এক অপরূপার হাতছানি
![]() |
পুরোনো দীঘা সৈকত |
আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে বীরকুল অঞ্চলের রাজা ছিলেন সাগর রায়। তাঁর বংশধররা প্রায় দুশো বছর এখানে রাজত্ব চালিয়েছিলেন। অতীতের এই বীরকুল গ্রামের সমুদ্র সৈকতই বর্তমানের দীঘার সমুদ্র সৈকত।
![]() |
দীঘার বুকে সূর্যোদয় |
১৭৫০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন। যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে ভারতবর্ষে পাঠানো হল। গভীর অধ্যাবসায় ও তাঁর কর্মের জন্য খুব তাড়াতাড়ি তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। লর্ড ক্লাইভ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপড়ত্তন করেছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর সংগঠনিক বৈশিষ্ঠতার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অনেক উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বাংলায় এসেই শাসন প্রণালীর সংস্কার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিতে মন দেন। ১৭৫৮ সালে তিনি মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট হন, ১৭৭৪ সালে তিনি বাংলার গভর্নর হয়েছিলেন।
বাংলার গরমে হেস্টিংস সাহেবের অবস্থা বেশ কাহিল হয়ে যেত। তিনি গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল করার জন্য সুন্দর, শীতল, নিরিবিলি একটা জায়গার সন্ধান করছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে ভাগীরথী নদীর মোহনা থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে একটা উপযুক্ত জায়গার সন্ধান তিনি পেলেন। সমুদ্রের ধারে বন -জঙ্গলে ঢাকা বেশ সুন্দর জায়গাটা। জায়গাটার নাম বীরকুল।
এখানকার সমুদ্রের ধারটা গ্রীষ্মকালে বেশ আরামদায়ক হবে বলেই মনে করলেন হেস্টিংস সাহেব। সমুদ্রের মাছ, জঙ্গলের পশু আর সাথে সমুদ্রের মনোরম হাওয়া সব মিলে জায়গাটা খুবই সুন্দর। এখানকার সৌন্দর্য্যে তিনি মুগ্ধ হয়ে বীরকুলের নাম দিলেন "ব্রাইটন অফ ক্যালকাটা"। এখানে তিনি একটা সুন্দর বাড়ি তৈরী করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাড়িটি দেখভালের অভাবে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় বলে শোনা যায়। ১৭৯৬ সাল নাগাদ আর এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী চার্লস চ্যাপম্যান এখানে আসেন। সেই সময় তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের তৈরী করা বাড়ীটা দেখতে পান নি বলে জানিয়েছিলেন। তারও এই জায়গাটা বেশ ভালো লেগে যায়। তিনি গ্রীষ্মকালে এখানে বেশ কিছুদিন কাটান। এরপর বেইলি নামে আর এক সাহেব ১৮৫২ সালে এই বীরকুলে আসেন। সমুদ্রের জলোচ্ছাস ও আশ-পাশের বন -জঙ্গল দেখে তিনিও মুগ্ধ হয়ে যান। এইভাবে চলতে চলতে বীরকুল একদিন দীঘা নামে পরিচিতি লাভ করে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। তিনি দীঘার উন্নয়নের জন্য হাত বাড়ান। তাঁর হাত ধরেই দীঘা আবার প্রচারের আলোয় চলে আসে। তিনি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দীঘাকে তুলে ধরলেন। রূপসী বাংলায় রূপের ডালি নিয়ে দীঘার যাত্রা শুরু হল। শুরু হলো এক অপরূপার হাতছানি দিয়ে পর্যটকদের ডাকা।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বন দপ্তরের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে বনসৃজন ও সৈকত সংরক্ষণের কাজ প্রথম শুরু করে। ১৯৫৫ সালে পাওয়ার
হাউস ও ক্যাফেটারিয়া তৈরী করা হয়। ১৯৫৬ সালে বন দপ্তরের কাছ থেকে উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দপ্তর দীঘার উন্নয়নের ভার নেয়। ১৯৫৮ সালে টুরিস্ট লজ, ১৯৬২ সালে বাজার, ১৯৬৪ সালে সৈকতাবাস, ১৯৭৭ সালে বাস স্ট্যান্ড তারা তৈরী করে। ভারতীয় রেল কয়েক বছর হল কলকাতা থেকে দীঘা যাওয়ার জন্য রেল চালু করে। এই রেলের জন্য দীঘা পৌঁছনো আরো সহজলভ্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রচুর হোটেল, রেস্তোরা, নানারকম দোকানপাট ও আলোকসজ্জায় দীঘা শহরটা ঝলমলে হয়ে উঠেছে।
সমুদ্রের জলোচ্ছাস, সুদীর্ঘ বালিয়াড়ি, বিস্তীর্ণ ঝাউবন নিয়ে দীঘার সৌন্দর্য যেন সত্যিই এক অপরূপার হাতছানি। প্রকৃতি প্রেমিক পযটকদের তীর্থক্ষেত্র। সাত আট কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রতটে সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে হাঁটা এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি মনে আনে । গভীর অন্ধকারের পর যখন পুব আকাশে রক্তিম আবির ছড়িয়ে দেয়, পূর্ব দিগন্ত থেকে সূর্যদেবের বিচ্ছুরিত ছটা সমগ্র সমুদ্রকে রঙিন করে তোলে, তখন সুন্দরী দীঘার উজ্জ্বলতা বেড়ে ওঠে। দীঘার সৌন্দর্যে সার্থক হয়ে ওঠে পর্যটকের চোখ। পর্যটকের মনও ভরে ওঠে দীঘা ভ্রমণের সার্থকতায়।
সমুদ্রের ধার দিয়ে পুরোনো দীঘা থেকে নতুন দীঘা যাওয়ার এক সুন্দর বাঁধানো রাস্তা দীঘার আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সমুদ্রের ধার বরাবর ঝাউগাছের ছড়াছড়ি। এই ঝাউবনে আসলেই তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানটির কথা বাঙালির মনে আসবেই। "চল রীনা , ক্যাসুরিনা, ছায়া গায়ে মেখে, কাঁকরের পথ দিয়ে একটু একটু করে হারিয়ে যাই, বল যাবে কিনা?" সত্যি ঝাউবনের ছায়ার তলায় আসলেই মন হারিয়ে যায়, সাথে কানে আসা সমুদ্রগর্জনের আওয়াজ সমুদ্রপ্রেমিককের জীবনে ষোলআনা পূর্ণতা লাভ করাবেই।
বর্তমান দীঘা শহরটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটা পুরোনো দীঘা আর একটা নতুন দীঘা। নতুন দিঘাটিকে পরবর্তীকালে তৈরী করা হয়েছে। দীঘা শহরে ঢোকার মুখেই একটা বিরাট প্রবেশদ্বার তৈরী করা হয়েছে। রাতের অন্ধোকারে আলোকসজ্জায় সাজানো প্রৱেশদ্বারটি বেশ সুন্দর দেখতে লাগে। পুরোনো দীঘা শহরটি একটু ঘিঞ্জি প্রকৃতির। এইখানেই সমুদ্রের ধারে বিশ্ববাংলা পার্ক তৈরী করা হয়েছে। এই পার্কের সামনে পর্যটকদের বসার জন্য প্রচুর চেয়ার পাতা রয়েছে। এই চেয়ারে বসে সমুদ্রের জলে পড়া জ্যোস্না রাতের চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব দেখতে খুব ভালো লাগে।
পুরোনো দীঘার কাছেই নতুন দীঘা শহরটি গড়ে তোলা হয়েছে। "দীঘা শংকরপুর উন্নয়ন পরিষদ " পরিকল্পিতভাবে এই শহরটিকে তৈরী করেছে। পুরোনো দীঘা থেকে এই নতুন দীঘা শহরটি বেশ নিরিবিলি। তবে দুই দীঘাতেই প্রচুর হোটেল ও রেস্তোরা গড়ে উঠেছে।
দ্রষ্টব্য স্থান :
অমরাবতী লেক - সমুদ্রের খুব কাছে নতুন দীঘাতে এই কৃত্রিম লেকটি তৈরী করা হয়েছে। লেকটির সাথে মরশুমি ফুলে সুন্দর করে সাজানো একটা বাগান আছে। লেকের জলে নৌকাবিহার করার ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের জন্য কয়েকটি খেলার ব্যবস্থাও রাখা আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ও পাখীদের মিষ্টি সুরেলা ডাকে জায়গাটা বেশ ভালো লাগলো।
রোপওয়ে - অমরাবতী পার্কের ভিতরেই একটা রোপওয়ে আছে। এই রোপওয়ে চড়ার জন্য টিকিট ঘরে দেখলাম অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। লাইন দিয়ে টিকিট কেটে রোপওয়েতে উঠে পড়লাম। রোপওয়ে চড়ার অভিজ্ঞতাটা আমার বেশ রোমাঞ্চকর লাগল।
দীঘা বিজ্ঞান কেন্দ্র - অমরাবতী পার্কের কাছেই এই বিজ্ঞান কেন্দ্রটি অবস্থিত। সমুদ্রের একঘেয়েমি কাটাতে হলে এখানে আসা উচিত। বিজ্ঞান-এর নানারকম জিনিস দিয়ে সাজানো এই বিজ্ঞান কেন্দ্রটি। এখানে থ্রিডি শোয়েরও ব্যবস্থা রয়েছে।
মেরিন একুরিয়াম - এটি পুরোনো দীঘাতে অবস্থিত। এশিয়ার সবচেয়ে বড় নির্মিত একুরিয়াম হল এটি। এখানে সমুদ্রের তলার নানারকম মাছ ও জন্তুদের জীবন যাত্রা দেখানো হয়। এখানে সমুদ্র নিয়ে নানারকম গবেষণা করাও হয়ে থাকে।
চন্দ্রোনেশ্বর মন্দির- পুরোনো দীঘা থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে এই মন্দিরটি অবস্থিত। ওড়িষ্যার বালেশ্বর জেলায় এটির অবস্থান। মন্দিরটি কলিঙ্গ স্থাপত্যে তৈরী। মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। এটি হল চন্দ্রোনেশ্বর অর্থাৎ শিবের মন্দির। প্রচুর পুণ্যার্থী এখানে ভিড় করেন। সামনের পুকুর থেকে মন্দির পর্যন্ত অনেক পুণ্যার্থীকে দন্ডী কাটতে দেখলাম। একজন পুরোহিত জানালেন এখানে দন্ডী কাটলে মনের বাসনা পূর্ণ হয়।
তালসারি সৈকত - এই সমুদ্র সৈকতটিও উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলায় অবস্থিত। পুরোনো দীঘা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই সৈকতটিও প্রাচীন ও দর্শনীয়। এখানেই সুবর্ণরেখা নদীটি সমুদ্রের সাথে মিশেছে। এটিও যথেষ্ট নির্জন, সুন্দর ও উপভোগ্য এক সৈকত। এখানেও বেশ কয়েকটি থাকার জন্য হোটেল রয়েছে।
মোহনা - মোহনা হল বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত একটা ছোট্ট গ্রাম। দীঘা থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে এই মোহনা গ্রামটি অবস্থিত। আমি গ্রাম বলছি বটে তবে এখানে কোনো লোকবসতি নেই। এই গ্রামে বসবাস করার জন্য কোনো বাড়ি ঘরও নেই। এখানে আসলে দেখা যায় দূরদূরান্ত থেকে শুধু মৎস্যজীবীদের ও মাছের ট্রলারের যাতায়াত করা। প্রত্যেকদিন সকাল বেলায় এখানে মাছের পাইকারি বাজার বসে। সমুদ্রের পাশেই এই বাজার। এখানেও একটা ছোট্ট সৈকত রয়েছে, তবে সৈকতটি ভীষণই নোংরা।
এছাড়া এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মন্দারমণি সৈকত, শংকরপুর সৈকত, তাজপুর সৈকত, জুনপুট সৈকত, বাঁকিপুর সৈকত ঘুরে আসা যায়।
৫০০ বছরের ইতিহাসের সরণি বেয়ে দীঘা আজ পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র। দীঘাকে ঘিরেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অর্থনীতি দ্রুত বিকাশ লাভ করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জেলার কর্মকর্তারা আরো নতুন নতুন সৈকতের সন্ধান করে চলেছে। ভ্রমণ পিপাসু বাঙালিরাও অপেক্ষা করে আছে এইসব নতুন সৈকতের জন্য।
কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে দীঘার দূরত্ব প্রায় ১৮৮ কিলোমিটার। কলকাতা বা হাওড়া থেকে এক ঘন্টা অন্তর দীঘা যাওয়ার জন্য সরকারি বাস ছাড়ে। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত এই বাস পাওয়া যায়। বর্তমানে অবশ্য কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকেও দীঘা যাওয়ার জন্য সরকারি বাস ছাড়ে। এছাড়া প্রতিদিন প্রচুর বেসরকারি বাসও কলকাতা-দীঘা যাতায়াত করে। বাসে কলকাতা থেকে দীঘা যেতে ঘন্টা পাঁচেক সময় লাগে। এছাড়া হাওড়া থেকে ট্রেনে করেও দীঘা যাওয়া যায়। ট্রেনে সময় একটু কম লাগে।
কোথায় থাকবেন : দীঘাতে সৈকতাবাস, পুরোনো টুরিস্ট লজ , নতুন টুরিস্ট লজ, নিরালা, আনন্দম প্রভৃতি সরকারি থাকার জায়গা রয়েছে। এই সরকারি লজগুলোকে কলকাতা থেকে অনেক আগেই বুক করতে হয়। বিভিন্ন ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনেক হলিডে হোম রয়েছে। এছাড়া পুরোনো দীঘা ও নতুন দীঘাতে প্রচুর বেসরকারি লজ রয়েছে।
![]() |
পুরোনো দীঘার সৈকত |
![]() |
সমুদ্রের ধারের রাস্তা |
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বন দপ্তরের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে বনসৃজন ও সৈকত সংরক্ষণের কাজ প্রথম শুরু করে। ১৯৫৫ সালে পাওয়ার
হাউস ও ক্যাফেটারিয়া তৈরী করা হয়। ১৯৫৬ সালে বন দপ্তরের কাছ থেকে উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দপ্তর দীঘার উন্নয়নের ভার নেয়। ১৯৫৮ সালে টুরিস্ট লজ, ১৯৬২ সালে বাজার, ১৯৬৪ সালে সৈকতাবাস, ১৯৭৭ সালে বাস স্ট্যান্ড তারা তৈরী করে। ভারতীয় রেল কয়েক বছর হল কলকাতা থেকে দীঘা যাওয়ার জন্য রেল চালু করে। এই রেলের জন্য দীঘা পৌঁছনো আরো সহজলভ্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রচুর হোটেল, রেস্তোরা, নানারকম দোকানপাট ও আলোকসজ্জায় দীঘা শহরটা ঝলমলে হয়ে উঠেছে।
![]() |
পুরোনো দীঘা |
সমুদ্রের জলোচ্ছাস, সুদীর্ঘ বালিয়াড়ি, বিস্তীর্ণ ঝাউবন নিয়ে দীঘার সৌন্দর্য যেন সত্যিই এক অপরূপার হাতছানি। প্রকৃতি প্রেমিক পযটকদের তীর্থক্ষেত্র। সাত আট কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রতটে সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে হাঁটা এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি মনে আনে । গভীর অন্ধকারের পর যখন পুব আকাশে রক্তিম আবির ছড়িয়ে দেয়, পূর্ব দিগন্ত থেকে সূর্যদেবের বিচ্ছুরিত ছটা সমগ্র সমুদ্রকে রঙিন করে তোলে, তখন সুন্দরী দীঘার উজ্জ্বলতা বেড়ে ওঠে। দীঘার সৌন্দর্যে সার্থক হয়ে ওঠে পর্যটকের চোখ। পর্যটকের মনও ভরে ওঠে দীঘা ভ্রমণের সার্থকতায়।
![]() |
মেঘাচ্ছন্ন দীঘার সৈকত |
সমুদ্রের ধার দিয়ে পুরোনো দীঘা থেকে নতুন দীঘা যাওয়ার এক সুন্দর বাঁধানো রাস্তা দীঘার আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সমুদ্রের ধার বরাবর ঝাউগাছের ছড়াছড়ি। এই ঝাউবনে আসলেই তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানটির কথা বাঙালির মনে আসবেই। "চল রীনা , ক্যাসুরিনা, ছায়া গায়ে মেখে, কাঁকরের পথ দিয়ে একটু একটু করে হারিয়ে যাই, বল যাবে কিনা?" সত্যি ঝাউবনের ছায়ার তলায় আসলেই মন হারিয়ে যায়, সাথে কানে আসা সমুদ্রগর্জনের আওয়াজ সমুদ্রপ্রেমিককের জীবনে ষোলআনা পূর্ণতা লাভ করাবেই।
![]() |
সূর্যোদয় ও ডাব বিক্রেতা |
বর্তমান দীঘা শহরটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটা পুরোনো দীঘা আর একটা নতুন দীঘা। নতুন দিঘাটিকে পরবর্তীকালে তৈরী করা হয়েছে। দীঘা শহরে ঢোকার মুখেই একটা বিরাট প্রবেশদ্বার তৈরী করা হয়েছে। রাতের অন্ধোকারে আলোকসজ্জায় সাজানো প্রৱেশদ্বারটি বেশ সুন্দর দেখতে লাগে। পুরোনো দীঘা শহরটি একটু ঘিঞ্জি প্রকৃতির। এইখানেই সমুদ্রের ধারে বিশ্ববাংলা পার্ক তৈরী করা হয়েছে। এই পার্কের সামনে পর্যটকদের বসার জন্য প্রচুর চেয়ার পাতা রয়েছে। এই চেয়ারে বসে সমুদ্রের জলে পড়া জ্যোস্না রাতের চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব দেখতে খুব ভালো লাগে।
![]() |
নতুন দীঘার সৈকত |
পুরোনো দীঘার কাছেই নতুন দীঘা শহরটি গড়ে তোলা হয়েছে। "দীঘা শংকরপুর উন্নয়ন পরিষদ " পরিকল্পিতভাবে এই শহরটিকে তৈরী করেছে। পুরোনো দীঘা থেকে এই নতুন দীঘা শহরটি বেশ নিরিবিলি। তবে দুই দীঘাতেই প্রচুর হোটেল ও রেস্তোরা গড়ে উঠেছে।
দ্রষ্টব্য স্থান :
অমরাবতী লেক - সমুদ্রের খুব কাছে নতুন দীঘাতে এই কৃত্রিম লেকটি তৈরী করা হয়েছে। লেকটির সাথে মরশুমি ফুলে সুন্দর করে সাজানো একটা বাগান আছে। লেকের জলে নৌকাবিহার করার ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের জন্য কয়েকটি খেলার ব্যবস্থাও রাখা আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ও পাখীদের মিষ্টি সুরেলা ডাকে জায়গাটা বেশ ভালো লাগলো।
রোপওয়ে - অমরাবতী পার্কের ভিতরেই একটা রোপওয়ে আছে। এই রোপওয়ে চড়ার জন্য টিকিট ঘরে দেখলাম অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। লাইন দিয়ে টিকিট কেটে রোপওয়েতে উঠে পড়লাম। রোপওয়ে চড়ার অভিজ্ঞতাটা আমার বেশ রোমাঞ্চকর লাগল।
দীঘা বিজ্ঞান কেন্দ্র - অমরাবতী পার্কের কাছেই এই বিজ্ঞান কেন্দ্রটি অবস্থিত। সমুদ্রের একঘেয়েমি কাটাতে হলে এখানে আসা উচিত। বিজ্ঞান-এর নানারকম জিনিস দিয়ে সাজানো এই বিজ্ঞান কেন্দ্রটি। এখানে থ্রিডি শোয়েরও ব্যবস্থা রয়েছে।
মেরিন একুরিয়াম - এটি পুরোনো দীঘাতে অবস্থিত। এশিয়ার সবচেয়ে বড় নির্মিত একুরিয়াম হল এটি। এখানে সমুদ্রের তলার নানারকম মাছ ও জন্তুদের জীবন যাত্রা দেখানো হয়। এখানে সমুদ্র নিয়ে নানারকম গবেষণা করাও হয়ে থাকে।
![]() |
চন্দ্রোনেশ্বর মন্দির |
চন্দ্রোনেশ্বর মন্দির- পুরোনো দীঘা থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে এই মন্দিরটি অবস্থিত। ওড়িষ্যার বালেশ্বর জেলায় এটির অবস্থান। মন্দিরটি কলিঙ্গ স্থাপত্যে তৈরী। মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। এটি হল চন্দ্রোনেশ্বর অর্থাৎ শিবের মন্দির। প্রচুর পুণ্যার্থী এখানে ভিড় করেন। সামনের পুকুর থেকে মন্দির পর্যন্ত অনেক পুণ্যার্থীকে দন্ডী কাটতে দেখলাম। একজন পুরোহিত জানালেন এখানে দন্ডী কাটলে মনের বাসনা পূর্ণ হয়।
তালসারি সৈকত - এই সমুদ্র সৈকতটিও উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলায় অবস্থিত। পুরোনো দীঘা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই সৈকতটিও প্রাচীন ও দর্শনীয়। এখানেই সুবর্ণরেখা নদীটি সমুদ্রের সাথে মিশেছে। এটিও যথেষ্ট নির্জন, সুন্দর ও উপভোগ্য এক সৈকত। এখানেও বেশ কয়েকটি থাকার জন্য হোটেল রয়েছে।
মোহনা - মোহনা হল বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত একটা ছোট্ট গ্রাম। দীঘা থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে এই মোহনা গ্রামটি অবস্থিত। আমি গ্রাম বলছি বটে তবে এখানে কোনো লোকবসতি নেই। এই গ্রামে বসবাস করার জন্য কোনো বাড়ি ঘরও নেই। এখানে আসলে দেখা যায় দূরদূরান্ত থেকে শুধু মৎস্যজীবীদের ও মাছের ট্রলারের যাতায়াত করা। প্রত্যেকদিন সকাল বেলায় এখানে মাছের পাইকারি বাজার বসে। সমুদ্রের পাশেই এই বাজার। এখানেও একটা ছোট্ট সৈকত রয়েছে, তবে সৈকতটি ভীষণই নোংরা।
এছাড়া এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মন্দারমণি সৈকত, শংকরপুর সৈকত, তাজপুর সৈকত, জুনপুট সৈকত, বাঁকিপুর সৈকত ঘুরে আসা যায়।
৫০০ বছরের ইতিহাসের সরণি বেয়ে দীঘা আজ পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র। দীঘাকে ঘিরেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অর্থনীতি দ্রুত বিকাশ লাভ করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জেলার কর্মকর্তারা আরো নতুন নতুন সৈকতের সন্ধান করে চলেছে। ভ্রমণ পিপাসু বাঙালিরাও অপেক্ষা করে আছে এইসব নতুন সৈকতের জন্য।
কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে দীঘার দূরত্ব প্রায় ১৮৮ কিলোমিটার। কলকাতা বা হাওড়া থেকে এক ঘন্টা অন্তর দীঘা যাওয়ার জন্য সরকারি বাস ছাড়ে। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত এই বাস পাওয়া যায়। বর্তমানে অবশ্য কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকেও দীঘা যাওয়ার জন্য সরকারি বাস ছাড়ে। এছাড়া প্রতিদিন প্রচুর বেসরকারি বাসও কলকাতা-দীঘা যাতায়াত করে। বাসে কলকাতা থেকে দীঘা যেতে ঘন্টা পাঁচেক সময় লাগে। এছাড়া হাওড়া থেকে ট্রেনে করেও দীঘা যাওয়া যায়। ট্রেনে সময় একটু কম লাগে।
কোথায় থাকবেন : দীঘাতে সৈকতাবাস, পুরোনো টুরিস্ট লজ , নতুন টুরিস্ট লজ, নিরালা, আনন্দম প্রভৃতি সরকারি থাকার জায়গা রয়েছে। এই সরকারি লজগুলোকে কলকাতা থেকে অনেক আগেই বুক করতে হয়। বিভিন্ন ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনেক হলিডে হোম রয়েছে। এছাড়া পুরোনো দীঘা ও নতুন দীঘাতে প্রচুর বেসরকারি লজ রয়েছে।
তারিখ : ২৪-০৩-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
1 comment:
Darun akta bhromon kahini digha ami anekbar gechi kintu itihasta Jana chhilo na eta amar kachhe upri paona holo
Post a Comment