Sunday, June 23, 2019

নদীর বাঁকে টাকী >


নদীর বাঁকে টাকী

ইছামতী 
নৌকো তার পাল তুলে ভেসে চলেছে, কারো মাথার ওপর ভারতের পতাকা, আবার কারো মাথায় উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা।  ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছুটা খামখেয়ালীভাবে তারা ইছামতীর বুকে ভেসে চলেছে। মাতাল হাওয়ায় পতাকাগুলো পত্ পত্ করে উড়ছে। ওপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা আর এপারে আমাদের টাকী। দুই দেশকে ভাগ করেছে ইছামতীর বিস্তীর্ণ জলরাশি। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতীকে দেখেছিলেন এক প্রকৃতি প্রেমিকের চোখে আর আমি শহুরে চোখে নীল আকাশের নীচে তার  অপরূপ শোভা দেখছি।  বহমান জলের  শোভা দেখতে দেখতে নদীর পাড় ধরে বাঁধানো রাস্তায় হেঁটে চলেছি। প্রকৃতির অপরূপ শোভা চাক্ষুষ করে মনটা আনন্দে ভড়ে  উঠছে। আমাদের বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আর এক  বাংলার দৃশ্য দেখা যেন এক পরম পাওনা হিসেবে ধরা দিচ্ছে। রোদের ঝলকানি আজ বড়ই কম, মেখলা আকাশে, মিষ্টিমধুর বাতাসে, মাটির সোঁদা গন্ধে ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। এখানে এক শান্তির পরিবেশ বিরাজ করছে। চারদিকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স আমাদের সুরক্ষা বর্ধন করে চলেছে। খেয়াল করিনি হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আমরা  পৌঁছে গিয়েছি টাকীর বিখ্যাত  পিকনিক স্পটে। শীতের সময় জায়গাটা বেশ জমজমাট থাকে।  আজ কোনো মানুষের দেখা নেই, নেই কোনো কোলাহল, একদম শান্ত নিরিবিলি। কত দূর দূরান্ত থেকে শীতের সময় লোকেরা এখানে পিকনিক করতে আসে। টাকী  পুরসভা বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে স্পটটি তৈরী করেছে। কয়েকটি চেয়ার ও একটা সুন্দর ভিউ পয়েন্ট তৈরী করে দিয়েছে।

ঘোষ বাবুদের ঠাকুর দালান 
ওখান থেকে আমরা ঘোষবাবুদের  পাড়ায় ঢুকে গেলাম। টাকীর জমিদার ছিলেন হরিনারায়ণ ঘোষ। তাঁর নামেই ঘোষ বাবুদের পাড়া।   কিছুটা এগোতেই টাকীর বিখ্যাত ঠাকুর দালানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রসঙ্গক্রমে  জানাই ১৯২৪  সালে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও  নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ঘোষবাবুদের আমন্ত্রণে এনাদের বসতবাড়িতে এসেছিলেন।  এই দালানে ঢোকার জন্য একটা বিশাল কালো রঙের দরজা রয়েছে, সিংহ দরজা বলা চলে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে দরজাটিতে বহুকাল কোনো রঙের পোঁচ পড়েনি, তবে দরজাটি ঐতিহ্যের ম্মারক হয়ে এখনও  বিরাজ করছে। দরজাটি দিয়েই ভিতরে আমরা চারজন অর্থাৎ আমি, বিনীতদা, সৌম্য ও তন্ময় ঢুকে পড়লাম। জনমানব শূন্য জায়গাটা। অসাধারণ কারুকাজ করা এক ঠাকুর দালান।  রন্ধে রন্ধে তার প্রাচীনতার প্রমান দিচ্ছে।  বয়স নাকি চার শতক পেরিয়ে গেছে। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে বড়ই ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে।  উপরের ছাদ ধসে গেছে, দেওয়ালের গায়ে বট বৃক্ষ  তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে, ঘুঘু তার বাচ্ছা নিয়ে বেশ সুখে-শান্তিতেই সংসার যাপন করছে। তবে প্রতিবছর এই দালানে দুর্গাপুজো হয়, সেই সময় অবশ্য বংশের সদস্যদের দেখা মেলে। এতো সুন্দর সৃষ্টির এই করুন অবস্থা দেখে মনটা বেশ বিমর্ষ হয়ে গেলো। এটাও হয়তো কালের বিবর্তনে একদিন হারিয়ে যাবে। একটু এগোতেই বাঁদিকে একটা পানাপুকুর আর ডানদিকে ঘোষবাবুদের বসত বাড়িটি রয়েছে। এই 
ঘোষবাবুদের ঠাকুর দালানের নকশা 
বাড়িটিও  প্রায় কয়েক  শত বছরের পুরোনো। বড় একটা সদর দরজা রয়েছে। দরজাটি বন্ধ থাকায় ভিতরে ঢুকে বাড়িটির বর্তমান  অবস্থাটা পর্যবেক্ষন করতে পারলাম  না, ভালো করে দেখাও হলো না। তবে বাইরে থেকে দেখে মনে হলো বেশ গাছ গাছালিতে ঘেরা একটা দোতলা বাড়ি। এখান থেকে বেরিয়ে একটু হাটঁতেই টাকীর বিখ্যাত রাষ্ট্রীয়  মহাবিদ্যালয়টির সামনে এসে পৌঁছলাম। মহাবিদ্যলয়ের সামনে ছাত্রদের  সাইকেল রাখার একটা  জায়গা করা আছে। আজ রবিবার, তাই বন্ধ রয়েছে। ১৯৫০ সালে মহাবিদ্যালয়টি  তৈরী হয়েছে।  এবার একটা টোটো ভাড়া করে টাকীর  বাকি দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে নেবো।

রায়চৌধুরিদের বসতবাড়ি ও ঠাকুর দালান 
কলকাতা থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের কোলে  অবস্থিত  টাকী উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার   গ্রাম্যতায় মোড়া  এক ছোট্ট গ্রাম্য শহর।  এই শহরের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কত কথা, কত কাহিনী, কত কিংবদন্তী, কত  ঘটনা। জমিদার প্রধান শহর টাকীতে আজ আর ঝাড়বাতির রোশনাই নেই। প্রাচীন রীতি মেনে সাবেকিয়ানায় শহরের জমিদার বাড়িগুলোতে আজও দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। টাকীর ইতিহাস ও জমিদার বৃত্তান্ত প্রায় সমার্থক। চারশো বছরের প্রাচীন শহরের মাটি এখানকার জমিদারির নীরব সাক্ষী।

