তিলোত্তমার প্রথম দুর্গাপূজা
- সুদীপ্ত মুখার্জী
কলকাতার ইতিহাস রাজা, জমিদার, বিত্তবান, ধনী-বণিকদের ইতিহাস। এদের সাথেই মিশে রয়েছে বহু বনেদি পরিবারের নিষ্ঠা, শ্রম, বুদ্ধি, অধ্যাবসাযের কাহিনী। কলকাতা শুধু জোব চার্ণকের কলকাতা নয়। এই তিলোত্তমা গড়ার ইতিহাসে ইংরেজদের পাশাপাশি বহু বনেদি পরিবারের অবদান সমানভাবে রয়েছে। তিলোত্তমার ইতিহাস যত প্রাচীন, ততই প্রাচীন এই তিলোত্তমার দুর্গাপূজা।
দুর্গাপূজা বাঙালিদের প্রধান উৎসব। বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো নিয়ে বহুরকম তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তা নিয়ে বহু নিউজপ্রিন্ট খরচও হয়েছে। কিন্তু শহর কলকাতার প্রথম দুর্গাপূজা নিয়ে কোথাও কোনোরূপ তর্কের স্থান নেই। যা সাবর্ণ গোত্রীয় লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর পত্নী ভগবতী দেবীর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল তাঁদের আটচালা ঠাকুর দালানে। সালটা ১৬১০। এই আটচালা ঠাকুরদালানটি বেহালা অঞ্চলের বড়িশায় অবস্থিত। এই পূজাটি ছিল তাদের পারিবারিক পূজা। পূজাটি আজও মহা আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তিলোত্তমার ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই যে সেখানে সাবর্ণ চৌধুরীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৬০৮ সালে লক্ষ্মীকান্ত বাবু মহারাজা মানসিংহের কাছ থেকে আটখানি পরগণা (উত্তরে হালিশহর থেকে দক্ষিণে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত বিস্তৃত) জমিদারি পান। এছাড়া মহারাজা মানসিংহের সুপারিশে মুঘল দরবার থেকে মজুমদার ও রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন। সেই থেকে এই পরিবার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
লক্ষীকান্ত মজুমদার আটচালার চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করে দুর্গাপূজা আরাধনা শুরু করেছিলেন।কথিত রয়েছে পূজাটি আনুমানিক ১৬০০ সাল নাগাদ হালিশহরে প্রথম শুরু হয়েছিল। ১৬১০ সালে উন্নত জনপদ বড়িশায় তা স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে পরিবারের আরো সাত শরিকের বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। আটচালাসহ ছয়টি পূজা হল আটচালা, বড়োবাড়ি, মেজবাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকি বাড়ি ও কালীকিঙ্কর বাড়ি। এছাড়া একটি বিরাটি অঞ্চলে ও একটি নিমতা অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আটটি বাড়িতেই একচলার প্রতিমায় ত্রিচালা অর্থাৎ টানাচৌড়ি আকৃতির চালচিত্র থাকে। সেই চালচিত্রে দশমহাবিদ্যার ও রাধাকৃষ্ণের পট চিত্রিত থাকে। দেবীর একপাশে থাকেন শ্রীরামচন্দ্র ও অন্য পাশে থাকেন মহাদেব। আটটি বাড়িতেই দেবীর গায়ের রং শিউলি ফুলের বোঁটার মতন অথবা স্বর্ণবর্ণ হয়। বিদ্যাপতি রচিত 'দুর্গাভক্ততরঙ্গিনী' মত অনুসারে আটটি বাড়িতে পূজা হয়। প্রাচীন গহনা দিয়ে দেবীকে সাজানো হয়। প্রতিবছর নিয়ম করে আটচালাতে জন্মাষ্ঠমীর দিন কাঠামো পূজা আর কৃষ্ণানবমীতে দেবীর বোধন হয়। শুরু হয় তিলোত্তমার প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা। সপ্তমীর দিন সপ্ততীর্থের জল দিয়ে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়।
বড়োবাড়ি, মেজবাড়ি ও নিমতার বাড়ির সিংহটি ঘোটকাকৃতির হয়। বড়োবাড়িতে সপ্তমীর দিন হয় অর্ধরাত্রিবিহীত পূজা এবং নবমীর দিন বড়োবাড়ি ও বিরাটি বাড়িতে কুমারীপূজা করা হয়। এছাড়া পূজার সময় ভক্তিমূলক গানের আসর বসে। অতীতে পশুবলি প্রথা থাকলেও বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে। সাতটি বাড়িতে আমিষভোগ দেওয়া হলেও কিন্তু নিমতার বাড়িতে দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। দেবীকে সাধারণত সাদা ভাত, পোলাও, খিচুড়ি, নানা রকমের ভাজা, তরকারি, তিন রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ইত্যাদি দেওয়া হয়। দশমীর দিন দেবীকে পান্তাভাত, ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুশাক, চালতার চাটনি দেওয়া হয়। নারীদের প্রাধান্য দেওয়ার উদ্দেশে এখানে পূজার কাজে সব সময় মহিলারাই এগিয়ে থাকেন।
সাবর্ণদের পরিবারের দুর্গাপূজা ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরের পূজা ও উৎসব। চন্ডীমন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, কালীঘাট মন্দির, ময়দা কালীবাড়ি, করুণাময়ী কালীমন্দির, নিমতা কালীবাড়ি, হালিশহরের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রাধাকান্ত মন্দির প্রভৃতি। সবকটা মন্দিরেই সারা বছর বিভিন্ন প্রকার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কাজে পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত থেকে সুস্থভাবে পরিচালনা করে থাকেন।
আজকে এই পরিবারের আটচালায় গেলে হয়তো ইতিহাসের ছিটেফোঁটা সেভাবে পাওয়া যাবে না কিন্তু পূজার সময় এই ঠাকুরদালানে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় যেন ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেন কথা বলছে ।
তারিখ : -০১-০৯-২০২১
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
1 comment:
খুব সুন্দর ছবি ও লেখা। এক অজানা বিষয় জানতে পেরে খুব খুশী হলাম। খুব ভালো থেকো তুমি। 🌹❤️❤️❤️🌹
Post a Comment