানত কর, তোর এক দরজা যেন শত দরজায় পরিণত হয়"।  নাট্য সম্রাট গিরিশ ঘোষ তার নতুন নাটক মঞ্চস্থ করার পূর্বে এখানে দেবী মূর্তির পায়ে নাটকটির পাণ্ডুলিপি ঠেকিয়ে নিয়ে যেতেন। নাটিকটিকে তিনি মায়ের পায়ে উৎসর্গ করতেন।  নাট্য সম্রাট মাকে  "উত্তর কলকাতার গিন্নি " বলে অভিহিত করে যান।  রামকৃষ্ণদেব ছাড়াও স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী সারদানন্দ প্রমুখেরা মায়ের পূজা অর্চনা করে গেছেন।  মাতা সারদা দেবীর পদধুলিও এখানে পড়েছে।  



নানান তিথিতে ও কালী পুজোর দিন ভক্ত ও ভক্তি মিলে-মিশে এক হয়ে যায়। দেবী সিদ্ধেশ্বরী সকলের  মনোবাঞ্ছা  পূরণ করেন বলে লোকের বিশ্বাস রয়েছে। দেবীর উপর মহিমায় "উত্তর কলকাতার গিন্নি" আজও মহিমান্বিত হয়ে  রয়েছেন।  


তারিখ :১৫-১১-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।