Thursday, August 15, 2019

দুর্গা কথা>

দুর্গা কথা




দূর্গা হলেন একজন জনপ্রিয় হিন্দু দেবী। হিন্দুরা তাঁকে মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ হিসেবে মনে করেন। পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী তিনি মহাদেবের স্ত্রী পার্বতী এবং কালীর অন্যরূপ।  দুর্গাপূজা  বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ পূজা। দেবী দুর্গা আবির্ভূত হন শক্তিরূপে।  হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মন্দ দেবতাদের ধ্বংস করার জন্যই তিনি আবির্ভূত হন এবং মন্দ দেবতাদের প্রধান মহিষাসুরকে বধ করেন।  স্কন্দ পূরাণে আছে রুরু দৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করে দেবী জগতে দুর্গা নামে পরিচিত হন। আবার শ্রী শ্রী চণ্ডীতে আছে দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করে দুর্গা নামে প্রতিষ্ঠিত হন। বেশিরভাগ জায়গায় দেবী দূর্গা "মহিষাসুরমর্দিনী" নামে পূজিতা হন। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী দুর্গা শব্দের আক্ষরিক ব্যাখ্যা হল -

'দ'  হল  =  দৈত্যনাশক 
'উ '-কার হল  =  বিঘ্ননাশক 
'রেফ'  =  রোগ ক্ষয়ের অর্থ বহন করে 
'গ'  হল  =  পাপনাশক 
'আ'  হল  =  শত্রূর বিনাশ 

সকল বিঘ্ন, রোগ, ভয়, শত্রূ  হতে যিনি আমাদের রক্ষা করেন,  তিনিই হলেন দেবী  'দুৰ্গা'
দেবী দুর্গা হিন্দু সমাজে নারীর প্রতিচ্ছবি। নারী শুধু মমতাময়ী মা, প্রেমময়ী স্ত্রী, স্নেহময়ী কন্যা নয়, নারীর ভিতরের যে শক্তি, যে তেজ, যে ক্ষমতা তারই বহিঃপ্রকাশ দেবী দুর্গার মধ্যে প্রকাশিত।
কখনও তিনি মহামায়া কখনও  তিনি দুর্গতিনাশিনী  আবার কখনও  তিনি মহিষাসুরমর্দিনীরূপে মর্ত্যে  পূজিত হন। বসন্তকালে বাসন্তীপূজা আর শরৎকালে অকালবোধন দুর্গাপুজো সাধারণত  করা হয়ে থাকে। শরৎকালের পুজো সবচেয়ে জনপ্রিয়।   সমস্ত অশুভশক্তিকে পরাজিত করে অশ্বিনের শারদপ্রাতে মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হন।  
.


দেবীর সৃষ্টি

সকল দেবতার শরীর থেকে নির্গত তেজোরাশি একত্রিত হয়ে এক দশভুজা নারীমূর্তি ধারণ করে।  

মহাদেবের তেজে তৈরী হয় দেবীমুখ
বরুণের তেজে জংঘা ও উরুদ্বয়
বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ
যমের তেজে কেশপাশ 
ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ 
চন্দ্রের তেজে স্তনযুগল 
পৃথিবীর তেজে নিতম্ব
 ব্রম্ভার তেজে পদযুগল
 সূর্যের তেজে পদ আঙ্গুলিসমূহ
 অষ্টবসুর তেজে হাতের আঙ্গুলিসমূহ 
কুবেরের তেজে নাসিকা,
সন্ধ্যাদেবীদ্বয়ের তেজে ভ্রূযুগল
 বায়ুর তেজে কর্ণদ্বয়
এবং বিশ্বকর্মা ও অন্যান্য দেবতাগণের তেজঃপুঞ্জ থেকে দশভুজা দেবী দুর্গা সৃষ্টি হলেন।
অনন্তর সমস্ত তেজোরাশিসম্ভূত মহাদেবীকে দেখে মহিষাসুরপীড়িত অমরগণ আনন্দিত হলেন।

দেবীকে  অস্ত্র প্রদান 

দেবতারা তাঁদের তেজরাশি  দিয়ে দশভুজা নারীকে তৈরী করলেন, এবার  তাঁকে অস্ত্র ও অলংকারে সজ্জিত করার পালা। দেবতারা দেবী দুর্গাকে নানারকম অস্ত্র ও অলংকার দিয়ে সজ্জিত করলেন।  ত্রিশূলধারী মহাদেব স্বীয় শুল থেকে শুলান্তর,  বিষ্ণু স্বীয় সুদর্শনচক্র থেকে চক্রান্তর উৎপাদন করে দেবীকে দিলেন , বরুণদেব দিলেন শঙ্খ , অগ্নিদেব দিলেন শক্তি , পবনদেব দিলেন একটি ধনু ও দুটি বানপূর্ণ  তূনীর,  ইন্দ্র তাঁর বজ্র থেকে বজ্রান্তর এবং ঐরাবত নামক স্বর্গগজের গলদেশস্থ ঘন্টা থেকে ঘন্টান্তর  উৎপাদন করে দিলেন, যমরাজ দিলেন কালদন্ড থেকে একটি দণ্ড, জলদেবতা বরুণ নিজের পাশ থেকে একটি পাশ, প্রজাপতি ব্রম্ভা রুদ্রাক্ষমালা থেকে একটি মালা ও কমণ্ডলু থেকে সৃষ্ট একটি  কমণ্ডলু,  নিমেষাদিকালাভিমানিনী দেবতা একটি প্রদীপ্ত খড়গ ও একটি ঢাল, ক্ষিরোদসমুদ্র দিলেন উজ্জ্বল মুক্তাহার, বজ্রযুগল ,দিব্যচূড়ামণি, দুইটি কুণ্ডল , হস্তসমূহের বলয়গুলি, শুভ্র ললাটভূষণ, সকল বাহুতে অঙ্গদ (বাজু), পায়ের নুপুর, কণ্ঠভূষণ ও অঙ্গুলিগুলির অঙ্গুরী, বিশ্বকর্মা দিলেন কুঠার, নানাপ্রকার অস্ত্র, অভেদ্য কবচ, সমুদ্র তাঁর শিরে অম্লান পদ্মের একটি মালা, বক্ষের একটি মালা ও হস্তে একটি পদ্ম দান করলেন ,গিরিরাজ হিমালয় দিলেন বাহনস্বরূপ সিংহ ও বিবিধ রত্ন, কুবের দিলেন পানপাত্র ,নাগরাজ বাসুকি মহামণিশোভিত একটি নাগাহার  প্রদান করলেন। অন্যান্য দেবগন কর্তৃক অস্ত্র ও অলংকারে ভূষিত হয়ে জগন্মাতা দেবী দূর্গা বারংবার অট্টহাস্য ও হুঙ্কার করতে লাগলেন। 

ক্রমবিকাশের পথে দেবী দূর্গা 


আদিম যুগে শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বিশ্বের প্রায় সকল দেশে প্রাণস্পন্দন ও প্রাণস্পন্দনহীন প্রাণী ও পদার্থের পূজা ও আরাধনার প্রচলন ছিল।  আদিম ও অনুন্নত যুগে বিদেহী আত্মা, ভূত-প্রেত প্রভৃতি অপদেবতাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পূজার প্রচলন ছিল। প্রাচীনকালে বৃক্ষকে কল্পনা করা হতো সূর্যের আশ্রয়রূপে। আকাশের সাথে বৃক্ষের সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হত। যেসব বৃক্ষগুলি সুউচ্চ ও সুপ্রসারিত যেমন বট, অশ্বত্থ, বেল, নিঁম এগুলিকে আকাশ বা সূর্যের আশ্রয় বলা হত এবং পূজা করার রীতি চালু ছিল। বৃক্ষ পূজার পর এলো যূপ ও স্তুপ পূজা। এগুলো বৈদিক যাগযজ্ঞে ব্যৱহৃত হত।  যূপ থেকেই ক্রমে শিবলিঙ্গের উৎপত্তি ও বিকাশ হয়েছে। যূপ ও বৃক্ষ পূজা আর্যসভ্যতার নিদর্শন। দেবী দুর্গার পূজা গোড়ার দিকে অশ্বত্থ, নিম, বেল প্রভৃতি বৃক্ষে করা হত।  বিল্ল বৃক্ষকে  সেখানে দেবী দূর্গা ভাবা হত। ষষ্ঠী তিথিতে বিল্ব বৃক্ষের পূজার পর সপ্তমীর প্রাতঃকালে বৃক্ষরূপিণী দেবী দুর্গার আরোহন করা হয়। শাঁখ, ঘন্টা, কাঁসর  ও ঢাক বাজিয়ে সেই শাখাদেবীকে পূজামণ্ডপে আনা হয়। বৈদিক সম্প্রদায়ের অনুকরণে বৌদ্ধসম্প্রদায়ে মূর্তি পূজা প্রবর্তিত হয়েছিল বলে ধরা হয়। মূর্তিপূজা ভারতের সকল প্রদেশেই প্রচলিত আছে তবে পশ্চিমবাংলায় এর প্রচলন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। দুর্গার দ্বিভূজা, চতুর্ভূজা, অষ্টভুজা, দশভুজা, দ্বাদশভূজা ও অস্টাদশভূজা মূর্তির কথা পূরণে বলা আছে। এই সকল মূর্তির সমস্ত মূর্তিই সকল দেশে পূজ্য নহে, বাংলায় আমরা দশভুজা মূর্তি পূজা করে থাকি।


স্বজন-পরিজন

দেবী দুর্গার স্বজন পরিজন বলতে সাধারণতভাবে তাঁর দুই পুত্র ও দুই কন্যাকে ধরা হয়। আমাদের দূর্গা প্রতিমায় মা দুর্গার দক্ষিণপাশে লক্ষ্মীর মূর্তি এবং বামপাশে সরস্বতীর মূর্তি থাকে। লক্ষ্মী মূর্তির উপরে  গণেশ আর সরস্বতী মূর্তির উপরে কার্তিকের মূর্তি থাকে।

দেবী সরস্বতী -  ভারতীয় পূরাণে দেবী সরস্বতী বহুমাত্রিক দেবী হিসেবে পরিচিত।  দেবী সরস্বতী হলেন জ্ঞান, বুদ্ধি, শিল্পকলা ও বিদ্যার দেবী।  শ্রী শ্রী চন্ডীতে মহাত্মা অম্ভুন ঋষির বিদুষী কন্যার নাম ছিল "বাক" এবং সেই "বাক" বিদ্যারূপিণী দেবী সরস্বতী নামে পরিচিত হয়েছিলেন।  সরস্বতী নামের পৌরাণিক ব্যাখ্যায় "নদীরূপা" ও "দেবতারূপা" দু রকমই  পাওয়া যায়। পদ্মপুরাণে তিনি দক্ষকন্যা এবং কশ্যপ পত্নী হিসাবে স্বীকৃত এবং ব্রম্ভবৈবত  পুরান মতে  তিনি নাযায়নের পত্নী। আদিতে তিনি উত্তর ভারতের সপ্তনদীর (গঙ্গা, যমুনা, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, সরস্বতী ও শতদ্রু ) অন্যতম নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।  সরস্বতী দেবী দুর্গার বামদিকে অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবীর বাহন শ্বেতহংস।

দেবী লক্ষ্মী - দেবী লক্ষ্মী হলেন ধনদেবী।  তবে দেবী লক্ষ্মীর রূপ বা মূর্তি বর্তমানকালে যেভাবে কল্পনা করা হয় বৈদিক যুগে সেরকম ছিল না। তখন লক্ষ্মীকে কখনও শুভ, আবার কখনও অশুভদায়িনীরূপে পাওয়া যায়।  দেবী মা দুর্গার দক্ষিণদিকে অধিষ্ঠিত থাকেন।  দেবীর বাহন পেঁচা।

সিদ্ধিদাতা গণেশ - সিদ্ধিদাতা গণেশ হলেন আসলে মিত্রদেবতার (সূর্যের) একটি ভিন্নরূপ।  সমস্ত পূজানুষ্ঠানে, ধর্মীয় ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে সর্বাগ্রে গণেশের পূজা বিধেয়। দক্ষিনভারতে গণেশের সমাদর ও পূজা অধিকতর ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ।  সিদ্ধিদাতা গণেশ মা দুর্গার ডানপাশে দেবী লক্ষ্মীর পরে অধিষ্ঠিত থাকেন।  গণেশের বাহন ইঁদুর।

কার্তিকেয় - কার্তিক বা কার্তিকেয় সাধারণতভাবে দেব সেনাপতি হিসেবে পরিচিত। কার্তিকের অপর নাম স্কন্দ।  কৃত্তিকা নক্ষত্রে কার্তিকের জন্ম। কৃত্তিকা নক্ষত্রমন্ডলীর ছয় কৃত্তিকার  দ্বারা পুত্ররূপ গৃহীত ও প্রতিপালিত হওয়ায় তিনি কার্তিক বা কার্তিকেয় নামে অভিহিত হইয়াছেন। কার্তিকের অর্থ কৃত্তিকাতনয়।  দেবী দুর্গার বামপাশে দেবী সরস্বতীর পরে অধিষ্ঠিত থাকেন। কার্তিকের বাহন ময়ূর।

আগমনী


আগমনী শব্দটি কন্যারুপী দেবীদুর্গার শরৎকালে মর্ত্যে আগমন বার্তাকেই প্রকাশ করে।  মায়ের আগমনী বার্তা আকাশ, বাতাস, হৃদয়-মন ভড়িয়ে তোলে।  হালকা হিম হিম  ভাব, ঘাসের গায়ে লক্ষ শিশিরের কোহিনুর, দোয়েল শ্যামার ডাক, সফেদ শুভ্র কাশের গুচ্ছ,  ঘন নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা এভাবেই প্রকৃতি  যেন তার বরণডালা নিয়ে আমাদের কাছে শরৎ ঋতুতে উপস্থিত হয়।  প্রকৃতির হাত ধরেই চারদিকে মায়ের আগমনের বার্তা মানুষের মনে আনন্দের পূর্বাভাসের হিন্দোল তোলে।


মহালয়া


"বাজলো তোমার আলোর ধ্বনি"- এর সুর আর স্বর্গীয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বজ্র গম্ভীর কণ্ঠের "আশ্বিনের  শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী" এই চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়েই মহালয়ার দিনটা শুরু হয়। শ্রী শ্রী চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়েই দেবী দুর্গাকে মর্ত্যলোকে  আবাহন জানানো হয়। শারদীয় দুর্গাপুজোর সাথে মহালয়ার কোনো সম্বন্ধ নেই। পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে মহালয়ার পরের দিন দেবীপক্ষের সূচনা হয়। গঙ্গার ঘাটগুলোতে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পন করার জন্য মানুষের ঢল নামে। পুণ্যস্নান আর মন্ত্রচারণে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা হয়।


পূজার পাঁচটা দিনের নিয়ম 

মহাষষ্ঠী

এই দিন দেবী সপরিবারে মর্ত্যে আবির্ভূত হন। বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে মায়ের মূর্তির উন্মোচন করা হয়। সকালে বিল্ব বৃক্ষে দেবীর মঙ্গল বোধন করা হয়। বোধন অর্থ জাগরণ অর্থাৎ বোধনে দেবী জাগরিত হন।  আমন্ত্রণ মানে দেবীকে নিয়ে আসা। বোধন, আমন্ত্রনের পর সন্ধ্যায় অধিবাস করা হয়। অধিবাস মানে দেবীর অবস্থান করা।  মহাষষ্ঠীর দিন নয়টি কোলস্ঘট জলপূর্ণ করে দেবীর নবশক্তিকে আহ্বান করা হয়। এই দিনই বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসবের শুভারম্ভ হয়।

মহাসপ্তমী


মহাসপ্তমী তিথিতে মৃন্ময়ী প্রতিমায় চক্ষুদান, প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও আবাহন মন্ত্রে মা মৃন্ময়ী হতে  চিন্ময়ীরূপে পূজিতা হন। সকালে নব পত্রিকা স্নানের মাধ্যমে দুর্গাপূজার সূচনা হয়। নব পত্রিকা হল দেবী দুর্গার প্রতিনিধি।  নয় ধরণের উদ্ভিদের পুজোর প্রাচীন প্রথা হল নবপত্রিকা স্নান। নবপত্রিকার চারদিকে শ্বেত অপরিজিতা লতা ও হরিদাক্ত ডোর (সুতা) দিয়ে বাঁধার নিয়ম আছে।  নবপত্রিকার আর এক নাম কুলবৃক্ষ। এই কুলবৃক্ষের প্রধান অধিষ্ঠিত দেবতা ও যোগিনীরা হলেন দেবীর সহচরী। জলপূর্ণ কলস বা ঘটকে  দেবীর প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়। ঘটের গায়ে সিঁদুরের পুত্তলিকা, ঘটের  মাথায় চালপূর্ণ  সরা ও নারিকেল, ঘটে জল ও ঘটের মুখে পঞ্চপল্লব রাখা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পরেই দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। ঘটে, প্রতিমায় দেবীর আবির্ভাব হয়।  মৃন্ময়ী প্রতিমা চিন্ময়ী রূপে আবির্ভত হন বলে ধরা হয়।

মহাঅষ্টমী


ভক্তবৃন্দের সমবেত পুষ্পাঞ্জলীর  মাধ্যমে মহাঅষ্টমীর সূচনা হয়ে থাকে। সকাল থেকে উপবাস করে তারপর পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার নিয়ম। এইদিন বহু হিন্দু পরিবারে অন্নভোগ রান্না হয় না, পরিবর্তে নিরামিষ খাবারের চল রয়েছে। অষ্টমী পূজার পরই হয় সন্ধিপূজা।

সন্ধিপূজা 


 সন্ধিপূজা হলো দুর্গাপূজার সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ পূজা। অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট আর নবমীর প্রথম ২৪ মিনিট হল সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণেই মা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন।  অসুরশক্তির বিনাশকালের এই শুভক্ষনেই সন্ধিপূজা করা হয়। এইদিন  কোথাও কোথাও কুমারী পূজাও করা হয়। বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা চালু করেছিলেন।



                                      কুমারী পূজা 



কুমারী পুজো শারদীয়া দুর্গোৎসবের এক বর্ণাঢ্য পর্ব।  তান্ত্রিক মতে কুমারী পুজো চলে আসছে বহু প্রাচীন কাল থেকে। কিন্তু এই পুজোর পরিচিতি সেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে কুমারী পুজোর আয়োজন করার পর থেকে এই পুজো নিয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। তন্ত্র শাস্ত্র অনুযায়ী কুমারী পুজো বলতে বোঝায় এক থেকে ষোলো বছরের কম বয়সী অরজঃসলা কুমারী মেয়ের পুজো। বয়স অনুসারে কুমারীর বিভিন্ন নামকরণ করা হয়।

এক বছরের কন্যার নাম =  সভ্যা 
দুই বছরের কন্যার নাম  =  সরস্বতী 
তিন বছরের কন্যার নাম  =  ত্রিধমূর্তি 
চার বছরের কন্যার নাম  =  কালিকা 
পাঁচ বছরের কন্যার নাম =  সুঙ্গা 
ছয় বছরের কন্যার নাম  = উমা 
সাত বছরের কন্যার নাম = মাতঙ্গিনী 
আট বছরের কন্যার নাম = কুষ্টিকা 
নয় বছরের কন্যার নাম  =  কাল সন্দভা 
দশ বছরের কন্যার নাম = অপরাজিকা
এগারো বছরের কন্যার নাম  = রুদ্রাণী 
বারো বছরের কন্যার নাম = ভৈরবী 
তেরো বছরের কন্যার নাম = মহালক্ষ্মী 
চোদ্দ বছরের কন্যার নাম = পঠনায়িকা 
পনেরো বছরের কন্যার নাম  = ক্ষেত্র 
ষোলো বছরের কন্যার নাম  = অম্বিকা 


মহানবমী

মহানবমী হল দুর্গা পূজার শেষ দিন।  সন্ধিপূজার পর শুরু হয় মহানবমীর পূজা। এই  দিন ষষ্ঠী থেকে যত দেবদেবীর পূজা করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে আহুতি দিতে হয়। এই দিনের অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে বলিদান।  শাস্ত্রমতে ছাগ বা মহিষাদি বলির রীতি আছে।  কিন্তু বর্তমানে পশুবলি করা যায় না, তার পরিবর্তে কুস্মান্ড, ইক্ষুদান বলি দেওয়া হয়।

দশমী

তিনদিনের পুজোর পর  বিষাদের দিন।  দশমীর পুজো শেষ করে মহাস্নানের যে দর্পণ ছিল সেটিতে মাকে  চিন্ময়ীরূপে বিসর্জন দেওয়া হয়।  বেজে ওঠে বিসর্জনের বাদ্যি। মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। নবমীর উচ্ছ্বাস-আনন্দের পরই বিদায়ের সুর নিয়ে আসে দশমী।

দেবীবরণ


দশমী পুজোর পর শুরু হয় দেবীকে বরণ করার পালা।  এই দেবীবরণের মাধ্যমে মাকে জানানো হয় মনের সব কামনা। বলা হয় "মা তুমি  আবার এসো, তুমি আমাদের রূপ দাও, যশ দাও, শত্রূকে জয় করার শক্তি দাও।  তোমার আশীর্বাদ আমাদের  নিত্য পাথেয় হোক "।

সিঁদুর খেলা


বিজয়ার বিষাদের  সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে সিঁদুর খেলার নিয়ম। এটা হল স্ত্রী আচার। মানুষের বিশ্বাস দুর্গামায়ের সিঁথির সিঁদুর নিয়ে মাথায় ঠেকালে সধবাদের সিঁথির সিঁদুর দীর্ঘস্থায়ী হয়। মাকে সিঁদুর দানের পর একে অন্যের সিঁথি সিঁদুরে রাঙিয়ে দেয়। দেবীবরণের মাধ্যমে আনন্দময় সমাপন ঘটে। চারদিনের প্রানঢালা আনন্দস্রোত পৌঁছে যায় শেষ লগ্নে। বিষাদসিন্ধুতে ডুবে যাওয়ার আগে সিঁদুরখেলার মাধ্যমেই  অন্তরের সব আবেগ উজাড় করে দেওয়া হয়।

বিসর্জন


 শাস্ত্র মতে পুরোহিত মায়ের বিসর্জনের আনুষ্ঠানিক পর্ব শেষ করেন। তারপর মণ্ডপে দেবীবরণ ও সিঁদুর খেলা অনুষ্ঠিত হয়।  সাধারণত সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা সহকারে মাকে  নিরঞ্জনের জন্য কাছাকাছি কোন নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই শোভাযাত্রার মধ্য দিয়েই শেষ হয় হিন্দু ধর্মের পরম কাঙ্খিত শারদোৎসব।  উত্তর চব্বিশ পরগনার টাকিতে এই বিসর্জন একটু অন্যভাবে পালন করা হয়ে থাকে। সেখানে সকালে দুটো নৌকোর মাঝখানে মাকে বসিয়ে সারাদিন ইছামতী নদীতে প্রদক্ষিণ করানো  হয়।  তারপর সন্ধ্যের সময় মাকে  ইছামতীতে ভাসানো হয়।

বিজয়া দশমী

শিবসহ শিবানী কয়েকদিনের জন্য ছিলেন কৈলাশের বাইরে। বিজয়া মুহূর্তে তাঁদের কৈলাসে ফিরে  আসাকে আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়।  মর্ত্যেও  মিষ্টি মুখের সাথে অশুভের উপর শুভের বিজয়া উদযাপিত হয়।  সবাই মেতে ওঠে এই মিষ্টতার উৎসবে।  পূর্বে এই উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল "কোলাকুলি" করা, যা বর্তমানে খুব একটা দেখা যায় না।

দুর্গাপূজা আনন্দময় মহামিলনের  উৎসব। যা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিয্যের প্রতীক।  এই পুজো এখন আর শুধু হিন্দুদের জন্য আনন্দ বয়ে আনে না, সব  জাতির মধ্যেই আনন্দ, শান্তি ও ভালোবাসা বয়ে নিয়ে আসে।  এ যেন এক সৌভ্রাতৃত্বের মিলনোৎসব। তাই দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় কৃত্য নয়, তা সার্বজনীন উৎসবও বটে




তথ্যসূত্র : মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা , স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ১৫-০৮-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 

Monday, August 5, 2019

কসবার গর্ব: শতাব্দী প্রাচীন কসবা সাধারণ পাঠাগার >

কসবার গর্ব: ১১৬ বছরের প্রাচীন পাঠাগার 



                            কসবা সাধারণ পাঠাগার 

শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে মানব সভ্যতার সকল জ্ঞান জমা হয়ে আছে গ্রন্থের ভিতর। অন্তহীন জ্ঞানের ভান্ডারই হল গ্রন্থ। গ্রন্থগুলি আজকের পৃথিবীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে।  এই গ্রন্থের আবাস্থল হল গ্রন্থাগার বা পাঠাগার। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে গ্রন্থাগারই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ তথ্যাদি সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে সেবা প্রদান করে আসছে। দক্ষিণ কলকাতার এক প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু অঞ্চল হল কসবা।  এখানে ১১৬ বছর আগে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি পাঠাগার, যা আজও  স্বমহিমায় বিরাজ করছে। 

১৯০৪ সালে কসবার মত এক গ্রামে কয়েকজন উৎসাহী যুবক জুলাই মাসের ২৪ তারিখে স্বর্গীয় নবীনকৃষ্ণ ঘোষাল  মহাশয়ের জমির এক পর্ণকুটিরে স্বদেশী আন্দোলনের পটভূতে "রেনু কুটির লাইব্রেরী" প্রতিষ্ঠা করে।  যুবকদের মধ্যে সর্বশ্রী নিরঞ্জন ঘোষাল, ক্ষীরোদ প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, বঙ্কিমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শৈলেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যাযের  নাম উল্লেখযোগ্য। পাঠাগারের উদ্বোধন সভায় বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক রায় সাহেব বিহারীলাল সরকার পৌরোহিত্য করেছিলেন।  ১৯০৬ সালের ২৬শে জানুয়ারি সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের উপস্থিতিতে বসন্তউৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বছর চারেক চলার পর ১৯০৮ সালে পরিচালকদের মতপার্থক্যের কারণে সাময়িক অচলাবস্থা হয়েছিল। পরবর্তীকালে "শান্তি লাইব্রেরী" নামে স্থান পরিবর্তন করে বঙ্কিমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে চলে আসে। এই সময় পাঠাগারে শ্যামলাল চক্রবর্তী মহাশয় দুইশত বই এবং নিত্যগোপাল ঘোষাল মহাশয় ৫০ টাকা দান করেন।

১৯১৭ সালের ১৯শে অক্টোবর আবার নাম পরিবর্তন করে "কসবা পাবলিক লাইব্রেরী" করা হয়। মন্মথনাথ রায় মহাশয়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় ও আর্থিক সহাযতায় লাইব্রেরীটি রেজিস্ট্রিকৃত হয়। ১৯১৯ সালে বঙ্কু বিহারী  চট্টোপাধ্যায় ও অমূল্য চট্টোপাধ্যায় পাঠাগারের বর্তমান জমিটি দান করেন।

পাঠাগারের প্রথম সারস্বত উৎসবে সভাপতি হিসেবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, এছাড়া পন্ডিত হরিদেব শাস্ত্রী ও বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার সি ভি রমন উপস্থিত ছিলেন।  ১৯২২ সালে হরিশ্চন্দ্র চৌধুরী ও গিরিশচন্দ্র চৌধুরী মহাশয়দের আর্থিক সাহায্যে পাঠাগারের গৃহনির্মাণের কাজ শুরু হয়। বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে গৃহনির্মাণ কার্য সুসম্পন্ন হয়।  ১৯২৮ সালে ইংরেজ সরকারের ৫০ টাকা অনুদানে বিজলি বাতির সংযোগ করা হয়।

১৯৩১ সালে পাঠাগারের উন্নতিকল্পে এক বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। উক্ত অনুষ্ঠানে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, স্বনামধন্য কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী, নির্মল চন্দ্র চন্দ্র সহ আরো বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সেই দিনে বিদ্রোহী কবি স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন।

১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৮০০ টাকার পুস্তক এবং ১৯৫২ সালে ৫৫০ টাকার পুস্তক প্রদান করে। চিত্তরঞ্জন জাতীয় বিদ্যালয় সোসাইটি পাঠাগারের আসবাব কেনার জন্য ২০০ টাকা প্রদান করে।

১৯৫৪ সালের ১৪ই নভেম্বর উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পাঠাগারের ৫০ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হয়। ৫০ বছরের গৌরবময় তথ্যসম্বলিত পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এই সময় কৃষ্ণচন্দ্র পাল মহাশয় একখণ্ড জমি দান করেন। পাঠাগারের গৃহকে দ্বিতল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।  ১৯৫৮ সালে পাঠ্যপুস্তক বিভাগটি খোলা হয়।  ১৯৫৯ সালের ৪ঠা অক্টোবর পাঠাগারের দ্বিতল গৃহটি উদ্বোধন করেন তদকালীন পৌরপ্রধান শ্রী বিজয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। এই বছরেই পাঠাগার শিশু বিদ্যালয় "আলোর পরশ"-র পরিচালনভার গ্রহণ করে।

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঠাগারের ৭৫তম বর্ষ পূর্তির উৎসব পালন করা হয়।  ১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৭৫০০ টাকা, ১৯৮৭ সালে  স্বর্গীয় ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়ের জন্মদিনে তাঁর পুত্রগণ ৫০০০ টাকা দান করেন।  ১৯৯৬ সালে ডি এন ঘোষ জনকল্যাণ ট্রাস্টের আর্থিক সহায়তায় পাঠাগারের ত্রিতল কক্ষ নির্মাণ শুরু হয়। এই সময় উচ্চশিক্ষার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আলাদা পাঠ্যপুস্তক বিভাগ খোলা হয়। ২০০৪ সালে মহা সাড়ম্বরে শতবর্ষ অনুষ্ঠান পালন করা হয়।  শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এম পি ল্যাড থেকে ৯৯,৫০০ টাকা, শ্রী দীনেশ ত্রিবেদীর এম পি ল্যাড থেকে ৫৬,০০০ টাকা এবং বিধায়ক শ্রী রবিন দেবের কাছ থেকে ১,০০,০০০ টাকা পাওয়া যায়।  উক্ত টাকায় পাঠাগারের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়।

আজকের যুগে সমস্ত তথ্যই কম্পিউটারের সাহায্যে পাওয়ার জন্য মানুষের বই পড়ার আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে, তা সত্ত্বেও এখানে প্রায় শতিনেক পাঠক-পাঠিকা ও হাজার তিরিশেক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। বর্তমান পরিচালকদের নিরলস চেষ্টায় দিন কয়েক আগে বেশ ঘটা করে ১১৬তম বর্ষ পালন করা হয়।  এই অনুষ্ঠানে কলকাতার নামী দুজন প্রকাশনা সংস্থাকে নিয়ে একটা বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। আমি এই মেলায় উপস্থিত থেকে দেখেছি এখনো বইয়ের প্রতি মানুষের একটা  আগ্রহ রয়েছে, তা মেলার ভীড় দেখে বুঝেছিলাম।

পাঠাগারের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সরণি বেয়ে ও কর্মীদের নিরলস চেষ্টায় এবং স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় শতাব্দী পেরোনো এই পাঠাগার আজও যেন যৌবনের ছটায় উজ্জ্বল।  পাঠাগারটি কসবার গর্ব, এলাকাবাসীর কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে।  আশাকরি সকলের যে উদ্দ্যমে আজ পাঠাগারের এই বাড়বাড়ন্ত, তা যেন কোনদিন থেমে না যায়। আমি সবার কাছে আবেদন রাখছি পাঠাগারের উন্নতির জন্য গরিব ছাত্র ছাত্রীদের কথা ভেবে পুস্তক ও আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া জন্য। কসবার এই গর্বকে আরো গৌরবের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।




ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০৫-০৮-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Friday, August 2, 2019

শ্রী শ্রী রামঠাকুর ও কৈবল্যধাম>

শ্রী শ্রী রামঠাকুর ও কৈবল্যধাম



"গুরু" এই শব্দটি বাঙালি জীবনের চলার পথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে।  যাঁর তুলনায় আমি লঘু তিনিই হলেন গুরু। গুরুই আমাদের চিত্তকে লঘুতার থেকে গুরুতার দিকে আকর্ষণ করেন। যুগে যুগে ভারতের মাটিতে বহু গুরুর আবির্ভাব ঘটেছে। বহু সদ্গুরু এসেছেন এই পুণ্যভূমিতে। তেমনই এক গুরু ১৮৬০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরের  ডিঙ্গামানিক গ্রামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মানবসত্তার অবমাননা, ধর্মের গ্লানি দূর করতে শ্রী শ্রী রামচন্দ্রদেবের আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনিই অপরমারাধ্য শ্রী শ্রী কৈবল্যনাথ বা শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ। দিব্যপুরুষ শ্রী শ্রী রামচন্দ্রদেবই সকলের পূজনীয় শ্রী শ্রী রামঠাকুর।


পিতা শ্রী রাধামাধব বিদ্যালঙ্কার ছিলেন একজন তন্ত্রাচারী সিদ্ধযোগী। মাতা শ্রীমতি কমলাদেবী আচার, নিষ্ঠা ও ধর্মপরায়ণ নারী ছিলেন।  তাঁদের চার পুত্র ও এক কন্যা ছিলেন।  তাঁদের তৃতীয় পুত্র শ্রী রামচন্দ্রদেব বাল্যকাল থেকেই অন্তর্মুখী ও ভাবুক প্রকতির ছিলেন।  পড়াশুনায় কোনো মন ছিল না, বনে-জঙ্গলে সবসময় ঘুরে বেড়াতেন।  মা চিন্তা করতেন পন্ডিতের ছেলে মূর্খ হয়ে থাকবে।  যদি তাঁর মনের পরিবর্তন হয় সেই কারণে অল্প বয়সেই তাঁর উপনয়ন দিয়ে দিলেন। উপনয়নের কিছুকাল পরেই রামচন্দ্র নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ালেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করলেন। তিনি স্বপ্নে এক গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা পেয়েছিলেন।  ভারত ও অধুনা বাংলাদেশের বিভিন্নপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি কামাখ্যা মন্দিরে এসে উপস্থিত হলেন।  এখানেই সেই তেজময় পুরুষের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হল যিনি তাঁকে স্বপ্নে দীক্ষা দিয়েছিলেন। গুরুর সাথে নিরুদ্দেশের পথে চলে গিয়েছিলেন, প্রায় আট-দশ বছর পরে তিনি গৃহে ফিরে আসেন। গুরুর সান্নিধ্যে থেকে তিনি হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ও অন্যান্য জায়গায় পরিভ্রমণ করেন। নানা তীর্থ দর্শনের সৌভাগ্যও তাঁর জীবনে ঘটেছিল। অল্প কিছুদিন বাদে তিনি আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যান।  ১৯০২-০৩ সাল নাগাদ আবার তাঁর পুনরাবির্ভাব হয়  কলকাতায়। ১৯০৩ সালে তাঁর মাতৃদেবীর মৃত্যুর সময় তিনি কালীঘাটে ছিলেন, তারপর কয়েক বছর হুগলির উত্তরপাড়াতে কাটান। ওখান থেকে আবার তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শোনা যায় এই সময় তিনি দক্ষিণ ভারতে কাটান এবং ১৯০৭ সালের শেষের দিকে তিনি আবার গৃহে ফিরে  আসেন। এই সময় থেকে তাঁর মহাপ্রয়াণ পর্যন্ত তিনি মানবসেবায় ব্রতী ছিলেন। তিনি কোনোদিন সন্ন্যাসীদের মতন গৈরিক বস্ত্র পড়েননি। গলায় মালা পরে,  অতি সাধারণ একটা ধুতি ও চাদর পরে সারাজীবন লোক শিক্ষা দিয়ে গেছেন।  তিনি অসীম আধ্যাত্মশক্তির আধার ছিলেন। ক্রমে ক্রমে একজন দুজন করে তাঁর ভক্তের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। ভক্তগণ তাঁর দর্শন ও অমৃতবাণী শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলো। ভক্তগণ তাঁর সেবা করার জন্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ প্রকাশ করল। তারা চট্টগ্রামের কাছে জঙ্গলঘেরা পাহাড়ের তলায় আশ্রম করার নির্দেশ পেলেন ঠাকুরের কাছ থেকে।  জরাজীর্ণ এক বটবৃক্ষকে ঘিরে আশ্রমটি ও যাত্রীনিবাস গড়ে তোলা হল। ঠাকুরের নির্দেশে শ্রী শ্রী কৈবল্যনাথের পট  প্রতিষ্ঠিত হল এবং শ্রীমৎ হরিপদ বন্দ্যেপাধ্যায় আশ্রমের প্রথম মোহন্ত নিযুক্ত হলেন। ঠাকুরের ইচ্ছানুসারে সত্যনারায়ণ সেবাই হল কৈবল্যধামের প্রধান লক্ষ্য ও কর্তব্য। এছাড়া এখানকার ক্রিয়াকর্মের অভিমুখ হল জনকল্যাণমুখী এবং মানুষের হিতসাধন।

ঠাকুরের নির্দেশেই কলকাতার যাদবপুরে কৈবল্যনাথ শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৪২ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি। এটাই ভারতবর্ষের একমাত্র ঠাকুরের আশ্রম। এই আশ্রমে একটা পরিচালন কমিটি আছে।  কমিটির সদস্যরাই এখানকার কাজকর্ম ও উৎসবগুলি পরিচালনা করে থাকেন। প্রতিদিন ভোরবেলা মঙ্গলারতি, মধ্যাহ্নে ভোগ, সন্ধ্যায় সত্যনারায়ণ সেবা, পাঁচালি পাঠ, সিন্নি হয়।  এখানে গ্রন্থাগার ও দাত্যব্য চিকিৎস্যালয় আছে। এখানে সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল ও আর্ত মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। এখানে এলোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথিক দুরকমের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া এম্বুলেন্স পরিষেবার ব্যবস্থাও রয়েছে।   দুস্থদের দান ধ্যান করা হয়। দুস্থ ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বইপত্তর ও স্কুল-কলেজের বেতন ও প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা করা হয়। ২০০৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর গ্রহাগারটির উদ্বোধন করা হয়। অধ্যাত্মবিষয়ক ও ভক্তিমুলকগ্রন্থে গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ। নাটমন্দিরের পাশে মূলমন্দিরে কৈবল্যনাথ বিজড়িত।  ভক্তদের মুক্ত হস্থের দনে এই বিশাল কর্মকান্ড চলে আসছে। "সত্যের সন্ধ্যানে" নামক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

ঠাকুর বলতেন আশ্রমই আমার প্রাণ, আশ্রমই হরিনামের লীলাভূমি ও নামযজ্ঞের স্থান।  এই স্থানের মাধ্যমে সর্বধর্ম সমন্বয় হবে এবং কালক্রমে কোন মহাপুরুষ এই পবিত্র ধামের মাহাত্ম্য প্রচার করবে। ঠাকুরের এই বাণী আজ সত্য বলে প্রমাণিত। দিনে দিনে যেমন ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে তেমন এই সত্যধামের কথা লোকমুখে প্রচারিত হচ্ছে।  ঠাকুরের দিব্য জীবনের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তারা উপলব্ধি করেছেন ঠাকুরের যোগমাহাত্ম্যকে। অপরিসীম আধ্যাত্মিক শক্তির মূর্ত প্রতীক শ্রী শ্রী ঠাকুর সর্বদা বিনয়ী থেকে মানুষের হিতসাধন করার চেষ্টা করে গেছেন। ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই  বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে প্রথমটি,  ভারতবর্ষের কলকাতার যাদবপুরে দ্বিতীয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়, এই দুটি আশ্রম "কৈবল্যধাম" নামে প্রতিষ্ঠিত। তৃতীয়টি তাঁর পবিত্র জন্মভূমি বাংলাদেশের ডিঙ্গামানিক  গ্রামে  "সত্যনারায়ণ শিবমন্দির" নামে  প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮৯ সালের ১লা মে শ্রী শ্রী ঠাকুর জীবন রাখেন। তাঁর নশ্বর দেহের  অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী গ্রামে ঠাকুরের মহাসমাধি হয়েছিল। যে স্থানে তাঁর দেহ সমাহিত হয় সেই স্থানে ঠাকুরের ইচ্ছা অনুযায়ী "সমাধি মন্দির" নির্মাণ করা হয় ও একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই আশ্রমটি ঠাকুরের চতুর্থ আশ্রম।

শ্রী শ্রী ঠাকুর ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় অবিভক্ত বঙ্গদেশে মানবজীবন ধারণ করে এসেছিলেন।  তিনি একান্তভাবে প্রচারবিমুখ ছিলেন।  একজন পরমপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশের মানুষ তাঁর  সম্বন্ধে অজ্ঞ।

ঠিকানা : ৩৪,  রামঠাকুর সারণি, যাদবপুর, কলকাতার ৭০০০৩২

পথনির্দেশিকা : কলকাতার যে কোনো স্থান থেকে বাসে করে যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডে এসে রিক্সা বা পায়ে হেঁটে পৌঁছানো যায়। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে যাদবপুর স্টেশানে নেমে রিক্সা বা পায়ে হেঁটেও  পৌঁছানো যায়।


তথ্যসূত্র : সময়-এসময় পত্রিকা, ১৪২২ মাঘ সংখ্যা

ছবি ও  লেখার স্বত্ত  : সুদীপ্ত মুখার্জী 
তারিখ : ০২-০৮-২০১৯


যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।