Sunday, December 17, 2023

গোমো স্টেশন


গোমো  রেলওয়ে স্টেশন 









হাওড়া ধানবাদ রেলের একটা স্টেশন হল গোমো। যে স্টেশনের ওপর দিয়ে গেলেই মনের মণিকোঠায় অগচরে যে নামটি বার বার উচ্চারিত হয়, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়, সেটি হল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নাম। ১৯৪১ সাল। বাংলার বীর সন্তান তখনও নেতাজী হননি। তিনি কলকাতার বাড়ীতে গৃহবন্দী রয়েছেন। ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে রাতের অন্ধকারে তিনি ভাইপো শিশির বসুকে নিয়ে কলকাতা ছেড়েছিলেন দেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে। রাতের অন্ধকারে কুয়াশা ঘেরা পথকে অতিক্রম করে গ্রান্ট ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে তাঁদের গাড়ি ছুটেছিল এই গোমো স্টেশনের উদ্দেশ্যে। তারপর, সুভাষচন্দ্র হয়ে গেলেন গিয়াসউদ্দিন। এখান থেকে তিনি ট্রেনে উঠে পড়লেন। চললেন কাবুলের উদ্দেশ্যে কিন্তু তাঁর আর ফেরা হলো না স্বাধীন ভারতে, দেখা হলো না স্বাধীন ভারতের পতাকা উড়তে। সুভাষের সেই স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে বর্তমান ঝাড়খন্ডের এই গোমো রেল স্টেশনটি। মহান দেশপ্রেমিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০০৯ সালের ২৩শে জানুয়ারী নেতাজীর জন্মদিনে ভারতীয় রেল মন্ত্রক এই স্টেশনের নাম বদল করে। স্টেশনের নাম হয় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস স্টেশন।


ছবি : আন্তর্জাল


তারিখ : -১৭-১২-২০২৩


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Saturday, August 19, 2023

ভিঙ্গা ভবন

ভিঙ্গা ভবন 




উত্তর প্রদেশের একটি জেলা শহর হল  কাশী  বা বেনারস।  শহরটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর শহরের প্রীতি ইটের গায়ে রয়েছে যেন পুরান, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা।  কত ঋষি মনীষী, সাধু-সন্ন্যাসীদের  পদধূলিমাখা একটি শহর। এখানেই দু-দুবার এসেছিলেন ভারতের অন্যতম হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক স্বামী বিবেকানন্দ 

ভিঙ্গা ভবন, বেনারসের ভিঙ্গা ভবন। ১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দ যখন শেষবারের জন্য কাশী গিয়েছিলেন তখন এই ভবনে তিনি ভিঙ্গার রাজার আপ্যায়নে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে এখানে বসেই সিদ্ধান্ত হয় ভিঙ্গা রাজার আর্থিক সহায়তায় ও স্বামী বিবেকানন্দের একান্ত ইচ্ছায় এবং স্বামী শিবানন্দজীর আন্তরিক চেষ্টায় কাশীতে ০/- টাকা স্বামী বিবেকানন্দের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যা লাক্সা রোডে গড়ে উঠেছে। দেখগড়ে উঠবে রামকৃষ্ণ অদ্বৈতাশ্রম ও চিকিৎসালয়। পরের দিনই ভিঙ্গার রাজা গোবান্দানন্দজীর হাত দিয়ে ৫০তে দেখতে তা আজ শতবর্ষ পার হয়ে গেছে।



তারিখ : ১৯-০৮-২০২৩


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

ছবি : জয়দেব দাস

Friday, January 13, 2023

গঙ্গাসাগরের ইতিহাস ও মাহাত্ম্য 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 



সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার।  এই প্রবাদটি  বর্তমানে অতীত। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন গঙ্গাসাগরে মানুষকে  বারে  বারে  যেতে দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে  অতিমারীর কথা মাথায় রেখে প্রশাসন একাধিক নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। সকলেই অঙ্গীকারবদ্ধ মেলাকে প্লাস্টিকবর্জিত, পরিবেশবান্ধব ও দূষণমুক্ত করে তুলতে। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি উৎসবের দিন। অতি প্রাচীন কাল থেকেই বহু মুনি-ঋষি ও সাধুসন্তরা এই বিশেষ দিনে সাগরদ্বীপে এসে গঙ্গাস্নান  করে পরম পুন্য ও তৃপ্তি লাভ করে চলেছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে গঙ্গাসাগর মেলা দ্বিতীয় বৃহত্তর মেলা হিসেবে পরিচিত।  কুম্ভ মেলাকে সর্ববৃহৎ মেলা হিসেবে গণ্য করা হয়। 

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ সীমান্তে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে রয়েছে  সুবিস্তৃত সুন্দরবন।  এই সুন্দরবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল সাগরদ্বীপ।  সাগরদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে সর্বজনের পরিচিত পুণ্যভূমি মহাতীর্থ গঙ্গাসাগর।  সম্মুখ ভাগে দিগন্তবিস্তৃত বিশাল সমুদ্র আর পশ্চাতে শ্যামল বনানী, উর্দ্ধে অনন্ত নীলাকাশ আর নিম্নে বালুকাবিস্তৃত বেলাভূমি।  প্রতি বৎসর  পৌষসংক্রান্তিতে এখানে মকর স্নানের মেলা বসে।  কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সর্বত্রই সারা পড়ে  যায়।  সাগরসঙ্গমে ছুটে আসতে  দেখা যায় দেশের পুন্যকামী মানুষদের। সারা বৎসর অবহেলায় পড়ে  থাকা বেলাভূমি এইসময় মুখরিত হয়ে ওঠে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর সমাগমে।  নির্জন বেলাভূমি পরিণত হয় মহামেলায়।  এই মহামেলার পশ্চাতে আছে এক পৌরাণিক কাহিনী।  

অতি প্রাচীনকালে ইক্ষাকুবংশে সগর নামে এক ধার্মিক রাজা অযোধ্যায় রাজত্ব করতেন। তাঁর দুই পত্নী ছিলেন - কেশননি ও সুমতী। কঠোর তপস্যার ফলে সগর রাজা মহাদেবের বরে কেশনির গর্ভে অসমঞ্জ আর সুমতীর গর্ভে ষাট হাজার সন্তান লাভ করেন। মহারাজ সগর একবার বশিষ্ঠাদি ঋষিগণের ব্যবস্থানুসারে এক অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করেন। প্রাচীনকালে সকল যজ্ঞের মধ্যে অশ্বমেধ যজ্ঞই প্রধান ছিল।  ভারতের শ্রেষ্ঠ নৃপতিগণ সার্বভৌমত্ব  প্রতিষ্ঠার জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ  করতেন। নিরানব্বইটি যজ্ঞ সুসম্পন্ন করার পর  অতি  সুলক্ষণ বিশিষ্ট একটি বিশেষ রঙের  অশ্বের  কপালে জয়পত্র বেঁধে তাকে ছেড়ে দেওয়া হত।  অশ্বটির  রক্ষণের জন্য নৃপতিগণ সসৈন্যে তাকে অনুসরণ করতো।  এক বৎসর পর অশ্বটি  যদি বিনা বাঁধায় ফিরে আসে তাহলে শাস্ত্রানুসারে তাকে বধ করে তার  মাংস খন্ড যজ্ঞে আহুতিরূপে প্রদান করা হত। তারপর অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হত।  সগররাজ যজ্ঞাশ্বটিকে  ছেড়ে দিলেন। অশ্বটির  রক্ষনাবেক্ষনের জন্য তাঁর ষাট হাজার সন্তানকে সাথে প্রেরণ করলেন।  প্রতাপশালী সন্তানগণ অশ্বসহ মহাসমারোহে ভারত ভ্রমণ করতে থাকেন।  সগর তনয়দের প্রতাপ দেখে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর ক্ষমতা হারানোর আশংকা করতে লাগলেন।  তিনি রাক্ষসের মূর্তি ধারণ করে যজ্ঞাশ্বটিকে অপহরণ করে সমাধিমগ্ন মহামুনি কপিলের আশ্রমের পিছনে বেঁধে রাখলেন।

মহামুনি কপিল ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ ঋষি।  প্রজাপতি কর্দমের ঔরসে ও দেবহুতির গর্ভে বিন্দুসরোবরের তীরে ইনি  জন্মগ্রহণ করেন।  ইনি পঞ্চবিংশতি তত্ত্বাত্মক সাংখ্যদর্শন প্রণেতা।  মাতার অনুমতি অনুসারে একাগ্র তপস্যার জন্য মুনিঋষি কপিল ভারতের নানা স্থানে ভ্রমণ করে সাগর উপকূলে এসে উপস্থিত হন। এখানে সমুদ্র তাঁকে অর্ঘ্যস্বরূপ বাসস্থানের ভূমি দান করলে তিনি মহাযোগে নিমগ্ন হলেন।  

এদিকে মহারাজ  তাঁর পুত্রগণ ফিরে আসছে না দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।    তিনি তাঁদের সন্ধানে  বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন দিকে পাঠালেন। খুঁজতে খুঁজতে মহারাজ সগরের পুত্র অসমঞ্জ-এর  পুত্র অংশুমান  সাগরদ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমে এসে জানতে পারলেন যে মহারাজ সগরের  ষাট  হাজার পুত্র মারা গেছেন। তিনি মহা ঋষি কপিলদেবকে সন্তুষ্ট করলেন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেন। তিনি মুনির কাছে জানতে চাইলেন কিভাবে  তাদেরকে ফিরে পাবে।  মুনি তাঁকে বললেন তুমি যদি পতিতপাবনী  গঙ্গা দেবীকে  আনয়ন করতে পারো তাহলে গঙ্গার সংস্পর্শে তারা  উদ্ধার লাভ করবে। অংশুমান এই খবর নিয়ে  অযোধ্যায় ফিরে মহারাজ সগরের কাছে তাঁর বংশ ধ্বংসের বিবরণ ও উদ্ধারের উপায়স্বরূপ গঙ্গা আনয়নের বিবরণ দেন।  সগর সব শুনে তিনি গঙ্গাকে আনয়ন  করার জন্য নিজে  গেলেন এবং ব্যর্থ হলেন। তাঁর পৌত্র অংশুমান ও অংশুমানের পুত্র দিলীপ গিয়ে ব্যর্থ হলেন।  অবশেষে  ভগীরথ হিমালয়ে মহাদেবের তপস্যা  করতে লাগলেন। দিলীপের দুই পত্নী ছিল সুজাতা ও সুমতি। রাজার অভাবে  অযোধ্যায় অশান্তির সৃষ্টি হতে লাগলো।  সেইসময় মহাদেবের বরে দিলীপের স্ত্রী সুজাতা গর্ভবতী হন।  তাঁর প্রসবের পরে পুত্রের বদলে একটি মাংসপিন্ড পাওয়া যায়।  তিনি দুঃখে সরযূ নদীতে প্রাণ বিসর্জন দিতে যান।  মহামুনি বশিষ্ঠের আদেশে    তিনি সেই মাংসপিন্ডটিকে সরযূ নদীতে শায়িত করে রাখেন।  অষ্টাবক্র মুনির আশীর্বাদে ওই মাংসপিন্ডটি একটি সুন্দর রাজপুরুষের আকার ধারণ করে। তাঁর  নাম হয় ভগীরথ। 

  ভগীরথের  কঠোর তপস্যায় দেবাদিদেব মহাদেব সন্তুষ্ট হলেন। তাঁর নির্দেশে ও ব্রহ্মর আশীর্বাদে ভগীরথ গঙ্গার সন্ধান পান।  গঙ্গা ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মলোক থেকে তাঁকে অনুগমন করেন।  কৈলাশ পর্বত থেকে ভূপৃষ্ঠে অবতরণকালে দেবাদিদেব মহাদেব গঙ্গার প্রবল ধারা তাঁর  জটার মধ্যে ধারণ করলেন। ভগীরথের তপস্যায় প্রীত হয়ে মহাদেব গঙ্গাকে জটমুক্ত করেন।  গঙ্গা প্রবাহিত হতে  লাগলো। তাঁর তীরে বিভিন্ন তীর্থস্থান গড়ে উঠতে লাগলো। অগ্রসর হতে হতে অবশেষে পতিতপাবনী গঙ্গা সাগরসঙ্গমে মহামুনি কপিলের অশ্রমের নিকট উপস্থিত হলে  তাঁর পবিত্র সলিল স্পর্শে  সগর বংশ  সাপ মুক্ত হয়। পরবর্তীকালে এখানে কপিল মুনির মন্দিরটি গড়ে ওঠে।  মন্দিরটি নদীগর্ভে বহুবার তলিয়ে গেছে।  বর্তমান মন্দিরটি ১৯৭৩ সালে নতুন করে নির্মিত হয়। 

 গঙ্গা হল ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গঙ্গা পতিতপাবনী।  মুক্তিদাত্রী। মানুষ যে কোনো  পাপ করুক অন্তিম সময়ে গঙ্গাস্নানে সমস্ত পাপ বিদূরিত হয় বলে  বিশ্বাস। দেহান্তে তার আত্মা স্বর্গগামী হয়।  এই মহাতীর্থে পৌষ সংক্রাতির দিনে স্নান করলে সর্বপাপ ক্ষয় হয়।

 বর্তমানে গঙ্গাসাগর দ্বীপের আয়তন প্রায় ৩০০ বর্গ  কিলোমিটার। যাত্রাপথ পূর্বের মতো একদমই দুর্গম নয়, বেশ সুগম। লক্ষ লক্ষ সাধু-সন্ত ও তীর্থযাত্রী বছরের পর বছর মেলার সময় ছুতে আসেন। তবে এখন সারাবছর সাগরদ্বীপে পর্যটকদের একটা সমাহার দেখা যায়।   সাগরসঙ্গমে পুণ্যার্থী যাত্রীগণ স্নান-তর্পনের পর কপিলমুনি, সগররাজা, পতিতপাবনী গঙ্গা ও রাজপুরুষ ভগীরথের  বিগ্রহ দর্শন এবং অর্ঘ্য ও অঞ্জলি দেওয়ার জন্য তীর্থযাত্রীরা  কাতারে কাতারে মন্দির প্রাঙ্গনে জড়ো  হন। এই সময় সারা দেশ থেকে প্রায় ৫০-৬০ লক্ষ্য পুণ্যার্থীর সমাগম হয়ে থাকে। তাদের জন্য সরকার প্রচুর পরিমাণে  অস্থায়ী আস্তানা তৈরী করে দেয়। হোগলার তৈরী যে অস্থায়ী আস্তানাগুলো গড়ে ওঠে তাতে অগ্নিনিরোধক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। মেলা প্রাঙ্গণ  জুড়ে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। মেলার পূর্বে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সব কিছুর আয়োজন করা হয়।  এই সময় সাগরদ্বীপে বেশ বড়  মেলা বসে, বিভিন্ন স্থানে সারা রাত  ধরে নানারকম ভক্তিমূলক গান পরিবেশন করা হয়। কোথাও কোথাও আবার ভক্তিমূলক চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। 

কুম্ভমেলা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।  ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্বে গঙ্গাসাগর মেলা অভিনব। যদিও এই মেলাটি এখনো জাতীয় মেলার স্বীকৃতি পায়নি। মেলার ঐতিহ্য, প্রাচীনত্ব এবং বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রী ও পর্যটককে হাতিয়ার করে কলকাতার দুর্গাপুজোর মতো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে ইনট্যানজিবল হেরিটেজের তকমা পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।  ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি জুটলে সাগরদ্বীপের পর্যটন কলকাতার দুর্গাপুজোর মত আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করবে।

তারিখ :-১৪-১০-২০২৩

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 







Sunday, November 6, 2022

বাজ থেকে রাজ


বাজ থেকে রাজ

সুদীপ্ত মুখার্জী 


মন্দিরময় গ্রাম 



ছোটনাগপুর মালভুমির পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ঝাড়খণ্ড রাজ্য।  এই রাজ্যের সাঁওতাল  পরগণা  বিভাগের অন্তর্গত দুমকা জেলায় অবস্থিত মলুটী নামক ঐতিহ্যবাহী মন্দির গ্রাম। গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের রামপুরহাট রেলস্টেশন থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ১৮৫৫ খিষ্ট্রাব্দের পূর্বে গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অন্তর্গত ছিল। মলুটির পরিবেশ বাংলার অন্যান্য গ্রামের মতো শান্ত ও  স্নিগ্ধ। এখানে  বাংলাভাষীদের প্রাধান্য রয়েছে। মলুটী গ্রামের পূর্বে নাম ছিল মল্লহাটি। 

পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা বাজবসন্ত স্থাপন করেছিলেন নানকার রাজ্য। রাজা বাজবসন্ত কোনও রাজপুত্র ছিলেন না,  ছিলেন সামান্য রাখাল বালক। প্রাচীন বীরভূম জেলার মৌড়েশ্বর গ্রামের নিকটবর্তী কাটিগ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে তার জন্ম হয়।  বাল্যকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ার জন্য বসন্তকে বালক বয়সেই অপরের গোচারণ করে সংসারে সাহায্য করতে হত। অন্যান্য রাখাল বালকের ন্যায় একদিন বিকেলে  সে গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরে। সূর্য পশ্চিমপাড়ে ঢলে পড়ার সময় তার মুখে রৌদ্র এসে পড়ছিল। এমন সময় এক অবাক কান্ড ঘটল।  এক বিষধর সাপ কোথা থেকে এসে তার মুখের ওপর ফণা তুলে দাঁড়ালো, যাতে মুখে সূর্যের রশ্মি না লাগে। ঠিক সেই সময় সুমেরু মঠের  দন্ডীস্বামী নিগমানন্দ তীর্থ মহারাজ শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মহাপ্রভু দর্শনের পর তারাপীঠের তারামাকে  দর্শনের উদ্দেশ্যে ওই পথ ধরে যাচ্ছিলেন।  তিনি এই দৃশ্য দেখে বিস্মৃত হলেন। বালকের দিকে এগোতেই সাপটি মাথা নিচু করে জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেলো। সন্ন্যাসী বালকের মধ্যে রাজলক্ষণ  দেখতে পেলেন। প্রথমে তিনি অনুমান করতে পারছিলেন না বালকটির রাজা হওয়ার পরিবর্তে গোচারণ বৃত্তিতে আসার কারণটি।  বালককে ঘুম থেকে তুলে তিনি তাকে নিয়ে তার কুটিরে আসলেন। অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন বসন্তের উপনয়ন ও দীক্ষা হয়ে গেছে। তিনি আরো জানতে পারলেন বালকটির ইষ্টমন্ত্রে এক অক্ষর ভুল আছে। তিনি বালকটির বিধবা মার কাছে বসন্তের কুলগুরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন এবং জানালেন যে ইষ্টমন্ত্রটি শুদ্ধ করে দিলে বসন্ত অনতিবিলম্বে রাজা হবে। দন্ডী সন্ন্যাসী বসন্তের কুলগুরুকে মন্ত্রটি ত্রুটিমুক্ত করতে অনুরোধ করলে  তিনি রাজি হলেন না।  অগত্যা সন্ন্যাসী একটা বিল্ব পত্রে মন্ত্রটিকে লিখে বালকটিকে  সেটি জলে ভাসিয়ে দিতে বললেন। সেইদিন সন্ধ্যায় সন্ন্যাসী বসন্তকে শুদ্ধ মন্ত্র দান  করলেন এবং প্রত্যেকদিন শুদ্ধাচারে ইষ্টমন্ত্রটি জপ করার উপদেশ দিলেন। তারপর তিনি তীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।  

পরিত্যক্ত দুর্গা দালান 



ঘটনাচক্রে গৌড়ের নবাব আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উড়িষ্যা হয়ে বীরভূমের মধ্য দিয়ে গৌড়ে ফিরছিলেন। বিশ্রামের জন্য ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে শিবির স্থাপন করেন।  শিবির থেকে বেগম সাহেবের পোষা প্রিয় একটা বাজপাখী সোনার শিকল কেটে উড়ে পালিয়ে যায়।  বালক বসন্ত পাখী  ধরার জন্য অন্যান্যদের মত গাছের ডালে ফাঁদ পেতে রেখেছিল। ওই ফাঁদে পলাতক বাজপাখী ধরা পরে গেল। পাখীটার পায়ে সোনার শিকল, নাকে সোনার নোলক দেখে মহানন্দে বসন্ত পাখীটাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসল। ওইদিকে বেগম সাহেব পাখীর শোকে শয্যা নিয়েছেন। বাদশা পাখীটি ফিরে পাওয়ার  জন্য চারদিকে ঢেড়া  দেওয়ালেন এবং পুরস্কার ঘোষণা করলেন। দন্ডী সন্ন্যাসী তখন বেশি দূর যাননি। তাঁর কানে এসে রাজার বিজ্ঞপ্তি পৌঁছালো। তিনি বুঝতে পারলেন বালক বসন্তের রাজ্যপ্রাপ্তির যোগ আসন্ন।  তিনি তাঁর তীর্থযাত্রা বন্ধ রেখে নবদীক্ষিত শিষ্য বসন্তের কুটিরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসলেন। শিষ্যের ঘরে বাজপাখীটা দেখে তিনি খুব আনন্দিত হলেন।  অচিরেই তিনি সশিষ্য বাদশার শিবিরে পৌঁছে বাজপাখীটি ফিরিয়ে দিলেন। তিনি রাজার কাছে বসন্তের দারিদ্রের কথা বলে কিছুটা ভূখণ্ড পুরস্কারস্বরূপ চেয়ে বসলেন। গৌড়ের নবাব কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা  না করে আদেশ দিলেন, পরদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্য্যাস্ত পর্যন্ত ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাখাল বালক যতটা পথ ঘুরে আসতে পারবে, সেই সমস্ত ভূমি তিনি তাকে নিস্কর জমিদারীরূপে দান  করবেন। পরদিন বালক বৃত্তাকারে প্রায় ষোল কিলোমিটার ব্যাসের ভূখণ্ড পরিক্রমা করে ফেললেন। তার সঙ্গে থাকা আমিন স্থানে স্থানে ওই ভূখণ্ডের সীমারেখা চিহ্নিত করে দিল। তৈরী হলো নানকার তালুক। বাদশা হোসেন শাহ বসন্তের পরিক্রমা করা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডটি ননকার রাজ্য অর্থাৎ নিস্কর রাজ্য বলে স্বীকৃতি দিলেন। তার সঙ্গে দিলেন কিছু অর্থ এবং কয়েকজন বিশ্বস্ত সৈন্য। বালকটিকে 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত করলেন। নানকার শব্দটি ননকর শব্দের অপভ্রংশ। প্রথমে রাজ্যটির আকার গোলাকার ছিল। পরবর্তীকালে অনেক মৌজা এই জমিদারীতে অন্তর্ভুক্ত  হয়েছে। 




রাজা বাজবসন্তের রাজত্বকাল আনুমানিক ১৫২০ - ১৫৭০ সাল পর্যন্ত ছিল।  তাঁর রাজ্যলাভের কিছু পর থেকে বীরভূম জেলাসহ সমগ্র গৌড়বঙ্গে একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যুবক রাজা বসন্ত ধীরে ধীরে তাঁর রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন। 

রাজা বাজবসন্তের রাজত্বকালের শেষের দিকে নানকার রাজ্যের চরম উন্নতি হয়। রাজ্যের আয়তন ছিল প্রায় ছত্রিশ কিলোমিটার ব্যাসের বৃত্তাকার ভূখণ্ড। রাজ্যের সীমানায় ছিল পূর্বে দ্বারকা নদী, পশ্চিমে সাঁওতাল পরগণা বিভাগের দুমকা জেলার কারাকাটা গ্রাম, উত্তরে বলিয়া-মৃত্যুঞ্জয়পুর এবং দক্ষিণে মল্লারপুর সহ ডামরার জঙ্গল অঞ্চল। এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের জন্য কোন কর দিতে হত না। তবে  পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পর ওয়ারেন হেস্টিংস যখন প্রচলিত ভূমিকরের পরিবর্তন ঘটান সেইসময় সামান্য কিছু টাকা নানকার রাজ্যের জন্য খাজনা ধার্য করা হয়েছিল। নানকার রাজ্যের আয়  ছিল প্রায় লক্ষাধিক টাকা এবং রাজারা উদ্বিত্ত টাকায় দেবালয় স্থাপন, পূজাচ্ছর্নায় এবং জ্ঞানী-গুণী সম্বর্ধনায় ব্যয় করতেন।  জমিদারি চলে যাওয়ার পরেও সাধু-সন্তদের সম্মানরক্ষা ও দেব-দেবী পূজার আড়ম্বর বেশ কিছুদিন অক্ষুন্ন ছিল। রাজা বাজবসন্ত মাত্র ১০-১১ বৎসর বয়সে রাজ্যলাভ করেছিলেন  প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন।  রাজা বাজবসন্তের মৃত্যুৰ পর আনুমানিক ১৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর পুত্র রাম সহায় রাজ সিংহাসনে বসেন। 

১৬৯৫ সালে রাজনগরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নানকার রাজপরিবার যখন মলুটীতে পৌঁছান তখন অঞ্চলটি ছিল অরণ্যময়। বন কেটে বসত স্থাপনের পর মলুটীতে নানকার রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করা হয়েছিল। ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের  সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলস্বরূপ তরাই অঞ্চল ও বীরভূমের কিয়দংশ নিয়ে নতুন জেলা সাঁওতাল পরগণার সৃষ্টি হয়েছে।  সেই সময় মলুটী সহ নানকার জমিদারির বৃহৎ অংশ সাঁওতাল পরগনা জেলায় চলে যায় এবং বাকি অংশ বীরভূমেই থেকে যায়।  গ্রামটি পুরাতাত্ত্বিক  বৈশিষ্টে ভরা। গ্রামটিকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছে এখানকার বৈচিত্রময় মন্দির ভাস্কর্য্য। 

গ্রামটিতে জীর্ণ রাসমঞ্চ, দুর্গামন্দির ও ৭২টা শিব মন্দির ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরগুলো অবশ্য এক জায়গায় নেই সমগ্র গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কথিত আছে, এখানে পূর্বে মোট ১০৮টি শিব মন্দির ছিল। ৩৬টা মন্দির রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ৭২টা  মন্দির রাজ্য সরকারের পুরাতত্ব বিভাগ বর্তমানে অধিগ্রহণ করেছে। মন্দিরগুলোতে মূলত এগুলি শিব, দূর্গা, বিষ্ণু ও কালী বিগ্রহ ছিল। অনেক শিব মন্দির রয়েছে বলে অনেকে গ্রামটিকে গুপ্তকাশীও বলে থাকে। রাজা বাজবসন্ত ও তাঁর বংশের অন্যান্য রাজারা মন্দিরগুলো নির্মাণ করেছিলেন।  

এখানকার মন্দিরশৈলী মিশ্র প্রকৃতির। গঠনশৈলী অনুসারে মন্দিরগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়, সেগুলো হল চালা, রেখা, মঞ্চ, একবাংলা ও সমতল ছাদ বিশিষ্ঠ। একেকটি মন্দির চারকোনা ভিত্তি বেদির উপর অবস্থিত। বেদির উপর দেওয়ালগুলো খাড়া উপরের দিকে উঠে গেছে এবং সেগুলোও চারকোনা। শিখরদেশ অর্ধগোলাকৃতি, চালগুলো আয়তনে ছোট। মন্দিরগুলো এক কক্ষ বিশিষ্ট।  চুন-সুরকি দিয়ে পাতলা লাল ইঁট গেঁথে  তৈরী করা হয়। মন্দিরগুলোর উচ্চতা সর্ব্বোচ ৬০ ফুট আর সর্বনিম্ন ১৫ ফুট। মন্দিরগুলোর সম্মুখভাগে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির অপূর্ব কার্যখোচিত, যাতে রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের বিভিন্ন গল্পগাঁথা। 

মলুটীতে অবস্থিত সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্দির হল মৌলীক্ষ্যা মায়ের মন্দির। মন্দিরটি এক বাংলা গঠনশৈলীতে নির্মিত। বহুকাল ধরে মন্দিরটি তন্ত্র সাধনার উপযুক্ত পীঠ বলে পরিচিত হয়ে এসেছে।  মৌলিক্ষ্যা  মাকে  মলুটীর রাজাগণ তাঁদের কুলদেবী সিংহবাহিনীরূপে পূজা শুরু করেছিলেন। মন্দিরের পরিবেশ ভাগম্ভীর। বামাখ্যাপাসহ বহু সাধক এখানে সাধনা করে গেছেন।  মন্দিরটি রাজা রাখরচন্দ্র নির্মাণ করে দেন।  

দুমকা জেলার শিকারীপাড়া থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যময়, ঐতিহাসিক নানকার রাজ্যের কথা যেমন কেউ মনে রাখেনি তেমন মন্দিরনগরী মলুটী গ্রামের কথা ইতিহাস মনে রাখেনি। অনাদরে পরে রয়েছে রাজবংশের অনন্য সব কীর্তিগুলো। মন্দিরগুলোর প্রাচীনত্ব অনুভব করে মানুষ আজও রোমাঞ্চিত হয়। 

 
তারিখ :০৭-১১-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



















Wednesday, October 5, 2022

তিলোত্তমাতে নীল বর্ণের দেবীর আরাধনা

তিলোত্তমাতে নীল বর্ণের দেবীর আরাধনা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 





বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে দুর্গোৎসব।  দুর্গাপূজা মানে বাঙালির আবেগ, বাঙালির উচ্ছাস। দুর্গাপূজার সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গরিমা। এবছর ইউনেস্কো আবার দুর্গোৎসবকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই স্বীকৃতির ফলস্বরূপ আজ বাঙালির আবেগের বিশ্বজয় ঘটেছে। 

আমরা জানি, পারিবারিক দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিল কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির আটচালায় আর জৌলুসের গোড়াপত্তন ঘটেছিল শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজায়। তারপর থেকে পূজাটি হয়ে ওঠে অভিজাত বাড়ির বৈভব প্রদর্শনীর অঙ্গ। সেই আমলে  কোথাও সাজে আবার কোথাও নাচগানের আসরের জৌলুসে প্রত্যেক বাড়ি যেন একে অপরকে টেক্কা দিতে লাগলো। চলতো বৈভবের প্রতিযোগিতা। 

বেশিরভাগ বনেদি বাড়িতে দেবীর গাত্রবর্ণ হলুদ রঙের হয়ে থাকে। তবে কোথাও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। বেলেঘাটার ভট্টাচার্য পরিবারের দেবীর গাত্রবর্ণ ঘন কালো অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণ। কলকাতার সাদার্ন এভিনিউতে ঘোষ রায় পরিবারের দেবীর গাত্রবর্ণ আবার নীল।  গতবার কৃষ্ণবর্ণের পূজাটি নিয়ে বিশদে লিখেছিলাম।  এবার ঘোষ রায় পরিবারের নীল রঙের দেবীমূর্তির কথা আপনাদের জানাবো।  

ঘোষ রায়  পরিবারের শ্রী প্রদীপ রায় ও শ্রীমতি শুভ্রা রায় জানালেন যে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে মহারাজ আদিশূর পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার জন্য কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাম্ভন ও পাঁচজন কায়স্থ সন্তান নিয়ে আসেন।  এই পাঁচজন কায়স্তের মধ্যে সৌকালীন গোত্রীয় মকরন্দ বাংলায় এসেছিলেন।  এই মকরন্দ হলেন ঘোষ  বংশের প্রথম সন্তান। পরে ঘোষ বংশের একটা শাখা বাংলার নবাবের নিকট হতে অধুনা বাংলাদেশের বরিশালের নরোত্তমপুর গ্রামের জমিদারি পান এবং সাথে 'রায়'  উপাধি পান। সেই সময় থেকে এই শাখাটি 'ঘোষ রায়' নাম পরিচিতি লাভ করে। 

এই বংশের সুসন্তান কালীমোহন রায়ের স্ত্রী স্বপ্নাদেশে শ্যামরূপী দুর্গার পূজা করার আদেশ পান। সালটা ছিল ১৮২৭। নরোত্তমপুরে কালীমোহনবাবু ও তাঁর স্ত্রী বেশ আড়ম্বরের সাথে পূজাটি করেন।  নীলবর্ণের দুর্গার আরাধনা আজও  চলছে।  



১৯৩৪ সালে বংশের পুত্র অবনীমোহন রায় কলকাতায় চলে আসেন। নীল দূর্গা পূজা তখনও বাংলাদেশে নরোত্তমপুর অনুষ্ঠিত হত। ১৯৩৮ সালে অবনীমোহনের চতুর্থ ভ্রাতা রোহিনীমোহন পরিবার নিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন।  সাদার্ন এভিনিউতে তিনি বাড়ি নির্মাণ করেন।  অবনীমোহনের তৃতীয় ভাই মোহিনীমোহন ও ছোটভাই নলিনীমোহন কলকাতার  প্রতাপাদিত্য প্লেসে ১৯৪৬ সালে নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ করেন।  ১৯৪৫ সাল  পর্যন্ত পূজাটি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর কলকাতার প্রতাপাদিত্য প্লেসের বাড়িতে চলে আসে।  ১৯৭৭ সালে পূজাটি আবার স্থানান্তরিত হয়ে সাদার্ন এভিনিউ-এর বাড়িতে চলে আসে। সেই থেকে আজও পূজাটি এখানে বেশ আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। 

এখানকার প্রতিমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল গাত্রবর্ণ নীল ও দেবীর বামদিকে থাকেন সরস্বতী ও গণেশ এবং ডানদিকে থাকেন লক্ষ্মী ও কার্তিক। একচালা ডাকের সাজে পারিবারিক গহনায় দেবী সজ্জিত। চালচিত্রে শিবদুর্গার পট অঙ্কিত। পঞ্চমীর দিন কালীঘাটের পটুয়াপাড়া থেকে সকালে প্রতিমা নিয়ে আসা হয়।  ষষ্ঠীর  সন্ধ্যায় বোধন বসে। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নানের পর দেবীর চক্ষুদান ও মূল পূজা শুরু হয়। ঘোষরায় পরিবার কায়স্থ বলে অন্নভোগ দেওয়া হয় না তবে অন্নভোগ রান্না করার জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন হয় সেইসব উপাদান দেবীকে নিবেদন করা হয়। বাইরের কোন প্রকার মিষ্টান্ন দেবীকে দেওয়া হয় না তবে মহাষ্টমীর সন্ধ্যারতির সময় লুচি, মিষ্টি, সুজি ইত্যাদি তৈরী করে মাকে  নিবেদন করা হয়। সপ্তমীর দিন ২৭টি, অষ্টমীর দিন ৬৪টি এবং মহানবমীর দিন ২৭টি ভাগে নৈবেদ্য ভোগ নিবেদন করা হয়। এইসব ভোগে নানা রকমের ফলের সাথে বাড়ির তৈরী নারকেল নাড়ু থাকে। মহানবমীর দিন হোম হয়।  পূর্বে পশুবলি দেওয়া হলেও বর্তমানে প্রতীকী বলিদানের প্রথা রয়েছে।  পরিবারের রীতি মেনে নিজস্ব পুঁথিতে আজও পূজাটি হয়ে আসছে।  দশমীর দিন সকালে দেবীর দর্পন বিসর্জনের পর অপরাজিতা পূজার চল রয়েছে।  অপরাজিতা পূজার পর বাড়ির মহিলারা মাছ খেয়ে তবেই দেবীবরণ করতে পারে। 

 তারিখ :-০৫-১০-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 












Tuesday, October 4, 2022

নেতাজীর পৈতৃক বাড়ির দুর্গাপূজা

নেতাজীর পৈতৃক বাড়ির দুর্গাপূজা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 


দেবী মূর্তি 



দুর্গাপূজা বাঙালির জীবনের সবচেয়ে প্রিয় উৎসব। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে বাঙালির সংস্কৃতিতে উৎসবটি এক বিশেষ স্থান লাভ করে আছে।  বাংলায় দুর্গাপূজা কবে প্রচলিত হয়েছিল, এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত  রয়েছে। সেই মতামত যাই থাকুক সেটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয়ে থাকে তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। বর্তমানে বঙ্গীয় শারদীয়া মহাপূজা একটি জাতীয় উৎসব হিসেবে মহান ঐতিহ্যের আধার হয়ে উঠেছে। সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাংস্কৃতিক (উনেস্কো)  বিবেচনায়  দুর্গোৎসব আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।  

বাংলায় দুর্গাপূজার ঐতিহ্যতে বারোয়ারি পূজার রমরমার সাথে সমান্তরালভাবে পরিবার কেন্দ্রিক পূজাগুলোও স্থান করে নিয়েছে।  যদিও পারিবারিক পূজাগুলো আগে শুরু হয়েছিল, তার অনেক পরে  বারোয়ারি পূজার প্রচলন হয়েছিল। পারিবারিক পূজাগুলোকে বনেদি বাড়ির পূজা বলেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সেরকম একটি পরিবারের পূজার আজ কথা  আমার কলমে ধরার চেষ্টা করলাম। 

ঠাকুরদালান 


পরিবারটি হল ভারতবর্ষের অন্যতম  ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবার। পরিবারের সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু, জানকীনাথ বসুর নাম ভারতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বরাবর গণ্য হয়ে এসেছে।  বসু বংশের আদিপুরুষ হলেন দশরথ বসু। তাঁর অধস্তন গোপীনাথ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুরবন্দর  নামক একটা জায়গা জায়গীর হিসেবে পান। পুরবন্দর থেকে সামান্য দূরে মাহীনগর গ্রামে তাঁরা বাস করতেন। মাহীনগরে মহামারী দেখা দিলে ওই গ্রাম পরিত্যাগ করে বসু পরিবার কোদালিয়ায় বসতি গড়ে তোলেন। বংশের সুসন্তান যাদবেন্দ্রনাথ ১৮২০ সালে কোদালিয়ায় দুর্গাপূজা শুরু করেন। পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরপুরুষ রামহরির পৌত্র হরনাথ বেশ জাঁকজমকের সাথে পূজাটি পরিচালনা করেন। তিনি বেশ কিছু বছর পূজার দায়িত্বে ছিলেন।  তারপর হরনাথের পুত্র জানকীনাথের উপর পূজা পরিচালনার  দায়িত্ব পড়ে।

বসত বাড়ির একাংশ 


তিনি যখন কটকে আইন ব্যবসায় নিযুক্ত হন তখন তাঁর  বড়ভাই যদুনাথ পূজার কাজ চালাতেন। তাঁর অর্থাৎ জানকীনাথের মৃত্যুর পর নেতাজীর মাতা প্রভাবতী দেবী পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।  প্রায় প্রতিবছর সুভাষচন্দ্র পূজার সময় এখানে আসতেন। তিনি করজোড়ে দুর্গাদালানে বসে থাকতেন। একাগ্রচিত্তে চন্ডীপাঠ শুনতেন। দেবীর চরণে অঞ্জলি প্রদান করতেন বলে পরিবারের এক সদস্যের কাছ থেকে জানতে পারলাম।   তিনি আরো জানালেন যে ১৯৩৯ সালে নেতাজী  শেষবারের মত এই বাড়িতে এসেছিলেন। 

গ্রামবাসী শ্রী দেবজিৎ রায় জানালেন পরিবারের পূজার জৌলুস পূর্বের মত  আজ অমলিন।  পূজার নিয়ম যতটা সম্ভব পূর্বের মত  পালন করার চেষ্টা করা হয়। আগে পূজার কটাদিন সমগ্র গ্রামবাসী একসাথে খাওয়া-দাওয়া করতো। নারকেল নাড়ু বিলানো হত। বর্তমানে একসঙ্গে আর খাওয়া-দাওয়া হয় না তবে ভোগ বিলানো হয়। এছাড়া দরিদ্রনারায়ণ সেবা করানো হয়। সাবেকি দিনের একচালা প্রতিমা। দেবীর অঙ্গসজ্জা সেরকম নেই। 

আজও  অষ্টমীর অঞ্জলি ও সন্ধিপূজার বেশ ঘটা করে করা হয়। এইদিন এখানে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে বহু আত্মীয় আজও  সমবেত হয়।  তাঁদের অনেকেই সন্ধিপূজার সময় উপস্থিত থাকেন। 

পারিবারিক রীতি মেনে পুরানো কাঠামোতে একচালা দেবী মূর্তি তৈরী করা হয়। কাঠামোটিকে বিসর্জনের পর ঠাকুরদালানে রেখে দেওয়া হয়। পূজাটি বসু বাড়ির ঠাকুর দালানেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত  হয়ে থাকে। ঠাকুর দালানের সামান্য দূরে রয়েছে পরিবারের আদি বাড়িটি। বর্তমানে বাড়িটি কেন্দ্রীয় সরকারের পুরাতত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে।  এখানে তারা একটা সংগ্রহশালা নির্মাণ করবে বলে জানতে পারলাম।  

বসু বাড়ির পূজাতে অন্যান্য বনেদি বাড়ির মত চাকচিক্য হয়তো দেখতে পাবেন না কিন্তু পূজাটি বেশ  নিষ্ঠার সাথে আজও অনুষ্ঠিত হতে দেখলাম। প্রচুর গ্রামবাসীকে  এখানে অঞ্জলি দিতে দেখলাম। 



তারিখ :-০৪-১০-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 






Saturday, October 1, 2022

অকালবোধন>P

                               অকালবোধন 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 





দেবী দূর্গা  হলেন হিন্দুদের খুবই জনপ্রিয় দেবী। হিন্দুরা তাঁকে শক্তির দেবী হিসেবে মনে করলেও মাতৃজ্ঞানে  সম্মান করে।  পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের পত্নী পার্বতী। দেবী আবির্ভূত হন শক্তিরূপে। মহাশক্তি দূর্গা মহাবিশ্বের অধীশ্বরী। সুপ্রাচীন কাল থেকেই মায়ের মৃন্ময়ী রূপকে চিন্ময়ী জ্ঞানে আমরা আরাধনা করে আসছি। 

দেবীপূজার মহাক্ষণ আসন্ন।  দশপ্রহরণধারিনী দেবী একাধারে  আমাদের জননী আবার কন্যাও।  দেবীকে নিয়ে আমাদের কত মান-অভিমান। পরমাশক্তি দেবী দূর্গা একদিকে রণরঙ্গিনী ও ভয়ঙ্করী এবং অন্যদিকে প্রসন্ন ও বরদায়িনী। একাধারে রনংদেহি মূর্তি ফুটে ওঠে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমায় আবার অন্যধারে তাঁর চোখ থেকে বর্ষিত হয় করুণাধারা।  পূরাণের পাতা ওল্টালে দেখা যায় যেমন তত্ত্বের বর্ণচ্ছটায় দেবী মাহাত্বের কথা তেমন ইতিহাসের পাতায়  বর্ণিত আছে উৎসবের পরম্পরায় তাঁর আরাধনার কথা। ভারত তথা বিশ্বে  বৎসরান্তে হয় তাঁর আগমন, আগমনী গানে তাঁর পূজার আয়োজন। আমাদের জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। 

বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠ পার্বণ হল শরৎকালের দুর্গাপূজা। এতো শুধু পূজা নয় - এতো মহাযজ্ঞ। আমাদের দেশে বছরে দুই বার দুর্গাপূজা করা হয়। একবার শীতের পর বসন্তকালের চৈত্র মাসে আর একবার বর্ষার অন্তে শরৎকালের আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষে।  রাজা সুরথ বসন্তকালে  প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। শ্রী শ্রী চন্ডীতে রাজা সুরথের নাম  মর্ত্যে  দেবী দুর্গার প্রথম পূজারী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। বসন্তকালে যে পূজা করা হয় তাকে দুর্গাপূজা না বলে 'বাসন্তী পূজা' নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এই পূজা অনেক জায়গায় বারোয়ারি পূজা হিসেবে করা হয়। অল্প কিছু  বাড়িতেও বাসন্তী পূজা করার চল রয়েছে।  

শরৎকালে দূর্গা মায়ের আরাধনাকে দুর্গাপূজা বলা হয়।  যেহেতু পূজাটি শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় তাই অনেকে 'শারদোৎসব' বলে থাকে। শরৎকালের এই পূজাটি সমাজে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা ও প্রসিদ্ধি  লাভ করেছে।  পূজাটিকে অকালবোধন বলা হয়।  রাবণ বধের পূর্বে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে অর্থাৎ অ-কালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন। 

হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রারম্ভে অকালবোধন  অনুষ্ঠিত হয়।  বোধন শব্দটির অর্থ হল জাগরণ বা জাগানো।  বিখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রদ্ধেয় অতুল সুর মহাশয় বলে গেছেন - 'দুর্গাপূজাই বাঙালির সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব। শরৎকালে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় বলে একে শারদীয়া পূজা বলা  হয়।  আষাঢ়  থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত দেবতাদের নিদ্রাকাল এবং এই অসময়ে দেবীর পূজা করা হলে বোধন করা  হয় বলে একে অকালবোধনও বলা হয়। কথিত যে, পুরাণ অনুযায়ী রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় রামের প্রতি দেবীর অনুগ্রহ আকর্ষণ করবার উদ্দেশ্যে  ব্রহ্মা দেবীর বোধন করেছিলেন।  কৃত্তিবাসী  রামায়ণ অনুযায়ী রাম নিজেই যুদ্ধের পূর্বে দেবীর বোধন করেছিলেন, বাল্মীকির রামায়ণে কিন্তু এসব কথা কিছু নেই। মহর্ষি  বাল্মীকি তাঁর রচিত সংস্কৃত রামায়ণে সূর্য্য ও অন্যান্য দেবতাদের পূজার কথা বলেছিলেন।  ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাস ওঝা বাল্মীকি রামায়ণের অনুকরণে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। তাঁর রচিত রামায়ণে শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের দেবীপূজার কথা উল্লেখ রয়েছে।  বাংলা রামায়ণে কবি কৃত্তিবাস শ্রীরামচন্দ্রের দেবীপূজা সম্বন্ধে বলেছেন - 

                                               "বিধাতা কহেন প্রভু এক কর্ম কর বিভু 
                                                          তবে হবে রাবণ-সংহার। 
                                               অকালবোধন করি পূজা দেবী মহেশ্বরী 
                                                         করিবে হে ঐ  দুঃখ-পাথর।"

কবিচিত্তের কল্পনায় বীর হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম সংগ্রহ করলেন, কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র একে একে ১০৭ টি পদ্ম মাতৃচরণে অঞ্জলি দিলেন। কিন্তু দেবী ছলনা করে একটি পদ্ম সরিয়ে রাখলেন। শ্রীরামচন্দ্র যখন ধনুর্বান দিয়ে নিজের একটি চক্ষু উৎপাটন করে মাতৃচরণে অঞ্জলি দিতে উদ্যত হলেন  ঠিক সেই সময় দেবী সহাস্যে তাঁকে  নিবৃত্ত করলেন। দেবীপূজা সমাপ্ত হল এবং শ্রীরামচন্দ্র দশাননকে  বধ করলেন। তবে প্রজাপতি ব্রহ্মার পরামর্শে ও সাহায্যেই তিনি দেবীকে ঘুম থেকে তুলে পূজা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি শরৎকালে দেবীকে জাগরণ পূর্বক তাঁর পূজা সম্পন্ন করে রাবণ বধে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বীয় পত্নীকেও লাভ করেছিলেন। 

বাংলা সনাতন বর্ষপঞ্জি অনুসারে একটি বছরকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটির একটি হল উত্তরায়ণ আর অপরটি হল দক্ষিণায়ন।  সূর্য যখন পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে উত্তরায়ণ কাল বলা হয় আর সূর্য যখন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে উত্তরায়ণ কাল বলা হয়। আর সূর্য যখন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছে অবস্থান করে তখন তাকে দক্ষিণায়ন কাল বলা হয়। মহাকবি কৃত্তিবাস তাঁর রচিত রামায়ণে বলে গেছেন বাংলা বর্ষপঞ্জির মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ এবং  আষাঢ় এই ছয় মাস হলো উত্তরায়ণ কালের অন্তর্গত।  বাকি ছয় মাস হল দক্ষিণায়ন কালের অন্তর্গত। এই ছয় মাস হল শ্রাবণ, ভাদ্র, অশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, ও পৌষ। 

উত্তরায়ণ কালে দেব-দেবীরা  জাগ্রত থাকেন।  এই সময়টাই দেবী আরাধনার প্রকৃত সময়।  তাই উত্তরায়ণ কালে দেবী আরাধনা করা হলে দেবীকে জাগাতে হয় না।  রাজা সুরথ বসন্ত কালে দেবীর আরাধনা করেছিলেন, যা বাসন্তী পূজা হিসেবে পরিচিত। তাই বাসন্তী পূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না।  অপরদিকে দক্ষিণায়ন কালের সময় দেব-দেবীদের নিদ্রার সময়। এই সময় পূজা করা হলে দেব-দেবীদের প্রথমে বোধন অর্থাৎ জাগ্রত করতে হয়। তারপর মূল পূজা শুরু হয়।  

শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের কথা শুধু কৃত্তিবাসী রামায়ণের পাওয়া যায় তা নয়, অকালে দশভূজার আবির্ভাবের  বিবরণ কয়েকটি পুরাণে পাওয়া যায়।  অকালবোধনই বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় উৎসব। শরতে প্রকৃতির মনোমোহিনী রূপের মধ্যে আগমন ঘটে মা দুর্গার।  দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, পাড়ায় পাড়ায়  শুরু হয় দেবীর অকালবোধন। হানাহানি, রেষারেষি ভুলে সবাই উৎসবের মেতে ওঠে। 




তারিখ :-০১-১০-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 









 

Tuesday, June 14, 2022

ঘূর্ণি

ঘূর্ণি পুতুলপট্টি 






পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার সদর শহর হল কৃষ্ণনগর। কালীভক্ত ও বিদ্যোৎসাহী রাজা ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। শিল্পের প্রতি তাঁর  আগ্রহ ছিল।  তাঁরই নামানুসারে শহরটির নামকরণ করা হয়েছিল। পূর্বে জায়গাটির নাম ছিল রেউই।  কৃষ্ণনগরের একটি অঞ্চলের নাম ঘূর্ণি। এই ঘূর্ণির মাটির পুতুল ও মূর্তির খ্যাতি জগৎজোড়া। এখানকার মৃৎশিল্পীদের সূক্ষ্ম হাতের কাজ দেখার মত। এখানকার সূক্ষ্ম শৈলী কৃষ্ণনগর ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না।  এখানকার মাটির কাজ পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ কুটির শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম।  কথিত আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে এখানে এই শিল্পের সূচনা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন বাংলাদেশের নাটোর প্রদেশ থেকে কয়েকজন মৃৎশিল্পী এখানে এসে মাটির পুতুল নির্মাণ শুরু করে। এরপর এখানে ধীরে ধীরে অন্যান্য জায়গা থেকে আরও মৃৎশিল্পী  এসে বসবাস শুরু করে। সেই থেকেই এখানে মৃৎ শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং ব্যাপকতা লাভ করে।  ক্রমেই এই শিল্প বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে পড়ে। 





কৃষ্ণনগর শহরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে জলঙ্গি নদী বয়ে চলেছে।  এই নদীর কাছেই ঘূর্ণির মৃৎশিল্পের উপনিবেশটি গড়ে উঠেছে। এই নদী তীরে মাটির নৌকা এসে ভেড়ে। সেই মাটি সংগ্রহ করে মৃৎশিল্পীরা বছরের পর বছর ধরে তাদের সুক্ষ্ম কারুকাজ ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বজায় রেখে চলছেন।   


এখানে মাটি খুব সহজলভ্য। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা রাজমহলের মাটি নিয়ে কাজ করে। এখানে  বেলে  ও দো-আঁশ মাটির মিশ্রনের সাথে পরিমাণ মতো এঁটেল মাটি ব্যবহার করে পুতুলগুলো নির্মাণ করা হয়। এখানে ছাঁচের পুতুল ছাড়াও হাত দিয়ে তৈরী নানারকম পুতুল গড়া হয়ে থাকে।  মাটি ছাড়াও ফাইবারের তৈরী বিভিন্ন পুতুলও নির্মিত হয়। 


কৃষ্ণনগর পৌরসভা এলাকার তিনটে অঞ্চলে মৃৎশিল্পীদের সুদীর্ঘকালের বসতি গড়ে উঠেছে। শহরের উত্তর-পূর্ব  উপকণ্ঠে ঘূর্ণিতে, শহরের দক্ষিণে নতুনবাজার রথতলা অঞ্চলে আর তৃতীয়টি হল ঘূর্ণির সংলগ্ন কুমোরপাড়া-ষষ্ঠীতলা। এই শিল্পের সাথে এখানে প্রায় তিনশো জন নারী-পুরুষ ও কিশোর জড়িত রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় নব্বই শতাংশ জাতিতে কুমোর। এছাড়া বাকি দশ শতাংশ অন্যান্য জাতি  এই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। 





শুধু মাটির পুতুল নয় এখানকার দূর্গা প্রতিমাও খুবই বিখ্যাত। কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল যারা তৈরী  করে তারা সাধারণত বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন।  শুধু আমাদের দেশ নয় তাঁদের অনেকেই বিশ্বের দরবারেও সম্মান অর্জন করেছে অর্থাৎ তাঁরা আন্তর্জাতিক স্তরে  সম্মানিত হয়েছেন। কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের মধ্যে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান ও পদক পান শ্রীরাম পাল। তাঁকে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প শৈলীর আদিপুরুষ বলা হয়। পরবর্তীকালে শ্রী মতিলাল পাল, শ্রী সুবীর পাল  ও আরো অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। কৃষ্ণনগরের সবচেয়ে যশস্বী কারুকার ছিলেন যদুনাথ পাল।  যদুনাথ পালের পর সাফল্য ও জনপ্রিয়তায় উল্লেখযোগ্য ছিলেন গোপেশ্বর পাল। কিশোর বয়সেই তিনি অবশ্য কলকাতার কুমোরটুলিতে চলে আসেন।  এছাড়া কার্তিক পাল,  বাদল পাল,  শংকর সরকার, গৌতম পাল ইত্যাদি কয়েকজন আজও এখানকার ঐতিহ্যমন্ডিত মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন।   রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায় ও গগনেন্দ্রনাথ  ঠাকুর এখানকার মৃৎশিল্পীদের সমাদর করেছেন। তাঁরা এই শিল্পের গুনগ্রাহী ছিলেন।  

কিভাবে যাবেন : 

শিয়ালদহ  স্টেশন থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে কৃষ্ণনগর স্টেশনে নামুন। সময় লাগবে ঘন্টা আড়াই। কৃষ্ণনগর  স্টেশন থেকে টোটো গাড়ি করে ঘূর্ণি পুতুলপট্টিতে চলে আসুন। 





তারিখ :১৫-০৬-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 





Wednesday, April 27, 2022

এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিব লিঙ্গ

এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ  শিব লিঙ্গ 

সুদীপ্ত মুখার্জী 






কলকাতা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে নদীয়া জেলায়  মাজদিয়া নামে  একটা ছোট্ট গ্রাম রয়েছে। গ্রামটির পরিচয়  বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে অজানা। এই গ্রামে গেলে দেখা মিলবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ শিবলিঙ্গের। শিবনিবাস বাংলার ইতিহাস খ্যাত ও পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ এক প্রাচীন স্থান।    কেউ কেউ শিবনিবাসকে পশ্চিমবঙ্গের কাশী  বলে থাকে। 

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়  এই অঞ্চলে বহু প্রাচীনকালে নসরৎ খাঁ নামে এক দুর্ধর্ষ ডাকাত বাস করতো। সেই  ডাকাতের নাম থেকেই অঞ্চলটির নাম হয়েছিল নসরৎ বেড়। নসরৎ ডাকাতের উৎপাতে অঞ্চলের সকলেই অত্যাচারিত হত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই ডাকাতকে দমন করার জন্য মাজদিয়ার জঙ্গলে উপস্থিত হন। সেই ডাকাতকে দমন করার পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র  পরদিন সকালে  নিকটবর্তী নদীতে মুখ ধুতে গেলে নদীর স্রোতে  ভেসে  আসা একটা  রুই মাছ লাফিয়ে মহারাজার পায়ের ওপর এসে পড়ে। এই ঘটনায় মহারাজার এক আত্মীয়ের কাছে ঘটনাটা খুব শুভ বলে মনে হয়েছিল। বাংলায় যখন বর্গী আক্রমণ ঘটেছিল সেই সময় মহারাজ সাময়িকভাবে তাঁর রাজধানীকে মাজদিয়ায় সরিয়ে নিয়ে আসেন। কেউ কেউ বলে থাকেন মহারাজ তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরকে বর্গীর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন।  মহারাজ এই স্থানে একটি শিব মন্দির স্থাপন করেন। তিনি মন্দিরে কষ্টিপাথরের নির্মিত একটা সুবিশাল শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা করেন।  



১৭৫৪ সালে অর্থাৎ ১৬৭৬ শকাব্দে  মাজদিয়ায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি রাজ রাজেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত হয়। কথিত রয়েছে, মহারাজ তাঁর প্রথম স্ত্রীর জন্য নাকি  এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।

 মন্দিরটি একটা উঁচু ভিত্তিবেদীর ওপর স্থাপিত। মন্দিরটি আটকোনা।  খাড়া দেওয়ালের        প্রতি কোনায় মিনার ধরণের আটটি থাম রয়েছে। মিনার বিশিষ্ট এই মন্দিরটির চূড়া সমেত  উচ্চতা ১২০ ফুট।  মন্দিরের সুউচ্চ চূঁড়াটি নদীর ঘাট থেকে দেখতে পাওয়া যায়। প্রবেশদ্বারে খিলান ও অবশিষ্ট দেওয়ালে একই আকৃতির ভরাট করা নকল খিলান পরিলক্ষিত হয়।  মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ যার উচ্চতা ৯ফুট এবং প্রস্থ ২১ ফুটের মতো। এই সুউচ্চ শিবলিঙ্গের নাম রাজ্ রাজেশ্বর। গর্ভগৃহে ঢুকে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তবে দেবাদিদেব মহাদেবের মাথায় জল বা দুধ  ঢালা যায়। ভক্তরা একদিকের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে জল বা দুধ ঢালে আর অন্যদিকের সিঁড়ি   দিয়ে নেমে দেবমুর্তিকে প্রদক্ষীণ  করে  থাকে। গ্রামবাসীরা অবশ্য এই মন্দিরটিকে বুড়ো শিব মন্দির বলে থাকে। এই মন্দিরের ছাদ ঢালু এবং গম্বুজ রয়েছে।  ঐতিহ্যবাহী বাঙালি কাঠামো অনুসরণ করে এটা নির্মিত না। এই মন্দিরে যেমন রয়েছে পোড়ামাটির কাজ তেমন রয়েছে ইসলামিক ও গোথিক কাজের নিদর্শন। 

এই অঞ্চলে মহারাজ সেই সময় নাকি ১০৮টি শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যা কালের গর্ভে আজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে পাশাপাশি তিনটি মন্দির দেখা যায়  রয়েছে।  রাজ্ রাজেশ্বর মন্দিরের পূর্ব দিকে রয়েছে চার চালা  বিশিষ্ট একটি (দ্বিতীয়) মন্দির। মন্দিরটির নাম রাঙ্গীশ্বর মন্দির। এই মন্দিরটির উচ্চতা  ৬০ ফুট।  এই মন্দিরটির ভিতরে রয়েছে ৭ ফুট উচ্চতার  শিবলিঙ্গ।  এই মন্দিরটির পাশে দেখা যায় রাম-সীতার মন্দির। এই মন্দিরটিও ১৭৪৩ সালে মহারাজ তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেছিলেন। পশ্চিমমুখী মন্দিরটি ভিত্তিবেদীর উপর অবস্থিত। মন্দিরটির  উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। এই মন্দিরের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কালো কষ্টিপাথরের রামচন্দ্র, অষ্টধাতুর নির্মিত দেবী সীতা ও শ্রীরামচন্দ্রের অনুজ লক্ষণ।  




 
এখানে সারাবছর দর্শনার্থীদের দেখা মিললেও শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার এখানকার শিবলিঙ্গে জল ঢালার জন্য লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম হয়।  প্রতি বছর  ভীম একাদশীতে এখানে মেলা বসে এবং তা চলে শিবরাত্রি পর্যন্ত।  শিবনিবাস মন্দিরে যাওয়ার জন্য পথে পরে চূর্ণী নদী।  চূর্ণী নদীর উপর বাঁশের  তৈরী একটা সাঁকো রয়েছে। সাঁকোটা পার হয়ে মন্দিরে যেতে হয়। এই সাঁকো ও তার আশপাশ অঞ্চলটি খুবই মনোরম।  ছবি তোলার জন্য খুবই আদর্শ।  

পূর্বেই বলেছি শিবনিবাসকে বাংলার কাশী বলা হয়, যদিও এখানে কাশীর মতো গঙ্গা নদী বয়ে যায় না, এখানে মন্দিরের পাশ দিয়ে চূর্ণী নদী প্রবাহিত হয়। 





কিভাবে যাবেন : শিয়ালদহ থেকে গেদে  লোকাল ধরে মাজদিয়া স্টেশানে পৌঁছান। সময় লাগবে আড়াই ঘন্টা। স্টেশান  থেকে টুকটুকি (টোটো)  গাড়ি করে শিবনিবাস গ্রামে  চলে আসুন । ভাড়া নেবে ১০ থেকে ১৫ টাকা।এখান  থেকে পায়ে হেঁটে একটা বাসের সাঁকো পার হয়ে যেতে হবে।  এই সাঁকো পার হওয়ার জন্য যাওয়া ও আসার ভাড়া  জন প্রতি  ৪ টাকা লাগবে।  


তারিখ :-২৭-০৪-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Sunday, April 10, 2022

কাশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা



কাশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা

সুদীপ্ত মুখার্জী 


কাশী হল হিন্দুদের পবিত্র তীর্থভূমি এবং পৃথিবীর প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। বহু প্রাচীনকাল থেকেই পূণ্যকামী মানুষদের এই তীর্থে বারে বারে ছুটে আসতে দেখা যায়।প্রাচীন  শৈব্যতীর্থ এই কাশীর আধুনিক নাম হয়েছে বারাণসী।  হিমালয়ের বুকে উত্তরকাশীর দুপাশ দিয়ে বয়ে আসা দক্ষিণে অসি ও উত্তরে বরুণা  নদী। বরুণা ও অসি এই দুই নদী প্রবাহিত হয়ে এসে কাশীর গঙ্গায় মিলিত হয়েছে। বরুণা ও অসি নদীর নাম একত্র করে বারাণসী নামের সৃষ্টি। পতিতপাবনী, জীবনদায়িনী ও স্রোতস্বীনি পবিত্র গঙ্গার তীরেই হিন্দুতীর্থ বারাণসীর অবস্থান। কাশী-বারাণসী নিজেই নিজের তুলনা। প্রাচীনত্বের নিরিখে কাশীর খ্যাতি জগৎজোড়া। এই তীর্থভূমিতে যেমন আছেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রথম  লিঙ্গ বিশ্বনাথজী ঠিক তেমন রয়েছেন কাশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা অন্নপূর্ণা। 

এখানকার বিশ্বনাথ মন্দির ও অন্নপূর্ণা মন্দির হিন্দুধর্মের পীঠস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম  ও খুবই জনপ্রিয়। গঙ্গাতীরে দশাশ্বমেধ ঘাট মানেই কাশী, কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির, মা অন্নপূর্ণা হল কাশীবাসীদের কাছে সব।  জনশ্রুতি অনুসারে এই স্থানেই বাবা বিশ্বনাথের সাথে দেবী অন্নপূর্ণার সহাবস্থান রয়েছে। এখানে বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের ঠিক পাশে রয়েছে দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির। দূরদূরান্ত থেকে অগণিত ভক্ত প্রতিদিন কাশীধামে আসেন এবং দেবী অন্নপূর্ণার প্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন। 

 
অন্নদাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা বা অন্নদা দেবী যিনি দেবী দুর্গার এক রূপ। মূলত দেবী দ্বিভূজা  হয়ে থাকেন। দ্বিভূজা দেবীর বামহস্তে অন্নপাত্র এবং ডানহাতে থাকে দরবিও অর্থাৎ চামচ বা হাতা।  প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দেবী অন্নপূর্ণার বিশাল আয়োজনে পূজা করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে আমরা দেবী অন্নপূর্ণার উল্লেখ দেখতে পাই। আধ্যাতিক সাংস্কৃতিক নগরী কাশীর জগন্মাতা হলেন রাজরাজেশ্বরী  অন্নাপূর্ণা।  দেবী অন্নপূর্ণাকে ঘিরে নানারকম কাহিনীর কথা শোনা যায়।  এইসব কাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাসদেবের কাশী প্রতিষ্ঠার উপাখ্যানও । 

আমরা জানি মুঘল আমলের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্রাট কাশীর একাধিক মন্দির চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে গেছেন। পরবর্তীকালে তা আবার কেউ না কেউ গড়ে দিয়েছেন। কথিত আছে, বাবা বিশ্বনাথ হলেন কাশীক্ষেত্রের নির্মাণকর্তা, কালভৈরব হলেন দ্বারপাল আর মা অন্নপূর্ণা হলেন কাশীক্ষেত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বিশ্বনাথ মন্দিরের ঠিক পাশে ও ঢুন্ডিরাজ গণেশের পরে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করে ডানদিকে পড়ে দেবী অন্নপূর্ণা মন্দিরের প্রবেশদ্বার। রূপোর কারুকার্য করা বিশাল দরজা হল প্রধান ফটক। এই প্রধান ফটক পেরোলেই মন্দিরসহ বিরাট নাটমন্দির অবস্থিত। গর্ভগৃহে রুপার আসনে উপবিষ্ট দেবী অন্নপূর্ণা। অপূর্ব মূর্তি। সোনার মুকুটে এখানে দেবী স্বর্ণময়ী, স্বর্নোজ্জ্বলা।  সুন্দর শাড়ি পরে ফুলের মালায় ঢাকা মা উপবিষ্ট রয়েছেন। বেশ উজ্জ্বল মুখমন্ডল, টানা টানা চোখযুগল। ১৭২৫ সালে দক্ষিণের রাজা বিষ্ণুপন্থ গাজাবেদী পূর্বেকার মন্দিরটি ভেঙে নতুন মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। নতুন মন্দিরের তুলনায়  পূর্বের মন্দিরটা বেশ ছোট ছিল।  বিগ্রহটি সোনার পাত দিয়ে মোড়া। দেবী অন্নপূর্ণার পাথরের আদি বিগ্রহটি অতি  জীর্ণ হয়ে যাওয়ায় এখন সর্বদাই মূর্তিটি ঢাকা থাকে সোনার আবরণে। মন্দির চত্বরে আরো কয়েকটি মন্দির রয়েছে।  মূল মন্দিরের বাঁদিকে কুবেরেশ্বর, ডানদিকে সূর্যদেব। এছাড়া গণেশ, যন্ত্রেশ্বর বিগ্রহ রয়েছে।  যন্ত্রেশ্বর বিগ্রহটির মাথায় খোদিত রয়েছে সুন্দরদেবী-যন্ত্রম। এটা খুবই প্রাচীন লিঙ্গ। এর পশ্চিম দিকে রয়েছে হনুমানজী দেবী মন্দিরের ঠিক সামনেই একটা আলাদা দালানের উপর রামচন্দ্রের মূর্তি। তীর্থযাত্রীদের নিকট যা সত্যনারায়ণ নামেই পরিচিত। এছাড়া ভবানীশঙ্করের একটা প্রাচীন মন্দির দালানে রয়েছে। কুবেরেশ্বররের ঠিক ওপরের ঘরে পূর্বেকার সোনার অন্নপূর্ণা বিগ্রহটি স্থাপিত রয়েছে। এই মূর্তিটি সবদিন দেখা যায় না, বিশেষ বিশেষ দিনে মূর্তিটিকে ভক্তদের দেখতে দেওয়া হয়। এই মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষেধ। তবে বিদেশী ও অহিন্দুদের জন্য নহবতখানা ঠিক উল্টোদিকে একটি ঝোলানো বারান্দা রয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে তারা দেবী অন্নপূর্ণাকে দর্শন করতে পারেন।  

কাশীতে তৈরী হয়েছে "কাশী অন্নপূর্ণা অন্নক্ষেত্র ট্রাস্ট"। বিনা খরচে  খাবার, অবৈতনিক  শিক্ষা ও  চিকিৎসা জনগণকে দেওয়া হল এই ট্রাস্টের প্রধান উদ্দেশ্য।  এই ট্রাস্টের মাধ্যমেই দেবী অন্নপূর্ণাকে অন্ন উৎসর্গ করা হয়।  তারপর সেই প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা  হয়। এখানকার ভোগ মন্দিরে বসেই খেতে হয়, তা মন্দির চত্বরের বাইরে আনা  যায় না।   

হিন্দু বিশ্বাস যে বাবা বিশ্বনাথের কাশীতে মা অন্নপূর্ণার কৃপায় কখনো কেউ অভুক্ত থাকে না। এই অন্নদায়িনী দেবী অন্ন  দিয়ে  দীন-দরিদ্র সকলেরই দুঃখ দূর করেন।   দেবী অন্নপূর্ণার এক নাম ভবানী।  কাশীতে ঘোরতর সংসারী হলেন বাবা বিশ্বনাথ। তাঁর স্ত্রী হলেন দেবী ভবানী। দেবী ভবানী বা অন্নপূর্ণা কাশীর নিত্যদেবী। কাশীতে ফুল-মালা, দীপ, ধূপ  ও নৈবেদ্য সহকারে অর্চনা করলে সংসারে কোনোদিন খাদ্যের অভাব ঘটবেনা বলে বিশ্বাস রয়েছে।  


পুরাণে  বলা আছে, যে মহাদেবের সাথে দেবীর মতবিরোধ হওয়ার জন্য তিনি কৈলাশ ত্যাগ করেন।  তাঁর কৈলাশ ত্যাগের  কারণে চারদিকে মহামারি ও খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সেই সময় ভক্তদের ঠিক রাখার জন্য মহেশ্বর ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু দেবীর মায়ায় তাঁর ভিক্ষার অভাব ঘটে। তখন দেবাদিদেব মহাদেব জানতে পারেন যে কাশীতে এক নারী রয়েছেন যিনি সকলকে অন্ন দান করেন। এই কথা শুনে মহাদেব তাঁর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে কাশীর  উদ্দেশ্যে  রওয়ানা দিলেন।  এখানে তিনি দেবীর নিকট থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করে ভক্তদের বিপদ থেকে রক্ষা করলেন।  


তারিখ :১০-০৪-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।