Tuesday, July 9, 2019

মইছাড়া >

মইছাড়া 

গরুর দৌড় 
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। ক্ষেতে-খামারে গেলে দেখা যায় বেশিরভাগ সময় চাষিরা লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত। বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি এই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। একসময় চাষাবাদে বাঁশের তৈরী মই দিয়ে জমিকে উৎকর্ষ করা হত। বর্তমানে চাষের কাজে যান্ত্রিক উপকরণের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে।  লাঙ্গল, মই, হালের গরু বা বলদের বদলে ঢুকে পড়েছে আধুনিক ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, ইত্যাদি। সময় ও শ্রমের সাশ্রয় করতে আধুনিক যন্ত্রপাতিতে কৃষকেরা বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে।  ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে ঐতিহ্যবাহী লাঙ্গল, মই  বা হালের গরু-বলদেরা।

আলোকচিত্রীরা অপেক্ষা করছে 
কদিন ধরেই আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে বর্ষা পশ্চিমবঙ্গে  প্রায় ঢুকে পড়েছে। বর্ষা ঢোকা মানেই গ্রামে গঞ্জে চাষ শুরু হওয়া।  বর্ষা ঢোকার আগেই চাষিরা তাদের কৃষিজমির উৎকর্ষতা বাড়াবার জন্য "মইছাড়া" উৎসব পালন করে থাকে।  মইছাড়া হচ্ছে গরুর দৌড়। এই উৎসবটি সাধারণভাবে জুন মাসের শেষের দিকে অথবা  জুলাই মাসের শুরুতে করা হয়ে থাকে অর্থাৎ   বর্ষা ঢোকার ঠিক আগে বলদ বা গরুকে দিয়ে জমিগুলোকে চাষযোগ্য করে তোলা হয়। মোদ্দাকথা হল মইছাড়া উৎসবটির মূল উদ্দেশ্য হল গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুরে জমিগুলো যখন বেশ শক্ত ফুটি-ফাটা হয়ে ওঠে, তখন সেই জমিগুলোতে চাষ করা যায় না। তাই বর্ষার আগে জমিগুলোকে চাষযোগ্য করে তুলতে হয়। 

পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটা জায়গায় এই উৎসব বেশ আড়ম্বরের সাথে উৎযাপন করা হয়।  আমাদের কলকাতার কাছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-এর হাড়াভাঙ্গা গ্রামে প্রতিবছর বেশ ঘটা করে দুইদিন ধরে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবের মাধ্যমে তারা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। প্রতিযোগীদের জন্য নানারকম মূল্যবান পুরস্কারেরও ব্যবস্থা থাকে। এই উৎসব এখানে যেন এক মিলনমেলা। সব ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। আশপাশের গ্রাম থেকে প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করে।  ক্যানিং-এর বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন প্রতিযোগিতাটি দেখতে আসে।  শুধু ক্যানিং কেন কলকাতা, হাওড়া, হুগলী  ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকেও বহু মানুষ
ভালো ছবির আশায় মাঠে নেমে পড়েছে 
দেখতে আসে। মইছাড়ার মাধ্যমে  প্রধানত কৃষিজমির উন্নতি করা হলেও  এখানে কিন্তু  মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই এই প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর ধরে এখানে এই উৎসব বা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।  জলাকীর্ণ জমিতে সাধারনভাবে এই প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  টান টান  উত্তেজনায় গরুর দৌড় শুরু হয়।  গরুর সাথে গরুর লড়াই বেশ জমে ওঠে। গরুর সাথে গরুর মালিকরাও সমানভাবে গরুকে সামলানোর জন্য দৌড়তে থাকে। মইছাড়ার ছবি তোলার জন্য কলকাতা বা তার আশেপাশের জেলাগুলো থেকে প্রচুর আলোকচিত্রীও উপস্থিত হয়।

২০১৮ সালে আমি এই উৎসবে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম, অনেক উৎকণ্ঠা নিয়ে ওখানে পৌঁছে দেখলাম
গরুর দৌড় 
খান তিরিশেক প্রতিযোগী গরু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, আর  ওই তিরিশটা গরুর ছবি তোলার জন্য প্রায় শখানেকের বেশি  ছবিপ্রেমী আলোকচিত্রী অপেক্ষা করছে।  বিরাট বিরাট লেন্স ও ক্যামেরা, ট্রাইপট নিয়ে সূর্য্যমামার তেজকে উপেক্ষা করে তারা অপেক্ষা করছে।  যখন  একটা দৌড় শুরু হচ্ছে তখন সমগ্র পরিবেশটা বেশ উত্তেজনায় কেঁপে উঠছে।  অতি উৎসাহী বেশ কিছু চিত্রপ্রেমীকে দেখলাম ভালো ছবির জন্য জল-কাদায় মাখামাখি করে মাঠের মধ্যে নেমে পড়েছে।

এখানে আলোকচিত্রীদের ক্যামেরা ও লেন্সের বহর দেখে আমি প্রথমদিকে সাহস করে আমার পুচকে ক্যামেরাটা বের করতে লজ্জা পাচ্ছিলাম।  পরের দিকে অবশ্য দু-একটা ছবি তুলেছি। ছবিগুলো হয়তো সেরকম ভালো কিছু হয়নি।  দর্শকাসন থেকে প্রতিযোগিতা শুরুর জায়গাটা বেশ কিছুটা দূরে ছিল,  সেক্ষেত্রে জুম লেন্স ছাড়া ছবি তোলা বেশ মুসকিল হচ্ছিল। আমার ক্যামেরাতে সেরকম কোনো জুম লেন্স নেই তাই ভালো ছবি তুলতে আমি পাচ্ছিলাম না।

এখানকার গরুর দৌড়ে কোন রাজনীতির রঙ নেই, নেই কোনো ধর্মের রঙও।  হিন্দু-মুসলমান একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দৌড়ে অংশগ্রহণ করে। এই প্রতিযোগিতাটা এখানে যেন এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জ্বলন্ত উদাহরণ।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০৯-০৭-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

No comments: