ভারতের জাতীয় পতাকার সাতকাহন
পতাকা হলো কোনো দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আর জাতীয় মর্যাদার প্রতীক। পৃথিবীর প্রত্যেক স্বাধীন দেশের একটা করে জাতীয় পতাকা থাকে। মর্যাদার সঙ্গে জাতীয় পতাকা সম্মান রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো ভারতবর্ষেরও একটি নিজস্ব জাতীয় পতাকা রয়েছে।
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ব্রিটিশ সরকার ভারতকে ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দেবে বলে ঘোষণা করে। ভারত স্বাধীনতা পায় ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। সেই থেকে ১৫ই আগস্ট ভারতের সর্বত্র স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় পতাকা উত্তলন করা হয়। আমরা জানি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। ভারতবাসীদের তীব্র ও দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বহু সংগ্রামীর জীবনের মূল্য দিয়ে এই স্বাধীনতা আমরা লাভ করেছিলাম। স্বাধীন ভারতের একটা নিজস্ব পতাকা হওয়া উচিত বলে সবাই মনে করলেন। ১৯৪৭ সালের ২২শে জুলাই গণপরিষদের অধিবেশনে ভারতের বর্তমান পতাকার রূপরেখাটি গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই পতাকাটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকার মর্যাদা লাভ করেছিল।
ভারতের জাতীয় পতাকাটি হলো আয়তাকার। পতাকাটি ত্রিবর্ণরঞ্জিত। প্রস্থ হয় দৈর্ঘ্যের দ্বিগুন। পতাকায় তিনটি রঙের জায়গা সমান থাকে। পতাকার কেন্দ্রে থাকে চব্বিশটি দণ্ড বিশিষ্ট নীল রঙের অশোকচক্র। এই অশোকচক্রের উপরে গেরুয়া, মাঝে সাদা আর নিচে সবুজ রং থাকে। এই তিনটি রঙের আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। উপরের গেরুয়া রংটি হল ত্যাগের প্রতীক, মাঝের সাদা রংটি হল শান্তির ও পবিত্রতার প্রতীক আর নিচের সবুজ রংটি নির্ভীকতা, জীবনধর্ম ও তারুণ্যের প্রতীক। মাঝের সাদা অংশটিতে একটি চক্র রয়েছে। চক্রটি হলো সম্রাট অশোকের ধর্ম চক্রের অনুকরণে নির্মিত। এই চক্রটিতে ২৪ টি স্পোক রয়েছে। এই ২৪ টি স্পোকও ২৪টি অর্থ বহন করে। এই স্পোকগুলির অর্থ হল ১) ধৈর্য্য, ২) আরোগ্য, ৩) শান্তি, ৪) ত্যাগ, ৫) অনুশাসন, ৬) সেবা, ৭) ক্ষমা, ৮) মৈত্রী, ৯) বন্ধুত্ব, ১০) সংগঠন, ১১) কল্যাণ, ১২) সমৃদ্ধি, ১৩) অধিকার, ১৪) কর্তব্য, ১৫) সহকার্য্য, ১৬) ন্যায়, ১৭) নীতি, ১৮) অর্থ, ১৯) সমতা, ২০) নিয়ম, ২১) ভালোবাসা, ২২) নিরাপত্তা, ২৩) সুরক্ষা, ২৪) উদ্যোগ।
পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া কৃত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বরাজ পতাকার ভিত্তিতেই এই পতাকাটির নকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয় পতাকার নকশাকার। ১৯৫০ সালে ভারতীয় সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালে ভারতীয় মানক ব্যুরো প্রথমবার জাতীয় পতাকা উৎপাদন সংক্রান্ত বিধি নিয়ম প্রকাশ করে। ১৯৬৮ সালের ১৭ই আগস্ট পুনরায় এই নিয়মের কিছু সংশোধন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী এই পতাকা একমাত্র খাদি নামক তাঁতবস্ত্রের কাপড়ে তৈরী করা হয়। তুলো, রেশম ও উল ছাড়া অন্যকিছু কাঁচা মাল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।
ভারতের জাতীয় পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কয়েকটি নিয়ম বেঁধে দেওয়া হযেছে। ভারতীয় মানক ব্যুরো এই পতাকা উৎপাদনের পদ্ধতি ও নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন স্থির করে দিয়েছে। জাতীয় পতাকা উৎপাদনের অধিকার কেবল খাদি উন্নয়ন ও গ্রামীণ শিল্প কমিশনের হাতে রয়েছে। এই কমিশন বিভিন্ন আঞ্চলিক গোষ্ঠীকে উৎপাদনের অধিকার দিয়ে থাকে। ২০০৯ সালে তথ্য অনুযায়ী কর্ণাটক খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘ জাতীয় পতাকার একমাত্র উৎপাদক।
ভারতের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। তার পতাকার রং ছিল সবুজ। উপরের দিকে সোনালী রঙের পদ্ম ছিল। এরপর ভগিনী নিবেদিতা ১৯০৫ সালে একটি লাল রঙের একটি পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পতাকাটির চারধারে ১০৮টি শিখা আর মাঝখানে হলুদ রঙে বজ্র ছিল। বজ্রটির বাঁদিকে "বন্দে" আর ডানদিকে "মাতরম" কথাটি লেখা ছিল। ১৯০৭ সালে ম্যাডাম ভিকাজী রুস্তম কামা বিদেশের মাটিতে প্রথম ভারতের পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন। ১৯১৭ সালে এনি বেসান্ত ও বাল গঙ্গাধর তিলক একটি নতুন পতাকার কথা ভেবেছিলেন। ১৯২১ সালে গান্ধীজি প্রথম তাঁর পতাকা নিয়ে আসেন। এই পতাকাটির উপরদিক থেকে তিনটি রং আড়াআড়ি ভাবে তিনটি সমান ভাগে ভাগ করা ছিল। রংগুলো সাদা, সবুজ ও লাল ছিল। মাঝখানে একটি রেখা আঁকা ছিল। ১৯৪৭ সালের ২২ শে জুলাই ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরী করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্য রাত্রে গণ পরিষদের হাতে জাতির উদ্দেশ্যে পতাকাটি তুলে দেওয়া হয়। তারপরের দিন মাঝ রাতে ১৫ই আগস্ট জওহরলাল নেহেরু ভারতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দিল্লিতে জওহরলাল নেহেরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী রূপে কারও ভার গ্রহণ করলেন। মাউন্ট ব্যাটন স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন। এই দিন সর্বপ্রথম দিল্লির লালকেল্লা থেকে জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন কর হয়। তার সাথে প্রত্যেকটি রাজ্যের রাজধানীগুলোতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিনটিকেএ সাদা দেশে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানি এই দিন প্রতিবছর ছুটি থাকে। বহু জায়গায় পতাকা উত্তোলনের সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
লেখা : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ১৫ই আগস্ট, ২০২০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪ ২০৭৫০
👉 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে বগতিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment