ইঞ্জিয়ারের নামেই সেতু
১৯৭৪ সাল। আগস্ট মাসের ২ তারিখ। শহরে ঘটে গেলো এই নৃশংস হত্যাকান্ড। নিহত হলেন ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের তরুণ নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞ কুমার বসু। তখন কসবা, বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, সন্তোষপুর এই অঞ্চলগুলো ছিল আজকের মতো জনপ্লাবিত নয়, নিছকই কিছু এপার-ওপার বাংলার মানুষের বাস। অঞ্চলগুলোকে ঠিক শহর বলা চলে না। শহর আর এই অঞ্চলগুলোর মাঝে একটা রেল লাইন আছে। এই লাইনটি শহর আর মফস্বলের মধ্যে তফাৎ গড়ে দিয়েছিল।
যাদবপুরের পূর্বদিকে সন্তোষপুর নামে একটা জায়গা আছে. সেই সময় জায়গাটা একদম নবীন একটা পল্লী হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। এই সন্তোষপুরেই ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসের ২ তারিখে তরুণ ইঞ্জিনীযার তার বোনের বাড়িতে এসেছিলেন। কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতে পৌঁছে গিয়েছিল। তরুণ বাড়ি যাওয়ার জন্য যাদবপুর স্টেশনে এসে পৌঁছলো। সে তখন উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে থাকতো। ঘড়িতে তখন রাত ৯টা বাজে। ট্রেন আসতেই সে উঠে পড়লো। রাত অনেকটা হয়ে যাওয়ায় গাড়িটা বেশ ফাঁকাই ছিল, কিছু পুরুষ ও কয়েকজন মহিলা কামরাটিতে ছিল। ট্রেনটি যাদবপুর থেকে ছেড়ে ঢাকুরিয়া স্টেশনে এসে থামলো। এখান থেকে কয়েকজন যুবক ট্রেনটিতে উঠলো। যথাসময়ে গাড়ি ছাড়লো। যুবকগুলো গেটের ধারে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। গাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে তারা স্বমূর্তি ধারণ করল। কেউ ছোড়া, কেউ ছুরি, কেউ বন্দুক উঁচিয়ে অতর্কিতে যাত্রীদের উপর আক্রমণ করতে আরম্ভ করল। মহিলা যাত্রীদের গহনা, পুরুষ যাত্রীদের মানিব্যাগ, ঘড়ি, আংটি ছিনিয়ে নিতে লাগলো। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না। তারা সব কিছু তাদের হাতে তুলে দিতে লাগল। তরুণ ইঞ্জিনীযার বিজন কুমার বসু আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। তার শরীরে তখন এক তরতাজা যুবকের রক্ত টকবগ করে ফুটছে। তিনি প্রতিবাদে সরফ হলেন। ছিনতাইবাজরা বালিগঞ্জ স্টেশনে নামার উদ্যোগ নিল, কিন্তু তারা নামতে পারলো না। বিজন বাবু তাদের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। তার সাথে যাত্রীদের কেউ গলা মেলালো না। চার পাঁচজন তরুনের সাথে মাত্র একজন কি করে পেরে উঠবে। যথারীতি তিনি একা তাদের সাথে যুজঁতে পারলেন না। আক্রমণকারীরা ছোড়া, ছুরির আঘাতে তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করলো। চলন্ত গাড়ি থেকে তার দেহটিকে ছুড়ে ফেলে দিলো। পরের স্টেশনে ছিনতাইবাজরা নেমে গেলো। সবাই চুপ করে বসে রইলো, কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না।
গাড়ি যথাসময়ে শেয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছলো। প্রতক্ষ যাত্রীরা সবাই নিজেদের গা বাঁচিয়ে নেমে চলে গেল। এতবড় ঘটনার কথা কেউ পুলিশকে জানানোর প্রয়োজনটুকু অনুভব করলো না। কেউ জানালো না। যে যার বাড়ির পথে রওনা দিলো। একজন মাত্র বছর ছত্রিশের তরুণ যাদের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিল তারা তার প্রতি সামান্যতম সৌজন্য দেখানোর কথা ভাবল না, নিজেদের পিঠ বাঁচিয়ে চলে গেলো।
সব মানুষ সমান হয় না। বনগাঁর বাসিন্দা এক বয়স্ক সাধু নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। সাধু প্রভূচরণ দাস স্বচক্ষে যা দেখেছেন তা রেল পুলিশকে জানালেন। তিনি এও বলে গেলেন তদন্তের স্বার্থে যদি কোনো প্রয়োজন হয়, তিনি সব সময় সাহায্য করতে আসবেন।
সেই সময় শিয়ালদহ রেল পুলিশের সুপার ছিলেন উমাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সব জেনে তৎক্ষণাৎ লাশ তুলে মর্গে পাঠালেন। খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়লো। পরের দিন শহরের বহুল প্রচারিত দৈনিকগুলোতে খবরটা প্রথম পাতায় মোটা হরফে ছাপা হল। চারদিকে সোরগোল পরে গেলো। তরুণ যেহেতু সি আই টির কর্মচারী ছিলেন, তাই তার কার্যালয়ের কর্মীরা এটা খুন না দুর্ঘটনা এই নিয়ে প্রশ্ন তুললো। তদন্তের দায়িত্ব নিলেন তৎকালী সিআইডির প্রধান জে সি তালুকদার। তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কার রায়। তার সরকার নড়ে চড়ে বসল। তদন্ত তার নিয়মে চলতে লাগলো। প্রচিলত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বেশ কয়েকদিন ধরে বিজন বসু হত্যা রহস্য জায়গা করে নিয়েছিলো। এইভাবে তদন্ত তার নিয়মে চলতে লাগলো। কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর। কিন্তু রহস্যের কোনো কিনারা হলো না। ধরা গেলো না ঘাতকদের। অপরাধীরা শাস্তি পেলো না।
বছর ৪০ আগে ১৯৭৮ সালে বালিগঞ্জ রেল স্টেশানের পাশে একটা সেতু নির্মাণ করা হল। সেতুটির নামকরণ করা হল সাহসী তরুনের নাম। সকলের সম্মতিতে সেতুটিকে তার নাম উৎসর্গিত করা হলো। হত্যাকান্ড ও সেতু নির্মাণের মাঝে এই লাইন দিয়ে বহু ট্রেন চলে গেছে। পাল্টে গেছে বাংলার সরকার। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মধু দণ্ডবতের স্ত্রী প্রমীলা দণ্ডবতে ও পশ্চিমবাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু সেতুটির উদ্বোধন করেছিলেন।
লেখা : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : 25 আগস্ট, ২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪ ২০৭৫০
👉 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে বগতিকে ফলো করে রাখুন।