Sunday, October 6, 2019

কলকাতার প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা >

বলরাম বসু ঘাট ও কলকাতার প্রথম বারোয়ারী  দুর্গাপূজা 



ঠাকুরদালানের প্রবেশদ্বার 

দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত অঞ্চলের নাম ভবানীপুর।  এককালে বর্ধিষ্ণু বাঙালির বাস ছিল এই অঞ্চলে,  তবে বর্তমানে অঞ্চলটি সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। অঞ্চলটিতে রয়েছে বাঙালির সাথে বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন মানুষের সহাবস্থান।  এই অঞ্চলের সাথে যেমন জড়িয়ে আছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, আশুতোষ মুখার্জী, উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়ের নাম, তেমন কলকাতার বিখ্যাত দু-দুটি হাসপাতাল এস, এস, কে এম ও শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালও এই অঞ্চলেই অবস্থিত। এই অঞ্চলেই একটা ছোট্ট গলিপথ রয়েছে। বলরাম বসু ঘাট রোড। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোড থেকে আদি গঙ্গার তীর পর্যন্ত বিস্তিত এই ছোট্ট গলিটি। কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাসে এই ছোট্ট গলিটার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

২০১৯ এর  পুজোর বিজ্ঞাপন 

বলরাম বসু ঘাট আদি গঙ্গার বুকে গড়ে ওঠা এক বহু সুপ্রাচীন ঘাট।  সতী ঘাট। এই ঘাটেই সতীদাহ প্রথা বন্ধের শেষ সময় মুখার্জী বাড়ির দুই বঁধূ  সতী  হয়েছিলেন।  ঘাটে এখনো একটা সতীদাহের স্মৃতি ফলক রয়েছে, যা গঙ্গা থেকে উদ্ধার হয়েছিল বলে কথিত রয়েছে। তাই এই ঘাটকে সতীস্থানও বলা হয়ে থাকে। খুবই পুন্য ঘাট।
 
গঙ্গা থেকে উদ্ধার হয় ফলক 
রানী রাসমণি এই ঘাটে স্নান করে কালীঘাটের কালী মন্দিরে পূজা দিতে যেতেন।  রানী রাসমণির সময় স্বর্গীয় বলরাম বসু ছিলেন একজন ধনী ব্যক্তি। ঘাটটি প্রথম কে সংস্কার করেছিলেন এই নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।  কেউ বলেন রানী রাসমণি সংস্কার করে দিয়েছিলেন আবার কারো কারো মতে বলরাম বসু মহাশয় সংস্কার করেছিলেন। ঘাটেই রয়েছে দুটি শিবমন্দির ও একটা জগন্নাথ মন্দির।  সরকারি সাহায্যে ও পল্লীবাসীদের অনুদানে ঘাটের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটা বিশাল ঠাকুর দালান। পরবর্তীকালে স্বর্গীয় নন্দদুলাল ঘোষ মহাশয় ঘাটটি ও ঠাকুরদালানটিকে সংস্কার করে দিয়েছিলেন। 

ঘাটের জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহ 

এই ঠাকুর দালানে প্রতিবছর দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা ও অন্নপূর্ণা পূজা বেশ ঘটা  করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সব পূজাতেই ভক্তরা গঙ্গা স্নান করে খালি পায়ে শিবমন্দিরে পূজা দেওয়ার পর দূর্গা বা অন্যপূজার অঞ্জলি দিয়ে থাকেন।

ঘাটের শিব মন্দিরের বিগ্রহ 

তারপর মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করার পড়েই  উপবাস ভঙ্গ করেন। জনশ্রুতি আছে যে এই সতীস্থানে কেউ কোনো মানদ  করলে তা সফল হয়।

দেবী মূর্তি 

আজ থেকে ১১০  বছর আগে অর্থাৎ ১৯১০  সালে আদি গঙ্গার তীরে এই ঘাটের পাশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কয়েকজন (১২ জন) বাঙালি ব্রাহ্মণ পল্লীবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এখানকার দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। এই বারোজনের মধ্যে কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। সেই থেকে আজও সমগ্র পূজাটি পরিচালনা করে থাকে  "ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা"। জমিদার বাড়ি, ধনী পরিবারের বেড়া ভেঙে এখানেই তিলোত্তমার বুকে  সর্বপ্রথম সকল পল্লীবাসীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমগ্র পূজা পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যা আজও স্বমহিমায় সৌভাতৃত্ত্ব ও সৌহার্দ্য পরিবেশ বজায় রেখে অনুষ্ঠিত হয়ে চলছে। যা কলকাতার বুকে সর্বপ্রথম সর্ব্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা বলে স্বীকৃত। 

আমরা জানি বাংলায় সর্বপ্রথম বারোয়ারি বা সর্বজনীনভাবে পুজো হয়েছিল হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় ১৭৯০ সালে। সেখানে বারোজন  যুবক বিন্দুবাসিনীতলার জঙ্গল পরিষ্কার করে সকলের আর্থিক সাহায্যে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিল, সেটাই বাংলার বুকে প্রথম বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজো হিসেবে পরিচিত।

বলরাম বসু ঘাট 
  
সুবৃহৎ পাকা ঠাকুরদালান, ঠাকুরদালানের প্রবেশপথটি মন্দিরের মতো করে তৈরী, মেঝেতে পাথর বসানো,  বৃহৎ হল ঘরেতে একচালার দেবী মূর্তি বিরাজ করছে।  দেবী মূর্তিটি স্বর্ণলংকারের সজ্জিত  পুজোর কটাদিন পাড়ার পুরুষ, মহিলারা ও সেবাইতরা ঠাকুর দালানে উপস্থিত থাকেন। এই সময় বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা উপস্থিত হয়। একজন বয়স্ক কর্মকর্তা শ্রী অরুন মুখোপাধ্যায় জানালেন যে  ষষ্ঠীতে বোধন,  সপ্তমীতে নবপত্রিকার প্রবেশ ও স্থাপন, অষ্টমীতে অঞ্জলি, সন্ধিপূজা, নবমীতে হোম ও কুমারী পূজা, দশমীতে দশমী পূজার পর অপরাজিতা পূজা ও সিঁদুর খেলা অনুষ্ঠিত হয়।  তারপর সাতজন ব্রাহ্মণ মিলে দেবীকে প্রদক্ষিণ করেন, তারপর সন্ধ্যায় দেবীকে পল্লীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরিয়ে এই ঘাটেই বিসর্জন দেওয়া হয়। এখানে গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা মতে পূজা হয়ে থাকে। পঞ্জিকার  প্রতিটি নিয়ম বেশ কঠোরভাবে পালিত হয়ে থাকে। এখানে কোনোরূপ বলি দেওয়া হয় না। দেবীর সব অস্ত্রই পিতলের। জনৈক ভক্ত অস্ত্রগুলো দান করেছিলেন। প্রতিবছর এই অস্ত্রই দেবীর হাতে বিরাজ করে। পাঁচজন প্রধান পুরোহিত ও সাথে দশজন সহযোগী পুরোহিত সমগ্র পুজোটি পরিচালনা করে থাকেন।  পাঁচজন প্রধান পুরোহিতের মধ্যে একজন তন্ত্রসাধক, একজন চন্ডীপাঠ বিশেষজ্ঞ ও আরেকজন জপ বিশেষজ্ঞ থাকেন।  এই পুরোহিতরা বংশ পরম্পরায় এখানে পূজা করে আসছেন।  ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে দেবীকে খিচুড়ী ভোগ আর দশমীর দিন পান্তা ভাত ও কঁচুশাক উৎসর্গ করা হয়। বিভিন্ন পূজা ছাড়াও সংগঠকরা সারাবছরই নানারকম সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে  যেমন রক্তদান শিবির, চক্ষু পরীক্ষা শিবির ও বস্ত্রদান ইত্যাদি। পূজার দিনগুলোতে সানাই বাদনের ব্যবস্থা থাকে, এখানে কোনোরূপ মাইকের বা কোনোরূপ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয় না।  পূজার কটাদিন খুবই শান্ত পরিবেশ বজায় থাকে।  
  
আদি গঙ্গার  বুকে বলরাম বসু  ঘাটের  বিপরীত ঘাট 


থিম পূজা যতই চিত্তাকর্ষক হোক বা যতই দৃষ্টিনন্দন হোক, সেখানে যতই মানুষের ঢল আছড়ে পড়ুক। এখানকার পুজোর কর্তাব্যক্তিদের কিন্তু তাতে কোনো আগ্রহ নেই। বাজারের থিমের দৌড়ে শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া এই পূজা কোনোদিন যোগ দেয়নি। ভবিষ্যতে কোনোদিন যোগ দেওয়ার কোনোরূপ ইচ্ছেও তাদের নেই। শুধু তাই নয়, শহরের অন্যান্য পুজোগুলির মতো কোনো পুরস্কারের দৌড়ে সামিল হওয়ার কথাও এরা কোনোদিন ভাবেনি। ঐতিহ্য ও চিরাচরিত আচার অনুষ্ঠানই এই পুজোর বৈশিষ্ট। পল্লীবাসীদের জন্য  বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাই এরা  প্রধান কর্তব্য বলে মনে করে।





ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :০৬-১০-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



No comments: