Sunday, October 27, 2019

কেওড়াতলা শ্মশান ও শ্মশানকালী>

কেওড়াতলা শ্মশান ও শ্মশানকালী



শ্মশান মানে শবদেহ দাহ করার স্থান। এ এমনি এক স্থান যেখানে প্রত্যেক মানুষকে কারোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার জন্য বা নিজের আন্তষ্টির সময় মৃত অবস্থায় যেতেই হয়। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই বেশিরভাগ শ্মশানেরই অবস্থান কোনো না কোনো নদীর তীরে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে দ্বারকা নদীর তীরে তারাপীঠের মহাশ্মশান, কোপাই নদীর তীরে কঙ্কালীতলার মহাশ্মশান। তেমনি কেওড়াতলা মহাশ্মশানটিও আদি গঙ্গার তীরে অবস্থিত। বহু সাহিত্যিকের কলমে শ্মশানের কথা বার বার উঠে এসেছে।  যদিও শ্মশানের চরিত্র বর্তমানে  সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কাঠের বদলে এসে গেছে বৈদ্যুতিক চুল্লি। আগের আলো-আঁধারি ভয়াবহ পরিবেশও পাল্টে হয়ে উঠেছে আলো ঝলমলে। মৃত্যু মানে জীবনের শেষ, তারপর দাহ পদ্ধতির মাধ্যমে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া। এখানে আসলে মনে হবে যেন এটাই বুঝি পৃথিবীর শেষ স্টেশন। 'শ' শব্দটির অৰ্থ শব অর্থাৎ মৃতদেহ আর 'শ্মান' শব্দটির অর্থ হলো শান বা বিছানা।  শ্মশানে আসলেই সব সময় শোনা যায় "বল হরি, হরি বোল" বা "রাম নাম সত্য হ্যায়" কথাগুলো। "হরি" বলতে বোঝায় যিনি জন্ম-মৃত্যু, জড়া-ব্যাধি হরণ করেন। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে ভগবান রাম যিনি সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাভূত করতে সক্ষম। তাই বিশ্বাস অনুযায়ী রামের নাম করলে আত্মার মুক্তি মেলে। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ শ্মশানেই কালী মন্দির দেখা যায় বা শ্মশান কালীর পুজোও  হতে দেখা যায়।




রাসবিহারী মোড় থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে সেতু পার হয়ে চেতলার দিকে। ওই সেতুতে ওঠার ঠিক আগে একটা মোড় পড়বে।  এই মোড়ের ডানদিকে পড়ে কালীঘাট অঞ্চল ও বিখ্যাত কালীমন্দিরটি আর বামদিকে পড়ে টালিগঞ্জ অঞ্চল ও বিখ্যাত কেওড়াতলা মহাশ্মশানটি।

কথিত আছে, এই বাঁদিকের অঞ্চলটিতে  পূর্বে কেওড়া গাছের জঙ্গল ছিল, সেই থেকে অঞ্চলটির নাম কেওড়াতলা হয়।  কেওড়াতলা শ্মশানটি বৃহৎ ও কলকাতার অন্যতম প্রাচীন শ্মশান। শ্মশানটির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আদি গঙ্গা। শ্মশানটি পূর্বে এই স্থানে ছিল না, কালীঘাট মন্দিরসংলগ্ন ঘাটে এর অবস্থান ছিল। শবদেহ দাহ করার সময় কালো ধোঁয়ায় মন্দিরটি ও অঞ্চলটি ভরে যেত। সমগ্র  অঞ্চলটিতে একটা অস্বাস্থ্যকর  পরিবেশ তৈরী হচ্ছিল। কলকাতা পৌরসংস্থা গঠন হওয়ার পর কালীঘাট মন্দিরের কাছে বর্তমান জায়গায় অর্থাৎ কেওড়াতলায় দুই বিঘা জমি নিয়ে শ্মশানটিকে স্থানান্তরিত করা হয়। শ্মশানটির ডান দিকে মায়ের ৫১ পীঠের এক পীঠ (কালীর মন্দির) ও নকুলেশ্বর ভৈরব মন্দির  থাকায়  জায়গাটা খুবই পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। শ্মশানটিকে তাই মহাশ্মশান বলা হয়।

বহুদিন যাবৎ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় ছিল। দহনের পোড়া কাঠ ও ভষ্মে জায়গাটা সব সময় অপরিষ্কার হয়ে থাকতো।  শ্মশানযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য কোনো ভালো জায়গা  ছিল না। কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত গঙ্গানারায়ণ হালদারের পত্নী শ্রীমতি বিশ্বময়ী দেবী শ্মশানঘাটটিকে বাঁধিয়ে দেন এবং পরবর্তীকালে তিনি শবযাত্রীদের বসার জন্য বিশ্রামাগার ও প্রবেশপথে একটা সুবিশাল তোরণ তৈরী করে দেন।  স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় কিছুটা  আধুনিকরণ ও সংস্কার করেন।  ২০০৪  ও ২০০৫ সালে পৌরসংস্থা বেশ কিছু টাকা ব্যয় করে আরো কিছু সংস্কার করে দেয়।  সেই টাকাতে নতুন  বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানো ও চত্বরটি সাজানোর কাজ করা হয়।  শবযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য উপযুক্ত একটি বিশ্রামাগার তৈরী করা হয়।  পরবর্তীকালে পৌরসংস্থা বিশ্রামাগারটিকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত করে দেয়। তার ফলে পুরোনো কাঠের শ্মশানটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। শ্মশান সংলগ্ন স্থানে ভারী সুন্দর, মনোরম একটা  বাগান তৈরী করা হয়েছে। গার্ডেনটির নাম "মাইসোর  গার্ডেন"। পৌরসংস্থা বর্তমানে আরো  সুন্দরভাবে গার্ডেনটিকে  সাজিয়ে দিয়েছে।

কলকাতার বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের শব এখানে দাহ করা হয়েছে। তাঁদের কয়েক জন যেমন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখ্যোপাধ্যায় প্রমুখের স্মৃতিসৌধ করা আছে। এছাড়া জীবনানন্দ দাশ, সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, নেলী সেনগুপ্ত, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু,  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখ ও আরো কত গন্যমান্য ব্যাক্তিত্বের দেহ এখানেই দাহ করা হয়েছে। এটি কলকাতা শহরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা শ্মশান বলে বিবেচনা করা হয়।

স্বজন হারানোদের কান্নায় যাদের দিন অতিবাহিত হয়, সেই ডোমরাই কেওড়াতলা শ্মশানে কালীপূজার রাতে  মায়ের আরাধনায় মত্ত হয়ে ওঠেন। সারা বছর শবদেহ ঘেটে যাদের জীবন চলে তারাই এই পুজোর মূল উদ্যোক্তা। পূজার রাতেও ওদের ছুটি নেই, শবদেহ আসলেই দাহ করার জন্য ওদের ছুটতে হয়। কর্তব্য পালন করেই তারা পরিবার নিয়ে উৎসবে সামিল হন। শববাহী যাত্রীদের কাছ থেকে কোনো প্রকার চাঁদা তোলা হয় না, স্থানীয় ব্যবসাদার ও  নিজেদের রোজগারের পয়সায় সম্পূর্ণ আয়োজন করা হয়। সমস্ত নিয়ম নীতি মেনেই ব্রাহ্মণ পূজা করে থাকেন। বাংলার অন্যান্য শ্মশানের মতো এখানেও খুব ঘটা করে পূজা করা হয়ে থাকে। কথিত আছে ১৮৭০ সালে একজন কাপালিক দুজন স্থানীয় ব্রাহ্মণের সাহায্যে শ্মশানকালী প্রতিষ্ঠা করেন। কাপালিক নিজের আনা  প্রতিমাতেই  পূজা করেন এবং পূজার পর প্রতিমা নিয়ে তিনি ফিরে যান। সেই প্রতিমা ছিল দুই হাত বিশিষ্ট ও প্রতিমার কোন জিহ্বা ছিল না। সেই থেকে এখানে ওই ধরনের মূর্তিই পূজিত  হয়ে চলেছে।  এখানকার মূর্তির দুটো হাত অর্থাৎ দেবী দ্বিভূজা। এক হাতে মাটির তৈরী নরমাংস থাকে  আর এক হাতে কারণবারি থাকে। দেবী ,মূর্তি উচ্চতায় ২২ ফুট। প্রতিবছর নিয়ম করেই শ্মশানকালীর পূজা করা হয়, যা আজও সমানভাবে চলে আসছে। দীপান্বিতা অমাবস্যায় মহাসমারোহে নিষ্ঠাভরে এই পূজার আয়োজন করা হয়। এখানে তান্ত্রিক মতে পূজা করা হয়। এখানে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। দেবীকে মুড়ি, চানাচুর, সিঙ্গারা, আট কড়াই ভাজা, ১৪ রকম মাছ, খিচুড়ি, পোলাও, সাদা ভাত ভোগ হিসেবে দেবীকে নিবেদন করা হয়।  এছাড়া বলির মাংসও মেক ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। ১৯২৪ সাল থেকে একটা সর্বজনীন পূজাকমিটির তত্ত্বাবধানে পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর ভাইফোঁটার দিন শ্মশানকালির বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখার মত হয়।  অঞ্চলের অধিবাসীরা এই শোভাযাত্রা চাক্ষুষ করা "খুবই পবিত্র" বলে মনে করে থাকে। আমি দেখেছি, এই শোভাযাত্রার সময় অধিবাসীরা  যাত্রা পথে নিজ নিজ বাজী পুড়িয়ে শোভাযাত্রাটির শোভা আরও বাড়িয়ে তোলে। শোভাযাত্রা যাওয়ার সময় দর্শনার্থীরা সবাই মিলে উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি  দিয়ে থাকে। শোভাযাত্রা থেকে ফুল ও বাতাসা দর্শকদের উদ্দেশ্যে ছোড়া হয়, সেই ফুল ও বাতাসা নেওয়ার জন্য বেশ হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সত্যিই এক অনবদ্য শোভাযাত্রা হয়ে থাকে।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :২৭-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Wednesday, October 23, 2019

ভালোপাহাড় >

ভালোপাহাড়  
রূপকথা না বাস্তব  





প্রবেশ দ্বার 

সেদিন মলয়ের দোকানে একটু আড্ডা মারার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। মলয় মানে আমার বন্ধু  মলয় সোম।  আড্ডা দিতে দিতে ও হঠাৎ বললো ভালোপাহাড় যাবে নাকি, আমি ২০ তারিখে যাচ্ছি। তখন ভালোপাহাড় সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা ছিল না। মলয় জানালো পাহাড় বলতে আমাদের যা ধারণা তার সাথে এখানে কোনো মিল নেই, এটা একটা ম্যান মেড অরণ্য। তবে ছোট ছোট পাহাড়তো অবশ্যই দেখতে পাবে। পাহাড় ও অরণ্যের মাঝে মানুষের তৈরী আর এক অরণ্য।  এই সামান্য কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম। যাই হোক ২০ তারিখে সকাল ৭ টায় ইস্পাত  এক্সপ্রেসএ টিকিট কাটা হলো। মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন কিলবিল করতে লাগলো ভালোপাহাড়টা কে বা কারা তৈরী করেছে, কোথায় এর অবস্থান। সেই মানুষটার বা মানুষগুলোর নামই বা  কি? মলয় কোনোটারই উত্তর দিতে রাজি হলো না, বললো আগে থেকে সব বলে দেওয়া যাবে না, ওখানে গিয়ে সব কিছু চাক্ষুষ করে মজা উপভোগ করবে। মনে মনে বললাম তবে তাই হোক।

পরের রবিবার ২০ তারিখে ইস্পাত এক্সপ্রসে টিকিট কাটা হল। যথারীতি ২০ তারিখ সকাল ৬ টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।  ট্রেন প্রায় দেড় ঘন্টা দেরিতে ছাড়লো।  আমরা ১২টা  নাগাদ গালুডি স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।  ওখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভালোপাহাড়।  অটো রিক্সা বলা ছিল। দীপকের অটো করে মিনিট ৪৫-এর মধ্যে আমরা ভালোপাহাড়ে পৌঁছে গেলাম।

শ্রদ্ধেয় শ্রী কমল চক্রবর্তী 

ওখানে পৌঁছে দেখলাম রাস্তার ধারে বিশাল একটা লোহার দরজা, দরজার ওপরে বড় বড় হরফে "ভালোপাহাড়" কথাটা লেখা আছে, গেটের পাশের দেওয়ালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  ও বিদ্যাসাগরের বাণী লেখা রয়েছে। ভিতরে  ঢুকে কি দেখবো তাই নিয়ে আমার মনটা ছটফট করছে। ভিতরে ঢুকে সবুজ অরণ্য দেখে মনটা স্নিগ্ধ ও শান্ত হয়ে গেলো।  ভালোপাহাড় হলো পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ানে অবস্থিত একটা সোসাইটি। এক পঞ্চপাণ্ডবের সোসাইটি। যাদের মূলমন্ত্র প্রচুর গাছ লাগানো ও মানব সেবা। ভিতরে গিয়ে আলাপ হল এক বিশাল মজার মানুষ বৃক্ষের পূজারী শ্রদ্ধেয় শ্রী কমল চক্রবর্তী   মহাশয়ের সঙ্গে।  প্রথম আলাপেই কথার ভাঁজে  উনি আমাদের মাতিয়ে দিলেন ।


বাচ্ছারা স্কুলে যাচ্ছে 

ভালোপাহাড় সম্বন্ধে জানতে হলে বছর পঁচিশ আগে ফিরে যেতে হবে।  সালটা ছিল ১৯৯৬।  পাঁচ বন্ধু মিলে  তখন টাটা বাবাজির শহরে বসে সাহিত্য চর্চা করতেন। "কৌরব" নামে  একটা বাংলা পত্রিকা চালাচ্ছিলেন। সবাই তখন বেকার। আড্ডা, কবিতা, গল্প, নাটক, গান ও বিখ্যাত সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য সভা করতেন। ১৯৬৮ সাল  নাগাদ কমল চক্রবর্তী, সুভাষ ভট্টাচার্য, অরুন আইন, শক্তিপদ হালদার ও বারীন ঘোষাল জামশেদপুরের এই পাঁচজন একত্রিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দেবজ্যোতি দত্ত এঁদের সাথে যুক্ত হন। এরা সেই সময় কবিসঙ্গ লাভ ও প্রকৃতিকে দেখার জন্য সারা পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন।  শান্তিনিকেতনের পান্নালাল দাসগুপ্তের তৈরী "টেগোরে সোসাইটি" দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, পঞ্চপাণ্ডবের  মাথায় তখন  কিছু একটা করার জন্য বাসনা জাগলো।  ঠিক করলেন কিছু একটা করতেই  হবে। ১৯৭১ সালে তারা প্রথম কৌরব নামে পত্রিকাটি বের করেছিলেন, যা আজও চলে আসছে।

ভালোপাহাড়ের পিছনের দৃশ্য 

এই পঞ্চপান্ডবের দল একটা ভালো জমি কিনতে চান, যেখানে চাষ বাস করা যাবে।  তাঁদের পরিচিত শচীন দত্ত মহাশয় জানালেন জামশেদপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বান্দোয়ানে  ৪০ বিঘা জমি তাঁর রয়েছে যেটা তিনি বিক্রি করতে চান।  জমিটি বড় রাস্তার ধারে অনাবাদি পাথুরে জমি।  জমিটি তাঁদের পছন্দও না হলেও তাঁরা কষ্ট করে জমিটি কিনলেন। ১৯৯৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর "ভালোপাহাড়" নাম দিয়ে একটা সোসাইটি গঠন করা হলো। সেই থেকে দলমা  ও রুমাই পাহাড়ের পাদদেশে ভালোপাহাড়ের চলা শুরু হল। "ভালোপাহাড়" আসলে একটা নন-প্রফিট এনজিও। পরবর্তীকালে তাঁরা  আরো  প্রায়  ৮০ - ৯০ বিঘে জমি কেনে।

ধানক্ষেত 

পুরুলিয়ার রুক্ষ - পাথুরে ভূমিকে  অনেক কষ্ট করে পাথর কেটে জমির মাটি বের করে গাছ লাগানো হয়েছিল। বর্তমানে যেন এক সবুজ মন্দির, যেখানে বাস করে বৃক্ষনাথ, আর বৃক্ষের পূজারীরা। এক স্বাধীন বাঁধনহারা  অরণ্য যেখানে গাছেদের  লম্বা লম্বা হাত যেন জড়িয়ে ধরে।   চারদিকে প্রচুর গাছ। কয়েক লক্ষ গাছ হবে। বর্ষার শেষে  ডালে ডালে কচি পাতার ঝালর। জানা ও অজানা কতরকম  ফুলে ভর্তি।  গঙ্গাফড়িং লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।  গাছে গাছে নানারকম পাখির দল  খেলে বেড়াচ্ছে।  পাতি হাঁস, রাজ হাঁস ও মুরগিও খেলে বেড়াচ্ছে। সূর্যদেবতা পাটে  গেলে একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া খেলে বেড়ায়। 

গোয়াল ঘর 

চারদিকে একটা জমজমাট নিঃশব্ধতা বজায় রয়েছে। গাছের পাতায় পাতায় শুধু জোনাকির আলো মিটিমিটি করে জ্বলছে। বৃক্ষগুলো জোনাকির আলোতে যেন  জলসার আসর বসিয়েছে। হওয়ার দোলায় তাদের মৃদুমন্দ আওয়াজ মন ভরিয়ে তুলছে।  এ যেন বৃক্ষ দেবতা, বৃক্ষনাথের মন্দির। দিব্য দর্শনে অনুভব করা  বৃক্ষনাথের শোভা। ঘুম ভাঙতে ভোরের আলোতে পাখিদের গান মনে উদ্দীপনা তৈরী করে দিল। সোনাঝুরি, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অশ্বত্থ, বট, শাল, সেগুন, শিমুল, গামার, তেতুল, কাঁঠাল, রুদ্রাক্ষ, চেরি, আপেল, আমলকি, আমড়া, চালতা, কারিপাতা এরকম কত শত বড় বড় সব গাছ রয়েছে। কয়েক বিঘে জমিতে চাষের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে  প্রায় ২৮ রকমের দেশীয় ধান চাষ করা হয়, যেগুলো আজ প্রায় অবলুপ্ত। তাছাড়া বহু রকমের সবজি চাষ করা হয়। এইসব চাষে কোনোরকম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না, সম্পূর্ণ জৈব সার ব্যবহার করে চাষ-আবাদ করা হয়।  গোয়াল ঘরে প্রায় ৪০ টা দেশি গরু রয়েছে ।  জল ধরে রাখার জন্য একটা কয়েক বিঘের  পুকুর কাটা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদিত একটা বাচ্ছাদের স্কুল রয়েছে। স্কুলটি ২০০৪ সালে তৈরী করা হয়।   এই স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত আদিবাসীদের গ্রামগুলো থেকে বাচ্ছারা এখানে পড়তে আসে।  স্কুলে প্রায় ২০০ টি বাচ্ছা  নিয়মিত লেখা-পড়া করে। বাচ্ছাদের শিক্ষার মধ্যে নিজেদের সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে চেনানোও এদের শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে রয়েছে।  বাচ্ছাদের স্কুলে আনা নেয়ার জন্য দুটো স্কুল বাস রয়েছে।  স্কুলে পাঁচজন মাস্টারমশাই রয়েছেন।  মাস্টারমশাই  ও বাচ্ছাদের জন্য নিয়মিত দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। হলুদ - মেরুন ইউনিফর্মে বাচ্ছাগুলো যখন দল বেঁধে স্কুলে আসে, তখন দেখতে  খুব সুন্দর লাগে। বাচ্ছাগুলোর মধ্যে দেখলাম খুবই শেখার অগ্রহ রয়েছে। স্কুলে খুবই ডিসিপ্লিন বজায় আছে। শুনলাম কোনো এক বছরে এই স্কুলটা সামগ্রিক বিচারে পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিরোপা পেয়েছিল। এছাড়া কমিউনিটি ডেভেলপমেনন্টের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। গ্রামের বহু গরিবদের বিনামূল্যে জামা-কাপড় ও কম্বল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।   ২০০৬ সালে একটা দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। দু-একজন দক্ষ চিকিৎসক নিয়মিত চিকিৎসা করে থাকেন।  গ্রামের হতদরিদ্র্যদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। সল্পমূল্যে ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে।

খাবার জায়গা 
রান্নাঘর 

সবুজায়ন প্রধান হলেও এখানে  দু-একদিন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।  এখানে রান্না করা হয়ে থাকে খোলা উনুনে কাঠের আগুনে। রান্নাও সম্পূর্ণ ঘরোয়া পদ্ধতিতে করা হয়, কোনোপ্রকার আড়ম্বর এখানে দেখা যায় না।  থাকার জন্য চার-পাঁচটি ঘর রয়েছে।  ঘরগুলো খুবই সুন্দর। এদের নিজস্ব সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার দিলীপ মাহাতো, প্রদীপ পাত্র, দীপক দত্ত, শিবু তন্তুবায়, জয়তীদেবী  ও দেবেনের ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। সবাই সদা হাস্যময়, সেবায়  সবসময় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে।
টটকো বাঁধে সূর্য্যাস্ত 

 ভালোপাহাড়ের থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটা সুন্দর গ্রাম রয়েছে।  এছাড়া এখন থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে টটকো বাঁধ (ভেলু  ড্যাম) রয়েছে। এই ড্যামে সূর্যাস্তের দৃশ্য খুবই মনোরম। ঝাড়খণ্ডের সাতগুরুং নদী ও মনোরম দলমা পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে বেশ ভালো লাগে। পশ্চিমবঙ্গের দুয়াসিনি পেরিয়ে বান্দোয়ানে যেতে হয়।  দুয়ারসিনির কাছেই সাতগুরুং নদীটি তির তির করে বয়ে চলেছে। আপনি ইচ্ছে করলে এই নদীর তীরে বা দলমার কোলে কিছুক্ষন সময় অতিবাহিত করতে পারেন।  প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যেতে চাইলে এখানে অবশ্যই দুটো দিন কাটিয়ে যেতে পারেন। ভালোপাহাড় হলো একটা নেশা।  এখানে আসলে আপনিও এই নেশায় বুদ্ হয়ে যাবেন। নেশার টানে বার বার এখানে আসতে মন চাইবে। রাস্তার নৈসগ্রিক দৃশ্য আপনাকে বারবার হাতছানি দেবে।

জয় বৃক্ষনাথের জয় 


কিভাবে যাবেন :
 সকলের ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরে গালুডি স্টেশনে এসে নামুন।  ওখান থেকে ভালোপাহাড় যাওয়ার অটো পেয়ে যাবেন। তবেএখানে থাকতে হলে আগে থেকে নীচের ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করে আসতে হবে, না হলে থাকার জন্য কোনো ঘর পাওয়া যাবে না।

ঠিকানা :
কমল চক্রবর্তী , "ভালোপাহাড়", কুঁচিয়া, বান্দোয়ান, পুরুলিয়া, পিন ৭২৩১২৯

ফোন নাম্বার :
৯৪৭৪৪৬২২৩৮ এবং  ৯৪৩১১৮৬২৫০


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :২৩-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Sunday, October 6, 2019

কলকাতার প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা >

বলরাম বসু ঘাট ও কলকাতার প্রথম বারোয়ারী  দুর্গাপূজা 



ঠাকুরদালানের প্রবেশদ্বার 

দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত অঞ্চলের নাম ভবানীপুর।  এককালে বর্ধিষ্ণু বাঙালির বাস ছিল এই অঞ্চলে,  তবে বর্তমানে অঞ্চলটি সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। অঞ্চলটিতে রয়েছে বাঙালির সাথে বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন মানুষের সহাবস্থান।  এই অঞ্চলের সাথে যেমন জড়িয়ে আছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, আশুতোষ মুখার্জী, উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়ের নাম, তেমন কলকাতার বিখ্যাত দু-দুটি হাসপাতাল এস, এস, কে এম ও শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালও এই অঞ্চলেই অবস্থিত। এই অঞ্চলেই একটা ছোট্ট গলিপথ রয়েছে। বলরাম বসু ঘাট রোড। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোড থেকে আদি গঙ্গার তীর পর্যন্ত বিস্তিত এই ছোট্ট গলিটি। কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাসে এই ছোট্ট গলিটার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

২০১৯ এর  পুজোর বিজ্ঞাপন 

বলরাম বসু ঘাট আদি গঙ্গার বুকে গড়ে ওঠা এক বহু সুপ্রাচীন ঘাট।  সতী ঘাট। এই ঘাটেই সতীদাহ প্রথা বন্ধের শেষ সময় মুখার্জী বাড়ির দুই বঁধূ  সতী  হয়েছিলেন।  ঘাটে এখনো একটা সতীদাহের স্মৃতি ফলক রয়েছে, যা গঙ্গা থেকে উদ্ধার হয়েছিল বলে কথিত রয়েছে। তাই এই ঘাটকে সতীস্থানও বলা হয়ে থাকে। খুবই পুন্য ঘাট।
 
গঙ্গা থেকে উদ্ধার হয় ফলক 
রানী রাসমণি এই ঘাটে স্নান করে কালীঘাটের কালী মন্দিরে পূজা দিতে যেতেন।  রানী রাসমণির সময় স্বর্গীয় বলরাম বসু ছিলেন একজন ধনী ব্যক্তি। ঘাটটি প্রথম কে সংস্কার করেছিলেন এই নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।  কেউ বলেন রানী রাসমণি সংস্কার করে দিয়েছিলেন আবার কারো কারো মতে বলরাম বসু মহাশয় সংস্কার করেছিলেন। ঘাটেই রয়েছে দুটি শিবমন্দির ও একটা জগন্নাথ মন্দির।  সরকারি সাহায্যে ও পল্লীবাসীদের অনুদানে ঘাটের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটা বিশাল ঠাকুর দালান। পরবর্তীকালে স্বর্গীয় নন্দদুলাল ঘোষ মহাশয় ঘাটটি ও ঠাকুরদালানটিকে সংস্কার করে দিয়েছিলেন। 

ঘাটের জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহ 

এই ঠাকুর দালানে প্রতিবছর দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা ও অন্নপূর্ণা পূজা বেশ ঘটা  করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সব পূজাতেই ভক্তরা গঙ্গা স্নান করে খালি পায়ে শিবমন্দিরে পূজা দেওয়ার পর দূর্গা বা অন্যপূজার অঞ্জলি দিয়ে থাকেন।

ঘাটের শিব মন্দিরের বিগ্রহ 

তারপর মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করার পড়েই  উপবাস ভঙ্গ করেন। জনশ্রুতি আছে যে এই সতীস্থানে কেউ কোনো মানদ  করলে তা সফল হয়।

দেবী মূর্তি 

আজ থেকে ১১০  বছর আগে অর্থাৎ ১৯১০  সালে আদি গঙ্গার তীরে এই ঘাটের পাশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কয়েকজন (১২ জন) বাঙালি ব্রাহ্মণ পল্লীবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এখানকার দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। এই বারোজনের মধ্যে কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। সেই থেকে আজও সমগ্র পূজাটি পরিচালনা করে থাকে  "ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা"। জমিদার বাড়ি, ধনী পরিবারের বেড়া ভেঙে এখানেই তিলোত্তমার বুকে  সর্বপ্রথম সকল পল্লীবাসীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমগ্র পূজা পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যা আজও স্বমহিমায় সৌভাতৃত্ত্ব ও সৌহার্দ্য পরিবেশ বজায় রেখে অনুষ্ঠিত হয়ে চলছে। যা কলকাতার বুকে সর্বপ্রথম সর্ব্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা বলে স্বীকৃত। 

আমরা জানি বাংলায় সর্বপ্রথম বারোয়ারি বা সর্বজনীনভাবে পুজো হয়েছিল হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় ১৭৯০ সালে। সেখানে বারোজন  যুবক বিন্দুবাসিনীতলার জঙ্গল পরিষ্কার করে সকলের আর্থিক সাহায্যে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিল, সেটাই বাংলার বুকে প্রথম বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজো হিসেবে পরিচিত।

বলরাম বসু ঘাট 
  
সুবৃহৎ পাকা ঠাকুরদালান, ঠাকুরদালানের প্রবেশপথটি মন্দিরের মতো করে তৈরী, মেঝেতে পাথর বসানো,  বৃহৎ হল ঘরেতে একচালার দেবী মূর্তি বিরাজ করছে।  দেবী মূর্তিটি স্বর্ণলংকারের সজ্জিত  পুজোর কটাদিন পাড়ার পুরুষ, মহিলারা ও সেবাইতরা ঠাকুর দালানে উপস্থিত থাকেন। এই সময় বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা উপস্থিত হয়। একজন বয়স্ক কর্মকর্তা শ্রী অরুন মুখোপাধ্যায় জানালেন যে  ষষ্ঠীতে বোধন,  সপ্তমীতে নবপত্রিকার প্রবেশ ও স্থাপন, অষ্টমীতে অঞ্জলি, সন্ধিপূজা, নবমীতে হোম ও কুমারী পূজা, দশমীতে দশমী পূজার পর অপরাজিতা পূজা ও সিঁদুর খেলা অনুষ্ঠিত হয়।  তারপর সাতজন ব্রাহ্মণ মিলে দেবীকে প্রদক্ষিণ করেন, তারপর সন্ধ্যায় দেবীকে পল্লীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরিয়ে এই ঘাটেই বিসর্জন দেওয়া হয়। এখানে গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা মতে পূজা হয়ে থাকে। পঞ্জিকার  প্রতিটি নিয়ম বেশ কঠোরভাবে পালিত হয়ে থাকে। এখানে কোনোরূপ বলি দেওয়া হয় না। দেবীর সব অস্ত্রই পিতলের। জনৈক ভক্ত অস্ত্রগুলো দান করেছিলেন। প্রতিবছর এই অস্ত্রই দেবীর হাতে বিরাজ করে। পাঁচজন প্রধান পুরোহিত ও সাথে দশজন সহযোগী পুরোহিত সমগ্র পুজোটি পরিচালনা করে থাকেন।  পাঁচজন প্রধান পুরোহিতের মধ্যে একজন তন্ত্রসাধক, একজন চন্ডীপাঠ বিশেষজ্ঞ ও আরেকজন জপ বিশেষজ্ঞ থাকেন।  এই পুরোহিতরা বংশ পরম্পরায় এখানে পূজা করে আসছেন।  ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে দেবীকে খিচুড়ী ভোগ আর দশমীর দিন পান্তা ভাত ও কঁচুশাক উৎসর্গ করা হয়। বিভিন্ন পূজা ছাড়াও সংগঠকরা সারাবছরই নানারকম সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে  যেমন রক্তদান শিবির, চক্ষু পরীক্ষা শিবির ও বস্ত্রদান ইত্যাদি। পূজার দিনগুলোতে সানাই বাদনের ব্যবস্থা থাকে, এখানে কোনোরূপ মাইকের বা কোনোরূপ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয় না।  পূজার কটাদিন খুবই শান্ত পরিবেশ বজায় থাকে।  
  
আদি গঙ্গার  বুকে বলরাম বসু  ঘাটের  বিপরীত ঘাট 


থিম পূজা যতই চিত্তাকর্ষক হোক বা যতই দৃষ্টিনন্দন হোক, সেখানে যতই মানুষের ঢল আছড়ে পড়ুক। এখানকার পুজোর কর্তাব্যক্তিদের কিন্তু তাতে কোনো আগ্রহ নেই। বাজারের থিমের দৌড়ে শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া এই পূজা কোনোদিন যোগ দেয়নি। ভবিষ্যতে কোনোদিন যোগ দেওয়ার কোনোরূপ ইচ্ছেও তাদের নেই। শুধু তাই নয়, শহরের অন্যান্য পুজোগুলির মতো কোনো পুরস্কারের দৌড়ে সামিল হওয়ার কথাও এরা কোনোদিন ভাবেনি। ঐতিহ্য ও চিরাচরিত আচার অনুষ্ঠানই এই পুজোর বৈশিষ্ট। পল্লীবাসীদের জন্য  বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাই এরা  প্রধান কর্তব্য বলে মনে করে।





ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :০৬-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Thursday, October 3, 2019

মূর্তিপূজা >

 মূর্তিপূজা



হিন্দু দৃষ্টিতে একমাত্র পরম আরাধ্য দেবতা হলেন ভগবান বা ঈশ্বর। আমাদের  ধারণা ঈশ্বর সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান। ঈশ্বরের বা পরমেশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতার বলে এই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে বলে ধরা হয়। তাঁরই করুণায় বিশ্বের জীবের  অস্তিত্ত্ব বিদ্যমান ও অন্তিমে বিলীন হওয়া। হিন্দুদের বিশ্বাস ঈশ্বরই দেবতারূপে বিভিন্ন সময় বিভিন্নরূপে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হন। ঈশ্বরই আমাদের পথ প্রদর্শক। আমরা জানি যে মূর্তি ঈশ্বর নয়, ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে আমরা মূর্তিকে পূজা করে থাকি। মূর্তি একটা মাধ্যম মাত্র। মূর্তিকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে প্রকৃতপক্ষে আমরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপসনা করি। মূর্তিপূজা হল উৎসবের আনন্দ, জনসমাবেশ ও জন্যসংযোগের উপায়। মূর্তিপূজার প্রচলনের বর্ণনা ঘটলে আমরা দেখতে পাই যে সুপ্রাচীনকালে মূর্তিপূজার কোনো অস্তিত্ব ছিল না।   

আদিম যুগে শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বিশ্বের প্রায় সকল দেশে প্রাণস্পন্দন ও প্রাণস্পন্দনহীন প্রাণী ও পদার্থের পূজা আরাধনার প্রচলন ছিল।  আদিম ও অনুন্নত যুগে বিদেহী আত্মা, ভূত-প্রেত প্রভৃতি অপদেবতাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পূজার প্রচলন ছিল।  প্রাচীনকালে বৃক্ষকে কল্পনা করা হত  সূর্যের আশ্রয়রূপে। আকাশের সাথে বৃক্ষের সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হত।  যেসব বৃক্ষগুলি সুউচ্চ ও সুপ্রসারিত যেমন, বট, অশ্বথ, বেল, নিম এগুলোকে আকাশ বা সূর্যের অশ্রয়স্থল হিসেবে ধরা হত।  এই সুউচ্চ বৃক্ষগুলোকে পূজা করার রীতি চালু ছিল।

বৃক্ষ পূজার পর এল যূপ ও স্তুপ পূজা। এগুলো বৈদিক যাগ যজ্ঞে ব্যৱহৃত হত। যূপ থেকেই ক্রমে শিবলিঙ্গের উৎপত্তি এবং বিকাশ হয়েছে।   যূপ ও বৃক্ষ পূজা আর্য সভ্যতার নিদর্শন। দেবী দুর্গার পূজা গোড়ার দিকে বট, অশ্বথ, বেল, নিম ইত্যাদি বৃক্ষে করা হত।  বেল বৃক্ষকে দেবী দূর্গা ভাবা হত। ষষ্ঠী তিথিতে বিল্ল বৃক্ষের পূজার পর সপ্তমীর প্রাতঃকালে বৃক্ষরূপিণী দেবী দুর্গার স্নান  করা হয়।  শাঁখ , ঘন্টা কাঁসর, ও ঢাক বাজিয়ে সেই শাখাদেবীকে পূজা মণ্ডপে আনা হয়। বৈদিক সম্প্রদায়ের অনুকরণে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে মূর্তি পূজা প্রবর্তিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। মূর্তিপূজা ভারতবর্ষের সকল প্রদেশেই প্রচলিত আছে।  তবে পশ্চিমবঙ্গে আর প্রচলন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

দুর্গার দ্বিভূজা, চতুর্ভূজা, অষ্টভূজা, দশভূজা, দ্বাদশভূজা ও অস্টাদশভূজা মূর্তির কথা পূরাণে বলা আছে।  এই সকল মূর্তির সমস্ত মূর্তিই সকল দেশে পূজ্য নয়। তবে বাংলায় আমরা দশভুজা মূর্তি পূজা করে থাকি।

আমরা যখন কোনো বিদ্বান ব্যক্তিকে সম্মান জানাই তখন তাঁর বিদ্যাকেই সম্মান জানাই, কখনোই তাঁর রক্তমাংসের শরীরটাকে সম্মান জানাই না। তেমনি আমরা যখন কোনো মূর্তিকে পূজা করি তখন আসলে ঈশ্বরকেই সম্মান জানিয়ে থাকি। কোনো মূর্তিকে সম্মান জানাই না। মূর্তিতো ঈশ্বরের প্রতীকরূপে আমাদের কাছে আসে।

বাঙালি সমাজ দেবী মূর্তির মধ্যেই মায়ের ভালোবাসা খুঁজে পায়। ঈশ্বরের প্রতিরূপ মূর্তিই সকল জীবের মা হয়ে বিরাজ করেন। তাই তো বলা হয়ে থাকে "যা দেবী  সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা"।

 ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :০৩-১০-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।