ভ্রমণ
নব কৈলাশ মন্দির
কথায় বলে "মাঘের শীত বাঘের গায়"। এই বছর এখনও কলকাতায় সেইভাবে ঠান্ডা পড়েনি। ঠান্ডা পড়েনি তো কি হয়েছে, তা বলে কি ঘুরতে যাবো না তাতো হয় না। গত শনিবার অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখ রাতে ঠিক করলাম পরেরদিন ৮ তারিখ অর্থাৎ রবিবার কোথাও একটা ঘুরতে যেতেই হবে। গিন্নির সাথে কথা বলে ঠিক করা হলো কালনার নব কৈলাশ মন্দির দেখতে যাবো, কারণ আমাদের দুজনের কারোরই এই মন্দিরটা এখনো দেখা হয়ে ওঠেনি। রাতেই গুগল বাবাজির স্মরণাপন্ন হলাম। বাবাজি জানালো সকাল ৮-০৬ মিনিট নাগাদ শিয়ালদহ স্টেশন থেকে একটা ট্রেন রয়েছে যেটা অম্বিকা কালনা স্টেশনে সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে আমাদের পৌঁছে দেবে। ওই ট্রেনটাই ধরবো বলে ঠিক করে নিলাম। পরের দিন ঠিক সময় ট্রেনটা ধরলাম এবং ঠিক সময় কালনায় পৌঁছেও গেলাম।
কালনা হলো বর্ধমান জেলার ভাগীরথীর তীরে একটা ছোট্ট শহর। বহু প্রাচীন জনপদ। পুণ্যসলিলা গঙ্গার (ভাগীরথী) পশ্চিমকূলে অবস্থিত অম্বিকা কালনা প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু স্থানরূপেই প্রসিদ্ধ। নগরটির প্রাচীনতা প্রায় হাজার তিনেক বছরের। অতীতে বর্ধমান রাজাদের গ্রীষ্মবাসের ঠিকানা এই নগরেই ছিল। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে এই স্থানটি অম্বুয়া বা অম্বিকা মুলুক নামে পরিচিত ছিল। পৌরাণিক ব্যাখ্যায় দেখা যায় অম্বুমুনির পূজিতা দেবী ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী অম্বিকা। দেবী অম্বিকা জৈনদের দেবী এই দেবী অম্বিকার নামানুসারে নগরটির নাম হয় অম্বিকা কালনা। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ লর্ড ক্যানিংহামের মতে সপ্তম শতাব্দীর অম্বুয়া বা অম্বিকা তাম্রলিপ্ত শহরের অধীনে ছিল। প্রাচীন কালনা নগর ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। ১৮১২ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কালনার সংস্কৃত পন্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে নিয়োগের জন্য এই নগরে পদার্পন করেছিলেন ১৭৭১ সালে বিখ্যাত কবি কমলাকান্তের জন্ম হয়েছিল এই শহরে। পোড়ামাটির ভাস্কর্যে বাংলা বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। মধ্যযুগীয় স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্পের নানাবিধ নিদর্শন নিয়ে শহরটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ঐশ্বর্যপূর্ণ পোড়ামন্দির দ্বারা সমৃদ্ধ অম্বিকা কালনাকে আসলে "মন্দির নগরী" বলা হয়। এখানকার মন্দিরগুলো সাধারণত আটচালা শৈলীতে নির্মিত। এই প্রাচীন শহরে দেখার মতো অনেক ঐতিহাসিক মন্দির, বৃক্ষতল, ধর্মস্থান ও রাজবাড়ী রয়েছে। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় মন্দির হলো নব কৈলাশ মন্দির। যাইহোক, আজ আমি শুধু কালনার নব কৈলাশ মন্দির অর্থাৎ ১০৮ শিব মন্দিরের কথাই আপনাদের বলব। পরে কোনো একসময় কালনার অন্যান্য দ্রষ্টব্যস্থানগুলোর কথা জানাবো। মন্দিরে ঢোকার পূর্বে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হলো। ভিতরে ঢুকে অপূর্ব চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ও নৈঃশব্দ আমায় বিস্মিত করে দিলো। ভারতবর্ষের অন্যান্য মন্দিরের যেরকম কোলাহল শোনা যায়, এখানে সেরকম নেই। পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতবর্ষের একমাত্র জেলা হল বর্ধমান, যেখানে দু-দুটো ১০৮/৯ শিব মন্দির রয়েছে। এই রকম ১০৮ বা ১০৯ কোনো মন্দির সারা ভারতবর্ষের আর কোথাও নেই। বর্ধমানের নবাবহাটে একটি সুন্দর ১০৮ শিব মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটি বর্ধমানের মহারানী বিষ্ণুকুমারী দেবী ১৭৮৮ সালে নির্মাণ করেছিলেন। জেলার দ্বিতীয় ১০৮ শিব মন্দিরটির অবস্থান কালনা শহরে। কালনার মন্দিরটি বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র ১৮০৯ সালে নির্মাণ করেছিলেন। দুটি মন্দিরের আকৃতি ভিন্ন, নবাবহাটের মন্দিরগুলো দুটি লম্বা সারিতে নির্মিত আর কালনার মন্দিরটি গোলাকৃতি আকৃতিতে নির্মিত। দুটি মন্দিরকেই ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খুব সুন্দর করে সংস্কার করে দিয়েছে। এই সংস্কারের ফলে পুরাতাত্ত্বিক কৌলিন্য কিছুটা হারিয়েছে বলে সবাই মতামত দিয়ে থাকে। উজ্জ্বল রঙের প্রলেপ থাকলেও এখানে ইতিহাসের গন্ধ পেতে কোনো অসুবিধা হয় না।
কালনার ১০৯ টি মন্দিরের মধ্যে ১০৮ টি মন্দির জ্যামিতিক বৃত্তে বিন্যস্ত, যা একটি স্থাপত্য বিস্ময়। মন্দিরের কাঠামো দুটি সমকেন্দ্রিয় বৃত্তের একটি সমন্বয়। এটি একটি পুঁথির অক্ষ মালার প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে রয়েছে আটচালাবিশিষ্ট ১০৮টি শিব মন্দির আর একটি পঞ্চরত্ন মন্দির। সবকটা মন্দিরের ছাদগুলো গম্ভূজাকৃতি। দুটি বৃত্তের মধ্যে মন্দিরগুলি তৈরী। বাইরের বৃত্তে ৭৪টি আর ভিতরের বৃত্তে ৩৪টি মন্দির রয়েছে। মন্দিরগুলির দেওয়ালে পৌরাণিক কাহিনী চিত্রিত আছে। ১০৮টি মন্দিরের প্রতিটিতে একটি করে শিব লিঙ্গ বিরাজ করছে। ভিতরের বৃত্তের পরিধি প্রায় ৩৩৬ ফুট আর বাইরের বিত্তের পরিধি প্রায় ৭১০ ফুট। মন্দিরগুলো স্বল্প উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত ও পরস্পর সংলংগ্ন। মন্দিরগুলির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট আর প্রস্থ প্রায় ৯.৫ ফুট। ভিতরের শিব মন্দিরগুলোতে শুভ্র বর্ণের আর বাইরের বিত্তের শিব মন্দিরগুলোতে অর্ধেক কৃষ্ণবর্ণ ও অর্ধেক শুভ্র বর্ণের শিব লিঙ্গ বিরাজ করছে। বৃত্ত দুটির ঠিক কেন্দ্রে একটা বাঁধানো ইঁদারা রয়েছে। এই ইঁদারার জল পূজার কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি হলো পঞ্চরত্ন মন্দির। ৬ ফুট উচ্চ ভিত্তিবেদীর উপর মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরটির আয়তন দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে প্রায় ১৩ ফুট করে, উচ্চতা প্রায় ৩৫ ফুট। বর্তমানে মন্দিরটি জল্পেশ্বর মন্দির নামে অধিক পরিচিত।
পুরো স্থাপত্যটি ঠিক জপমালার মতো। সমগ্র সৃষ্টিটি এক অপূর্ব শিল্পসত্তা ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধনকে বহন করে চলেছে।
বর্তমানে মন্দিরগুলির দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষন (আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)। মন্দিরে ঢোকার মুখে বিভাগের একটা নীল রঙের বোর্ডে এখানকার সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখে রাখা রয়েছে। পুরাতত্ত্ব বিভাগ মন্দির চত্বরের মধ্যে একটা সুন্দর বাগান তৈরী করেছে। এই বাগানের জন্য মন্দিরের সৌন্দর্য শতগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সমগ্র মন্দিরটিকে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। দিনের থেকে রাতে মন্দিরগুলোকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে। চুপচাপ শুধু ইতিহাসকে অনুভব করে গেলাম। প্রায় আড়াইশো বছরের এক পৌরাণিক ও বাংলার এক শিল্পকলার অপূর্ব নিদর্শন দেখতে দেখতে আমি ইতিহাসের পাতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখানে ইতিহাসের সাথে অধ্যাত্বিকতা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। এ যেন ইতিহাস ও আধ্যাতিকতার এক মেলবন্ধন, এ যেন বাংলা তথা ভারতের সংষ্কৃতির এক জীবন্ত সাক্ষী।
আমাদের বাংলায় ঘোরার স্থানের কোনো অভাব নেই, শুধু একটু সন্ধান করতে পারলেই হলো। কলকাতা থেকে কালনা ঘুরতে যাওয়ার জন্য রাত্রিবাসের কোনো প্রয়োজন নেই। সকালে বেরিয়ে সবকিছু দেখে রাতে অনায়াসেই ফিরে আসা যায়। এখানে আসলে বাংলার টেরাকোটার অপরূপ সৃষ্টির সাথে আপনার পরিচয় হবে তার জন্য অবশ্যই একবার ঘুরে যান।
কিভাবে যাবেন :
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে অম্বিকা কালনা স্টেশনে এসে নামবেন। স্টেশনের বাইরে টোটো বা রিক্সা ভাড়া করে মন্দির চত্বরের আসতে পারবেন।
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ১২-১২-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment