শান্তিপুর বড়ো গোস্বামী বাড়ির দুর্গাপূজা
- সুদীপ্ত মুখার্জী
নদীয়া জেলার একটা বর্ধিষ্ণু মফস্বল শহর হল ভাগীরথী তীরবর্তী শান্তিপুর। প্রাচীনকাল থেকেই শান্তিপুর শহরে নানা সময় নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করেছেন। তাঁরা নানারূপ ধর্মচর্চার নিদর্শন রেখে গেছেন। এই জনপদের আনাচে কানাচে কান পাতলেই নানারকম কাহিনী শোনা যায়। এখানকার রাস, ভাঙারাসের শোভাযাত্রা, বাবলার সপ্তম দোল, দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা প্রভৃতির খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। শান্তিপুরের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের কথা উঠলেই যে পরিবারের নাম সবার আগে উচ্চারিত হয় তা হল বড়ো গোস্বামী বাড়ি। এই বাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। শান্তিপুরের বিভিন্ন বনেদি বাড়িগুলোতে দেবী দুর্গার আহবান করা হলেও এখানকার অর্থাৎ বড়ো গোস্বামী বাড়িতে কিন্তু মা দুর্গার ভিন্নরূপ দেবী কাত্যায়নী পূজা করা হয়। এই পূজা করার পিছনে অবশ্য একটা কাহিনীর কথা শোনা যায়।
শান্তিপুরের প্রতিটি ধূলিকণা যার লীলার সাক্ষী তিনি হলেন শ্রী অদ্বৈত্য আচার্য্য। তাঁর পুত্র বলরাম মিশ্রের পুত্র হলেন রাঘবেন্দ্র গোস্বামী। এই রাঘবেন্দ্র গোস্বামীর হাত ধরেই সূচনা হয়েছিল বড়ো গোস্বামী বাড়ির।
![]() |
দেবী কাত্যায়নী মন্দির |
ভারতবর্ষে তখন মুঘল শাসন চলছে, রাজা মানসিংহের আক্রমণ ও অত্যাচারে সবাই ভয়ে জর্জরিত। সেই সময় অধুনা বাংলাদেশের যশোরের ক্ষত্রিয় রাজা বসন্ত রায় মধুরেশ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা নেন। রাজা বসন্ত রায় ছিলেন বারো ভূঁইয়াদের একজন। রাজা কালা পাহাড়ের মন্দির ও শ্রীবিগ্রহ ধ্বংস যজ্ঞে আতঙ্কিত হয়ে তিনি দোলগোবিন্দের বিগ্রহটিকে পুরী থেকে যশোরে নিয়ে আসেন। দোলগোবিন্দকে তিনি তাঁর গৃহদেবতা হিসেবে বেশ কিছুদিন পূজা করেন। তিনি তাঁর বিগ্রহের রক্ষনাবেক্ষন ও সেবায় ত্রুটির আশঙ্কায় এই দোলগোবিন্দের বিগ্রহটিকে তাঁর গুরুদেব শ্রী মথুরেশ গোস্বামীর হাতে অর্পণ করেন। মথুরেশ গোস্বামী যশোর থেকে পদব্রজে দোলগোবিন্দ বিগ্রহসহ শান্তিপুরে আসেন এবং তা বড়ো গোস্বামী বাড়ির মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিগ্রহটির নতুন নামকরণ করেন "শ্রী শ্রী রাধারমণ জিউ"। এই রাধারমণকে নিয়ে পরিবারের সকলে বেশ আনন্দে দিন কাটাচ্ছিল। পূজা ও তাঁর সেবায় তারা সারাক্ষন ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু একদিন হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল। পরিবারের মন্দির থেকে শ্রী শ্রী রাধারমণের বিগ্রহটি উধাও হয়ে গেল। ঘটনায় বাড়ির পুরুষ ও মহিলাদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সবাই খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লো। অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর প্রভুদের মাথায় এল যে পূর্বে একবার শ্রীধাম বৃন্দাবনে গোপীরা 'দেবী কাত্যায়নীর ব্রত' পালন করে লীলাপুরুষোত্তমকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তারা শ্রী শ্রী রাধারমণ জিউয়ের বিগ্রহটিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তৎকালীন প্রভুদের স্ত্রীরা দেবী কাত্যায়নীর ব্রত করা শুরু করেন। মায়ের নিকট তাঁরা হত্যে থেকে তৃতীয় রাত্রে তাঁদের কোনো একজন স্বপ্নাদৃষ্ট হলেন যে নিকটবর্তী দিগনগরের একটি জলাশয় তাঁদের ইষ্টদেবতা শ্রী শ্রী রাধারমণ নিমজ্জিত রয়েছে। তারা ওই জলাশয় গিয়ে তাদের ইষ্টদেবতাকে নিয়ে আসে এবং তাঁকে মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই থেকে বাড়ির মন্দিরে দুর্গাপূজার সময় 'দেবী কাত্যায়নী' পূজা শুরু হয়। দেখতে দেখতে যা আজ ৪৫০ বছর অতিক্রম করে গেছে।
পূজার কটাদিন প্রত্যহ দেবীকে ৩৬ রকমের ব্যঞ্জন দিয়ে রাজসিক প্রসাদ নিবেদন করা হয়। মা শ্বেত অশ্বাকৃতি ঘোড়ার উপর অধিষ্ঠাত্রী। মায়ের দশটি হাতের দুটি হাত বড় আর বাদবাকি আটটি হাত কলার ছড়ার ন্যায় ছোট হয়। কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী ও লক্ষ্মী থাকেন বিপরীত দিকে অর্থাৎ দেবীর ডানদিকে কার্তিক ও লক্ষ্মী আর বামদিকে গণেশ ও সরস্বতী থাকেন। দেবীর হাতে ত্রিশূল থাকে। মায়ের মৃন্ময়ী মুখটি মহামায়ার আদিরূপ। সম্পূর্ণ বৈষ্ণবীয় রীতিতে বড়ো গোস্বামী বাড়ির নির্দিষ্ট পুঁথি অনুযায়ী দেবী কাত্যায়নীর পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকে। দেবীপক্ষের প্রথম দিন থেকেই চন্ডীপাঠ ও দেবীর বোধন শুরু হয়। দশমীর দিন সকাল নয়টার মধ্যে দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় পরিবারের ইষ্টদেবতা শ্রী শ্রী রাধারমণের নিত্য ভোগ রান্না।
দেবী কাত্যায়নী মাতার বিসর্জনের দিন প্রথা অনুযায়ী রাস উৎসবের শুভ সূচনা করা হয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী মানুষের বিশ্বাস দেবী কাত্যায়নী মাতা রাস উৎসবের শুভ সূচনা করে যান। এককালে এই পূজায় বেশ বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হত, আজ সাড়ে চার শতবর্ষ অতিক্রম করেও তারা তাদের ঐতিহ্যকে যতটা সম্ভব ধরে রেখেছে।
তারিখ :১২-০৯-২০২১
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment