Sunday, November 6, 2022

বাজ থেকে রাজ


বাজ থেকে রাজ

সুদীপ্ত মুখার্জী 


মন্দিরময় গ্রাম 



ছোটনাগপুর মালভুমির পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ঝাড়খণ্ড রাজ্য।  এই রাজ্যের সাঁওতাল  পরগণা  বিভাগের অন্তর্গত দুমকা জেলায় অবস্থিত মলুটী নামক ঐতিহ্যবাহী মন্দির গ্রাম। গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের রামপুরহাট রেলস্টেশন থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ১৮৫৫ খিষ্ট্রাব্দের পূর্বে গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অন্তর্গত ছিল। মলুটির পরিবেশ বাংলার অন্যান্য গ্রামের মতো শান্ত ও  স্নিগ্ধ। এখানে  বাংলাভাষীদের প্রাধান্য রয়েছে। মলুটী গ্রামের পূর্বে নাম ছিল মল্লহাটি। 

পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা বাজবসন্ত স্থাপন করেছিলেন নানকার রাজ্য। রাজা বাজবসন্ত কোনও রাজপুত্র ছিলেন না,  ছিলেন সামান্য রাখাল বালক। প্রাচীন বীরভূম জেলার মৌড়েশ্বর গ্রামের নিকটবর্তী কাটিগ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে তার জন্ম হয়।  বাল্যকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ার জন্য বসন্তকে বালক বয়সেই অপরের গোচারণ করে সংসারে সাহায্য করতে হত। অন্যান্য রাখাল বালকের ন্যায় একদিন বিকেলে  সে গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরে। সূর্য পশ্চিমপাড়ে ঢলে পড়ার সময় তার মুখে রৌদ্র এসে পড়ছিল। এমন সময় এক অবাক কান্ড ঘটল।  এক বিষধর সাপ কোথা থেকে এসে তার মুখের ওপর ফণা তুলে দাঁড়ালো, যাতে মুখে সূর্যের রশ্মি না লাগে। ঠিক সেই সময় সুমেরু মঠের  দন্ডীস্বামী নিগমানন্দ তীর্থ মহারাজ শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মহাপ্রভু দর্শনের পর তারাপীঠের তারামাকে  দর্শনের উদ্দেশ্যে ওই পথ ধরে যাচ্ছিলেন।  তিনি এই দৃশ্য দেখে বিস্মৃত হলেন। বালকের দিকে এগোতেই সাপটি মাথা নিচু করে জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেলো। সন্ন্যাসী বালকের মধ্যে রাজলক্ষণ  দেখতে পেলেন। প্রথমে তিনি অনুমান করতে পারছিলেন না বালকটির রাজা হওয়ার পরিবর্তে গোচারণ বৃত্তিতে আসার কারণটি।  বালককে ঘুম থেকে তুলে তিনি তাকে নিয়ে তার কুটিরে আসলেন। অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন বসন্তের উপনয়ন ও দীক্ষা হয়ে গেছে। তিনি আরো জানতে পারলেন বালকটির ইষ্টমন্ত্রে এক অক্ষর ভুল আছে। তিনি বালকটির বিধবা মার কাছে বসন্তের কুলগুরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন এবং জানালেন যে ইষ্টমন্ত্রটি শুদ্ধ করে দিলে বসন্ত অনতিবিলম্বে রাজা হবে। দন্ডী সন্ন্যাসী বসন্তের কুলগুরুকে মন্ত্রটি ত্রুটিমুক্ত করতে অনুরোধ করলে  তিনি রাজি হলেন না।  অগত্যা সন্ন্যাসী একটা বিল্ব পত্রে মন্ত্রটিকে লিখে বালকটিকে  সেটি জলে ভাসিয়ে দিতে বললেন। সেইদিন সন্ধ্যায় সন্ন্যাসী বসন্তকে শুদ্ধ মন্ত্র দান  করলেন এবং প্রত্যেকদিন শুদ্ধাচারে ইষ্টমন্ত্রটি জপ করার উপদেশ দিলেন। তারপর তিনি তীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।  

পরিত্যক্ত দুর্গা দালান 



ঘটনাচক্রে গৌড়ের নবাব আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উড়িষ্যা হয়ে বীরভূমের মধ্য দিয়ে গৌড়ে ফিরছিলেন। বিশ্রামের জন্য ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে শিবির স্থাপন করেন।  শিবির থেকে বেগম সাহেবের পোষা প্রিয় একটা বাজপাখী সোনার শিকল কেটে উড়ে পালিয়ে যায়।  বালক বসন্ত পাখী  ধরার জন্য অন্যান্যদের মত গাছের ডালে ফাঁদ পেতে রেখেছিল। ওই ফাঁদে পলাতক বাজপাখী ধরা পরে গেল। পাখীটার পায়ে সোনার শিকল, নাকে সোনার নোলক দেখে মহানন্দে বসন্ত পাখীটাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসল। ওইদিকে বেগম সাহেব পাখীর শোকে শয্যা নিয়েছেন। বাদশা পাখীটি ফিরে পাওয়ার  জন্য চারদিকে ঢেড়া  দেওয়ালেন এবং পুরস্কার ঘোষণা করলেন। দন্ডী সন্ন্যাসী তখন বেশি দূর যাননি। তাঁর কানে এসে রাজার বিজ্ঞপ্তি পৌঁছালো। তিনি বুঝতে পারলেন বালক বসন্তের রাজ্যপ্রাপ্তির যোগ আসন্ন।  তিনি তাঁর তীর্থযাত্রা বন্ধ রেখে নবদীক্ষিত শিষ্য বসন্তের কুটিরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসলেন। শিষ্যের ঘরে বাজপাখীটা দেখে তিনি খুব আনন্দিত হলেন।  অচিরেই তিনি সশিষ্য বাদশার শিবিরে পৌঁছে বাজপাখীটি ফিরিয়ে দিলেন। তিনি রাজার কাছে বসন্তের দারিদ্রের কথা বলে কিছুটা ভূখণ্ড পুরস্কারস্বরূপ চেয়ে বসলেন। গৌড়ের নবাব কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা  না করে আদেশ দিলেন, পরদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্য্যাস্ত পর্যন্ত ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাখাল বালক যতটা পথ ঘুরে আসতে পারবে, সেই সমস্ত ভূমি তিনি তাকে নিস্কর জমিদারীরূপে দান  করবেন। পরদিন বালক বৃত্তাকারে প্রায় ষোল কিলোমিটার ব্যাসের ভূখণ্ড পরিক্রমা করে ফেললেন। তার সঙ্গে থাকা আমিন স্থানে স্থানে ওই ভূখণ্ডের সীমারেখা চিহ্নিত করে দিল। তৈরী হলো নানকার তালুক। বাদশা হোসেন শাহ বসন্তের পরিক্রমা করা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডটি ননকার রাজ্য অর্থাৎ নিস্কর রাজ্য বলে স্বীকৃতি দিলেন। তার সঙ্গে দিলেন কিছু অর্থ এবং কয়েকজন বিশ্বস্ত সৈন্য। বালকটিকে 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত করলেন। নানকার শব্দটি ননকর শব্দের অপভ্রংশ। প্রথমে রাজ্যটির আকার গোলাকার ছিল। পরবর্তীকালে অনেক মৌজা এই জমিদারীতে অন্তর্ভুক্ত  হয়েছে। 




রাজা বাজবসন্তের রাজত্বকাল আনুমানিক ১৫২০ - ১৫৭০ সাল পর্যন্ত ছিল।  তাঁর রাজ্যলাভের কিছু পর থেকে বীরভূম জেলাসহ সমগ্র গৌড়বঙ্গে একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যুবক রাজা বসন্ত ধীরে ধীরে তাঁর রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন। 

রাজা বাজবসন্তের রাজত্বকালের শেষের দিকে নানকার রাজ্যের চরম উন্নতি হয়। রাজ্যের আয়তন ছিল প্রায় ছত্রিশ কিলোমিটার ব্যাসের বৃত্তাকার ভূখণ্ড। রাজ্যের সীমানায় ছিল পূর্বে দ্বারকা নদী, পশ্চিমে সাঁওতাল পরগণা বিভাগের দুমকা জেলার কারাকাটা গ্রাম, উত্তরে বলিয়া-মৃত্যুঞ্জয়পুর এবং দক্ষিণে মল্লারপুর সহ ডামরার জঙ্গল অঞ্চল। এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের জন্য কোন কর দিতে হত না। তবে  পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পর ওয়ারেন হেস্টিংস যখন প্রচলিত ভূমিকরের পরিবর্তন ঘটান সেইসময় সামান্য কিছু টাকা নানকার রাজ্যের জন্য খাজনা ধার্য করা হয়েছিল। নানকার রাজ্যের আয়  ছিল প্রায় লক্ষাধিক টাকা এবং রাজারা উদ্বিত্ত টাকায় দেবালয় স্থাপন, পূজাচ্ছর্নায় এবং জ্ঞানী-গুণী সম্বর্ধনায় ব্যয় করতেন।  জমিদারি চলে যাওয়ার পরেও সাধু-সন্তদের সম্মানরক্ষা ও দেব-দেবী পূজার আড়ম্বর বেশ কিছুদিন অক্ষুন্ন ছিল। রাজা বাজবসন্ত মাত্র ১০-১১ বৎসর বয়সে রাজ্যলাভ করেছিলেন  প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন।  রাজা বাজবসন্তের মৃত্যুৰ পর আনুমানিক ১৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর পুত্র রাম সহায় রাজ সিংহাসনে বসেন। 

১৬৯৫ সালে রাজনগরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নানকার রাজপরিবার যখন মলুটীতে পৌঁছান তখন অঞ্চলটি ছিল অরণ্যময়। বন কেটে বসত স্থাপনের পর মলুটীতে নানকার রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করা হয়েছিল। ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের  সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলস্বরূপ তরাই অঞ্চল ও বীরভূমের কিয়দংশ নিয়ে নতুন জেলা সাঁওতাল পরগণার সৃষ্টি হয়েছে।  সেই সময় মলুটী সহ নানকার জমিদারির বৃহৎ অংশ সাঁওতাল পরগনা জেলায় চলে যায় এবং বাকি অংশ বীরভূমেই থেকে যায়।  গ্রামটি পুরাতাত্ত্বিক  বৈশিষ্টে ভরা। গ্রামটিকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছে এখানকার বৈচিত্রময় মন্দির ভাস্কর্য্য। 

গ্রামটিতে জীর্ণ রাসমঞ্চ, দুর্গামন্দির ও ৭২টা শিব মন্দির ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরগুলো অবশ্য এক জায়গায় নেই সমগ্র গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কথিত আছে, এখানে পূর্বে মোট ১০৮টি শিব মন্দির ছিল। ৩৬টা মন্দির রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ৭২টা  মন্দির রাজ্য সরকারের পুরাতত্ব বিভাগ বর্তমানে অধিগ্রহণ করেছে। মন্দিরগুলোতে মূলত এগুলি শিব, দূর্গা, বিষ্ণু ও কালী বিগ্রহ ছিল। অনেক শিব মন্দির রয়েছে বলে অনেকে গ্রামটিকে গুপ্তকাশীও বলে থাকে। রাজা বাজবসন্ত ও তাঁর বংশের অন্যান্য রাজারা মন্দিরগুলো নির্মাণ করেছিলেন।  

এখানকার মন্দিরশৈলী মিশ্র প্রকৃতির। গঠনশৈলী অনুসারে মন্দিরগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়, সেগুলো হল চালা, রেখা, মঞ্চ, একবাংলা ও সমতল ছাদ বিশিষ্ঠ। একেকটি মন্দির চারকোনা ভিত্তি বেদির উপর অবস্থিত। বেদির উপর দেওয়ালগুলো খাড়া উপরের দিকে উঠে গেছে এবং সেগুলোও চারকোনা। শিখরদেশ অর্ধগোলাকৃতি, চালগুলো আয়তনে ছোট। মন্দিরগুলো এক কক্ষ বিশিষ্ট।  চুন-সুরকি দিয়ে পাতলা লাল ইঁট গেঁথে  তৈরী করা হয়। মন্দিরগুলোর উচ্চতা সর্ব্বোচ ৬০ ফুট আর সর্বনিম্ন ১৫ ফুট। মন্দিরগুলোর সম্মুখভাগে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির অপূর্ব কার্যখোচিত, যাতে রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের বিভিন্ন গল্পগাঁথা। 

মলুটীতে অবস্থিত সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্দির হল মৌলীক্ষ্যা মায়ের মন্দির। মন্দিরটি এক বাংলা গঠনশৈলীতে নির্মিত। বহুকাল ধরে মন্দিরটি তন্ত্র সাধনার উপযুক্ত পীঠ বলে পরিচিত হয়ে এসেছে।  মৌলিক্ষ্যা  মাকে  মলুটীর রাজাগণ তাঁদের কুলদেবী সিংহবাহিনীরূপে পূজা শুরু করেছিলেন। মন্দিরের পরিবেশ ভাগম্ভীর। বামাখ্যাপাসহ বহু সাধক এখানে সাধনা করে গেছেন।  মন্দিরটি রাজা রাখরচন্দ্র নির্মাণ করে দেন।  

দুমকা জেলার শিকারীপাড়া থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যময়, ঐতিহাসিক নানকার রাজ্যের কথা যেমন কেউ মনে রাখেনি তেমন মন্দিরনগরী মলুটী গ্রামের কথা ইতিহাস মনে রাখেনি। অনাদরে পরে রয়েছে রাজবংশের অনন্য সব কীর্তিগুলো। মন্দিরগুলোর প্রাচীনত্ব অনুভব করে মানুষ আজও রোমাঞ্চিত হয়। 

 
তারিখ :০৭-১১-২০২২

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।