Tuesday, December 24, 2019

বড়দিন ও কলকাতা >

বড়দিন ও কলকাতা 


পঁচিশ মানে বড়দিন 
পঁচিশ মানে যীশু 
পঁচিশ মানে সকল দেশে 
খুশি সকল শিশু।

পঁচিশ মানে কেক, মিষ্টি 
পঁচিশ মানে ভালোবাসা 
পঁচিশ মানে সান্তাক্লজ 
মেটায়  শিশুর আশ।



পঁচিশে ডিসেম্বর মানেই বড়দিন। বড়দিন মানেই শিশুদের মন ভোলানোর জন্য সান্তাক্লজের আবির্ভাব ও উপহার প্রদানের  অলীক কল্পনা।  বড়দিন হলো খ্রিস্টান  ধর্মাবলম্বীদের  এক বাৎসরিক উৎসব। ধরা হয় এই দিনে খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রিষ্ট জন্মেছিলেন। সেই কবে বেথেলহেমের আস্তাবলে আশ্রয় নিয়েছিলেন আসন্নপ্রসবা মেরি, সারা বেথেলহেম যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, সেই সময় সবার অলক্ষে চুপিচুপি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আস্তাবলে এসে নামলো। এক অপার্থিব আলো  সারা পৃথিবীকে  আলোকিত করল। জন্ম নিল এক শিশু।  সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি যে এই শিশু একদিন পাল্টে দেবে পৃথিবীর মানচিত্রকে। এই নির্দিষ্ট দিনটিতে যীশু জন্মগ্রহণ করেছেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।  যীশুর জন্মদিনের কোনো তারিখের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে যীশুর পৃথিবীবাস শেষ হওয়ার অনেক বছর পর ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন প্রথম যীশুর জন্মদিন পালন করেছিলেন। রোমবাসীরা সারা রাত  জেগে সেদিন বড়দিনের উৎসব উদযাপন করেছিলেন। যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনকে ইংরেজিতে "খ্রিষ্টমাস" বলা হয় আর বাংলায় "বড়দিন" বলে অভিহিত করা হয়। বাংলায় বড়দিন শব্দটি সম্ভবত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সর্বপ্রথম তাঁর লেখায় ব্যবহার করেছিলেন।  তিনি লিখেছিলেন "যদিও আমরা হই হিন্দুর সন্তান,  বড়দিনে সুখী তবু, খ্রিষ্টান সমান"।

২৪শে  ডিসেম্বর মধ্য রাত্রি থেকে গির্জায় গির্জায় প্রার্থনার  মধ্য দিয়ে যীশুর জন্মদিন পালন করা রীতি রয়েছে। ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে সারা বিশ্বেই বড়দিন বা খ্রিষ্টমাস হিসেবে পালন করা হয়। সময়ের আবর্তে বড়দিন আজ পেয়েছে সর্বজনীন উৎসবের মর্যাদা।  শুরুতে এই উৎসব সেরকমভাবে উৎযাপন করা হতো না।  যীশু খ্রিষ্টের জন্মের বহু বছর পর থেকে এই দিনটিকে খ্রিস্টানরা আনন্দ ও মুক্তির দিন হিসেবে পালন করা শুরু করে। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে যীশুই মানব জাতিকে দেখিয়েছিলেন মুক্তি ও কল্যাণের পথ। তাই তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করে সারা বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষেরা। ২৫শে উৎসবের শুরু আর নিউ য়ার্স উৎসবের শেষ।

আমাদের শহর একসময় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। শহরের বুকে  ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের মধ্যে গির্জার সংখ্যাও কিছু কম নয়। প্রতিবছরই এইসব গির্জাগুলো বড়দিনের প্রাক্কালে নানারকম আলোকমালায় সজ্জিত হয়। ক্রিসমাস ইভের সন্ধ্যায় ও ক্রিসমাসের দিন মানুষের ঢল নামতে দেখা যায় এই গির্জাগুলোতে। অনুষ্ঠিত হয় প্রার্থনা সভার। এই বিশেষ দিনে বিভিন্ন গির্জা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় সেই সব চার্চগুলোর ছবি। এই দিন স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারী ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলো সাধারণত ছুটি থাকে। বাবা-মায়ের হাত ধরে কচিকাচারা সকাল থেকেই ভিড় জমান শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে। যদিও বাঙালির সাথে বড়দিনের কোনো সুদূর সম্পর্ক নেই, তবুও বাঙালিরা এই দিনটা উৎসব হিসেবেই পালন করে আসছে।

আমাদের তিলোত্তমা সেজে উঠে, সেজে উঠে শহরের অ্যাংলো পাড়াগুলো। শহরের রাস্তার দুপাশে নানান  মাপের সান্টা ক্লজ, ক্রিসমাস ট্রি, জিঙ্গল বেল বিক্রির জন্য বিক্রেতারা পশরা  সাজিয়ে বসেন।  যুগ যুগ ধরে আমাদের শহরে হিন্দু-মুসলমানদের মন্দির-মসজিদের পাশাপাশি অবস্থান করে বহু গির্জা। এ যেন শহর কলকাতার এক সম্প্রীতির বন্ধন। কলকাতা তো সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শহর। নস্টালজিয়া বাঙালির শিরায় শিরায়। তাই তারা সব ধর্মের অনুষ্ঠানেই নিজেদের আনন্দটুকু ঠিকভাবে তুলে নিতে জানে। শহর জুড়ে শীতের আবহাওয়া। তাপমাত্রার পারদ এই সময় অনেকটাই নেমে যায়, লেগে যায় হিমের পরশ। বড়দিনের অপেক্ষায় প্রহর গোনে শহরবাসী। বাবা-মায়ের হাত ধরে কচিকাচারা সকাল থেকেই ভিড় জমান চিড়িয়াখানায় বা ইকোপার্কে বা অন্যান্য জায়গাগুলোতে। রংবাহারি আলোর সাথে উৎসবের মেজাজ মহানগরবাসীদের বরাবরই পছন্দের।  সেজে ওঠে গির্জাগুলোর সাথে সাথে হগ মার্কেট, বো-ব্যারাক,  অ্যালেন পার্ক ও সমগ্র পার্ক স্ট্রিট। এলইডি আলোর চাঁদোয়ায় ঢাকা, আলো ঝলমল করে অ্যালেন পার্ক্ ও পার্ক স্ট্রিট।  উৎসব উদযাপনের ছাপ লক্ষ্য করা যায় পার্ক স্ট্রিটের আনাচে-কানাচে। পার্ক স্ট্রিটের আনন্দ বুক ভোরে নিতে আসে বাঙালিরা। বেলুন হাতে পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথ ও রাস্তাটিতে  মাথায় লাল আলো জ্বলা সান্টা টুপি পরে বাচাদের বড়দের হাত ধরে ঘুরতে দেখা যায়। গান বাজনা, খাওয়া-দাওয়া আর হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে শহুরে জীবনগুলো। কারো সঙ্গে বন্ধু-বান্ধব, কারো সঙ্গে প্রিয় নারী। রাত যত বাড়ে তত সাহেবপাড়ার আলোগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বার-রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় উপচে পরে। বারগুলোতে ওঠে স্কচ-হুস্কির ফোয়ারা। কোনো কোনো বারে আবার নাচ-গানের এলাহী ব্যবস্থা থাকে। সুন্দরী নৃত্যপটীয়সীরা তাদের শরীরের  চটুল ভঙ্গিতে অতিথিদের উষ্ণ শরীর করে তোলে উষ্ণতর। দলে দলে শহরের মানুষ সামিল হয় সাহেবপাড়াগুলোতে। সেলফি তোলার হিড়িক পরে যায়। আট থেকে আশি ভিড় জমান গির্জাগুলোতে ও পার্ক স্ট্রিটের বাহারি আলোর তলায়।  সর্ব জাতি মিলেমিশে এক হয়ে যায়। যুবক-যুবতী ও বাচ্ছারা  মাথায় লাল রঙের সান্টা টুপি  আর চোখে বাহারি নকল চশমায় নিজেদের সাজিয়ে তোলে। তিলোত্তমা বড়দিনকে স্বাগত জানায়।

 পাড়ায় পাড়ায়  তৈরী হয় বড়দিনের নানারকমের সামগ্রীর সাথে কেকের দোকান।  কেক ছাড়া বড়দিনের স্বাদটাই বিস্বাদ।  তাই কেকের দোকানেও  ভিড় উপছে পড়তে দেখা যায়। কেক বিলাসের অন্যতম পীঠস্থান হল হগ মার্কেট।  গরম গরম কেকের গন্ধে বাজারটির চারদিক  ম ম  করে। নাহুমস, ক্যাথলিন এরকম বহু নামি-দামি ব্যান্ডের আঁতুরঘর এই জায়গাটি। হগ মার্কেটে বছরের পর বছর ধরে এই দোকানগুলো কেকের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। এখানে আসলেই আপনার সাধ্যের মধ্যেই হবে আপনার স্বাদ পূরণ।  বড়দিনের কেক, হগ মার্কেট ও বাঙালি মিলেমিশে এই সময়টাতে যেন  এক হয়ে যায়।

ক্রিস্টমাস ট্রি, আলো, মিষ্টি, খেলনা, তারা, ঘন্টা দিয়ে ঘর সাজানোর রেওয়াজ  বহু প্রাচীন। প্রথম দিকে উত্তর ইউরোপের ফার গাছগুলোকে এভাবে সাজানো হতো।  পরবর্তীকালে তা বিশ্বের সর্বত্রই ছড়িয়ে পরে।  আমাদের শহরও এর থেকে বাদ  যায় না।  শহরের বহু মানুষকে এইদিন ক্রিস্টমাস গাছ ও রং-বেরঙের আলো  দিয়ে নিজেদের  ঘরে যীশুর মূর্তি  সাজাতে দেখা যায়।

সান্টাক্লজ হল পাশ্চাত্য সংস্কৃতির রূপকথার এক কিংবদন্তি চরিত্র। সাধারণভাবে তিনি সান্টা নামে পরিচিত। উপকথায় বলে তিনি নাকি একজন অত্যন্ত দয়াবান ছিলেন। সান্টা সাধারণত হাস্যমুখর, সাদা দাঁড়িওলা একজন বৃদ্ধ মানুষের চিত্র।  তার পরনে সাদা কলার ও সাদা আস্তিনের লাল কোর্ট ও সাদা আস্তিনের লাল রঙের ট্রাউজার্স, কালো চামড়ার বেল্ট ও বুট জুতো  পরিহিত। তার পিঠের ঝোলাতে থাকে নানা রকমের উপহার সামগ্রী।  প্রাচীন গ্রিসের লাইসিয়াতে চতুর্থ শতকে সন্ট নিকোলাসের উল্লেখ মেলে। প্রচলিত বিশ্বাস হলো তিনি নাকি বড়দিনের প্রাকাল্লে অর্থাৎ ২৪ তারিখ মধ্যরাত্রে ভালো ভালো ছেলে মেয়েদের নানারকম উপহার দিয়ে থাকেন। এই কিংবদন্তির উৎস হল ঐতিহাসিক উপহার প্রদানকারী চরিত্র সন্ট নিকোলাস। সন্তসুলভ অবদানগুলোর পাশাপাশি তিনি শিশুদের পরিচর্যা, দয়া ও উপহার প্রদানের জন্য খ্যাত ছিলেন।  সন্তের পোশাকে তিনি শিশুদের খোঁজখবর নিতেন এবং বিচার করে দেখতেন কোন কোন শিশু উপহার পাওয়ার যোগ্য। সি সন্ত  নিকোলাস সান্তাক্লজের আদি রূপ। নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামে খুবই জনপ্রিয় চরিত্র সিন্টারক্লাস ৬ই ডিসেম্বর তিনি উপহার দেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিসমাসের দিনও  বেশ কিছু লোক উপহার দিয়ে থাকেন।  যদিও আধুনিক সান্টাক্লজের রূপকল্পটি সৃষ্টি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। মার্কিন প্রেসে সান্তাক্লজ শব্দটি ১৭৭৩ সালে সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল। রূপকথা আছে কি নেই কারো সেভাবে জানা না থাকলেও আমরা দেখেছি বহু মা-বাবা তার শিশু ২৪ তারিখে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়লে তার মাথার কাছে একটি মোজার ভিতরে নানারকম খেলনা ও উপহার ভরে রেখে দেয়, পরের দিন সকালে শিশুটির ঘুম ভাঙলে সে যেন মোজাটি খুলে দেখতে পায় যে  সান্টাক্লজ  তার জন্য কি কি উপহার পাঠিয়েছে।  শিশু মনের আনন্দে তৈরী হয় উৎসবের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য।  সারা পৃথিবীতেই পিতা-মাতার তাদের সন্তানদের সান্টাক্লজ  ও অন্যান্য উপহারপ্রদানকারীদের সম্পর্কে শিক্ষা দিলেও, কেউ কেউ এগুলোকে কুসংস্কার হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। আবার অনেক দেশেই এই দিনে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে উপহার আদান-প্রদানের রীতি রয়েছে।

বড়দিন মানে ঈশ্বরের কাছে থেকে সঠিক পথের নির্দেশ পাওয়া। বড়দিন মানে খারাপ কাজ ছেড়ে ভালো পথে চলতে শেখার দিন।  যীশু নামের অর্থ উদ্ধারকর্তা বা রক্ষাকর্তা।  যীশু হলেন একজন মানবরূপী ঈশ্বর।  পবিত্র বাইবেল বলে "যীশু খ্রিষ্টেই  আমরা মুক্তি, পাপের মোচন প্রাপ্ত হয়েছি।  ইনিই অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি"। আমাদের জীবনে বড়দিনের সার্থকতা শুধু ত্যাগস্বীকারে, ভোগবিলাসে বা উপহার দেয়া-নেয়াতে নয়।  যদি আমরা সর্ব ধর্মের সকল মানুষকে ভালোবাসি, তবেই বড়দিন সমাজে সার্থক হবে।

কবিতা : শক্তিপদ ঘোষ
ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ২৪-১২-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Thursday, December 12, 2019

নব কৈলাশ মন্দির >

ভ্রমণ

নব কৈলাশ মন্দির 



কথায় বলে "মাঘের শীত বাঘের গায়"।  এই বছর এখনও কলকাতায় সেইভাবে ঠান্ডা পড়েনি। ঠান্ডা পড়েনি তো কি হয়েছে, তা বলে কি ঘুরতে যাবো না তাতো হয় না। গত শনিবার অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখ রাতে ঠিক করলাম পরেরদিন ৮ তারিখ অর্থাৎ রবিবার কোথাও একটা ঘুরতে যেতেই হবে।  গিন্নির সাথে কথা বলে ঠিক করা হলো কালনার নব কৈলাশ মন্দির দেখতে যাবো, কারণ আমাদের দুজনের কারোরই এই মন্দিরটা এখনো দেখা হয়ে ওঠেনি। রাতেই গুগল বাবাজির স্মরণাপন্ন  হলাম। বাবাজি জানালো সকাল ৮-০৬ মিনিট নাগাদ শিয়ালদহ স্টেশন থেকে একটা ট্রেন রয়েছে যেটা অম্বিকা কালনা স্টেশনে সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে আমাদের পৌঁছে দেবে।  ওই ট্রেনটাই  ধরবো বলে ঠিক করে নিলাম। পরের দিন ঠিক সময় ট্রেনটা ধরলাম এবং ঠিক সময় কালনায় পৌঁছেও গেলাম।





কালনা হলো বর্ধমান জেলার ভাগীরথীর তীরে একটা ছোট্ট শহর। বহু  প্রাচীন জনপদ।  পুণ্যসলিলা গঙ্গার (ভাগীরথী) পশ্চিমকূলে অবস্থিত  অম্বিকা কালনা প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু স্থানরূপেই প্রসিদ্ধ।  নগরটির প্রাচীনতা প্রায় হাজার তিনেক বছরের। অতীতে বর্ধমান রাজাদের গ্রীষ্মবাসের ঠিকানা এই নগরেই ছিল। পঞ্চদশ ও ষোড়শ  শতকে এই স্থানটি অম্বুয়া বা অম্বিকা  মুলুক নামে  পরিচিত ছিল। পৌরাণিক ব্যাখ্যায় দেখা যায় অম্বুমুনির পূজিতা দেবী ছিলেন  সিদ্ধেশ্বরী অম্বিকা। দেবী অম্বিকা জৈনদের দেবী  এই দেবী অম্বিকার নামানুসারে নগরটির নাম হয় অম্বিকা কালনা। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ লর্ড ক্যানিংহামের  মতে সপ্তম শতাব্দীর অম্বুয়া বা অম্বিকা তাম্রলিপ্ত শহরের অধীনে ছিল।  প্রাচীন কালনা নগর ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। ১৮১২ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কালনার সংস্কৃত পন্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে নিয়োগের জন্য এই নগরে পদার্পন করেছিলেন  ১৭৭১ সালে বিখ্যাত  কবি কমলাকান্তের জন্ম হয়েছিল এই শহরে। পোড়ামাটির ভাস্কর্যে বাংলা বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। মধ্যযুগীয় স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্পের নানাবিধ নিদর্শন নিয়ে শহরটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।




ঐশ্বর্যপূর্ণ পোড়ামন্দির দ্বারা সমৃদ্ধ অম্বিকা কালনাকে আসলে "মন্দির নগরী" বলা হয়। এখানকার মন্দিরগুলো সাধারণত আটচালা শৈলীতে নির্মিত। এই প্রাচীন শহরে দেখার মতো অনেক ঐতিহাসিক মন্দির, বৃক্ষতল, ধর্মস্থান ও রাজবাড়ী রয়েছে। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় মন্দির হলো নব কৈলাশ মন্দির।  যাইহোক, আজ  আমি শুধু কালনার নব কৈলাশ মন্দির অর্থাৎ ১০৮ শিব মন্দিরের কথাই আপনাদের বলব। পরে কোনো একসময় কালনার অন্যান্য দ্রষ্টব্যস্থানগুলোর কথা জানাবো। মন্দিরে ঢোকার পূর্বে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হলো।  ভিতরে ঢুকে অপূর্ব চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ও নৈঃশব্দ আমায়  বিস্মিত করে দিলো। ভারতবর্ষের অন্যান্য মন্দিরের যেরকম কোলাহল শোনা যায়, এখানে সেরকম নেই।  পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতবর্ষের একমাত্র জেলা হল বর্ধমান,  যেখানে দু-দুটো ১০৮/৯ শিব মন্দির রয়েছে।  এই রকম ১০৮ বা  ১০৯ কোনো মন্দির সারা ভারতবর্ষের আর কোথাও নেই। বর্ধমানের নবাবহাটে একটি সুন্দর ১০৮ শিব মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটি বর্ধমানের মহারানী বিষ্ণুকুমারী দেবী ১৭৮৮ সালে নির্মাণ করেছিলেন।  জেলার দ্বিতীয় ১০৮ শিব মন্দিরটির অবস্থান কালনা শহরে। কালনার মন্দিরটি বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র ১৮০৯ সালে নির্মাণ করেছিলেন।  দুটি মন্দিরের আকৃতি ভিন্ন, নবাবহাটের  মন্দিরগুলো দুটি লম্বা সারিতে নির্মিত আর কালনার মন্দিরটি গোলাকৃতি আকৃতিতে নির্মিত।  দুটি মন্দিরকেই ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খুব সুন্দর করে সংস্কার করে দিয়েছে।  এই সংস্কারের ফলে পুরাতাত্ত্বিক কৌলিন্য কিছুটা হারিয়েছে বলে সবাই মতামত দিয়ে থাকে। উজ্জ্বল রঙের প্রলেপ থাকলেও এখানে ইতিহাসের গন্ধ পেতে কোনো অসুবিধা হয় না।

কালনার  ১০৯ টি মন্দিরের মধ্যে  ১০৮ টি মন্দির জ্যামিতিক বৃত্তে বিন্যস্ত, যা একটি স্থাপত্য বিস্ময়।  মন্দিরের কাঠামো দুটি সমকেন্দ্রিয় বৃত্তের একটি সমন্বয়। এটি একটি পুঁথির অক্ষ মালার প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে রয়েছে আটচালাবিশিষ্ট ১০৮টি শিব মন্দির আর একটি পঞ্চরত্ন মন্দির। সবকটা মন্দিরের  ছাদগুলো গম্ভূজাকৃতি।  দুটি বৃত্তের মধ্যে মন্দিরগুলি তৈরী।  বাইরের বৃত্তে ৭৪টি আর ভিতরের বৃত্তে ৩৪টি মন্দির রয়েছে।  মন্দিরগুলির দেওয়ালে পৌরাণিক কাহিনী চিত্রিত আছে। ১০৮টি মন্দিরের প্রতিটিতে একটি করে শিব লিঙ্গ বিরাজ করছে। ভিতরের বৃত্তের পরিধি প্রায় ৩৩৬ ফুট আর বাইরের বিত্তের পরিধি প্রায় ৭১০ ফুট। মন্দিরগুলো স্বল্প উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত ও পরস্পর সংলংগ্ন। মন্দিরগুলির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট আর প্রস্থ প্রায় ৯.৫ ফুট।  ভিতরের শিব মন্দিরগুলোতে শুভ্র বর্ণের আর বাইরের বিত্তের শিব মন্দিরগুলোতে অর্ধেক কৃষ্ণবর্ণ ও অর্ধেক শুভ্র বর্ণের  শিব লিঙ্গ বিরাজ করছে। বৃত্ত দুটির ঠিক কেন্দ্রে একটা  বাঁধানো ইঁদারা রয়েছে।  এই ইঁদারার জল পূজার কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।  

১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি  হলো পঞ্চরত্ন মন্দির। ৬ ফুট উচ্চ  ভিত্তিবেদীর উপর মন্দিরটি অবস্থিত।  মন্দিরটির আয়তন দৈর্ঘ্যে  ও প্রস্থে  প্রায় ১৩ ফুট করে, উচ্চতা প্রায় ৩৫ ফুট। বর্তমানে মন্দিরটি জল্পেশ্বর মন্দির নামে  অধিক পরিচিত।  

পুরো স্থাপত্যটি ঠিক জপমালার মতো। সমগ্র সৃষ্টিটি এক অপূর্ব শিল্পসত্তা ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধনকে বহন করে চলেছে। 

বর্তমানে মন্দিরগুলির দায়িত্বে  রয়েছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষন (আর্কিওলজিক্যাল  সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)  মন্দিরে ঢোকার মুখে বিভাগের একটা নীল রঙের বোর্ডে এখানকার সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখে রাখা রয়েছে। পুরাতত্ত্ব বিভাগ মন্দির চত্বরের মধ্যে একটা সুন্দর বাগান তৈরী করেছে।  এই বাগানের জন্য মন্দিরের সৌন্দর্য শতগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সমগ্র মন্দিরটিকে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। দিনের থেকে রাতে মন্দিরগুলোকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে। চুপচাপ শুধু ইতিহাসকে অনুভব করে গেলাম। প্রায় আড়াইশো বছরের এক পৌরাণিক ও বাংলার এক শিল্পকলার অপূর্ব নিদর্শন দেখতে দেখতে আমি ইতিহাসের পাতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখানে ইতিহাসের সাথে অধ্যাত্বিকতা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।  এ যেন ইতিহাস ও আধ্যাতিকতার এক মেলবন্ধন, এ যেন বাংলা তথা ভারতের সংষ্কৃতির এক  জীবন্ত সাক্ষী। 


 আমাদের বাংলায় ঘোরার স্থানের কোনো অভাব নেই, শুধু একটু সন্ধান করতে পারলেই হলো। কলকাতা থেকে কালনা ঘুরতে যাওয়ার জন্য রাত্রিবাসের কোনো প্রয়োজন নেই।  সকালে বেরিয়ে সবকিছু দেখে রাতে অনায়াসেই ফিরে আসা যায়। এখানে আসলে বাংলার টেরাকোটার অপরূপ সৃষ্টির সাথে আপনার পরিচয় হবে তার  জন্য অবশ্যই একবার ঘুরে যান। 




কিভাবে যাবেন : 


হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে অম্বিকা কালনা স্টেশনে এসে নামবেন।  স্টেশনের বাইরে টোটো বা রিক্সা ভাড়া করে মন্দির চত্বরের আসতে পারবেন।  



ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ১২-১২-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Tuesday, December 3, 2019

জীবন ও জীবিকা (দ্বিতীয় পর্ব )


জীবন  ও জীবিকা 
(দ্বিতীয় পর্ব )


ধীবর বা মৎস্যজীবী 


আমরা কাগজে বা খবরে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে  প্রায়ই  দেখতে পাই "দীঘার সমুদ্র ফুঁসছে, সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চলগুলোতে জলোচ্ছাস দেখা দিচ্ছে। ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে। মৎসজীবীদের প্রতি সতর্কতা জারি করা হয়েছে"।  এই খবর দেখার পর আমরা দৌড়ে যাই জলোচ্ছাস দেখার জন্য, কখনো ভাবি না ঐসব অঞ্চলের মৎসজীবীদের কথা,  আবহাওয়ার দুর্নিপাকে পরে তাদের দুর্ভোগের কথা।

এরা ধীবর সম্প্রদায়। কথ্য ভাষায় আমরা জেলে বা মৎসজীবি বলে থাকি। মাছ ধরাই এদের জীবিকা, জাতিগত পেশা। তথ্যগতভাবে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে এরা  তফসিলি জাতি বা নিচু জাতি গোষ্ঠীভুক্ত। জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে  আমাদের দেশে ধর্মীয় প্রশ্নে বেশিরভাগই জেলেই হিন্দু ও  মুসলমান সম্প্রদায়ের হয়।  হিন্দু জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন শাখা শ্রেণী রয়েছে যেমন, কৈবর্ত্য, রাজবংশী, বেরুয়া, জিয়ানি, মালো, নদীয়াল ও আরো কয়েকটি। মাছ ধরার ইতিহাস বহু প্রাচীন। খ্রিষ্টপুর্ব ৩২১-৩০০ সালে  কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে মাছ ধরার বর্ননা রয়েছে। জেলেদের অস্তিত্বের ছবি মেলে হরপ্পা-মহেঞ্জদরোর খনন কার্যের সময়।  সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাসেও এদের কথা রয়েছে।

দুনিয়ায় জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষকে কোনো না কোনো ভাবে উপার্জন করে নিজের ও পোষ্যবর্গের প্রয়োজন মেটাতে হয়। আজকের পেশা হিসেবে আমি মৎস্য শিকারীদের বেছে নিয়েছি।  সাধারণভাবে যারা মাছকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে তারাই জেলে বা মৎস্যজীবী হিসেবে স্বীকৃত। আবহমান কাল থেকেই একশ্রেণী লোকের পেশা হল খাল-বিল, নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরা। জেলে বা মৎস্যজীবী সম্প্রদায় বংশ পরম্পরায় মৎস্য আহরণ ও নিকটবর্তী পাইকারি হাটে বা বাজারে বিক্রি করে চলেছে। কেউ কেউ আবার আড়তদারদের কাছেও বিক্রি করে থাকে।  মৎসজীবীদের যেমন ইতিহাস রয়েছে তেমন রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাত্রা। মাছের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পর থেকে জেলেদের কাজের পরিধিও অনেকগুন বেড়ে গেছে। মাছের প্রজনন থেকে শুরু করে মাছ চাষের প্রায় প্রতিটি ধাপ এরাই পরিচালনা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই পেশা আজ কিছুটা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ।  ঝড়, জলোচ্ছাস, জোয়ারের তীব্রতা, নদী-ভাঙ্গন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের বিপদ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। জীবিকার জন্য জীবনকে বাজি রেখে এদের চলতে হয়।  বিকল্প জীবিকা বা নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাও সরকারিভাবে না থাকায় নতুন প্রজন্ম অনিচ্ছাকৃতভাবে এই পেশায় চলে আস্তে বাধ্য হচ্ছে। এদের বসবাস  সাধারণত নদী, খাল-বিল বা সমুদ্রের কাছাকাছি হয়ে থাকে।  তারা বেশিরভাগ সময় নদীতে বা খালে-বিলে মাছ ধরে থাকে। এক শ্রেণীর জেলে আবার গভীর সমুদ্রে মাছের আশায় পাড়ি জমায়। এদের জীবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তারা যখন সমুদ্র পাড়ি দেয়  তখন তাদের পরিবার নিরাপদে ফেরা পর্যন্ত খুবই উদ্বিগ্নে  থাকে। বেশিরভাগ জেলেদেরই কোনো নিজস্ব নৌকো থাকে না।  মালিকের কাছ থেকে নৌকো  ভাড়া করে তারা সমুদ্র পাড়ি দেয়।  ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ  নিয়ে জাল কিনতে হয়। তার ফলে মহাজনের কাছে ঋণবদ্ধও  হয়ে পড়ে।

বেশ কিছু মৎসজীবি সমুদ্র উপকূলের কাছে একসাথে একটি ছোট পাড়ায় বসবাস করে, এই পাড়াটিকে সবাই জেলেপাড়া বলে অভিহিত করে থাকে। জেলেপাড়ায় সূর্যের উদয় ও অস্তের সঙ্গে দিন-রাতের সম্পর্ক ততটা নেই, যতটা আছে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে।  রাতদুপুরে জোয়ার এলে জেলেপাড়ায় তখন দিনের মতোই কর্মব্যস্ততা পরিলক্ষিত হয়। সমুদ্রের উত্তাল, জলের রং, মাছের চরিত্র অনুযায়ী জাল ফেলতে হয়। জাল বিভিন্ন রকমের হয়। সমুদ্রের উপযোগী জাল হলো সাবাড় জাল। এই প্রকার জাল বিশাল আয়তনের হয়। শুধু জালের ওপর মাছ ধরা নির্ভর করে না, মাছ ধরার কৌশলও অনেকাংশে নির্ভর করে।  ট্রলারে বরফ বোঝাই করে তারা মাছ ধরার জন্য সাত-আট  দিনের জন্য সমুদ্রে পাড়ি দেয়। এই কদিনের খাবারও  সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। গ্রীষ্ম বা শীতের সময়ের চেয়ে বর্ষার সময় বেশি মাছ উৎপন্ন হয়।  সেই সময় জেলেরাও  বেশি পরিমাণে মাছ ধরতে পারে, তার ফলে তাদের আয়ের পরিমাণ অনেকটা বাড়ে। অবসর সময় নতুন জাল তৈরী ও পুরোনো জাল মেরামতি করেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।


সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে মাছ ধরা ভীষণই বিপদজনক।  এখানে থাকে জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ।  সুন্দরবনের বিভিন্ন খাড়িতে মাছ ধরতে গিয়ে বহু মৎসজীবি বাঘের হামলায় মারা যান।  এই অঞ্চলের বহু মহিলা তাদের স্বামীকে বাঘের হামলায় হারিয়েছেন। হিঙ্গলগঞ্জ, গোসাবা, কুলতলী, পাথরপ্রতিমা এবং বাসন্তী ব্লকের গ্রামবাসীরা রোজকার জীবন ও জীবিকার জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল।  তাদের জন্য এইসব অঞ্চল সংলগ্ন জঙ্গলে বাঘের উপস্থিতি খুব বড় সন্ত্রাসের কারণ। এইসব অঞ্চলে গেলে সর্বত্রই এক গল্প শোনা যায়, বেশ কিছু পরিবার তাদের পুরুষ সদস্যদের  বাঘের আক্রমণে খুইয়েছেন। খুঁজে দেখলে এখানে বিধবা পাড়াও খুঁজে পাওয়া যাবে।  অধিকাংশ পরিবারেরই মহিলাদের জীবন যন্ত্রনা ও দারিদ্রে ভরা।


 পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মৎস্যজীবীরা সমুদ্রে নৌ যাত্রার প্রাক্কালে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার্চ্চনা করে থাকে  সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা বনবিবির পূজা করে থাকে।  মুসলমান মৎসজীবীরা আবার গাজীর আরাধনা করে।  ওদের প্রবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে।

জীবনকে বাজি রেখে রক্ত, ঘাম, উত্তেজনা আর মেহনতের দ্বারা জেলেপাড়ার মানুষদের অন্নসংস্থান হয়। সত্যই এদের জীবন খুবই সংগ্রামের জীবন।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০৩-১২-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Sunday, November 24, 2019

জীবন ও জীবিকা (প্রথম পর্ব)

জীবন ও জীবিকা (প্রথম পর্ব)
জীবন ও জীবিকা



 জীবনের বিচিত্র পথে ছুটে চলেছে জীবিকার গাড়ি 

মনুষ্য জীবন বড়ই বিচিত্র।  জন্মের মাধ্যমেই জীবন যুদ্ধের শুরু। জীবন থাকলেই হবে না তাকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যেতে হবে,  তবেই জীবনের সার্থকতা। জীবনের মৌলিক চাহিদার সাথে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার সম্পর্ক অনস্বীকার্য।  সাধারণভাবে জীবনের প্রথম কুড়ি - বাইশ বছর আমরা পড়াশোনার মাধ্যমে কাটিয়ে দিয়ে থাকি। ততদিন বেশিরভাগ ছাত্র বা ছাত্রীরা সমাজের কঠিনতার সাথে সেভাবে পরিচিত হয় না।  লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর শুরু হয় জীবন ও সমাজের  বাস্তবতার সংঘাত। ধীরে ধীরে তারা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।  জীবনতরীকে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয় সমাজের কঠিনতার  মোকাবিলা করে নিজের জীবনকে  সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য।  ভুলতে বসে বিকেলের সোনাঝরা ঝলমল করা রোদের আলোতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার দিনগুলোকে। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে জীবনের সংজ্ঞা ভিন্ন  হতে থাকে। কারো কারো কাছে জীবন শুধু নিরন্তর উপভোগের বিষয়, কারো কারো কাছে জীবন মানে নিঃস্বার্থভাবে অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, আবার কারো কাছে জীবন মানে ভোগ ছেড়ে নিজেকে গড়ে তোলা। সাধারণভাবে জীবনধারণের অর্থই হল জীবিকা। জীবিকার আর এক প্রতিশব্দ হল পেশা।  পেশা হচ্ছে কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর পরবর্তী জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকুরী বা অন্য কোনো বিত্তিপেশাকে গ্রহণ করা।  এই পেশার সাহায্যে তাঁরা আর্থিক উপার্জনের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করে।  প্রতিটি মানুষ জীবিকা সংগ্রামের যুদ্ধে প্রতিনিয়ত সামিল থাকে। প্রতিদিন কেউ সস্তায়  নিজেকে আবার কেউ চড়া দামে নিজেকে বিক্রি করছে।  জীবন ও জীবিকা দুটোই চলমান।  জীবন চলে বয়সের তাগিদে আর জীবিকা চলে জীবনের তাগিদে। গতানুগতিক জীবনে হাজারো জীবিকার ভিড়ে মানুষ তার নিজস্ব জীবিকার সন্ধান খুঁজে পায়।  জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ কি না করে।  কারো জীবন সুখে-শান্তি ও আনন্দে ভরে থাকে আবার কারো জীবন বড়োই বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। 

 এখানে মানুষের বিচিত্র জীবিকার কথা ধীরে ধীরে  বিভিন্ন পর্বে  বলবো। আমি মাঝে মাঝে বিভিন্ন পেশাকে বা জীবিকাকে নিয়ে লিখবো। আজ তার প্রথম পর্ব। বাকি পর্বগুলোর  লেখাগুলোকে  নজর রাখবেন। 


 বিড়ি বাঁধাই 

(প্রথম পর্ব)




ধূমপানের ইতিহাস খুবই দীর্ঘ। এই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি।  সুপ্রাচীন কালে  বিশ্বে তামাকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রথমদিকে ইউরোপের দেশ গুলোতে তামাক পাতার ব্যবহার শুরু হয়। ১৫৬০ সালে জঁ নিকোট ফ্রান্সে তামাক পাতাকে জনপ্রিয় করেন।  তাঁরই নাম থেকে নিকোটিন কথাটির উদ্ভব হয়েছে। প্রথমদিকে তামাক পাতা ঔষধ হিসেবে ব্যৱহৃত  হলেও ধীরে ধীরে তা নেশার সামগ্রী হয়ে ওঠে। এই শতকেই বিজ্ঞানীরা নিকোটিনের ক্ষতিকর দিকগুলো আবিষ্কার করেন।  ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে নিকোটিনের বিষ নিয়ে সারা বিশ্বে প্রচার শুরু হয়।


বিড়ি হচ্ছে একটা ধূমপানের সামগ্রী।  ধূমপানের জন্য তৈরী শুকনো তামাক পাতা দিয়ে পাকানো একটি ক্ষুদ্র শলাকা হচ্ছে  বিড়ি। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামীণ এলাকাতে সিগারেটের বিকল্প হিসেবে বিড়ি খুবই জনপ্রিয়। ভারতবর্ষের বড় বড় তামাক কোম্পানির  পাশাপাশি বিড়ি শিল্পও অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  বিড়ি বাঁধা  আমাদের দেশের অন্যতম একটা কুটিরশিল্প। এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে রয়েছে জেলার অর্থনীতি।  গ্রামের বহু  মানুষের  জীবিকা হলো  এই বিড়ি বাঁধা।  বিড়ি বাঁধতে ব্যৱহৃত হয় তামাক, কেন্দুপাতা ও সুতো। এটি কুটিরশিল্প হলেও  পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার আওরঙ্গবাদ অঞ্চলে প্রায় ২০-৩০ টা  ছোট বড় বিড়ির কারখানা রয়েছে। এই সব কারখানাগুলো থেকে দৈনিক প্রায় ৩০-৩৫ কোটি  বিড়ি উৎপাদন হয়। বিড়ি বাঁধাই এই অঞ্চলের বহু পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। এই আয়ে থেকেই পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয়। এই শিল্পের সাথে বেশ কয়েকলাখ শ্রমিক জড়িয়ে রয়েছে। সারা বিশ্বেই ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলোকে  নিয়ে প্রচারের মাধ্যমে  মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে।  পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য রাজ্য সরকার ও ভারত সরকার একইভাবে সচেতন করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রচার করে চলেছে।  তামাক বিক্রয়ের সাথে দেশের ও রাজ্যের বিরাট পরিমানের শুল্ক আমদানি হয়।  তাই এই শিল্প বন্ধ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।




ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২৪-১১-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Sunday, November 10, 2019

ঘাটশিলা >

নিরুদ্দেশের যাত্রা .......


ঘাটশিলা স্টেশন 

ভ্রমণ সব সময়ই আনন্দদায়ক। তা সে নিকটবর্তী স্থান  বা দুর ভ্রমণ হোক।  একঘেয়ে জীবনযাত্রার থেকে বেরিয়ে  একটু বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য দু দিনের ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়া। ব্যস্ত জীবনে বা সংসারের যাঁতাকল থেকে একটু মুক্তি,  একটু অন্যরকম আনন্দ খুঁজে নেওয়ার জন্য দুই বন্ধু অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। কোথায় যাবো, কোন ঠিকানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেব, কিছুই ঠিক না করে সকাল সকাল  হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।  স্টেশনের বোর্ডে দেখলাম ৬.৫৫ মিনিটে ইস্পাত এক্সপ্রেস ছাড়বে। মলয় বললো চলো এটাতে করে টাটানগর যাই, ফেরার পথে গালুডি বা ঘাটশিলা যাবো।  কিছু না ভেবে টাটানগর পর্যন্ত দুটো টিকিট কেটে দুজনে ট্রেনে উঠে পড়লাম। মলয় বললো টাটানগর প্রথম যাই, ওখানে একরাত্রি থেকে পরের দিন  গালুডি বা ঘাটশিলা ঘুরে হাওড়া ফিরে আসবো।  ওর মতামতে আমি রাজি হতে পারলাম না।  ওকে বললাম,  মাত্র দুটো দিন অর্থাৎ  ৪০ ঘন্টা ভ্রমণের সময়, তার মধ্যে তিন -সাড়ে তিন ঘন্টা করে ট্রেনে যাওয়া ও আসা,  ঘন্টা আট -নয় রাতে ঘুমোনো বাদ দিলে  হাতে ঘোরার জন্য থাকলো মাত্র ২৪-২৫ ঘন্টা। এতো কম সময় দু-জায়গায় ঘুরতে গেলে কোনোটাই ভালোভাবে দেখা হবে না, ঘোরার  আনন্দটাই বিফলে যাবে। আমার মনে হয় তার চেয়ে ভালো  আমরা ঘাটশিলাতেই নেমে মেঠো পথ ও পাহাড়ি ঝর্ণা দেখে দুটো দিন কাটিয়ে দেবো।  মলয় আমার কথা ফেলতে পারলো না। দুজনের মতের মিলে অবশেষে পথের ঠিকানা মিলল। ঠিক হলো আমরা ঘাটশিলাতেই এবারের ছুটিটা উপভোগ করবো। আমরা সাড়ে দশটা নাগাদ ঘাটশিলা পৌঁছলাম। স্টেশনের পাশেই একটা হোটেল ঠিক করে ব্যাগ পত্তর রেখে, একটু  ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ঘাটশিলা পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত ছিল।  বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলার একটি সুন্দর ছোট্ট শহর। শহরটি সুবর্ণরেখা নদীর তীরে অবস্থিত পাহাড়ে ঘেরা বনভূমি অঞ্চল। বাঙালিদের কাছে বরাবর খুবই আকর্ষণীয়, বর্তমানে বাঙালি পর্যটকদের কাছেও সমান আকর্ষণীয় স্থান। চারধারে অনুচ্চ পাহাড়, মাঝে আপনবেগে বয়ে চলা পাগলপারা সুবর্ণরেখা  নদী। তার সাথে বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের স্মৃতিমাখা পথ ঘাট। অতীতে বহু বাঙালি স্বাস্থ্যউদ্ধারের উদ্দেশ্যে এখানে এসে বেশ কিছুদিন করে বসবাস  করতো।  অতীতে এখানেই ধলভূম রাজ্যের রাজধানী ছিল।

ঘাটশিলা রামকৃষ্ণ মিশন 
আমরা প্রথমে রাস্তায় একটু জলখাবার ও চা খেয়ে একটা অটো ভাড়া করে চললাম দাহিঘরা অঞ্চলে অবস্থিত রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমে। বেশ সুন্দর নিরিবিলি স্থানটি। মিশনের অন্যান্য আশ্রমগুলির পরিবেশ যেরকম থাকে,  এখানেও ঠিক সেরকম পরিবেশই বজায় রয়েছে। আশ্রমটি ১৯৩৫ সালে তৈরী করা হয়।  ২০০৪ সালে এটি বেলুড় মঠ ও মিশনের  অধীনে আসে।  ঢুকতেই সামনে একটি ছোট্ট সুন্দর মন্দির পড়ল, মন্দিরে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের মূর্তি বিরাজ করছে।  এদের কর্মযজ্ঞের মধ্যে দেখলাম বিনামূল্যে দুস্থদের চিকিৎসা কেন্দ্র, গদাধর অব্যুধ্যয় প্রকল্পে তৈরী কম্পিউটার শিক্ষা কেন্দ্র, ফিজিওথেরাপি কেন্দ্র রয়েছে।  এছাড়া এখান থেকে নানারকম অনুষ্ঠান করা হয়। গরিব দুঃখীদের  কম্বল, ঔষধ, জামাকাপড় ইত্যাদি প্রয়োজনে বিনামূল্যে দান  করে  থাকে। এবার আমাদের যাওয়ার কথা গৌরীকুঞ্জ।

পৌঢ়  বয়সে বিভূতিভূষণ রমাদেবীকে বিবাহ করলেও তাঁর প্রথমা  স্ত্রী গৌরীদেবীকে তিনি ভুলতে পারেননি। ঘাটশিলার সুবর্ণরেখা নদীর কূলে তিনি একটা ছোট্ট কুটির কিনে তার নাম রেখেছিলেন গৌরী দেবীর নামে।  তিনি কুটিরটির  নাম "গৌরীকুঞ্জ" রেখেছিলেন।
বিভূতিভূষণের বাড়ি 
গৌরীকুঞ্জ হলো সেই বাড়ি যেখানে বিভূতিভূষণের স্মৃতিমাখা সংগ্রহশালাটি রয়েছে  আমাদের অটো ঘুরিয়ে নিয়ে কিছুটা পথ এগোতেই একটা ছোট রাস্তা একটু নিচের দিকে নেমে গেছে, এই রাস্তাটির নামটা ভারী সুন্দর। বিভূতিভূষণের স্মৃতিজড়ানো নাম "অপুর পথ", নামটা আমার বেশ লাগলো। গৌরীকুঞ্জে ঢোকার পর প্রথমেই দেখলাম পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা।  ভিতরে ঢোকার জন্য একটা বড় প্রবেশদ্বার তৈরী করা আছে।  প্রবেশদ্বারের ভিতরে সাহিত্যিকের  একটা মর্মর মূর্তি  স্থাপন করা আছে। বাড়ির শেষ প্রান্তে "অপুর পাঠশালা" নামে  একটা বাংলা শিক্ষার পাঠশালা গড়ে তুলেছে গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি। ঝাড়খণ্ডের বাঙালি সন্তানদের বাংলা শেখার কোনো সুযোগ না থাকার কারণে পাঠশালাটি গড়ে তোলা হয়েছে।  এটা ঠিক প্রথাগত শিক্ষা কেন্দ্র নয়, বাংলাশিক্ষার কোনো কোর্স নেই। বাচ্ছারা যাতে মনের আনন্দে বাংলা শিখতে পারে সেটাই লক্ষ্য পাঠশালাটির। এখানে বর্ণপরিচয়, সহজ পাঠ যেমন শেখানো হয় তেমন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এরকম দিক্পালদের রচিত উপন্যাস  ও ছোট গল্পও গল্পের মাধ্যমে পড়ে শোনানো হয়। পাঠশালার আসল উদ্দেশ্য হলো  বাংলা সাহিত্যের প্রতি উৎসাহ তৈরী করা। এই পাঠশালার পাশেই  সাহিত্যিকের পুত্র তাড়াদাসের  নামে নামাঙ্কিত একটা মঞ্চ রয়েছে। ভিতরে দুটি ঘর নিয়ে তৈরী  সংগ্রহশালায়  দেখলাম সাহিত্যিকের ব্যৱহৃত সব সামগ্রীগুলোকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে। তাঁর ব্যৱহৃত জামা-কাপড়, কলম, পাণ্ডুলিপি অনেককিছু রয়েছে। দুটি ঘর, প্রশস্থ বারান্দা, গাছ-গাছালিতে ঘেরা সুনিবিড় এক শান্তির নীড়। সংগ্রহশালার ঘর  দুটিতে পা
অপুর পাঠশালা ও তারাদাস মঞ্চ 
ছোঁয়াতেই বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা আমার অজান্তেই নুইয়ে পড়ল। প্রকৃতির সাধক ব্যক্তিগত জীবনে কত অনাড়ম্বরভাবে জীবন কাটাতেন, তাই লক্ষ্য করছিলাম। অপু-দুর্গার স্রষ্টা, প্রকৃতি প্রেমিক, প্রকৃতির বুকেই কিভাবে জীবন পরিচালনা করতেন, তাই দেখছিলাম।  তাঁর কলম তুলিতে আঁকা প্রকৃতিকে তো আমরা চিনতে শিখেছি তাঁরই গল্পের মাধ্যমে।  জীবনের অনেকটা সময় তিনি এখানে অতিবাহিত করেছেন।  এখানেই ১৯৫০ সালে তাঁর জীবন সংগ্রামের ইতি ঘটেছে।

এখান থেকে আমরা রওয়ানা দিলাম এখানকার বিখ্যাত  রঙ্কিনী মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে। এখান  থেকে মন্দির যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে একটা হোটেলে দুপুরের আহারটা সেরে নিলাম।  বিস্তীর্ণ একটা চত্বরের মধ্যে লাল রঙের একটা মন্দির। গর্ভগৃহে অষ্টভুজা মূর্তি বিরাজ করছে, পাদপ্রদীপে শিবমূর্তি রয়েছে।   চত্বরের মধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গায় হাড়িকাঠ রয়েছে।  বেশ জাগ্রত মন্দির। ভয়ঙ্করী দেবী বলে সকলে তাঁকে ভয় করেন আবার বিপদে আপদে তাঁকেই স্মরণ করেন।  জন্মাষ্টমীতে বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।  শুনলাম অষ্টমী ও নবমীতে এখানে খুব ঘটা  করে মোষ বলি দেওয়া হয়।  বর্তমানে পশুবলি সারা দেশে যখন আইনত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে,  তখন  কি করে এখানে পশুবলি দেওয়া হয়, ঠিক বুঝতে পারলাম না ও বিশ্বাসও  করতে পারলাম না।  যাই  হোক, মন্দিরটা খুব ভালো লাগলো। আনুমানিক তেরোশো খ্রীষ্টাব্দের  কথা, তখন পরম শক্তিশালী রাজা ছিলেন জগৎ দেব। কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি তাঁর রাজধানী এখানকার জঙ্গলে স্থানান্তরিত  করেন। এখানেই তিনি তাঁর গড় প্রতিষ্ঠা করেন এবং নাম দেন ধলভূমগড়।  কথিত আছে দেবী রঙ্কিনীর স্বপ্নাদেশ  পেয়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত  নিয়েছিলেন।  তিনি গালুডির শালবনে  রঙ্কিনী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।  পরবর্তীকালে সেই মন্দির স্থানান্তরিত করা হয় ঘাটশিলায়।

গালুডি বাঁধের রাস্তা 
ওখান থেকে এবার আমাদের গন্তব্য গালুডি বাঁধ। ঘাটশিলা থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে এই বাঁধ।  প্রকৃতির বৈচিত্রে ভরা অঞ্চল হল গালুডি। এটাও বাঙালিদের স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য আদর্শ জায়গা, প্রকৃতির কোলে দু-একদিন থাকলে স্বাস্থ্য  ও মন দুটোই ভালো হতে বাধ্য।   গালুডি স্টেশন পার হয়ে কিছুটা এগোতেই এই বাঁধের ধারে  আমরা পৌঁছে গেলাম। সূর্যিমামা তখন সুবর্ণরেখার জলে ডুব দিয়ে দিয়েছে। শক্ত পোক্ত বাঁধের ওপর বেশ চওড়া রাস্তা এপার থেকে ওপার  চলে গেছে।  সুবর্ণরেখা ফুঁসছে তাকে বেঁধে রাখার
গালুডি বাঁধে সূর্যাস্ত 
ক্ষোভে। তারই  মাঝে একদল লোক খেপলা জাল দিয়ে মাছ  ধরতে ব্যস্ত।  পাহাড়ের লাল আভা মাখা রূপ ও প্রকৃতির অপরূপ রূপ আমাকে মুগ্ধ করে দিল।  প্রকৃতি ও আধুনিক সভ্যতা যেন এখানে অঙ্গাঙ্গিভাবে একে  অপরকে জড়িয়ে রেখেছে।মন ভোলানো দৃশ্য কিছুক্ষন হারিয়ে যাওয়ার জন্য যেন অপেক্ষা করে রয়েছে। এবার আজকের মত আমাদের ঘোরা শেষ হয়ে গেলো এবার ফেরার পালা।

হোটেলে ফিরে  একটু বিশ্রাম নিয়ে  আবার বেরোলাম। প্রথমে একটু চা ও সিঙ্গারা খেলাম। তারপর এখানকার জনবাসীদের জীবনযাত্রার একটা ছবি মনে গেঁথে  রাখতে বাজার  এলাকাটা একটু ঘুরলাম। নানারকম পসরার দোকান রয়েছে, তবে দোকানগুলো কয়েকটা ছাড়া খুব একটা সাজানো নয়, তবে ক্রেতার কোনো অভাব আছে বলে মনে হলো না। বেশিরভাগ দোকানগুতেই অল্প হলেও  ক্রেতা রয়েছে। বাড়িগুলো বেশ পুরোনো।  একটা বেশ বড় বাড়ি ( সাত কি আট তলা হবে ) দেখতে পেলাম, সেই বাড়িটার তলায় বেশ বড় একটা জামা-কাপড়ের দোকান ঝলমল করছে।  বাজারে বেশ কিছুক্ষন কাটানোর পর আমরা স্টেশনে অনেকটা সময় কাটালাম।  স্টেশনটা পুরোনো আমলের বাড়ি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তবে স্টেশন চত্বরে আলোর বড়োই অভাব রয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে দশটার মধ্যে হোটেলে ঢুকে গেলাম।

পরেরদিন সকাল ৯ টার মধ্যে হোটেল ছেড়ে দিতে হল।  হোটেল ছেড়ে জলখাবার খেয়ে আবার একটা অটো ভাড়া নিয়ে চললাম ছোটবেলায় পড়া ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ফুলডুঙরি পাহাড়ে পাণ্ডবদের অভিযান গল্পের কথা ভাবতে ভাবতে ফুলডুঙরির পথে। ঘাটশিলার কাছেই রহস্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে

প্যাডেল বোর্ড ও বুরুডি জলাশয় 
আছে এই ফুলডুঙরি পাহাড়।  শাল, পিয়াল, মহুয়া ও কত জানা অজানা বিশাল বিশাল গাছে পরিবেষ্টিত এই মাঝারি মাপের পাহাড়টি। বেশ একটা আরণ্যক পরিবেশ। ছায়ামাখা পথ টিলা ঘিরে উঠেছে, সঙ্গী করেছে সবুজ বনানীকে। পাহাড়ের ওপর থেকে শহরটি দেখা মনোমুগ্ধকর লাগলো। এই পাহাড় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের  খুবই প্রিয় ছিল।  তাঁর অনেক সৃষ্টির মধ্যে পাহাড়টিও অমর  হয়ে রয়েছে। এবার ঘাটশিলার সবচেয়ে মনোরম জায়গা বুরুডি  লেক ও ধারাগিরি ঝর্ণা দেখতে চললাম।


বুরুডি লেক 
পাকা রাস্তা ছেড়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তা এঁকে বেঁকে চলেছে, রাস্তাটিতে অজস্র গরু, মোষ, ছাগলের চলাফেরা রয়েছে, তাদের কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। তিনদিকে পাহাড়ে ঘেরা মাঝখানে এই সৌন্দর্য্যে মোড়া  জলাশয়টি। পাহাড়ি ঝোরার জল ধরে তৈরী হয়েছে সরোবরটি। নীলচে-সবুজ জল। বিস্তীর্ণ উপত্যকা, চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা।  রোদে ঝলমল করছে জলরাশি, তার মধ্যে পাহাড়ের ছায়া, পাহাড়ের ছায়াগুলো জলে পড়ায় দারুন লাগছে।  প্রথম দেখাতেই এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।  কি সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য।  কি অপূর্ব জলরাশি, পাহাড়ের কোলে বাতাসে দুলে দুলে উঠছে।  তার মধ্যে বেশ কয়েকটি রঙিন প্যাডেল বোট  চলাফেরা করছে।  বহু পর্যটক এই বোটগুলো ভাড়া করে কিছুক্ষন ঘুরে ঘুরে সমগ্র প্রাকৃতিক পরিবেশটা উপভোগ করছে।  আমরাও একটা বোট ভাড়া নিয়ে কিছুক্ষন পরিবেশের সাথে নিজেদের শহুরে শরীরটাকে একটু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম  এবার ধারাগিরির  ধারা দেখবো।

গিরিখাতের মাঝ দিয়ে জলের ধারা এসে এক অপরূপ ঝর্ণার সৃষ্টি করেছে। বুরুডি থেকে ধারাগিরি রাস্তাটা পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে বলে অটো চালক ভাইয়া জানালো।  দুপাশে পাহাড় আর মাঝখানে ঝর্ণার মৃদু মন্দ জলের আওয়াজ আর মাঝে মাঝে পাহাড়ি পাখিদের ডাক এক কথায় অসাধারণ।  যাওয়ার পথে দেখছিলাম পাহাড়ের গায়ে আদিবাসীরা চাষ করছে। এখানকার জল সরকারিভাবে পরিশুদ্ধ করে কাছের গ্রামগুলোতে সরবরাহ করা হয়।  অটো ভাইয়া আমাদের বললো পেট ভরে জল পান করে নিন, এই জল হজমের পক্ষে খুবই ভালো। আমরা পেট ভরে জল পান করে নিলাম।   এবার আমাদের ফেরার পালা, কারণ দুপুর সাড়ে তিনটের সময় আমাদের ট্রেন তার মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে হবে। সেই কারণে হাতে আর সময় নেই।  তাড়াতাড়ি করে ফিরে আসলাম।

দুটো দিন কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না , নির্ভেজাল অক্সিজেন দুদিন ধরে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসলাম। মনে এক রোমাঞ্চকর আবেগ  বেশ কিছুদিন ধরে রাখার চেষ্টা করলাম।  এখানকার স্মৃতি সত্যিই ভোলার নয়।   এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।


কিভাবে যাবেন : 

হাওড়া থেকে প্রতিদিন সকাল ৬-৫৫ মিনিটে ছাড়ছে হাওড়া-তিতলাগড় ইস্পাত এক্সপ্রেস।ঘাটশিলায় পৌঁছয় বেলা ৯-৫৪ মিনিটে। ১২৮৬৫ আপ লালমাটি এক্সপ্রেস মঙ্গল ও শনিবার সকাল ৮-৩০ মিনিটে ছেড়ে ঘাটশিলায় পৌঁছয় ১১-৩৮ মিনিটে। ১২৮১৩ স্টিল এক্সপ্রেস বিকাল ১৭-৩০ মিনিটে হাওড়া ছেড়ে ঘাটশিলায় পৌঁছয় রাত ২০-৩৬ মিনিটে। এ ছাড়াও সকাল ৯-৩০ মিনিটে হাওড়া ছেড়ে একটি লোকাল ট্রেন ঘাটশিলা যাচ্ছে ১৩-৪০ মিনিটে। খড়্গপুর থেকেও ট্রেনে ঘাটশিলা যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন:
ঘাটশিলা স্টেশনের কাছে অজস্র হোটেল রয়েছে।  দরদাম করে একটাতে উঠে পড়লেই হল। তবে আমার মতে সবথেকে ভালো হয় যদি রামকৃষ্ণ মিশনে আগে থেকে ব্যবস্থা করে থাকা যায়। 



ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ ১০- ১১-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Sunday, October 27, 2019

কেওড়াতলা শ্মশান ও শ্মশানকালী>

কেওড়াতলা শ্মশান ও শ্মশানকালী



শ্মশান মানে শবদেহ দাহ করার স্থান। এ এমনি এক স্থান যেখানে প্রত্যেক মানুষকে কারোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার জন্য বা নিজের আন্তষ্টির সময় মৃত অবস্থায় যেতেই হয়। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই বেশিরভাগ শ্মশানেরই অবস্থান কোনো না কোনো নদীর তীরে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে দ্বারকা নদীর তীরে তারাপীঠের মহাশ্মশান, কোপাই নদীর তীরে কঙ্কালীতলার মহাশ্মশান। তেমনি কেওড়াতলা মহাশ্মশানটিও আদি গঙ্গার তীরে অবস্থিত। বহু সাহিত্যিকের কলমে শ্মশানের কথা বার বার উঠে এসেছে।  যদিও শ্মশানের চরিত্র বর্তমানে  সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কাঠের বদলে এসে গেছে বৈদ্যুতিক চুল্লি। আগের আলো-আঁধারি ভয়াবহ পরিবেশও পাল্টে হয়ে উঠেছে আলো ঝলমলে। মৃত্যু মানে জীবনের শেষ, তারপর দাহ পদ্ধতির মাধ্যমে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া। এখানে আসলে মনে হবে যেন এটাই বুঝি পৃথিবীর শেষ স্টেশন। 'শ' শব্দটির অৰ্থ শব অর্থাৎ মৃতদেহ আর 'শ্মান' শব্দটির অর্থ হলো শান বা বিছানা।  শ্মশানে আসলেই সব সময় শোনা যায় "বল হরি, হরি বোল" বা "রাম নাম সত্য হ্যায়" কথাগুলো। "হরি" বলতে বোঝায় যিনি জন্ম-মৃত্যু, জড়া-ব্যাধি হরণ করেন। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে ভগবান রাম যিনি সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাভূত করতে সক্ষম। তাই বিশ্বাস অনুযায়ী রামের নাম করলে আত্মার মুক্তি মেলে। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ শ্মশানেই কালী মন্দির দেখা যায় বা শ্মশান কালীর পুজোও  হতে দেখা যায়।




রাসবিহারী মোড় থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে সেতু পার হয়ে চেতলার দিকে। ওই সেতুতে ওঠার ঠিক আগে একটা মোড় পড়বে।  এই মোড়ের ডানদিকে পড়ে কালীঘাট অঞ্চল ও বিখ্যাত কালীমন্দিরটি আর বামদিকে পড়ে টালিগঞ্জ অঞ্চল ও বিখ্যাত কেওড়াতলা মহাশ্মশানটি।

কথিত আছে, এই বাঁদিকের অঞ্চলটিতে  পূর্বে কেওড়া গাছের জঙ্গল ছিল, সেই থেকে অঞ্চলটির নাম কেওড়াতলা হয়।  কেওড়াতলা শ্মশানটি বৃহৎ ও কলকাতার অন্যতম প্রাচীন শ্মশান। শ্মশানটির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আদি গঙ্গা। শ্মশানটি পূর্বে এই স্থানে ছিল না, কালীঘাট মন্দিরসংলগ্ন ঘাটে এর অবস্থান ছিল। শবদেহ দাহ করার সময় কালো ধোঁয়ায় মন্দিরটি ও অঞ্চলটি ভরে যেত। সমগ্র  অঞ্চলটিতে একটা অস্বাস্থ্যকর  পরিবেশ তৈরী হচ্ছিল। কলকাতা পৌরসংস্থা গঠন হওয়ার পর কালীঘাট মন্দিরের কাছে বর্তমান জায়গায় অর্থাৎ কেওড়াতলায় দুই বিঘা জমি নিয়ে শ্মশানটিকে স্থানান্তরিত করা হয়। শ্মশানটির ডান দিকে মায়ের ৫১ পীঠের এক পীঠ (কালীর মন্দির) ও নকুলেশ্বর ভৈরব মন্দির  থাকায়  জায়গাটা খুবই পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। শ্মশানটিকে তাই মহাশ্মশান বলা হয়।

বহুদিন যাবৎ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় ছিল। দহনের পোড়া কাঠ ও ভষ্মে জায়গাটা সব সময় অপরিষ্কার হয়ে থাকতো।  শ্মশানযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য কোনো ভালো জায়গা  ছিল না। কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত গঙ্গানারায়ণ হালদারের পত্নী শ্রীমতি বিশ্বময়ী দেবী শ্মশানঘাটটিকে বাঁধিয়ে দেন এবং পরবর্তীকালে তিনি শবযাত্রীদের বসার জন্য বিশ্রামাগার ও প্রবেশপথে একটা সুবিশাল তোরণ তৈরী করে দেন।  স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় কিছুটা  আধুনিকরণ ও সংস্কার করেন।  ২০০৪  ও ২০০৫ সালে পৌরসংস্থা বেশ কিছু টাকা ব্যয় করে আরো কিছু সংস্কার করে দেয়।  সেই টাকাতে নতুন  বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানো ও চত্বরটি সাজানোর কাজ করা হয়।  শবযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য উপযুক্ত একটি বিশ্রামাগার তৈরী করা হয়।  পরবর্তীকালে পৌরসংস্থা বিশ্রামাগারটিকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত করে দেয়। তার ফলে পুরোনো কাঠের শ্মশানটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। শ্মশান সংলগ্ন স্থানে ভারী সুন্দর, মনোরম একটা  বাগান তৈরী করা হয়েছে। গার্ডেনটির নাম "মাইসোর  গার্ডেন"। পৌরসংস্থা বর্তমানে আরো  সুন্দরভাবে গার্ডেনটিকে  সাজিয়ে দিয়েছে।

কলকাতার বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের শব এখানে দাহ করা হয়েছে। তাঁদের কয়েক জন যেমন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখ্যোপাধ্যায় প্রমুখের স্মৃতিসৌধ করা আছে। এছাড়া জীবনানন্দ দাশ, সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, নেলী সেনগুপ্ত, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু,  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখ ও আরো কত গন্যমান্য ব্যাক্তিত্বের দেহ এখানেই দাহ করা হয়েছে। এটি কলকাতা শহরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা শ্মশান বলে বিবেচনা করা হয়।

স্বজন হারানোদের কান্নায় যাদের দিন অতিবাহিত হয়, সেই ডোমরাই কেওড়াতলা শ্মশানে কালীপূজার রাতে  মায়ের আরাধনায় মত্ত হয়ে ওঠেন। সারা বছর শবদেহ ঘেটে যাদের জীবন চলে তারাই এই পুজোর মূল উদ্যোক্তা। পূজার রাতেও ওদের ছুটি নেই, শবদেহ আসলেই দাহ করার জন্য ওদের ছুটতে হয়। কর্তব্য পালন করেই তারা পরিবার নিয়ে উৎসবে সামিল হন। শববাহী যাত্রীদের কাছ থেকে কোনো প্রকার চাঁদা তোলা হয় না, স্থানীয় ব্যবসাদার ও  নিজেদের রোজগারের পয়সায় সম্পূর্ণ আয়োজন করা হয়। সমস্ত নিয়ম নীতি মেনেই ব্রাহ্মণ পূজা করে থাকেন। বাংলার অন্যান্য শ্মশানের মতো এখানেও খুব ঘটা করে পূজা করা হয়ে থাকে। কথিত আছে ১৮৭০ সালে একজন কাপালিক দুজন স্থানীয় ব্রাহ্মণের সাহায্যে শ্মশানকালী প্রতিষ্ঠা করেন। কাপালিক নিজের আনা  প্রতিমাতেই  পূজা করেন এবং পূজার পর প্রতিমা নিয়ে তিনি ফিরে যান। সেই প্রতিমা ছিল দুই হাত বিশিষ্ট ও প্রতিমার কোন জিহ্বা ছিল না। সেই থেকে এখানে ওই ধরনের মূর্তিই পূজিত  হয়ে চলেছে।  এখানকার মূর্তির দুটো হাত অর্থাৎ দেবী দ্বিভূজা। এক হাতে মাটির তৈরী নরমাংস থাকে  আর এক হাতে কারণবারি থাকে। দেবী ,মূর্তি উচ্চতায় ২২ ফুট। প্রতিবছর নিয়ম করেই শ্মশানকালীর পূজা করা হয়, যা আজও সমানভাবে চলে আসছে। দীপান্বিতা অমাবস্যায় মহাসমারোহে নিষ্ঠাভরে এই পূজার আয়োজন করা হয়। এখানে তান্ত্রিক মতে পূজা করা হয়। এখানে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। দেবীকে মুড়ি, চানাচুর, সিঙ্গারা, আট কড়াই ভাজা, ১৪ রকম মাছ, খিচুড়ি, পোলাও, সাদা ভাত ভোগ হিসেবে দেবীকে নিবেদন করা হয়।  এছাড়া বলির মাংসও মেক ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। ১৯২৪ সাল থেকে একটা সর্বজনীন পূজাকমিটির তত্ত্বাবধানে পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর ভাইফোঁটার দিন শ্মশানকালির বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখার মত হয়।  অঞ্চলের অধিবাসীরা এই শোভাযাত্রা চাক্ষুষ করা "খুবই পবিত্র" বলে মনে করে থাকে। আমি দেখেছি, এই শোভাযাত্রার সময় অধিবাসীরা  যাত্রা পথে নিজ নিজ বাজী পুড়িয়ে শোভাযাত্রাটির শোভা আরও বাড়িয়ে তোলে। শোভাযাত্রা যাওয়ার সময় দর্শনার্থীরা সবাই মিলে উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি  দিয়ে থাকে। শোভাযাত্রা থেকে ফুল ও বাতাসা দর্শকদের উদ্দেশ্যে ছোড়া হয়, সেই ফুল ও বাতাসা নেওয়ার জন্য বেশ হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সত্যিই এক অনবদ্য শোভাযাত্রা হয়ে থাকে।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :২৭-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Wednesday, October 23, 2019

ভালোপাহাড় >

ভালোপাহাড়  
রূপকথা না বাস্তব  





প্রবেশ দ্বার 

সেদিন মলয়ের দোকানে একটু আড্ডা মারার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। মলয় মানে আমার বন্ধু  মলয় সোম।  আড্ডা দিতে দিতে ও হঠাৎ বললো ভালোপাহাড় যাবে নাকি, আমি ২০ তারিখে যাচ্ছি। তখন ভালোপাহাড় সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা ছিল না। মলয় জানালো পাহাড় বলতে আমাদের যা ধারণা তার সাথে এখানে কোনো মিল নেই, এটা একটা ম্যান মেড অরণ্য। তবে ছোট ছোট পাহাড়তো অবশ্যই দেখতে পাবে। পাহাড় ও অরণ্যের মাঝে মানুষের তৈরী আর এক অরণ্য।  এই সামান্য কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম। যাই হোক ২০ তারিখে সকাল ৭ টায় ইস্পাত  এক্সপ্রেসএ টিকিট কাটা হলো। মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন কিলবিল করতে লাগলো ভালোপাহাড়টা কে বা কারা তৈরী করেছে, কোথায় এর অবস্থান। সেই মানুষটার বা মানুষগুলোর নামই বা  কি? মলয় কোনোটারই উত্তর দিতে রাজি হলো না, বললো আগে থেকে সব বলে দেওয়া যাবে না, ওখানে গিয়ে সব কিছু চাক্ষুষ করে মজা উপভোগ করবে। মনে মনে বললাম তবে তাই হোক।

পরের রবিবার ২০ তারিখে ইস্পাত এক্সপ্রসে টিকিট কাটা হল। যথারীতি ২০ তারিখ সকাল ৬ টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।  ট্রেন প্রায় দেড় ঘন্টা দেরিতে ছাড়লো।  আমরা ১২টা  নাগাদ গালুডি স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।  ওখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভালোপাহাড়।  অটো রিক্সা বলা ছিল। দীপকের অটো করে মিনিট ৪৫-এর মধ্যে আমরা ভালোপাহাড়ে পৌঁছে গেলাম।

শ্রদ্ধেয় শ্রী কমল চক্রবর্তী 

ওখানে পৌঁছে দেখলাম রাস্তার ধারে বিশাল একটা লোহার দরজা, দরজার ওপরে বড় বড় হরফে "ভালোপাহাড়" কথাটা লেখা আছে, গেটের পাশের দেওয়ালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  ও বিদ্যাসাগরের বাণী লেখা রয়েছে। ভিতরে  ঢুকে কি দেখবো তাই নিয়ে আমার মনটা ছটফট করছে। ভিতরে ঢুকে সবুজ অরণ্য দেখে মনটা স্নিগ্ধ ও শান্ত হয়ে গেলো।  ভালোপাহাড় হলো পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ানে অবস্থিত একটা সোসাইটি। এক পঞ্চপাণ্ডবের সোসাইটি। যাদের মূলমন্ত্র প্রচুর গাছ লাগানো ও মানব সেবা। ভিতরে গিয়ে আলাপ হল এক বিশাল মজার মানুষ বৃক্ষের পূজারী শ্রদ্ধেয় শ্রী কমল চক্রবর্তী   মহাশয়ের সঙ্গে।  প্রথম আলাপেই কথার ভাঁজে  উনি আমাদের মাতিয়ে দিলেন ।


বাচ্ছারা স্কুলে যাচ্ছে 

ভালোপাহাড় সম্বন্ধে জানতে হলে বছর পঁচিশ আগে ফিরে যেতে হবে।  সালটা ছিল ১৯৯৬।  পাঁচ বন্ধু মিলে  তখন টাটা বাবাজির শহরে বসে সাহিত্য চর্চা করতেন। "কৌরব" নামে  একটা বাংলা পত্রিকা চালাচ্ছিলেন। সবাই তখন বেকার। আড্ডা, কবিতা, গল্প, নাটক, গান ও বিখ্যাত সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য সভা করতেন। ১৯৬৮ সাল  নাগাদ কমল চক্রবর্তী, সুভাষ ভট্টাচার্য, অরুন আইন, শক্তিপদ হালদার ও বারীন ঘোষাল জামশেদপুরের এই পাঁচজন একত্রিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দেবজ্যোতি দত্ত এঁদের সাথে যুক্ত হন। এরা সেই সময় কবিসঙ্গ লাভ ও প্রকৃতিকে দেখার জন্য সারা পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন।  শান্তিনিকেতনের পান্নালাল দাসগুপ্তের তৈরী "টেগোরে সোসাইটি" দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, পঞ্চপাণ্ডবের  মাথায় তখন  কিছু একটা করার জন্য বাসনা জাগলো।  ঠিক করলেন কিছু একটা করতেই  হবে। ১৯৭১ সালে তারা প্রথম কৌরব নামে পত্রিকাটি বের করেছিলেন, যা আজও চলে আসছে।

ভালোপাহাড়ের পিছনের দৃশ্য 

এই পঞ্চপান্ডবের দল একটা ভালো জমি কিনতে চান, যেখানে চাষ বাস করা যাবে।  তাঁদের পরিচিত শচীন দত্ত মহাশয় জানালেন জামশেদপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বান্দোয়ানে  ৪০ বিঘা জমি তাঁর রয়েছে যেটা তিনি বিক্রি করতে চান।  জমিটি বড় রাস্তার ধারে অনাবাদি পাথুরে জমি।  জমিটি তাঁদের পছন্দও না হলেও তাঁরা কষ্ট করে জমিটি কিনলেন। ১৯৯৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর "ভালোপাহাড়" নাম দিয়ে একটা সোসাইটি গঠন করা হলো। সেই থেকে দলমা  ও রুমাই পাহাড়ের পাদদেশে ভালোপাহাড়ের চলা শুরু হল। "ভালোপাহাড়" আসলে একটা নন-প্রফিট এনজিও। পরবর্তীকালে তাঁরা  আরো  প্রায়  ৮০ - ৯০ বিঘে জমি কেনে।

ধানক্ষেত 

পুরুলিয়ার রুক্ষ - পাথুরে ভূমিকে  অনেক কষ্ট করে পাথর কেটে জমির মাটি বের করে গাছ লাগানো হয়েছিল। বর্তমানে যেন এক সবুজ মন্দির, যেখানে বাস করে বৃক্ষনাথ, আর বৃক্ষের পূজারীরা। এক স্বাধীন বাঁধনহারা  অরণ্য যেখানে গাছেদের  লম্বা লম্বা হাত যেন জড়িয়ে ধরে।   চারদিকে প্রচুর গাছ। কয়েক লক্ষ গাছ হবে। বর্ষার শেষে  ডালে ডালে কচি পাতার ঝালর। জানা ও অজানা কতরকম  ফুলে ভর্তি।  গঙ্গাফড়িং লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।  গাছে গাছে নানারকম পাখির দল  খেলে বেড়াচ্ছে।  পাতি হাঁস, রাজ হাঁস ও মুরগিও খেলে বেড়াচ্ছে। সূর্যদেবতা পাটে  গেলে একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া খেলে বেড়ায়। 

গোয়াল ঘর 

চারদিকে একটা জমজমাট নিঃশব্ধতা বজায় রয়েছে। গাছের পাতায় পাতায় শুধু জোনাকির আলো মিটিমিটি করে জ্বলছে। বৃক্ষগুলো জোনাকির আলোতে যেন  জলসার আসর বসিয়েছে। হওয়ার দোলায় তাদের মৃদুমন্দ আওয়াজ মন ভরিয়ে তুলছে।  এ যেন বৃক্ষ দেবতা, বৃক্ষনাথের মন্দির। দিব্য দর্শনে অনুভব করা  বৃক্ষনাথের শোভা। ঘুম ভাঙতে ভোরের আলোতে পাখিদের গান মনে উদ্দীপনা তৈরী করে দিল। সোনাঝুরি, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অশ্বত্থ, বট, শাল, সেগুন, শিমুল, গামার, তেতুল, কাঁঠাল, রুদ্রাক্ষ, চেরি, আপেল, আমলকি, আমড়া, চালতা, কারিপাতা এরকম কত শত বড় বড় সব গাছ রয়েছে। কয়েক বিঘে জমিতে চাষের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে  প্রায় ২৮ রকমের দেশীয় ধান চাষ করা হয়, যেগুলো আজ প্রায় অবলুপ্ত। তাছাড়া বহু রকমের সবজি চাষ করা হয়। এইসব চাষে কোনোরকম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না, সম্পূর্ণ জৈব সার ব্যবহার করে চাষ-আবাদ করা হয়।  গোয়াল ঘরে প্রায় ৪০ টা দেশি গরু রয়েছে ।  জল ধরে রাখার জন্য একটা কয়েক বিঘের  পুকুর কাটা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদিত একটা বাচ্ছাদের স্কুল রয়েছে। স্কুলটি ২০০৪ সালে তৈরী করা হয়।   এই স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত আদিবাসীদের গ্রামগুলো থেকে বাচ্ছারা এখানে পড়তে আসে।  স্কুলে প্রায় ২০০ টি বাচ্ছা  নিয়মিত লেখা-পড়া করে। বাচ্ছাদের শিক্ষার মধ্যে নিজেদের সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে চেনানোও এদের শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে রয়েছে।  বাচ্ছাদের স্কুলে আনা নেয়ার জন্য দুটো স্কুল বাস রয়েছে।  স্কুলে পাঁচজন মাস্টারমশাই রয়েছেন।  মাস্টারমশাই  ও বাচ্ছাদের জন্য নিয়মিত দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। হলুদ - মেরুন ইউনিফর্মে বাচ্ছাগুলো যখন দল বেঁধে স্কুলে আসে, তখন দেখতে  খুব সুন্দর লাগে। বাচ্ছাগুলোর মধ্যে দেখলাম খুবই শেখার অগ্রহ রয়েছে। স্কুলে খুবই ডিসিপ্লিন বজায় আছে। শুনলাম কোনো এক বছরে এই স্কুলটা সামগ্রিক বিচারে পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিরোপা পেয়েছিল। এছাড়া কমিউনিটি ডেভেলপমেনন্টের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। গ্রামের বহু গরিবদের বিনামূল্যে জামা-কাপড় ও কম্বল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।   ২০০৬ সালে একটা দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। দু-একজন দক্ষ চিকিৎসক নিয়মিত চিকিৎসা করে থাকেন।  গ্রামের হতদরিদ্র্যদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। সল্পমূল্যে ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে।

খাবার জায়গা 
রান্নাঘর 

সবুজায়ন প্রধান হলেও এখানে  দু-একদিন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।  এখানে রান্না করা হয়ে থাকে খোলা উনুনে কাঠের আগুনে। রান্নাও সম্পূর্ণ ঘরোয়া পদ্ধতিতে করা হয়, কোনোপ্রকার আড়ম্বর এখানে দেখা যায় না।  থাকার জন্য চার-পাঁচটি ঘর রয়েছে।  ঘরগুলো খুবই সুন্দর। এদের নিজস্ব সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার দিলীপ মাহাতো, প্রদীপ পাত্র, দীপক দত্ত, শিবু তন্তুবায়, জয়তীদেবী  ও দেবেনের ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। সবাই সদা হাস্যময়, সেবায়  সবসময় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে।
টটকো বাঁধে সূর্য্যাস্ত 

 ভালোপাহাড়ের থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটা সুন্দর গ্রাম রয়েছে।  এছাড়া এখন থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে টটকো বাঁধ (ভেলু  ড্যাম) রয়েছে। এই ড্যামে সূর্যাস্তের দৃশ্য খুবই মনোরম। ঝাড়খণ্ডের সাতগুরুং নদী ও মনোরম দলমা পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে বেশ ভালো লাগে। পশ্চিমবঙ্গের দুয়াসিনি পেরিয়ে বান্দোয়ানে যেতে হয়।  দুয়ারসিনির কাছেই সাতগুরুং নদীটি তির তির করে বয়ে চলেছে। আপনি ইচ্ছে করলে এই নদীর তীরে বা দলমার কোলে কিছুক্ষন সময় অতিবাহিত করতে পারেন।  প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যেতে চাইলে এখানে অবশ্যই দুটো দিন কাটিয়ে যেতে পারেন। ভালোপাহাড় হলো একটা নেশা।  এখানে আসলে আপনিও এই নেশায় বুদ্ হয়ে যাবেন। নেশার টানে বার বার এখানে আসতে মন চাইবে। রাস্তার নৈসগ্রিক দৃশ্য আপনাকে বারবার হাতছানি দেবে।

জয় বৃক্ষনাথের জয় 


কিভাবে যাবেন :
 সকলের ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরে গালুডি স্টেশনে এসে নামুন।  ওখান থেকে ভালোপাহাড় যাওয়ার অটো পেয়ে যাবেন। তবেএখানে থাকতে হলে আগে থেকে নীচের ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করে আসতে হবে, না হলে থাকার জন্য কোনো ঘর পাওয়া যাবে না।

ঠিকানা :
কমল চক্রবর্তী , "ভালোপাহাড়", কুঁচিয়া, বান্দোয়ান, পুরুলিয়া, পিন ৭২৩১২৯

ফোন নাম্বার :
৯৪৭৪৪৬২২৩৮ এবং  ৯৪৩১১৮৬২৫০


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :২৩-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Sunday, October 6, 2019

কলকাতার প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা >

বলরাম বসু ঘাট ও কলকাতার প্রথম বারোয়ারী  দুর্গাপূজা 



ঠাকুরদালানের প্রবেশদ্বার 

দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত অঞ্চলের নাম ভবানীপুর।  এককালে বর্ধিষ্ণু বাঙালির বাস ছিল এই অঞ্চলে,  তবে বর্তমানে অঞ্চলটি সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। অঞ্চলটিতে রয়েছে বাঙালির সাথে বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন মানুষের সহাবস্থান।  এই অঞ্চলের সাথে যেমন জড়িয়ে আছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, আশুতোষ মুখার্জী, উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়ের নাম, তেমন কলকাতার বিখ্যাত দু-দুটি হাসপাতাল এস, এস, কে এম ও শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালও এই অঞ্চলেই অবস্থিত। এই অঞ্চলেই একটা ছোট্ট গলিপথ রয়েছে। বলরাম বসু ঘাট রোড। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোড থেকে আদি গঙ্গার তীর পর্যন্ত বিস্তিত এই ছোট্ট গলিটি। কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাসে এই ছোট্ট গলিটার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

২০১৯ এর  পুজোর বিজ্ঞাপন 

বলরাম বসু ঘাট আদি গঙ্গার বুকে গড়ে ওঠা এক বহু সুপ্রাচীন ঘাট।  সতী ঘাট। এই ঘাটেই সতীদাহ প্রথা বন্ধের শেষ সময় মুখার্জী বাড়ির দুই বঁধূ  সতী  হয়েছিলেন।  ঘাটে এখনো একটা সতীদাহের স্মৃতি ফলক রয়েছে, যা গঙ্গা থেকে উদ্ধার হয়েছিল বলে কথিত রয়েছে। তাই এই ঘাটকে সতীস্থানও বলা হয়ে থাকে। খুবই পুন্য ঘাট।
 
গঙ্গা থেকে উদ্ধার হয় ফলক 
রানী রাসমণি এই ঘাটে স্নান করে কালীঘাটের কালী মন্দিরে পূজা দিতে যেতেন।  রানী রাসমণির সময় স্বর্গীয় বলরাম বসু ছিলেন একজন ধনী ব্যক্তি। ঘাটটি প্রথম কে সংস্কার করেছিলেন এই নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।  কেউ বলেন রানী রাসমণি সংস্কার করে দিয়েছিলেন আবার কারো কারো মতে বলরাম বসু মহাশয় সংস্কার করেছিলেন। ঘাটেই রয়েছে দুটি শিবমন্দির ও একটা জগন্নাথ মন্দির।  সরকারি সাহায্যে ও পল্লীবাসীদের অনুদানে ঘাটের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটা বিশাল ঠাকুর দালান। পরবর্তীকালে স্বর্গীয় নন্দদুলাল ঘোষ মহাশয় ঘাটটি ও ঠাকুরদালানটিকে সংস্কার করে দিয়েছিলেন। 

ঘাটের জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহ 

এই ঠাকুর দালানে প্রতিবছর দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা ও অন্নপূর্ণা পূজা বেশ ঘটা  করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সব পূজাতেই ভক্তরা গঙ্গা স্নান করে খালি পায়ে শিবমন্দিরে পূজা দেওয়ার পর দূর্গা বা অন্যপূজার অঞ্জলি দিয়ে থাকেন।

ঘাটের শিব মন্দিরের বিগ্রহ 

তারপর মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করার পড়েই  উপবাস ভঙ্গ করেন। জনশ্রুতি আছে যে এই সতীস্থানে কেউ কোনো মানদ  করলে তা সফল হয়।

দেবী মূর্তি 

আজ থেকে ১১০  বছর আগে অর্থাৎ ১৯১০  সালে আদি গঙ্গার তীরে এই ঘাটের পাশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কয়েকজন (১২ জন) বাঙালি ব্রাহ্মণ পল্লীবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এখানকার দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। এই বারোজনের মধ্যে কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। সেই থেকে আজও সমগ্র পূজাটি পরিচালনা করে থাকে  "ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা"। জমিদার বাড়ি, ধনী পরিবারের বেড়া ভেঙে এখানেই তিলোত্তমার বুকে  সর্বপ্রথম সকল পল্লীবাসীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমগ্র পূজা পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যা আজও স্বমহিমায় সৌভাতৃত্ত্ব ও সৌহার্দ্য পরিবেশ বজায় রেখে অনুষ্ঠিত হয়ে চলছে। যা কলকাতার বুকে সর্বপ্রথম সর্ব্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা বলে স্বীকৃত। 

আমরা জানি বাংলায় সর্বপ্রথম বারোয়ারি বা সর্বজনীনভাবে পুজো হয়েছিল হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় ১৭৯০ সালে। সেখানে বারোজন  যুবক বিন্দুবাসিনীতলার জঙ্গল পরিষ্কার করে সকলের আর্থিক সাহায্যে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিল, সেটাই বাংলার বুকে প্রথম বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজো হিসেবে পরিচিত।

বলরাম বসু ঘাট 
  
সুবৃহৎ পাকা ঠাকুরদালান, ঠাকুরদালানের প্রবেশপথটি মন্দিরের মতো করে তৈরী, মেঝেতে পাথর বসানো,  বৃহৎ হল ঘরেতে একচালার দেবী মূর্তি বিরাজ করছে।  দেবী মূর্তিটি স্বর্ণলংকারের সজ্জিত  পুজোর কটাদিন পাড়ার পুরুষ, মহিলারা ও সেবাইতরা ঠাকুর দালানে উপস্থিত থাকেন। এই সময় বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা উপস্থিত হয়। একজন বয়স্ক কর্মকর্তা শ্রী অরুন মুখোপাধ্যায় জানালেন যে  ষষ্ঠীতে বোধন,  সপ্তমীতে নবপত্রিকার প্রবেশ ও স্থাপন, অষ্টমীতে অঞ্জলি, সন্ধিপূজা, নবমীতে হোম ও কুমারী পূজা, দশমীতে দশমী পূজার পর অপরাজিতা পূজা ও সিঁদুর খেলা অনুষ্ঠিত হয়।  তারপর সাতজন ব্রাহ্মণ মিলে দেবীকে প্রদক্ষিণ করেন, তারপর সন্ধ্যায় দেবীকে পল্লীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরিয়ে এই ঘাটেই বিসর্জন দেওয়া হয়। এখানে গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা মতে পূজা হয়ে থাকে। পঞ্জিকার  প্রতিটি নিয়ম বেশ কঠোরভাবে পালিত হয়ে থাকে। এখানে কোনোরূপ বলি দেওয়া হয় না। দেবীর সব অস্ত্রই পিতলের। জনৈক ভক্ত অস্ত্রগুলো দান করেছিলেন। প্রতিবছর এই অস্ত্রই দেবীর হাতে বিরাজ করে। পাঁচজন প্রধান পুরোহিত ও সাথে দশজন সহযোগী পুরোহিত সমগ্র পুজোটি পরিচালনা করে থাকেন।  পাঁচজন প্রধান পুরোহিতের মধ্যে একজন তন্ত্রসাধক, একজন চন্ডীপাঠ বিশেষজ্ঞ ও আরেকজন জপ বিশেষজ্ঞ থাকেন।  এই পুরোহিতরা বংশ পরম্পরায় এখানে পূজা করে আসছেন।  ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে দেবীকে খিচুড়ী ভোগ আর দশমীর দিন পান্তা ভাত ও কঁচুশাক উৎসর্গ করা হয়। বিভিন্ন পূজা ছাড়াও সংগঠকরা সারাবছরই নানারকম সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে  যেমন রক্তদান শিবির, চক্ষু পরীক্ষা শিবির ও বস্ত্রদান ইত্যাদি। পূজার দিনগুলোতে সানাই বাদনের ব্যবস্থা থাকে, এখানে কোনোরূপ মাইকের বা কোনোরূপ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয় না।  পূজার কটাদিন খুবই শান্ত পরিবেশ বজায় থাকে।  
  
আদি গঙ্গার  বুকে বলরাম বসু  ঘাটের  বিপরীত ঘাট 


থিম পূজা যতই চিত্তাকর্ষক হোক বা যতই দৃষ্টিনন্দন হোক, সেখানে যতই মানুষের ঢল আছড়ে পড়ুক। এখানকার পুজোর কর্তাব্যক্তিদের কিন্তু তাতে কোনো আগ্রহ নেই। বাজারের থিমের দৌড়ে শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া এই পূজা কোনোদিন যোগ দেয়নি। ভবিষ্যতে কোনোদিন যোগ দেওয়ার কোনোরূপ ইচ্ছেও তাদের নেই। শুধু তাই নয়, শহরের অন্যান্য পুজোগুলির মতো কোনো পুরস্কারের দৌড়ে সামিল হওয়ার কথাও এরা কোনোদিন ভাবেনি। ঐতিহ্য ও চিরাচরিত আচার অনুষ্ঠানই এই পুজোর বৈশিষ্ট। পল্লীবাসীদের জন্য  বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাই এরা  প্রধান কর্তব্য বলে মনে করে।





ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :০৬-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।