Tuesday, December 3, 2019

জীবন ও জীবিকা (দ্বিতীয় পর্ব )


জীবন  ও জীবিকা 
(দ্বিতীয় পর্ব )


ধীবর বা মৎস্যজীবী 


আমরা কাগজে বা খবরে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে  প্রায়ই  দেখতে পাই "দীঘার সমুদ্র ফুঁসছে, সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চলগুলোতে জলোচ্ছাস দেখা দিচ্ছে। ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে। মৎসজীবীদের প্রতি সতর্কতা জারি করা হয়েছে"।  এই খবর দেখার পর আমরা দৌড়ে যাই জলোচ্ছাস দেখার জন্য, কখনো ভাবি না ঐসব অঞ্চলের মৎসজীবীদের কথা,  আবহাওয়ার দুর্নিপাকে পরে তাদের দুর্ভোগের কথা।

এরা ধীবর সম্প্রদায়। কথ্য ভাষায় আমরা জেলে বা মৎসজীবি বলে থাকি। মাছ ধরাই এদের জীবিকা, জাতিগত পেশা। তথ্যগতভাবে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে এরা  তফসিলি জাতি বা নিচু জাতি গোষ্ঠীভুক্ত। জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে  আমাদের দেশে ধর্মীয় প্রশ্নে বেশিরভাগই জেলেই হিন্দু ও  মুসলমান সম্প্রদায়ের হয়।  হিন্দু জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন শাখা শ্রেণী রয়েছে যেমন, কৈবর্ত্য, রাজবংশী, বেরুয়া, জিয়ানি, মালো, নদীয়াল ও আরো কয়েকটি। মাছ ধরার ইতিহাস বহু প্রাচীন। খ্রিষ্টপুর্ব ৩২১-৩০০ সালে  কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে মাছ ধরার বর্ননা রয়েছে। জেলেদের অস্তিত্বের ছবি মেলে হরপ্পা-মহেঞ্জদরোর খনন কার্যের সময়।  সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাসেও এদের কথা রয়েছে।

দুনিয়ায় জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষকে কোনো না কোনো ভাবে উপার্জন করে নিজের ও পোষ্যবর্গের প্রয়োজন মেটাতে হয়। আজকের পেশা হিসেবে আমি মৎস্য শিকারীদের বেছে নিয়েছি।  সাধারণভাবে যারা মাছকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে তারাই জেলে বা মৎস্যজীবী হিসেবে স্বীকৃত। আবহমান কাল থেকেই একশ্রেণী লোকের পেশা হল খাল-বিল, নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরা। জেলে বা মৎস্যজীবী সম্প্রদায় বংশ পরম্পরায় মৎস্য আহরণ ও নিকটবর্তী পাইকারি হাটে বা বাজারে বিক্রি করে চলেছে। কেউ কেউ আবার আড়তদারদের কাছেও বিক্রি করে থাকে।  মৎসজীবীদের যেমন ইতিহাস রয়েছে তেমন রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাত্রা। মাছের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পর থেকে জেলেদের কাজের পরিধিও অনেকগুন বেড়ে গেছে। মাছের প্রজনন থেকে শুরু করে মাছ চাষের প্রায় প্রতিটি ধাপ এরাই পরিচালনা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই পেশা আজ কিছুটা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ।  ঝড়, জলোচ্ছাস, জোয়ারের তীব্রতা, নদী-ভাঙ্গন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের বিপদ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। জীবিকার জন্য জীবনকে বাজি রেখে এদের চলতে হয়।  বিকল্প জীবিকা বা নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাও সরকারিভাবে না থাকায় নতুন প্রজন্ম অনিচ্ছাকৃতভাবে এই পেশায় চলে আস্তে বাধ্য হচ্ছে। এদের বসবাস  সাধারণত নদী, খাল-বিল বা সমুদ্রের কাছাকাছি হয়ে থাকে।  তারা বেশিরভাগ সময় নদীতে বা খালে-বিলে মাছ ধরে থাকে। এক শ্রেণীর জেলে আবার গভীর সমুদ্রে মাছের আশায় পাড়ি জমায়। এদের জীবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তারা যখন সমুদ্র পাড়ি দেয়  তখন তাদের পরিবার নিরাপদে ফেরা পর্যন্ত খুবই উদ্বিগ্নে  থাকে। বেশিরভাগ জেলেদেরই কোনো নিজস্ব নৌকো থাকে না।  মালিকের কাছ থেকে নৌকো  ভাড়া করে তারা সমুদ্র পাড়ি দেয়।  ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ  নিয়ে জাল কিনতে হয়। তার ফলে মহাজনের কাছে ঋণবদ্ধও  হয়ে পড়ে।

বেশ কিছু মৎসজীবি সমুদ্র উপকূলের কাছে একসাথে একটি ছোট পাড়ায় বসবাস করে, এই পাড়াটিকে সবাই জেলেপাড়া বলে অভিহিত করে থাকে। জেলেপাড়ায় সূর্যের উদয় ও অস্তের সঙ্গে দিন-রাতের সম্পর্ক ততটা নেই, যতটা আছে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে।  রাতদুপুরে জোয়ার এলে জেলেপাড়ায় তখন দিনের মতোই কর্মব্যস্ততা পরিলক্ষিত হয়। সমুদ্রের উত্তাল, জলের রং, মাছের চরিত্র অনুযায়ী জাল ফেলতে হয়। জাল বিভিন্ন রকমের হয়। সমুদ্রের উপযোগী জাল হলো সাবাড় জাল। এই প্রকার জাল বিশাল আয়তনের হয়। শুধু জালের ওপর মাছ ধরা নির্ভর করে না, মাছ ধরার কৌশলও অনেকাংশে নির্ভর করে।  ট্রলারে বরফ বোঝাই করে তারা মাছ ধরার জন্য সাত-আট  দিনের জন্য সমুদ্রে পাড়ি দেয়। এই কদিনের খাবারও  সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। গ্রীষ্ম বা শীতের সময়ের চেয়ে বর্ষার সময় বেশি মাছ উৎপন্ন হয়।  সেই সময় জেলেরাও  বেশি পরিমাণে মাছ ধরতে পারে, তার ফলে তাদের আয়ের পরিমাণ অনেকটা বাড়ে। অবসর সময় নতুন জাল তৈরী ও পুরোনো জাল মেরামতি করেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।


সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে মাছ ধরা ভীষণই বিপদজনক।  এখানে থাকে জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ।  সুন্দরবনের বিভিন্ন খাড়িতে মাছ ধরতে গিয়ে বহু মৎসজীবি বাঘের হামলায় মারা যান।  এই অঞ্চলের বহু মহিলা তাদের স্বামীকে বাঘের হামলায় হারিয়েছেন। হিঙ্গলগঞ্জ, গোসাবা, কুলতলী, পাথরপ্রতিমা এবং বাসন্তী ব্লকের গ্রামবাসীরা রোজকার জীবন ও জীবিকার জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল।  তাদের জন্য এইসব অঞ্চল সংলগ্ন জঙ্গলে বাঘের উপস্থিতি খুব বড় সন্ত্রাসের কারণ। এইসব অঞ্চলে গেলে সর্বত্রই এক গল্প শোনা যায়, বেশ কিছু পরিবার তাদের পুরুষ সদস্যদের  বাঘের আক্রমণে খুইয়েছেন। খুঁজে দেখলে এখানে বিধবা পাড়াও খুঁজে পাওয়া যাবে।  অধিকাংশ পরিবারেরই মহিলাদের জীবন যন্ত্রনা ও দারিদ্রে ভরা।


 পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মৎস্যজীবীরা সমুদ্রে নৌ যাত্রার প্রাক্কালে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার্চ্চনা করে থাকে  সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা বনবিবির পূজা করে থাকে।  মুসলমান মৎসজীবীরা আবার গাজীর আরাধনা করে।  ওদের প্রবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে।

জীবনকে বাজি রেখে রক্ত, ঘাম, উত্তেজনা আর মেহনতের দ্বারা জেলেপাড়ার মানুষদের অন্নসংস্থান হয়। সত্যই এদের জীবন খুবই সংগ্রামের জীবন।


ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০৩-১২-২০১৯

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


No comments: