Monday, July 1, 2019

পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যমন্ডিত রথযাত্রা>

পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যমন্ডিত রথযাত্রা




ইসকনের রথের মেলা 


 এলোরে, এলোরে, এল রথযাত্রা 
রথে চড়ে যাবে কৃষ্ণ, বলরাম আর  সুভদ্রা 

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।  বাঙালির মানসিকতা হল দূরকে নিকট করা, তাই সব উৎসবই বাঙালির বড় প্রিয়। উৎসবের প্রেরণা যেমন বাঙালির মজ্জাগত, তেমন ধর্মীয় চেতনাও তাদের মজ্জাগত।  বাংলায় সব উৎসবই আলাদা আলাদা মেজাজ নিয়ে আসে। রথযাত্রা হল একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব।  রথযাত্রার প্রধান আকর্ষণ রথ হলেও তার মেলাও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। বাঙালি জীবনে বহুকাল ধরেই মেলার যোগ রয়েছে। প্রতিটি মেলার সাথেই বাঙালির সম্পর্ক বেশ নিবিড় ও আত্মিক।

প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে সারা দেশে হিন্দুরা রথযাত্রা অনুষ্ঠান পালন করে।  হিন্দুদের অন্যতম প্রধান উৎসব হল এই রথযাত্রা। ভারতের সর্ববৃহৎ রথ উৎসবটি পালিত হয়ে থাকে ওড়িষ্যার পুরীতে। শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রার মত বাংলার নিজস্ব রথযাত্রা যথেষ্ট তাৎপর্য্যপূর্ণ এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। পুরীর মত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উৎসবটি উদযাপন করা হয়। হুগলী জেলার মাহেশ ও গুপ্তিপাড়া, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, নৈহাটির রথ  ও কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের রথ  যথেষ্ঠ ঐতিহ্যমন্ডিত  এবং কলকাতার ইস্কনের রথ খুব জনপ্রিয়। এছাড়াও  অনেক বনেদি  বাড়িতেও রথের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

চৈতন্য মহাপ্রভু সর্বপ্রথম ভক্তিবাদের প্রচলন নীলাচলে করেছিলেন। তবে এই  রথ উৎসবটি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কারো কারো মতে নীলাচলে ভক্তিবাদের সূচনাই নাকি এই উৎসবের সূচনা। কিন্তু রামায়ন, মহাভারত ও  ভগবত গীতার বিভিন্ন  আখ্যানে রথের কথা আমরা পেয়েছি। অর্জুনের রথ, পুস্পক রথের উল্লেখ আমরা এইসব পৌরাণিক উপাখ্যানে পেয়েছি।

মাহেশের রথ 
মাহেশের রথ :
হুগলী  জেলার  বিখ্যাত রথযাত্রা হল শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা।  এই রথ উৎসবটি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন রথযাত্রা, যা আজ ছয় শত বর্ষ অতিক্রম করে গেছে। লক্ষ্যাধিক ভক্তের উপস্থিতিতে জগন্নাথদেব মাসির বাড়িতে যাত্রা করেন। প্রথমদিকে কাঠের রথ ছিল। কোনো এক সময় কাঠের রথটি আগুনে ভষ্মীভূত হয়ে যাওয়ায়, কলকাতার কৃষ্ণকান্ত বসু সম্পূর্ণ লোহার তৈরী ৫০ ফুট উচ্চতার, ১২টি চাকাবিশিষ্ঠ রথটি নির্মাণ করে দেন। সেই রথটি  এখনো চালানো হয়।  কথিত আছে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মা সারদা দেবী মাহেশের রথ দেখতে এসেছিলেন। বেশ উৎসাহের সাথে এখানে রথ ও  রথের মেলা আয়োজন করা হয়।
মহিষাদলের রথ :
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথ উৎসবটি খুবই ঐতিহ্যশালী রথ উৎসব।  ১৭৭৬ সালে স্বর্গীয় রাজা  আনন্দলাল উপাধ্যায়ের সহধর্মিনী রানী জানকীদেবী এখানকার রথযাত্রাটি সূচনা করেন।  ১৭ চূড়া বিশিষ্ঠ রথটিতে ৩৪ টি চাকা ছিল।  পূর্বের রথটি ভগ্ন অবস্থায় চলে যাওয়ার পর ২০১৭ সালে ২৮ লক্ষ টাকা ব্যয় নতুন করে ১৩ চূড়া বিশিষ্ট রথ তৈরী করা হয়। বর্তমানে নতুন রথটি চালানো হয়। এখানকার রথে জগন্নাথ, বলরাম বা সুভদ্রা থাকেন না, শুধু রাজপরিবারের কুলদেবতা রথে উপবিষ্ট থাকেন। এককালে রাজপরিবারের সদস্যরাই রথের  দড়ি টানতেন, তবে বর্তমানে মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি ও রাজপরিবার যৌথভাবে রথ উৎসবটি আয়োজন করে। এখানে বেশ বড় একটা মেলারও  আয়োজন করা হয়। মেলাটি প্রায় দিন ১৫  চলে।

গুপ্তিপাড়ার রথ :
বাংলার রথ উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ রথযাত্রা হল হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। ১৭৪০ সালে স্বামী মধুসূদানন্দ এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন।  এখানকার রথের অন্যতম বৈশিষ্ঠ হল "ভান্ডারা লুঠ"। ভারতবর্ষের আর কোথাও এই ভান্ডার লুঠ হয় না। এই ভান্ডার লুঠ উৎসবটি উল্টোরথের ঠিক আগের দিন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  এই দিনেও প্রচুর লোক সমাগম হতে দেখা যায়।  এখানকার রথে জগন্নাথদেবের বদলে উপবিষ্ট থাকেন বৃন্দাবন জীউ।  তাই বলা হয় বৃন্দাবন জীউর রথ।  ১১৫৬ বর্গফুট চাওড়া আর ৩৬  ফুট উচ্চতার রথটি নবরত্ন ধাঁচে তৈরী। রথের দিন থেকে সাত দিন ধরে এখানে বিরাট মেলা বসে। মেলায় প্রচুর লোকের সমাগম হয়।

নৈহাটির রথ :
নদীয়া  জেলার নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় খুব প্রাচীন একটা রথের উৎসব হয়ে আসছে।  এই উৎসবের সাথে বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে জড়িয়ে আছে। এই রথ উৎসবটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়দের  কুলদেবতা বিজয় রাধাবল্লভ জীউর রথ উৎসব।  বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ ভ্রাতা শ্রী শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় এই রথযাত্রা ১৮৬২ সালে শুরু করেছিলেন। ১৮৭৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রথের সময় নৈহাটিতে এসেছিলেন। সেই সময় একটা বালিকা মেলার ভীড়ে হারিয়ে গিয়েছিল। সকলের সাথে বঙ্কিমচন্দ্র নিজে বালিকাটির অনুসন্ধান করেছিলেন। এই ঘটনা তাঁকে যথেষ্ঠ ব্যথিত করেছিল। পরবর্তীকালে তিনি এই ঘটনা অবলম্বনে "রাধারানী" নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন।

বড়িশার রথ :
প্রাচীনত্বের নিরিখে বেহালার বড়িশা অঞ্চলের সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের রথ খুবই প্রাচীন। এই রথ উৎসবটি কলকাতার প্রাচীনতম রথ উৎসব।  ১৭১১ সালে বড়িশা গ্রামে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কৃষ্ণদেব রথের ও একটা বিনোদন মেলার সূচনা করেছিলেন।  সেই সময় নয় চূড়া বিশিষ্ঠ রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার পরিবর্তে পরিবারের নারায়ণ  শিলা উপবিষ্ট থাকত।  ১৯১১ সালে পারিবারিক  মন্দিরে নতুনভাবে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ও একটি ত্রিতল রথ তৈরী করা হয়।  তারপর থেকে নবরূপে রথযাত্রা শুরু হয়।  এখন রথের উৎসব ও মেলা পরিসরে অনেক ছোট হয়ে গেছে।

কলকাতা রথযাত্রা :
কলকাতার ইসকনের রথ 
কলকাতা শহরে ইসকন গত ৪৭ বছর ধরে রথ উৎসবটি উদযাপন করে আসছে। যদিও এই রথ উৎসবটি প্রাচীন বা ঐতিহ্যপূর্ণ নয়, তবে খুবই জনপ্রিয়। ১৯৭২ সালের ১২ই জুলাই এই উৎসবটির সূচনা করা হয়েছিল। রথের দড়ি টানার জন্য শহর ও শহরতলি থেকে বহু ভক্ত এইদিন জমায়েত হয়। রথের দিন থেকে আট দিন ধরে মেলার আয়োজন করা হয়। এই সময় বহু ভক্ত বিদেশ থেকেও এসে অংশগ্রহণ করে। গত ২২ বছর ধরে ইসকন নদীয়া জেলার মায়াপুরেও এই উৎসবটি করে আসছে।



এছাড়া কলকাতা ও  জেলার অনেক জায়গায় বহুদিন ধরে রথের উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে হুগলী  জেলার চন্দননগরের রথ, নদীয়া জেলার শান্তিপুরের গোস্বামী বাড়ির রথ,  বালির গোস্বামী বাড়ির রথ, বর্ধমান রাজবাড়ির রথ, খড়্গপুরের জগন্নাথ মন্দিরের রথ, কলকাতার খিদিরপুরের জগন্নাথ মন্দিরের রথ প্রমুখ।  অনেক বনেদী বাড়িতেও খুব ঘটা করে রথ উৎসব পালন করা হয়। কলকাতার দর্জিপাড়ার রাজকৃষ্ণ মিত্র বাড়ির রথ (২০০ বছর) ও দুর্গাচরণ মিত্র বাড়ির রথ (২৫০ বছর), জোড়াসাঁকোর নরসিংহ দা বাড়ির রথ ( ১৫০ বছর), বৌবাজারের রামকানাই অধিকারী বাড়ির রথ (১৫০ বছর ), বেহালার সোনার দূর্গা বাড়ির পেতলের রথ (৮০ বছর) খুবই প্রাচীন রথযাত্রা।

 সেকালে জানবাজারে রানী রাসমনি এক লক্ষ বাইশ হাজার টাকা দিয়ে একটি সম্পূর্ণ রুপোর রথ তৈরী করেন। এই রুপোর রথ সুন্দর করে সাজিয়ে বেশ বড় শোভাযাত্রার  আয়োজন করেছিলেন।  এই রথে তাঁদের কুলদেবতা রঘুবীর উপবিষ্ঠ ছিলেন। সেই সুসজ্জিত রথ এখন আর জানবাজারে চলে না, বহুদিন হলো ওই রথ দক্ষিনেশ্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে এখনো মহাসমারোহে রথ উৎসবটি পালন করা হয়। তবে বর্তমানে ওই রথে রঘুবীরের বদলে জগন্নাথদেব উপবিষ্ট থাকেন।



রথের উৎসব মানেই বাঙালির মাতোয়ারা হওয়ার উৎসব। পাঁপড়ভাজা, জিলিপি, ফুচকা ছাড়া রথযাত্রা ভাবা যায় না, যাকে ঘিরে বাঙালি আজও নস্টালজিয়ায় ভোগে। রথের দড়িতে টান দিলেই পুণ্যলাভ, এই চিরকালীন বিশ্বাস থেকেই বাঙালি পুরী থেকে বাংলার বিভিন্ন রথ উৎসবের শুভলগ্নে সামিল হযে থাকে। রথ হল বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিলনমেলা। সুপ্রাচীন যুগ থেকেই রথ বাঙালি সংস্কৃতির সাথে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রয়েছে।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০১-০৭-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

তথ্যসূত্র : গুগল 

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




No comments: