Saturday, February 16, 2019

কামারপুকুর-জয়রামবাটি ভ্রমণ kamarpukur jayrambati >

 পুণ্যের খোঁজে ঠাকুরের দেশে 


উনিশ শতকের জাগরণ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়। এই জাগরণই আমাদের পরাধীনতার  নাগপাশ থেকে মুক্তি দিয়েছিল।  এই জাগরণ বাংলার ধর্মে, সাহিত্যে, শিল্পকলায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। এই সময়ই অর্থাৎ ১৮৩৬ সালের ১৮ই ফ্রেব্রুয়ারী সুখলালগঞ্জে গদাধর নামে এক বালক জন্মগ্রহণ করেন।  হুগলী  জেলার আরামবাগ মহকুমাধীন গোঘাট থানার একটি ছোট্ট  গ্রাম এই সুখলালগঞ্জ। অতীতের  সুখলালগঞ্জই বর্তমানের  কামারপুকুর। 

আজ আমি ও আমার তিন বন্ধু সোম শঙ্কর, হারাধন ও চাঁদদা একটা গাড়ী  ভাড়া করে একটু পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে কামারপুকুর ও জয়রামবাটি ঘুরতে চললাম। আমাদের গাড়ী ঠিক সকাল ৬টায় কসবা থেকে ছাড়লো। রাস্তায় একটু চা ও জলখাবার খেয়ে নিলাম। তারকেশ্বর, আরামবাগের ওপর দিয়ে বেশ দ্রুতগতিতেই চালাচ্ছিল চালক ছেলেটি। আমোদর নদী পার করে সকাল ৯টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম কামারপুকুরে। প্রথমেই দুপুরের প্রসাদ নেওয়ার জন্য কুপন নিলাম। তারপর শ্রী রামকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে দেখলাম।  জায়গাগুলোর কথা পরে জানাব, তার আগে একটু কামারপুকুরের বর্ননা দিয়ে রাখি।  

আগেই বলেছি কামারপুকুর গ্রামটি হুগলী  জেলার একটা ছোট্ট  গ্রাম।  তবে প্রাচীন গ্রন্থে কামারপুকুর গ্রামের কোনো নাম পাওয়া যায় না।  কামারপুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গড় মান্দারণ বলে একটা গ্রাম ছিল। এই গড় মান্দারণ একটা ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। এই স্থানের ওপর ভিত্তি করেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "দুর্গেশনন্দিনী" লিখেছিলেন।  প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত এই গড় মান্দারণ দুর্গের ভগ্ন তোরণ, স্তুপ ও একটু দূরে অবস্থিত শৈলেশ্বর শিব মন্দিরটি  আজও রয়েছে। ক্ষীণতোয়া আমোদর নদী ও অপরপ্রান্তের জঙ্গলাকীর্ণ স্তুপ আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।  এই গড় মান্দারণ কামারপুকুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। একটু বেলাইন হয়ে গিয়েছিলাম, যাইহোক, হুগলী  জেলার উত্তর পশ্চিমাংশে যেখানে বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলা মিশেছে, ঠিক সেই জায়গাতেই কামারপুকুর গ্রামটি অবস্থিত। শ্রী রামকৃষ্ণের স্মৃতি শ্রীপুর, মুকুন্দপুর ও কামারপুকুর পাশাপাশি অবস্থিত এই তিনটি গ্রামেই লুকিয়ে আছে। এই তিনটি গ্রামই ঠাকুরের লীলাক্ষেত্র ছিল।  এই  গ্রাম তিনটিকে একত্রে বৃহৎ কামারপুকুর হিসেবে বর্তমানে ধরা হয়।

কামারপুকুর মঠের  প্রবেশদ্বার 
এইসব গ্রামের অধিবাসীরা বরাবরই খুব ধার্মিক প্রকৃতির  ছিলেন। সেই প্রাচীনকাল থেকেই  প্রায় প্রতিটি ঘরেই নানারকম দেব-দেবীর পূজাচ্চচর্না করা হত। শ্রী রামকৃষ্ণের জনক শ্রী ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় তাঁদের পৈতৃক ভিটা থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর এই কামারপুকুরে এসে বসবাস শুরু করেন। ক্ষুদিরামের পরিবার বরাবরই শ্রী রামচন্দ্রের উপাসক ছিলেন। এই গ্রামটি ঠাকুর শ্রী  শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মস্থান বলে তাঁর অনুরোগীদের কাছে খুবই পবিত্র স্থান। আজ সারা পৃথিবীর মানুষই এই গ্রামটির সাথে পরিচিত।

শ্রী শ্রী সারদা মায়ের জীবদ্দশাতেই কামারপুকুরে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর জন্মভিটায় একটা স্মৃতি মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। রামকৃষ্ণ মিশনের তৈরী করা এই মন্দিরটি ১৯৫১ সালে উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া কামারপুকুরে ও তার আশপাশে আরো বহু মন্দির রয়েছে,  সব মন্দির আমাদের দেখা হয়ে ওঠেনি। ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত যে কটা স্থান ও মন্দির দেখেছি ও  তাদের  সম্মন্ধে যতটা জানতে পেরেছি তা আপনাদের  জানাব।



কামারপুকুরের দ্রষ্টব্য স্থান  : 

রামকৃষ্ণ মঠ :  ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব বসতবাড়ির ঢেঁকিশালে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।  ঠিক সেই জায়গাতেই অর্থাৎ ঢেঁকিশালের  জায়গাতেই বর্তমান  মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে।  মন্দিরটির ভিতরে একটা বেদী  রয়েছে।  বেদীটির ওপরেই প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতায় ঠাকুরের সমাধিমগ্ন মর্মর মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটির সামনে একটা নাটমন্দিরও আছে।  রামকৃষ্ণ মিশন ঠাকুরদের এই  পৈতৃক জায়গা ছাড়াও পরবর্তীকালে আরো প্রায় ৮৪ বিঘা জমি কিনেছে। ১৯৪৯ সালের ১লা মার্চ বিখ্যাত শিল্পী শ্রী নন্দলাল বসু পরিকল্পিত স্মৃতি মন্দিরটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল।

ঠাকুরের বাসভবন :  দুটি কুটির নিয়ে তৈরী ঠাকুরের বাসভবন।  একটিতে ঠাকুর থাকতেন, আর একটি কুটিরে ঠাকুরের মধ্যমভ্রাতা রামেশ্বর তার পুত্র কন্যা নিয়ে বাস করতেন। এই কুঠিটি দ্বিতল। বর্তমানে এই দ্বিতল কুঠিটি মন্দিরের ভাড়ারঘর হিসেবে ব্যৱহৃত হয়।  ঠাকুরের বাসগৃহটি যথাযথ ভাবে একইরকম রেখে সুরক্ষা করা হয়েছে।  এই গৃহে ঠাকুরের একটা প্রতিকৃতিও  রাখা আছে।

রঘুবীরের মন্দির : ঠাকুরের বাসগৃহের সামনে এই মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরে রঘুবীর শিলা, শীতলাদেবীর ঘট, রামেশ্বর শিব পূজিত হয়।  এছাড়া ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মীদেবীর গোপাল ও নারায়নশীলের পুজোর  ব্যবস্থা রয়েছে।  ঠাকুরের উপনয়নের পর ঠাকুর এখানে রঘুবীরের পুজো করেছিলেন। বর্তমানে এই মন্দিরটি রামেশ্বরের বংশধরগণের তত্ত্বাবধানে আছে।  তারাই এখানকার পূজার্চ্চনা করে থাকে। মঠ থেকে পূজা ও ভোগের সব সামগ্রি দেওয়া হয়।

আম্রবৃক্ষ : ঠাকুরের বাস্তুভিটার সদর ঘরের পূর্বদিকে এই আম্রবৃক্ষটি  আছে।  ঠাকুর স্বহস্তে গাছটি রোপন করেছিলেন।

যুগিদের শিবমন্দির :  ঠাকুরের বাসভবনের উত্তরদিকে রাস্তার পাশে এই মন্দিরটি আছে। যুগিবংশের রামানন্দ যুগি মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পূর্বমুখী আটচালা-বিশিষ্ট মন্দিরটি ছোটর ওপর বেশ সুন্দর। মন্দিরটির গায়ে পোড়া মাটির কাজ করা কিছু শিল্পকলাও আছে। এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবের নাম শান্তিনাথ।.বর্তমানে মন্দিরটি রামকৃষ্ণ মঠের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখানকার এক  মহিলার কাছে শুনলাম এই মন্দিরেই ঠাকুরের মাতৃদেবী চন্দ্রমণি দেবী  প্রার্থনা করেছিলেন। মন্দিরটির  থেকেই এক দিব্যজ্যোতি চন্দ্রমণি দেবীর  দেহে প্রবেশ করেছিল। এই ঘটনার পরেই ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। 

হালদার পুকুর: যুগিদের শিবমন্দিরের উত্তরদিকে রাস্তার ধারে এই বিশাল পুকুরটি রয়েছে। পুকুরটিকে হালদার পরিবারের ছোট ছেলে খনন করেছিলেন। ঠাকুরের পিত-মাতা ও ঠাকুর স্বয়ং পুকুরটি ব্যবহার করতেন। পরবর্তীকালে মা সারদাদেবীও পুকুরটি ব্যবহার করেছেন। পুকুরটি রামকৃষ্ণ মঠ  কিনে নিয়েছেন এবং তারাই পুকুরটির  রক্ষনাবেক্ষন করেন।

লক্ষ্মীজলা : এই 
 জমিটিকে ভিত্তি করেই কামারপুকুর গ্রামে ক্ষুদিরামের বসবাসের সূচনা হয়েছিল।  হালদারপুকুরের পশ্চিমদিকে জমিটির অবস্থান। ক্ষুদিরাম এই জমিতেই চাষবাস আরম্ভ করেছিলেন। বর্তমানে মঠের কৃষিবিভাগ এই জমিতেই চাষ করে। এখানকার ধানেই আজও রঘুবীরের সেবা হয়ে থাকে।

ঠাকুরের পাঠশালা 


রামকৃষ্ণ পাঠশালা : রামকৃষ্ণ মন্দিরটির পূর্বদিকে লাহাবাবুদের চন্ডীমণ্ডপটি রয়েছে। এই চণ্ডীমণ্ডপের ঠিক সামনে অবস্থিত আটচালাটিই ঠাকুরের পাঠশালা। এই পাঠশালাতেই বালক গদাধর পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি হন। সেই আমলে আটচালাটি খড়ের ছাউনি দেওয়া ছিল।  পরে টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া হয়।  ছাপান্নটি কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরী সাবেক আটচালার কাঠামোটি। এখনও আটচালাটি অক্ষুন্ন আছে। এই পাঠশালাতেই গদাধরকে পড়িয়েছিলেন যদুনাথ সকার, রাজেন্দ্রনাথ সরকার এবং তাঁর  সহপাঠী ছিলেন গঙ্গাবিষ্ণু ও হারাধন।

 লাহাদের চণ্ডীমণ্ডপ :  এই চন্ডীদালান বা দুর্গামন্দিরটি পূর্বমুখী। ১২৫৭ বঙ্গাব্দে ধর্মদাস লাহা মন্দিরটি পাকা করেন।  বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই মন্দিরে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে।

লাহাদের বাড়ি :  ধর্মদাস লাহা ছিলেন একজন ধনী ব্যক্তি।  তিনি ঠাকুরের পিতা  ক্ষুদিরামের পরম বন্ধু ছিলেন।  লাহা ও চট্ট্যোপাধ্যায় পরিবারের মধ্যেও একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ঠাকুরের  বাসভবনের দক্ষিণদিকে লাহাদের প্রাসাদোপম অট্টালিকাটি রয়েছে।  ওই আমলে এই প্রাসাদের এক কোনে  একটা পান্থনিবাস ছিল। সেখানে সাধুরা এসে বিশ্রাম নিতেন। এই পান্থনিবাসেই ঠাকুর সাধুদের সেবা করতেন। শুনলাম পাঠশালার উত্তরদিকে লাহাদের একটা রাসমঞ্চ ছিল, যা  ধ্বংস হয়ে গেছে।

পার্বতীনাথ মন্দির : এই আটচালা শৈলীর মন্দিরটি পাঠশালার উত্তর-পূর্ব কোনে অবস্থিত। ধর্মদাস লাহার কন্যা প্রসন্নময়ী দেবী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।  মন্দিরটির বিগ্রহ হলেন বাবা মহাদেব।

দামোদর বা বিষ্ণুমন্দির :  জগন্নাথ লাহা মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।  তিন খিলানযুক্ত  বারান্দাসহ মন্দিরটি ঠাকুরের মন্দিরের পূর্ব-দক্ষিণ কোনে অবস্থিত। মন্দিরটির গর্ভগৃহের সংহাসনে দামোদরশিলা  আসীন আছেন।

পাইনবাড়ি : ঠাকুরের মন্দিরের ডানদিকে সতীনাথ পাইন ও দুর্গাদাস পাইনের বসতবাড়ীটি অবস্থিত।  এই বাড়ীতে গদাধরের অবাধ যাতায়াত ছিল। এই গৃহেই ঠাকুর তাঁতিবউ সেজে অন্দরমহলে প্রবেশ করে দুর্গাদাস পাইনের দর্পচূর্ণ করেছিলেন। এই বাড়ীরই সন্তান লক্ষণ পাইন যখনই কলকাতা থেকে দেশের বাড়ি ফিরতেন তখনই তিনি দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে গিয়ে ঠাকুরের সাথে দেখা করে তবে ফিরতেন। এই বাড়িটির মধ্যেই পাইনদের একটা বিষ্ণুমন্দির ছিল। এই মন্দিরটির সামনেই কিশোর বয়সে ঠাকুর যাত্রায় শিবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ঠাকুরের স্মৃতিমাখা সেই বিষ্ণুমন্দিরটি আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত।

চিনু শাখারীর ভিটা :  ঠাকুরের বাসভবনের পূর্বদিকে সামান্য দূরে চিনু ওরফে শ্রীনিবাস শাঁখারির বসতবাড়ীটি রয়েছে। এই চিনু শাঁখারিই সর্বপ্রথম বালক গদাধরকে দেখে অবতাররূপে চিহ্নিত করেছিলেন।  ঠাকুরের সাথে তাঁর "চিনুদাদা"-র  খুব সুনিবিড় সম্পর্ক ছিল।  চিনুর বাস্তুভিটায় ঠাকুরের যাতায়াত ছিল।  বর্তমানে চিনুদের এই বাস্তুভিটাটিও  রামকৃষ্ণ মঠ  ও মিশনের অন্তর্ভুক্ত।

শান্তিনাথ শিবমন্দির : চিনু শাঁখারির বাড়ির পূর্বদিকে ঘোষপাড়ায় এই প্রাচীন  শিবমন্দিরটি রয়েছে। ভরত  ঘোষ ও তার পুত্র অর্জুন ঘোষ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। টেরাকোটার কাজ করা মন্দিটির উচ্চতা ২৫ ফুট আর প্রস্থ ১৫ ফুট।  মন্দিরটিতে এখনও নিত্য পূজা ও শিবরাত্রির দিন বিশেষ পূজা করা হয়ে থাকে।

গোপীশ্বরের মন্দির : ঠাকুরের পাঠশালার পূর্বদিকে এই প্রাচীন মন্দিরটি অবস্থিত। ঠাকুরের পিতা  ক্ষুদিরামের আশ্রয়দাতা সুখলাল গোস্বামীর পূর্বসূরি গোপিলাল গোস্বামীর নামানুসারেই মন্দিরটি পরিচিত। মন্দিরটিতে শিবের অধিষ্ঠান আছে। শুনলাম এই মন্দিরের সাথে পূর্বে একটা নাটমন্দির ছিল, যা এখন আর নেই। 

ধনীমাতার মন্দির : লাহাবাবুদের চণ্ডীমণ্ডপের দক্ষিণদিকে এই মন্দিরটির অবস্থান। মন্দিরের বেদীতে একটা রঙিন পট এবং এই পটটির  পিছনদিকে ঠাকুরের একটা তৈলচিত্র রয়েছে। কলকাতার  বৌবাজারের রাধারমণ দাস মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ভূতির খালের শ্বশান : শ্রী রামকৃষ্ণ মন্দিরের পশ্চিমপারে এই শ্বশানটি ছিল। এই শ্বশানের বটবৃক্ষের তলায় ঠাকুর বহুবার ধ্যানে বিভোর হয়েছিলেন। এখানে ঠাকুর স্বহস্তে একটা বেলগাছ রোপন করেছিলেন, কিন্তু তা আজ আর নেই। বর্তমানে  শ্বশানের মাঠটি খালার মাঠে পরিণত হয়েছে।  এই মাঠটির পশ্চিমদিকে শিশু উদ্দ্যান আর দক্ষিণদিকে যাত্রীনিবাস তৈরী করা হয়েছে। ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই শ্বশানে প্রতিবছর শ্রী রামকৃষ্ণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শুনলাম এখানেই ১৯৩৬ সালে বেলুড় মঠ  শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মশতবর্ষের  সূচনা করেছিলেন। 


এই মন্দিরগুলো ছাড়াও কামারপুকুর আরো কয়েকটা মন্দির রয়েছে, সময়ের অভাবে সেগুলো আমাদের আজ আর দেখা হয়ে উঠল না।  ভবিষ্যতে আবার একবার এসে মন্দিরগুলো দেখার ইচ্ছা রয়ে গেল। মন্দির দর্শন করতে করতে কোথা থেকে যে তিন ঘন্টা সময় কেটে গেছে খেয়াল করতে পারিনি। ঘড়িতে তখন ১২টা বাজে। আমরা মিশনের বইয়ের দোকানে একটু বই দেখে  প্রসাদ নেওয়ার জন্য খাবার ঘরে এসে পৌঁছলাম।   খাবার ঘরটিতে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম কি বিশাল ঘর আর বহু স্টিলের বেঞ্চ দিয়ে সাজানো রয়েছে ঘরটি।  আমার মনে হল সাত-আটশো লোক একসাথে বসে এখানে খেতে পারবে।  যাইহোক, আমরা হাত-মুখ ধুয়ে একটা বেঞ্চে এসে বসলাম। প্রথমেই গরম গরম ভাত, তার সাথে একে একে পাঁচ-মিশালী তরকারি, ডাল, চাটনি এবং সবশেষে পায়েস পরিবেশন করা হল।  সবকটা রান্নাই স্বাদে অতুলনীয়।  খিদের মুখে এরকম গরম গরম সুন্দর খাবার পেয়ে আমরাও পেট ভরে খেয়ে নিলাম। মন্দিরের উল্টোদিকে গেস্ট হাউসের পাশে রাস্তার ধারে একটা সুন্দর বিশ্রামাগার রয়েছে। খাওযার পরে ওই বিশ্রামাগারে আমরা কিছুক্ষন বিশ্রাম করে নিলাম। বিশ্রামের পর আমরা আর এক পুণ্যভূমি জয়রামবাটির মন্দিরগুলো দেখতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিলাম।



রামকৃষ্ণদেবের জন্মভুমি কামারপুকুর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে জয়রামবাটী গ্রামটি অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার কোতলপুর থানার অধীনে একটা ছোট্ট গ্রাম হল এই জয়রামবাটি। এই গ্রামেরই এক গরীব মুখোপাধ্যায় পরিবারে ১৮৫৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর সারদাদেবী  জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯২০ সালের ২০শে  জুলাই দেহত্যাগ করেছিলেন।১৮৫৯ সালের মে মাসে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের  সাথে তাঁর  বিবাহ হয়। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্তদের কাছে তাই এই গ্রামটিও একটা তীর্থক্ষেত্ররূপে পরিগণিত হয়েছে।  সারদাদেবীর বাসভনটিও রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধীনে রয়েছে। তারা এই বাসভবনেই বিরাট একটা মাতৃমন্দির নির্মাণ করেছে।

জয়রামবাটির দ্রষ্টব্য স্থান :

মাতৃমন্দির :  এই মন্দিরটি মঠের কেন্দ্রস্থলে তৈরী করা হয়েছে।  মন্দিরটিতে ১৯৫৪ সালে  সারদা মায়ের একটি শ্বেতপাথরের মূর্তি বসানো হয়েছে তাঁর জন্মশতবর্ষপূর্তির সময়। তার আগে একটা তৈলচিত্র ছিল।,এই তৈলচিত্রকেই তখন পূজা করা হত। বর্তমানে ওই তৈলচিত্রটি বেলুড় মঠে  রামকৃষ্ণ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত করা আছে। ১৯৩২ সালের ১৯শে এপ্রিল স্বামী সারদানন্দ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানের শ্বেত পাথরের মূর্তিটির তলায় শ্রী শ্রীমার দেহাবশেষ রাখা আছে। মন্দিরটির সামনে একটা বিরাট প্রার্থনা কক্ষ আছে। মন্দিরটির ওপরে অর্থাৎ চূঁড়ায় "মা"  শব্দটি  রয়েছে ও  একটা পতাকা সবসময় উড়ছে ।

মায়ের পুরোনো বাড়ি  : মঠের প্রবেশদ্বারের বাঁদিকে এই বাড়িটি রয়েছে। ১৯১৫ সাল পর্যন্ত মা  সারদা দেবী এই  বাড়িতেই বসবাস করতেন।  এই বাড়িতে তিনি তাঁর ভক্তদের দীক্ষা দিতেন।

মায়ের নতুন বাড়ি  : এই নতুন বাড়ীটিও মঠের মধ্যে অবস্থিত। প্রবেশদ্বারের পাশে একটা ছোট দরজা দিয়ে এই বাড়ীতে প্রবেশ করতে হয়।  এই বাড়ীতেই  সারদাদেবী  ১৯১৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বসবাস করতেন। এই বাড়ীতেও  তিনি অনেক ভক্তদের দীক্ষা দিয়েছিলেন।

পুন্যিপুকুর : মাতৃমন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে এই পুকুরটি আছে। সারদাদেবী এই পুকুরটি ব্যবহার করতেন।  তাই ভক্তদের কাছে পুকুরটি খুবই পবিত্র।

ধর্মঠাকুরের মন্দির : পুন্যিপুকুরের পাশেই এই মন্দিরটি আছে। মন্দিরটি সারদা মায়ের পরিবারের গৃহদেবতা  সূর্যনারায়ণ ধর্মঠাকুরের মন্দির। এখানে নিয়মিত তাঁর পুজো করা হয়।   

সিংহবাহিনী মন্দির : মঠের কাছেই এই মন্দিরটি অবস্থিত।  সিংহবাহিনী হল মা দুর্গার একটি রূপ এবং এটি  জয়রামবাটি গ্রামের দেবতা। মন্দিরটিতে সিংহবাহিনী, মহামায়া, চন্ডী  ও মনসার ধাতব মুখ রয়েছে, তবে কোনো সম্পূর্ণ মূর্তি নেই। সারদা দেবী বহুবার এই মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন। এখানকার লোকেরা এই মন্দিরের মাটিকে খুব পবিত্র হিসেবে ধরে এবং তারা এই মাটিকে ঔষধ হিসাবেও ব্যবহার করে থাকে।


কামারপুকুর বা জয়রামবাটি এই দুটি জায়গাতেই এখানকার বিখ্যাত সাদা বোঁদে খেতে ভুলবেন না।  ঠাকুর ও সারদাদেবী  এই বোঁদে দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল। এই বোঁদে পশ্চিমবঙ্গের স্বতন্ত্র ঐতিয্যবাহী একপ্রকার  মিষ্টান্ন। এই বোঁদে কবে কে কবে প্রথম তৈরী করেছিলেন তার তথ্য পাওয়া যায় নি।  তবে ঠাকুরের বাড়ির পাশেই মোদক পরিবারের মিষ্টির দোকান ছিল ঠাকুর এই দোকান থেকে বোঁদে  কিনে খেতেন।  


কিভাবে যাবেন :  কলকাতার ধর্মতলা থেকে সরকারি/বেসরকারি বাসে  করে সরাসরি যেতে পারেন , এছাড়া ট্রেনে করে আরামবাগ স্টেশন পৌঁছে বাস বা গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন।  
   

তারিখ : ১৬-০২-২০১৯

 ছবি ও লেখার স্বত্ব অধিকার : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০



 আমার এই লেখাটি ও ছবিগুলো যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


4 comments:

Unknown said...

Beautiful

kabita mandal said...

সুন্দর লেখা, পড়ে ভালো লাগলো

Unknown said...

জয়রামবাটি যে কূপন সংগ্ৰহ কখন করতে হবে, মূল্যে কত, ফোন নাম্বার যদি, বিস্তারিত জানালে খুবই উপকৃত হইব। ধন্যবাদ ভালো থাকবেন।

Akash+Ayantika said...

অনেক ভালো লাগলো।
কামারপুকুর থেকে♥️