Tuesday, September 10, 2019

কলকাতার দুর্গাপূজা >

কলকাতার দুর্গাপূজা 




দুর্গাপূজা বাঙালিদের প্রধান উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা।  এই শহর হিন্দু প্রধান বাঙালি শহর হওয়ায় দুর্গাপূজার আধিক্য অন্যান্য জায়গার তুলনায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ১৬১০ সালে দক্ষিণ কলকাতার বেহালা অঞ্চলের বড়িশায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের শ্রী লক্ষীকান্ত রায়চৌধুরী শহরে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা প্রচলন করেন, যা পারিবারিক পূজা ছিল।  এই পূজা তাঁদের পরিবারের আটচালায় আজও আড়ম্বরের সাথে অনুষ্ঠিত হয়।  তবে বর্তমানে পরিবারের আরও সাত  শরিকের বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে।  আটচালাসহ ছয়টি পূজা বড়িশা অঞ্চলে আর একটি পূজা বিরাটি অঞ্চলে ও একটি বেলঘরিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব তাঁদের  পারিবারিক দুর্গাপূজা শুরু করেন।  এই পূজায় সেই আমলে ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ অধিকারিক  ও  শহরের অন্যান্য বিশিষ্টজনরা আমন্ত্রিত থাকতেন।   বাইজি নাচ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান ও তার সাথে মদ্যপানের আসর বসত। শহরে বাবু সম্প্রদায়ের প্রতীক হয়ে ওঠে পূজাটি। পূজাটিতে  শাস্ত্রাচার গৌণ ছিল, আনন্দানুষ্ঠানাদি প্রধান হিসেবে দেখা যেত।

পরবর্তীকালে রানী রাসমণি দেবী জানবাজারে তাঁদের বসতবাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। তিনি সম্পূর্ণ শুদ্ধাচারে পূজা করতেন।  তিনিও ইংরেজ অতিথি ও দেশীয় প্রজাদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রাখতেন। তাঁর পূজায় যাত্রানুষ্ঠান প্রধান ছিল।  রানীর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতাগণ নিজ নিজ বাসভবনে পূজার প্রচলন করেন।  ধীরে ধীরে শহর কলকাতার অন্যান্য ধনী পরিবারগুলোতেও দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়।

বিংশ  শতাব্দীর প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৯১০ সালে কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের বলরাম বসু ঘাট রোডে "সনাতন হিন্দু ধর্মোৎসহিনী সভার" সদস্যরা পাড়ার সকলকে নিয়ে দুর্গাপূজা আরম্ভ করে। এই পূজাটিই তিলোত্তমার বুকে প্রথম বারোয়ারী পূজা হিসেবে পরিচিত। আজও কঠোর নিয়মানুসারে পূজাটি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সার্বজনীন, ১৯১৩ সালে শ্যামবাজারের শিকদার বাগানে, ১৯১৯ সালে বাগবাজারে, ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতি বারোয়ারীভাবে পূজা শুরু করে। বর্তমানে শহরের অলিতে-গলিতে পূজা হতে দেখা যায়। শহরে প্রায় হাজার তিনেক বারোয়ারী  দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

১৯৮৫ সালে বারোয়ারী পূজাগুলোতে প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের প্রচলন হতে দেখা যায়।  এই বছরই এশিয়ান পেইন্টস বারোয়ারী পূজাগুলোতে "শারদ সম্মান" চালু করে। তিলোত্তমার বুকে  চালু হয়ে যায় থিম পূজা। মণ্ডপ সজ্জার  বদল দ্রুত গতিতে ঘটতে আরম্ভ করলো।  সাবেকিয়ানার বদলে চাকচিক্য ও আড়ম্বর বেড়ে যেতে দেখা গেলো। মানুষের মধ্যেও মণ্ডপের শিল্প নিয়ে তৈরী হতে লাগলো উৎসাহ ও উদ্দীপনা। পূর্বে বাঁশ-কাপড়ের মণ্ডপ আর সাবেকি প্রতিমাতে পূজা হতো। বর্তমানে পূজাকে ঘিরে শিল্পউৎসব শুরু হয়ে গেছে।

পরবর্তীকালে এশিয়ান পেইন্টসকে দেখে অন্যান্য বাণিজ্যিক সংস্থাও দুর্গাপূজায় শিল্প উৎকর্ষে নানারকম সম্মানের ডালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। থিম পূজাগুলোতে শুরু হয়ে গেছে তুমুল থিমের লড়াই। পূজা ঘিরে শুরু হয়ে গেছে প্রতিযোগিতা। থিম পূজাগুলোতে উঠে আসতে লেগেছে নানারকম শিল্প উৎকর্ষ। পূজার দৌলতে বহু বিলুপ্ত শিল্পও প্রাণ পেতে আরম্ভ করেছে।  উঠে আসতে  লাগলো আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্ররা ও চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠিত আর্ট ডিরেক্টররা থিম মেকার হিসেবে। এইসব থিম মেকারদের হাত ধরে পূজা মণ্ডপগুলো উদ্ভাষিত হতে লাগলো শিল্প উৎকর্ষে। বহু ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়েও অনবদ্য শিল্প সৃষ্টি হতে লাগলো।  বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মন্ত্রীরা এক একটি পূজার সাথে নিজেদের জড়িয়ে নিতে শুরু করলো। পূজাগুলোকে তাঁরা তাঁদের জনসংযোগের হাতিয়ার করলো।  তাঁদের পূজাগুলোতে  ও অন্যান্য নামি পুজোগুলোতে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো দরাজ হাতে টাকা দিয়ে পূজাকে আরো সমৃদ্ধ করতে লাগলো।  বহু দুস্থ শিল্পী এই থিম পূজায় মণ্ডপ সজ্জার কাজ করে আর্থিকভাবে উন্নত হতে লাগলো। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়তে লাগলো। থিমের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আলোকসজ্জা করা শুরু হলো। আলোকসজ্জাতে পূর্বে চন্দননগরের একচেটিয়া আধিপত্য থাকলেও বর্তমানে তাদের সাথে হাতে হাত রেখে বহু নবীন ও প্রবীণ আলোকশিল্পী তাদের আলোর খেলা দেখাচ্ছে।  থিমের পুজোয় মণ্ডপে আর পুরানো দিনের মতো চটুল গান শোনা যায় না।  সেই গানের বদলে থিম অনুযায়ী গান বা শব্দ ব্যবহার করা হয়।  এই কাজেও অনেক সংগীতশিল্পী ও সুরকার কাজ পাচ্ছে।

এখন কলকাতার দুর্গাপূজা সারা বিশ্বে একটা আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।  পূজার কটাদিন ভারত তথা বিশ্বের বহু শহর থেকে বহু পর্যটক তিলোত্তমায় এসে ভীড় জমান। ইউনেস্কো প্রতি বছর তাদের বিশ্ব সংস্কৃতি বিভাগে বেশ কয়েকটি নতুন শিল্পকে সংযোজিত করে।  ২০২০ সালের দুর্গাপূজাকে ইউনেস্কো তাদের মনোনয়নে রেখেছে। এটা দুর্গাপূজার ইতিহাসে একটা নতুন পালক হিসেবে দেখা দেবে। বাংলা তথা বাঙালির শিল্প নতুনভাবে বিশ্ব স্বীকৃতি লাভ করবে। পুজোর শিল্প সজ্জা নিয়ে সত্যিই আজ বাঙালির গর্বের দিন।



ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ :১০-০৯-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 







No comments: