Friday, September 27, 2019

মহালয়া অমাবস্যা >

মহালয়া অমাবস্যা 

মহালয়া এই শব্দটি বলতে আমরা বুঝি সাত সকালে উঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে শোনা চন্ডীপাঠ আর মায়ের মর্ত্যে আগমনের বার্তাকে।  কিন্তু এই দিনই পিতৃপক্ষের শেষদিন।  পরদিন দেবীপক্ষের শুরু।  দেবীপক্ষের শুরু মানেই দূর্গা দুর্গতিনাশিনীর আরাধনার শুরু, বাঙালির শারদীয়া উৎসবের শুরু।  পিতৃপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ মহালয়ার দিন গঙ্গার ঘাটে ঘাটে দেখা যায় ষোলো শ্রাদ্ধ উৎযাপন হতে। হিন্দু রীতি অনুসারে মহালয়া হল প্রয়াত পূর্ব পুরুষদের তর্পনের মাধ্যমে স্মরণ করে তাদের শান্তি কামনার উদ্দেশ্যে জলদান করা হয়।  পিতৃপক্ষ নিয়ে আত্মার মোক্ষলাভের কথা মার্কন্ডেয় পূরণে বলা আছে।  দেবীপক্ষের সাথে যেমন  দুর্গাপুজোর যোগ আছে, তেমন পিতৃপক্ষের সাথে মহাভারতের যোগ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে মহাভারতে একটি আখ্যান রয়েছে।

মহাভারতে কর্ণকে আমরা সবাই জানি দাতা কর্ণ হিসেবে। কর্ণ সারাজীবন সোনা, রুপা, হীরে, জহরত দান করে এসেছেন। তিনি কোনো মানুষকে কোনোদিন কোনো খাবার বা পোশাক দান করেননি।  কর্ণের দাতার  ভূমিকা অর্থাৎ তার এইসব ভালো কাজের জন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর  তিনি স্বর্গরাজ্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন।  স্বর্গরাজ্যে যখন তার  আত্মার ক্ষিদে পেল, সে খেতে চাইল, তখন তাকে খাদ্য-পানীয়ের বদলে সোনা, রুপা, হীরে, জহরত খেতে দাওয়া হল।  কর্ণ অবাক হয়ে যমরাজের (মতান্তরে দেবরাজ ইন্দ্র ) কাছে জানতে চাইলেন, এগুলোর মানে কি? যমরাজ তাকে বলল দাতা হিসেবে তুমি খুবই ভালো কাজ করেছ, তাই তোমার স্বর্গলাভ হয়েছে।  কিন্তু তুমি দান হিসেবে সবাইকে সোনা, রুপা, হীরে, জহরত দান করেছ। কোনদিন কোন  বুভুক্ষ মানুষকে কোন খাবার দান করোনি। নিজের পূর্বপুরুষদের কথা কখনো ভাবোনি, তাদের কখনো খাবার বা জলদান করোনি। পূর্বপুরুষদের গমন পথে কোনোদিন আলোক প্রজ্জলিত করোনি। দাতার পুণ্যলাভের জন্য তুমি  স্বর্গে এসেছ ঠিকই, কিন্তু তুমি  খাদ্য-পানীয় পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হওনি।  তাই  তোমার এই পরিণতি হয়েছে।

কর্ণ যমরাজকে জানালেন তার পূর্ব পুরুষদের তিনি চেনেন না।  জন্ম মুহূর্ত থেকেই আমার মা আমায় ত্যাগ করে চলে গেছেন। সুত বংশজাত অধিরথ ও তাঁর পত্নী আমায় প্রতিপাল্ন করেন। আমার  বীরত্ত্ব ও শৌয্য  দেখে দুর্যোধন আমায় আশ্রয় দেন।  কুরুক্ষেত্ত্রের  যুদ্ধ শুরুর  আগে দিন প্রথমে কৃষ্ণ ও পরে মাতা কুন্তী আমায় আমার জন্ম ও বংশ পরিচয় জানান। এরপর যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেলো। পূর্ব পুরুষদের জল দেওয়ার সময় পাইনি তো।  তাহলে এখন উপায় কি? আমি কি কোনোদিনই খাদ্য বা পানীয় পাবো না। যমরাজ তাকে বললেন খাদ্য-পানীয় পেতে হলে তোমাকে আবার মর্ত্যে ফিরে  যেতে হবে এবং পূর্ব পুরুষদের জলদান করতে হবে।

যমরাজ তখন তাকে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ  তিথিতে ১৪ দিনের  জন্য আবার মর্ত্যে পাঠালেন। কর্ণ মর্ত্যে এসে এই ১৪ দিন সমস্ত বুভুক্ষ মানুষকে পেটভরে খাওয়ালেন, বুভুক্ষ মানুষদের আত্মার শান্তি ঘটালেন, মনের পরিতৃপ্তি পূরণ করলেন। পূর্ব পুরুষদের তিল ও জল দান  করলেন।  ১৪ দিন পর তিনি আবার স্বর্গে ফিরে আসলেন।  স্বর্গে এবার তাকে নানা পদের নানারকম খাবার খেতে দেওয়া হল।  কথিত আছে কর্ণের এই ১৪ দিনের  মর্ত্য সফরকে  পিতৃপক্ষ এবং মহালয়ার সময়কাল বলা হয়।  সেই থেকেই মহালয়ার দিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পিতৃ  পুরুষদের উদ্দেশ্যে তিল ও জলদান করার রীতি প্রচলিত হয়েছে।  মহালয়ার অমাবস্যাকে সর্বপিতৃ অমাবস্যা, পিতৃ অমাবস্যা, পেডালা অমাবস্যা, মহালয়া অমাবস্যা বলেও অভিহিত করা হয়। তর্পনকারী প্রথমে ব্রহ্ম, বিষ্ণু ,ও মহাদেবকে জলদান করে। তারপর মানব শ্রেণীকে জলদান করে। মহালয়া অমাবস্যা তিথি থেকে পরের অমাবস্যা অর্থাৎ কালী পূজার অমাবস্যা পর্যন্ত পূর্ব পুরুষরা মর্ত্যে থাকেন বলে শাস্ত্রকারদের বা মানুষের অনুমান। 

মহালয়া পিতৃ পুরুষদের জলদান করার তিথি। মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপূজার কোনো যোগ নেই, যোগ নেই আকাশবাণীর প্রচারিত "মহিষাসুরমর্দিনী" গীতিআলেখ্যটিরও।


 ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :০৩-০৯-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Sunday, September 22, 2019

ফুলের বাজারে পূজার গন্ধ >

ফুলের বাজারে পূজার গন্ধ 


আমাদের তিলোত্তমায় বাজারের সংখ্যা প্রচুর।  বিচিত্র রকমের বাজার দেখা যায়।  শহরের জনবহুল ব্যস্ততম বাজারগুলির মধ্যে অন্যতম হল গঙ্গাতীরবর্তী মল্লিকঘাটে অবস্থিত ফুলের বাজারটি।  এটি এশিয়ার বৃহত্তম ফুলের বাজার।


ফুল হল বিশ্ব ভালোবাসার সর্বজনীন এক অনন্য উপহারের উপকরণ।  ফুলের আদান প্রদানের মত  নান্দনিক সুন্দর কাজ আর নেই।  ফুল শুধু নান্দনিকতার উপকরণ নয়, পূজার অন্যতম উপকরণও বটে।  বিশ্ব পেক্ষাপটে আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভীত গড়তে  সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হতে দেখা গেছে।  বাংলার আবহাওয়া, মাটি ফুল চাষের জন্য খুবই সহায়ক।  এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীনকাল থেকেই ফুলের চাষ হয়ে আসছে। সজ্জায় বা পূজাপার্বনে ফুল সবসবসময়েই গ্রহণযোগ্য সামগ্রী।  পদ্ম, অপরাজিতা, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, শ্বেতচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা , দোলনচাঁপা, গাঁদা,  বকুল, রজনীগন্ধা, জবা, কদম, কৃষ্ণচূঁড়া, রাধাচূঁড়া, মাধবীলতা, নয়নতারা, পলাশ, শিউলি, টগর, শালুক, শাপলা প্রভৃতি কত শত  ফুলের নাম শোনা যায়।  এদের গন্ধে মানুষ মাতোয়ারা।  বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতেও ফুলের যথেষ্ট কদর আছে।  যদিও বর্তমানে গন্ধহীন প্লাস্টিকের ফুল গৃহসজ্জা ও অনুষ্ঠানাদিতে বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছে।  কিন্তু পূজা পার্বনে এইসব আর্টিফিশিয়াল ফুলগুলো এখনো কোনো দাঁত ফোটাতে পারেনি।  তবে দিনকে দিন যেভাবে আসল ফুলের  দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে কি হবে বলা মুশকিল। যতই প্লাস্টিকের ফুল ঘরে ঘরে সৌন্দর্যের প্রতীক হোক, কিন্তু আসল ফুলের গন্ধে মানুষ সব সময়ে মুগ্ধ থাকবেই। সেই স্থান কোনোদিনই নকল ফুলগুলো পূরণ করতে পারবে না। এজন্যই যেন বলা হয়  "ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়"।


গঙ্গার ধারে  হাওড়া ব্রিজের তলায় অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম ফুলের বাজার। হাওড়া ব্রিজের তলায় গড়ে ওঠা এই ফুলের বাজারে ভোর হয় সূর্য ওঠার অনেক আগেই।  রাত থাকতেই ট্রেন বা ট্রাক বোঝাই  করে ফুল আসে।  আসেন খদ্দরেরা।  কলকাতা ও রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে ও  বিয়েবাড়ি থেকে নিত্যপূজার  সমস্ত ফুলের  যোগান এই বাজার দিয়ে থাকে। শহর ও শহরতলি থেকে ভোর তিনটে থেকে রাত  দশটা পর্যন্ত প্রতিদিন ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের ভিড়ে গমগম করে এই সরু একফালি জায়গাটা। বর্তমানে ক্রেতা বিক্রেতার চাপে বাজারটা আর ওই এক ফালি জায়গাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।  বাড়তে বাড়তে তা স্ট্র্যান্ড রোডে এসে উপস্থিত হয়েছে।  প্রতিদিন কয়েক হাজার ক্রেতাকে যেমন দেখা যায় তেমন  প্রায় হাজারখানেক  বিক্রেতাকেও দেখা যায়।  দিনকে দিন চাহিদা বেড়েই চলেছে।  বিয়ে বা পূজা পার্বনের দিনগুলোতে তিলধারণের জায়গা থাকে না।  এখান  থেকে দেশের বিভিন্ন প্রদেশ ও বেশ কয়েকটি দেশেও ফুল রপ্তানি হয়ে থাকে।  এখানে প্রায় ২৫০ টি স্থায়ী দোকান ও ৩০০ টির মত ভেন্ডার রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন প্রায় লাখ  দশেক টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। অবস্থানগত কারণেও বাজারটি সকলকে বিস্মিত করে।  বাজারটির ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পুন্য সলিলা  গঙ্গা নদী আর ঠিক বিপরীত পাড়ে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে ব্যস্ততম হাওড়া স্টেশনটি রয়েছে।




 পচা ফুল-পাতায় জায়গাটা যেন এক নরককুন্ড।  এই নরককুণ্ডতেই প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতা বিক্রেতার সমাগম হয়, চলে লাখ লাখ টাকার লেনদেন। এইভাবেই অস্বাস্থকর পরিবেশে বাজারটি চলে প্রতিদিন প্রায় ২০ ঘন্টা ধরে।  দুপাশে স্তূপাকার ফুল ও ফুলের মালা মাঝের সরু জায়গাটা দিয়ে লোক  চলাচল ও ফুলবোঝাই ম্যাটাডোর চলাচল করে। এখানকার ক্রতা বিক্রতাদের ইচ্ছা ফুল বাজারটি "আধুনিক ফ্লাওয়ার মার্কেট"এ  পরিণত হোক। মল্লিকঘাট ফুলবাজারের অবস্থার উন্নতি ঘটানোর দু-একবার  চেষ্টা হলেও তা  এখনো পর্যন্ত সফল হয়নি। কয়েক বছর আগে সরকারি তরফ থেকে কিছু  পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, তা বিভিন্ন যাঁতাকলে আটকে রয়েছে। সংস্কারের কথা বহুবার শোনা গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বাজার সেই পূর্বের মতো হতশ্রী অবস্থাতেই রয়ে গেছে। বিপজ্জনকভাবে দুলতে দুলতে চলা ম্যাটাডোরের আঘাতে প্রতিদিন ছোটোখাটো দুর্ঘটনা লেগেই আছে।

সংস্কার হোক বা না হোক এই নরককুন্ডতেই দিকে দিকে  কিন্তু ফুলের সুবাস ছড়িয়ে  আছে, গেলে শুধু ফুলেরই নানারকম সুবাস নাকে আসে। রাশি রাশি ফুলের  স্তুপের পাশ দিয়ে আপনার হেঁটে  যাওয়াটা ভারী মনোরম লাগবে, আর আপনার জীবনে একটা দৃষ্টিনন্দন উপলব্ধি হয়ে উঠতে বাধ্য।

একজন বয়স্ক লোক গাঁদা, রজনীগন্ধার স্টিক  ও গোলাপ বিক্রি করছেন।  ওনার কাছ থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে দুটো রজনীগন্ধার স্টিক ও কিছু গোলাপ কিনে বাড়ির পথ ধরলাম। আমার মতো নগন্য একজন ক্রেতা যখন তার সামনে এসে দরদাম করছে তখন তার মুখে খেলে যাওয়া অনাবিল হাসি যা  দেখে আমার মনটা ভরে উঠেছিল, এই হাসি আমার জীবদ্দশায় সত্যি কোনোদিন  ভুলতে পারবো না। সারা রাস্তাটা রজনী গন্ধা ও গোলাপের সুবাস নিতে নিতে চললাম। স্মৃতির পাতায় এক মনরোম অনুভূতি  যোগ হলো, যা হয়তো কোনোদিন বিস্মৃতি হবে না।








ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :২২-০৯-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Tuesday, September 10, 2019

কলকাতার দুর্গাপূজা >

কলকাতার দুর্গাপূজা 




দুর্গাপূজা বাঙালিদের প্রধান উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা।  এই শহর হিন্দু প্রধান বাঙালি শহর হওয়ায় দুর্গাপূজার আধিক্য অন্যান্য জায়গার তুলনায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ১৬১০ সালে দক্ষিণ কলকাতার বেহালা অঞ্চলের বড়িশায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের শ্রী লক্ষীকান্ত রায়চৌধুরী শহরে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা প্রচলন করেন, যা পারিবারিক পূজা ছিল।  এই পূজা তাঁদের পরিবারের আটচালায় আজও আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়।  তবে বর্তমানে পরিবারের আরও সাত  শরিকের বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে।  আটচালাসহ ছয়টি পূজা বড়িশা অঞ্চলে আর একটি পূজা বিরাটি অঞ্চলে ও একটি বেলঘরিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব তাঁদের  পারিবারিক দুর্গাপূজা শুরু করেন।  এই পূজায় সেই আমলে ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ অধিকারিক  ও  শহরের অন্যান্য বিশিষ্টজনরা আমন্ত্রিত থাকতেন।   বাইজি নাচ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান ও তার সাথে মদ্যপানের আসর বসত। শহরে বাবু সম্প্রদায়ের প্রতীক হয়ে ওঠে পূজাটি। পূজাটিতে  শাস্ত্রাচার গৌণ ছিল, আনন্দানুষ্ঠানাদি প্রধান হিসেবে দেখা যেত।

পরবর্তীকালে রানী রাসমণি দেবী জানবাজারে তাঁদের বসতবাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। তিনি সম্পূর্ণ শুদ্ধাচারে পূজা করতেন।  তিনিও ইংরেজ অতিথি ও দেশীয় প্রজাদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রাখতেন। তাঁর পূজায় যাত্রানুষ্ঠান প্রধান ছিল।  রানীর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতাগণ নিজ নিজ বাসভবনে পূজার প্রচলন করেন।  ধীরে ধীরে শহর কলকাতার অন্যান্য ধনী পরিবারগুলোতেও দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়।

বিংশ  শতাব্দীর প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৯১০ সালে কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের বলরাম বসু ঘাট রোডে "সনাতন হিন্দু ধর্মোৎসহিনী সভার" সদস্যরা পাড়ার সকলকে নিয়ে দুর্গাপূজা আরম্ভ করে। এই পূজাটিই তিলোত্তমার বুকে প্রথম বারোয়ারী পূজা হিসেবে পরিচিত। আজও কঠোর নিয়মানুসারে পূজাটি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সার্বজনীন, ১৯১৩ সালে শ্যামবাজারের শিকদার বাগানে, ১৯১৯ সালে বাগবাজারে, ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতি বারোয়ারীভাবে পূজা শুরু করে। বর্তমানে শহরের অলিতে-গলিতে পূজা হতে দেখা যায়। শহরে প্রায় হাজার তিনেক বারোয়ারী  দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

১৯৮৫ সালে বারোয়ারী পূজাগুলোতে প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের প্রচলন হতে দেখা যায়।  এই বছরই এশিয়ান পেইন্টস বারোয়ারী পূজাগুলোতে "শারদ সম্মান" চালু করে। তিলোত্তমার বুকে  চালু হয়ে যায় থিম পূজা। মণ্ডপ সজ্জার  বদল দ্রুত গতিতে ঘটতে আরম্ভ করলো।  সাবেকিয়ানার বদলে চাকচিক্য ও আড়ম্বর বেড়ে যেতে দেখা গেলো। মানুষের মধ্যেও মণ্ডপের শিল্প নিয়ে তৈরী হতে লাগলো উৎসাহ ও উদ্দীপনা। পূর্বে বাঁশ-কাপড়ের মণ্ডপ আর সাবেকি প্রতিমাতে পূজা হতো। বর্তমানে পূজাকে ঘিরে শিল্পউৎসব শুরু হয়ে গেছে।

পরবর্তীকালে এশিয়ান পেইন্টসকে দেখে অন্যান্য বাণিজ্যিক সংস্থাও দুর্গাপূজায় শিল্প উৎকর্ষে নানারকম সম্মানের ডালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। থিম পূজাগুলোতে শুরু হয়ে গেছে তুমুল থিমের লড়াই। পূজা ঘিরে শুরু হয়ে গেছে প্রতিযোগিতা। থিম পূজাগুলোতে উঠে আসতে লেগেছে নানারকম শিল্প উৎকর্ষ। পূজার দৌলতে বহু বিলুপ্ত শিল্পও প্রাণ পেতে আরম্ভ করেছে।  উঠে আসতে  লাগলো আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্ররা ও চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠিত আর্ট ডিরেক্টররা থিম মেকার হিসেবে। এইসব থিম মেকারদের হাত ধরে পূজা মণ্ডপগুলো উদ্ভাষিত হতে লাগলো শিল্প উৎকর্ষে। বহু ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়েও অনবদ্য শিল্প সৃষ্টি হতে লাগলো।  বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মন্ত্রীরা এক একটি পূজার সাথে নিজেদের জড়িয়ে নিতে শুরু করলো। পূজাগুলোকে তাঁরা তাঁদের জনসংযোগের হাতিয়ার করলো।  তাঁদের পূজাগুলোতে  ও অন্যান্য নামি পুজোগুলোতে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো দরাজ হাতে টাকা দিয়ে পূজাকে আরো সমৃদ্ধ করতে লাগলো।  বহু দুস্থ শিল্পী এই থিম পূজায় মণ্ডপ সজ্জার কাজ করে আর্থিকভাবে উন্নত হতে লাগলো। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়তে লাগলো। থিমের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আলোকসজ্জা করা শুরু হলো। আলোকসজ্জাতে পূর্বে চন্দননগরের একচেটিয়া আধিপত্য থাকলেও বর্তমানে তাদের সাথে হাতে হাত রেখে বহু নবীন ও প্রবীণ আলোকশিল্পী তাদের আলোর খেলা দেখাচ্ছে।  থিমের পুজোয় মণ্ডপে আর পুরানো দিনের মতো চটুল গান শোনা যায় না।  সেই গানের বদলে থিম অনুযায়ী গান বা শব্দ ব্যবহার করা হয়।  এই কাজেও অনেক সংগীতশিল্পী ও সুরকার কাজ পাচ্ছে।

এখন কলকাতার দুর্গাপূজা সারা বিশ্বে একটা আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।  পূজার কটাদিন ভারত তথা বিশ্বের বহু শহর থেকে বহু পর্যটক তিলোত্তমায় এসে ভীড় জমান। ইউনেস্কো প্রতি বছর তাদের বিশ্ব সংস্কৃতি বিভাগে বেশ কয়েকটি নতুন শিল্পকে সংযোজিত করে।  ২০২০ সালের দুর্গাপূজাকে ইউনেস্কো তাদের মনোনয়নে রেখেছে। এটা দুর্গাপূজার ইতিহাসে একটা নতুন পালক হিসেবে দেখা দেবে। বাংলা তথা বাঙালির শিল্প নতুনভাবে বিশ্ব স্বীকৃতি লাভ করবে। পুজোর শিল্প সজ্জা নিয়ে সত্যিই আজ বাঙালির গর্বের দিন।



ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :১০-০৯-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 







Monday, September 2, 2019

শহীদ মিনার >

কলকাতা

শহীদ মিনার 


শহীদ মিনার 


ময়দানের এক কোনে  মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে।  বয়স তার প্রায় দুই শতক হতে চলল। এখানে দাঁড়িয়ে সে দীর্ঘদিন ধরে শহরের কত ইতিহাস, কত ঘটনাকে চাক্ষুষ করে চলেছে।  কত সুখ দুঃখের সাথী।  তারই পদতলে কত নেতা কত মিটিং করেছে বহুকাল ধরে।  সে যে আমাদের তিলোত্তমার হাটথ্রম, সে যে আমাদের প্রাণের মিনার, আমাদের শহীদ মিনার। 

কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা। এই প্রাণকেন্দ্রের প্রাণবিন্দু হল অক্টালোরি মনুমেন্ট (Octerloney  Monument).বা শহীদদের  স্মরণে মিনার। দেখতে দেখতে প্রায় ১৯০ টা বছর পার হয়ে গেলো।  ১৫৮ ফুট উচ্চতা নিয়ে এখনো একপায়ে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার অন্যতম স্মৃতিস্তম্ভটি।  বিখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টুইন তাঁর কলকাতা ভ্রমণের  সময়  বলে গিয়েছিলেন "Cloud Kissing Monument"

১৮০৪ সালে ইন্দো-নেপাল যুদ্ধে গোর্খাদের বিরুদ্ধে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিযা  কোম্পানির কমান্ডার মেজর জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টালনি।  তিনি এই যুদ্ধে কোম্পানির পতাকাকে বিজয় পতাকাতে পরিণত করেছিলেন। তাঁর অক্লান্ত লড়াই ও কোম্পানি বাহিনীর বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে ব্রিটিশ সরকার এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেছিল।  সৌধটির নকশা তৈরী করে দিয়েছিলেন জে পি পার্কার। ১৯২৮ সালে সরকারি কোষাগারের অর্থ সাহায্যে ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে সৌধটি নির্মিত হয়েছিল। কলকাতা ময়দানের উত্তর-পূর্ব কোণে মিনারটি অবস্থিত।  সৌধটি উচ্চতায়  ১৫৮ ফুট, ভিতরে ২২৩ টি কুন্ডলি আকারের সিঁড়ি রয়েছে।গম্বুজটির ওপরে দুটি বারান্দা রয়েছে।  মিনারটির নিচের অংশ মিশরীয় স্থাপত্যে আর উপরের অংশটি সিরীয় এবং গম্বুজটি তুর্কি শৈলীতে তৈরী।  বার্ন এন্ড কোম্পানি মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন।  মিনারটির দক্ষিণ দিকে একটা বিরাট মাঠ রয়েছে।  এককালে এই মাঠটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ও নানারকম মেলা আয়োজিত হতো। ১৯৩১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিজলি জেলে তরুণ বন্দিদের হত্যার প্রতিবাদে এই মাঠেই এক সভায় পৌরোহিত্য করেছিলেন।  ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে তদকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকার সৌধটিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণে উৎসর্গ করে, তখন তারা সৌধটির নাম পরিবর্তন করে "শহীদ মিনার" করে। ব্রিটিশ সরকারের এক অসাধারণ নিদর্শন।

শহীদ মিনারের মাঠ 


পূর্বে লন্ডন আইয়ের মতো মিনারটির উপরে উঠে তিলোত্তমার দৃশ্য দেখতে দেওয়া হতো।  বর্তমানে কলকাতা পুলিশ উপরে ওঠার আর অনুমতি দেয় না। ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ  সরকার ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে সৌধটির সংস্কারে হাত দিয়েছিল। সৌধটির ভিতর ও বাইরে সুন্দরভাবে আলোকিত করেছে।  সমগ্র সৌধটিকে নতুন রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে।  শোনা যাচ্ছে সংস্কারের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এও শোনা যাচ্ছে কাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেলে দর্শকদের আবার উপরে ওঠার অনুমতি দিতে পারে। ডেভিড অক্টালোনি (১২ই ফেব্রুয়ারি ১৭৫৮-১৫ই জুলাই, ১৮২৫) ছিলেন একজন ব্রিটিশ সেনা আধিকারিক।  তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।  বিভিন্ন যুদ্ধে তার অসামান্য পারদর্শিতার জন্য তিনি মেজর জেনারেল পদে (১৮০৪ সালে) উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি দিল্লির রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৮০৩ সালে।  এই সময় তিনি যশোবন্ত রাও হোলকারের আক্রমণ, পিন্ডারী যুদ্ধে (১৮১৭-১৮১৮) দস্যু দমনে তিনি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন।  তার হস্তক্ষেপে বিখ্যাত অমৃতসর চুক্তি সাক্ষর হয়েছিল।  পাঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিংকে তিনি ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য করেছিলেন।  ১৮১৬ সালে নেপাল যুদ্ধে (১৮১৪-১৮১৫) জয়লাভ করে তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেছিলেন। নেপাল যুদ্ধের স্মারক হিসেবে কলকাতায় প্রসিদ্ধ "অক্টালোনি মনুমেন্ট" নির্মিত হয়।

শহীদ মিনার কলকাতার একটা আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান, যার সাথে ইতিহাস ও রাজনীতি জড়িয়ে রয়েছে।  কলকাতা দর্শন করতে আসলে  অবশ্যই এই স্মৃতিস্তম্ভটি দর্শন করা উচিত।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :০৩-০৯-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।