Sunday, July 21, 2019

অকালে ঝরে যাওয়া তারা >

অকালে ঝরে যাওয়া তারা 






জুলাই মাসটা বাংলা সিনেমার দুই নক্ষত্রের পতন ঘটেছিলো। ২২ তারিখে অসাধারণ অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরীর আর ২৪ তারিখ মহানায়ক উত্তমকুমারের। 
 
 ২২শে জুলাই বাঙালির এক বেদনার দিন। এইদিন এক লেলিহান শিখা কেড়ে নিয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রতিভাবান নায়িকাকে। সালটা ছিল ১৯৮৬।  দিনটি বাঙালি দর্শকদের কাছে খুবই দুঃখের দিন। তাঁর অকাল প্রয়াণে বাংলা তথা বাঙালির জীবনে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তাঁর আসল নাম ছিল শিপ্রা, বিখ্যাত পরিচালক শ্রী তরুণ মজুমদার শিপ্রা নামটা বদলে  "মহুয়া" নামটা দিয়েছিলেন। বাংলায় বহু অভিনেত্রী এসেছিলেন তার মধ্যে কেউ অসামান্যা  সুন্দরী, কেউ গ্ল্যামারাস ছিলেন।  আবার কেউ কেউ নিজ অভিনয় দক্ষতায় দর্শকদের মন ছুঁয়ে গিয়েছিলেন। মহুয়া সুন্দরী তো ছিলেন তার সাথে তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় দক্ষতাও  ছিল। দর্শকরা তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় দক্ষতা দেখে চমকে গিয়েছিলেন।

২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮ সালে কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পিতা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী উদয়শঙ্করের দলে নাচ করতেন। তিনি পরে মুম্বাই পাড়ি দেন।  কিন্তু তিনি সেখানে সফলতার মুখ দেখতে পাননি।  কিছুটা বাধ্য হয়েই আবার কলকাতায় ফিরে আসেন।  ছোট্ট শিপ্রা ততদিনে সহজাত দক্ষতায় নাচের তালে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। নীলাঞ্জনবাবু তাঁর এই ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।  কন্যার মাধ্যমেই তিনি সফলতায় পৌঁছতে চাইলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে  তিনি পাড়ার জলসায় শিপ্রার নাচের ব্যবস্থা করলেন।  শিপ্রাও বহু গন্যমান্য শিল্পীদের সাথে একই মঞ্চে নেচে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। তিনি সেদিন "সোনালী রায়" নামে নেচেছিলেন। শিপ্রা নামটি ব্যবহার করেননি। তাঁর নাচের তালে দর্শক ও আয়োজকরা স্থম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন, গন্যমান্য শিল্পীরাও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কলকাতা ও তার আশপাশের  পাড়ার জলসার  মঞ্চগুলোকে তিনি মাতিয়ে দিতে লাগলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মেয়ে শিপ্রা হয়ে উঠলো নৃত্যশিল্পী সোনালী রায়। শিপ্রা বা সোনালির লেখাপড়ায় ছেদ পড়ল। তাঁর স্কুল জীবনের এই সময়ই ইতি ঘটল।

১৯৭২ সালে তরুণ মজুমদার "শ্রীমান পৃত্থিরাজ" সিনেমার জন্য একটা অল্প বয়সী মেয়ে খুঁজছিলেন। শিপ্রাকে দেখে তাঁর পছন্দ হয়। তিনি স্ক্রিন টেস্ট নেন, শিপ্রাও স্ক্রিন টেস্টে উত্তীর্ণ হন।  মাত্র চোদ্দ  বছর বয়সের শিপ্রাকে তিনি অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে নির্বাচিত করলেন।  সন্ধ্যা রায় নিজ হাতে ছোট্ট শিপ্রাকে সিনেমার উপযোগী করে গড়ে তুললেন। ১৯৭৩ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ছবিটা মুক্তি পায়। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর শিপ্রাও হয়ে উঠলো অভিনেত্রী মহুয়া। শুরু হলো তাঁর অভিনয় জীবন আর দর্শকরাও খুঁজে পেলো একজন প্রতিভাবান অভিনেত্রীকে। এই সিনেমার পর তিনি আরো অনেক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন।  তারমধ্যে মহানায়ক উত্তমকুমারের সাথে "সেই চোখ" ও "বাঘ বন্দী খেলা", "সূর্যসাক্ষী", :ইমন কল্যাণ", "প্রতিশোধ"  উল্লেখযোগ্য ছিল।  উত্তমকুমার থেকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত বহু বিখ্যাত নায়কের সাথে তিনি অভিনয় করেছিলেন।  বহু সুপার ডুপার হিট সিনেমা তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ২রা মে ১৯৭৬ সালে অভিনেতা তিলক চক্রবর্তীকে বিবাহ করেন।

১৯৮০ সালে তরুণবাবু দাদার কীর্তি সিনেমায় আবার মহুয়াকে দেবশ্রী রায়ের দিদির  ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত করলেন।  মহুয়াও খুবই দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুললেন। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮০ সালের ২৮শে নভেম্বর। এই সিনেমাটি মহুয়াকে সফলতার উচ্চাসনে বসালো। এই সিনেমার জন্য তিনি সেরা নায়িকা  হিসেবে বি. এফ. জে  পুরস্কার পেয়েছিলেন। দাদার কীর্তির পর তাঁকে  আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।  তিনি আপামর বাঙালির মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে ১৯৮২ সালে "মাটির স্বর্গ", ১৯৮৩ সালে "লাল গোলাপ", রণজিৎ মল্লিকের সাথে ১৯৮২ সালে "শাঠে শাঠ্যাং", ১৯৮৪ সালে "প্রায়শ্চিত্ত" ও 'শত্রু', দীপঙ্কর দের সাথে ১৯৮২ সালে "পিয়াসা", ১৯৮৫ সালে "আমার পৃথিবী" ও "শাপমুক্তি", তাপস পালের সাথে ১৯৮১ সালে "সাহেব", ১৯৮৪ সালে "পারাবত প্রিয়া", ১৯৮৫ সালে "আশীর্বাদ" ও "জীবন", প্রসেনজিতের সাথে তিনি একটাই সিনেমা করেছিলেন ১৯৮৫ সালে "মধুময়"। এছাড়া তাঁর আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি হলো  "অনুরাগের ছোঁয়া", "সুবর্ণলতা", "দাদু-নাতি-হাতি", "কেনারাম বেচারাম", "পাকা দেখা", "সৎমা", "শুভরজনী" প্রভৃতি। এছাড়া তিনি  তপন সিনহার  "আদমি আউর আওরাত" হিন্দি টেলিফিল্মে আমল পালাকারের সাথে অভিনয় করেছিলেন। তিনি বেশিরভাগ সিনেমায় নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। মাত্র বারো বছরের চলচ্চিত্র জীবনে তিনি প্রায় পঞ্চাশটির মত সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর  নাচ, অভিনয়ের সাথে ফুটবলের প্রতিও  খুবই আগ্রহ ছিল। মহুয়া যখন খ্যাতির মধ্যগগনে তখন তিনি তমালের সাথে প্রেমে লিপ্ত হন।  "আনন্দমেলা" সিনেমার শুটিংয়ের সময় তাদের প্রেম দিঢ় হয়। ১৯৭৬ সালের ২রা মে তিনি তিলকের ঘরণী হন। টালিগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায়  ও  বেহালাতেও এই দম্পত্তি ভাড়াটে হিসেবে কাটিয়েছেন।  পরবর্তীকালে টালিগঞ্জের করুণাময়ী অঞ্চলে নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ করেন কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই বাড়ির গৃহপ্রবেশের আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

তাঁর অভিনয় জীবনের সফলতার মধ্যগগনেই চরম বিপত্তিটি ঘটেছিলো। ১৯৮৫ সালের জুলাই মাসের ১২ তারিখে মধ্যরাত্রে স্টোভ ফেটে আগুনে পুড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।  দশদিন ধরে যমে মানুষে লড়াই চালিয়েও নিজেকে রক্ষা করতে পারেন নি।  স্বামী তিলক  ও সাত বছরের পুত্র গোলাককে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।  যদিও তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তাঁর  মৃত্যু যে ভাবেই হোক তিনি কিন্তু এই সামান্য সময়ের মধ্যে বাঙালির মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। বাঙালি আজও তাঁকে ভুলতে পারে না। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৩৪ বছর পরেও তাঁর নাম শুনলে বাঙালি নস্টালজিয়ায় ভোগে।


তথ্যসূত্র : ১)  গুগল
                ২)  A Directory of Bengali Cinema - Parimal Ray & Kazi Anirban

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২১-০৭-২০১৯



যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Saturday, July 20, 2019

মেট্রোপলিটন বিল্ডিং >

মেট্রোপলিটন বিল্ডিং





কলকাতার ময়দান অঞ্চলটি অতীতে ছিল জঙ্গল এলাকা। পরবর্তীকালে এই জঙ্গলের উত্তর অংশটিকে পরিষ্কার করে এসপ্ল্যানেড বা ধর্মতলা নাম দেওয়া হয। ধর্মতলা বা এসপ্ল্যানেড হল কলকাতার একদম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটা বাণিজ্যিক এলাকা। শহরের খুবই ব্যস্ততম এলাকা। এই এলাকাতেই একদিকে রয়েছে শহীদ মিনার, বাস ও ট্রামের গুমটি আর একদিকে আছে বিখ্যাত মেট্রো সিনেমা হল (বর্তমানে শপিং মল) এই মেট্রো সিনেমা হালের পাশেই আছে শিল্পকলায় ও সৌন্দর্যেমোড়া একটি বৃহৎ বাড়ি, যার ওপরে  তিন কোনে তিনটি গম্বুজ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এই বৃহদাকার ভবনটি জওহরলাল নেহেরু রোড ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত।  

বাড়িটি ব্রিটিশ আমলে তৈরী করা হয়েছিল। বর্তমান নাম "মেট্রোপলিটন বিল্ডিং" কিন্তু পূর্বে অবশ্য নাম ছিল Whiteway Laidlaw department store"হোয়াইওয়ে লেডলও এন্ড ডিপার্টমেন্ট স্টোর" (Whiteway, and Laidlaw Department Store)  হোয়াটওয়ে লেডলও এন্ড ডিপার্টমেন্ট স্টোর হলো একটি ব্রিটিশ সংস্থা।  দুজন স্কটিশ ১৮৮২ সালে এই সংস্থাটির গোড়াপত্তন করেন। কলকাতাতেই তাদের প্রধান কার্যালয় ছিল।  এছাড়া ভারতবর্ষের মুম্বাই, চেন্নাই, ও সিমলায় তাদের শাখা ছিল, ভারতের বাইরে লাহোর, কলম্বো, বার্মা, সাংহাই এরকম কয়েকটি জায়গাতেও  তাদের শাখা ছিল।  হোয়াইওয়ে লেডলও এন্ড ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ডাকনাম ছিল "Right-away""Paid-for"। সংস্থাটিতে কোনোরকম ধার-বাকি পাওয়া যেত না, তারা সম্পূর্ণ নগদে ব্যবসা করত।  

 ১৯০৫ সালে সংস্থাটি তাদের প্রধান কার্যালয় তৈরী করে দেওয়ার জন্য ম্যাকিনটোশ এন্ড বার্ন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। জমিটি কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ একটা জায়গা ছিল। সংস্থাটিও চেয়েছিলো খুবই আকর্ষণীয়ভাবে বাড়িটি তৈরী করতে, যাতে ক্রেতাদের সহজেই আকর্ষণ করা যায় । ম্যাকিনটোশ সংস্থাও খুব সুন্দরভাবে ও আকর্ষনীয়রূপ দিয়ে বাড়িটি তৈরী করে দিয়েছিল। এক একটি তলা বেশ বড় আকারের ও সিঁড়িও বেশ চাওড়া করে তৈরী করেছিল। ভিতরে মার্বেল পাথরের ও কাঠের সুন্দর কাজ করে দিয়েছিল। হোয়াইওয়ে লেডলও এন্ড ডিপার্টমেন্ট স্টোর নীচের ও প্রথম তলটিতে  তাদের দোকান খোলে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা দুটো আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংস্থাকে ভাড়া দেয়। বাণিজ্যিক জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছি "ভিক্টরিয়া চেম্বার"  এটি আবাসিক ও বিণিজ্যিক ভবন। বাড়িটি নিও ব্যারোক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরী। ভবনটির মাথায় তিনটি গম্বুজযুক্ত মিনার আছে।, তার মধ্যে একটি ক্লক টাওয়ার। বাড়িটির জানালাগুলো  খিলানযুক্ত জানালা। 

সেই সময় ব্রিটিশদের কলকাতা শহরে আরো দুটি ডিপার্মেন্ট স্টোর ছিল। লোয়ার চৌরঙ্গী রোডে "আর্মি এন্ড নেভি স্টোর" আর একটি "হল এন্ড এন্ডারসন" নামে পার্ক স্ট্রীটে। হোয়াইওয়ে লেডলও এন্ড ডিপার্টমেন্ট স্টোরটি ক্রমে ক্রমে কলকাতার প্রধান ও উৎকৃষ্টতম স্টোরে রূপান্তরিত হয়েছিল।  

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পর কলকাতা থেকে ব্রিটিশরা তাদের দেশে ফিরে যেতে শুরু করল, তখন থেকে ক্রেতার এভাবে স্টোরটিতে কেনা-বেচাও কমতে থাকলো।  ধীরে ধীরে স্টোরটি বন্ধ হয়ে গেলো।  তখন মেট্রোপলিটন লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি সম্পূর্ণ বাড়িটা ভাড়ায় নিলো। বাণিজ্যিক জায়গাটির নাম তারা পরিবর্তন করে রাখলো "সাচিন্দ নন্দ চেম্বার" আর  বাড়িটার নাম তারা পাল্টে করলো "মেট্রোপলিটন বিল্ডিং"। 

বর্তমানে বাড়িটির একতলায় বিগবাজার নামে একটি সংস্থাকে  ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ওপরের তলাগুলোতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক কার্যালয় এখনো রয়েছে। ১৯০৫ সালে নির্মিত ভবনটির মালিকানা এখন রয়েছে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের হাতে। ২০০৩ সালে ভারতীয় জীবন বীমা নিগম বাড়িটিকে সংস্কার করেছে। বাড়িটির বাইরের দেওয়াল সাদা করে দিয়েছিলো। ২০১০ সালে বিখ্যাত শিল্পী গণেশ পাইনের কথা অনুযায়ী তারা সাদা রঙের সাথে সোনালী রঙের প্রয়োগ ঘটায়। বর্তমানে সাদা ও সোনালী রঙে রঙ্গীন করা আছে। ভবনটি কলকাতার ঐতিহ্য বহন করছে। ধর্মতলার সৌন্দর্য্য বর্ধন করছে।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২০-০৭-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Tuesday, July 9, 2019

মইছাড়া >

মইছাড়া 

গরুর দৌড় 
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। ক্ষেতে-খামারে গেলে দেখা যায় বেশিরভাগ সময় চাষিরা লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত। বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি এই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। একসময় চাষাবাদে বাঁশের তৈরী মই দিয়ে জমিকে উৎকর্ষ করা হত। বর্তমানে চাষের কাজে যান্ত্রিক উপকরণের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে।  লাঙ্গল, মই, হালের গরু বা বলদের বদলে ঢুকে পড়েছে আধুনিক ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, ইত্যাদি। সময় ও শ্রমের সাশ্রয় করতে আধুনিক যন্ত্রপাতিতে কৃষকেরা বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে।  ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে ঐতিহ্যবাহী লাঙ্গল, মই  বা হালের গরু-বলদেরা।

আলোকচিত্রীরা অপেক্ষা করছে 
কদিন ধরেই আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে বর্ষা পশ্চিমবঙ্গে  প্রায় ঢুকে পড়েছে। বর্ষা ঢোকা মানেই গ্রামে গঞ্জে চাষ শুরু হওয়া।  বর্ষা ঢোকার আগেই চাষিরা তাদের কৃষিজমির উৎকর্ষতা বাড়াবার জন্য "মইছাড়া" উৎসব পালন করে থাকে।  মইছাড়া হচ্ছে গরুর দৌড়। এই উৎসবটি সাধারণভাবে জুন মাসের শেষের দিকে অথবা  জুলাই মাসের শুরুতে করা হয়ে থাকে অর্থাৎ   বর্ষা ঢোকার ঠিক আগে বলদ বা গরুকে দিয়ে জমিগুলোকে চাষযোগ্য করে তোলা হয়। মোদ্দাকথা হল মইছাড়া উৎসবটির মূল উদ্দেশ্য হল গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুরে জমিগুলো যখন বেশ শক্ত ফুটি-ফাটা হয়ে ওঠে, তখন সেই জমিগুলোতে চাষ করা যায় না। তাই বর্ষার আগে জমিগুলোকে চাষযোগ্য করে তুলতে হয়। 

পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটা জায়গায় এই উৎসব বেশ আড়ম্বরের সাথে উৎযাপন করা হয়।  আমাদের কলকাতার কাছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-এর হাড়াভাঙ্গা গ্রামে প্রতিবছর বেশ ঘটা করে দুইদিন ধরে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবের মাধ্যমে তারা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। প্রতিযোগীদের জন্য নানারকম মূল্যবান পুরস্কারেরও ব্যবস্থা থাকে। এই উৎসব এখানে যেন এক মিলনমেলা। সব ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। আশপাশের গ্রাম থেকে প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করে।  ক্যানিং-এর বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন প্রতিযোগিতাটি দেখতে আসে।  শুধু ক্যানিং কেন কলকাতা, হাওড়া, হুগলী  ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকেও বহু মানুষ
ভালো ছবির আশায় মাঠে নেমে পড়েছে 
দেখতে আসে। মইছাড়ার মাধ্যমে  প্রধানত কৃষিজমির উন্নতি করা হলেও  এখানে কিন্তু  মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই এই প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর ধরে এখানে এই উৎসব বা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।  জলাকীর্ণ জমিতে সাধারনভাবে এই প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  টান টান  উত্তেজনায় গরুর দৌড় শুরু হয়।  গরুর সাথে গরুর লড়াই বেশ জমে ওঠে। গরুর সাথে গরুর মালিকরাও সমানভাবে গরুকে সামলানোর জন্য দৌড়তে থাকে। মইছাড়ার ছবি তোলার জন্য কলকাতা বা তার আশেপাশের জেলাগুলো থেকে প্রচুর আলোকচিত্রীও উপস্থিত হয়।

২০১৮ সালে আমি এই উৎসবে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম, অনেক উৎকণ্ঠা নিয়ে ওখানে পৌঁছে দেখলাম
গরুর দৌড় 
খান তিরিশেক প্রতিযোগী গরু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, আর  ওই তিরিশটা গরুর ছবি তোলার জন্য প্রায় শখানেকের বেশি  ছবিপ্রেমী আলোকচিত্রী অপেক্ষা করছে।  বিরাট বিরাট লেন্স ও ক্যামেরা, ট্রাইপট নিয়ে সূর্য্যমামার তেজকে উপেক্ষা করে তারা অপেক্ষা করছে।  যখন  একটা দৌড় শুরু হচ্ছে তখন সমগ্র পরিবেশটা বেশ উত্তেজনায় কেঁপে উঠছে।  অতি উৎসাহী বেশ কিছু চিত্রপ্রেমীকে দেখলাম ভালো ছবির জন্য জল-কাদায় মাখামাখি করে মাঠের মধ্যে নেমে পড়েছে।

এখানে আলোকচিত্রীদের ক্যামেরা ও লেন্সের বহর দেখে আমি প্রথমদিকে সাহস করে আমার পুচকে ক্যামেরাটা বের করতে লজ্জা পাচ্ছিলাম।  পরের দিকে অবশ্য দু-একটা ছবি তুলেছি। ছবিগুলো হয়তো সেরকম ভালো কিছু হয়নি।  দর্শকাসন থেকে প্রতিযোগিতা শুরুর জায়গাটা বেশ কিছুটা দূরে ছিল,  সেক্ষেত্রে জুম লেন্স ছাড়া ছবি তোলা বেশ মুসকিল হচ্ছিল। আমার ক্যামেরাতে সেরকম কোনো জুম লেন্স নেই তাই ভালো ছবি তুলতে আমি পাচ্ছিলাম না।

এখানকার গরুর দৌড়ে কোন রাজনীতির রঙ নেই, নেই কোনো ধর্মের রঙও।  হিন্দু-মুসলমান একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দৌড়ে অংশগ্রহণ করে। এই প্রতিযোগিতাটা এখানে যেন এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জ্বলন্ত উদাহরণ।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০৯-০৭-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Friday, July 5, 2019

ব্যতিক্রমী ও অভিনব রথযাত্রা>

ব্যতিক্রমী ও অভিনব রথযাত্রা

দুর্গাপুজো কলকাতাসহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ উৎসব বলে ধরা হয়ে থাকে। দুর্গাপুজোর পর যে উৎসবটি বাঙালিকে সবচেয়ে আকর্ষণ করে থাকে তা হলো রথযাত্রা। রথের দিনই দূর্গাপুজোর সৃচনা বলে ধরা হয় কারণ বেশীরভাগ জায়গাতে এই দিন মা দূর্গার কাঠামো পুজো করা হয়। রথযাত্রা হল জগন্নাথদেবের উৎসব, তবে তাঁর সাথে তাঁর ভাই বলরাম  ও বোন সুভদ্রাকে দেখা যায়।  ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় রথ উৎসবটি অবশ্য শ্রীক্ষেত্র পুরীতে অনুষ্ঠিত হয়।  এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে খুব আড়ম্বরের সাথে উৎসবটি পালন করা হয়। ইসকন সংস্থার দৌলতে এখন সারা বিশ্বেই  ইসকন মন্দিরগুলোতে বেশ ঘটা করে রথ উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গায় রথের সওয়ারি জগন্নাথদেব হলেও অনেক জায়গায় অনেক রকম ব্যতিক্রম দেখা যায়।  কোথাও রাধা-কৃষ্ণ যুগলে, কোথাও নারায়ণ শিলা, কোথাও রাজা রামচন্দ্র আবার  কোথাও ভগবান বিষ্ণুদেবকেও দেখা যায় রথের সওয়ারি  হতে।   

আমরা দুর্গাপুজোতে প্রতিবারই যেমন নানারকম ব্যতিক্রমী থিম দেখতে পাই। এবার অর্থাৎ ২০১৯এর  রথ উৎসবেও থিম ঢুকে পড়তে দেখা গেলো।  এবার মেদিনীপুর শহরে এরকম একটা ব্যতিক্রমী ছবি দেখা গেলো। কাপড়, প্লাই ও প্রায় তিন হাজার শুকনো আমের আটি দিয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তিটি তৈরী করা হয়েছে। হুগলী জেলার চন্দননগরের শিল্পী শুভনাথ মল্লিক এই অভিনব ও ব্যতিক্রমী মূর্তিটি তৈরী করেন। বিগ্রহগুলো দশ ফুট উচ্চতার। শোভাযাত্রায় জগন্নাথদেবের সাথে নাকি আরো ২২ টি বিভিন্ন দেবতার মঞ্চসজ্জা ছিল।  ২০০২ সাল থেকে মেদিনীপুর শহরের জগন্নাথ মন্দিরের মূর্তি প্রতিবার শিল্পী  শুভনাথ মল্লিক তৈরী করে আসছেন। এবার তিনি একটু অন্য রকমের শিল্পকলাকে তুলে ধরলেন। রথ যে রাস্তা দিয়ে যাবে সেই রাস্তাটিকে সুন্দর করে আলপনা দিয়ে সাজানো হয়েছিল।  

নদীয়ার নবদ্বীপে একটা অভিনব রথ চালানো হয়।  সাধারণত রথে জগন্নাথদেবের সাথে তাঁর ভাই ও বোনকে দেখা যায়।  কিন্তু  নদীয়ার নবদ্বীপের অনুমহাপ্রভু মন্দিরের রথে শুধু জগন্নাথদেব একলা উপবিষ্ট থাকেন। এই রথটি মনিপুরী বৈষ্ণবদের রথ বলে পরিচিত। একটি নির্দিষ্ট সময়ে জগন্নাথদেবকে আট দিন ধরে জয়দেবের দশাবতার স্ত্রোত্র পড়ে শোনানো হয়। কথিত আছে দ্বারকা থেকে শ্রীকৃষ্ণ একা  বৃন্দাবন ধামে এসেছিলেন। সেখানে তিনি রাধারানী ও অন্যান্য গোপিনীদের কৃপা করেন।  তাই এই দর্শনকে অনুসরণ করে এখানকার রথে জগন্নাথদেব একলা থাকেন। এখানকার রথের আর একটা বৈশিষ্ট্য হল রথের যাত্রাপথে বিভিন্ন ভক্তের বাড়িতে থামানো হয় এবং সেই বাড়ি থেকে জগন্নাথদেবকে আরতি করা হয় ও ভোগ দেওয়া হয়।

সাধারণভাবে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার হাত থাকে না, কিন্তু কালনার জগন্নাথ বাড়ির রথে জগন্নাথ ও বলরামের হাত রয়েছে, শুধু সুভদ্রার হাত নেই। কথিত আছে বর্ধমানের মহারাজ স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন জগন্নাথ ও বলরামের হাত লাগাবার।  ২৫০ বছর ধরে এখানে এই নিয়ম চলে আসছে।

হাওড়া কদমতলার মাকড়দহ রোডের বাদুরি পরিবারের রথ প্রায় ৬০০ বছরের রথ উৎসব। এই বংশের রথ ৬০০ বছর ধরে কোনোদিন মাসির বাড়ি যায়নি।  পারিবারিক রীতি অনুযায়ী এখানকার রথ মাসির বাড়ি যায় না।  জগন্নাথদেবকে রথে করে মেলা ঘুরিয়ে নিজ বাটিতে রাখা হয়।  পূর্বে নাকি এখানে জগন্নাথদেব মাসির বাড়িতে যেতেন। সূর্য কুমার বাদুরি মহাশয় এই প্রথা চালু করেন। সেই থেকেই এখানে এই নিয়ম মেনে চলা হয়।


আমরা জানি জগন্নাথদেব ও তাঁর ভাই বোন মাসির বাড়িতে গিয়ে পোড়া পিঠে খান।  কিন্তু মায়াপুরের ইসকনের  মন্দিরে দেবতারা নাকি সব রকমের পদ খান।  ইসকনের জগন্নাথদেব নাকি সবরকম  পদ মিলিয়ে প্রায় ১০০ রকম পদ গ্রহণ করেন। বলরাম ও সুভদ্রার জন্য ৫৬ রকম পদ থাকে।  গুন্ডিচায় দেশি বিদেশি  মিলিয়ে পদগুলোকে তৈরী করা হয়। এই মেনুতে যেমন দইবড়া, পিঠেপুলি, খিচুড়ি, পায়েস, মিষ্টি থাকে তেমন চাউমিন, পোলাও থাকে। সাতদিন ধরে প্রভু নানারকম পদ মহানন্দে ভোজন করেন।

হুগলীর গুপ্তিপাড়ার রথকে জগন্নাথের রথ বলা হয় না, এখানে বৃন্দাবন জীউর রথ বলা হয়। মহিষাদলের রথে জগন্নাথ বলরামের সাথে রাজবাড়ীর কুলদেবতা অধিষ্ঠিত থাকেন।  কলকাতার দর্জিপাড়ার রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়ীতে তাঁদের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর। তাই তাঁদের উপবিষ্ঠ থাকেন কুলদেবতা, তাই এই রথকে রাজরাজেশ্বরের রথযাত্রা বলা হয়।  

এইভাবে অনেক জায়গায় যেমন পারিবারিক নিয়ম রীতিতে নানারকম অভিনবত্ব দেখা যায় তেমন এবার আবার নতুন থিমের রথযাত্রাও দেখা গেছে। আশা করা যায় এবার থেকে রথ উৎসবটিতেও থিমের রমরমা শুরু হতে দেখা যাবে। 


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০৬-০৭-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

তথ্যসূত্র গুগল


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Monday, July 1, 2019

পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যমন্ডিত রথযাত্রা>

পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যমন্ডিত রথযাত্রা




ইসকনের রথের মেলা 


 এলোরে, এলোরে, এল রথযাত্রা 
রথে চড়ে যাবে কৃষ্ণ, বলরাম আর  সুভদ্রা 

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।  বাঙালির মানসিকতা হল দূরকে নিকট করা, তাই সব উৎসবই বাঙালির বড় প্রিয়। উৎসবের প্রেরণা যেমন বাঙালির মজ্জাগত, তেমন ধর্মীয় চেতনাও তাদের মজ্জাগত।  বাংলায় সব উৎসবই আলাদা আলাদা মেজাজ নিয়ে আসে। রথযাত্রা হল একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব।  রথযাত্রার প্রধান আকর্ষণ রথ হলেও তার মেলাও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। বাঙালি জীবনে বহুকাল ধরেই মেলার যোগ রয়েছে। প্রতিটি মেলার সাথেই বাঙালির সম্পর্ক বেশ নিবিড় ও আত্মিক।

প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে সারা দেশে হিন্দুরা রথযাত্রা অনুষ্ঠান পালন করে।  হিন্দুদের অন্যতম প্রধান উৎসব হল এই রথযাত্রা। ভারতের সর্ববৃহৎ রথ উৎসবটি পালিত হয়ে থাকে ওড়িষ্যার পুরীতে। শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রার মত বাংলার নিজস্ব রথযাত্রা যথেষ্ট তাৎপর্য্যপূর্ণ এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। পুরীর মত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উৎসবটি উদযাপন করা হয়। হুগলী জেলার মাহেশ ও গুপ্তিপাড়া, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, নৈহাটির রথ  ও কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের রথ  যথেষ্ঠ ঐতিহ্যমন্ডিত  এবং কলকাতার ইস্কনের রথ খুব জনপ্রিয়। এছাড়াও  অনেক বনেদি  বাড়িতেও রথের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

চৈতন্য মহাপ্রভু সর্বপ্রথম ভক্তিবাদের প্রচলন নীলাচলে করেছিলেন। তবে এই  রথ উৎসবটি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কারো কারো মতে নীলাচলে ভক্তিবাদের সূচনাই নাকি এই উৎসবের সূচনা। কিন্তু রামায়ন, মহাভারত ও  ভগবত গীতার বিভিন্ন  আখ্যানে রথের কথা আমরা পেয়েছি। অর্জুনের রথ, পুস্পক রথের উল্লেখ আমরা এইসব পৌরাণিক উপাখ্যানে পেয়েছি।

মাহেশের রথ 
মাহেশের রথ :
হুগলী  জেলার  বিখ্যাত রথযাত্রা হল শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা।  এই রথ উৎসবটি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন রথযাত্রা, যা আজ ছয় শত বর্ষ অতিক্রম করে গেছে। লক্ষ্যাধিক ভক্তের উপস্থিতিতে জগন্নাথদেব মাসির বাড়িতে যাত্রা করেন। প্রথমদিকে কাঠের রথ ছিল। কোনো এক সময় কাঠের রথটি আগুনে ভষ্মীভূত হয়ে যাওয়ায়, কলকাতার কৃষ্ণকান্ত বসু সম্পূর্ণ লোহার তৈরী ৫০ ফুট উচ্চতার, ১২টি চাকাবিশিষ্ঠ রথটি নির্মাণ করে দেন। সেই রথটি  এখনো চালানো হয়।  কথিত আছে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মা সারদা দেবী মাহেশের রথ দেখতে এসেছিলেন। বেশ উৎসাহের সাথে এখানে রথ ও  রথের মেলা আয়োজন করা হয়।
মহিষাদলের রথ :
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথ উৎসবটি খুবই ঐতিহ্যশালী রথ উৎসব।  ১৭৭৬ সালে স্বর্গীয় রাজা  আনন্দলাল উপাধ্যায়ের সহধর্মিনী রানী জানকীদেবী এখানকার রথযাত্রাটি সূচনা করেন।  ১৭ চূড়া বিশিষ্ঠ রথটিতে ৩৪ টি চাকা ছিল।  পূর্বের রথটি ভগ্ন অবস্থায় চলে যাওয়ার পর ২০১৭ সালে ২৮ লক্ষ টাকা ব্যয় নতুন করে ১৩ চূড়া বিশিষ্ট রথ তৈরী করা হয়। বর্তমানে নতুন রথটি চালানো হয়। এখানকার রথে জগন্নাথ, বলরাম বা সুভদ্রা থাকেন না, শুধু রাজপরিবারের কুলদেবতা রথে উপবিষ্ট থাকেন। এককালে রাজপরিবারের সদস্যরাই রথের  দড়ি টানতেন, তবে বর্তমানে মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি ও রাজপরিবার যৌথভাবে রথ উৎসবটি আয়োজন করে। এখানে বেশ বড় একটা মেলারও  আয়োজন করা হয়। মেলাটি প্রায় দিন ১৫  চলে।

গুপ্তিপাড়ার রথ :
বাংলার রথ উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ রথযাত্রা হল হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। ১৭৪০ সালে স্বামী মধুসূদানন্দ এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন।  এখানকার রথের অন্যতম বৈশিষ্ঠ হল "ভান্ডারা লুঠ"। ভারতবর্ষের আর কোথাও এই ভান্ডার লুঠ হয় না। এই ভান্ডার লুঠ উৎসবটি উল্টোরথের ঠিক আগের দিন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  এই দিনেও প্রচুর লোক সমাগম হতে দেখা যায়।  এখানকার রথে জগন্নাথদেবের বদলে উপবিষ্ট থাকেন বৃন্দাবন জীউ।  তাই বলা হয় বৃন্দাবন জীউর রথ।  ১১৫৬ বর্গফুট চাওড়া আর ৩৬  ফুট উচ্চতার রথটি নবরত্ন ধাঁচে তৈরী। রথের দিন থেকে সাত দিন ধরে এখানে বিরাট মেলা বসে। মেলায় প্রচুর লোকের সমাগম হয়।

নৈহাটির রথ :
নদীয়া  জেলার নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় খুব প্রাচীন একটা রথের উৎসব হয়ে আসছে।  এই উৎসবের সাথে বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে জড়িয়ে আছে। এই রথ উৎসবটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়দের  কুলদেবতা বিজয় রাধাবল্লভ জীউর রথ উৎসব।  বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ ভ্রাতা শ্রী শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় এই রথযাত্রা ১৮৬২ সালে শুরু করেছিলেন। ১৮৭৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রথের সময় নৈহাটিতে এসেছিলেন। সেই সময় একটা বালিকা মেলার ভীড়ে হারিয়ে গিয়েছিল। সকলের সাথে বঙ্কিমচন্দ্র নিজে বালিকাটির অনুসন্ধান করেছিলেন। এই ঘটনা তাঁকে যথেষ্ঠ ব্যথিত করেছিল। পরবর্তীকালে তিনি এই ঘটনা অবলম্বনে "রাধারানী" নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন।

বড়িশার রথ :
প্রাচীনত্বের নিরিখে বেহালার বড়িশা অঞ্চলের সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের রথ খুবই প্রাচীন। এই রথ উৎসবটি কলকাতার প্রাচীনতম রথ উৎসব।  ১৭১১ সালে বড়িশা গ্রামে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কৃষ্ণদেব রথের ও একটা বিনোদন মেলার সূচনা করেছিলেন।  সেই সময় নয় চূড়া বিশিষ্ঠ রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার পরিবর্তে পরিবারের নারায়ণ  শিলা উপবিষ্ট থাকত।  ১৯১১ সালে পারিবারিক  মন্দিরে নতুনভাবে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ও একটি ত্রিতল রথ তৈরী করা হয়।  তারপর থেকে নবরূপে রথযাত্রা শুরু হয়।  এখন রথের উৎসব ও মেলা পরিসরে অনেক ছোট হয়ে গেছে।

কলকাতা রথযাত্রা :
কলকাতার ইসকনের রথ 
কলকাতা শহরে ইসকন গত ৪৭ বছর ধরে রথ উৎসবটি উদযাপন করে আসছে। যদিও এই রথ উৎসবটি প্রাচীন বা ঐতিহ্যপূর্ণ নয়, তবে খুবই জনপ্রিয়। ১৯৭২ সালের ১২ই জুলাই এই উৎসবটির সূচনা করা হয়েছিল। রথের দড়ি টানার জন্য শহর ও শহরতলি থেকে বহু ভক্ত এইদিন জমায়েত হয়। রথের দিন থেকে আট দিন ধরে মেলার আয়োজন করা হয়। এই সময় বহু ভক্ত বিদেশ থেকেও এসে অংশগ্রহণ করে। গত ২২ বছর ধরে ইসকন নদীয়া জেলার মায়াপুরেও এই উৎসবটি করে আসছে।



এছাড়া কলকাতা ও  জেলার অনেক জায়গায় বহুদিন ধরে রথের উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে হুগলী  জেলার চন্দননগরের রথ, নদীয়া জেলার শান্তিপুরের গোস্বামী বাড়ির রথ,  বালির গোস্বামী বাড়ির রথ, বর্ধমান রাজবাড়ির রথ, খড়্গপুরের জগন্নাথ মন্দিরের রথ, কলকাতার খিদিরপুরের জগন্নাথ মন্দিরের রথ প্রমুখ।  অনেক বনেদী বাড়িতেও খুব ঘটা করে রথ উৎসব পালন করা হয়। কলকাতার দর্জিপাড়ার রাজকৃষ্ণ মিত্র বাড়ির রথ (২০০ বছর) ও দুর্গাচরণ মিত্র বাড়ির রথ (২৫০ বছর), জোড়াসাঁকোর নরসিংহ দা বাড়ির রথ ( ১৫০ বছর), বৌবাজারের রামকানাই অধিকারী বাড়ির রথ (১৫০ বছর ), বেহালার সোনার দূর্গা বাড়ির পেতলের রথ (৮০ বছর) খুবই প্রাচীন রথযাত্রা।

 সেকালে জানবাজারে রানী রাসমনি এক লক্ষ বাইশ হাজার টাকা দিয়ে একটি সম্পূর্ণ রুপোর রথ তৈরী করেন। এই রুপোর রথ সুন্দর করে সাজিয়ে বেশ বড় শোভাযাত্রার  আয়োজন করেছিলেন।  এই রথে তাঁদের কুলদেবতা রঘুবীর উপবিষ্ঠ ছিলেন। সেই সুসজ্জিত রথ এখন আর জানবাজারে চলে না, বহুদিন হলো ওই রথ দক্ষিনেশ্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে এখনো মহাসমারোহে রথ উৎসবটি পালন করা হয়। তবে বর্তমানে ওই রথে রঘুবীরের বদলে জগন্নাথদেব উপবিষ্ট থাকেন।



রথের উৎসব মানেই বাঙালির মাতোয়ারা হওয়ার উৎসব। পাঁপড়ভাজা, জিলিপি, ফুচকা ছাড়া রথযাত্রা ভাবা যায় না, যাকে ঘিরে বাঙালি আজও নস্টালজিয়ায় ভোগে। রথের দড়িতে টান দিলেই পুণ্যলাভ, এই চিরকালীন বিশ্বাস থেকেই বাঙালি পুরী থেকে বাংলার বিভিন্ন রথ উৎসবের শুভলগ্নে সামিল হযে থাকে। রথ হল বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিলনমেলা। সুপ্রাচীন যুগ থেকেই রথ বাঙালি সংস্কৃতির সাথে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রয়েছে।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০১-০৭-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

তথ্যসূত্র : গুগল 

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।