Tuesday, August 25, 2020

ইঞ্জিয়ারের নামেই সেতু >P

ইঞ্জিয়ারের নামেই সেতু 





১৯৭৪ সাল।  আগস্ট  মাসের ২ তারিখ।  শহরে ঘটে গেলো এই নৃশংস হত্যাকান্ড। নিহত হলেন ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের তরুণ নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞ কুমার বসু।  তখন কসবা, বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, সন্তোষপুর এই অঞ্চলগুলো ছিল আজকের মতো জনপ্লাবিত নয়,  নিছকই কিছু এপার-ওপার বাংলার মানুষের বাস। অঞ্চলগুলোকে ঠিক শহর বলা চলে না।  শহর আর এই অঞ্চলগুলোর মাঝে একটা  রেল লাইন আছে। এই লাইনটি  শহর আর মফস্বলের  মধ্যে তফাৎ গড়ে দিয়েছিল। 

যাদবপুরের পূর্বদিকে সন্তোষপুর নামে একটা জায়গা আছে. সেই সময় জায়গাটা একদম নবীন একটা পল্লী হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। এই সন্তোষপুরেই ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসের ২ তারিখে তরুণ ইঞ্জিনীযার  তার বোনের বাড়িতে এসেছিলেন। কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতে পৌঁছে গিয়েছিল।  তরুণ বাড়ি যাওয়ার জন্য যাদবপুর স্টেশনে এসে পৌঁছলো। সে তখন উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে থাকতো।  ঘড়িতে তখন রাত  ৯টা  বাজে। ট্রেন আসতেই সে উঠে পড়লো। রাত অনেকটা হয়ে যাওয়ায় গাড়িটা বেশ ফাঁকাই ছিল,  কিছু পুরুষ ও  কয়েকজন মহিলা কামরাটিতে ছিল।  ট্রেনটি যাদবপুর থেকে ছেড়ে ঢাকুরিয়া স্টেশনে এসে থামলো।  এখান থেকে কয়েকজন যুবক ট্রেনটিতে উঠলো। যথাসময়ে গাড়ি ছাড়লো। যুবকগুলো গেটের ধারে  দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। গাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে তারা স্বমূর্তি ধারণ করল।  কেউ ছোড়া, কেউ ছুরি, কেউ বন্দুক উঁচিয়ে অতর্কিতে যাত্রীদের উপর আক্রমণ করতে আরম্ভ করল। মহিলা যাত্রীদের গহনা, পুরুষ যাত্রীদের মানিব্যাগ, ঘড়ি, আংটি ছিনিয়ে নিতে লাগলো। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না। তারা সব কিছু তাদের হাতে তুলে দিতে লাগল।  তরুণ ইঞ্জিনীযার বিজন কুমার বসু আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। তার শরীরে তখন এক তরতাজা যুবকের রক্ত টকবগ করে ফুটছে।    তিনি প্রতিবাদে সরফ হলেন।  ছিনতাইবাজরা বালিগঞ্জ স্টেশনে নামার উদ্যোগ নিল, কিন্তু তারা নামতে পারলো না। বিজন  বাবু তাদের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন।  তার সাথে যাত্রীদের কেউ গলা মেলালো না।  চার পাঁচজন তরুনের সাথে মাত্র একজন কি করে পেরে উঠবে। যথারীতি  তিনি একা তাদের সাথে যুজঁতে পারলেন না।  আক্রমণকারীরা ছোড়া, ছুরির আঘাতে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করলো। চলন্ত গাড়ি থেকে তার দেহটিকে ছুড়ে ফেলে দিলো। পরের স্টেশনে ছিনতাইবাজরা নেমে গেলো।  সবাই চুপ করে বসে রইলো, কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না।  

গাড়ি যথাসময়ে শেয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছলো।  প্রতক্ষ যাত্রীরা সবাই নিজেদের গা বাঁচিয়ে নেমে চলে গেল।  এতবড় ঘটনার কথা কেউ পুলিশকে জানানোর প্রয়োজনটুকু অনুভব করলো না। কেউ  জানালো না।  যে যার বাড়ির পথে রওনা দিলো। একজন মাত্র বছর ছত্রিশের  তরুণ যাদের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিল  তারা তার প্রতি সামান্যতম সৌজন্য দেখানোর কথা ভাবল না, নিজেদের পিঠ বাঁচিয়ে চলে গেলো।  

সব মানুষ সমান হয় না।  বনগাঁর বাসিন্দা  এক বয়স্ক সাধু  নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। সাধু  প্রভূচরণ দাস স্বচক্ষে যা দেখেছেন তা রেল পুলিশকে জানালেন। তিনি এও বলে গেলেন তদন্তের স্বার্থে যদি কোনো প্রয়োজন হয়,  তিনি সব সময় সাহায্য করতে আসবেন। 

সেই সময় শিয়ালদহ  রেল পুলিশের সুপার ছিলেন উমাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।  তিনি সব জেনে তৎক্ষণাৎ লাশ তুলে মর্গে পাঠালেন। খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়লো। পরের দিন শহরের বহুল প্রচারিত দৈনিকগুলোতে খবরটা প্রথম পাতায় মোটা হরফে ছাপা হল।  চারদিকে সোরগোল পরে গেলো।  তরুণ যেহেতু সি আই টির  কর্মচারী ছিলেন, তাই তার কার্যালয়ের কর্মীরা এটা খুন না দুর্ঘটনা এই নিয়ে প্রশ্ন তুললো।  তদন্তের দায়িত্ব নিলেন তৎকালী সিআইডির প্রধান জে  সি তালুকদার। তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কার রায়। তার সরকার নড়ে চড়ে বসল।   তদন্ত  তার নিয়মে চলতে লাগলো।  প্রচিলত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বেশ কয়েকদিন ধরে বিজন বসু হত্যা রহস্য জায়গা করে নিয়েছিলো।  এইভাবে তদন্ত তার নিয়মে চলতে লাগলো। কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর।  কিন্তু রহস্যের কোনো কিনারা হলো না।  ধরা গেলো না ঘাতকদের। অপরাধীরা শাস্তি পেলো না। 

 বছর ৪০ আগে ১৯৭৮ সালে বালিগঞ্জ রেল স্টেশানের পাশে একটা সেতু নির্মাণ করা হল।  সেতুটির নামকরণ করা হল সাহসী তরুনের নাম। সকলের সম্মতিতে  সেতুটিকে তার নাম উৎসর্গিত করা হলো।  হত্যাকান্ড ও সেতু নির্মাণের মাঝে এই  লাইন দিয়ে বহু ট্রেন চলে গেছে। পাল্টে গেছে বাংলার সরকার। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মধু দণ্ডবতের স্ত্রী প্রমীলা দণ্ডবতে ও পশ্চিমবাংলার তৎকালীন  মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু  সেতুটির উদ্বোধন করেছিলেন। 





 লেখা :  সুদীপ্ত মুখার্জী 

তারিখ : 25  আগস্ট, ২০২০ 

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪ ২০৭৫০ 

👉 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।  পরবর্তী লেখাগুলো পেতে বগতিকে ফলো করে রাখুন।  






Saturday, August 15, 2020

ভারতের জাতীয় পতাকার সাতকাহন >P

ভারতের জাতীয় পতাকার সাতকাহন 



পতাকা হলো কোনো দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আর জাতীয় মর্যাদার প্রতীক। পৃথিবীর প্রত্যেক স্বাধীন দেশের একটা করে জাতীয় পতাকা থাকে। মর্যাদার সঙ্গে জাতীয় পতাকা সম্মান রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য।  পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো ভারতবর্ষেরও  একটি নিজস্ব জাতীয় পতাকা রয়েছে।  

 ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ব্রিটিশ সরকার ভারতকে ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দেবে বলে ঘোষণা করে। ভারত স্বাধীনতা পায় ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। সেই থেকে ১৫ই আগস্ট  ভারতের সর্বত্র স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় পতাকা উত্তলন করা হয়। আমরা জানি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল।  ভারতবাসীদের তীব্র ও দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বহু সংগ্রামীর জীবনের মূল্য দিয়ে এই স্বাধীনতা আমরা লাভ করেছিলাম। স্বাধীন ভারতের একটা নিজস্ব পতাকা হওয়া  উচিত বলে সবাই মনে করলেন। ১৯৪৭ সালের ২২শে জুলাই গণপরিষদের অধিবেশনে ভারতের বর্তমান পতাকার রূপরেখাটি গৃহীত হয়েছিল।  পরবর্তী সময়ে এই পতাকাটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয়  পতাকার মর্যাদা লাভ করেছিল।  

ভারতের জাতীয় পতাকাটি হলো আয়তাকার। পতাকাটি ত্রিবর্ণরঞ্জিত। প্রস্থ হয় দৈর্ঘ্যের  দ্বিগুন।  পতাকায় তিনটি রঙের জায়গা সমান থাকে। পতাকার কেন্দ্রে থাকে চব্বিশটি দণ্ড বিশিষ্ট নীল রঙের অশোকচক্র। এই অশোকচক্রের উপরে গেরুয়া, মাঝে সাদা আর নিচে সবুজ রং থাকে। এই তিনটি রঙের আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। উপরের গেরুয়া রংটি হল ত্যাগের প্রতীক, মাঝের সাদা রংটি হল শান্তির ও পবিত্রতার প্রতীক আর নিচের সবুজ রংটি নির্ভীকতা, জীবনধর্ম ও তারুণ্যের প্রতীক।  মাঝের সাদা অংশটিতে একটি চক্র রয়েছে।  চক্রটি হলো সম্রাট অশোকের ধর্ম চক্রের অনুকরণে নির্মিত।  এই চক্রটিতে ২৪ টি স্পোক রয়েছে।  এই ২৪ টি স্পোকও ২৪টি অর্থ বহন করে।  এই স্পোকগুলির অর্থ হল ১) ধৈর্য্য, ২) আরোগ্য, ৩) শান্তি, ৪) ত্যাগ, ৫) অনুশাসন, ৬) সেবা, ৭) ক্ষমা, ৮) মৈত্রী, ৯) বন্ধুত্ব, ১০) সংগঠন, ১১) কল্যাণ, ১২) সমৃদ্ধি, ১৩) অধিকার, ১৪) কর্তব্য, ১৫) সহকার্য্য, ১৬) ন্যায়, ১৭) নীতি, ১৮) অর্থ, ১৯) সমতা, ২০) নিয়ম, ২১) ভালোবাসা, ২২) নিরাপত্তা, ২৩) সুরক্ষা, ২৪) উদ্যোগ।   

  পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া কৃত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বরাজ পতাকার ভিত্তিতেই এই পতাকাটির নকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয় পতাকার নকশাকার।  ১৯৫০ সালে ভারতীয় সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।  ১৯৫২ সালে ভারতীয়  মানক ব্যুরো  প্রথমবার জাতীয় পতাকা উৎপাদন সংক্রান্ত বিধি নিয়ম প্রকাশ করে।  ১৯৬৮ সালের ১৭ই আগস্ট পুনরায় এই নিয়মের কিছু সংশোধন করা হয়।  নিয়ম অনুযায়ী এই পতাকা একমাত্র খাদি নামক তাঁতবস্ত্রের কাপড়ে তৈরী করা হয়। তুলো, রেশম ও উল ছাড়া অন্যকিছু কাঁচা মাল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।
  
ভারতের জাতীয় পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কয়েকটি নিয়ম বেঁধে দেওয়া হযেছে। ভারতীয় মানক  ব্যুরো এই পতাকা উৎপাদনের পদ্ধতি ও নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন স্থির করে দিয়েছে।  জাতীয় পতাকা উৎপাদনের অধিকার কেবল খাদি উন্নয়ন ও গ্রামীণ শিল্প কমিশনের হাতে রয়েছে।  এই কমিশন বিভিন্ন আঞ্চলিক গোষ্ঠীকে উৎপাদনের অধিকার দিয়ে থাকে।  ২০০৯ সালে তথ্য অনুযায়ী কর্ণাটক খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘ জাতীয় পতাকার একমাত্র উৎপাদক।  

 ভারতের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর।  ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়।  তার পতাকার রং ছিল সবুজ।  উপরের দিকে সোনালী রঙের পদ্ম  ছিল।   এরপর ভগিনী নিবেদিতা ১৯০৫ সালে একটি লাল রঙের একটি পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পতাকাটির চারধারে ১০৮টি শিখা  আর মাঝখানে হলুদ রঙে বজ্র ছিল। বজ্রটির বাঁদিকে "বন্দে" আর ডানদিকে "মাতরম" কথাটি লেখা ছিল।  ১৯০৭ সালে ম্যাডাম ভিকাজী রুস্তম কামা বিদেশের মাটিতে প্রথম ভারতের পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন। ১৯১৭ সালে এনি বেসান্ত ও বাল গঙ্গাধর তিলক একটি নতুন পতাকার কথা ভেবেছিলেন।  ১৯২১ সালে গান্ধীজি প্রথম তাঁর পতাকা নিয়ে আসেন।  এই পতাকাটির উপরদিক থেকে তিনটি রং আড়াআড়ি ভাবে তিনটি সমান ভাগে ভাগ করা ছিল।  রংগুলো সাদা, সবুজ ও লাল ছিল।  মাঝখানে একটি রেখা আঁকা ছিল।  ১৯৪৭ সালের ২২ শে  জুলাই ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরী করা হয়েছিল।  ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্য রাত্রে গণ পরিষদের  হাতে জাতির উদ্দেশ্যে পতাকাটি তুলে দেওয়া হয়। তারপরের দিন মাঝ রাতে ১৫ই আগস্ট জওহরলাল নেহেরু ভারতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দিল্লিতে জওহরলাল নেহেরু  স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী রূপে কারও ভার গ্রহণ করলেন।  মাউন্ট ব্যাটন স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন। এই দিন সর্বপ্রথম দিল্লির লালকেল্লা থেকে জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন কর হয়।  তার সাথে প্রত্যেকটি রাজ্যের রাজধানীগুলোতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।  দিনটিকেএ সাদা দেশে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।  সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানি এই দিন প্রতিবছর ছুটি থাকে। বহু জায়গায় পতাকা উত্তোলনের সাথে  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।   


 লেখা :  সুদীপ্ত মুখার্জী 

তারিখ : ১৫ই আগস্ট, ২০২০ 

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪ ২০৭৫০ 

👉 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।  পরবর্তী লেখাগুলো পেতে বগতিকে ফলো করে রাখুন।  


Saturday, August 8, 2020

অস্তাচলে রবি> P

অস্তাচলে রবি 

সুদীপ্ত মুখার্জী 



নিমতলা মহাশ্মশান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাধিস্থল 






"সম্মুখে দেখছি অপরাহ্নের সূর্য শেষ বিদায়ের পথ নিচ্ছে - ভাগীরথীর গৈরিক জলপ্রবাহে উঠেছে এক করুন তাপ - আজ সমস্ত বাংলার বুকে দীর্ঘশ্বাসের ওঠা-পড়া - বাতাসে হাহাকার - বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ আর নেই।  রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের জানি, কিন্তু তিনি বাঙালির রবিঠাকুর, বাঙালির গৌরব, বাঙালির প্রাণের প্রাণ, একটি আপনজন। - আজ সূর্যকে কি বিসর্জন দিয়ে চিররাত্রির অন্ধকারের মধ্যে বাঙালি জাতি আত্মগোপন করবে - না আবার সে নবসূর্যের আলোক সভাতলে জ্যোতির সমুদ্রে স্নান করতে পারবে ? সমগ্র বাঙালির মনে এই প্রশ্ন উঠছে বার বার, আজ তাই সকলের মনে এই প্রার্থনা জেগে উঠছে, হে কবি, হে পুরাতন, হে চিরনূতন - রাত্রির অবসান ক্ষণিক হোক - আগামীকালের নবপ্রভাতে নূতনরূপে তুমি দেখা দাও, - দেখা দাও আবার হে নুতন। "  - শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র 


বৃহস্পতিবার ৭ই আগস্ট, ১৯৪১ সাল  (২২শে  শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ঘড়িতে তখন দুপুর ১২টা  বেজে গেছে হঠাৎ সকলকে শোকাতুর করে চলে গেলেন বিশ্বের কবি, বাঙালির প্রাণের কবি। ৮০ বছর ৩ মাস বয়সে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। 
 
কবি তাঁর শেষ দিনগুলোতে খুবই ভুগছিলেন।  শান্তিনিকেতনে কবিরাজি ও এলোপ্যাথি উভয় পদ্ধতিতে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু কোনো চিকিৎসাতেই তিনি সুস্থ হচ্ছিলেন না। শরীরে একটা ছোট অস্ত্রপ্রচারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কবিগুরুর মন একদমই চাইছিলো না শেষ বয়সে এসে এই কাটা ছেঁড়া করাটা। 

মৃত্যুর সপ্তাহ দুই পূর্বে ২৫শে জুলাই কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে অসুস্থ শরীরে চিকিৎসার সুবিধার জন্য কলকাতায় নিয়ে আসতে হয়েছিল। কবিকে ছেড়ে আসতে  হয়েছিল তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের ও শান্তিনিকেতনকে।  সেদিন দুপুর ৩টা ১৫ নাগাদ তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এসে পৌঁছলেন। ৩০শে জুলাই তাঁর অস্ত্রপ্রচার হওয়ার কথা। ৩০শে জুলাই  যথাসময়ে তাঁর  অস্ত্রপ্রচার হয়। সেইদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি অসুস্থ শরীরেই একটি বড় কবিতা লিখলেন ও তাঁর স্নেহের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে একটা চিঠিও  লিখলেন।  সকাল  ১১টা  নাগাদ তাঁকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে আসা হলো, মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে অপেরেশনটি  শেষ হয়ে যায়। অপারেশন করলেন বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ডাক্তার ললিত ব্যানার্জী।  অপেরেশনের পর থেকে তাঁর শরীরটা আরো ভেঙে গেলো। শরীরে তাপমাত্রা ও ভারসাম্যের হেরফের হতে লাগলো। ৬ই আগস্ট ঠাকুরবাড়িতে উৎসুক মানুষের ভিড়। কবির শরীর আর ডাক্তারের আয়ত্তের মধ্যে থাকছিল না। কবির তখন হিক্কা উঠছিল।  ২২শে শ্রাবণ (৭ই আগস্ট) ভোররাত্রি থেকেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মোটর গাড়ির  আনাগোনা চলছিল।  নিকট আত্মীয়, বন্ধু,  প্রিয়জন সব দলে দলে আসছেন। সকাল  থেকেই ভক্তরা জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জমায়েত হতে লাগল। বেলা ১২টা নাগাদ তাঁর নিঃশ্বাস কম হতে লাগলো। শরীরের উষ্ণতা কমে আস্তে লাগল। তাঁর শরীরের তখন  আরো অবনতি হল। ধীরে ধীরে শেষের সেই সময় আসতে লাগলো। ১২টা ১০ মিনিট, কবির শেষ  নিঃশ্বাস পড়লো।  একেবারেই তা থেমে গেলো। তিনি  চির বিদায় নিলেন।  বাংলার আকাশে সেই সময় হঠাৎই যেন সূর্যাস্ত হয়ে গেলো। সূর্য্যের মতোই যিনি জ্বলজ্বলে মূর্তিতে দীপ্যমান থেকে চিরকাল জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি  তাঁর লেখনীতে সকল বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে গেছেন, এই সেই রবি যা আজ অস্তাচলে। রবি ঠাকুর অমৃতলোকে যাত্রা করলেন।  বাইরে জনতার কোলাহল শুরু হয়ে গেলো। সবাই একবার তাদের প্রাণের গুরুদেবকে শেষবারের মত  দেখতে চায়।

রানী চন্দ্রের বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই - "গুরুদেবকে সাদা বেনারসী  জোড় পরিয়ে সাজানো হল।  কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, পাট-করা চাদর গলার নীচ থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো, কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা, দুপাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল রজনীগন্ধা। বুকের ওপর রাখা হাতের মাঝে একটি পদ্মকোরক ধরিয়ে দিলাম; দেখে মনে হতে লাগল যেন রাজবেশে রাজা ঘুমোচ্ছেন রাজশয্যার উপরে। ক্ষণকালের জন্য যেন সব তন্ময় হয়ে রইলাম। একে একে  এসে প্রণাম করে যেতে লাগল নারীপুরুষে।  ব্রহ্মসংগীত হতে লাগল এক দিকে শান্তকণ্ঠে। 

ভিতরে উঠোনে নন্দদা সকাল থেকে তাঁর নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন। নকশা এঁকে মিস্ত্রি দিয়ে কাঠের পালঙ্ক তৈরী করালেন। গুরুদেব যে রাজার রাজা, শেষ-যাওয়াও  তিনি সেইভাবেই তো যাবেন।
 
তিনটে বাজতে হঠাৎ এক সময়ে গুরুদেবকে সব্বাই মিলে  নীচে নিয়ে গেল।  দোতলার পাথরের ঘরের পশ্চিম বারান্দা হতে দেখলাম - জনসমুদ্রের উপর দিয়ে একখানি ফুলের নৌকো নিমেষে বাইরে ভেসে চলে গেল।"

 
শোকার্ত বিহ্বল মানুষের উন্মাদনা ব্যাথার আগুনে পরিণত হল।  দিকে দিকে জমাট বাঁধা কান্নার রোল উঠতে লাগল। জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে নিমতলা পর্যন্ত সমগ্র রাস্তা  জনসমুদ্রে পরিণত হতে লাগল। সূর্যের দাবদাহে তপ্ত হয়ে ওঠা প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে চলেছে শোকাতুর মানুষের মিছিল। অচিরেই রাস্তাগুলোতে তৈরী হয়ে উঠলো জনসমুদ্র।  ধীরে ধীরে ওই জনসমুদ্র অতিক্রম করে কবিগুরুর নশ্বর দেহ বিকেল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট নাগাদ  নিমতলা শ্মশানঘাটে এসে পৌঁছলো।  উপস্থিত সকলের চোখে তখন বাঁধনহারা চোখের জল। সকলেই চোখের জলে নতমুখে কবিকে চিরবিদায় জানালেন।  

আকাশবাণী কেন্দ্র পনেরো মিনিট অন্তর  কবির অন্তিম যাত্রার ধারা বিবরণ দিচ্ছিল।   বীরেন্দ্রাকৃষ্ণ ভদ্র  তার আবেগঘন  কণ্ঠে এই দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমার লেখার প্রথম স্তবকে রয়েছে  আকাশবাণী থেকে প্রচারিত কবির শেষ যাত্রার বিবরণ। এই ধারাভাষ্যটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দেওয়া। 

চিত্র ও লেখা " সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২২শে শ্রাবণ , ১৪২৭ (ইং. ০৭-০৮-২০২০)
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪ ২০৭৫০ 



👉 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।  পরবর্তী লেখাগুলো পেতে বগতিকে ফলো করে রাখুন।  

Sunday, August 2, 2020

রাখী পূর্ণিমা ও উৎসব >P

রাখী পূর্ণিমা ও উৎসব 


বাঙালি বরাবরই উৎসব প্রিয় জাতি। তাদের রন্ধে রন্ধে বিভিন্ন উৎসব জড়িয়ে রয়েছে। কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।  শ্রাবণ মাসের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে ঝুলন পূর্ণিমার উৎসব। ঝুলন সাজিয়ে ছোটরা এই উৎসবে সামিল হয়ে থাকে। ঝুলনযাত্রা পাঁচ দিন ব্যাপী চলে। এটা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের উৎসব।  এই উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে রাখী  উৎসবের  মধ্য দিয়ে।  এই উৎসবের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, ও সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। এই উৎসব কবে কিভাবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে।  কিছু গল্পও  প্রচলিত রয়েছে।  

এই উৎসবটা সাধারণভাবে সর্বভারতেই উদযাপিত হয়ে থাকে। হিন্দু জৈন ও শিখরা এই উৎসবে সামিল হয়।  এটি  ভাই বোনের ভালোবাসা ও শুভ কামনার উৎসব।  এই দিন দিদি বা বোনেরা দাদা বা ভাইদের হাতে রাখী নামে  পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়।  এই সুতোর মাধ্যমে তারা  একে  ওপরের কাছে সারা জীবন রক্ষা নিজেদের করার শপথ গ্রহণ করে।

 মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে যে কোন এক যুদ্ধে কৃষ্ণের হাতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হয়, সেই সময় পাণ্ডবদের স্ত্রী দৌপদী তার শাড়ির আঁচলের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেয়।  এই ঘটনায় কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে দৌপদীকে তার ভগ্নি হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তিনি তাকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।  বহু বছর পর যখন কৌরবরা দৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে গেলে কৃষ্ণ তার সম্মান রক্ষা  করেন।  এইভাবেই রাখীবন্ধনের প্রচলন হয়।  

কথিত রয়েছে,  দৈত্যরাজা বলি বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন। বিষ্ণু বৈকুন্ঠ  ছেড়ে বলি রাজ্য রক্ষা করতে আসেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী তার স্বামীকেফিরে পাওয়ার জন্য সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে  বলিরাজার কাছে আসেন  এবং তাঁকে তার স্বামী নিরুদ্দেশ বলে জানান। তার স্বামী যতদিন না ফিরে আসবেন ততদিন তিনি রাজার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।  রাজা তার প্রার্থনা মনজুর করেন।  এই শ্রাবন পূর্ণিমার শুভ তিথিতে তিনি রাজার হাতে পবিত্র রাখী বেঁধে দেন।  রাজা এই রাখী বাঁধার  কারণ জানতে চাইলে তিনি রাজাকে সব খুলে বলেন। রাজা তার কথায় মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে আবার বৈকুন্ঠে ফিরে  যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।  সেই থেকে রাখীবন্ধনের উৎসব পালিত হয়।   

চিতোরের রানী কর্ণবতী মুঘল  সম্রাট হুমায়ূনকে রাখী পাঠান।  সালটা ছিল ১৫৩৫। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর  আক্রমণ করলে বিধবা রানী ভয় পেয়ে যান এবং খুব অসহায় বোধ করেন।  সেই সময়  তিনি সম্রাট কাছে সাহায্য প্রার্থী হন এবং তাকে একটি রাখী পাঠান।  রানীর পাঠানো রাখী দেখে সম্রাট অভিভূত হয়ে যান  এবং তিনি চিতোর রক্ষা  করার জন্য সৈন্য পাঠান।  তবে সম্রাট সৈন্য পাঠাতে দেরি করায়  বাহাদুর শাহ চিতোরের দুর্গ জয় করেন।  ১৫৩৫ সালের ৮ই মার্চ রানী তার সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য জোহর ব্রত পালন করেনা এবং নিজেকে আগুনে আত্মহুতি দেন। এটি মধ্য সপ্তদশ শতকের লোকগাথা হিসেবে প্রচলিত আছে।  

বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের কারণে ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ রাখী উৎসবটি প্রচলন করেছিলেন।  উনিশ শতকে বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায় পৌঁছেছিল। ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার সিন্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯০৫ সালের ১৯ শে জুলাই তৎকালীন ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময় সারা ভারতের সব নেতা এই সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে আন্দোলন  শুরু করেন। কলকাতায়  রবীন্দ্রনাথ হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান ভাই ও বোনকে আহ্বান করেছিলেন। এই আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে তিনি একে  ওপরের হাতে রাখী পরিয়ে  দিতে বলেন।  প্রতিবাদস্বরূপ উৎসব পালন করেন।  তিনি তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। এই দিন প্রতিবাদস্বরূপ কোনো বাড়িতে উনুন জ্বালানো হয়নি।   

রাখীবন্ধন  একটি জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। দামি, কম দামি, রঙিন রাখীর নিচে ঢাকা পড়ে  যায় আমাদের দীনতা, আমাদের লজ্জাবোধ। একটা সুতোর মারফত আমরা আমাদের সব কিছু ঢেকে সৌভাতৃত্বকে সামনে তুলে আনতে চেষ্টা করি।  গড়ে তুলি সৌহার্দ্যের বন্ধন।  




ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ : ০২-০৮-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

👉 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।  পরবর্তী লেখাগুলো পেতে বগতিকে ফলো করে রাখুন।