জোড়া শিব মন্দির 
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সেই সময়কার জমিদারি প্রথা আজ মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে।কয়েকটা পোড়ো বাড়ি শুধু আজ ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখনো এখানকার বাতাসে জমিদারি মেজাজের গল্প ভেসে বেড়ায়। পঞ্চদশ শতকে ইছামতীর তীরে, সুন্দরবনের দ্বারপ্রান্তে গড়ে ওঠে প্রাচীন জনপদ টাকী। ইছামতীর গর্ভেই চাপা পড়ে আছে টাকীর অজানা ইতিহাস। ট্যাঁক শব্দটি থেকে টাকী নামের উৎপত্তি। ট্যাঁক মানে সরু মুখযুক্ত নদীর তীর।  টাকীর ইতিহাসে জমিদারদের প্রভাব ছিল বরাবর।  টাকীর স্রষ্টা বলে ধরা হয় রায়চৌধুরী পরিবারকে।  বিরাট গুহ ছিলেন এই পরিবারের আদিপুরুষ। রায়চৌধুরী তাঁদের পাওয়া পদবী। অষ্টাদশ শতকে রায়চৌধুরী পরিবারের কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী
ত্রিমূর্তি মন্দির 
শ্রীপুর থেকে এসে টাকীতে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। এই বংশের কালীনাথ একজন সমাজসংস্কারক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি বারাসাত-টাকী এই ৩৩ মাইল রাস্তাটি ও টাকীতে একটা স্কুল তৈরী করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় টাকীর শিক্ষা ও সংষ্কৃতি বৃদ্ধিতে তিনি  অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই বংশেরই অষ্টাদশ পুরুষ  রামসন্তোষের পুত্রগণ টাকীতে চারটি বাড়ি বানান। দয়ারাম করেন পুবের বাড়ি, শ্যামসুন্দর করেন পশ্চিমের বাড়ি, রামকান্ত করেন দক্ষিনের বাড়ি এবং গোবিন্দপ্রসাদ করেন উত্তরের বাড়ি। প্রায় সব কটা বাড়ির বেশিরভাগ অংশই আজ  নদীগর্ভে চলে গেছে। বর্তমানের পুবের বাড়িটি নতুনভাবে তৈরী করেন সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী। এই পুবের বাড়িটিও অর্ধ ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে। ঘোষবাবুরাও  টাকীর অন্যতম জমিদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঘোষবাবুদের আদিপুরুষ ছিলেন শ্রীশচন্দ্র ঘোষ। এই বংশের  হরিনারায়ণ ঘোষের হাত ধরেই ঘোষ পরিবারের জমিদারির উন্নতি শুরু হয়। পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরসূরিরা জমিদারির  আরো  উন্নতি ও সম্প্রসারিত করেন। শুনলাম বর্তমানে তাঁদের বসতবাড়ী  আর বসবাসযোগ্য নেই , ঠাকুর দালানের অবস্থার বর্ননা আগে জানিয়েছি। অন্যান্য জায়গার মত টাকীতেও সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র, মামলা-মোকদ্দমা সবই চলেছে। টাকীর জমিদারি বৃত্তান্তে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়া দুই ধারার মেলবন্ধন  ঘটতে  দেখা গেছে। শহরবাসীদের মুখে একটা প্রবাদ শোনা যায় "টাকীর লাঠি, সাতক্ষীরার মাটি, গোবরডাঙার হাতি" -  যা এক সময় গল্পগাথায় পরিণত হয়েছিল। টাকীর জমিদারদের বিখ্যাত লেঠেল বাহিনী, গোবরডাঙার জমিদারদের প্রচুর সম্পদ ও সাতক্ষীরার জমিদারদের প্রচুর ভূসম্পত্তি  ছিল। বর্তমানে টাকী পুরসভা এই গ্রামটিকে দেখাশোনা করে। এখানকার পুরসভাও খুব প্রাচীন। ১৮৬৯ সালের ১লা এপ্রিল টাকী পুরসভাটি  গঠিত হয়েছিল। পুরসভাটি ঘোষবাবুদের বসদবাড়িটি ভাড়া নিয়েও  কিছুদিন  চালানো হয়েছিল।

কুলেশ্বরী কালীবাড়ি 
টোটো গাড়ি প্রথমে আমাদের রাজবাড়ী ঘাটে নিয়ে এল।  টাকী পৌর সংস্থা বেশ সুন্দর করে ঘাটটিকে সাজিয়ে দিয়েছে। ঘাটটিতে ঢোকার জন্য একটা বড় প্রবেশ তোরণ করা আছে।  ভিতরে বসে ইছামতীর শোভা উপভোগ করার জন্য অনেক বড় জায়গা নিয়ে অনেকগুলো চেয়ার পাতা আছে। নদীর ধার বরাবর লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা রয়েছে।  এই ঘাটটির পাশেই এককালে শ্যামসুন্দর বাবুর তৈরী পশ্চিমের বাড়িটি ছিল,  যা আজও টাকীবাসীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পুরসভা পুরো বাড়িটি ভেঙে সামান্য অংশ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছে। এখান থেকে আমরা চলে এলাম টাকীর বিখ্যাত জমিদার রায়চৌধুরীবাবুদের বসতবাড়ি ও ঠাকুর দালান দেখতে। এই বাড়িটি বেশ বড় জায়গার মধ্যে একটা সাধারণ দোতালা বাড়ির মতো, জমিদার বাড়ির গন্ধ এখানে মিলবে না।  সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত এখানে প্রতিবছর নিয়ম করে দুর্গাপুজো করা হয়।  বাড়িটির ভিতর দিকে ঠাকুর দালানটি রয়েছে। বাড়িটির সামনে ও পাশে বিরাট জমি রয়েছে।  জমিটিতে অনেক গাছ রয়েছে। পরিবেশটা বেশ শান্ত ও একদম নিরিবিলি।  শুনলাম  বংশের লোকেরা মাঝে মাঝে আসেন।  কেয়ারটেকারের পরিবার এখানে দেখাশোনা ও বসবাস করে। মিনি সুন্দরবন যেতে গিয়ে পথে পড়ল "বিসর্জন" সিনেমার বাড়িটি। কি আশ্চর্য সিনেমাতে বাড়িটি দেখেছিলাম বাংলাদেশে কিন্তু এখানে এসে দেখলাম বাড়িটি ভারতবর্ষেই অবস্থিত। যাই হোক, টোটো থেকে নেমে বাড়িটি পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। ভাঙা চোরা একটা কুঁড়ে বাড়ি।  পর্ণ কুটিরও বলা চলে। বাড়িটিতে কেউ বাস করে বলে মনে হলো না। এবার আমাদের দেখতে যাওয়ার পালা টাকীর মিনি সুন্দরবন। এটা নাকি টাকীর মুখ্য আকর্ষণ। আমাদের পৌঁছতে প্রায়  মিনিট কুড়ি লেগে গেলো। সীমান্ত সুরক্ষাকারীদের কাছে আধার কার্ড দেখিয়ে ভারতীয়  বলে প্রমান করতে হলো। প্রমাণিত হওয়ার পর তবে  ভিতরে ঢোকার ছাড়পত্র পাওয়া গেলো। বিএসফের এই চেকপোস্টের একদম কাছেই নন্দদুলাল জীউর মন্দিরটি অবস্থিত। দেবকীনন্দনের প্রতিষ্ঠিত আসল মন্দিরটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।  তারপর এখানকার  সেবাইতরা একটি চালাঘরে বিগ্রহ রেখে সেবা কার্য চালাচ্ছিলেন, একবার এক প্রবল ঝড়ে কাঁঠাল গাছ থেকে একটি ডাল ভেঙে মন্দিরের চালায় এসে পরে, এই ডালের আঘাতে ঘরটির সাথে বিগ্রহটির কিছু অংশ ভেঙে যায়। ভাঙা বিগ্রহ মন্দিরে রাখলে গ্রামের অমঙ্গল হবে বলে গ্রামবাসীরা মনে  করলেন । বর্তমানের এই মন্দিরটি  ও বিগ্রহটি গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে নির্মাণ করে দিয়েছেন। সেটা দেখে আর একটু এগোনোর পর মিনি সুন্দরবনে এসে পৌঁছলাম। টোটো রেখে দশ টাকার টিকিট কেটে হাঁটতে  শুরু করলাম ।   বেশ সুন্দর গ্রাম্য
বিসর্জন চলচ্চিত্রের শুটিং এই বাড়ীতে হয়েছিল 
পরিবেশ, পাকা সুন্দর সেতু রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে, রাস্তার দুধারে গোলপাতার গাছ ভর্তি রয়েছে, সাথে অনেক সুন্দরী গাছও আছে দেখলাম।  চারদিকে নিঃস্তব্ধ, পাখির ডাক শুনতে শুনতে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম।  রাস্তার শেষে একটা বিশ্রামাগার করা আছে।  এখান থেকে কাঁচা পথ নেমে গেছে ইছামতীর বুকে। জায়গাটা ভালোই লাগল। গোলপাতার জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবন দেখে আবার রওনা দিলাম জোড়া শিব মন্দির দেখতে। টাকীর জমিদার রামকান্তের পুত্র গোপীনাথ রায়চৌধুরী প্রায় তিনশো বছর আগে উত্তরপল্লী অঞ্চলে  একটা বিরাট পুকুর খনন করেন। এই পুকুরের পাড়েই  তিনি শিব মন্দির দুটি প্রতিষ্ঠা করেন। পুকুরের এপার থেকে মন্দিরগুলো দেখলাম। মন্দির দুটিকে নতুনভাবে পুরসভা সংস্কার করে রঙ করে দিয়েছে। ওই মন্দির দুটো শিবানন্দ মন্দির নামে  পরিচিত।  শিব চতুর্থীতে এখানে মেলা বসে। এবার আমরা চললাম মোহনা। পদ্মা, কালিন্দী ও ইছামতীর মিলনস্থান। মোহনার একটু আগে দেখলাম একটা বিশাল হোটেল তৈরী হচ্ছে। আমাদের টোটো
মোহনা ও বাংলাদেশের গোলপাতার জঙ্গল 
চালকভাইয়া জানালো এই হোটেলটি ইটিসি কোম্পানি বানাচ্ছে। মোহনার কাছ থেকে বাংলাদেশের গোলপাতার জঙ্গলটা দেখা যাচ্ছে।  এই জায়গাটি থেকে ইছামতী ও বাংলাদেশের দৃশ্য দেখতে মন্দ লাগলো না।  ফেরার পথে ইকো পার্কে ৩০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে ঢুকলাম। পার্কটি বেশ সুন্দর।পার্কে  বোটিং করার সুব্যবস্থা রয়েছে। একটু এগোতে দেখতে পেলাম ত্রিমূর্তি মন্দিরটি। মন্দিরটি বেশী পুরোনো নয়। সুন্দরভাবে রঙ করা এক অপরূপ মন্দির। ত্রিমূর্তি মন্দিরটি দেখে চার শত বছর পুরনো  টাকীর কুলেশ্বরী কালীবাড়িতে  এলাম। টাকীর পাশ দিয়ে কোনো এক সময়  ইছামতী ছাড়াও নাকি যমুনা নামে একটা নদী প্রবাহিত হতো বলে অনুমান করা হয়।  সেই নদীর কুলেই এই কালিবাড়িটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। নদীর ঢেউয়ে পূর্বতন মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে  যায়। জলের স্রোতে মূর্তিটি এই স্থানে চলে আসে।  বর্তমানের সিমেন্টের মন্দির ও মূর্তিটি অমর রায়চৌধুরী তৈরী করে দিয়েছেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এখানে মেলা বসে।  এই মেলায় অনেক লোকের সমাগম হয়।   এবার আমরা চললাম টাকীর
রামকৃষ্ণ মন্দির ও আশ্রম  
বিখ্যাত রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরটি দেখতে।  বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে মিশনটি গড়ে উঠেছে।  মিশনের ভিতরে মন্দির ছাড়াও একটা আবাসিক স্কুল ও গ্রন্থাগার রয়েছে। মিশনটি ও স্কুলটি সম্ভবত ১৯৩১-৩২ সাল নাগাদ স্থাপিত হয়েছে।

সবশেষে টাকীর বিসর্জনের কথা না বললে টাকী ভ্রমণের কথা পরিপূর্ণতা পায় না। আমি বছর পাঁচেক আগে একবার দশমীর দিন বিসর্জন দেখতে  এখানে এসেছিলাম। টাকীর পুজোর ইতিহাস প্রায় তিন-চারশো বছরের। শোনা যায় জমিদার জগৎবন্ধু রায়চৌধুরী প্রথম টাকীতে দুর্গাপুজোর প্রচলন  করেছিলেন।  সেই ধারা এখনো বজায় আছে, তবে আগেকার সেই জৌলুশ আর নেই।  একচালা ডাকের সাজের প্রতিমাই এখানে পুজো হয়ে থাকে। শুনেছি বংশ পরম্পরায় পুরোহিত, ঢাকি ও মৃৎশিল্পী কাজ করে চলেছে। দশমীর দিন এখানে সম্প্রীতি বন্ধনের এক মিলনমেলার প্রচলন ছিল।  হিন্দু মুসলমান সব একাকার হয়ে যেত, ভারত বাংলাদেশ মিলেমিশে এক হয়ে যেত। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক এই দিন বিএসফের অনুমতি নিয়ে টাকী বেড়াতে  আসত। বর্তমানে নিরাপত্তার কারণে আর তাদের আসার অনুমতি দেওয়া হয় না।  ইছামতীর বুকে টাকীর বিসর্জন বিশ্ব বিখ্যাত। বিজয়া দশমীর দিন টাকী ও সাতক্ষীরায় দেবীকে বিসর্জন দেয় দুই বাংলার মানুষ। টাকীতে দেখেছি সকালে দুটি নৌকোর মাঝে বাঁশ বেঁধে দেবীকে বসানো হয়, সারাদিন ধরে মাকে নিয়ে নৌকো দুটি ইছামতীতে পরিক্রমা করে।  সন্ধ্যের  সময় অশ্রুসিক্ত চোখে মাকে বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয়। এই দিন বিসর্জনের দৃশ্য চাক্ষুষ করতে প্রায় হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়ে থাকে  . এই দিন  টাকী শহর  ও ইছামতীকে কঠোর নিরাপত্তায় বেঁধে ফেলা হয়।
ভাসানের উদ্দেশ্যে দেবীকে নৌকোয় তোলা হচ্ছে 
নদীজুড়ে বিএসফের বেশ কয়েকটি স্পীট  বোর্ড,  পুলিশের ও পুরসভার আরো কয়েকটি নৌকো নিরাপত্তায় থাকে।  ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের দল ও মেডিকেল দলকেও  প্রস্তুত রাখা থাকে।


আজকের মতো আমাদের ঘোরা শেষ হয়ে গেলো, এবার ফেরার পালা।  টোটো করে আমরা হাসনাবাদ স্টেশনে চলে এলাম।  তখন সূর্য ডুবতে অনেকটা সময় বাকি।  একটা ট্রেন স্টেশনে অপেক্ষা করছে, ছাড়ার সময় ৪-১৫ মিনিটে। আমরা উঠে পড়লাম। ট্রেনটি একদম ঠিক সময় ছেড়ে দিলো।

কিভাবে যাবেন :
শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদ লোকাল ট্রেন ধরুন। সময় মোটামুটি ঘন্টা দুয়েকে লাগবে,   টাকী রোড স্টেশনে নামবেন। স্টেশনের বাইরে প্রচুর টোটো গাড়ি দেখতে পাবেন, ওই টোটো গাড়ি করে রাজবাড়ী ঘাটে চলে আসুন। ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ২০ টাকা। এছাড়া আপনি স্টেশন থেকেই সমগ্র টাকী বেড়ানোর জন্য টোটো গাড়ি ভাড়া নিয়ে নিতে পারেন। তাতে ভাড়া মোটামুটি  চার-পাঁচ জনের জন্য ৫০০ টাকা লাগবে। একটু দরদাম করে নেবেন। পর্যটক দেখলে অনেক ভাড়া বেশি চাইবে। এছাড়া ধর্মতলা থেকে বাসে করে এখানে পৌঁছানো যায়। নিজস্ব গাড়ি করে এখানে খুব সহজেই আসতে পারবেন এবং সময়ও অনেকটা কম লাগবে।

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২৪-০৬-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Friday, June 21, 2019

মাহেশের রথ>

মাহেশের রথ

দেখতে দেখতে প্রায় পাঁচ পাঁচটা শতক পেড়িয়ে গেছে।  ওখানকার মন্দিরের সেবাইতরা অবশ্য দাবি করেন ৬০০ বছর উর্ত্তীর্ন হয়ে গেছে। গত সোমবার তাঁর  প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো স্নানযাত্রার মাধ্যমে।  প্রথাগতভাবে জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রাকে স্নান করিয়ে  সুন্দরভাবে সাজিয়ে মন্দিরে এনে রাখা হয়। তারপর কিছুক্ষন মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয়।  পরে ভক্তদের দেখার জন্য মন্দির খোলা হয়।  আমার খুব পরিচিত শেওড়াফুলি রাজবংশের সদস্য শ্রী আশীষ রায় মহাশয় রুপোর ছাতা ঠাকুরের মাথায় ধরার জন্য প্রতিবছরের  ন্যায় এবছরেও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর এই ছবি দেখে বছর তিনেক আগে আমার দেখা মাহেশের রথযাত্রার কথা মনে পড়ছিল। আজ তার কিছু স্মৃতিকথা বলার চেষ্টা করছি। 

রথযাত্রা মানে উৎসব। রথযাত্রার কথা বললে সবাই আগে পুরীর রথযাত্রাকে মনে করে।  ওড়িশার মতো বাংলায় এই রথযাত্রা খুবই প্রাচীন উৎসব।  হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ বাংলার সবচেয়ে প্ৰাচীন রথ উৎসব।  শোনা যায় কমলাকার পিপিলাই ১৫৩৩ সালে এখানকার জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইত হন এবং তিনি নাকি প্রায় পাঁচ শত বছর পূর্বে প্রথম রথ উৎসবটি শুরু করেছিলেন। আষাঢ় মাসের শুক্লা পক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। সনাতন হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান উৎসব হল এই রথযাত্রা উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বর্তমানে এই উৎসব এক মিলনোৎসবে পরিণত হয়েছে।  এইদিন জগন্নাথ তাঁর ভাই বলরাম আর বোন সুভদ্রাকে নিয়ে মাসির বাড়ি যান। সাত দিন পরে অর্থাৎ উল্টোরথের দিন তাঁরা সকলে মাসি বাড়ি থেকে ফিরে আসেন।  এই উৎসব নিয়ে নানারকম পৌরাণিক গল্প রয়েছে, আজ আমি সেই গল্পের উপস্থাপন করে লেখাটিকে দীর্ঘায়িত করবো না।  আজ শুধু আমার স্মৃতিকথাই  আপনাদের জানাবো।

২০১৬ সালে রথের দিন সকালে বাজারে আমার বন্ধু  শঙ্করের সাথে দেখা হল।  দেখা হওয়ার পর ও মহেশের রথ দেখতে যেতে বলল।  আমি ওর কথায়  রাজি হয়ে গেলাম।  সকাল ১১টা  নাগাদ দুজনে যাত্রা শুরু করলাম।  সাড়ে বারোটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই শ্রীরামপুর যাওয়ার একটা ট্রেনও পেয়ে গেলাম। আধ ঘন্টার মধ্যে শ্রীরামপুরে পৌঁছে গেলাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু চা খেয়ে একটা অটো রিক্সা ধরে মাহেশে এলাম।  তখনও  রথের সাজগোছ চলছে। চারদিকে লোকে লোকারন্য।  অল্প সময়ের মধ্যেই রথ সাজানো শেষ হয়ে গেলো। ওখানকার সাংসদ শ্রী কল্যাণ ব্যানার্জী মহাশয় রথের দড়ি টেনে যাত্রার উদ্বোধন করলেন। একবার  উড়িষ্যার পুরীর রথ উৎসব দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।  এখানেও দেখলাম প্রায় সেরকম লোকের ভিড়, ঠ্যালা-ঠেলি চলছিল। মাঝে মাঝে দড়ির প্রাচীর গড়ে লোকের ভীড়কে সামাল দেওয়া হচ্ছিল। লোকের ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে যাচ্ছিল। কিছু করার ছিল না, এভাবেই এই নিয়ম মেনেই সবাইকে রথ দেখতে হচ্ছিলো। আমরাও এই ভাবেই নিয়ম মেনে রথের সাথে এগিয়ে চলতে থাকলাম। রথের কাছাকাছি পৌঁছানোর কোনো সুযোগ নেই। ভীড়ের কাছে হার মানতে হলো আমাদের। রথের ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারলাম না। রথের দড়িও টানা হলো না।  সুউচ্চ রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা বিরাজ করছেন।  অপরূপভাবে রথটিকে সাজানো হয়েছে। রথে উপবিষ্ট পুরোহিতরা মাঝে মাঝে বাতাসা ছুড়ে দিচ্ছিলেন ভক্তদের উদ্দেশ্যে।  আমাদের ভাগ্যেও একটা বাতাসা জুটে গিয়েছিল।   এইভাবে চলতে চলতে রাস্তার ধারে নির্মীয়মান একটা বাড়ির দোতলায় উঠে সব কিছু দেখছিলাম। জি টি রোড ধরে  প্রায় এক  কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে মাসির বাড়ি পৌঁছলো। রথের সমস্ত পরিক্রমাটা বেশ ভালোভাবে দেখলাম। বেশ ভালোই লাগলো।  এবার একটু মেলাটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম।  খুবই ছোট্ট মেলা।  রাস্তার দুধারে নানারকম সরঞ্জাম নিয়ে দোকান করা হয়েছে। খেলনা, জামাকাপড়, গৃহস্থালী সামগ্রী আর প্রচুর পাঁপড়, ফুচকা ও জিলিপির দোকান রয়েছে দেখলাম। রাস্তার ধারে বেলুন বিক্রি হচ্ছে, বাচ্ছাদের বায়না মেটাতে অভিভাকরা কিনছেন।   মেলাটা দিন সাতেক চলে। উল্টোরথের পর আর কারোকে বসতে দেওয়া হয় না। আমরাও প্রথমে গরম গরম জিলিপি ও পরে পাঁপড়ভাজা খেলাম।  বেশ কিছুক্ষন ঘুরে ঘুরে সমগ্র মেলাটা উপভোগ করলাম। মেলা দেখে একটু ফাঁকা জায়গায় একটা চায়ের দোকানে চা খেতে ঢুকলাম। বেশ বয়স্ক ও অভিজ্ঞ দোকানদারকে দেখে মেলার ইতিহাস জানার লোভ সামলাতে পারলাম না। ওনার নাম বললেন গোবিন্দ সরকার। ওনার কাছে ইতিহাস জানতে চাইতে উনি বেশ আনন্দ সহকারে সব কিছু জানাতে আরম্ভ করলেন।

জনৈক বাঙালি সাধু ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী চতুর্দশ শতকের কোনো এক সময় পুরীতে জগন্নাথ দর্শনের জন্য গিয়েছিলেন। জগন্নাথদেবকে দেখে তিনি খুবই প্রীত হয়েছিলেন।  তিনি মাহেশের গঙ্গার ধারে জগন্নাথ,  বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ একটা ছোট্ট কুটিরে স্থাপন করেন।  শেওড়াফুলির জমিদার শ্রী মনোহর রায় পরবর্তীকালে ওই স্থানে একটা মন্দির নির্মাণ করে দেন।  জমিদারের নির্মিত মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়লে কলকাতার নিমাইচাঁদ মল্লিকের  সহায়তায় ১৭৫৫ সালে একটা নতুন মন্দির তৈরী করা হয়। গোবিন্দবাবু বললেন জগন্নাথ মন্দিরের সাথে যেমন  কলকাতার নাম জড়িয়ে আছে ঠিক এখানকার রথের সাথেও কলকাতার নাম জড়িয়ে আছে। মাহেশের প্রথম রথটি কলকাতার জনৈক ব্যক্তি তৈরী করে দিয়েছিলেন।  তাঁর নামটা উনি মনে  পারলেন না।  এই রথটা জীর্ণ হয়ে যাওয়ায় কলকাতার কৃষ্ণরাম বসু পঞ্চচূড়াবিশিষ্ট একটা কাঠের রথ তৈরী করে দিয়েছিলেন।  ১৮৮৪ সালে ওই রথটি এক  বিভৎস্য অগ্নিকান্ডে সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। এই ঘটনায় শহরবাসীরা খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। কলকাতার কৃষ্ণচন্দ্র বসু, যিনি সেইসময় হুগলির দেওয়ান ছিলেন, তিনি এক লক্ষ টাকা ব্যয় করে মার্টিন বার্ন কোম্পানিকে দিয়ে সম্পূর্ণ লোহার তৈরী একটা রথ শ্রীরামপুরবাসীদের উপহার দিলেন।  ৫০ ফুট উচ্চতার রথটির ওজন প্রায় ১২৫ টন ও রথটিতে ১২টি চাকা রয়েছে। সেই রথ আজও চলছে। প্রতিবছর নিয়ম করে রথটিকে মেরামত এবং রঙ করা হয়। তিনি আরো জানালেন এই রথ দেখতে নাকি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব , মা সারদা দেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পদধূলি  মাহেশে পড়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "রাধারানী"  এখানকার মেলার পেক্ষাপটে লিখেছিলেন। গোবিন্দবাবু বলছিলেন এই রথকে কেন্দ্র করে সেকালে যেমন  উৎসাহ ছিল একালেও সমানভাবে  রয়ে গেছে। প্রতিবছর কত দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এই রথ দেখতে আসে। শুধু তাই নয় আমি অনেক বিদেশিকেও এই রথ দর্শনে আসতে দেখেছি। মাহেশ এখন আর গ্রাম নয়, শহর। ঐতিহ্যে এই রথের মেলা  যতটা প্রাচীন বর্তমানে আয়তনে ততটাই ছোট।  গোবিন্দবাবু বলছিলেন আগে এই মেলা বিরাট আকারে হতো, এখন নগরায়নের চাপে স্থান সংকুলানের  জন্য তা  দিনকে দিনকে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ওনাকে প্রণাম জানিয়ে আমরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম।

মাহেশের পর বাংলায় পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথযাত্রা খুব প্রাচীন রথ উৎসব।এছাড়া বর্ধমানের গুপ্তিপাড়া, কলকাতার ইস্কনের রথও খুব জনপ্রিয় রথ উৎসব। কিছুটা  হেঁটে  রিষড়া স্টেশান যাওয়ার জন্য একটা রিক্সা ঠিক করলাম। রিষড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে হাওড়া এলাম।




ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২৩-০৬-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০



 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Monday, June 3, 2019

স্মরণিকায় কিছুক্ষন >

 কলকাতা 

স্মরণিকায় কিছুক্ষন........

স্মরণিকা মিউজিয়াম 
ট্রাম এই নামটার সাথে জড়িয়ে আছে শহরবাসীর নানারকম স্মরণীয় মুহূর্তের কত কথা।  আমাদের শহরের সাথে ট্রামের একটা নাড়ির টান রয়ে গেছে, এ যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। "চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন" - এরকম কত গানে বা কবিতায় ট্রামকে নিয়ে কত ভালোলাগার কথা সেই ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি । বাস্তবেও এই ধীর গতির ট্রাম শুধু একটা পরিবহনের বস্তু নয়, এ তিলোত্তমার এক আবেগ। ট্রাম ছাড়া আমাদের শহরকে ভাবা যায় না। শহরের ঐতিহ্যের সাথে যানটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বের অনেকগুলো শহরেই ট্রাম চলাচল করত। যা আজ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন  ও  মাত্র দু একটি শহরে চলতে দেখা যায়।  আমাদের শহরে ২৪শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৭৩ সালে সর্বপ্রথম ট্রাম পরিষেবা চালু করা হয়। আর্মেনিয়ান ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত প্রথম ট্রামটি চালানো হয়েছিল। প্রথম ট্রামটি ঘোড়ায় টানা ট্রাম ছিল।  এটাই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ট্রাম পরিষেবা ছিল। কিছুদিন পরে এই পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১লা নভেম্বর, ১৮৮০ সালে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপন আবার ট্রাম যাত্রার  উদ্বোধন করেন। এরপর "ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি" নামে  একটি সংস্থা তৈরী করা হয়।  এই সংস্থা তখন থেকেই কলকাতাতে  ট্রাম চালানোর দায়িত্ব নেয়। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ট্রামের  কোম্পানিটিকে অধিগ্রহণ করে। প্রথমদিকে ঘোড়ায় টানা ট্রাম বেশ কিছু বছর চালানো হয়েছিল  পরবর্তীকালে স্টিম ইঞ্জিনের মাধ্যমে ট্রামকে চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। ১৯০২ সালে ট্রামকে বৈদ্যুতিকরণ করা হয়। এটাই এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা ছিল।

গত ৩১শে মে গ্রীষ্মের এক তপ্ত দগ্ধ দুপুরে খিদিরপুর অঞ্চলে একটা কাজের জন্য যাই। কাজটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যাওয়ায় হাতে অঢেল সময় উৎবিত্ত হয়ে যায়।  মনটাও বাড়ি ফিরে আসতে  চাইছিল না। বাস স্টপেজে এসে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়।  সামনে দিয়ে একটা ট্রাম চলে গেলো। সেই ট্রাম দেখে আমার  ট্রাম চড়ার শখ জন্মালো। বহুকাল ট্রাম  চড়া হয়নি। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর সুন্দর চাকচিক্য মার্কা একটা ট্রাম এল।  ট্রামটি ধর্মতলাতে যাচ্ছে। দেরী  না করে ট্রামটির প্রথম কামরাতে উঠে পড়লাম। জানলার ধারে একটা বসার সিটও মিলে গেলো। ব্রিজ পাড় করে গড়ের মাঠের সবুজকে চিড়ে দুরক্ত গতিতে ট্রামটি চলছিল। এই রাস্তায় ট্রামে করে গেলে "ধীর গতির যান" এই কথাটা ভুলে যেতে হবে। বাঁদিকে সুন্দর রাস্তা আর ডানদিকে সবুজ মাঠ। মাঠে বাচ্ছা ও  যুবকদের ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম, বেশ উপভোগও করছিলাম। মাঝে মাঝে কন্ডাক্টারের বেলের টুং টুং শব্দের আওয়াজে  মনটাও ভরিয়ে তুলছিল। এইভাবেই চলতে চলতে ট্রাম ধর্মতলাতে এসে পৌঁছল। ট্রাম থেকে নেমে পড়লাম।  মনটা  তখন একটু চা চা করে ডাক পাড়ছিল।  চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম, কিছুটা এগোনোর পরই  হঠাৎ করে রাস্তায় আমার এক পুরোনো স্কুলের বন্ধু শুভাশিসের  সাথে দেখা হয়ে গেলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। আমি ওকে বললাম চল একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে কথা  বলি। শুভাশিস আমায় বললো এখানকার কোনো চায়ের দোকানের চা খেয়ে মন ভরবে না।  বরঞ্চ চল স্বরণিকাতে যাই। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল স্মরণিকা হয়তো কোনো রেস্টুরেন্ট  হবে। পৌঁছে দেখলাম ও আমায় ট্রামের মিউজিয়ামে নিয়ে এসেছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এরকম একটা ক্যাফেটেরিয়া সমেত ট্রামের মিউজিয়াম আছে বলে  আমার জানা ছিল না। স্মরণীয় যানের সংগ্রহশালার নাম "স্মরণিকা" আমার মনে হলো একদম সার্থক নামকরণ। যাই হোক ২০ টাকা দিয়ে ও দুটো টিকিট কাটলো। টিকিট দেখিয়ে আমরা একটা বাতানুকূল দু-কামরার ট্রামের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তপ্ত গরম থেকে এসে এই বাতানুকূল পরিবেশ মন্দ লাগছিল না।

এক কামরা বাতানুকুল ট্রাম 
ধর্মতলা ট্রাম ডিপোর সাথেই  ট্রামের দুটি কামরাকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই মিউজিমটিকে। ভিতরে প্রবেশ করার পর দেখলাম প্রথম কামরাটিতে  একটা ক্যাফেটেরিয়া  আর দ্বিতীয় কামরাটিতে একটা মিউজিয়াম তৈরী করা হয়েছে। প্রথম কামরার ক্যাফেটেরিয়াতে অনেকগুলো বসার জায়গা রয়েছে, বেশিরভাগ জায়গাতেই অনেকে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমরাও একটা বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। ক্যাফেটেরিয়াতে বিস্কুট, চিপস ও কফি পাওয়া যায়।  আমরা একটা চিপসের প্যাকেট ও দুটো কফির অর্ডার দিলাম।  কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের খাবার পরিবেশন করা হলো। বেশ কিছুক্ষন আমি আর শুভাশিস কফি খেতে খেতে নানারকম সুখ-দুঃখের গল্প করছিলাম। কফি খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর আমরা দ্বিতীয় কামরায় মিউজিয়ামটি দেখতে
প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম 
গেলাম।  ট্রামের ইতিহাসকে খুব সুন্দর করে  এখানে দেখানো হয়েছে নানারকম আলোকচিত্রের মাধ্যমে। পুরোনো কলকাতা ও ট্রামের বিবর্তন সবটাই এইসব আলোকচিত্রের বিষয়বস্তু। নীচের দিকে ছোট ছোট কাঁচের বাক্সের মধ্যে ট্রাম গাড়ির বিবর্তনের রেপ্লিকা করে রাখা আছে।  এছাড়া পণ্য পরিবহন ট্রামের রেপ্লিকাও আছে। ট্রামের জন্মলগ্ন থেকে ব্যৱহৃত  বিভিন্ন রকমের মুদ্রা ও টিকিট রাখা আছে। ট্রাম কোম্পানির কোষাগারে রাখা স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তরকালের ব্যৱহৃত টিকিট ও আনা পয়সা, টাকা, নয়া পয়সার বাতিল করা নমুনা এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। ট্রাম কোম্পানিতে ব্যৱহৃত ডোবানো নিবের কলম, ফাউন্টেন পেন , কাঁচের কলম ও দোয়াতদানও রাখা আছে।  ১৯২০ সালে ট্রাম কোম্পানি বাস চালু করেছিল। বাসগুলো সবই ট্রনিক্রফ্ট এন্ড কোম্পানির তৈরী ছিল।  ১৯২৫ সাল পর্যন্ত এই বাস পরিষেবা চালু ছিল।  সেই বাসের  একটা নমুনা মডেল হিসেবে রাখা আছে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ টিকিট নানা সময় ব্যৱহৃত হয়েছিল যেমন দৈনিক টিকিট, মাসিক টিকিট ও তার হোল্ডার, ছাত্রদের জন্য
 বিভিন্ন রকমের ব্যাজ 
বিশেষ ছাড়ের কুপন, খুচরোর পরিবর্তে ডিউ  কুপন ইত্যাদির নমুনা প্রদর্শিত হয়েছে। দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে কন্ডাক্টরদের টুপি, বাহুবন্ধ, ব্যাজ, বেল্ট ইত্যাদি। এগুলো দেখতে দেখতে পড়ন্ত বিকেলে আমি কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে পড়ছিলাম। মনের জানালা দিয়ে পুরোনো স্মৃতিগুলো উঁকি দিচ্ছিল।

বাঙালির নস্টালজিক আবেগটাকেই ট্রাম কোম্পানি তুরুপের তাস করেছে। শুনলাম এই মিউজিয়ামে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭৫ থেকে ১০০ জন দর্শক   আসে। কোম্পানি এই জাদুঘরটিকে আয়তনে ও বৈচিত্রে আরো বাড়াবার পরিকল্পনা করছে। ট্রাম তো শুধু আবেগ নয়, বাঙালির অহংকার, তিলোত্তমার গর্ব। এখানে এসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ইতিহাসের সঙ্গে কিছু মুহূর্ত কাটাতে মন্দ লাগলো না।


সময়সূচি ও টিকিট :
বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিকটা দিন মিউজিয়াম খোলা থাকে দুপুর ১টা থেকে রাত  ৮টা পর্যন্ত।  টিকিটের মূল্য ১০ টাকা জন প্রতি।

ঠিকানা :
৬ নং সিদু কানু ডহর, ধর্মতলা, কলকাতা ৭০০ ০৬৯

কিভাবে যাবেন :
যেকোনো গাড়ি ধরে ধর্মতলায় চলে আসুন।  ধর্মতলা ট্রাম ডিপোর মধ্যেই এই সুন্দর মিউজিয়ামটি রয়েছে।

কিছু তথ্য :
এখানে কোনো ক্যামেরা ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না, তবে আপনি আপনার মোবাইলের ক্যামেরা ব্যবহার করে ছবি তুলতে পারবেন।  মোবাইল ব্যবহারের উপর কোনো বাঁধা নিষেধ নেই।  এখানকার ক্যাফেটেরিয়াতে শুধু চা, কফি, বিস্কুট ও চিপস কিনতে পারবেন, অন্য কিছু এখানে পাওয়া যায় না। খাবার সামগ্রীগুলো পয়সা দিয়ে কিনতে হবে।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০৩-০৬-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Saturday, June 1, 2019

গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন >

গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন 


একটা বীজের মধ্যেই থাকে একটা সম্ভাবনাময় জীবন, ভালো প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভালো পরিচর্যা পেলে সেই বীজই একদিন এক মহীরুহে পরিণত হয়। আজ আমি সেরকমই এক প্রতিষ্ঠানের কথা বলবো, যা ভালো সংগঠকদের হাতে পরে সামান্য থেকে আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। জন্মের পর থেকে আশিটা বছর পাড় করে যা আজও বিশ্বজনীন ঐক্যসাধনের এক সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে। যার পঠন-পাঠন প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের জ্ঞানী-গুণী জনের সম্মান অর্জন করে চলেছে।

১৯৩৬ সাল, ভারত তথা বিশ্বের নানা জায়গাতেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্ম শতবর্ষ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। আমাদের মহনগরেও বেশ আড়ম্বরের সাথেই ঠাকুরের  জন্ম শতবর্ষ পালন করা হচ্ছিল। সেই অনুষ্ঠানে ভক্তবৃন্দ ও জনসাধারণের কাছ থেকে বহু অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল। সমাপ্তি অনুষ্ঠানের পর উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কলকাতাতেই একটা আন্তর্জাতিক মানের কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। আজ যে বাড়িতে অর্থাৎ ১৫নং কলেজ স্কোয়ারে তৈরী হয়েছে কলকাতার অন্যতম সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র ভারতীয় কফি হাউস, সেই আলবার্ট হলেই ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ছিল শ্রী রামকৃষ্ণ জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির কার্যালয়। সেই সময় "রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার" নামে একটি শাখাকেন্দ্র তৈরী করা হয়েছিল।  ২৯শে জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে এই আলবার্ট হলের তিনতলায় সকলের উপস্থিতিতে রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা কেন্দ্র "রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার"-এই উদ্বোধন করা হয়।

এই কেন্দ্রটির জন্মলগ্নে কোনো আর্থিক সঙ্গতি ছিল না।  জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি প্রথমে ২৬৫৯ টাকা ও পরবর্তীকালে পুস্তক প্রকাশনার জন্য আরো ৩০১৮ টাকা শাখা কেন্দ্রটিকে দান করে। স্থান সংকুলানের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে আলবার্ট হল থেকে ১৯ নং কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিটে উঠে যায়।  ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে।  পাঠাগার, ছাত্রাবাস, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, ও প্রকাশনার কাজ শুরু হয়।  এই স্থানও প্রয়োজনের তুলনায় ছোট হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটি আবার স্থান পরিবর্তন করে ৪এ, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে একটা তিন তলা বাড়িতে উঠে আসে। এই বাড়িতে আসার পর প্রতিষ্ঠানটির সংবিধানে কিছু রদ-বদল করা হয়। সেই সময় রামকৃষ্ণ মিশন এই প্রতিষ্ঠাটিকে স্বয়ং সম্পূর্ণ একটা  প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দান করে।  ১৯৪৩ সালে কর্নেল ডি এন ভাদুড়ী ও তাঁর সহধর্মিনী শ্রীমতি হিমাংশুবালা দেবী ১১১ নং রসা রোডে প্রাসাদোপম একটি বাড়ি প্রতিষ্ঠানটিকে দান করেন। ২৯শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ কলকাতার এই বাড়িতে উঠে আসে। ১৯৫০ সালে ইন্সটিটিউটটি UNESSCO-এর সাথে যৌথভাবে কাজ আরম্ভ করে। দিন কে দিন প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি বেড়ে চলতে থাকে। এই বাড়িতে আসার পর প্রকাশনার কাজ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। সেই সময় কর্মকর্তারা একটা নিজস্ব বাড়ির প্রয়োজন অনুভব করতে থাকেন।

কলকাতা ইম্প্রুমেন্ট ট্রাস্টের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক সাহায্যে সাত লক্ষ টাকার বিনিময়ে সাদার্ন এভিনিউ ও গড়িয়াহাট রোডের সংযোগস্থলে একটা বিরাট জমি ক্রয় করা হয়।  কলকাতার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান "মেসার্স ব্যালাডি থম্পসন এন্ড ম্যাথু" বাড়িটির নকশা তৈরী করে দেয়। "মেসার্স মার্টিন এন্ড বার্ন কোম্পানি" বাড়িটি তৈরির দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৫৫ সালের ৩০শে  জুন শাস্ত্রীয় মতে বাড়িটির  ভিত্তিস্থাপন করা হয়।  ১৯৬১ সালের ১লা নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরু এই সুরম্য অট্টালিকাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।  এই উদ্বোধন অনুষ্ঠান মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন ভারতের  উপ-রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্রীমতি পদ্মজা নাইডু, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়,  ও ইনস্টিটিউটের সম্পাদক স্বামী নিত্যস্বরূপানন্দজী। এছাড়া এই অনুষ্ঠানে দেশ ও বিদেশের বহু গন্যমান্য ব্যক্তিত্ব  অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজের ঐকান্তিক চেষ্টায় পার্শবর্তী আরো ৪০ কাটা জমি ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকায় ক্রয় করা হয়। এই জমিতে নতুন একটা বাড়ি তৈরী করে মূল ভবনের সাথে সংযুক্ত করা হয়। এই বাড়িটি তৈরী করে "কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং" বলে একটি ভারতীয় সংস্থা।  ২০০৫ সালের ২০শে মে নতুন বাড়িটির গৃহপ্রবেশ করা হয়। কলকাতা পৌরসভা ১৯৯৬ সালের ২৭শে নভেম্বর  রামকৃষ্ণ মিশনের এই শাখাকেন্দ্রটির বাড়িটিকে "ঐতিহ্যশালী ভবন"-এর স্বীকৃতি প্রদান করে। বাড়িটি সত্য়ি খুবই দৃষ্টিনন্দনকারি একটি বাড়ি।

এই ইনস্টিটিউটিতে  ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিভাগ চালু করা হয়।  এই বিভাগগুলোর কথা নিম্নে সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করলাম।

পত্রিকা :
১৯৫০ সালে প্রথম একটা কুড়ি পাতার পত্রিকা ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়। তারপর থেকে নিয়মিতভাবে এই পত্রিকা আজও প্রকাশ করা হয়ে থাকে।  এই পত্রিকার সাহায্যে দেশ বিদেশের মানুষকে ইনস্টিটিউটের কর্মধারা ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত করা হয়। এই পত্রিকাটিতে দেশ বিদেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ তাঁদের মূল্যবান লেখা লিখে থাকেন।

প্রকাশনা বিভাগ :
১৯৩৮ সালের ২৯শে জানুয়ারি এই বিভাগটি আলবার্ট হলে চালু করা হয়েছিল। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি এই তিনটি ভাষাতেই প্রচুর মূল্যবান পুস্তক এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে।   "The Heritage of India" (আটটি খন্ডে প্রকাশিত) এই বইটি সর্ব প্রথম এখান থেকে প্রকাশিত হয়। স্বামী সুপর্ণানন্দজী মহারাজের সম্পাদনায় "History of Science in India" (আটটি খন্ডে প্রকাশিত) নামে  এক বিরল গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া "Swami Vivekananda in Contemporary Indian News", "SwamiVivekananda and Indian Nationalism", "The Universal Mother", "বেদান্ত ও রামকৃষ্ণ", "পূর্ণযোগী রামকৃষ্ণ" "শব্দকোষের ইতিহাস", "শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা", "বিশ্ববরেন্য রামকৃষ্ণ", "স্বামীজী ও তাঁর বাণী", ইত্যাদি বিখ্যাত গ্রন্থগুলি এখান থেকে প্রকাশিত হয়।  স্বামী শিবদানন্দ ও স্বামী সুবত্তমানন্দজীর তত্ত্বাবধানে এই বিভাগটি প্রভূত উন্নতি করে।

গবেষণা বিভাগ :
মূল ভবনের চতুর্থ তলে বিস্তীর্ণ জায়গা নিয়ে এই বিভাগটি রয়েছে।  দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও অধ্যাপকরা এই বিভাগের সাথে যুক্ত রয়েছে। এখানে বহু ছাত্র-ছাত্রী গবেষণার কাজ করে থাকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিষয়কে নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে গবেষণা করা হয়।

সংগ্রহশালা :
এই সংগ্রহশালাটি মূল ভবনের তৃতীয় তলে অবস্থিত। এই  সংগ্রহশালাটিতে বহু মূল্যবান চিত্র, শিল্প নিদর্শন, সুচিশিল্প, লোকশিল্প, পুঁথি ও নানারকম ধাতু মূর্তি রয়েছে।  এছাড়া পটচিত্র, বস্ত্রশিল্প ও আলোকচিত্রও দেখতে পাওয়া যায়।  সংগ্রহশালার প্রদর্শনকক্ষে বাৎসরিক  ও সাময়িক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক অতিথিশালা ও ছাত্রাবাস:
১৯৫৪ সালে ছাত্রাবাসটি প্রথমে রসা  রোডের বাড়িতে চালু করা হয়েছিল।  পরবর্তীকালে এটিকে গোলপার্কের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়।  ১৯৬১ সালে ছাত্রাবাসটির সাথে আন্তর্জাতিক অতিথিশালাটি যুক্ত হয়।  পঠন-পাঠন ও গবেষণার কাজে লিপ্ত এবং ভারতবর্ষকে জানবার জন্য যারা দেশ-বিদেশ থেকে গবেষণার কাজে এখানে আসেন, তাঁদের জন্য এখানে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহু ব্যাক্তিত্বের এখানে আগমন ঘটেছে।

যুব বিভাগ :
স্বামীজী ভারত নির্মাণের কারিগর হিসেবে যুবশক্তিকে চিহ্নিত করেছিলেন।  জন্মলগ্ন থেকেই স্বামীজীর আকাঙ্খিত যুবশক্তির উন্নতি সাধনের কাজ করে চলেছে এই বিভাগটি।  দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের অনুদান, বৃত্তি ও পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। নিয়মিত কলকাতা ও বিভিন্ন জেলায় যুবসম্মেলনের আয়োজন করা হয়। স্বামীজীর আদর্শকে যুব শক্তির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য।

সাধারণ পাঠাগার :
জন্মলগ্নের  সময় থেকেই এই বিভাগটি চালু করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ডাঃ বারিদবরণ মুখার্জী তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ৩০ হাজার গ্রন্থ এখানে দান করেছিলেন।  ইনস্টিটিউটের নানাবিধ কর্মের মধ্যে লাইব্রেরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান কর্ম।  বর্তমানে এখানে প্রায় চার লক্ষাধিক  গ্রন্থ সংগৃহিত রয়েছে। ১০,০০০ দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ এখানে রয়েছে।  প্রায় ৩০,০০০ ই-সাময়িক পত্র-পত্রিকার সুবিধা সদস্যরা পেয়ে থাকেন। এছাড়া কম্পিউটারাইসড ক্যাটালক ,ফটোকপি, ইন্টারনেট পরিষেবা, ম্যাপ, ল্যাপটপ  ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সুবিধাও সদস্যদের দেওয়া হযে থাকে। সম্পূর্ণ বাতানুকূল বিশাল একটা পাঠকক্ষ রয়েছে,  যেখানে একসঙ্গে প্রায় ২০০ জন বসে পড়তে পারে।

শিশু ও কিশোর গ্রন্থাগার :
সাধারণ গ্রন্থাগারের মতো শিশু ও কিশোরদের জন্য আলাদা করে আর একটা গ্রন্থাগার রয়েছে। সাধারণ গ্রন্থাগারের সব রকম সুবিধা এই গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়।  এছাড়া ইনডোর গেম, মাল্টিমিডিয়ার সুবিধাও রয়েছে। প্রতি মাসের শেষ শনিবার সদস্যদের জন্য নানারকম শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া বাৎসরিক অঙ্কন ও অন্যান্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

পুস্তক বিপনী :
এই বিপনীতে এখানকার প্রকাশনা বিভাগের সমস্ত গ্রন্থ পাওয়া যায়।  এছাড়া অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থার রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী, বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতা সংক্রান্ত সমস্ত গ্রন্থ  ও অন্যন্য আধ্যাত্মিক  গ্রন্থও পাওয়া যায়। প্রত্যেকটা  বই ক্রয়ে এখানে  ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হযে থাকে।

এখানে ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় বেশি ছবি দিতে পারলাম না। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের এই শাখা কেন্দ্রটিতে ঢুকলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এটা বাড়ি না প্রাসাদ, আসলে এটা একটা জ্ঞানমন্দির, বিরাট কর্মকেন্দ্রের ভান্ডার। বেশিরভাগ লোকের ধারণা রামকৃষ্ণ মিশনের এই বাড়িটি একটি ধর্মীয় কালচারের প্রতিষ্ঠান।  এখানে না আসলে, বা এঁনাদের কাজের পরিধি সম্বন্ধে না জানলে বাইরে থেকে কোনো ধারণা করা যায় না।  এখান থেকে যে কি বিশাল কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তা জানলে বোঝা যায় কেন সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠানটি এতো জনপ্রিয়। এই প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে আমার নিয়মিত যাতায়াত আছে বলে এঁনাদের  কাজের পরিধি সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞানার্জন করতে পেরেছি। আমাদের কল্লোলিনীতে বহু গর্বের জিনিস আছে। এই প্রতিষ্ঠানটি শহরবাসীর কাছে এক পরম অহংকার এবং অবশ্যই গর্বের প্রতিষ্ঠান।

তথ্যসূত্র : চিরন্তনে পঁচাত্তর

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০১-০৬-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।