Sunday, April 28, 2019

শতবর্ষের আলোকে মান্না দে >


শতবর্ষের আলোকে মান্না দে



বিংশ শতাব্দী ভারতীয় খেলাধুলা ও  সংস্কৃতি  জগতে এক বিস্ময়ের শতাব্দী, বলা যায় বহু নক্ষত্র সমাবেশের শতাব্দী। খেলাধুলার  জগতে,  সাহিত্য জগতে, অভিনয়ের  জগতে,  সংগীত জগতে এই শতাব্দী বিশ্বে তথা ভারতবর্ষে  অজস্র নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজ নিজ জগৎকে অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছিলেন। এই শতাব্দীতেই  ভারতীয়  সংগীত জগতে কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দের জন্ম হয়েছিল।  সংগীত জগতে  তাঁর  উজ্জ্বল পদার্পন ভারতীয় সংগীতকে এক উচ্চ আসনে বসিয়েছিল। তাঁর অধ্যাবসায় তাঁকে ভারতীয়  সংগীত জগতে এক নক্ষত্রে পরিণত করেছিল।   ২০১৯ সালের ১লা মে দেখতে দেখতে তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হতে চলল। দিকে দিকে তাঁর শতবর্ষই উদযাপন করা হচ্ছে। 

যখন আমার বারো - তেরো বছর বয়স তখন আমি  "বিনাকা সংগীতমালা" অনুষ্ঠানে ওনার গান শুনে আমি প্রথম এই কণ্ঠ মাধুর্যের সাথে পরিচিত হই। তারপর থেকে এই কণ্ঠ আমার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে  জড়িয়ে গেছে।  আমার কৈশোরের প্রথম প্রেমই এই গায়কীর সাথে। সেই প্রেম আজও আমায় সমানভাবে আকর্ষণ করে রেখেছে, হয়তো আমার জীবনের শেষ নিঃশাস পড়া অবধি এই প্রেমের বন্ধন অটুট থাকবে। কয়েকদিন  যদি এই কণ্ঠ  বা এই গায়কী না শুনি এখনো  আমার মনটা উতলা হয়ে ওঠে। ১৯৮৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমি অন্তত খান তিরিশেক ওনার গানের  প্রোগ্রাম শুনেছি, তার মধ্যে ১৮টা একক প্রোগ্রাম ছিল, যা আমার স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। ওনার গানের সাথে রাধাকান্ত নন্দীর যুগলবন্দী, পরবর্তীকালে রাধাকান্ত নন্দীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মানিক নন্দীর যুগলবন্দী কোনদিন ভুলতে পারবো না। গায়ক ও তবলচির কি অসাধারণ বোঝাপড়া ছিল যা চোখে না দেখলে বলে বোঝানো  যাবে না।

মান্না দে, আজ এই সুন্দর ভুবনের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন ঠিকই। কিন্তু আজও সমগ্র ভারতবাসীকে তিনি তাঁর সুরমূর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছেন। তাই তো এখনকার পরিচিত গায়ক অঞ্জন দত্ত ভক্তদের মনের কথা বলেছেন " আর বিরহের কথা এলে, বুকের জ্বালা ভুলে, আজও মাঝে মাঝে গাই মান্না দের গান"। প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ , ভক্তি , বন্ধুত্ব, উন্মাদনা মানব জীবনের সব ধরণের অনুভূতির প্রকাশ মান্না দের গানে বার বার এসেছে। তাঁর  গায়কি  দিয়ে তিনি সমগ্র দেশবাসী তথা পৃথিবীর মানুষকে মন-মুগ্ধ করে রেখেছেন।  ক্ল্যাসিক্যাল, সেমি -  ক্ল্যাসিক্যাল, গজল, আধুনিক গানে শুধু নয়, রক এন্ড রোল গানেও তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ  তিনি রেখে গেছেন। বাংলা ও হিন্দি ছাড়া ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় তিনি গান গেয়ে গেছেন। যার কণ্ঠে খেলা করতো সংগীতের সাত সুর।  তিনি সুরের চলনে সঞ্চার করতে পারতেন নাটক।  কঠিন গানকে কত সহজভাবে তিনি গাইতে পারতেন তার নমুনা বোধহয় "লাগা চুঁনড়ি মে দাগ" বা পড়াসন  চলচ্চিত্রের  "এক চতুর নার"। তাঁর এই ক্ষমতা অকল্পনীয় ছিল। বৈচিত্রের বিচারে সংগীতবোদ্ধাদের কাছে তিনি সর্বকালের সেরা গায়ক বলে বিবেচিত। তিনি বহু  ভাষায় বহু গান গেয়েছিলেন ঠিকই, তবে হিন্দি ও বাংলা গানে তাঁকে  কিংবদন্তি বলে ধরা হয়।

"ও কেন এত সুন্দরী হল" বা "এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি" গানের মাধ্যমে তিনি ব্যর্থ প্রেমিকের মনের  যন্ত্রনা যেমন ফুটিয়ে  তুলেছেন। তেমন  "সে আমার ছোট বোন" গানটিতে তিনি তাঁর  স্নেহ মায়া সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। "আমায় একটু জায়গা দাও,মায়ের মন্দিরে বসি" গানটিতে তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তিকে সুনিপুনভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, যা  শুনলে যে কোনো শ্রোতার চোখ জলে ভিজে যায়। মান্না দের গানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তার গানের পরিধি বাঙালি জীবনের প্রত্যেকটা  ধাপের সাথে মিশে আছে।  আমাদের সব অনুভূতি বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ তাঁর গানে গানে প্রকাশিত হয়েছে। তাই তো তিনি "সারা  জীবনের গান" বা " সারা বছরের  গান" গেয়ে  ছিলেন।

 একশো বছর পূর্বে অর্থাৎ  ১লা মে  ১৯১৯ সালে উত্তর কলকাতার ৯ নং মদন ঘোষ লেনের এক মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা  পূর্ণ চন্দ্র দে আর মাতা ছিলেন মহামায়া  দেবী। তিনি শৈশবে ইন্দু বাবুর পাঠশালায়, পরে  স্কটিশ চার্চ স্কুল ও স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক হন। স্নাতক হওয়ার পর তাঁর পড়াশুনার পাঠ তিনি সাঙ্গ  করেন। তাঁর কাকা বিখ্যাত সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণ চন্দ্র দে তাঁকে সংগীতের প্রতি বরাবর অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করতেন। মান্না দের  যেমন সংগীতের প্রতি আকর্ষণ ছিল তেমন কুস্তি, বক্সিংয়ের প্রতিও খুব আগ্রহ ছিল। তিনি নিয়মিত বক্সিং চর্চা করতেন এবং খুবই পারদর্শী ছিলেন এই সব খেলায়। পড়াশুনার পাঠ সাঙ্গ  করার পর তিনি তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের ছত্রছায়ায় সংগীত চর্চ্চা শুরু করেন। উস্তাদ  দাবির খাঁর কাছে তিনি সংগীতের তালিম নেওয়াও শুরু করেন। পরবর্তীকালে মুম্বাই যাওয়ার পর তিনি উস্তাদ আমন আলী খাঁ ও উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছে হিন্দুস্তানী সংগীতের তালিম নেন।

১৯৪২ সালে তিনি মুম্বাই পাড়ি দেন। প্রথমে তিনি কাকার সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তারপর শচীন দেববর্মন ও ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ ও অন্যান্য সুরকারদের অধীনে কাজ করেন।  কাজ করতে করতে তিনি স্বনামধন্য গীতিকারদের সংস্পর্শে আসেন। এইভাবে কিছুদিন চলার পর তিনি স্বাধীনভাবে সংগীত পরিচালনার কাজ শুরু করেন।

১৯৪৩ সালে "তামান্না" নামে একটা ছবিতে তাঁর কাকার সুরে প্রথম গায়ক হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে। "জাগো আই উষা" গানটি তিনি সুরাইয়ার সাথে দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন। এই গানটা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। ১৯৫০ সালে শচীন দেববর্মনের সুরে "মশাল" ছবিতে তিনি প্রথম এককভাবে গান গেয়েছিলেন।  এই গানটাও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গানটাই তাঁকে পাকাপোক্ত গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তীকালে  তিনি বহু সুরকারের সুরে বহু জনপ্রিয় গান গেয়ে গেছেন। ১৯৫৩ সালে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় নিজের সুরে "কত  দূরে আর নিয়ে যাবে বল" ও  "হায় হায় গো , রাত যায় গো"  গান দুটি  তাঁর  গাওয়া প্রথম বাংলা গান। পুজোর সময় গান দুটি প্রকাশ হওয়ার পর সুপার হিট হয়।  ১৯৬৭ সালে এন্টনি ফিরিঙ্গি সিনেমায় উত্তমকুমারের লিপে গাওয়া সব কটা গান আজও বাঙালির হৃদয়কে মোহিত করে রাখে। তিনি যেমন আরতি  মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকরের সাথে দ্বৈত কণ্ঠে বাংলা সিনেমায় বেশ কিছু জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন। তেমন  অনিল বাগচী, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে বাংলা চলচ্চিত্রেও  অনেক গান আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। বাংলা আধুনিক গানে পুলক বন্দ্যোপাধ্যাযের লেখা ও নিজের সুরে গাওয়া গানগুলি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সুপর্ন কান্তি ঘোষের সুরে বেশ কিছু বিখ্যাত গান তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। তার মধ্যে কফি হাউসের গানটি তো চিরকালীন শ্রেষ্ঠ গান হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে।  তিনি সব ভাষা মিলে  প্রায়  হাজার চারেক গান গেয়েছেন।

মান্না দে শুধু গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না. তিনি একজন নামজাদা সংগীত পরিচালকও ছিলেন। ১৯৪০ সালে যখন তাঁর বয়স ২১ বছর তখন তিনি শৈলেশ রায়ের কথায় "ওগো দূরের ধ্যানে" ও "বালুকাবেলায় অলস খেলায়" এই দুটি গান সুপ্রীতি ঘোষকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন। রেকর্ডে অবশ্য সুরকার হিসেবে প্রবোধ চন্দ্র দের  নাম উল্লেখ করা আছে।  তখন তিনি মান্না নামটি মনে হয়  ব্যবহার করতেন না। এরপর তিনি বহু বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন।  তিনি নিজের সুরে নিজে যেমন গেয়েছেন তেমন প্রচুর নামি-অনামী শিল্পীদের দিয়েও গান গাইয়েছেন। তাঁর সুরের মধ্যে সবসময় শাস্ত্রীয় সংগীতের ছোঁয়া  প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। ছায়াছবি ছাড়াও প্রচুর নন ফিল্মি গানে তিনি সুর দিয়ে গেছেন। ১৯৭৬ সালে পুজোর সময় আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাইয়েছিলেন "আমি খাতার পাতায় লিখেছিলাম", ও সুমন কল্যাণপুরকে দিয়ে গাইয়েছিলেন "কাঁদে কেন মন আজ" এবং "শুধু স্বপ্ন নিয়ে খেলা চলছে ", ১৯৭৮ সালে হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে  গাইয়েছিলেন  "আমার বলার কিছু ছিল না"। এছাড়া প্রতিবছর তিনি নিজের সুর করা গানগুলো নিজেই গেয়ে গেছেন।  সবকটা গানই জনপ্রিতার শীর্ষে পৌঁছেছিল। কণ্ঠ  অনুযায়ী আদর্শ সুর নির্বাচন করার ক্ষমতা তাঁর ছিল।

১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী ও ২০০৫ সালে পদ্মভূষণ খেতাব তিনি ভারত সরকারের থেকে লাভ করেন। ২০০৪ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০০৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট্ সম্মানে সম্মানিত হন।  ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ সম্মান প্রদান করে।  এছাড়া দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার, বহু প্রাদেশিক সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে বহু সম্মানে তিনি সম্মানিত হয়েছেন।

১৯৫৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তিনি কেরালার কন্যা সুলোচনা কুমারনকে বিবাহ করেন।  ১৯৫৬ সালের ১৯শে অক্টোবরে তাঁর প্রথম কন্যা সুরমা ও ১৯৫৮ সালের ২০শে  জানুয়ারী  তাঁর  কনিষ্ঠা  কন্যা সুমিতা জন্মগ্রহণ করে।  তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর মুম্বাইয়ে বসবাস করেন।  তবে কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে তিনি প্রায়ই যাতায়াত করতেন। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর শেষ জীবনটা তিনি তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা সুমিতার কাছে ব্যাঙ্গালোরে কাটান। ২০১৩ সালের ২৪শে অক্টোবর ব্যাঙ্গালোরে তাঁর  মৃত্যু হয়। "শেষ পাতা গো, শাখায় তুমি থাকো" শেষ পর্যন্ত সেই পাতা ঝড়েই গেছে, কিন্তু শ্রোতারা সব সময়ই তাঁর গাওয়া গানগুলোকে মনে মনে গুন্ গুন্ করবে। মুকুটটা পড়েই আছে, শুধু রাজা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।

নিয়ম, নিষ্ঠা, অধ্যাবসায়, শিক্ষা ও রেওয়াজে সাজানো যেন এক সংঙ্গীত মন্দির, যে মন্দিরে একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন মান্না দে। প্রবাদপ্রতিম এই সংগীতশিল্পী আজ আমাদের মধ্যে নেই ঠিকই, কিন্তু মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসা তার গানের অপেক্ষায় আমরা চিরকাল রয়ে যাবো।  কাগজ বা পাথরে তাঁর  নাম আমরা না লিখে আজও আমাদের হৃদয়ে  লিখে রেখেছি এবং তা রয়ে যাবে।




তারিখ :  ১লা মে, ২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Sunday, April 21, 2019

ঢাকুরিয়া লেক Lake >

প্রেমিক প্রেমিকাদের নিজস্ব ঠিকানা 


লেক ও রাস্তা 
আমাদের তিলোত্তমার শ্বাসযন্ত্র। কলকাতার ফুসফুস।  প্রেমিক-প্রেমিকাদের একান্ত ঠিকানা। যুগলদের স্নিগ্ধ বাতাসে বসে একান্তে কিছুটা সময় গল্প করে কাটানোর নিজস্ব জায়গাই হল  দক্ষিণ  কলকাতার বুকে গড়ে তোলা এই কৃত্রিম হ্রদটি। হ্রদটির পূর্বের নাম ছিল ঢাকুরিয়া লেক বর্তমানে অবশ্য  রবীন্দ্র সরোবর নামে  পরিচিত। এটি শহরের এক অন্যতম  বিনোদন পার্ক।  

দুরন্ত গতিতে চলা আমাদের ঐতিহ্যশালী তিলোত্তমা কলকাতা। বায়ুদূষণে যখন আমাদের তিলোত্তমাবাসীদের অবস্থা কাহিল, তখন তরতাজা নির্মল নিশ্বাস নেওয়ার জন্য এই হৃদটিতে এসে মন প্রাণ ভরে  তুলতে পারেন। এক টুকরো আকাশ, সুদীর্ঘ জলরাশি, প্রচুর গাছ দিয়ে সাজানো গোছানো এক মনোরম পরিবেশ যা আপনার জন্যই  অপেক্ষা করে রয়েছে।
লেকের রাস্তা 

উনিশ শতকের প্রথমদিকে কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলটির বেশিভাগ জায়গাই জলে-জঙ্গলে ভর্তি ছিল। বসবাসের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। ১৯২০ সালে কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলের উন্নতিকল্পে রেল লাইনের ধার বরাবর ঢাকুরিয়া, লেক গ্রার্ডেন্স, টালিগঞ্জের বেশ কিছুটা অঞ্চলকে নিয়ে ১৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। রাস্তাঘাট তৈরী, নীচু  জমি উঁচু করে  বসবাসযোগ্য করে তোলাই ছিল তাদের  এই  জমি  অধিগ্রহনের একমাত্র কারণ। এই অধিগৃহীত জমির জঙ্গল পরিষ্কার করে ৭৩ একর জায়গা নিয়ে তারা একটি  বৃহৎ হ্রদ খনন করে। বাকি অংশটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়। এই বৃহৎ হৃদটিই আজকের রবীন্দ্র সরোবর। আমাদের শহরের প্রাণভ্রমরা।

হ্রদটি প্রথম থেকেই ঢাকুরিয়া লেক বলে পরিচিত ছিল। ১৯৫৮ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নামানুসারে কে আই টি হ্রদটির নামকরণ করে। জলাশয়টি ছাড়া এখানে তারা তৈরী করে ফুটবল স্টেডিয়াম, মুক্তমঞ্চ, ঝুলন্ত সেতু। এছাড়া এখানে বৌদ্ধ মন্দির, মসজিদ ও একটা গ্যালারিও রয়েছে। জলাশয়টিকে ঘিরে সুন্দর রাস্তা ও বসার জন্য বেশ কিছু চেয়ার তৈরী করা আছে।

ফুটবল স্টেডিয়ামটির নামও বিশ্বকবির নামে  নামাঙ্কিত। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামটি ১৯৫০ সালে হ্রদটির উত্তরদিকে তৈরী করা হয়েছিল। ছাব্বিশ হাজার আসনবিশিষ্ট এক সুন্দর ফুটবল স্টেডিয়াম।  অডিও -ভিসুয়ালের সুবিধাযুক্ত এটিই  কলকাতার প্রথম স্টেডিয়াম।
সূর্যাস্তের আলোকচ্ছটা 

হ্রদটির উত্তরদিকে কেয়াতলার কাছে বিদ্রোহী কবি নজরুলের নামে  একটা বিশাল মুক্ত মঞ্চ রয়েছে। এই মঞ্চটিতে প্রায় তিন  হাজার দর্শকের বসার ব্যবস্থা আছে। এখানেই পৃথিবী বিখ্যাত ডোভার লেন মিউজিক উৎসবটি প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়।  এছাড়া সারা বছরই নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

হ্রদটির দক্ষিণদিকে গোলপার্কের ঠিক পিছনে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের ঐতিহ্যশালী বাড়িটি রয়েছে। এখানে বড়দের ও শিশুদের দুটি  পাঠাগার, দেশী ও বিদেশী ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র, মিউজিয়াম, প্রার্থনা ঘর, প্রকাশনা বিভাগ  ও  পুস্তক বিপনী রয়েছে। রামকৃষ্ণ মঠের এই শাখা কেন্দ্রটি শিক্ষা ও সংস্কৃতির  এক অসাধারণ চর্চা কেন্দ্র।

জাপানি বৌদ্ধ মন্দির
জলাশয়টির দক্ষিণদিকে ঢাকুরিয়া চৈতন্য মহাপ্রভু সেতুর পাশে অবস্থিত অসাধারণ একটি বৌদ্ধ মন্দির। আন্তর্জাতিক সংগঠন নিপ্পনজান মোয়োহোজির প্রতিষ্ঠাতা নিচিদাৎসু ফুজি কলকাতার একমাত্র জাপানি বৌদ্ধ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৫ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখানে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় বেশ ভক্তিভরে প্রার্থনা করা হয়।

হ্রদটির দক্ষিণদিকে একটা সুন্দর ঠাকুরের গ্যালারী রয়েছে। এই গ্যালারীতে বিখ্যাত বেশ কিছু সার্বজনীন দূর্গা পুজোর পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিমাগুলো কে সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। ২০১২ সালে এই গ্যালারীটিকে তৈরী করা হয়েছে।

 জলাশয়টির দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে বেশ কয়েকটা সাঁতার ও রোয়িং প্রশিক্ষণের কেন্দ্র রয়েছে। এইসব প্রশিক্ষণ  কেন্দ্রগুলো বহু পুরোনো।  এখান থেকে বহু শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করে।

সেই ঐতিহাসিক কামান 
১৯২০ সালে যখন হ্রদটির  খননকার্য চালানো হচ্ছিলো  তখন ইংরেজ আমলে তৈরী  কতকগুলি কামান এখানে  পাওয়া গিয়েছিল। সেই কামানগুলি দূর্গা গ্যালারীর  কাছে আজও সগৌরবে বিরাজ করছে।

হ্রদটির দক্ষিণদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা পূর্ণবয়ব ভাস্কর্য রয়েছে। প্রতি বছর  রবীন্দ্রনাথের  জন্ম ও মৃত্যুরদিন সকালে ফুল-মালা দিয়ে কবিকে সম্মান জানানো হয়।

হ্ৰদটির  মধ্যভাগে একটা ছোট্ট সুন্দর দ্বীপ  রয়েছে। এই দ্বীপটির মধ্যে একটা মসজিদ আছে।  এই মসজিদটি হ্রদটি খনন করার পূর্ব থেকেই রয়েছে।  এই দ্বীপটিতে যাওয়ার জন্য ভারী সুন্দর একটা ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। ১৯২৬ সালে
ঝুলন্ত সেতু 
সেতুটিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেতুর ওপর থেকে জলে খেলে বেড়ানো মাছেদের জলকেলির দৃশ্যটি খুব মনোরম লাগে।

শাল, সেগুন, আম, অশ্বত্থ, বট প্রভৃতি বড় বড় গাছ সমগ্র হৃদটিকে ঘিরে রেখেছে।  শোনা যায় প্রায় পঞ্চাশ রকমের গাছ এখানে রয়েছে, তারমধ্যে বেশ কিছু গাছের বয়স শতবর্ষ  পেড়িয়ে গেছে।  গাছগুলি ঐতিহ্যশালী হ্রদটির পরিবেশকে সবুজ ও মনোরম করে তুলেছে। বেশ কিছু বিলুপ্তপ্রায় গাছ এখানে দেখা যায়। হ্রদের জলে রাজহাঁসের খেলে বেড়ানোর দৃশ্যও মন ভরিয়ে দেয়।

সরোবরটিতে  পাঁচটি প্রবেশ পথ রয়েছে।  প্রবেশ পথগুলির টাইলসে রবীন্দ্রনাথের লেখনী দিয়ে চিত্রিত করা আছে।  সরোবরের জলাশয়টির পাশের রাস্তাগুলোকে  টাইলস দিয়ে সুন্দর করে বাঁধানো হয়েছে।  জলাশয়ের রেলিংগুলোতে বোলার্ড লাগানো হয়েছে।  বোলার্ড হচ্ছে আবহাওয়া প্রতিরোধকারী এক প্রকার দর্শনীয় সৌর আলো।  সন্ধ্যের সময় যখন আলোগুলো জ্বলে ওঠে তখন লেকের সৌন্দর্য দ্বিগুন  করে তোলে। নিরাপত্তার করণে চারদিকে আরো কিছু অন্য ধরণের আলো দিয়ে সাজিয়ে  তোলা হয়েছে। লেকের দেয়ালগুলোতেও  বেশ কিছু জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের চিত্র চিত্রিত করা হয়েছে। সব সময় এখানে  পাখীদের কলতানে ভরে থাকে।  শীতকালে এখানে বেশ কিছু অতিথি পাখীদের দেখা মেলে। প্রতিদিন ভোরবেলা  ও সন্ধ্যের সময় বহু স্থানীয় বাসিন্দাদের এখানে ভ্রমণ করতে দেখা যায়।

বিশ্বকবির ভাস্কর্য 
বর্তমানে সরকারি তরফ থেকে রবীন্দ্র সরোবরের সৌন্দর্যায়নের জন্য নতুন  একগুচ্ছ পরিকল্পনা করা হয়েছে।  সরোবরের চারদিকে বসার জন্য নতুন করে বেশ কিছু বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে।  আগের শিশু উদ্যানের মতো একটা নতুন শিশু উদ্দ্যান তৈরী করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। হ্রদের জলকে পরিষ্কার করে পরিবেশের সঙ্গে মানানসই করা হচ্ছে।  ছট পুজো করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কুকুর নিয়ে এই সরোবরে ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত করার চেষ্টা চলছে। এইসব সৌন্দর্যায়নের কাজে প্রাতঃভ্রমণকারীদের সংগঠন সর্বতোভাবে  সহযোগিতা করছে।  "ত্রুমিত্র" নামে এক প্রকল্পের মাধ্যমে এখানকার বিশাল বিশাল গাছগুলোকে দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।  এই প্রকল্পে নতুন নতুন গাছও  বসানো হচ্ছে।

দূর্গা গ্যালারির প্রতিমা 
আধুনিক সাজসজ্জা , বর্ণিল আলোকচ্ছটা, হ্রদের জলে সূর্যাস্তের রঙে রঙিন হয়ে ওঠা, গাছের ফাঁকে আলো-আঁধারি খেলা, এই আবছা আলোয় যুগলের গল্পে মশগুল থাকা, বাচ্ছাদের দুরন্তপণা  সবমিলে এখানকার স্নিগ্ধ, সুমধুর পরিবেশ শহরবাসীকে সবসময় প্রলুব্ধ করে চলেছে। এখানে আসলে একান্তে নিরিবিলি পরিবেশে  বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করা যায়। দৈনন্দিন কাজের পরিশ্রম  থেকে  কিছুটা সময় বের করে এখানে কাটাতে পারলে পরেরদিন নতুন উদ্দ্যমে নতুনভাবে কাজে মন দিতে সুবিধা হয়।




তারিখ : ২১-০৪-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Saturday, April 13, 2019

অন্নপূর্ণা মন্দির >

প্রতিরূপ


মূল মন্দির 
দেবী অন্নপূর্ণা বা অন্নদা হলেন পার্বতীর এক রূপ।  দেবী অন্নপূর্ণা  হলেন দ্বিভূজা। তাঁর  এক হাতে থাকে অন্নের  পাত্র আর অন্য হাতে থাকে দর্বী অর্থাৎ  হাতা।  চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে দেবী পূজিত হন।  কাশীতে ১৭২৫ সালে নির্মিত ভারতবর্ষের অন্যতম জাগ্রত অন্নপূর্ণার মন্দিরটি আছে। এছাড়া অন্যান্য বহু স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবী অন্নপূর্ণার বহু মন্দির আছে। অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রভাবেই দেবী অন্নপূর্ণার পূজা চালু হয়। কথিত আছে যে নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার মহাশয় বাংলায় সর্বপ্রথম অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলন করেন।  

১৮৪৭ সালে রানী রাসমণি দাস-দাসী, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে  নিয়ে কাশী যাত্রা করেন। তাঁর  উদ্দেশ্য ছিল কাশীর মাকে দর্শন করা ও ভক্তিভরে মায়ের পুজো দেওয়া। কিন্তু যাত্রাপথে একদিন রাতে রানী স্বপ্নাদেশ পান যে "কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ভাগীরথীর তীরে একটা মনোরম পরিবেশে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করে পুজো ও ভোগের ব্যবস্থা কর, আমি নিজে আবির্ভূত হয়ে তোর কাছ থেকে নিত্যপূজা গ্রহণ করব"। ভক্তিপরায়ণা রানী এইরূপ আদেশ লাভের পর তাঁর  কাশীযাত্রা স্থগিত করে দেন। তাঁর সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিনি ১৮৫৫ সালে দক্ষিনেশ্বরে মা ভবতারিনীর মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ।

মন্দিরে পঙ্খের কাজ 
রানীর কনিষ্ঠ জামাতা মথুরনাথ বিশ্বাসেরও বহুকালের ইচ্ছা ছিল কাশীতে গিয়ে শ্রী শ্রী বিশ্বেশ্বর ও মা অন্নপূর্ণার দর্শন ও ষোড়শ  প্রচারে পুজো দেওয়ার। রানীর কাশী যাত্রা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় মথুরবাবুর বাসনা পূর্ণ হয়নি। তখন থেকেই তিনি দক্ষিনেশ্বরের কাছে দেবী অন্নপূর্ণার একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য  মনে মনে বাসনা পোষণ করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ করে যেতে পারেননি। রানীর চতুর্থ কন্যা অর্থাৎ মথুরবাবুর সহধর্মিনী জগদম্বাদেবী মথুরবাবুর ইচ্ছাপূরণের ব্যবস্থা করেন। তিনি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের  অনুমতি নিয়ে ১৮৭৫ সালে গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চল চানকে মা অন্নপূর্ণার এক বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন। অতীতের চানকই বর্তমানের ব্যারাকপুর। ব্যারাকপুরের তালপুকুর অঞ্চলের এই মন্দিরটি ১৮৭৫ সালের ১২ই এপ্রিল উদ্বোধন করা হয়। মন্দিরটি দক্ষিনেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের অনুকরণে তৈরী, ঠিক যেন তারই অবিকল এক প্রতিরূপ। তবে এই মন্দিরটি দক্ষিনেশ্বরের মন্দিরের থেকে উচ্চতায় সামান্য বেশি আর দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে কিছুটা কম। মন্দিরটির পোশাকি নাম "শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির"।

মন্দিরে পঙ্খের কাজ 
ব্যারাকপুরের মন্দিরটি বঙ্গীয় স্থাপত্য শৈলীতে তৈরী নবরত্ন ধারার মন্দির। এক বিরাট তোরণের ভিতর দিয়ে  মন্দিরে প্রবেশ করার পর  দেখলাম  পাশাপাশি  নাটমন্দির ও মূলমন্দিরটি রয়েছে। এছাড়া নহবতখানাও আছে। মন্দিরটির পশ্চিমদিকে কিন্নরেশ্বর, কল্যাণেশ্বর, কামেশ্বর, কৈলাসেশ্বর, কপিলেশ্বর, ও কেদারেশ্বর নামে  ছয়টি আট চালাবিশিষ্ট শিব মন্দির রয়েছে। প্রত্যেকটি মন্দিরে তিন ফুট উচ্চতার  কালো রঙের শিব মূর্তি বিরাজ করছে। এই শিব মন্দিরগুলির ঠিক মাঝখানে গঙ্গা ঘাটে  যাওয়ার একটা ছোট্ট দ্বার রয়েছে। গঙ্গার ঘাটটির নাম "রাসমণি ঘাট"। ঘাটের পাশে মহিলাদের সাজ বদলের জন্য একটা ঘর  রয়েছে।

প্রবেশের তোরণ 


মূল মন্দিরটি ইঁটের তৈরী উঁচু বেদীর  ওপর স্থাপিত। মন্দিরটিতে ওঠার জন্য তিনদিকে সিঁড়ি রয়েছে। মন্দিরটির স্তম্ভগুলি খুবই সুন্দর। মন্দিরটির গায়ে সুন্দর পঙ্খের কাজ করা আছে। মন্দিরটির দ্বিতল ও ত্রিতলে সুন্দর খাঁজকাটা দেওলাকৃত নয়টি রত্ন  রয়েছে। গর্ভগৃহে শ্বেতপাথরের বেদীর উপরে সম্পূর্ণ রুপোর তৈরী সিংহাসনে বেনারসি শাড়ি পরিহিতা  অষ্টধাতুতে তৈরী মায়ের মূর্তিটি বিরাজ করছে। এখানকার দেবী সোনার অলংকারে ভূষিতা। মূর্তিটির বাম হস্তে অন্নপাত্র আর ডান হস্তে দর্বী রয়েছে। মূর্তিটির ডানদিকে দন্ডায়মান রুপোর তৈরী মহাদেব রয়েছে। মহাদেবের হস্তে ত্রিশূল ও ভিক্ষাপাত্র আছে।

তোরণের সেই বিখ্যাত সিংহের মূর্তিটি 
নাট মন্দির 

মন্দিরটির ঠিক সামনে বেশ চাকচিক্যময় একটা বড় নাটমন্দির রয়েছে। এই নাটমন্দিরে প্রবেশ করার জন্য সাতটি প্রবেশপথ রয়েছে। গোলাকৃতি উঁচু থাম নাটমন্দিরটির চারদিকে আছে। পুরো মন্দির চত্বরটি ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা  আছে।

কথিত আছে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব চারবার এই মন্দির দর্শনে এসেছিলেন। ঠাকুর শেষবার ১৮৮২ সালের উল্টোরথের দিন মাহেশের রথ দেখে ফেরার পথে  মনমোহন, লাটুবাবু, গিরীন্দ্র ও হৃদয়কে সাথে নিয়ে এই  মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে রাসমণি ঘাটে এসে নেমেছিলেন। ঠাকুরের পদধুলিমাখা চানকের এই অন্নপূর্ণা মন্দিরটি খুবই ঐতিহ্যময় স্থান।
রাসমণি ঘাট 

মন্দিরটিতে অন্নপূর্ণা পুজোর দিন বাৎসরিক পুজো খুব ঘটা করে হয়ে থাকে। এইদিন মাকে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। এই দিন কুমারীপুজোও করা হয়। অন্নপূর্ণার পুজো ছাড়াও বিপত্তারিণী, জগদ্ধার্থী  ও কালীপুজোও খুব আড়ম্বরের সাথে করা হয়ে থাকে। শিব মন্দিরগুলিতে নীলষষ্ঠী ও শিবরাত্রির দিনে পুজো হয়ে থাকে এইসব উৎসবের দিনগুলোতে ব্যারাকপুরের এই মন্দিরে  প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়।

ছয়টির তিনটি শিবমন্দির 
মন্দিরটির প্রবেশ পথে একটা বেশ বড় তোরণ আছে। তোরণটির মাথায় একটা  বড় সিংহের মূর্তি রয়েছে। এই সিংহের  মূর্তিটি নিয়ে লোকমুখে একটা গল্প চালু আছে।  সিংহ যেহেতু ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতীক ছিল, তাই তারা এই সিংহের মূর্তিটি সরিয়ে দেওয়ার জন্য সিংহের মূর্তিটি  নির্মাণের পর থেকেই মন্দির প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। মন্দির প্রশাসন এই সমস্যার সমাধানের জন্য আদালতের সাহায্য প্রার্থনা করে। দীর্ঘদিন আইনি লড়াই চলে। অবশেষে আদালত তাদের রায়ে জানায় যে "Art is art, let the art prevail"। প্রবেশপথে দেখলাম এখনো সিংহের মূর্তিটি যথাস্থানে বিরাজমান।

বাবা মহাদেব 
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের স্মৃতি বিজড়িত এই প্রতিরূপ মন্দিরটি বহুদিন  যাবৎ দর্শন করার খুব  ইচ্ছে ছিল, নানা কারনে হয়ে উঠছিলো না। গত রবিবার সব বাঁধাকে দূর করে সক্কাল সক্কাল  শিয়ালদহ স্টেশন  থেকে ব্যারাকপুরগামী ট্রেনে চেপে বসলাম। যথাসময়ে ব্যারাকপুরে পৌঁছেও গেলাম। ওখান থেকে অটো রিক্সা করে তালপুকুরে এসে নামলাম। তালপুকুর থেকে সামান্য পথ পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছলাম। এখানে এসে মন্দিরের চারপাশের পরিবেশ দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। চারদিকে লোহালক্কড়ের দোকান, চায়ের দোকান, মন্দিরটির ঠিক সামনে ছোট ছোট ঘরে বেশ কিছু পরিবার বাস করছে, দেখে মনে হলো পরিবারগুলো সবই ভিন রাজ্যের। তারা বিহারী বলে মনে হল। একজনকেও বাঙালি বলে মনে হল না। মন্দিরটিতে দর্শনাথী নেই বললেই চলে। পূজা সামগ্রী কেনার জন্য কোনো দোকানও  চোখে পড়লো না।  দক্ষিনেশ্বরের মন্দিরটির পরিবেশ মনে গেঁথে থাকায় এখানকার এই ঐতিহাসিক মন্দিটির পরিবেশ আমায় যথেষ্ট ব্যথিত করলো। অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের পরিবেশের সাথে এখানকার পরিবেশে  আসমান-জমিন ফারাক রয়েছে।  যাই  হোক এতদিনের স্বপ্ন সফল হয়েছে তাই কালবিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি মন্দিরটি দেখে নিলাম। মন্দির দর্শনের সমস্ত বিবরণ উপরে উল্লেখ করেছি। আমার মনে হয় অবস্থানগত ও পরিবেশগত কারণেই মন্দিরটির এতো ঐতিহাসিক মূল্য থাকা সত্বেও  সেইভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি।

মন্দির দর্শনের  সময় :
সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২.৩০ আর বিকেল ৪টা থেকে রাত  ৮টা পর্যন্ত।

কিভাবে যাবেন :

শ্যামবাজার থেকে ব্যারাকপুরগামী বাসে করে তালপুকুরে নামবেন। অথবা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে ব্যারাকপুর স্টেশনে নেমে অটো রিক্সা করে তালপুকুরে এসে নামতে হবে।  তালপুকুর থেকে রিক্সা বা পায়ে হেঁটে  সামান্য পথ গেলেই এই প্রতিরূপ মন্দিরটি  দেখতে পাবেন। মন্দিরটি একদম রাস্তার ধরেই অবস্থিত।

তারিখ : ১৩-০৪-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো  লাগে, তাহলে   অবশ্যই   আপনার  মূল্যবান  মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Saturday, April 6, 2019

কলকাতার সংগ্রহশালা

কলকাতার  সংগ্রহশালা

কলকাতা শহর সুপ্রাচীন এক শহর। শহরের প্রাচীন ইতিহাসের গল্প আমরা সবাই জানি।  ব্রিটিশ ভারতের উত্থান ও পতনের ইতিহাসের গল্পও আমাদের জানা আছে। রাজা - জমিদারদের তৈরী বিভিন্ন পুরাকীৰ্তির সব  অন্যন্য সংগ্রহ কলকাতার বিভিন্ন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে।  কত শত পুরাকীর্তি ও রাজা রাজরাজড়াদের ব্যৱহৃত কত সামগ্রী, কত শিল্প সব নিয়ে শহরের বুকেই গড়ে উঠেছে কত বিচিত্র সব সংগ্রহশালা। এইসব সংগ্রহশালাগুলো ভারতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের  প্রতীক হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আজ আমি এখানে কলকাতা শহরের  সংগ্রশালাগুলো সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আকারে জনাবো।

ভারতীয় জাদুঘর :
১৯১৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন।  এটি ভারতবর্ষের বৃহত্তম জাদুঘর এবং বিশ্বের প্রাচীনতম জাদুঘর হিসেবে পরিগণিত হয়। ভারত সরকার এটির পরিচালনা  করে। এটি একটি  সাংকৃতিক ও বিজ্ঞান বিষয়ক   জাদুঘর। সম্পূর্ণ সংগ্রহশালাটিকে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ১) শিল্প , ২) নৃতত্ত্ব, ৩) ভূতত্ত্ব,  ৪) পুরাতত্ত্ব, ৫) প্রাণীতত্ত্ব ও  ৬) উদ্ভিজ্জ। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রবেশমূল্য ৫০/- টাকা, পাঁচ বছরের উর্দ্ধে ২০/- টাকা আর বিদেশী পর্যটকদের জন্য ৫০০/- টাকা লাগে। ক্যামেরার জন্য আলাদা মূল্য ধার্য করা হয়।  স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য  অবশ্য কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না।  সংগ্রহশালাটি প্রতি সোমবার বন্ধ থাকে। মঙ্গলবার থেকে রবিবার সকাল ১০টা  থেকে সন্ধ্যে ৮টা  পর্যন্ত খোলা থাকে। ভারতীয় জাদুঘরটি কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলে অবস্থিত।

ঠিকানা :
 ২৭, জওহরলাল নেহেরু রোড
কলকাতা - ৭০০ ০১৬

এশিয়াটিক সোসাইটি : 
এটি কলকাতার একটি অগ্রণী গবেষণা কেন্দ্র। ১৭৮৪ সালের ১৫ই জানুয়ারী  স্যার উইলিয়াম জোন্স এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ২৬টি ভাষায় ৫০ হাজারের বেশি ম্যানারস্ক্রিপ্ট সংরক্ষিত আছে। নিজস্ব গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালায় বহু প্রাচীন পুঁথি, বইপত্র, তাম্রসনদ, মুদ্রা, ছবি ও আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিটি বিশ্বের সমজাতীয় সংস্থাগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। ১৮০৮ সালে এখানকার গ্রহাগারটিকে জনগণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। এশিয়াটিক সোসাইটিটি জওহরলাল রোড ও পার্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থলে  অবস্থিত।

ঠিকানা :
 ১ ,পার্ক স্ট্রিট
কলকাতা - ৭০০০১৬

আশুতোষ সংগ্রহশালা :
এই সংগ্রহশালাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত। এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ একটি শিল্প সংগ্রহশালা। ১৯৩৭ সালে তৈরী হয় এই সংগ্রহশালাটি। ভারতের প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত সংগ্রহশালা হল এই আশুতোষ সংগ্রহশালাটি।   এখানে বিভিন্ন যুগের শিল্পসামগ্রী সংরক্ষিত আছে।

ঠিকানা :
৮৭/১ কলেজ স্ট্রিট
কলকাতা - ৭০০ ০৭৩

বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড টেকনোলজি মিউজিয়াম :
দক্ষিণ কলকাতার গুরুসদয় রোডে অবস্থিত এই সংগ্রহশালাটি  ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞানের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ও প্রযুক্তি সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এটি চালু করা হয়। এখানকার আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয় গ্যালারিগুলো হলো অন্ধকারে বিশ্বপরিচয়, চিলড্রেন্স গ্যালারি, চিত্তাকর্ষক পদার্থবিদ্যা, পরিবহন, চালিকা শক্তি, জনপ্রিয় বিজ্ঞান, জৈবপ্রযুক্তি, ধাতু, বিদ্যুৎ, টেলিভিশন, ও গণিত।  এখানে টিকিটের বিনিময়ে দৈনিক বিজ্ঞানভিত্তিক  মজাদার  সব প্রদর্শন প্রদর্শিত হয়ে থাকে। সাধারণ দর্শকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৩০/- টাকা। সকাল ১০টা  থেকে বিকেল ৫.৩০ পর্যন্ত সংগ্রহশালাটি খোলা থাকে।

ঠিকানা :
১৯এ , গুরুসদয় রোড
কলকাতা - ৭০০ ০১৯


পুলিশ মিউজিয়াম :
কলকাতা পুলিশের ব্যৱহৃত সরঞ্জাম ও ঐতিহাসিক নানারকম দুর্লভ সামগ্রীতে ও ছবিতে  জমজমাট একটা সংগ্রহশালা। এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ব্যৱহৃত বেশ কিছু অস্ত্রসামগ্রীও সংরক্ষিত আছে। স্বাধীনতার আগে ও এখনকার কলকাতা পুলিশের ইতিহাস জানতে এখানে আসতে পারেন। এখানে ছবি তুলতে দেওয়া হয় না। এটি সকাল ১১টা  থেকে বিকেল ৫টা  পর্যন্ত সংগ্রহশালাটি খোলা থাকে। সংগ্রহশালাটি মানিকতলার কাছে অবস্থত।

ঠিকানা :
১১৩ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র স্ট্রিট
কলকাতা - ৭০০ ০০৯

ভারতীয় রেলওয়ে জাদুঘর :
এই জাদুঘরটি অবশ্য কলকাতার মধ্যে পড়ছে না, তবুও কলকাতার খুব কাছে বলে আমি এটিকে কলকাতার মধ্যেই রাখলাম। এই সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন হয় ২০০৬ সালের ৭ই এপ্রিল। ভারতীয় রেলের প্রথম থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে এখানে সংরক্ষিত করা আছে।  প্রতি সোমবার বন্ধ থাকে। অন্যান্য দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫.৩০ পর্যন্ত এটি খোলা থাকে। সংগ্রহশালাটি হাওড়া স্টেশনের পাশে অবস্থিত।

ঠিকানা :
রেল মিউজিয়াম ট্রয় ট্রেন লাইন
হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন
হাওড়া , পশ্চিমবঙ্গ - ৭১১১০১

 ভিক্টোরিয়া  মেমোরিয়াল হল :
এই হলটি যে কোনো দেশের পর্যটকের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। মহারানী ভিক্টোরিয়ার নামাঙ্কিত এই হলটি কলকাতার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সংগ্রহশালা। এখানে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বেশ কিছু দুর্লভ পুস্তক ও তৈলচিত্র সংরক্ষিত আছে। ব্রিটিশ আমলের সৈন্যদের ব্যৱহৃত কামান ও অন্যান্য সামগ্রীও সংরক্ষিত আছে। ১৯২১ সালে এই হলটি স্থাপিত হয়েছিল। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত হলটি খোলা থাকে। প্রবেশ মূল্য ভারতীয় দর্শকদের জন্য ৩০/- টাকা আর সার্ক  দেশের পর্যটকদের জন্য ১০০ টাকা, ভারতীয় ও সার্ক  দেশ ছাড়া অন্যান্য দেশের পর্যটকদের জন্য ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। সংগ্রহশালাটি পিজি হাসপাতালের বিপরীত দিকে অবস্থিত।

ঠিকানা :
১ কুইন্স ওয়ে
কলকাতা ময়দান
কলকাতা - ৭০০ ০৭১

নেতাজি ভবন :
দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে এই জাদুঘরটি অবস্থিত। ১৯৫৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।  এটি একটি স্মারক ভবন ও গবেষণা কেন্দ্র। এই ভবনের জাদুঘরে নেতাজীর পায়ের ছাপ রাখা আছে।  প্রতি সোমবার এটি বন্ধ থাকে, অন্যান্য দিন  সকাল ১১টা  থেকে বিকেল ৪.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে। সংগ্রহশালাটি নেতাজি ভবন মেট্রো স্টেশনের কাছে অবস্থিত।

ঠিকানা :
৩৮/২ লালা লাজপত রায় সরণি
ভবানীপুর, কলকাতা - ৭০০ ০২০

বোট মিউজিয়াম :
এই সংগ্রহশালাটি কলকাতা শহরে নতুন সংযোজিত একটা সংগ্রহশালা। এখানে প্রায় ৫০ রকমের নৌকো ও জাহাজের প্রতিরূপ বানিয়ে রাখা আছে। খুবই সুন্দর সংগ্রহশালাটি। এই সংগ্রহশালাটি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে কোনোরকম ছবি তুলতে দেওয়া হয় না।  প্রতি শনি ও রবিবার বন্ধ থাকে , অন্যন্য দিন সকাল ১০টা  থেকে বিকেল ৫.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে। সংগ্রহশালাটি কাঁকুড়গাছিতে অবস্থিত।

ঠিকানা :
আম্বেদকর ভবন
পি ১/৪ সি আই টি স্কিম VII (এম )
ভি আই পি রোড
কলকাতা - ৭০০ ০৫৪


নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম :
চৌরঙ্গী  রোডের  ওপর  একটা সুন্দর  তিনতলা   বাড়িতে  এই  মিউজিয়ামটি  অবস্থিত।  ১৯৭২  সালের
২৪শে  নভেম্বর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর  নামাঙ্কিত এই মিউজিয়ামটি    তদকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর  রায় উদ্বোধন করেন। প্রায় ১৩০টি দেশের পুতুল ও তিনশোর বেশি গণেশের মূর্তি  দিয়ে সাজানো এক সুন্দর সংগ্রহশালা।  বাচ্ছাদের সাথে বড়রাও  এখানে ভিড় জমান।  সোমবার ও মঙ্গলবার এটি পূর্ণদিবস বন্ধ থাকে। অন্যান্য দিন সকাল ১১টা  থেকে সন্ধ্যে ৭টা  পর্যন্ত খোলা থাকে।  ষোলো বছরের নীচে বয়স হলে ১০ টাকা আর ষোলো বছরের উর্দ্ধে  ২০ টাকা প্রবেশ মূল্য  লাগবে। সংগ্রহশালাটি এক্সইড মোড়ে অবস্থিত।

ঠিকানা :
৯৪/১ চোরঙ্গী রোড
কলকাতা - ৭০০ ০২০


জাতীয় গ্রন্থাগার :
এই গ্রন্থাগারটি ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার। এটি  দক্ষিণ কলকাতার আলিপুর অঞ্চলে চিড়িয়াখানার সামনে অবস্থিত।   প্রায় ২ কোটির ওপর বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। ৩০ হেক্টর জায়গা নিয়ে এটি তৈরী।  সোমবার থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা  থেকে রাত  ৮টা  আর শনিবার ও রবিবার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা  পর্যন্ত খোলা থাকে।

ঠিকানা :
বেলভেডিয়ার রোড
আলিপুর, কলকাতা - ৭০০ ০২৭


সাবর্ণ সংগ্রহশালা :
সাবর্ণ রায়চৌধুরীর নাম কলকাতার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।  ২০০৫ সালের ৫ই জুন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উদ্যোগে এই সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন করা হয়। এখানে অসংখ্য প্রাচীন মানচিত্র , জমিদারির দলিল দস্তাবেজ, কলকাতার সুতানুটি গোবিন্দপুরের  প্রজাস্বত্ব হস্তান্তের দুষ্প্রাপ্য দলিলের কপি রয়েছে। পরিবারের ব্যৱহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্রের সংগ্রহও আছে।  বৃহস্পতিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা  থেকে দুপুর ১২টা  আর বিকেল ৫টা  থেকে রাত  ৭টা  পর্যন্ত খোলা থাকে। সংগ্রহশালাটি বেহালার বরিশা অঞ্চলে অবস্থিত।

ঠিকানা :
সপ্তর্ষি ভবন, বড়বাড়ি
৬৭/৩ ডায়মন্ড হারবার রোড
বরিশা, কলকাতা - ৭০০ ০৩৪

জোড়াসাঁকো সংগ্রহশালা :
এই সংগ্রহশালাটি  সম্পূর্ণরূপে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত এক সংগ্রহশালা। তিনতলা বিশিষ্ট সংগ্রহশালাটি বেশ সাজানো গোছানো এক সংগ্রহশালা। এখানে রবীন্দ্রনাথের ও তার পরিবারের ব্যৱহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, অবনীন্দ্রনাথের বিভিন্ন অঙ্কন, রবীন্দ্রনাথের আঁতুরঘর, পড়ার ঘর, গান শোনার ঘর, সাহিত্য চর্চার ঘর ইত্যাদি দেখতে এখানে আসতে পাবেন।  প্রতি সোমবার এই সংগ্রহশালাটি পূর্ণদিবস বন্ধ থাকে। মঙ্গলবার থেকে রবিবার পর্যন্ত সকাল ১০.৩০ থেকে বিকেল  ৫টা  পর্যন্ত খোলা থাকে।

ঠিকানা : 
২৬৭ রবীন্দ্র সরণি, সিঙ্গিবাগান,
জোড়াসাঁকো, কলকাতা - ৭০০ ০০৭

স্মরণিকা ট্রাম  মিউজিয়াম) :
এই সংগ্রহশালাটি ২০১৪ সালে উদ্বোধন করা হয়।  এখানে পুরোনো ট্রামের টিকিট, কযেন  এক্সচেঞ্জ মেশিন, কন্ডাক্টরের পরিহিত ইউনিফর্ম ও টুপি  ইত্যাদি। সংগ্রহশালাটিটি ধর্মতলা ট্রাম ডিপোর পাশে তৈরী করা হয়েছে। দর্শনের সময় দুপুর ১টা থেকে রাত  ৮টা  পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানে ঢোকার জন্য সামান্য প্রবেশমূল্য লাগে।

ঠিকানা :
৬ সিদ্ধ কানু  ডহর, ধর্মতলা
কলকাতা - ৭০০ ০৬৯


মাদার ওয়াক্স মিউজিয়াম :
এই সংগ্রহশালাটি কলকাতার একদম কাছে নিউটাউনে অবস্থিত। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে এটির উদ্বোধন করা হয়।   ভারতবর্ষের জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্যদের  মোম  দিয়ে তৈরী  মূর্তি করে রাখা আছে। সোমবার বাদ  দিয়ে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত  ৭.৩০ পর্যন্ত এই সংগ্রহশালাটি খোলা থাকে। এখানে প্রবেশ করার জন্য মূল্য দিতে হবে তিন বছর থেকে  ১২ বছর পর্যন্ত ১৫০/- টাকা আর ১২ বছরের  উর্দ্ধে ২৫০/- টাকা লাগে।

ঠিকানা : 
ফিনান্স সেন্টার, ৫ & ৬ তল
অ্যাকশন এরিয়া ২, সিবিডি ১
নিউ টাউন , কলকাতা - ৭০০ ১৫৬

মৌলানা আবুল কালাম মিউজিয়াম :
দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে ভারতরত্ন মৌলনা আবুল কালাম আজাদের বসতবাড়িটিই বর্তমানে মিউজিয়াম তৈরী করা হয়েছে। এখানে ওনার ব্যৱহৃত চশমা, লাঠি, জামাকাপড় ও নানারকম ছবি সরক্ষিত করা আছে।  ভারতরত্ন-এর  রেপ্লিকাও এখানে রাখা আছে।  এই মিউজিয়ামে প্রবেশ করার জন্য কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না।

ঠিকানা :
৫ লাভলক প্লেস
কলকাতা - ৭০০ ০১৯

গুরুসদয় মিউজিয়াম :
এই  সংগ্রহশালাটি বেহালার জোকা  অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে স্যার গুরুসদয় দত্তর সারাজীবনের সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে সাজানো। এটি ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের সংগ্রহশালা। এখানে সুক্ষ হস্তশিল্প, পোড়ামাটির প্যানেল, কথার কাজ, কালীঘাটের পটচিত্র সংরক্ষিত আছে। সোমবার বাদে প্রতিদিন সকাল ১১তা থেকে বিকেল ৫তা পর্যন্ত খোলা থাকে। ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৫ টাকা, ভারতীয়দের জন্য ১০ টাকা  আর বিদেশিদের জন্য ৫০ টাকা প্রবেশ মূল্য লাগে।

ঠিকানা :
ব্রতচারী গ্রাম,
পি৬  ডায়মন্ড হারবার রোড
ডায়মন্ড পার্ক , জোকা
কলকাতা - ৭০০ ১০৪

একাডেমি অফ ইন্ডিয়ান কয়েন্স এন্ড হিস্ট্রি :
১৯৯৭ সালে এটি তৈরী করা হয়।  একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা ও ইতিহাস নিয়ে কাজ করে, তারাই  এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তারাই এটি পরিচালনা করে।  যে কোনো কাজের দিন বেলা ১২টা থেকে  সন্ধ্যে ৬টা  পর্যন্ত এটি খোলা থাকে।

ঠিকানা :
৩৬২/বি রবীন্দ্র সরণি
কলকাতা

ফ্যানাটিক স্পোর্টস মিউজিয়াম:
এ যেন এক ছাদের তলায় এক টুকরো খেলার পৃথিবী। প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক রোবিয়া মজুমদার ও হর্ষ নেওটিয়ার  যৌথ উদ্যোগে প্রায় সাত হাজার বর্গফুট এলাকা নিয়ে এই সংগ্রহশালাটি তৈরী করা হয়েছে।  এখানে সচিন টেন্ডুলকারের ১০০ তম সেঞ্চুরি করার ব্যাট যেমন আছে তেমন অন্যান্য সব ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের নানারকম ক্রীড়া সরঞ্জাম সংগ্রহ করে রাখা আছে।  এটা কলকাতার মুকুটে নবতম পালক। এখানে প্রবেশ করার জন্য সাধারনদের জন্য ১০০ টাকা আর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৫০ টাকা প্রবেশ মূল্য লাগে।

ঠিকানা :
রাজারহাট , কলকাতা


জাদুঘর বা সংগ্রহশালা হলো একটি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংরক্ষিত আবাসস্থল। এইসব ঐতিহ্যকে  যথাযথভাবে  সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা খুবই জরুরি। নতুন প্রজন্মকে দেশের ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানানো খুবই প্রয়োজন। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানার জন্য নতুন প্রজন্মের সাথে সবারই  এইসব জাদুঘর বা সংগ্রহশালা দেখা  উচিত।

তারিখ : ০৬-০৪-২০১৯
ছবি ও লেখার স্বত্ত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি যদি আপনার ভালো  লাগে, তাহলে  অবশ্যই   আপনার  মূল্যবান  মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।