Sunday, March 31, 2019

ভিস্তি Visti>

আজও ভিস্তিওলার দেখা মেলে 




"ন্যাড়া যায় বেলতলাতে"।  ন্যাড়া যে বেলতলাতে যায় সবাই সেকথা জানে এবং পুঁথিতেও  লেখা আছে কিন্তু কোথাও লেখা নেই বা কারো জানা নেই যে ন্যাড়া বেলতলাতে "কবার যায়?" এই প্রশ্নে "আবোল তাবোল"এর লেখক সুকুমার রায় বেশ চিন্তায় পরে গিয়েছিলেন। কেউই তাঁকে সদুত্তর দিতে পারছিলেন না। এমন সময় এক ভিস্তিওলার আবির্ভাবে তিনি চিন্তামুক্ত হলেন। 
                       
                                                লাখোবার যায় যদি সে      যাওয়া তার ঠেকায়  কিসে?
                                                   ভেবে তাই পাই না দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?
                                                      এ কথাটা যেমনি বলা     রোগা  এক ভিস্তিওলা
                                                     ঢিপ করে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তাঁর।
                                              হেসে বলে, আজ্ঞে সে কি?     এতে আর গোল হবে কি?
                                                   নেড়াকে  তো নিত্য দেখি      আপন চোখে পরিষ্কার - 
                                                      আমাদেরি বেলতলা যে      নেড়া  সেথা খেলতে আসে 
                                                        হরে দরে হয় ত মাসে       নিদেন পক্ষে পঁচিশ বার।"

বিখ্যাত লেখক সুকুমার রায় এইভাবেই আমাদের সাথে ভিস্তিওলাদের পরিচয় করে দিয়েছিলেন। যে ব্যক্তি  মশকে করে  জল বহন  ও সরবরাহ  করে তাকেই  ভিস্তিওলা বলা হয়। এই পেশাটি   পুরোনো কলকাতার প্রায় বিলুপ্ত এক পেশা। 

গতকাল  বিকেলের   দিকে  আমি ইলিয়ট  রোড  ধরে হেঁটে   ফিরছিলাম।  হঠাৎই   দেখলাম    একজন ভিস্তিওলা রাস্তার কল থেকে তার মশকে জল ভরছে। এই  দৃশ্য দেখে আমার  ছোটবেলার স্মৃতিটা মনে  উদয়  হল। আমি ছোটবেলায়  গড়িয়াহাট  অঞ্চলে কতবার  এই ভিস্তিওলাদের দেখেছি।  দেখেছি  তারা এরকমই মশকে  রাস্তার কল থেকে  জল ভরছে ,  দেখেছি  তাদের এই মশকের  জল  দিয়ে রাস্তা  ধুয়ে দিতে

আগেকার  দিনে যুদ্ধের সময়  এই মশকের  ব্যবহার খুব বেশি পরিমানে  ছিল।  মশকে করে জল ভরে টম টম  গাড়িতে  করে  ব্রিটিশ সেনা  ছাউনিগুলোতে সরবরাহ করা  হত। দিল্লি ও ঢাকাতেও এককালে প্রচুর  ভিস্তিওলা ছিল  বলে শুনেছিলাম।  কলকাতা    শহরের   সাথে এই   ভিস্তিওলাদের   সম্পর্ক কিন্তু  বহুদিনের।     প্রতিদিন ভোরবেলায় তারা রাস্তার কল  থেকে তাদের মশকে জল ভর্তি করে মহানগরীর রাস্তা ধুয়ে  দিত।    

বিশ   শতকে   কলকাতা   পুরসভা   এই   ভিস্তিওলাদের   রাস্তা  ধোয়ার  কাজে  ব্যবহার করত বড়দের  মুখে শুনেছিলাম  আর্থিক  সচ্ছল   পরিবারের   লোকেরা   এরকম  ভিস্তিওলাদের  কাছ থেকে  ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে  টাকা   দিয়ে  জল  কিনত। এখন অবশ্য এই  কাজে  সব  জায়গাতেই  মশকের  বদলে বালতি   বা  ড্রামে  করে    জল   ভরে  সরবরাহ   করতে  দেখা   যায় ।  তাদের  অবশ্য  ভারী  বলা  হয় ।ভিস্তিওলাদের   কাঁধে ঝোলানো  লম্বা  ছাগলের  চামড়ার ব্যাগ  থাকতো।  এই  চামড়ার   ব্যাগগুলিকেই  মশক বলা  হয়।  সেই  সবসময়  কলকাতা  শহরে  এই  পেশাতে  প্রচুর লোককে  দেখা  যেত।  যতদিন  যাচ্ছে  আস্তে  আস্তে এই পেশাটা  অবলুপ্তির  পথে চলে  যাচ্ছে।  আজ  যে  ভিস্তিওলার  দেখা  পেলাম  তার  নাম   রাজু  হাসান।  তার  সাথে   কথা   বলে  জানতে  পারলাম  এই   পেশাতে  সে  বহুদিন ধরেই   রয়েছে।  তার পিতা এই পেশায় দীর্ঘদিন ছিলেন। সে বললো এখন এক ভিস্তি জলের দাম পাই মাত্র ১০ থেকে ১২  টাকার মত।  সকাল ও  বিকেল  মিলে প্রায় ৩০ ভিস্তি জল দিতে পারি। তবে  এখন সেরকম চাহিদা না থাকায় সারাদিনে মাত্র ১৫ -২০  ভিস্তির মত জল দেওয়া যায়। বেশিরভাগ জায়গাতেই আজ আর জলের প্রয়োজন হয় না।  অনেক ভিস্তিওলা কলকাতা ছেড়ে দেশে ফিরে গেছে। আবার অনেকে  অন্য  পেশায়  চলে  গেছে।  সে  আরো  জানালো  জানবাজার  অঞ্চলে  অবশ্য  কয়েকজন  ভিস্তিওলা এখনও  আছে। তারা  বেশিরভাগই বিহারের বাসিন্দা। সে অবশ্য জানবাজারে  থাকে  না,   তপসিয়াতে  সে থাকে।  কথা  প্রসঙ্গে সে  জানালো মশকে  প্রায়  ২০ লিটার  মত  জল  ধরে।  তার  কাছে   জানতে  চাইলাম  তার  ছেলে  কি এই  পেশায়  আসতে  চায়  কিনা।   সে বললো একদমই  চায়  না। সে  উল্টে আমাকেই  প্রশ্ন করল যে এই  পেশায় আসলে তার ছেলে কি  খেতে পাবে ?  তার ছেলে  কাঠের কাজ  শিখে  কাঠের মিস্ত্রির  কাজ  করে।  সে  ইলিয়ট  রোড , রাফি  আহমেদ   কিদোয়াই  রোড , মারকুইস  স্ট্রিট  এইসব অঞ্চলেই জল সরবরাহ করে। 

বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল যুগে পৌঁছে আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো এরকম বহু পেশা  আজ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। 

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 

তারিখ : ৩১-০৩-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০



 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Sunday, March 24, 2019

দীঘা ভ্রমণ Digha >


এক অপরূপার  হাতছানি 


পুরোনো দীঘা সৈকত 
পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগর হল বঙ্গোপসাগর। শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে চলা এক মহাসাগর।  এই সাগরের তীরেই অবস্থিত  ওড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গ ভারতের এই চারটি অঙ্গরাজ্য। এর সৈকতও এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে চলে গেছে। সৈকতগুলোও জায়গার নাম অনুসারে নামাঙ্কিত হয়েছে। প্রতিটি সৈকতই  পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তেমনি এক সৈকত আমাদের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দীঘার সমুদ্র সৈকত। দীঘা হল পশ্চিমবঙ্গের এক অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। এখানে শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা  শুধু নয় সারা বছরই পর্যটকদের মেলা বসে। ভীড় আর ভীড় আর ভীড়, পর্যটকদের ভীড়ের ঠেলায় দীঘার নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়েছে। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্য থেকেই প্রচুর পর্যটক এখানে সারা বছরই আসে। শুধু ভারতীয় নয় প্রচুর বিদেশী পর্যটকও  এখানে আসে। কলকাতার খুব কাছে বলে বাঙালিদের ভীড় এখানে সব থেকে বেশি দেখা যায়। ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের কাছে দীঘা হলো ছোট্ট ভ্রমণের এক মনের মতন জায়গা।

আজ   থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে বীরকুল অঞ্চলের   রাজা ছিলেন সাগর   রায়।   তাঁর   বংশধররা প্রায় দুশো বছর এখানে রাজত্ব চালিয়েছিলেন। অতীতের এই বীরকুল গ্রামের সমুদ্র  সৈকতই  বর্তমানের  দীঘার সমুদ্র সৈকত।
দীঘার বুকে সূর্যোদয় 

১৭৫০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন।  যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে  ভারতবর্ষে পাঠানো হল। গভীর অধ্যাবসায় ও তাঁর  কর্মের জন্য খুব তাড়াতাড়ি তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। লর্ড ক্লাইভ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপড়ত্তন করেছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর  সংগঠনিক বৈশিষ্ঠতার মাধ্যমে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অনেক উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বাংলায় এসেই শাসন প্রণালীর সংস্কার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিতে মন দেন। ১৭৫৮ সালে তিনি মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট হন, ১৭৭৪ সালে তিনি বাংলার গভর্নর হয়েছিলেন।

বাংলার গরমে হেস্টিংস সাহেবের অবস্থা বেশ কাহিল হয়ে যেত। তিনি গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল করার জন্য  সুন্দর, শীতল, নিরিবিলি একটা জায়গার সন্ধান করছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে ভাগীরথী নদীর মোহনা থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে একটা উপযুক্ত জায়গার সন্ধান তিনি পেলেন। সমুদ্রের ধারে  বন -জঙ্গলে ঢাকা বেশ সুন্দর জায়গাটা। জায়গাটার নাম বীরকুল।
পুরোনো দীঘার সৈকত 
এখানকার  সমুদ্রের ধারটা গ্রীষ্মকালে বেশ আরামদায়ক হবে বলেই মনে করলেন হেস্টিংস সাহেব। সমুদ্রের  মাছ, জঙ্গলের পশু আর সাথে সমুদ্রের মনোরম হাওয়া সব মিলে জায়গাটা খুবই  সুন্দর। এখানকার সৌন্দর্য্যে  তিনি মুগ্ধ হয়ে বীরকুলের নাম দিলেন "ব্রাইটন অফ ক্যালকাটা"। এখানে তিনি একটা সুন্দর বাড়ি তৈরী করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস  দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাড়িটি দেখভালের অভাবে  সম্পূর্ণ  নষ্ট হয়ে যায় বলে শোনা যায়। ১৭৯৬ সাল  নাগাদ আর এক  ব্রিটিশ ব্যবসায়ী চার্লস চ্যাপম্যান এখানে আসেন।  সেই সময় তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের তৈরী করা  বাড়ীটা দেখতে পান নি বলে জানিয়েছিলেন।  তারও  এই জায়গাটা বেশ ভালো লেগে যায়।  তিনি গ্রীষ্মকালে এখানে বেশ কিছুদিন কাটান। এরপর বেইলি  নামে  আর এক সাহেব  ১৮৫২ সালে এই বীরকুলে আসেন। সমুদ্রের জলোচ্ছাস ও আশ-পাশের বন -জঙ্গল দেখে তিনিও মুগ্ধ হয়ে যান। এইভাবে চলতে চলতে বীরকুল একদিন দীঘা নামে  পরিচিতি লাভ করে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। তিনি দীঘার উন্নয়নের  জন্য হাত বাড়ান। তাঁর হাত ধরেই দীঘা আবার প্রচারের আলোয় চলে আসে। তিনি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দীঘাকে তুলে ধরলেন।  রূপসী বাংলায় রূপের ডালি নিয়ে দীঘার যাত্রা শুরু হল। শুরু হলো এক অপরূপার  হাতছানি দিয়ে পর্যটকদের ডাকা।
সমুদ্রের ধারের রাস্তা 

পশ্চিমবঙ্গ সরকার বন দপ্তরের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে বনসৃজন ও সৈকত সংরক্ষণের কাজ প্রথম শুরু করে।  ১৯৫৫ সালে পাওয়ার
হাউস ও ক্যাফেটারিয়া তৈরী করা হয়।  ১৯৫৬ সালে বন দপ্তরের কাছ থেকে উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দপ্তর দীঘার উন্নয়নের ভার নেয়।  ১৯৫৮ সালে টুরিস্ট লজ, ১৯৬২ সালে বাজার, ১৯৬৪ সালে সৈকতাবাস, ১৯৭৭ সালে বাস স্ট্যান্ড তারা তৈরী করে। ভারতীয় রেল কয়েক বছর হল কলকাতা থেকে দীঘা  যাওয়ার জন্য রেল চালু করে। এই রেলের জন্য দীঘা পৌঁছনো আরো সহজলভ্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে  প্রচুর হোটেল, রেস্তোরা,  নানারকম দোকানপাট ও আলোকসজ্জায় দীঘা  শহরটা ঝলমলে হয়ে উঠেছে।
পুরোনো দীঘা 

 সমুদ্রের জলোচ্ছাস, সুদীর্ঘ বালিয়াড়ি, বিস্তীর্ণ ঝাউবন নিয়ে দীঘার সৌন্দর্য যেন সত্যিই এক অপরূপার হাতছানি। প্রকৃতি প্রেমিক পযটকদের তীর্থক্ষেত্র। সাত আট কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রতটে  সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে হাঁটা এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি মনে আনে । গভীর অন্ধকারের পর যখন পুব আকাশে রক্তিম আবির ছড়িয়ে দেয়, পূর্ব দিগন্ত থেকে সূর্যদেবের বিচ্ছুরিত ছটা  সমগ্র সমুদ্রকে রঙিন করে তোলে, তখন সুন্দরী দীঘার উজ্জ্বলতা বেড়ে ওঠে। দীঘার সৌন্দর্যে সার্থক হয়ে ওঠে পর্যটকের চোখ। পর্যটকের মনও ভরে ওঠে দীঘা ভ্রমণের সার্থকতায়।
মেঘাচ্ছন্ন দীঘার সৈকত 

সমুদ্রের ধার দিয়ে পুরোনো দীঘা  থেকে নতুন দীঘা যাওয়ার  এক সুন্দর বাঁধানো রাস্তা দীঘার  আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সমুদ্রের ধার বরাবর ঝাউগাছের ছড়াছড়ি। এই ঝাউবনে আসলেই তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানটির কথা বাঙালির মনে আসবেই। "চল রীনা , ক্যাসুরিনা, ছায়া গায়ে মেখে, কাঁকরের পথ দিয়ে একটু একটু করে হারিয়ে যাই, বল যাবে কিনা?" সত্যি ঝাউবনের ছায়ার  তলায় আসলেই মন হারিয়ে যায়, সাথে কানে আসা সমুদ্রগর্জনের আওয়াজ সমুদ্রপ্রেমিককের জীবনে ষোলআনা পূর্ণতা লাভ করাবেই।
সূর্যোদয় ও ডাব  বিক্রেতা 

বর্তমান দীঘা শহরটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটা পুরোনো দীঘা  আর একটা নতুন দীঘা। নতুন দিঘাটিকে পরবর্তীকালে তৈরী করা হয়েছে।  দীঘা শহরে ঢোকার মুখেই একটা বিরাট প্রবেশদ্বার তৈরী করা হয়েছে। রাতের অন্ধোকারে আলোকসজ্জায় সাজানো প্রৱেশদ্বারটি বেশ সুন্দর দেখতে লাগে। পুরোনো দীঘা শহরটি একটু ঘিঞ্জি প্রকৃতির। এইখানেই সমুদ্রের ধারে বিশ্ববাংলা পার্ক তৈরী করা হয়েছে। এই পার্কের   সামনে পর্যটকদের বসার জন্য  প্রচুর চেয়ার পাতা রয়েছে। এই চেয়ারে  বসে সমুদ্রের জলে  পড়া জ্যোস্না রাতের  চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব দেখতে খুব ভালো লাগে।
নতুন দীঘার সৈকত 

পুরোনো দীঘার কাছেই নতুন দীঘা শহরটি গড়ে তোলা হয়েছে। "দীঘা  শংকরপুর উন্নয়ন পরিষদ " পরিকল্পিতভাবে এই শহরটিকে তৈরী করেছে।  পুরোনো দীঘা থেকে এই নতুন দীঘা শহরটি  বেশ নিরিবিলি। তবে দুই দীঘাতেই প্রচুর হোটেল ও রেস্তোরা গড়ে উঠেছে।

দ্রষ্টব্য স্থান :

অমরাবতী লেক - সমুদ্রের খুব কাছে নতুন দীঘাতে এই কৃত্রিম  লেকটি তৈরী করা হয়েছে। লেকটির সাথে মরশুমি ফুলে সুন্দর করে সাজানো একটা বাগান আছে। লেকের জলে নৌকাবিহার করার ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের জন্য কয়েকটি খেলার ব্যবস্থাও রাখা আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ও  পাখীদের  মিষ্টি সুরেলা ডাকে  জায়গাটা বেশ ভালো লাগলো।

রোপওয়ে  - অমরাবতী পার্কের ভিতরেই একটা রোপওয়ে আছে।  এই রোপওয়ে চড়ার  জন্য টিকিট ঘরে দেখলাম অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। লাইন দিয়ে টিকিট কেটে  রোপওয়েতে  উঠে পড়লাম।  রোপওয়ে চড়ার অভিজ্ঞতাটা  আমার  বেশ রোমাঞ্চকর লাগল।

দীঘা  বিজ্ঞান কেন্দ্র  - অমরাবতী পার্কের কাছেই এই বিজ্ঞান কেন্দ্রটি অবস্থিত। সমুদ্রের একঘেয়েমি কাটাতে হলে এখানে আসা উচিত। বিজ্ঞান-এর নানারকম  জিনিস দিয়ে সাজানো এই বিজ্ঞান কেন্দ্রটি। এখানে থ্রিডি শোয়েরও  ব্যবস্থা রয়েছে।

মেরিন একুরিয়াম -  এটি পুরোনো দীঘাতে অবস্থিত। এশিয়ার সবচেয়ে বড় নির্মিত একুরিয়াম হল এটি। এখানে সমুদ্রের তলার  নানারকম মাছ ও জন্তুদের জীবন যাত্রা দেখানো হয়। এখানে সমুদ্র নিয়ে নানারকম গবেষণা করাও  হয়ে থাকে।

চন্দ্রোনেশ্বর  মন্দির 

চন্দ্রোনেশ্বর মন্দির- পুরোনো দীঘা থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে এই মন্দিরটি অবস্থিত। ওড়িষ্যার বালেশ্বর জেলায় এটির অবস্থান। মন্দিরটি কলিঙ্গ স্থাপত্যে তৈরী।  মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। এটি  হল চন্দ্রোনেশ্বর অর্থাৎ শিবের মন্দির। প্রচুর পুণ্যার্থী এখানে ভিড় করেন। সামনের পুকুর থেকে মন্দির পর্যন্ত অনেক পুণ্যার্থীকে দন্ডী কাটতে দেখলাম। একজন পুরোহিত জানালেন এখানে  দন্ডী  কাটলে মনের বাসনা পূর্ণ হয়।

তালসারি সৈকত - এই সমুদ্র সৈকতটিও উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলায় অবস্থিত। পুরোনো দীঘা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই সৈকতটিও প্রাচীন ও দর্শনীয়। এখানেই সুবর্ণরেখা নদীটি সমুদ্রের সাথে মিশেছে। এটিও যথেষ্ট নির্জন, সুন্দর ও উপভোগ্য এক সৈকত। এখানেও বেশ কয়েকটি থাকার জন্য হোটেল রয়েছে।

 মোহনা - মোহনা হল বঙ্গোপসাগরের তীরে  অবস্থিত একটা ছোট্ট গ্রাম।  দীঘা থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে এই মোহনা গ্রামটি অবস্থিত। আমি গ্রাম বলছি বটে তবে এখানে কোনো লোকবসতি নেই। এই গ্রামে বসবাস করার জন্য কোনো বাড়ি ঘরও নেই।  এখানে আসলে দেখা যায় দূরদূরান্ত থেকে শুধু মৎস্যজীবীদের ও মাছের ট্রলারের যাতায়াত করা। প্রত্যেকদিন সকাল বেলায় এখানে মাছের পাইকারি বাজার বসে। সমুদ্রের পাশেই এই বাজার। এখানেও একটা ছোট্ট  সৈকত রয়েছে, তবে সৈকতটি ভীষণই নোংরা।

এছাড়া এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মন্দারমণি সৈকত, শংকরপুর সৈকত, তাজপুর সৈকত, জুনপুট সৈকত, বাঁকিপুর সৈকত  ঘুরে  আসা যায়।

 ৫০০ বছরের ইতিহাসের সরণি বেয়ে দীঘা আজ পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র। দীঘাকে ঘিরেই  পূর্ব মেদিনীপুর জেলার  অর্থনীতি  দ্রুত বিকাশ লাভ করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জেলার কর্মকর্তারা আরো নতুন নতুন সৈকতের সন্ধান করে চলেছে।  ভ্রমণ পিপাসু বাঙালিরাও অপেক্ষা করে আছে এইসব নতুন সৈকতের জন্য। 


কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে দীঘার দূরত্ব প্রায় ১৮৮ কিলোমিটার। কলকাতা বা হাওড়া থেকে এক ঘন্টা অন্তর দীঘা যাওয়ার জন্য সরকারি বাস ছাড়ে।  সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত এই বাস পাওয়া যায়। বর্তমানে অবশ্য কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকেও দীঘা যাওয়ার জন্য  সরকারি বাস ছাড়ে।  এছাড়া প্রতিদিন প্রচুর বেসরকারি বাসও কলকাতা-দীঘা  যাতায়াত করে। বাসে  কলকাতা থেকে দীঘা যেতে ঘন্টা পাঁচেক সময় লাগে। এছাড়া হাওড়া  থেকে ট্রেনে করেও দীঘা যাওয়া যায়।  ট্রেনে সময় একটু কম লাগে। 

কোথায় থাকবেন : দীঘাতে সৈকতাবাস, পুরোনো টুরিস্ট লজ , নতুন টুরিস্ট লজ, নিরালা, আনন্দম প্রভৃতি সরকারি থাকার জায়গা রয়েছে। এই সরকারি লজগুলোকে কলকাতা থেকে অনেক আগেই বুক করতে  হয়। বিভিন্ন ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনেক  হলিডে হোম রয়েছে।  এছাড়া পুরোনো দীঘা  ও নতুন দীঘাতে প্রচুর বেসরকারি লজ  রয়েছে। 






তারিখ : ২৪-০৩-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

গেঁওখালী ভ্রমণ Geokhali >


ত্রিবেণী সঙ্গম 



ত্রিবেণী অর্থাৎ তিনটি নদীর মিলনস্থল। ত্রিবেণী সঙ্গম বলতে আমরা প্রথমেই বুঝি এলাহাবাদ বা প্রয়াগরাজের ত্রিবেণী সঙ্গমকে।  এখানে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী এই তিনটি  নদীর মিলন ঘটেছে।  হিন্দু ধর্মে এই জায়গাটা খুবই পবিত্র। এটা এক তীর্থস্থান। কিন্তু আমাদের কলকাতার খুব কাছেই আর একটা
গেঁওখালীতে গঙ্গার দৃশ্য 
ত্রিবেণী সঙ্গম রয়েছে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা ও তিনটি নদীর মিলনস্থলই  হল এই ত্রিবেণী সঙ্গম। হাওড়ার দিক থেকে আসা রূপনারায়ণ নদী, মেদিনীপুরের দিক থেকে আসা হুগলী নদী  আর ঝাড়খন্ড থেকে আসা হুগলি জেলা হয়ে  দামোদর নদ এই স্থানেই এসে মিলিত হয়েছে। এই তিনটি নদী এক হয়ে হুগলী নদী নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এই মিলনস্থলের তিন দিকে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা অবস্থিত। এই তিনটি  জেলা হল পূর্বদিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ দিকে হাওড়া ও পশ্চিম দিকে পূর্ব মেদিনীপুর। এই মিলন স্থলের দুই পাড়ে  দুইটি সুন্দর বেড়ানোর জায়গা রয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের পাড়ে গেঁওখালী আর হাওড়ার পাড়ে গাদিয়ারা। এ যেন একই মায়ের পেট থেকে বেড়োনো যমজ সন্তান। আজ আমি শুধু পূর্ব মেদিনীপুরের গেঁওখালীর কথাই  আপনাদের বলব।  


পূর্ব  মেদিনীপুর হল পশ্চিমবঙ্গের এক সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক জেলা। এই জেলার পর্যটন ও পুরাতত্ত্বের কথা বহু বইয়ের বহু পাতায়  স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।  এই জেলায় যেমন সমুদ্র রয়েছে, তেমন প্রত্নতত্বের সম্ভারও রয়েছে। জেলার মহিষাদল ব্লকের একটা ছোট্ট গ্রাম হল গেঁওখালী। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই দেখার মত। প্রাচীনকালে বিদেশ  থেকে কলকাতা বা উড়িষ্যা আসতে  গেলে এই গেঁওখালীর কাছের  তাম্রলিপ্ত বন্দরকে ব্যবহার করতে হত। শোনা যায় ১৮৮৮ সালে খ্রিস্টান ধর্মযাজক উইলিয়াম কেরী সাহেব এই গেঁওখালীতে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন। ইতিহাসবিদরা বলেন বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারত ভ্রমণের সময়ে এই অঞ্চলেরই তাম্রলিপ্ত বন্দরকেই ব্যবহার করেছিলেন। গত রবিবার  আমি ও বিনীতদা (শ্রী বিনিতেন্দ্র চৌধুরী) দুজনে ছবি তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে  গেঁওখালী পর্যটনে গিয়েছিলাম।

গেঁওখালী ফেরী ঘাটের পথে লঞ্চ 

অন্যান্য ভ্রমণ স্থানগুলোর মত গেঁওখালীতে সেরকম দর্শনীয়  হয়তো কিছু দেখতে পাবেন না। তবে এখানকার শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ আপনার মন কেড়ে নেবে।  গঙ্গার পাড় বরাবর রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনটাও আপনার স্নিগ্ধ হয়ে উঠবে। প্রভাতের সূর্যোদযের  মনভোলানো  দৃশ্য এখানকার  সবথেকে আকর্ষণীয়।শীতের সময় শীতের রুক্ষ পরিবেশের মধ্যে এখানে নদীর ধারে তৈরী করা চেয়ারগুলোতে বসে সূর্যোদয়ের মোহময়ী রূপ দেখতে খুবই ভালো লাগবে। নদীর ধারের সারিবদ্ধভাবে বড় বড় গাছগুলির ফাঁক দিয়ে কুয়াশায়  আবছাভাবে দেখতে পাওয়া পালতোলা ডিঙি নৌকো ও তার মাঝিদের দাঁড় বওয়ার  দৃশ্য দেখা  যেন এক পরম পাওয়া। 



গেঁওখালীতে গঙ্গার দৃশ্য
একটু বেলা বাড়লে সূর্যের আলোয় নদীর বুকে রোদ ঝিলমিল খেলা দেখতেও বেশ ভালো লাগে। শীতের সময় ভোরবেলায় টাটকা খেজুরের রস খাওয়া এক নতুন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। পায়ে হেঁটে বা রিক্সা করে এই অঞ্চলটা একটু ঘুরে দেখতেও মন্দ লাগে না। দিগন্ত বৃস্তিত জলরাশি বয়ে চলেছে সাগরের পানে। কলকাতা থেকে মুহুর মুহুর আধুনিক জাহাজের  সমুদ্র যাত্রা  বা পাল তোলা নৌকোর যাতায়াত দেখতেও মন্দ লাগে না। শীতের সময় আপনার উরু উরু মনটাকে এখানে নিয়ে আসলে আশাকরি  ভরিয়ে তুলতে  পারবেন।

খাঁড়িতে মাঝি জাল বুনছে 

ফেরি ঘাটের পাশে একটা খাঁড়িতে  দেখলাম একজন মাঝি নৌকোতে বসে জাল বুনছে। এই দৃশ্যটা আমার কাছে একটা উপরি পাওনা হল।  প্রতি সোমবার ও শুক্রবার সকালে এখানে একটা হাট বসে। আমাদের মত  শহুরে লোকদের  কাছে এই গ্রামীণ হাট বেশ উপভোগ করার মত।  ফেরি ঘাটের কাছে নদীর চড়ে অনেকগুলো জাহাজের ভগ্নাবশেষও দেখতে পেলাম। গেঁওখালী থেকে দু-তিন  কিলোমিটার দূরে মীরপুর বলে একটা জায়গায়  একটা ফিরিঙ্গি পাড়া রয়েছে। এখনো সেখানে কয়েকটা ফিরিঙ্গি  পরিবার বসবাস করে। এই পাড়াতে একটা গির্জাও রয়েছে। এই গির্জার পাশে  বেশ সুন্দর একটা ফুলের বাগানও দেখতে পেলাম। আমাদের  রিক্সাওয়ালা অনন্ত বলল মহিষাদলের রাজারাই এখানে ফিরিঙ্গিদের জমি দান করেছিলেন। অনন্ত   আমাদের  বড়দিনের সময় এই ফিরিঙ্গি পাড়াতে একবার আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। সে বলছিল ওই সময় এখানকার  গির্জাটি ও পুরো পাড়াটিকে  খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। 

মহিষাদল রাজবাড়ী 

গেঁওখালী ঘুরে আপনি একটা টোটো গাড়ি ঠিক করে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে মহিষাদল রাজবাড়ী দেখে আসতে পারেন। গেঁওখালী থেকে মহিষাদল রাজবাড়ী যেতে মিনিট কুড়ি সময় লাগবে। রাজবাড়ীটি বেশ সুন্দর। এখানে দুটি রাজবাড়ী রয়েছে।  একটি হল ফুলবাগ রাজবাড়ী আর একটা হল ভগ্নপ্রায় রঙ্গীবসান রাজবাড়ী। ফুলবাগ রাজবাড়ীটি বেশ সুন্দর। এই বাড়িটির  এক  তলায় একটা সুন্দর সংগ্রহশালা রয়েছে। এই সংগ্রহশালাটি ও রঙ্গীবসান রাজবাড়ীটি  দেখে পাশেই  অবস্থিত গোপাল জীউ শিব মন্দিরগুলো দেখে নেবেন। আমার মহিষাদল রাজবাড়ী লেখায় এখানকার বিস্তারিত তথ্য পাবেন। এই রাজবাড়ীর  কিছুটা  দূরে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজরিত একটি কুটির রয়েছে। এই কুটিরটিও পারলে দেখে নেবেন। যদিও আমরা সময়ের অভাবে এই কুটিরটি দেখতে যাইনি। গেঁওখালী ও মহিষাদল ঘুরে আপনার হাতে যদি সময় থাকে তাহলে আপনি তমলুক শহরটিও একবার ঘুরে আসতে পারেন। বাসে আধ ঘন্টার মত সময় লাগবে গেঁওখালী থেকে তমলুক পৌঁছতে। তমলুকে আপনি রাজবাড়ী, তমলুক সংগ্রহশালা ও সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ বর্গভীমা মন্দিরটি দেখেতে পারেন।
 
নূরপুর ঘাট থেকে  নেওয়া
সূর্যাস্তের ছবি
 
   

আপনি ইচ্ছে করলে একদিনেই গেঁওখালী ঘুরে কলকাতায়  ফিরে  আসতে পারেন। এখানে রাত্রি যাপনের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। খুব সকালের বাস ধরতে পারলে সব কিছু দেখে রাতের মধ্যেই কলকাতায় ফিরে আসা যায়। আপনি যদি তমলুক ঘুরতে যান তাহলে আপনি তমলুক স্টেশন থেকেও খুব সহজেই ট্রেন ধরে হাওড়া স্টেশনে আসতে পারবেন। এই পথে অবশ্য ট্রেন একটু  কম  চলাচল করে। যাওয়ার আগে ট্রেনের সময়গুলো একটু জেনে গেলে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।  আপনার যাত্রাটাও বেশ সুখকর হবে।


কিভাবে যাবেন :
কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাসে  করে ৬০ কিলোমিটার দূরে নূরপুর ফেরি ঘাটে এসে পৌঁছান। বাসে মোটামুটি ঘন্টা তিনেকের মতো সময় লাগবে। ওখান  থেকে লঞ্চে করে নদী পার হলেই গেঁওখালীতে পৌঁছানো যাবে। ফেরি সার্ভিস মোটামুটি  পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা অন্তর।নূরপুরের ঠিক উল্টোদিকে গেঁওখালী গ্রাম। এছাড়া আপনি হাওড়া স্টেশন থেকে হলদিয়াগামী ট্রেন ধরে সতীশ সামন্ত হল্ট স্টেশনে নেমে বাস বা অটো রিক্সা করে গেঁওখালী যেতে পারবেন। সতীশ সামন্ত স্টেশন থেকে গেঁওখালীর দূরত্ব ৮ কিলোমিটার।

কোথায় থাকবেন :
গেঁওখালীর কাছে রূপনারায়ণ নদীর ধারে সেচ দপ্তরের  একটা সুন্দর বাংলো আছে। এছাড়া হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের "ত্রিবেণী সঙ্গম টুরিস্ট কমপ্লেক্স" নামে একটা থাকার ব্যবস্থা আছে। এই দুটো জায়গাতেই রাত্রিবাসের সুবিধা রয়েছে।


তারিখ : ২৮-০৩-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Wednesday, March 20, 2019

আছিপুর ভ্রমণ Achhipur >

  ভারতের চীনাদের স্মৃতিচিহ্ন 

মূল মন্দিরের প্রবেশদ্বার 

আপনি কি জানেন বাংলায় "চিনি" কথাটি কিভাবে এসেছিল? সেটা জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় ২৪০ বছর আগের এক ঘটনায়।  বাংলায় তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ব্যবসা রমরমিয়ে চালাচ্ছে। বাংলার বড়লাট তখন ওয়ারেন হেস্টিংস। ১৭৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার  ওয়ারেন হেস্টিংসকে  বাংলার গভর্নর হিসেবে মনোনীত করে। পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য সমগ্র ভারতের  গভর্নরও হয়েছিলেন। বাংলার গভর্নর হওয়ার পর তিনি কোম্পানির শাসন প্রণালীর  যেমন সংস্কার করেছিলেন তেমন কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলেই ১৭৭৮ সাল নাগাদ চীন দেশ থেকে টং আছি নামে একজন চীনা ভদ্রলোক ব্যবসা করার উদ্দেশ্য নিয়ে  কলকাতার খুব কাছে বজবজে তাঁর জাহাজ  ভেড়ান।  আমরা জানি হিউয়েন স্যাং বা ফা হিয়েন বহুকাল আগে চীন দেশ থেকেই   ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তাঁরা শুধু ভ্রমণ করার উদ্দেশেই এই দেশে পা.দিয়েছিলেন।  তাঁদের জাহাজও কিন্তু সেই আমলে বাংলার বুকে তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসে .ভিড়েছিল। তাঁরা পায়ে হেঁটেই  ভারতের রূপ-রস উপভোগ করেছিলেন। কিন্তু টং আছি  এই দেশে  ভ্রমণ করতে আসেননি, তিনি  ব্যবসা করতেই  এসেছিলেন। তিনিই  প্রথম চীনা ব্যবসায়ী যিনি ব্যবসায়ী হিসেবেই চীন দেশ থেকে  ভারতের বুকে পা রেখেছিলেন।   
নামের ফলক 

তিনি  চীনের ক্যান্টন নিবাসী একজন চায়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি  কয়েকজন চীনা শ্রমিককেও সাথে করে এখানে নিয়ে এসেছিলেন।  টং আছি চীন দেশের একজন বিখ্যাত ইংরেজ
 ব্যবসায়ী জেমস ফিল্টন সাহেবের কাছ থেকে একটা সুপারিশপত্র নিয়ে এসেছিলেন।  বজবজে নেমে এখানকার নদীর ধারের জায়গাটা তাঁর বেশ মনে ধরল।  এখানে আসার পর তিনি একদিন কলকাতায় এসে তদকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের সাথে দেখা করলেন।  তিনি মহামান্য গভর্নরকে জেমস ফিল্টনের সুপারিশপত্রটা দিলেন। তিনি নানারকম ব্যাবসায়িক আলোচনা করার সাথে সাথে হেস্টিংস সাহেবকে চায়ের গন্ধ ও স্বাদের কথা বললেন।  তিনি হেস্টিংস সাহেবকেও জানালেন যে তিনি এখানে কোন চায়ের ব্যবসা করার জন্য আসেননি। তিনি বজবজে নদীর ধারে একটা  সুগার কারখানা করতে চান।  হেস্টিংস সাহেব তাঁর সাথে আলোচনা করে খুবই সন্তুষ্ট হলেন। চীনা  ব্যবসায়ীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে হেস্টিংস  সাহেব তাঁকে বজবজে  নদীর ধারে  ৬৫০ বিঘা  জমির পাট্টা  দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পাট্টা দেওয়া জমিটির খাজনা হিসেবে ৪৫ টাকা ধার্য করলেন। টং আছি সব কিছুতেই রাজি হয়ে গেলেন। সেই সময় ওই অঞ্চলের জমির মালিকানা ছিল বর্ধমানের মহারাজাদের হাতে। তদকালীন বর্ধমান মহারাজ গভর্নর হেস্টিংসের আদেশ অনুসারে ৬৫০ বিঘা জমির টঙের নামে  লেখাপড়া করে দিলেন। টং তো বেজায় খুশি। সেই সময় বজবজের  নদীর ধারটা জলা -জঙ্গলে ভর্তি ছিল। সেই জঙ্গল পরিষ্কার করার পরই তাঁর পক্ষে সুগার কারখানা তৈরী করা সম্ভব হবে। তিনি আবার তাঁর দেশে ফিরে গেলেন।  সেখান থেকে প্রায় ১১০ জন চীনা  শ্রমিককে নিয়ে আবার বজবজে আসলেন। এই চীনা  শ্রমিকরা  কঠোর পরিশ্রম করে জঙ্গল পরিষ্কার করলেন। তারপর টং আছি  এখানে তাঁর সাধের সুগার কারখানা  স্থাপন করলেন। এই কারখানা তৈরী করতে প্রায় তিন তিনটে বছর অতিক্রম করে গেল।  অবশেষে ১৭৮১ সালে কারখানা চালু করা হলো।  এই সুগার  কারখানাটি থেকেই ভারতবর্ষের প্রথম চিনি উৎপাদন শুরু হলো।  চীনা মালিকের তৈরী প্রথম সুগার কারখানা বলে "চিনি" শব্দটা লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। সেই থেকেই বাংলা ভাষায় "চিনি" শব্দটার  প্রচলন হতে আরম্ভ করলো। এই চিনি কল স্থাপনের মাত্র তিন বছর পর টং আছি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।  সালটা ছিল ১৭৮৩। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর  সাধের চিনি কলটি বন্ধ হয়ে গেলো। এখানকার চীনা শ্রমিকরা নতুন কাজের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা ও তার আস -পাশের অঞ্চলগুলোতে।  ১৮০০ সালের প্রথমদিকে ইংরেজ সরকার এই অঞ্চলের সমস্ত জমি নিলাম করে বিক্রি করে দিলেন। তারা কিন্তু আছির  তৈরী করা চীনা মন্দিরটি ও তাঁর সমাধির জায়গাটিকে বিক্রি করেনি। তারা আছির সম্মানে এই অঞ্চলের নাম আছির নামে  "আছিপুর" নামাঙ্কিত করল।
মন্দিরের বন্ধ দরজা

টং আছিই ভারতবর্ষের বুকে প্রথম চীনা ব্যাবসায়ী ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর দেখানো পথ ধরে চীন দেশের বহু প্রদেশ থেকে বহু চীনা  ব্যবসায়ী ও শ্রমিক এখানে আসতে  আরম্ভ করল।   তাঁরা কলকাতার এক একটা জায়গায় একসাথে বেশ কয়েকজন করে থাকতে আরম্ভ করলেন। এই সব জায়গাগুলোতে তাঁরা তাঁদের মহল্লা বানাতে লাগলেন। চীনা মন্দির বানালেন বেশ কয়েক জায়গায়। এইভাবেই ভারতের বুকে চীনা উপনিবেশ গড়ে উঠতে লাগল।

আছিপুরের মন্দির ও টং আছির সমাধির স্থান সেই আমলে প্রবাসী চীনাদের একমাত্র পূজা করার জায়গা ছিল।  বর্তমানে টেরিটি বাজার অঞ্চলের চীনারা নিজেদের উপার্জিত অর্থে এখানকার সংস্কার ও রক্ষণবেক্ষণ করে থাকে। আমরা প্রথমেই মন্দিরটির সামনে এসে পৌঁছলাম।  বেশ সুন্দর ও বড় একটা প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রবেশদ্বারটি চীনা স্থাপত্যের এক নিদর্শন। প্রবেশদ্বারটি সবুজ ও লাল রঙে রাঙানো। এই প্রবেশদ্বারের ওপরের দিকে  লেখা আছে কলকাতার "গি হিং চার্চ এন্ড ক্লাব" তারাই এই মন্দিরটির দেখভাল করে।  এটি মন্দিরটির একমাত্র প্রবেশ পথ। প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার পর দেখলাম বিশাল একটা খালি জায়গা রয়েছে। এই খালি জায়গাটিকে  হলুদ ও  লাল রঙের পাঁচিল  দিয়ে ঘেরা। খালি জায়গাটির ডানদিকে একটা ছোট চীনা  মন্দির আর বাঁদিকে  একটা ঘেরা পুস্করিণী আছে।
আছিপুরের গঙ্গা 

আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা দুপুর বেলায় গিয়েছিলাম বলে মূল মন্দিরটি খোলা পাইনি। মন্দিরটি সকাল ও বিকেলে খোলা হয় মাঝে দুপুরবেলায় বন্ধ থাকে।  মূল প্রবেশদ্বারের পাশে একজন বয়স্ক লোক বসে বিড়ি বাঁধছিলেন।   তার কাছ থেকে শুনলাম মন্দিরটি দেখাশুনা করেন গোপাল নামে  একজন যুবক। তিনি ওই যুবকের ফোন নাম্বার দিলেন আমরা তাকে ফোন করে অনুরোধ করলাম একবার যদি উনি এসে আমাদের মন্দিরটি দেখার ব্যবস্থা করে দেন। ওনাকে জানালাম আমরা কলকাতা থেকে এসেছি শুধু এই মন্দিরটি দেখার জন্য। উনি কিছুতেই রাজি হলেন না।  আমাদের সব অনুরোধ বৃথা গেল।  যাইহোক, কিছু করার ছিল না।  বন্ধ মন্দিরটির প্রবেশের দরজার থেকে ভিতরের অংশে যা আছে তা দেখার চেষ্টা করলাম।  সেরকম কিছুই দেখতে পেলাম না।
আছিপুরের ফেরি ঘাট 

পাশের ওই বয়স্ক ভদ্রলোকটির কাছে এখানকার সব কিছু জানার চেষ্টা করলাম। উনি আমাদের বললেন মন্দিরটির ভিতরের  স্তম্ভগুলোতে  খুব সুন্দর কাঠের কাজ করা আছে।  মন্দিরের গর্ভগৃহে একজোড়া চীনা  দেব-দেবী প্রতিষ্ঠিত আছে। এই দেব-দেবী নাকি টং নিজে চীন দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন।  তবে  এখানকার জনগণের কাছে এই দেব-দেবী "খুদা-খুদি" নামে  পরিচিত।  এই দেব-দেবীকে প্রসাদ হিসেবে নানারকম ফল দেওয়া হয়। ফলের  সাথে ভাজা চিকেনও  দেওয়া হয়।  প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায়  পূজা করা হয়।  পূজার সময় চীনা ধুপ জ্বালান হয়।  এই ধুপ নাকি চীন দেশ থেকে কলকাতা হয়ে এখানে আনা  হয়।  তিনি বললেন তাঁর ছোটবেলায় তিনি এই অঞ্চলে বেশ কিছু চীনা পরিবারকে বসবাস করতে দেখেছেন। এখন কোনো চীনা পরিবার আর এই অঞ্চলে থাকে না।  প্রতিবছর  ফেব্রুয়ারী মাসে এখানে মেলা বসে। সেই সময় এখানে রবিবারে বা  ছুটির দিনগুলোতে কলকাতা থেকে প্রচুর চীনা পরিবার এখনও  পুজো দিতে আসে।  মন্দিরের সামনের রাস্তাটি তখন গাড়িতে ভর্তি হয়ে যায়।

 মন্দিরের পুস্করিণী 
তাঁর ছোট বেলায় তিনি এইসব দিনগুলোতে  প্রায় এক-দেড় হাজার লোককে এখানে আসতে দেখেছেন। বর্তমানে একশো-দেড়শোর মত লোক আসে। তিনি বললেন ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে চীনা নববর্ষের সময়  এখানে মেলা বসে।  সেই সময় এখানে বেশ ঘটা করে কালী পুজো করা  হয়ে থাকে। সেইদিনও এখানে  প্রচুর চীনা পরিবারের সমাগম হয়। তিনি আমাদের ওই সময় একবার এখানে আসতে বললেন।  তিনি এও বললেন ওই সময় আসলে আসল আছিপুরকে দেখতে পাওয়া যাবে।

তিনি আমাদের দক্ষিণরায়ের মন্দির ও গঙ্গার পাড়ে  টং আছির সমাধিস্থলটি দেখে আসতে বললেন। কিন্তু প্রথম থেকেই ভাগ্য আমাদের সহায়তা করছিল না। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। এখন আকাশ কালো করে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হলো। আমদের  বাধ্য হয়েই ওখান থেকে ফিরে  আসতে হল। পরে আবার একবার আসবো বলে মনে মনে ভেবে রাখলাম। ঝড়-বৃষ্টি একটু কমতেই আমরা স্টেশনের পথ ধরলাম।

আছিপুর দেখে অটো করে বজবজ স্টেশনে নেমে একটু হেঁটে চলে আসুন বজবজ ফেরি ঘাটে। এই সেই ঘাট যেখানে ১৮৯৭ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগো থেকে এসে নেমেছিলেন। এই ঘাটের ধারে  একটা সুন্দর কালী মন্দির আছে।  ওই মন্দিরটি অবশ্যই দেখে নেবেন। ঘাটের কাছেই একটা বিখ্যাত  শহীদ স্তম্ভও আছে।  স্তম্ভটিকে  "কমাগাতামারু শহীদ স্তম্ভ"  বলা হয়।   এটা একটা ঐতিহাসিক স্তম্ভ। এই স্তম্ভের  ইতিহাসটা পরে কোনো এক সময় বলা যাবে। বর্তমানে বজবজ স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে "কোমাগাথামারু" স্টেশন করা হয়েছে।

আছিপুর গ্রামটি আজও বেঁচে আছে টং আছির স্মৃতিকে বুকে নিয়ে। পশ্চিমবাংলার  বুকে প্রথম চীনাদের না হওয়া এক উপনিবেশের গল্পে। বেঁচে আছে আজও ভারতের চায়না টাউনের  সেই  স্থপতির কাহিনীতে।



কিভাবে যাবেন : শিয়ালদহ  স্টেশন থেকে প্রতিঘন্টায় একটা করে বজবজ  লোকাল ছাড়ে।ওই ট্রেনে করে বজবজ স্টেশনে এসে নামুন। স্টেশনের বাইরে থেকে অটো রিক্সা পাওয়া যাবে। ওই অটো করে  খুব সহজেই  আছিপুর পৌঁছানো যায়। ট্রেনে এক ঘন্টার মতো সময় লাগবে আর অটোতে মিনিট কুড়ি সময় লাগবে।



তারিখ : ২০-০৩-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Friday, March 15, 2019

বসন্তউৎসবে শান্তিনিকেতন ভ্রমণ Basanta Utsab Santiniketan >


 শান্তিনিকেতনের  বসন্তউৎসব

লোকে লোকারণ্য উৎসব মাঠ 
শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে প্রকৃতি যখন নতুনরূপে তার  সৌন্দর্য বিস্তার করে । তখন গাছে গাছে নতুন পাতা ও ফুলে ভরে উঠতে দেখা যায়। পলাশ-শিমুল গাছও  তাদের ডালে ডালে রঙিন ফুলে ভরিয়ে তোলে। কোকিলের কুহু কুহু ডাকে শহর-গ্রাম সরগরম হয়ে ওঠে।  মানুষ তখন ঋতুরাজ বসন্তকে আহ্বান জানাতে প্রস্তুত হয়।  ফাল্গুন মাস হলো বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এগারোতম মাস আর বসন্ত কাল হলো ঋতুচক্রের শেষ ঋতু। নতুন করে জেগে ওঠে নতুন আনন্দ, নতুন আশায় রঙিন হয়ে ওঠে মন। শীতের শীতল রুক্ষতা ভেঙে প্রকৃতিও রঙিন হয়ে ওঠে। ফাগুনের হাত ধরেই প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন ঘটে। বসন্তের প্রধান উৎসবই  হল দোল উৎসব।
নৃত্যরত 
কবিগুরুর ভাষায় যা বসন্ত উৎসব। বসন্ত উৎসব মানে ফাগের রঙে রঙিন হয়ে ওঠা, বসন্ত উৎসব মানে শান্তিনিকেতনের আকাশে , বাতাসে আনন্দের হিল্লোল তোলা ।
আশ্রমিক কন্যারা 

দোলযাত্রা প্রধানত হিন্দু-বৈষ্ণবদের উৎসব বলেই খ্যাত।  সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই নানারকম পৌরাণিক উপাখ্যানে এই উৎসবের কথা বলা আছে। এই দোলপূর্ণিমার দিনেই উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও অন্যান্য গোপিনীদের সাথে রঙের খেলায় মেতে উঠেছিলেন। এই দোল পূর্ণিমার তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভু নদীয়া জেলার শান্তিপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শান্তিপুরবাসিনীরা তাই এই দোল পূর্ণিমাকে "গুরুপূর্ণিমা" বলে থাকে।  গ্রামে-গ্রামে, শহরে-শহরে আট থেকে আসি বছরের কেউ এই উৎসবে সামিল হতে বা  নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে বাদ যায় না।  



লাঠি নিয়ে নাচে ব্যস্ত আশ্রমিকরা 
ভারতের নানাপ্রান্তেই এই উৎসব বেশ ঘটা  করে পালিত হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকেই। বীরভূমের শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব ভারতের সবথেকে বড় ও প্রাণঢালা এক উৎসব বলে বিবেচিত হয়।  সেই কবে ১৯০৭ সাল নাগাদ কবিগুরুর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর দুই বন্ধু "ঋতুরঙ্গ" নামে  এক উৎসবের সূচনা করেছিলেন। তখন শান্তিনিকেতনের প্রাককুটীরের সামনে বেশ কয়েক বছর ধরে এই উৎসব উদযাপন করা হচ্ছিল।  তিনি তাঁর পিতার লেখা গান "এ কি লাবণ্য পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে" গানটি নিজের গলায় গেয়ে উৎসবটির সূচনা করেছিলেন। এই প্রাককুঠিরই বর্তমানে শমীন্দ্র পাঠাগারে পরিণত হয়েছে।  তাঁর অকাল মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত উৎসবটির প্রচলন করেন সম্ভবত ১৯১৫-১৬ সাল নাগাদ। সাধারণত আমারা  দোল বা হোলিকে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার অংশ বলেই জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই প্রথাকে ভেঙে  ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানালেন তাঁর মতো  করে। তিনি এই উপলক্ষ্যে লিখলেন "আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে" ও "আহা  আজি এ বসন্তে". দুটি গান।  
আদিবাসী পলাশের মালা বিক্রি করছে 

২০১৭ সালের দোলের দু-দিন আগের  রাতে ফোন করে আমার এক বন্ধু শ্রী সুদীপ্ত মিত্র ওর সাথে শান্তিনিকেতনে ছবি তুলতে  যেতে বলল। কিন্তু ও থাকার কোনো ব্যবস্থা করেনি বলে জানালো।  বহু আগে থেকে ব্যবস্থা না করলে ওখানে এইসময় থাকার জন্য কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না, এটা  আমার জানা ছিল।আমার এক দাদা শ্রী গৌতম  সরকারের  শান্তিনিকেতনের সীমান্তপল্লিতে  একটা বাড়ি আছে।  পরেরদিন সকালে তাঁকে ফোন করে জানতে চাইলাম ওনার বাড়িতে দুদিন থাকা যাবে কিনা?  আমরা যাচ্ছি শুনে উনিও আমাদের সাথে যেতে চাইলেন। সেইদিন দুপুরে ওনার কলকাতার বাড়িতে যখন আমরা পৌঁছলাম তখন ওনার
দর্শনার্থী 
ছেলে গৌরবও আমাদের সাথে যেতে চাইলো। যাইহোক, আমরা চারজনে ওনার গাড়ি করে দুপুর তিনটে  নাগাদ রওনা দিলাম, রাত  আটটার সময় আমরা শান্তিনিকেতনে  এসে পৌঁছলাম। মাঝে অবশ্য আমরা শক্তিগড়ে লাংচা ও চা খেয়ে নিয়েছিলাম। ওনার বাড়িতে পৌঁছনোর পর কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেতে আমরা বেরোলাম। একটু বেশি রাত  হয়ে গিয়েছিল বলে বেশিরভাগ দোকানই  বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।  একটা ছোট খাবার হোটেল খোলা পেলাম।  ওখানে বসে গরম গরম আলুর পরোটা ও তরকারি খেয়ে নিলাম। খেয়ে এসে আমরা কিছুক্ষন গল্প করে শুয়ে পড়লাম।

পরেরদিন সকাল ৬টার সময় ঘুম থেকে উঠে ৭ টার মধ্যে তৈরী হয়ে হাতিপুকুর দিয়ে হেঁটে আশ্রম মাঠে এসে পৌঁছলাম।  এতো সকালেই মাঠটাতে ভীড়ে ভীড়াক্কার। কিছুক্ষন পর আমি, গৌতামদা  ও গৌরব একটু চা খাবার উদ্দেশ্যে মাঠের বাইরে বেরোলাম। লোকের ভীড়  আমাদের ঠেলতে ঠেলতে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে এসে ফেলল।  এই ভীড়ের ধাক্কায়  আমাদের চা খাওয়ার ইচ্ছে তখন হারিয়ে গেছে। আমরা আর এই ভীড় ঠেলে আশ্রম মাঠে ফিরে আসতেই পারলাম না।  আমার বন্ধু সুদীপ্ত আশ্রম মাঠেই  রয়ে গেলো। তার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কারোরই মুঠিফোন কাজ করছিলো না তখন।  আমরা কালোবাড়ি অঞ্চলেই ঘুরে ঘুরে  ঘন্টা চারেক সময় কাটালাম।
নৃত্যে ব্যস্ত আশ্রমিকরা 

এখানে দেখছিলাম অনেকগুলো জায়গাতেই বেশ কয়েকজন একসাথে নাচে-গানে মেতে উঠেছে। বেশ কিছু বিদেশী আশ্রমিকও দেশী আশ্রমিকদের সাথে সমানভাবে অংশ নিচ্ছে। এইসব অনুষ্ঠানগুলো আমরা বেশ উপভোগ করছিলাম।  মূল উৎসব মাঠের অবস্থাটাও এখান থেকে কিছুটা দেখা যাচ্ছিল। যদিও অনেক দূর থেকে আমরা দেখছিলাম তাই সবটা দেখা সম্ভবও হচ্ছিল না।  অনুষ্ঠান মঞ্চটা এখান  থেকে একদমই  দেখা যাচ্ছিল না।  শুধু লোকের মাথা ছাড়া বেশি কিছু দেখার কোনো উপায় ছিল না।  এখানকার পুলিশ বেশ সতর্কভাবেই উৎসব মাঠটিকে ও সমগ্র শান্তিনিকেতনকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। মাঠের চারদিকে চারটি ওয়াচ টাওয়ার তৈরী করা হয়েছে। এইসব টাওয়ারগুলি থেকে কয়েকজন করে পুলিশ  সারা মাঠটিকে লক্ষ্য রাখছে। মাঠের
মধ্যে আকাশে ড্রোন ক্যামেরা চক্কর কাটছে।  পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য বাসন্তী রঙের  টুপি পরা  কয়েকশো বিশ্বভারতীর নিজস্ব সেচ্চাসেবকও রয়েছে দেখলাম। বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই উৎসবটি চলছিল। এরকম সুশৃঙ্খলভাবে কলকাতায়  দোল উৎসব আমি কোনো দিন হতে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। বসন্ত উৎসব ও দোল বা হোলি উৎসবের তফাৎটা এখানে আসার পরই আমি ঠিকমত  বুঝতে পারলাম।  কলকাতার মতো এখানে কারোকে কোনো বেলেল্লাপনা বা অশালীন  আচরণ করতে দেখলাম না। কত সুশৃঙ্খলভাবে এখানে সমগ্র  অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করা হচ্ছিল, এখানে না আসলে সেটা  বোঝা যায় না। তার জন্য এখানকার প্রশাসনের বিশেষ পুরস্কার পাওয়া উচিত। পর্যটক বা আশ্রমিক সবাই নিজেরা নিজেদের মত করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মেতে আছে। আশ্রমিক মেয়েরা বেশিরভাগই দেখলাম বাসন্তী রঙের শাড়ি আর ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে উৎসবটিতে সামিল হয়েছে।আদিবাসীদের তৈরী  করা পলাশ ফুলে গাঁথা মালা গলায় পরে, মাথায় গোঁজা লাল-হলুদ পলাশফুল। সুন্দর সাজে সজ্জিত হয়ে এখানকার আশ্রমিক মেয়েদের রূপ যেন দ্বিগুনভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এরকম সুন্দর পোশাক আর তার সাথে রঙিন ফাগের রঙে নিজেদের সাজিয়ে তারা এক মনমুগ্ধকর পরিবেশ উপহার দিচ্ছিল দর্শনার্থীদের। বেশিরভাগ পর্যটকরাই রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনকে ভালোবেসে কত দূর দূর থেকে এই উৎসবে সামিল হতে আসে। কবিগুরুর "গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ " এই দিন যেন আরো রাঙিয়ে উঠে।

দইওয়ালা 
অনেক ঘোরাঘুরি করার পর আমরা একটা বড় গাছের তলায় বিশ্রাম করার জন্য বসেছিলাম, সেই সময় দেখলাম কাঁধে বাঁক নিয়ে একজন মধ্যবয়সী "দই চাই, দই লাগবে নাকি" বলে  ঘুরে ঘুরে দই বিক্রি করছে।  এই দৃশ্য দেখে আমায় কবিগুরুর সেই বিখ্যাত "অমল ও দইওয়ালা" কাহিনীটা মনে করিয়ে দিল। আমরা এক ভার  করে দই কিনে  খেলাম, গরমে একটু শান্তি পেলাম।

বাচ্চা  শিব 
একজন বাচ্চাকে দেখলাম  শিব সেজে দুটো পয়সা রোজগারের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে।  এই দৃশ্যটা  দেখে আমার খুব খারাপ   লাগছিল।  ভাবছিলাম যখন সবাই এখানে রঙের খেলায় মেতে উঠেছে, তখন এইটুকু বাচ্চা ছেলেটা তাতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছেকে গোপন করে দুটো পয়সা রোজগারের জন্য ঘুড়ে  বেড়াচ্ছে। তার এই রোজগারে হয়তো পরিবারের অন্নসংস্থান হচ্ছে, পরিবারের দীনতা কিছুটা হলেও হয়তো ঘুচছে, হয়তো তার কোন ছোট ভাই বা বোনের পড়াশুনার খরচা  ওই  যোগাচ্ছে। এই আনন্দের মধ্যেও মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।  তাকে ডেকে আমি ১০০ টাকা আর গৌতাম্দা ১০০ টাকা দিলাম। এই টাকাটা পায়ে সে বেশ খুশি হয়ে চলে গেল।

এখানে সারাদিনই নানা জায়গায় নানা অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যেবেলাতে শান্তিনিকেতনের বেশ  কয়েক  জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গান ও নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও আবার রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যও পরিবেশন করা হয়।

এখানকার এক অধ্যাপকের সাথে আলাপচারিতায় জানলাম কবিগুরু ১৯৪০ সালে অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর আগের বছর শেষবার শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪১ সালে তাঁর অসুস্থতার কারণে তিনি এখানে আসতে পারেননি।
কালো বাড়ির সামনে আমি ও গৌতমদা 

এখানে নাচের তালে তালে, গানের সুরে সুরে  যেন আকাশে ওড়ে ফাগুয়ার রং। রঙিন মনে তখন শুধুই আনন্দের ফোয়ারা ওঠে। সবমিলিয়ে শান্তিনিকেতনের দোল দেখার জন্য বাঙালি কেন বারে বারে এখানে ছুটে আসে তা এই দিনে এখানে না আসলে বুঝতে পারতাম না। তাই দেশী পর্যটকদের সাথে বহু  বিদেশী পর্যটক কত সুদূর পথ পেড়িয়ে এখানে আসেন। তারা উপভোগ করে যান কবিগুরুর বসন্তউৎসবের মেজাজটাকে। মনে খুশীর হিল্লোল, আনন্দের প্রাপ্তি যেন ফুটে উঠছে সকল আশ্রমিক ও পর্যটদের মুখে। এ যেন এক বসন্তের পরম পাওনা, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই ডিজিটাল যুগেও এখানে  রবীন্দ্র অনুরাগী মানুষজন তা সে এখানকার আশ্রমিক ছাত্র-ছাত্রী হোক  বা অধ্যাপক হোক,  একবারের জন্য কেউ রবীন্দ্রনাথের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন  না। এখানে  বসন্ত উৎসব তাই আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এই উৎসব যেন এক ভালোবাসার পরশ ও উপলব্ধির মেলবন্ধন। বর্তমানে এই ধরণের মেলবন্ধনের  উৎসব খুব প্রাসঙ্গিক বলে আমার মনে হয়।  

কিভাবে যাবেন : 
হাওড়া স্টেশন থেকে গণদেবতা, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ও আরো অনেকগুলো ট্রেন রয়েছে।  শিয়ালদহ স্টেশন থেকেও মাতারা এক্সপ্রেস ও আরো কয়েকটি ট্রেন রয়েছে।  এইসব ট্রেনে করে বোলপুর স্টেশনে এসে নামুন।  সময় মোটামুটি ঘন্টা তিনেকের মতো লাগবে। বোলপুর স্টেশন থেকে অটো বা রিক্সা করে আশ্রম মাঠে আসুন।

কোথায় থাকবেন :
বোলপুর, শান্তিনিকেতনে অনেকগুলো বেসরকারি লজ রয়েছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের একটা সুন্দর অতিথি নিবাস রয়েছে।  এইসব লজ  বা অতিথি নিবাসে এইসময় এসে থাকতে চাইলে অন্তত তিন-চার মাস আগে থেকে বুকিং করতে হবে।  



তারিখ : ১৫-০৩-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Friday, March 8, 2019

রত্নাবলী রায় Ratnabali Roy>

রত্নাবলী রায়

আজ ৮ই মার্চ। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্বের  নারীরা আজকের দিনটা গত  ৪৫ বছর ধরে  তাদের দিন হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিনটি উদযাপনের পিছনে বহু নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের  সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে।  জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে দিনটি ঘোষণা করেছিল। 

সেই প্রাচীনকাল থেকেই গোয়ালিয়রের মহারানী অহল্যাবাঈ বা অন্যান্য মহারানীরা  সামাজিক উন্নতিকল্পে বহু অর্থ ব্যয় করেছিলেন। ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিটিশ বিরোধী সিপাহী বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজত্বকালে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি সমাজ সংস্কারক নারী জাতির উন্নয়নের জন্য লড়াই করেছিলেন। আজ রাজনীতি, খেলাধুলা, শিক্ষা, ব্যবসা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতের নারীরা পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করছেন। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।  প্রতিটি গ্রামে বা শহরে মহাসমারোহে এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আজ আমি এক অসামান্যা  নারীর কথা বলব, যিনি সামনে থেকে প্রায় তিরিশ  বছর ধরে মানসিক রোগীদের উন্নয়নের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। ২০০৪ সালে  বিশিষ্ঠ মানসিক চিকিৎসক স্বর্গীয় ডাক্তার কে. এল. নারায়ণন আমায় প্রথম রত্নাদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কাজের সূত্রে আমি বহুবার ওনার কাঁকুলিয়ার বাড়িতে গিয়েছি। সেই সব সময় আমি সামনে থেকে তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও মানসিক রোগীদের নিয়ে তাঁর  উদবিঘ্নের কথা জেনেছিলাম। 

রত্নাবলী রায়, এমনি এক নারী যিনি হাজার হাজার মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মুখ বুজে কাজ করে চলেছেন আজ প্রায় দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে।  এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি হিউমেন রাইটস ওয়াচ নামে  এক বিদেশী সংগঠন থেকে ২০১৬ সালে "আলিয়েন  ডেজ ফোর্জেস" পুরস্কারে পুরস্কৃত হন।  এই কাজের  জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি যেমন সম্মানিত হয়েছেন, তেমন অসম্মান, বৈষম্য   হুমকিরও সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে।  

কলকাতার এক শিক্ষিত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  ছোটবেলা থেকেই তার পরিবারকে সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে থাকতে তিনি  দেখে এসেছেন। মা-দিদিমাদের কাছে আসা বিশিষ্ঠ সমাজকর্মীদের সংস্পর্শে তিনি বহুবার এসেছিলেন।  

ছোটবেলা থেকেই তিনি যথেষ্ট ডানপিটে ছিলেন। তাঁর ছোটবেলা যে বাড়িতে কেটেছে, সেই বাড়ির চারপাশে বস্তি অঞ্চল ছিল।  পড়াশুনার সাথে  তিনি সেই বস্তির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে গুলি খেলা ও নানারকম খেলাধুলা করে কাটাতেন। সেই সময় ওই অঞ্চলে জলের  খুব অভাব ছিল, তাই কর্পোরেশনের গাড়ি এসে জল দিত অঞ্চলবাসীদের। তিনি ও তাঁর  বন্ধুরা সেই জল বালতি করে নিয়ে আসতেন। একবার এইসব ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একটা অঙ্কন প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও  করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রদর্শনী দেখতে মাত্র একজন দর্শক  এসেছিলেন। তাঁর বাবা - মা বা বাড়ির বড়রা কেউ তাঁর দস্যিপনায় কখনো বাঁধা দেয়নি।  তাই তিনি খুব স্বাধীনভাবেই বড় হয়েছেন।   

এইভাবে আনন্দে-উল্লাসের মধ্য দিয়েই সাউথ পয়েন্ট স্কুলে তাঁর স্কুলজীবন কেটেছিল। তিনি কলকাতার বিখ্যাত গোখেল কলেজে মনস্তত্ব নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। তারপর মনস্তত্ব নিয়ে রাজাবাজার সায়েন্স  কলেজ থেকে  স্নাতকোত্তর পাশ করেন। এরপর তিনি হাভার্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ শিক্ষা নিয়ে আসেন। 

ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে এসেছেন তাঁর দুই পিসিকে, যাঁরা  মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না।  পিসিদের দেখেই তিনি এই বিষয় পড়ার সিদ্ধান্ত নেন।  এই বিষয়ের বইয়ের পাতায় তিনি যত ঢুকেছেন, তত  তাঁর  পিসিদের কথা মনে পড়ত।     

পড়াশুনা শেষ করার পর প্রথমে কলকাতার এক বিখ্যাত হাসপাতালের মানসিক বিভাগে যোগ দেন।  সেই হাসপাতালের উর্দ্ধতন কর্মীরা তাঁর পূর্ব পরিচয় অর্থাৎ তাঁর পিসিদের কথা জানার পর থেকে তাঁকে নানারকম ব্যঙ্গতিতে অতিষ্ঠ করতেন। কেউ বলতেন "আমেরিকান স্পাই", কেউ বলতেন "ফ্রুট এন্ড নাট" বা কেউ বলতেন "হাইপোমোনিক"। এখানে এত অপমান তাঁর সহ্যের  সীমা  ছাড়িয়ে গিয়েছিল।  তিনি একদিন চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি হয়তো অধ্যাপনা বা কোনো চেম্বার খুলে বসতে পারতেন। কিন্তু তিনি বরাবরই খুব স্বাধীনচেতা, তাই তিনি ঐসব সুখের জীবনে পা না বাড়িয়ে এক অসামান্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে মানসিক প্রতিবন্ধীদের  নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য এগিয়ে গেলেন। 

তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে চলেছেন।  ২০০০ সালে তিনি "অঞ্জলি" নামে  এক সংস্থা  তৈরী করেন।  এই সংস্থা সরকারি মানসিক হাসপাতালগুলিতে যেসব মানসিক রুগী ভর্তি রয়েছেন, তাদের নানারকম কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়।  এছাড়া মনোসামাজিক অক্ষমতায় আক্রান্ত নারী ও তাদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মুখ্য অংশীদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এই সংস্থা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্যাভলভ মেন্টাল হাসপাতাল, লুম্বিনীপার্ক মেন্টাল হাসপাতাল ও বহরমপুর মেন্টাল হাসপাতাল এই তিনটি সরকারি হাসপাতালকে নিয়ে কাজ করছে। এইসব হাসপাতালের রুগীরা যারা প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে, তারা যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে তার জন্য সবসময়ই এরা সচেষ্ট থাকে। 

তিনি বলেছেন "মনোসামাজিক অক্ষমতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই অপমানিত হন এবং নীরব থাকতে বাধ্য হন, কিন্তু আমি তা অস্বীকার করি। আমার কাজ হল মানুষজনকে তাদের মানবিকতা পুনরুদ্ধার  করতে সহাযতা করা"। যারা  নানাভাবে সামাজিক বলি হয়েছেন, তাদের নিয়ে ও সামাজিক  উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে  টেলিভিশনের পর্দায় "ভালো আছি, ভালো থেকো" বলে একটা অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন।


তারিখ : ০৮-০৩-২০১৯

 লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
 আমার এই লেখাটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Thursday, March 7, 2019

কলকাতার বিনোদন পার্ক Kolkata Park

কলকাতার বিনোদন পার্ক 

কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, পূর্বে ভারতের রাজধানী ছিল। তিনশো  বছরের ইতিহাসে  সমৃদ্ধ একটা শহর। এই শহরের  অলিতে গলিতে ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আমাদের এই শহর কারো কাছে  আনন্দনগরী বা  "সিটি অফ জয়"  আবার কারো কাছে আবর্জনায় ভরা এক নোংরা শহর।  এখানকার জনজীবন কখনোই স্তব্ধ থাকে না।  সারাবছরই মেলা, ধর্ণা, মিছিল-মিটিং চলতেই থাকে। হই-হট্টগোলের মাঝেও কিছুটা সময় একান্তে কাটানোর জন্য এখানে নিত্য-নতুন বিনোদন পার্ক গড়ে উঠছে। এইসব পার্কে গিয়ে আপনি আপনার পরিবারকে নিয়ে কিছুটা সময় আনন্দে  কাটাতে পারেন। আপনার ক্লান্ত শরীরটাকে কিছুটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশে বসে , শীতল বাতাসে ক্লান্তিমুক্ত করতে পারেন। এখানে আজ আমি এরকম কিছু পার্কের কথা লিখব। যে পার্কগুলো শহরবাসীর কাছে এক একটা অমূল্য পাওনা। 

কলকাতা ময়দান 
ময়দান বা গড়ের মাঠ  কলকাতার কেন্দ্রস্থলে বিরাট জায়গা নিয়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠটা রয়েছে। এটাকে শহর কলকাতার ফুসফুস বলা হয়। পৃথিবীর কোনো শহরের কেন্দ্রস্থলে এরকম সবুজে ঢাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল দেখাযায় না।   পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭৭ সালে গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণের পর তার আশ-পাশের সব জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে।  এই জঙ্গল কাটার ফলেই একটা বিস্তীর্ন খালি জায়গা বেরিয়ে আসে।   সেই খালি  জায়গাটিই কলকাতা ময়দান। ময়দানটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে রয়েছে। তৃনাচ্ছাদিত ময়দানে প্রচুর বড়  গাছ-গাছালি রয়েছে। এখানে গেলেই দেখা যায় বহু ছেলে  ফুটবল বা ক্রিকেট খেলছে। ময়দানটির উত্তরদিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসস্থানটি অবস্থিত। এই বাসস্থানের পিছনদিকে পৃথিবীর বৃহৎ ক্রিকেট স্টেডিয়াম "ইডেন গার্ডেন্স" রয়েছে। ময়দানে  অনেকগুলো ছোট বড় ক্রীড়া সংস্থার বাংলো রয়েছে। বেশ কয়েকটি বড় ক্রীড়া সংস্থার  নিজস্ব গ্যালারি দিয়ে ঘেরা মাঠও তাদের বাংলোর সাথে রয়েছে । প্রতিদিন সকালে প্রচুর বয়স্ক লোকেরা এখানে প্রাতঃভ্রমণ করে 

ঠিকানা :
জওহরলাল নেহেরু রোড 
কলকাতা 


মোহরকুঞ্জ
২০০৫ সালে কলকাতা পৌর সংস্থা এই উদ্দ্যানটি তৈরী করে।  উদ্দ্যানটি রবীন্দ্র সদনের ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত।  পূর্বে এই উদ্দ্যানটির নাম ছিল "সিটিজেন পার্ক"। প্রথিতযশা  শিল্পী শ্ৰীমতী  কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর  ২০০৭ সালে পার্কটি তাঁর নামে উৎসর্গিত করা হয়।  তাঁর আসল নাম ছিল "অনিমা" আর  ডাক নামছিল "মোহর"। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন স্বনামধন্য রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও শিক্ষিকা।  ১৯৩৫ সালে  রবীন্দ্রনাথ তাঁর "অনিমা" নামটি পরিবর্তন করে "কণিকা" নাম রাখেন।  এই পার্কটি তৈরী করতে ৬৪ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। পার্কটি নানারকম ফুলে সজ্জিত। বিভিন্ন জায়গায় বসার জন্য ব্যবস্থা আছে।  এছাড়া একটা মুক্ত মঞ্চ আছে। এই মুক্ত মঞ্চে সারা বছর নানারকম  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। পার্কটি সকাল ৫টা থেকে ৯টা আর দুপুর ৩টা থেকে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। পার্কটিতে ঢোকার জন্য কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না।   

ঠিকানা :
ক্যাথিড্রাল রোড , রেস কোর্স 
কলকাতা - ৭০০ ০২২

নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বর 
এই চত্বরটি মোহরকুঞ্জের ঠিক সামনে অবস্থিত। এই স্থানটিকে বা অঞ্চলটিকে  কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। অঞ্চলটির মধ্যে ভারতবর্ষের প্রধান চারটি   সাংস্কৃতিক কেন্দ্র  রয়েছে। একদিকে রবীন্দ্র সদন, আর এক দিকে নন্দন নামে  চলচ্চিত্রের দুটি প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। এছাড়া শিশির মঞ্চ বলে একটা নাটকের প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। শিশির মঞ্চের ঠিক সামনে দুটি তলা নিয়ে  দুটি আর্ট এক্সজিবিশনের হলও  রয়েছে। চত্বরটির পিছনদিকে একাডেমি অফ ফাইন আর্টস নাম একটা গ্যালারি ও সাথে একটা নাটকের মঞ্চও রয়েছে। এইসব মঞ্চ ও গ্যালারিগুলোতে প্রতিদিন নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এছাড়া বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গায প্রচুর বড় বড় গাছের সমারোহ আছে।  এরকম গাছের ফাঁকে আর একটা মুক্ত মঞ্চও রয়েছে।এখানে গেলে দেখা যায় গাছের তলায় বসে বাচ্চা-বড় সবাই আড্ডায় ব্যস্ত আছে। এই আড্ডাস্থলটি যুবক-যুবতীদের প্রাণের জায়গা।


ঠিকানা :  
১/১ এ জে সি বসে রোড 
কলকাতা - ৭০০ ০২০


মনোহর দাস   তরাগ 
বনবীথিই হল পূর্বতন মনোহর দাস তরাগ। এটি  কলকাতা ময়দানের দক্ষিণদিকে অবস্থিত। এটা একটি বহু পুরোনো জলাশয়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই জলাশয়টিকে নতুনভাবে সংস্কার, সংরক্ষণ ও সৌন্দযায়ন করা হয়েছে। জলাশয়টির চারপাশে বাঁধানো বেশ সুন্দর  রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। জলাশয়টির চারদিকের পাড়গুলোকেও সুন্দর করে বাঁধানো হয়েছে। লোহার ফেন্সিং দিয়ে জলাশয়টিকে ঘেরা হয়েছে। আলোক সজ্জার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এখানে প্রবেশ করার জন্য কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না। 

ঠিকানা :
জওহরলাল রোড 
কলকাতা 



আলিপুর চিড়িয়াখানা  
ভারতের   মোটামুটি  বড়   বড়  শহরেই   একটা   করে চিড়িয়াখানা  বা   পশুশালা   রয়েছে।  তাদের   মধ্যে   কলকাতার     চিড়িয়াখানা সবচেয়ে  প্রাচীন  ও  অন্যতম। এই   পশুশালাটি  কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানগুলির   মধ্যে   সবচেয়ে জনপ্রিয়  স্থান।  চিড়িয়াখানাটি  ১৮৭০ সালে  তৈরী করা  হয়। ১৮৭৬ সালের  ১লা  জানুয়ারি   প্রিন্স  অফ  ওয়েলস    সপ্তম  এডওয়ার্ড  এই   চিড়িযাখাটির  উদ্বোধন করেন।  এখানে  নানান    প্রজাতির  জীবজন্তু   রয়েছে। বেশ  কিছু   বিরল প্রজাতির পাখিও আছে। "সাদা বাঘ" এখানকার  সবচেয়ে  আকর্ষণীয়।  শীতের  সময়  পশুপ্রেমী  বা উৎসবপ্রেমী বাঙালি  চিড়িয়াখানাতে ভিড় করবেই।   আজকের  এনিম্যাল  প্ল্যানেট  বা    জিওগ্রাফি  চ্যানেলের  যুগেও   কলকাতার  চিড়িয়াখানায় জীবন্ত জন্তু  দেখার  অভিজ্ঞতা  শিশু  -কিশোর - বৃদ্ধ  কেউ  হাতছাড়া  করতে  চায়    না।  প্রতি  বৃহস্পতিবার   পশুশালাটি  পূর্ণদিবস  বন্ধ  থাকে।  সকাল  ৯টা  থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এটি  খোলা থাকে। প্রবেশ  মূল্য লাগে ৫ বছরের উর্ধে ২৫ টাকা আর   ৫ বছরের নিম্নে  ১০ টাকা।   

ঠিকানা :
২ আলিপুর রোড 
কলকাতা ৭০০ ০২৭

মিলেনিয়াম পার্ক 
গত  শতাব্দীর শেষ সময়  এই পার্কটি  গঙ্গার পূর্ব তীরে তৈরী করা হয়।  খ্রিষ্ট  বছর গণনার হিসেবে 
দ্বিতীয়   সহশ্রাব্দকে  স্মরণীয় করে রাখার জন্যই  পশ্চিমবঙ্গ সরকার  পার্কটি তৈরী করে। ১৯৯৯ সলের  ২৬শে   ডিসেম্বর    সরকারিভাবে  পার্কটির উদ্বোধন করা  হয়।পার্কটির  মূল   প্রবেশ দ্বারটি   নির্মাণ  করে  দিয়েছে   টাটা   গোষ্ঠী।   মিলেনিয়াম পার্কের  তোরণটিকে  তাই   অনেকে    টাটা  গেটও  বলে    থাকে।   এখানে  মজাদার  কিছু    রাইড বাচ্ছাদের জন্য রয়েছে।  ছুটির  দিনে  অসংখ্য  শিশু  তাদের  অভিভাবকদের সাথে  মজা  নিতে এখানে আসে। পার্কটি  সকাল  এগারোটা  থেকে  রাত  আটটা  পর্যন্ত খোলা  থাকে।  এই  পার্ক থেকে গোধূলি বেলায় গঙ্গার বুকে সূর্যাস্ত দেখা একটা স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরী করে দেয়।  

ঠিকানা :
১২ স্ট্র্যান্ড রোড 
বাবদীবাগ , কলকাতা ৭০০ ০০১  

রবীন্দ্র সরোবর 
এটি  দক্ষিণ কলকাতায় অবস্থিত একটি কৃত্রিম জলাশয়। ১৯২০ সালে কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট
দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলের ১৯২ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে।  তখন এই জায়গাটা বেশ ঘন জঙ্গলে  ঢাকা  ছিল।   অঞ্চলটিকে  বসবাসযোগ্য করে তোলাই  তাদের উদ্দেশ্য ছিল। ঠিক এই সময়েই তারা এখানে একটা বৃহৎ হ্রদ খনন করেন। যা তখন ঢাকুরিয়া লেক বলে পরিচিত ছিল।১৯৫৮ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নামে এই হৃদটিকে নামাঙ্কিত করা হয়। হ্রদটিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে এখানে গড়ে উঠেছে শিশু উদ্দ্যান, খেলার মাঠ, বাগান। ২০০৩ সালে জাতীয় হ্রদ সংরক্ষণ প্রকল্পে এই হ্রদটি সংযুক্ত হয়।  হ্রদটির আয়তন ৭৩ একর আর বাকি অংশে প্রচুর গাছ-গাছালি রয়েছে। শীতকালে এই হ্রদে প্রচুর পরিযায়ী পাখীকে এখানে আসতে দেখা যায়। হ্রদটির উত্তর দিকে ১৯৫০ সালে ২৬০০০ আসন বিশিষ্ট একটা ফুটবল স্টেডিয়াম গড়ে তোলা হয়েছিল। এখানে রবীন্দ্রনাথের একটা পূর্ণবয়ব ভাস্কর্য রয়েছে। হ্রদটির দক্ষিণদিকে একটা জাপানি বৌদ্ধ  মন্দির আছে। হৃদটিতে বেশ কয়েকটি রোয়িং ও সুইমিং ক্লাব রয়েছে। হৃদটিতে একটা ঝুলন্ত সেতু ও একটা মসজিদও  রয়েছে। এখানেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের নামে নামাঙ্কিত একটা মুক্তমঞ্চ আছে। এই পার্কে ঢোকার জন্য কোনো প্রবেশ মূল্যের দরকার হয় না। পার্কটি ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে।     


ঠিকানা :
সাউদার্ন এভিনিউ 
কলকাতা - ৭০০ ০২৯

সুভাষ  সরোবর 
কলকাতার বুকে দক্ষিণের রবীন্দ্র সরোবর আর পূর্বের সুভাষ সরোবর যেন কলকাতার দুই হৃৎপিণ্ড। এই সরোবর দুটি শহরের কোলাহলের মধ্যে থেকেও স্নিগ্ধ বাতাস নেওয়ার আদর্শ জায়গা। সুভাষ সরোবরে আসলেই দেখা যায় প্রচুর গাছ-গাছালিতে ভরপুর। শোনা যায় পাখিদের কলতান। এ যেন হারিয়ে যাওয়ার এক ঠিকানা। এই সরোবরটি  সল্টলেকে স্টেডিয়ামের ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত। 

ঠিকানা :
সুভাষ সরোবর পার্ক ,
ফুলবাগান, বেলেঘাটা 
কলকাতা - ৭০০ ০১০

প্রকৃতি তীর্থ 
এই  পার্কটি  কলকাতার  নিউটাউন   শহরে  অবস্থিত   ৪৮০ একর  জায়গা  নিয়ে  তৈরী  পার্কটি  ভারতের   বৃহত্তম পার্ক। এছাড়াও  ১০৮  একর   জায়গা  নিয়ে  একটা   দ্বীপ  রয়েছে। পার্কটি   তিনটি   অংশে  বিভক্ত। এই  থিম    উদ্যানে   দুটো  জলাশয় ও তিরিশটি  বিনোদনমূলক   জায়গা  আছে।  ২০১২ সালের    ২৯ শে   ডিসেম্বর  পার্কটির    উদ্বোধন  করা    হয়।  পার্কটিতে   বিভিন্ন  রকমের  গাছ রয়েছে।  পার্কটি  কলকাতা আন্তর্জাতিক  বিমানবন্দর  থেকে  মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে  অবস্থিত।   পার্কটি    পরিচালনা   করে  পশ্চিমবঙ্গ    হাউসিং ইনফ্রাস্টাকচার   ডেভেলপমেন্ট    কর্পোরেশন   (হিটকো)   দেশ  বিদেশের  পর্যটকদের  কাছে  গ্রাম  বাংলার  রূপ তুলে ধরার     উদ্দ্যেশ্য নিয়েই এই  পার্কটি  তৈরী  করা  হয়েছিল ।  এখানে  নানারকম  বাগান, মাস্ক গার্ডেন, রেস্তোরা, কটেজ , ট্রয় ট্রেন, ব্লাটারফ্লাই গার্ডেন আছে।   এখানেই   তৈরী   করা  হয়েছে    "সাত আশ্চর্য"  এই  সাত  আশ্চর্য  হলো  পৃথিবীর   বিখ্যাত  সাতটি  ঐতিহাসিক  সৌধকে  বেছে   তাদের   প্রতিরূপ  দেওয়া  হয়েছে।   বিশাল  দীঘি,  সবুজে   মোরা এই  পার্কে  বুকভরে  স্নিগ্ধ   বাতাস নেওয়ার জন্য এখানে  আসতেই  পারেন  আপনারা। এই  পার্কটি  প্রতি সোমবার পূর্ণ  দিবস বন্ধ থাকে।  গ্রীষ্মকালে মঙ্গলবার থেকে শনিবার দুপুর ২.৩০ মিনিট থেকে রাত  ৮.৩০ আর রবিবার ও ছুটির দিন দুপুর ১২টা  থেকে  রাত্রি  ৯.৩০ পর্যন্ত খোলা  থাকে। শীতকালে  মঙ্গলবার থেকে শনিবার দুপুর ১২টা  থেকে রাত  ৮.৩০  পর্যন্ত  এবং  রবিবার  ও  ছুটির  দিনে  সকাল  ১১ টা  থেকে  রাত  ৭.৩০ পর্যন্ত  খোলা  থাকে। পার্কটিতে ঢুকতে গেলে ৩০ টাকা  প্রবেশ মূল্য দিয়ে ঢুকতে হবে।  

ঠিকানা :
মেজর আর্টেরিয়াল রোড (সাউথ-ওয়েস্ট)
অ্যাকশন এরিয়া ২, নিউটউন 
কলকাতা - ৭০০ ১৫৬

নিক্কো পার্ক 
এই পার্কটি ১৯৯১ সালে কলকাতার মানচিত্রে জুড়ে গেছে। কলকাতার এক শিল্পসংস্থা এটি তৈরী করেএটা এক অন্যতম জনপ্রিয় ও বৃহত্তম  চিত্তবিনোদনের উদ্যান  প্রায় ৪০ একর জায়গা নিয়ে পার্কটি তৈরী হয়েছে। এটাকে কলকাতার  ডিজনিল্যান্ডও  বলা হয়। যে কোনো বয়সের মানুষ এখানে  আসতে পারেন। এখানকার রাইডগুলি বেশ রোমাঞ্চকর। বাইরের খাওয়া নিয়ে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয়  না,  তবে ভেতরে সবরকম স্বাদের খাবারের  স্টল আছে।  এই  পার্কটি প্রতিদিন খোলা থাকে।  গ্রীষ্মকালে সকাল ১১টা  থেকে রাত  ৯টা  আর শীতকালে সকাল ১১টা  থেকে রাত  ৮টা  পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রবেশ মূল্য ১৫০ টাকা।  এছাড়া ভিতরের  বিভিন্ন পার্কে বিভিন্ন মূল্যের প্যাকেজ রয়েছে।  

ঠিকানা :
সল্টলেকে বাইপাস ঝিলমিল 
সেক্টর - ২, বিধাননগর 
কলকাতা - ৭০০ ১০৬

নলবন বোটিং কমপ্লেক্স 
যারা কোলাহল মুক্ত নির্জন জায়গা ভালোবাসেন তাদের জন্য এই জায়গাটি খুবই মনোরম লাগবে। এখানকার আকর্ষণের মধ্যে সম্পূর্ণ পায়ে চালানো হালকা ধরণের বোট ও শিকারা  উল্লেখযোগ্য।  

ঠিকানা :
এইচ এম ব্লক, নলবন ভেরি 
বিধাননগর , কলকাতা - ৭০০ ১০৬

স্বভূমি  
এটা একটা ঐতিহ্যপূর্ণ উদ্যান। এখানে এখনো ভারতীয় চারুকলাকে ধরে রেখেছে।  সল্টলেক স্টেডিয়ামের ঠিক উল্টোদিকে সুভাষ সরোবর তার কাছেই এই উদ্যানটির অবস্থান। এখানে কারুশিল্প গ্রাম, শহর অঞ্চল, খাদ্য উদ্যান ও মীনা বাজার আছে। এখানে পশ্চিমবঙ্গের সব ঐতিহ্যসম্পন্ন সম্ভারের স্টল আছে।  

ঠিকানা :
৮৯সি মৌলানা আবুল কালাম সরণি 
কাঁকুড়গাছি, কলকাতা - ৭০০০৫৪


সায়েন্স সিটি 
এটি একটি বিজ্ঞান সংগ্রহশালা ও বিজ্ঞানকেন্দ্রিক বিনোদন উদ্যান।  এই জায়গাটি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খুবই শিক্ষণীয় জায়গা। সব বয়সের মানুষের কাছেই এখানে অনেক কিছুই শিক্ষণীয় আছে। এমন শিক্ষণীয় ও বিনোদনের উপযুক্ত স্থান ভারতে  খুবই  কম আছে। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের ধারে অবস্থিত এই  বিজ্ঞান কেন্দ্রটি শিক্ষার সাথে বাড়ানোরও  উপযুক্ত একটা জায়গা।  এটির মধ্যে একটি রোপওয়ে, ছোট বড় দুটি  অডিটোরিয়াম ও ৮টি সেমিনার হল আছে। এখানে  স্পেস এক্সিবিউশন, ডায়নামোশেন, আর্থ এক্সপ্লোরেশন, মেরিটাইম সেন্টার ও সায়েন্স পার্ক রয়েছে। এসবের প্রতিটি বিভাগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিজ্ঞান চিত্র প্রদর্শনী, থ্রিডি প্রদর্শনী ও চলচ্চিত্র অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।  সায়েন্স সিটি প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানে প্রবেশ করতে গেলে ৪০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে ঢুকতে হবে। এছাড়া অভন্তরীন আকর্ষণগুলোর জন্য  আলাদা আলাদা প্রবেশ মূল্য লাগে।  

ঠিকানা :
জে বি এস হালডেনে এভিনিউ 
ইস্ট তপসিয়া,  কলকাতা - ৭০০ ০৪৬

মুদিয়ালী নেচার পার্ক 
এই পার্কটি তারাতলা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ও ব্রেসব্রিজ স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটেও যাওয়া যাওয়া যায়। ২০০৫ সালের ১০ই জুলাই পার্কটির উদ্বোধন করা হয়। বিশাল জায়গা নিয়ে পার্কটি তৈরী করা হয়েছে।পার্কটিতে বেশ কয়েকটা  বড় বড়  জলাশয় আছে।  নানারকম ফুল ও  বড় বড় গাছে পার্কটি একদম ভরপুর। " মুদিয়ালী ফিশারমেন্স কো -অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড" নামে এক সংস্থা বর্তমানে  উদ্দ্যানটির  দেখাশোনা করে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায়না ভিতরের এই সুবিশাল জায়গাটিকে মাত্র ২৫/- টাকার বিনিময়ে একবার ভিতরে ঢুকলেই বুঝতে পারবেন  এর বিশালতাটি 

ঠিকানা :
তারাতলা রোড 
পাহাড়পুর, গার্ডেনরিচ 
 কলকাতা - ৭০০ ০৮৮

হিমেল হাওয়ার পরশ গায়ে লাগলেই বোঝা যায়, শহরে শীত চলে এল। আর শহরে শীতের আগমন মানেই শহরের বিভিন্ন জায়গায় পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবীদের একটু  নিয়ে ঘুড়ে বেড়ানো। ঘুড়ে বেড়ানোর কথা মনে আসলেই শহরবাসী উপরিল্লিখিত বিনোদন পার্কগুলিতে ঘুড়তে চলে   আসে।  




তারিখ : ০৭-০৩-২০১৯
 লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।