Sunday, July 21, 2019

অকালে ঝরে যাওয়া তারা >

অকালে ঝরে যাওয়া তারা 






জুলাই মাসটা বাংলা সিনেমার দুই নক্ষত্রের পতন ঘটেছিলো। ২২ তারিখে অসাধারণ অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরীর আর ২৪ তারিখ মহানায়ক উত্তমকুমারের। 
 
 ২২শে জুলাই বাঙালির এক বেদনার দিন। এইদিন এক লেলিহান শিখা কেড়ে নিয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রতিভাবান নায়িকাকে। সালটা ছিল ১৯৮৬।  দিনটি বাঙালি দর্শকদের কাছে খুবই দুঃখের দিন। তাঁর অকাল প্রয়াণে বাংলা তথা বাঙালির জীবনে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তাঁর আসল নাম ছিল শিপ্রা, বিখ্যাত পরিচালক শ্রী তরুণ মজুমদার শিপ্রা নামটা বদলে  "মহুয়া" নামটা দিয়েছিলেন। বাংলায় বহু অভিনেত্রী এসেছিলেন তার মধ্যে কেউ অসামান্যা  সুন্দরী, কেউ গ্ল্যামারাস ছিলেন।  আবার কেউ কেউ নিজ অভিনয় দক্ষতায় দর্শকদের মন ছুঁয়ে গিয়েছিলেন। মহুয়া সুন্দরী তো ছিলেন তার সাথে তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় দক্ষতাও  ছিল। দর্শকরা তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় দক্ষতা দেখে চমকে গিয়েছিলেন।

২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮ সালে কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পিতা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী উদয়শঙ্করের দলে নাচ করতেন। তিনি পরে মুম্বাই পাড়ি দেন।  কিন্তু তিনি সেখানে সফলতার মুখ দেখতে পাননি।  কিছুটা বাধ্য হয়েই আবার কলকাতায় ফিরে আসেন।  ছোট্ট শিপ্রা ততদিনে সহজাত দক্ষতায় নাচের তালে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। নীলাঞ্জনবাবু তাঁর এই ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।  কন্যার মাধ্যমেই তিনি সফলতায় পৌঁছতে চাইলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে  তিনি পাড়ার জলসায় শিপ্রার নাচের ব্যবস্থা করলেন।  শিপ্রাও বহু গন্যমান্য শিল্পীদের সাথে একই মঞ্চে নেচে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। তিনি সেদিন "সোনালী রায়" নামে নেচেছিলেন। শিপ্রা নামটি ব্যবহার করেননি। তাঁর নাচের তালে দর্শক ও আয়োজকরা স্থম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন, গন্যমান্য শিল্পীরাও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কলকাতা ও তার আশপাশের  পাড়ার জলসার  মঞ্চগুলোকে তিনি মাতিয়ে দিতে লাগলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মেয়ে শিপ্রা হয়ে উঠলো নৃত্যশিল্পী সোনালী রায়। শিপ্রা বা সোনালির লেখাপড়ায় ছেদ পড়ল। তাঁর স্কুল জীবনের এই সময়ই ইতি ঘটল।

১৯৭২ সালে তরুণ মজুমদার "শ্রীমান পৃত্থিরাজ" সিনেমার জন্য একটা অল্প বয়সী মেয়ে খুঁজছিলেন। শিপ্রাকে দেখে তাঁর পছন্দ হয়। তিনি স্ক্রিন টেস্ট নেন, শিপ্রাও স্ক্রিন টেস্টে উত্তীর্ণ হন।  মাত্র চোদ্দ  বছর বয়সের শিপ্রাকে তিনি অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে নির্বাচিত করলেন।  সন্ধ্যা রায় নিজ হাতে ছোট্ট শিপ্রাকে সিনেমার উপযোগী করে গড়ে তুললেন। ১৯৭৩ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ছবিটা মুক্তি পায়। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর শিপ্রাও হয়ে উঠলো অভিনেত্রী মহুয়া। শুরু হলো তাঁর অভিনয় জীবন আর দর্শকরাও খুঁজে পেলো একজন প্রতিভাবান অভিনেত্রীকে। এই সিনেমার পর তিনি আরো অনেক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন।  তারমধ্যে মহানায়ক উত্তমকুমারের সাথে "সেই চোখ" ও "বাঘ বন্দী খেলা", "সূর্যসাক্ষী", :ইমন কল্যাণ", "প্রতিশোধ"  উল্লেখযোগ্য ছিল।  উত্তমকুমার থেকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত বহু বিখ্যাত নায়কের সাথে তিনি অভিনয় করেছিলেন।  বহু সুপার ডুপার হিট সিনেমা তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ২রা মে ১৯৭৬ সালে অভিনেতা তিলক চক্রবর্তীকে বিবাহ করেন।

