Thursday, September 30, 2021

বাঁকুড়ার বীট পরিবারের দুর্গাপূজা >P

সোনামুখীর বিট পরিবারের দুর্গাপূজা 



-  সুদীপ্ত মুখার্জী  




বাঁকুড়া হল পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা। প্রাচীন যুগে বাঁকুড়া জেলা  ছিল রাঢ় অঞ্চলের অধীনস্ত। বাঁকুড়া জেলা ও এর আশপাশের অঞ্চলগুলো এককালে মল্লরাজত্বের কেন্দ্রভূমি ছিল। খিষ্ট্রীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের  সূচনাকাল পর্যন্ত যাঁরা এখানে রাজত্ব করে গেছেন তাঁরা "মল্লরাজ" নামে খ্যাত ছিল। 

এই বাঁকুড়া জেলারই একটি ছোট্ট গ্রাম হলো সোনামুখী গ্রাম। গ্রাম্য দেবী স্বর্ণময়ী দেবীর নামানুসারে গ্রামটির  নামকরণ হয় সোনামুখী।   এই গ্রামে প্রায়  ২০০ বছরেরও  বেশি সময়  ধরে বসবাস করে বীট পরিবার। তাঁদের এই পারিবারিক পূজাটিও প্রায় দ্বিশতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। ১২৩৩ বঙ্গাব্দে বীট পরিবারের সন্তান স্বর্গীয় শত্রুঘ্ন বীট মহাশয় স্বইচ্ছায় তাঁদের পরিবারে দুর্গাপূজা শুরু করেন। গতবছর এই পারিবারিক পূজাটি ১৯৫ বছরে পদার্পন করেছে।  বীট পরিবারের বসতবাড়ির অনতিদূরে দে পরিবারের বাসভূমির নিকট  রয়েছে একটি সুপ্রাচীন দুর্গামন্দির। বীট ও দে এই দুই  পরিবার আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ। স্বর্গীয় শত্রুঘ্ন বীট মহাশয়ের প্রপৌত্রগণের পরিবারের  মিলিত উদ্যোগে  আজও  পূজাটি বেশ আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  

 প্রতিমা এই দূর্গা মন্দিরেই  নির্মাণ করা হয়।  একচালা সাবেকি প্রতিমায় পূজা করা হয়।  মা দূর্গা ও লক্ষ্মী অতসী বর্ণের হয়।  পরিবারের দেবত্ব করা  জমিতে ধান চাষ করা হয়।  সেই ধানের খড়  ও মাটি দিয়ে দেবী মূর্তি নির্মাণ করা হয়।  এখানে কোনোপ্রকার বাইরের খড় ও মাটি  দেবী মূর্তি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়না। 

 রথযাত্রার দিন কাঠামো পূজা করা হয়। বোধন শুরু হয় পূজার দিন ১৫ পূর্বে আদ্রানক্ষত্র  সংযুক্ত অশ্বিন মাসের  কৃষ্ণানবমী তিথিতে। মূল পূজা শুরু হয় ষষ্ঠীর দিন থেকে।  ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পরিবারের কেউ তাদের পায়ে কোনোপ্রকার জুতো ব্যবহার করেন না। এই কটাদিন পরিবারের যে যেখানেই থাকুক তারা খালি পায়ে থাকে। এটাই পরিবারের রীতি। এই রীতিটি  প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। 
 
 


সপ্তমীর দিন নিকটবর্তী দশের পুকুরে নবপত্রিকা স্নান করানো হয়। স্নান করানোর পর  নবপত্রিকাকে সেগুন কাঠের পালকিতে চড়িয়ে  মূল মন্দিরে নিয়ে আসা হয়।  এই দিন গৃহলক্ষ্মীকে শোভাযাত্রা সহকারে বাড়ির মহিলারা বাসগৃহ থেকে দূর্গা মন্দিরে নিয়ে আসেন। পূজার কটাদিন গৃহদেবী  মন্দিরে অবস্থান করেন। দশমীর দিন নবপত্রিকাকে বিসর্জন দেওয়ার পূর্বে গৃহদেবী লক্ষ্মীকে পুনরায়  বাসগৃহে ফিরিয়ে নিয়ে আসা  হয়। 

অষ্টমীর দিন সকালবেলা পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এই দিন বাড়ির এয়োস্ত্রীরা পূজারী ব্রাহ্মণের  স্ত্রীকে আলতা পরিয়ে বস্ত্রদান করেন এবং তাঁকে জল-মিষ্টি খাওয়ানো হয়।  তারপর পরিবারের সবাই ওনার  আশীর্বাদ গ্রহণ করেন।  পূজার কটাদিন পরিবারের সবাই সম্পূর্ণ নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন।  সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর দিন চালকুমড়া বলি দেওয়া হয়।  

একসময় বিষ্ণুপুরের দলমাদল কামানের আওয়াজ শোনার পর এখানে সন্ধিপূজা শুরু হতো, যদিও সে প্রথা আজ বিলুপ্ত।  তবে আজও  অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে 'খ্যান' উৎসব এখানে অনুষ্ঠিত হয়।  বলি দেওয়ার পর দুভাগ করা চালকুমড়োটি, তরবারি, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে বেশ কয়েকজন মিলে সোনামুখী থানায় দৌঁড়ে নিয়ে যায়। এই প্রথা কম বেশি অঞ্চলের সকল পূজা কমিটিই অনুসরণ করে।  থানা থেকে তাদের তরবারিটিকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়।  তারপর ওই তরবারি নিয়ে তারা পুনরায় দূর্গা মন্দিরে ফিরে  আসে।  তারা ফিরে  আসার পর মন্দিরে দেবীর আরতি  শুরু হয়। 
 
নবমীর দিন হোমযজ্ঞ করা হয়। এই  দিন সোনামুখী গ্রামের গ্রাম্য দেবী স্বর্ণময়ী  মাতার মন্দিরে বিশেষ পূজার উদ্দেশ্যে সবাই উপস্থিত হয়। শুধু এই বাড়ি নয় সোনামুখী গ্রামের প্রত্যেকটা পূজা মণ্ডপ থেকে এই দিন স্বর্ণময়ী  দেবীর মন্দিরে বিশেষ পূজার  উদ্দেশ্যে আসে।
  
দশমীর দিন সকালে নবপত্রিকা গ্রামের দশের পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। পূজার দিনগুলোতে পরিবারের সবাই নিরামিষ আহার গ্রহণ করলেও দশমীর দিন মাছ, শাক ও পায়েস খাওয়ার পর দেবীকে প্রথমে বরণ করা হয় তারপর সিঁদুর খেলা হয়।  অপরাজিত পূজা করার নিয়ম রয়েছে।  বাড়ির সকল সদস্য এই দিন অপরাজিতার মালা বাহুতে ধারণ করেন। সন্ধ্যাবেলা দেবী মৃন্ময়ীকে গ্রামের দশের  পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়।  





পূজার কটাদিন দেবীকে বিভিন্ন ফল, মিষ্টি ও বিভিন্ন প্রকার নাড়ু, খাজা, গজা ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।  অষ্টমীর দিন লুচি ভোগ নিবেদন করা হয়।  এখানে দেবীকে কোনো প্রকার অন্নভোগ দেওয়ার নিয়ম নেই।  

কর্মসূত্রে  বা বৈবাহিক সূত্রে দূর দূরান্তে থাকা পরিবারের সদস্যরা এবং আত্মীয়-স্বজনেরা  এইসময়  সকলেই পূজা প্রাঙ্গনে এসে মিলিত হয়।  পূজার কটাদিন পূজা প্রাঙ্গনটি হয়ে ওঠে পারিবারিক মিলন উৎসব। এ যেন সারা বছরের অপেক্ষার অবসানের মহামিলন উৎসব।  



ছবি সৌজন্যে : সৌভিক বীট ও নিলয়া  দে 



 তারিখ : ০১-১০-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Saturday, September 25, 2021

ভবানীপুর মল্লিক বাড়ির পূজা >P

ভবানীপুর মল্লিক বাড়ির পূজা 


- সুদীপ্ত মুখার্জী 






দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত অঞ্চলের নাম ভবানীপুর।  এককালে বর্ধিষ্ণু বাঙালির বাস ছিল এই অঞ্চলে,  তবে বর্তমানে অঞ্চলটি সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। অঞ্চলটিতে রয়েছে বাঙালির সাথে বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন মানুষের সহাবস্থান। এই অঞ্চলেই একটা ছোট্ট গলিপথ রয়েছে। মোহিনী মোহন রোড। সেই গলিপথে বসবাস করে অঞ্চলের একটি প্রসিদ্ধ পরিবার। মল্লিক পরিবার। কলকাতার পারিবারিক  দুর্গাপুজোর ইতিহাসে এই ছোট্ট গলিটার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই পরিবারের পূজা এবছর ৯৬ বছরে পদার্পন করবে।




১৯২৫ সালে মল্লিক পরিবারের  সন্তান রাধামাধব মল্লিক বর্ধমান জেলার গুপ্তিপাড়া থেকে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছিলেন বর্ধমানের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। ইকমিক কুকারের আবিষ্কর্তা ইন্দুমাধব মল্লিক এই পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁরা  তিন ভাই ছিলেন। ইন্দুমাধব, প্রিয়মাধব ও সুরেন্দ্র।  সুরেন্দ্র  ২৫ মোহিনী মোহন রোডে  বাড়িটিতে  একটি চণ্ডী মণ্ডপ তৈরী করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে সুরেন্দ্র নির্মিত চণ্ডীমণ্ডপটি ঠাকুর দালান বিশেষ ছিল।  এই ঠাকুর দালানে প্রথমে দূর্গা নয় দেবী অন্নপূর্ণার পূজা করা হয়েছিল।  পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র ও পরিবারের অন্যান্যদের উদ্যোগে ঠাকুরদালানে দেবী দুর্গার আহ্বান করা হয়। সেই থেকে আজও পারিবারিক নিয়ম নীতি মেনে পূজাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।  তাঁরা কখনই পরিবর্তনের স্রোতে গা না ভাসিয়ে নিজেদের একটা  স্বতন্ত্র বজায় রেখে এগিয়ে চলেছেন। 

এঁনারা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত।  ঠাকুরদালানেই দেবী প্রতিমা নির্মিতি হয়।  জন্মাষ্ঠমীর দিন কাঠামো পূজা করা হয়। পরিবারের কুলদেবতা শ্রীধর নারায়ণ। সাবেকি একচালা বাংলা শৈলীর মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। ডাকের সাজে দেবীকে সজ্জিত করা হয়। এছাড়া আলাদা করে দেবীকে সোনা ও রুপার গহনা পড়ানো হয়।  দেবীর বাহন সিংহ আধুনিক রূপের।  প্রতিপদাদিকল্প অনুসারে পূজা হয়, তাই মহালয়ার পরের দিন থেকে আরম্ভ হয় বোধন।  মহালয়ার পরবর্তী প্রতিপদ থেকে চণ্ডীর পূজা শুরু হয়। বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে এখানে পূজা করা হয়। ষষ্ঠীর দিন শুরু হয় দেবী দুর্গার বোধন।  এই দিন থেকেই পরিবারের সদস্যদের পারিবারিক আড্ডা চলতে থাকে। ঠাকুর দালান সরগরম হয়ে ওঠে।  ফল-ফুল ও মন্ত্রে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে সমগ্র ঠাকুরদালানটি। প্রতিদিন নতুন ফুলের মালা ও রুপোর ১০৮টি পদ্মমালায় দেবীকে সুসজ্জিত করে তোলা হয়। কুলদেবতা শ্রীধর নারায়ণকে দেবীর পাশে বসানো হয়।  সপ্তমীতে কলাবৌ স্নান, অষ্টমীতে কুমারীপূজা, পুষ্পাঞ্জলি ও নবমীতে হোম যজ্ঞ সবটাই  বৈষ্ণব মতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  




এখানে দেবীকে কোনোরূপ অন্নভোগ দেওয়ার নিয়ম নেই। তার পরিবর্তে তাঁরা লুচি, নানারকম তরকারি, চাটনি, নানারকম ফল ও মিষ্টি ভোগ হিসেবে দেবীকে নিবেদন করে থাকেন।  পূজার সবকটা দিনই দেবীকে নৈবেদ্য দেওয়ার প্রথা রয়েছে। 

এই বাড়িরই সন্তান বিশিষ্ট অভিনেতা শ্রী রণজিৎ মল্লিক ও তাঁর কন্যা অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিক।  তাঁরা  পূজার কটাদিন সারাক্ষণই ঠাকুর দালানে উপস্থিত থাকেন। পরিবারের গৃহবঁধূ বিখ্যাত গায়িকা প্রমিতা মল্লিক।  পূজার কটাদিন যেমন বিশ্বের  বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত থাকেন তেমন এই কটাদিন বিনোদন জগতের বহু তারকাকেই উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।  এককালে দশমীর দিন বিসর্জনের বিদায়ী সুরের সাথে ঠাকুরদালানে গান, নাটক ইত্যাদি পরিবারের সদস্যদের  দ্বারা অনুষ্ঠিত হতো। পূজার বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকে নাটকের মহড়া চলতো।  বর্তমানে তা আর অনুষ্ঠিত হয় না।  

এঁনারা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত বলে পূজার কটা দিন নিরামিষ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। দেবী বিসর্জনের পর আমিষ খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সব পদই  মল্লিক পরিবারের হেঁশেলে রান্না করা হয়।  দশমীর দিন দেবীকে ভবানীপুরের আদি গঙ্গার বলরাম বোস রোড ঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয়। শহর কলকাতার বনেদি বাড়ির পূজাগুলোর মধ্যে ধীরে ধীরে দক্ষিণ কলকাতার মোহিনী মোহন রোডের মল্লিক পরিবারের পূজাটি বিশিষ্ঠ  স্থান  অর্জন করে চলেছে।

ছবি : লেখক   

তারিখ : ২৫-০৯-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 





Thursday, September 23, 2021

হাওড়ার বসু পরিবারের পূজা >P

হাওড়ার বসু পরিবারের পূজা 



- সুদীপ্ত মুখার্জী 





হাওড়া-কলকাতা যমজ শহর হিসেবে পরিচিত। কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর। হাওড়া কলকাতার মত  বড় না হলেও অত্যন্ত জনবহুল শহর। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য  জায়গার মতো এখানেও  ধর্মীয় ও সংস্কৃতি চর্চা সুপ্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে।  ধর্মীয় ও  সামাজিক উৎসবগুলোর মধ্যে দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, রথযাত্রা, দোলযাত্রা, পৌষপার্বণ  ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলো বেশ মহাসমারোহে পালিত হয়। হাওড়া ময়দানের  কাছেই শিবপুরে অবস্থিত 'রামকৃষ্ণপুর' বলে একটা খুবই প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু অঞ্চল রয়েছে।  এই অঞ্চলেই বসবাস করে পশ্চিমবঙ্গের একটা সুপরিচিত ও শিক্ষিত পরিবার। বসু পরিবার।  

এই পরিবারের কৃতি সন্তান হলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ নিমাই সাধন বসু।  এছাড়া বংশের সন্তান স্বপন সাধন ( টুটু ) বসুর নাম ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র সৃঞ্জয় বসুর নাম  সকলের কাছে সুপরিচিত। পরিবারটি প্রথমে হাওড়ার আমতার কাছে  সিংটি গ্রামে বসবাস করতেন। পূর্বে সেখানেই  পরিবারের দুর্গাপূজাটি শুরু হয়েছিল।  সেখান থেকে হাওড়ার  রামকৃষ্ণপুর অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন  ঈশানচন্দ্র বসু। সালটা ১৮৪০।  ওই বছর তিনি এখানে তাঁদের পারিবারিক দুর্গাপূজাকে নিয়ে আসেন। সেই থেকে পূজাটি  এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। পারিবারিক পূজাটি বর্তমানে পঞ্চম প্রজন্মের হাতে রয়েছে। এখন  পরিবারের সদস্য শ্রী গৌতম মোহন বসু পূজাটির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।  তিনি জানালেন তাঁদের পারিবারিক পূজাটি  আজও  সেই পুরাতন ঐতিহ্য ও পরম্পরা বজায় রেখে খুবই নিষ্ঠার সাথে করা হয়ে থাকে। এবছরও তাঁরা তাঁদের সেই পুরাতন পারিবারিক রীতি-নীতি বজায় রেখেই পূজা করবেন তবে অবশ্যই করোনার সরকারি বিধি নিষেধ তাঁরা মেনে চলবেন।   

পূজাটি প্রতি বছর বসু বাড়ির ঠাকুরদালানে অনুষ্ঠিত হয়। জন্মাষ্ঠমীর পরদিন নন্দোৎসবের দিন কাঠামো পূজা অনুষ্ঠিত হয়।  সেই দিন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে দেবী মূর্তি গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এখানকার  দেবী একচালা সাবেক  মূর্তিকে  ডাকের সাজে সজ্জিত করা হয়।  তবে সিংহের গাত্রবর্ণ কিন্তু রুপোলি হয়।  বাজারের কেনা চালচিত্র এখানে ব্যবহার করা হয়না। তার পরিবর্তে কোনো শিল্পীকে দিয়ে চালচিত্র আঁকিয়ে নেওয়া হয়। মায়ের হাতের সব অস্ত্রই সম্পূর্ণ রুপার নির্মিত। এখানকার  পূজাটিতে এককালে পশুবলি দেওয়ার নিয়ম ছিল। ১৯৪০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা পূজায় পশুবলি বন্ধ করে দেন।  তার বদলে কুমড়ো ইত্যাদি বলি শুরু হয়। এনাদের পুজোয় নবমীর দিন খুব ঘটা করে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে শাক্ত মতে পূজা করা হয়। দেবীর ভোগে সাধারণত থাকে  নানারকম ফল, নারকেল নাড়ু, বহু রকম মিষ্টি  ইত্যাদি।  পূজার সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা নিয়ম করে ঠাকুরদালানে উপস্থিত হন। ঠাকুরদালানে  চলে তাঁদের আড্ডা ও হৈচৈ।

দশমীর দিন দেবীকে গঙ্গার নিকটবর্তী  ঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয়। দেবী মূর্তি বিসর্জনের পর সেই কাঠামো তুলে আনা হয়।  যত্ন সহকারে সেটা পরের বছর প্রতিমা নির্মাণের জন্য তুলে রাখা হয়।  

ছবি : শ্রী গৌতম মোহন বসুর  সৌজন্যে প্রাপ্ত 

তারিখ : ২৩-০৯-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Monday, September 13, 2021

শান্তিপুর বড়ো গোস্বামী বাড়ির দুর্গাপূজা >P

শান্তিপুর বড়ো গোস্বামী বাড়ির  দুর্গাপূজা 

- সুদীপ্ত মুখার্জী






নদীয়া জেলার একটা বর্ধিষ্ণু মফস্বল শহর হল ভাগীরথী তীরবর্তী শান্তিপুর। প্রাচীনকাল থেকেই শান্তিপুর শহরে নানা সময় নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করেছেন। তাঁরা নানারূপ  ধর্মচর্চার নিদর্শন রেখে গেছেন। এই জনপদের আনাচে কানাচে কান পাতলেই নানারকম কাহিনী শোনা যায়।  এখানকার  রাস, ভাঙারাসের শোভাযাত্রা, বাবলার সপ্তম দোল, দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা প্রভৃতির খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে।  শান্তিপুরের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের কথা উঠলেই যে পরিবারের নাম সবার আগে উচ্চারিত হয় তা হল বড়ো গোস্বামী বাড়ি। এই বাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। শান্তিপুরের বিভিন্ন বনেদি বাড়িগুলোতে দেবী দুর্গার আহবান করা হলেও এখানকার অর্থাৎ বড়ো গোস্বামী বাড়িতে কিন্তু মা দুর্গার ভিন্নরূপ দেবী কাত্যায়নী পূজা করা হয়।  এই পূজা করার পিছনে অবশ্য একটা কাহিনীর কথা শোনা যায়।  



শান্তিপুরের প্রতিটি ধূলিকণা যার লীলার সাক্ষী তিনি হলেন শ্রী অদ্বৈত্য আচার্য্য।  তাঁর পুত্র বলরাম মিশ্রের পুত্র হলেন রাঘবেন্দ্র গোস্বামী। এই রাঘবেন্দ্র গোস্বামীর হাত ধরেই সূচনা হয়েছিল বড়ো গোস্বামী বাড়ির। 


দেবী কাত্যায়নী মন্দির 



ভারতবর্ষে তখন মুঘল শাসন চলছে, রাজা মানসিংহের আক্রমণ ও অত্যাচারে সবাই ভয়ে জর্জরিত। সেই সময় অধুনা বাংলাদেশের যশোরের ক্ষত্রিয় রাজা বসন্ত রায় মধুরেশ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা নেন।  রাজা বসন্ত রায় ছিলেন বারো ভূঁইয়াদের একজন। রাজা কালা পাহাড়ের মন্দির ও শ্রীবিগ্রহ ধ্বংস  যজ্ঞে আতঙ্কিত হয়ে তিনি  দোলগোবিন্দের বিগ্রহটিকে পুরী থেকে যশোরে নিয়ে আসেন। দোলগোবিন্দকে তিনি তাঁর গৃহদেবতা হিসেবে বেশ কিছুদিন পূজা করেন। তিনি তাঁর  বিগ্রহের রক্ষনাবেক্ষন ও সেবায় ত্রুটির আশঙ্কায়  এই দোলগোবিন্দের বিগ্রহটিকে তাঁর গুরুদেব শ্রী মথুরেশ গোস্বামীর হাতে অর্পণ করেন।  মথুরেশ গোস্বামী যশোর থেকে পদব্রজে দোলগোবিন্দ বিগ্রহসহ শান্তিপুরে আসেন এবং তা বড়ো গোস্বামী বাড়ির মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিগ্রহটির নতুন নামকরণ করেন "শ্রী শ্রী রাধারমণ  জিউ"।  এই রাধারমণকে নিয়ে পরিবারের সকলে বেশ আনন্দে দিন কাটাচ্ছিল।  পূজা ও তাঁর সেবায় তারা সারাক্ষন ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু একদিন হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল। পরিবারের মন্দির থেকে শ্রী শ্রী রাধারমণের বিগ্রহটি উধাও হয়ে গেল। ঘটনায়  বাড়ির পুরুষ ও মহিলাদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সবাই খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লো।  অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর প্রভুদের মাথায় এল যে পূর্বে একবার শ্রীধাম বৃন্দাবনে গোপীরা 'দেবী কাত্যায়নীর ব্রত' পালন করে লীলাপুরুষোত্তমকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তারা শ্রী শ্রী রাধারমণ জিউয়ের বিগ্রহটিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তৎকালীন প্রভুদের স্ত্রীরা দেবী কাত্যায়নীর ব্রত করা শুরু করেন। মায়ের নিকট তাঁরা হত্যে থেকে তৃতীয় রাত্রে তাঁদের কোনো একজন স্বপ্নাদৃষ্ট  হলেন যে নিকটবর্তী দিগনগরের একটি জলাশয় তাঁদের ইষ্টদেবতা শ্রী শ্রী রাধারমণ নিমজ্জিত রয়েছে। তারা ওই জলাশয় গিয়ে তাদের ইষ্টদেবতাকে নিয়ে আসে এবং তাঁকে মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।  সেই থেকে বাড়ির মন্দিরে দুর্গাপূজার সময় 'দেবী কাত্যায়নী' পূজা শুরু হয়।  দেখতে দেখতে যা আজ  ৪৫০ বছর অতিক্রম করে গেছে। 



পূজার কটাদিন প্রত্যহ দেবীকে ৩৬ রকমের ব্যঞ্জন দিয়ে রাজসিক প্রসাদ নিবেদন করা হয়। মা শ্বেত  অশ্বাকৃতি ঘোড়ার উপর অধিষ্ঠাত্রী।  মায়ের দশটি হাতের দুটি  হাত বড় আর বাদবাকি আটটি হাত কলার ছড়ার ন্যায় ছোট হয়।  কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী ও লক্ষ্মী থাকেন বিপরীত দিকে অর্থাৎ দেবীর ডানদিকে কার্তিক ও লক্ষ্মী আর বামদিকে গণেশ ও সরস্বতী থাকেন। দেবীর হাতে ত্রিশূল থাকে। মায়ের মৃন্ময়ী মুখটি মহামায়ার আদিরূপ। সম্পূর্ণ বৈষ্ণবীয় রীতিতে বড়ো গোস্বামী বাড়ির নির্দিষ্ট পুঁথি অনুযায়ী দেবী কাত্যায়নীর পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকে। দেবীপক্ষের প্রথম দিন থেকেই চন্ডীপাঠ ও  দেবীর বোধন শুরু হয়। দশমীর দিন সকাল নয়টার মধ্যে দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় পরিবারের ইষ্টদেবতা শ্রী শ্রী রাধারমণের  নিত্য ভোগ রান্না।
 
দেবী কাত্যায়নী মাতার বিসর্জনের দিন প্রথা অনুযায়ী রাস উৎসবের শুভ সূচনা করা হয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী মানুষের বিশ্বাস দেবী কাত্যায়নী মাতা রাস  উৎসবের শুভ সূচনা করে যান।  এককালে এই পূজায় বেশ বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হত, আজ সাড়ে চার শতবর্ষ অতিক্রম করেও তারা তাদের ঐতিহ্যকে যতটা সম্ভব ধরে রেখেছে।   



তারিখ :১২-০৯-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 





Wednesday, September 8, 2021

পান্তাভোগে মাতৃবিদায় >P

পান্তাভোগে মাতৃবিদায়   


- সুদীপ্ত মুখার্জী 






নদীয়া জেলার শান্তিপুর একটি প্রাচীন জনপদ। মহাপুরুষ চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু  শ্রী অদ্বৈত্য আচার্য্যের সাধনভূমি হল শান্তিপুর।  এখানে  প্রায় ছয় হাজার বছরের  প্রাচীন জনপদ বলে অনুমান করা হয়। এখানকার বহু বিখ্যাত ব্যাক্তি বিশ্বের দরবারে শান্তিপুরের নাম  উজ্জ্বল করে গেছেন।  সুপ্রাচীন এই জনপদে বেশ কিছু বনেদি পরিবার রয়েছে। সেই সব পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা লোকের মুখে মুখে আজও ফেরে। সেইসব প্রাচীন ঐতিহ্যের গরিমা নিয়ে ভগ্নপ্রায় বাড়িগুলো আজও  মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। 




 
এই প্রাচীন জনপদে বহুকাল ধরে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের  খুব ঐতিহ্যপূর্ণ একটা পরিবার বসবাস করে। মৈত্র পরিবার।  এই পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল নদীয়া জেলার ধুবুলিয়ার বেলপুকুর গ্রামে।  বংশের পুত্র রজনীকান্ত মৈত্র সর্বপ্রথম নদীয়া জেলার শান্তিপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনিই এখানে তাঁদের বসত বাড়ি নির্মাণ করেন ও পারিবারিক দুর্গাপূজাটি শুরু করেন। পূজাটি এবছর ১২৬ বছরে পড়ল। মৈত্র বংশের পুত্র লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত, আইনজ্ঞ, বিশিষ্ট সাংসদ। ১৯৪৮ সালে  অস্থায়ী পার্লামেন্ট গঠন হলে তিনি ডঃ আম্বেদকারের নেতৃত্বে গঠিত ভারতীয় সংবিধান কমিটির সদস্য হন। তিনি ছিলেন রজনীকান্ত মৈত্রের পুত্র। লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র ও হিরণবালা দেবীর একমাত্র পুত্র হলেন কাশীকান্ত মৈত্র। পিতার মত তাঁর কর্মজীবনও ছিলো বর্ণময়। তিনি ছিলেন আইনজ্ঞ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী। বিশিষ্ট বাগ্মী কাশীকান্ত ছিলেন মানবিক মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। তিনি একজন মননশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার সুব্রত মৈত্র।  

পূজাটি ১৮৯৫ সালে শুরু হয়েছিল।  একচালা শোলার সাজে প্রতিমাকে সজ্জিত করা হয়।  রথের দিন কাঠামো পূজা করা হয় আর জন্মাষ্ঠমীর দিন কাঠামোর গায়ে মাটির প্রলেপ পড়ে।  দেবীর গাত্রবর্ণ অতসী ফুলের রঙে রাঙানো হয়।  দেবীর রূপ  মহিষমর্দিনী। পূজাটি ভদ্রাসনের  ঠাকুর দালানে করা হয়। ঠাকুরদালানের ঠিক পাশে রয়েছে বোধনতলা। এই বোধনতলাতে একটা প্রায় ১৩০ বছর বয়সী বেলগাছ রয়েছে। সেই বেলগাছের তলায় দেবীর বোধন হয়। এনাদের ভদ্রাসনের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে পরিবারের গৃহদেবতা কাশীনাথের মন্দির।  দেবীপুরাণ মতে এখানে দেবী পূজা করা হয়ে থাকে।  পূজার কটাদিন প্রত্যহ সকালে প্রথমে বোধনতলায় পূজা করা হয়, তারপর ঠাকুর দালানে মূল দেবীর পূজা শুরু হয়। পূজার সময় গৃহদেবতা কাশীনাথকে ঠাকুরদালানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়। পূজার কটাদিন দেবীর সামনে কাশীনাথকে বসিয়ে দেবীর পূজা করা হয়। দশমীর দিন দেবীর দর্পণে ভাসান হওয়ার পর আবার তাঁকে তাঁর মন্দিরে ফেরত দিয়ে আসা হয়।  দ্বাদশীর দিন আবার গৃহদেবতা কাশীনাথকে ঠাকুর দালানে আমন্ত্রণ করা হয়।  তাঁকে ঠাকুর দালানে বসিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয় এবং বেশ ঘটা করে পূজা করা হয়।  পূজা সাঙ্গ  হলে আবার তাঁকে তাঁর নির্দিষ্ট মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত  করা হয়।   

সপ্তমী ও অষ্টমীতে দেবীকে সাদাভাত, পোলাও, মুগের ডালের খিচুড়ি, শুক্ত, নানারকম তরকারি ও ভাজা দেওয়া হয়।  নবমীর দিন অন্যান্য দিনের মত ভোগ হিসেবে সবকিছু থাকলেও এইদিন বিশেষ পদ হিসেবে কচু শাক, চালতার চাটনি দেবীকে নিবেদন করা হয়।  দশমীর দিন নৈবেদ্যের সাথে পান্তা ভোগ দিয়ে দেবীকে বিদায় জানানো হয়। প্রতিমা নিকটবর্তী খালে বিসর্জন করা হয়। এককালে এই পারিবারিক পূজাটি খুবই আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হত। বর্তমানে তার জৌলুস অনেকটা কমে গেছে। কালের স্রোতে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও এখানকার ঐতিহ্যপূর্ণ পূজাটি আজও যতটা সম্ভব তার গরিমা বজায় রেখে চলেছে।  


তারিখ : ০৮-০৯-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Wednesday, September 1, 2021

তিলোত্তমার প্রথম দুর্গাপূজা >p

তিলোত্তমার প্রথম দুর্গাপূজা 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 




কলকাতার ইতিহাস রাজা, জমিদার, বিত্তবান, ধনী-বণিকদের ইতিহাস। এদের সাথেই মিশে রয়েছে বহু বনেদি পরিবারের নিষ্ঠা, শ্রম, বুদ্ধি, অধ্যাবসাযের কাহিনী। কলকাতা শুধু জোব চার্ণকের কলকাতা নয়। এই তিলোত্তমা গড়ার ইতিহাসে ইংরেজদের পাশাপাশি বহু বনেদি পরিবারের অবদান সমানভাবে রয়েছে।  তিলোত্তমার ইতিহাস যত প্রাচীন, ততই প্রাচীন এই তিলোত্তমার দুর্গাপূজা। 

দুর্গাপূজা বাঙালিদের প্রধান উৎসব। বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো নিয়ে বহুরকম তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তা নিয়ে বহু নিউজপ্রিন্ট খরচও  হয়েছে। কিন্তু শহর কলকাতার প্রথম দুর্গাপূজা নিয়ে কোথাও কোনোরূপ তর্কের স্থান নেই। যা সাবর্ণ গোত্রীয়  লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর পত্নী ভগবতী দেবীর  হাত ধরেই শুরু হয়েছিল তাঁদের আটচালা ঠাকুর দালানে। সালটা ১৬১০। এই আটচালা ঠাকুরদালানটি বেহালা অঞ্চলের বড়িশায় অবস্থিত। এই পূজাটি ছিল তাদের পারিবারিক পূজা।  পূজাটি আজও মহা আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তিলোত্তমার ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই যে সেখানে সাবর্ণ চৌধুরীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৬০৮ সালে লক্ষ্মীকান্ত বাবু মহারাজা মানসিংহের কাছ থেকে আটখানি পরগণা (উত্তরে হালিশহর থেকে দক্ষিণে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত বিস্তৃত) জমিদারি পান। এছাড়া মহারাজা মানসিংহের সুপারিশে মুঘল দরবার থেকে মজুমদার ও রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন।  সেই থেকে এই পরিবার সাবর্ণ  রায়চৌধুরী পরিবার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।  

লক্ষীকান্ত মজুমদার আটচালার চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করে দুর্গাপূজা আরাধনা শুরু করেছিলেন।কথিত রয়েছে পূজাটি আনুমানিক ১৬০০ সাল  নাগাদ হালিশহরে প্রথম শুরু হয়েছিল। ১৬১০ সালে উন্নত জনপদ বড়িশায় তা স্থানান্তরিত করা হয়।  বর্তমানে পরিবারের আরো সাত শরিকের বাড়িতে দুর্গাপূজা  হয়ে থাকে।  আটচালাসহ  ছয়টি পূজা হল আটচালা, বড়োবাড়ি, মেজবাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকি বাড়ি ও কালীকিঙ্কর বাড়ি। এছাড়া একটি বিরাটি  অঞ্চলে ও একটি নিমতা অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  আটটি বাড়িতেই একচলার প্রতিমায় ত্রিচালা অর্থাৎ টানাচৌড়ি আকৃতির চালচিত্র থাকে। সেই চালচিত্রে দশমহাবিদ্যার ও রাধাকৃষ্ণের পট চিত্রিত থাকে। দেবীর একপাশে থাকেন শ্রীরামচন্দ্র ও অন্য পাশে থাকেন মহাদেব। আটটি বাড়িতেই দেবীর গায়ের রং শিউলি ফুলের বোঁটার মতন অথবা স্বর্ণবর্ণ হয়। বিদ্যাপতি রচিত 'দুর্গাভক্ততরঙ্গিনী' মত অনুসারে আটটি বাড়িতে পূজা হয়। প্রাচীন গহনা দিয়ে দেবীকে সাজানো হয়।  প্রতিবছর নিয়ম করে আটচালাতে জন্মাষ্ঠমীর দিন কাঠামো পূজা আর কৃষ্ণানবমীতে দেবীর বোধন হয়।  শুরু হয় তিলোত্তমার প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা। সপ্তমীর দিন সপ্ততীর্থের জল দিয়ে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়। 



বড়োবাড়ি, মেজবাড়ি ও নিমতার বাড়ির সিংহটি ঘোটকাকৃতির হয়।  বড়োবাড়িতে সপ্তমীর দিন হয় অর্ধরাত্রিবিহীত পূজা এবং নবমীর দিন বড়োবাড়ি ও বিরাটি বাড়িতে কুমারীপূজা করা হয়।  এছাড়া পূজার সময় ভক্তিমূলক গানের আসর বসে।  অতীতে পশুবলি প্রথা থাকলেও বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ  হয়ে গেছে।  সাতটি বাড়িতে আমিষভোগ দেওয়া হলেও কিন্তু  নিমতার বাড়িতে দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়।  দেবীকে   সাধারণত সাদা ভাত, পোলাও, খিচুড়ি, নানা রকমের ভাজা, তরকারি, তিন রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ইত্যাদি দেওয়া হয়। দশমীর দিন দেবীকে পান্তাভাত, ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুশাক, চালতার চাটনি দেওয়া হয়।  নারীদের প্রাধান্য দেওয়ার উদ্দেশে এখানে পূজার  কাজে সব সময় মহিলারাই এগিয়ে থাকেন।  

সাবর্ণদের পরিবারের দুর্গাপূজা ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরের পূজা ও উৎসব। চন্ডীমন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, কালীঘাট মন্দির, ময়দা কালীবাড়ি, করুণাময়ী কালীমন্দির, নিমতা কালীবাড়ি, হালিশহরের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রাধাকান্ত মন্দির প্রভৃতি।  সবকটা মন্দিরেই সারা বছর বিভিন্ন প্রকার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কাজে পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত থেকে সুস্থভাবে পরিচালনা করে থাকেন। 

আজকে এই পরিবারের আটচালায় গেলে হয়তো ইতিহাসের ছিটেফোঁটা সেভাবে পাওয়া যাবে না কিন্তু পূজার সময় এই ঠাকুরদালানে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় যেন ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেন কথা বলছে । 


তারিখ : -০১-০৯-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।