একটা বীজের মধ্যেই থাকে একটা সম্ভাবনাময় জীবন, ভালো প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভালো পরিচর্যা পেলে সেই বীজই একদিন এক মহীরুহে পরিণত হয়। আজ আমি সেরকমই এক প্রতিষ্ঠানের কথা বলবো, যা ভালো সংগঠকদের হাতে পরে সামান্য থেকে আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। জন্মের পর থেকে আশিটা বছর পাড় করে যা আজও বিশ্বজনীন ঐক্যসাধনের এক সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে। যার পঠন-পাঠন প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের জ্ঞানী-গুণী জনের সম্মান অর্জন করে চলেছে।
১৯৩৬ সাল, ভারত তথা বিশ্বের নানা জায়গাতেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্ম শতবর্ষ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। আমাদের মহনগরেও বেশ আড়ম্বরের সাথেই ঠাকুরের জন্ম শতবর্ষ পালন করা হচ্ছিল। সেই অনুষ্ঠানে ভক্তবৃন্দ ও জনসাধারণের কাছ থেকে বহু অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল। সমাপ্তি অনুষ্ঠানের পর উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কলকাতাতেই একটা আন্তর্জাতিক মানের কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। আজ যে বাড়িতে অর্থাৎ ১৫নং কলেজ স্কোয়ারে তৈরী হয়েছে কলকাতার অন্যতম সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র ভারতীয় কফি হাউস, সেই আলবার্ট হলেই ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ছিল শ্রী রামকৃষ্ণ জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির কার্যালয়। সেই সময় "রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার" নামে একটি শাখাকেন্দ্র তৈরী করা হয়েছিল। ২৯শে জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে এই আলবার্ট হলের তিনতলায় সকলের উপস্থিতিতে রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা কেন্দ্র "রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার"-এই উদ্বোধন করা হয়।
এই কেন্দ্রটির জন্মলগ্নে কোনো আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি প্রথমে ২৬৫৯ টাকা ও পরবর্তীকালে পুস্তক প্রকাশনার জন্য আরো ৩০১৮ টাকা শাখা কেন্দ্রটিকে দান করে। স্থান সংকুলানের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে আলবার্ট হল থেকে ১৯ নং কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিটে উঠে যায়। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাঠাগার, ছাত্রাবাস, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, ও প্রকাশনার কাজ শুরু হয়। এই স্থানও প্রয়োজনের তুলনায় ছোট হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটি আবার স্থান পরিবর্তন করে ৪এ, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে একটা তিন তলা বাড়িতে উঠে আসে। এই বাড়িতে আসার পর প্রতিষ্ঠানটির সংবিধানে কিছু রদ-বদল করা হয়। সেই সময় রামকৃষ্ণ মিশন এই প্রতিষ্ঠাটিকে স্বয়ং সম্পূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দান করে। ১৯৪৩ সালে কর্নেল ডি এন ভাদুড়ী ও তাঁর সহধর্মিনী শ্রীমতি হিমাংশুবালা দেবী ১১১ নং রসা রোডে প্রাসাদোপম একটি বাড়ি প্রতিষ্ঠানটিকে দান করেন। ২৯শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ কলকাতার এই বাড়িতে উঠে আসে। ১৯৫০ সালে ইন্সটিটিউটটি UNESSCO-এর সাথে যৌথভাবে কাজ আরম্ভ করে। দিন কে দিন প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি বেড়ে চলতে থাকে। এই বাড়িতে আসার পর প্রকাশনার কাজ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। সেই সময় কর্মকর্তারা একটা নিজস্ব বাড়ির প্রয়োজন অনুভব করতে থাকেন।
কলকাতা ইম্প্রুমেন্ট ট্রাস্টের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক সাহায্যে সাত লক্ষ টাকার বিনিময়ে সাদার্ন এভিনিউ ও গড়িয়াহাট রোডের সংযোগস্থলে একটা বিরাট জমি ক্রয় করা হয়। কলকাতার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান "মেসার্স ব্যালাডি থম্পসন এন্ড ম্যাথু" বাড়িটির নকশা তৈরী করে দেয়। "মেসার্স মার্টিন এন্ড বার্ন কোম্পানি" বাড়িটি তৈরির দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৫৫ সালের ৩০শে জুন শাস্ত্রীয় মতে বাড়িটির ভিত্তিস্থাপন করা হয়। ১৯৬১ সালের ১লা নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরু এই সুরম্য অট্টালিকাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এই উদ্বোধন অনুষ্ঠান মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্রীমতি পদ্মজা নাইডু, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, ও ইনস্টিটিউটের সম্পাদক স্বামী নিত্যস্বরূপানন্দজী। এছাড়া এই অনুষ্ঠানে দেশ ও বিদেশের বহু গন্যমান্য ব্যক্তিত্ব অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজের ঐকান্তিক চেষ্টায় পার্শবর্তী আরো ৪০ কাটা জমি ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকায় ক্রয় করা হয়। এই জমিতে নতুন একটা বাড়ি তৈরী করে মূল ভবনের সাথে সংযুক্ত করা হয়। এই বাড়িটি তৈরী করে "কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং" বলে একটি ভারতীয় সংস্থা। ২০০৫ সালের ২০শে মে নতুন বাড়িটির গৃহপ্রবেশ করা হয়। কলকাতা পৌরসভা ১৯৯৬ সালের ২৭শে নভেম্বর রামকৃষ্ণ মিশনের এই শাখাকেন্দ্রটির বাড়িটিকে "ঐতিহ্যশালী ভবন"-এর স্বীকৃতি প্রদান করে। বাড়িটি সত্য়ি খুবই দৃষ্টিনন্দনকারি একটি বাড়ি।
এই ইনস্টিটিউটিতে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিভাগ চালু করা হয়। এই বিভাগগুলোর কথা নিম্নে সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করলাম।
পত্রিকা :
১৯৫০ সালে প্রথম একটা কুড়ি পাতার পত্রিকা ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়। তারপর থেকে নিয়মিতভাবে এই পত্রিকা আজও প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এই পত্রিকার সাহায্যে দেশ বিদেশের মানুষকে ইনস্টিটিউটের কর্মধারা ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত করা হয়। এই পত্রিকাটিতে দেশ বিদেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ তাঁদের মূল্যবান লেখা লিখে থাকেন।
প্রকাশনা বিভাগ :
১৯৩৮ সালের ২৯শে জানুয়ারি এই বিভাগটি আলবার্ট হলে চালু করা হয়েছিল। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি এই তিনটি ভাষাতেই প্রচুর মূল্যবান পুস্তক এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
"The Heritage of India" (আটটি খন্ডে প্রকাশিত) এই বইটি সর্ব প্রথম এখান থেকে প্রকাশিত হয়। স্বামী সুপর্ণানন্দজী মহারাজের সম্পাদনায়
"History of Science in India" (আটটি খন্ডে প্রকাশিত) নামে এক বিরল গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া "
Swami Vivekananda in Contemporary Indian News", "
SwamiVivekananda and Indian Nationalism", "
The Universal Mother",
"বেদান্ত ও রামকৃষ্ণ", "পূর্ণযোগী রামকৃষ্ণ" "শব্দকোষের ইতিহাস", "শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা", "বিশ্ববরেন্য রামকৃষ্ণ", "স্বামীজী ও তাঁর বাণী", ইত্যাদি বিখ্যাত গ্রন্থগুলি এখান থেকে প্রকাশিত হয়। স্বামী শিবদানন্দ ও স্বামী সুবত্তমানন্দজীর তত্ত্বাবধানে এই বিভাগটি প্রভূত উন্নতি করে।
গবেষণা বিভাগ :
মূল ভবনের চতুর্থ তলে বিস্তীর্ণ জায়গা নিয়ে এই বিভাগটি রয়েছে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও অধ্যাপকরা এই বিভাগের সাথে যুক্ত রয়েছে। এখানে বহু ছাত্র-ছাত্রী গবেষণার কাজ করে থাকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিষয়কে নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে গবেষণা করা হয়।
সংগ্রহশালা :
এই সংগ্রহশালাটি মূল ভবনের তৃতীয় তলে অবস্থিত। এই সংগ্রহশালাটিতে বহু মূল্যবান চিত্র, শিল্প নিদর্শন, সুচিশিল্প, লোকশিল্প, পুঁথি ও নানারকম ধাতু মূর্তি রয়েছে। এছাড়া পটচিত্র, বস্ত্রশিল্প ও আলোকচিত্রও দেখতে পাওয়া যায়। সংগ্রহশালার প্রদর্শনকক্ষে বাৎসরিক ও সাময়িক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক অতিথিশালা ও ছাত্রাবাস:
১৯৫৪ সালে ছাত্রাবাসটি প্রথমে রসা রোডের বাড়িতে চালু করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এটিকে গোলপার্কের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৬১ সালে ছাত্রাবাসটির সাথে আন্তর্জাতিক অতিথিশালাটি যুক্ত হয়। পঠন-পাঠন ও গবেষণার কাজে লিপ্ত এবং ভারতবর্ষকে জানবার জন্য যারা দেশ-বিদেশ থেকে গবেষণার কাজে এখানে আসেন, তাঁদের জন্য এখানে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহু ব্যাক্তিত্বের এখানে আগমন ঘটেছে।
যুব বিভাগ :
স্বামীজী ভারত নির্মাণের কারিগর হিসেবে যুবশক্তিকে চিহ্নিত করেছিলেন। জন্মলগ্ন থেকেই স্বামীজীর আকাঙ্খিত যুবশক্তির উন্নতি সাধনের কাজ করে চলেছে এই বিভাগটি। দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের অনুদান, বৃত্তি ও পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। নিয়মিত কলকাতা ও বিভিন্ন জেলায় যুবসম্মেলনের আয়োজন করা হয়। স্বামীজীর আদর্শকে যুব শক্তির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য।
সাধারণ পাঠাগার :
জন্মলগ্নের সময় থেকেই এই বিভাগটি চালু করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ডাঃ বারিদবরণ মুখার্জী তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ৩০ হাজার গ্রন্থ এখানে দান করেছিলেন। ইনস্টিটিউটের নানাবিধ কর্মের মধ্যে লাইব্রেরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান কর্ম। বর্তমানে এখানে প্রায় চার লক্ষাধিক গ্রন্থ সংগৃহিত রয়েছে। ১০,০০০ দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ এখানে রয়েছে। প্রায় ৩০,০০০ ই-সাময়িক পত্র-পত্রিকার সুবিধা সদস্যরা পেয়ে থাকেন। এছাড়া কম্পিউটারাইসড ক্যাটালক ,ফটোকপি, ইন্টারনেট পরিষেবা, ম্যাপ, ল্যাপটপ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সুবিধাও সদস্যদের দেওয়া হযে থাকে। সম্পূর্ণ বাতানুকূল বিশাল একটা পাঠকক্ষ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে প্রায় ২০০ জন বসে পড়তে পারে।
শিশু ও কিশোর গ্রন্থাগার :
সাধারণ গ্রন্থাগারের মতো শিশু ও কিশোরদের জন্য আলাদা করে আর একটা গ্রন্থাগার রয়েছে। সাধারণ গ্রন্থাগারের সব রকম সুবিধা এই গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়। এছাড়া ইনডোর গেম, মাল্টিমিডিয়ার সুবিধাও রয়েছে। প্রতি মাসের শেষ শনিবার সদস্যদের জন্য নানারকম শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া বাৎসরিক অঙ্কন ও অন্যান্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
পুস্তক বিপনী :
এই বিপনীতে এখানকার প্রকাশনা বিভাগের সমস্ত গ্রন্থ পাওয়া যায়। এছাড়া অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থার রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী, বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতা সংক্রান্ত সমস্ত গ্রন্থ ও অন্যন্য আধ্যাত্মিক গ্রন্থও পাওয়া যায়। প্রত্যেকটা বই ক্রয়ে এখানে ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হযে থাকে।
এখানে ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় বেশি ছবি দিতে পারলাম না। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের এই শাখা কেন্দ্রটিতে ঢুকলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এটা বাড়ি না প্রাসাদ, আসলে এটা একটা জ্ঞানমন্দির, বিরাট কর্মকেন্দ্রের ভান্ডার। বেশিরভাগ লোকের ধারণা রামকৃষ্ণ মিশনের এই বাড়িটি একটি ধর্মীয় কালচারের প্রতিষ্ঠান। এখানে না আসলে, বা এঁনাদের কাজের পরিধি সম্বন্ধে না জানলে বাইরে থেকে কোনো ধারণা করা যায় না। এখান থেকে যে কি বিশাল কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তা জানলে বোঝা যায় কেন সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠানটি এতো জনপ্রিয়। এই প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে আমার নিয়মিত যাতায়াত আছে বলে এঁনাদের কাজের পরিধি সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞানার্জন করতে পেরেছি। আমাদের কল্লোলিনীতে বহু গর্বের জিনিস আছে। এই প্রতিষ্ঠানটি শহরবাসীর কাছে এক পরম অহংকার এবং অবশ্যই গর্বের প্রতিষ্ঠান।
তথ্যসূত্র : চিরন্তনে পঁচাত্তর
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ০১-০৬-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।