১৯৮০ সালে তরুণবাবু দাদার কীর্তি সিনেমায় আবার মহুয়াকে দেবশ্রী রায়ের দিদির  ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত করলেন।  মহুয়াও খুবই দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুললেন। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮০ সালের ২৮শে নভেম্বর। এই সিনেমাটি মহুয়াকে সফলতার উচ্চাসনে বসালো। এই সিনেমার জন্য তিনি সেরা নায়িকা  হিসেবে বি. এফ. জে  পুরস্কার পেয়েছিলেন। দাদার কীর্তির পর তাঁকে  আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।  তিনি আপামর বাঙালির মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে ১৯৮২ সালে "মাটির স্বর্গ", ১৯৮৩ সালে "লাল গোলাপ", রণজিৎ মল্লিকের সাথে ১৯৮২ সালে "শাঠে শাঠ্যাং", ১৯৮৪ সালে "প্রায়শ্চিত্ত" ও 'শত্রু', দীপঙ্কর দের সাথে ১৯৮২ সালে "পিয়াসা", ১৯৮৫ সালে "আমার পৃথিবী" ও "শাপমুক্তি", তাপস পালের সাথে ১৯৮১ সালে "সাহেব", ১৯৮৪ সালে "পারাবত প্রিয়া", ১৯৮৫ সালে "আশীর্বাদ" ও "জীবন", প্রসেনজিতের সাথে তিনি একটাই সিনেমা করেছিলেন ১৯৮৫ সালে "মধুময়"। এছাড়া তাঁর আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি হলো  "অনুরাগের ছোঁয়া", "সুবর্ণলতা", "দাদু-নাতি-হাতি", "কেনারাম বেচারাম", "পাকা দেখা", "সৎমা", "শুভরজনী" প্রভৃতি। এছাড়া তিনি  তপন সিনহার  "আদমি আউর আওরাত" হিন্দি টেলিফিল্মে আমল পালাকারের সাথে অভিনয় করেছিলেন। তিনি বেশিরভাগ সিনেমায় নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। মাত্র বারো বছরের চলচ্চিত্র জীবনে তিনি প্রায় পঞ্চাশটির মত সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর  নাচ, অভিনয়ের সাথে ফুটবলের প্রতিও  খুবই আগ্রহ ছিল। মহুয়া যখন খ্যাতির মধ্যগগনে তখন তিনি তমালের সাথে প্রেমে লিপ্ত হন।  "আনন্দমেলা" সিনেমার শুটিংয়ের সময় তাদের প্রেম দিঢ় হয়। ১৯৭৬ সালের ২রা মে তিনি তিলকের ঘরণী হন। টালিগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায়  ও  বেহালাতেও এই দম্পত্তি ভাড়াটে হিসেবে কাটিয়েছেন।  পরবর্তীকালে টালিগঞ্জের করুণাময়ী অঞ্চলে নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ করেন কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই বাড়ির গৃহপ্রবেশের আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

তাঁর অভিনয় জীবনের সফলতার মধ্যগগনেই চরম বিপত্তিটি ঘটেছিলো। ১৯৮৫ সালের জুলাই মাসের ১২ তারিখে মধ্যরাত্রে স্টোভ ফেটে আগুনে পুড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।  দশদিন ধরে যমে মানুষে লড়াই চালিয়েও নিজেকে রক্ষা করতে পারেন নি।  স্বামী তিলক  ও সাত বছরের পুত্র গোলাককে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।  যদিও তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তাঁর  মৃত্যু যে ভাবেই হোক তিনি কিন্তু এই সামান্য সময়ের মধ্যে বাঙালির মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। বাঙালি আজও তাঁকে ভুলতে পারে না। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৩৪ বছর পরেও তাঁর নাম শুনলে বাঙালি নস্টালজিয়ায় ভোগে।


তথ্যসূত্র : ১)  গুগল
                ২)  A Directory of Bengali Cinema - Parimal Ray & Kazi Anirban

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ২১-০৭-২০১৯



যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


No comments: