পান্তাভোগে মাতৃবিদায়
- সুদীপ্ত মুখার্জী
নদীয়া জেলার শান্তিপুর একটি প্রাচীন জনপদ। মহাপুরুষ চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু শ্রী অদ্বৈত্য আচার্য্যের সাধনভূমি হল শান্তিপুর। এখানে প্রায় ছয় হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ বলে অনুমান করা হয়। এখানকার বহু বিখ্যাত ব্যাক্তি বিশ্বের দরবারে শান্তিপুরের নাম উজ্জ্বল করে গেছেন। সুপ্রাচীন এই জনপদে বেশ কিছু বনেদি পরিবার রয়েছে। সেই সব পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা লোকের মুখে মুখে আজও ফেরে। সেইসব প্রাচীন ঐতিহ্যের গরিমা নিয়ে ভগ্নপ্রায় বাড়িগুলো আজও মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়।
এই প্রাচীন জনপদে বহুকাল ধরে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের খুব ঐতিহ্যপূর্ণ একটা পরিবার বসবাস করে। মৈত্র পরিবার। এই পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল নদীয়া জেলার ধুবুলিয়ার বেলপুকুর গ্রামে। বংশের পুত্র রজনীকান্ত মৈত্র সর্বপ্রথম নদীয়া জেলার শান্তিপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনিই এখানে তাঁদের বসত বাড়ি নির্মাণ করেন ও পারিবারিক দুর্গাপূজাটি শুরু করেন। পূজাটি এবছর ১২৬ বছরে পড়ল। মৈত্র বংশের পুত্র লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত, আইনজ্ঞ, বিশিষ্ট সাংসদ। ১৯৪৮ সালে অস্থায়ী পার্লামেন্ট গঠন হলে তিনি ডঃ আম্বেদকারের নেতৃত্বে গঠিত ভারতীয় সংবিধান কমিটির সদস্য হন। তিনি ছিলেন রজনীকান্ত মৈত্রের পুত্র। লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র ও হিরণবালা দেবীর একমাত্র পুত্র হলেন কাশীকান্ত মৈত্র। পিতার মত তাঁর কর্মজীবনও ছিলো বর্ণময়। তিনি ছিলেন আইনজ্ঞ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী। বিশিষ্ট বাগ্মী কাশীকান্ত ছিলেন মানবিক মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। তিনি একজন মননশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার সুব্রত মৈত্র।
পূজাটি ১৮৯৫ সালে শুরু হয়েছিল। একচালা শোলার সাজে প্রতিমাকে সজ্জিত করা হয়। রথের দিন কাঠামো পূজা করা হয় আর জন্মাষ্ঠমীর দিন কাঠামোর গায়ে মাটির প্রলেপ পড়ে। দেবীর গাত্রবর্ণ অতসী ফুলের রঙে রাঙানো হয়। দেবীর রূপ মহিষমর্দিনী। পূজাটি ভদ্রাসনের ঠাকুর দালানে করা হয়। ঠাকুরদালানের ঠিক পাশে রয়েছে বোধনতলা। এই বোধনতলাতে একটা প্রায় ১৩০ বছর বয়সী বেলগাছ রয়েছে। সেই বেলগাছের তলায় দেবীর বোধন হয়। এনাদের ভদ্রাসনের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে পরিবারের গৃহদেবতা কাশীনাথের মন্দির। দেবীপুরাণ মতে এখানে দেবী পূজা করা হয়ে থাকে। পূজার কটাদিন প্রত্যহ সকালে প্রথমে বোধনতলায় পূজা করা হয়, তারপর ঠাকুর দালানে মূল দেবীর পূজা শুরু হয়। পূজার সময় গৃহদেবতা কাশীনাথকে ঠাকুরদালানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়। পূজার কটাদিন দেবীর সামনে কাশীনাথকে বসিয়ে দেবীর পূজা করা হয়। দশমীর দিন দেবীর দর্পণে ভাসান হওয়ার পর আবার তাঁকে তাঁর মন্দিরে ফেরত দিয়ে আসা হয়। দ্বাদশীর দিন আবার গৃহদেবতা কাশীনাথকে ঠাকুর দালানে আমন্ত্রণ করা হয়। তাঁকে ঠাকুর দালানে বসিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয় এবং বেশ ঘটা করে পূজা করা হয়। পূজা সাঙ্গ হলে আবার তাঁকে তাঁর নির্দিষ্ট মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
সপ্তমী ও অষ্টমীতে দেবীকে সাদাভাত, পোলাও, মুগের ডালের খিচুড়ি, শুক্ত, নানারকম তরকারি ও ভাজা দেওয়া হয়। নবমীর দিন অন্যান্য দিনের মত ভোগ হিসেবে সবকিছু থাকলেও এইদিন বিশেষ পদ হিসেবে কচু শাক, চালতার চাটনি দেবীকে নিবেদন করা হয়। দশমীর দিন নৈবেদ্যের সাথে পান্তা ভোগ দিয়ে দেবীকে বিদায় জানানো হয়। প্রতিমা নিকটবর্তী খালে বিসর্জন করা হয়। এককালে এই পারিবারিক পূজাটি খুবই আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হত। বর্তমানে তার জৌলুস অনেকটা কমে গেছে। কালের স্রোতে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও এখানকার ঐতিহ্যপূর্ণ পূজাটি আজও যতটা সম্ভব তার গরিমা বজায় রেখে চলেছে।
তারিখ : ০৮-০৯-২০২১
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment