বড়দিন ও কলকাতা
পঁচিশ মানে বড়দিন
পঁচিশ মানে যীশু
পঁচিশ মানে সকল দেশে
খুশি সকল শিশু।
পঁচিশ মানে কেক, মিষ্টি
পঁচিশ মানে ভালোবাসা
পঁচিশ মানে সান্তাক্লজ
মেটায় শিশুর আশ।
পঁচিশে ডিসেম্বর মানেই বড়দিন। বড়দিন মানেই শিশুদের মন ভোলানোর জন্য সান্তাক্লজের আবির্ভাব ও উপহার প্রদানের অলীক কল্পনা। বড়দিন হলো খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এক বাৎসরিক উৎসব। ধরা হয় এই দিনে খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রিষ্ট জন্মেছিলেন। সেই কবে বেথেলহেমের আস্তাবলে আশ্রয় নিয়েছিলেন আসন্নপ্রসবা মেরি, সারা বেথেলহেম যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, সেই সময় সবার অলক্ষে চুপিচুপি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আস্তাবলে এসে নামলো। এক অপার্থিব আলো সারা পৃথিবীকে আলোকিত করল। জন্ম নিল এক শিশু। সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি যে এই শিশু একদিন পাল্টে দেবে পৃথিবীর মানচিত্রকে। এই নির্দিষ্ট দিনটিতে যীশু জন্মগ্রহণ করেছেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। যীশুর জন্মদিনের কোনো তারিখের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে যীশুর পৃথিবীবাস শেষ হওয়ার অনেক বছর পর ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন প্রথম যীশুর জন্মদিন পালন করেছিলেন। রোমবাসীরা সারা রাত জেগে সেদিন বড়দিনের উৎসব উদযাপন করেছিলেন। যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনকে ইংরেজিতে "খ্রিষ্টমাস" বলা হয় আর বাংলায় "বড়দিন" বলে অভিহিত করা হয়। বাংলায় বড়দিন শব্দটি সম্ভবত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সর্বপ্রথম তাঁর লেখায় ব্যবহার করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন "যদিও আমরা হই হিন্দুর সন্তান, বড়দিনে সুখী তবু, খ্রিষ্টান সমান"।
২৪শে ডিসেম্বর মধ্য রাত্রি থেকে গির্জায় গির্জায় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে যীশুর জন্মদিন পালন করা রীতি রয়েছে। ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে সারা বিশ্বেই বড়দিন বা খ্রিষ্টমাস হিসেবে পালন করা হয়। সময়ের আবর্তে বড়দিন আজ পেয়েছে সর্বজনীন উৎসবের মর্যাদা। শুরুতে এই উৎসব সেরকমভাবে উৎযাপন করা হতো না। যীশু খ্রিষ্টের জন্মের বহু বছর পর থেকে এই দিনটিকে খ্রিস্টানরা আনন্দ ও মুক্তির দিন হিসেবে পালন করা শুরু করে। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে যীশুই মানব জাতিকে দেখিয়েছিলেন মুক্তি ও কল্যাণের পথ। তাই তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করে সারা বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষেরা। ২৫শে উৎসবের শুরু আর নিউ য়ার্স উৎসবের শেষ।
আমাদের শহর একসময় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। শহরের বুকে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের মধ্যে গির্জার সংখ্যাও কিছু কম নয়। প্রতিবছরই এইসব গির্জাগুলো বড়দিনের প্রাক্কালে নানারকম আলোকমালায় সজ্জিত হয়। ক্রিসমাস ইভের সন্ধ্যায় ও ক্রিসমাসের দিন মানুষের ঢল নামতে দেখা যায় এই গির্জাগুলোতে। অনুষ্ঠিত হয় প্রার্থনা সভার। এই বিশেষ দিনে বিভিন্ন গির্জা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় সেই সব চার্চগুলোর ছবি। এই দিন স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারী ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলো সাধারণত ছুটি থাকে। বাবা-মায়ের হাত ধরে কচিকাচারা সকাল থেকেই ভিড় জমান শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে। যদিও বাঙালির সাথে বড়দিনের কোনো সুদূর সম্পর্ক নেই, তবুও বাঙালিরা এই দিনটা উৎসব হিসেবেই পালন করে আসছে।
আমাদের তিলোত্তমা সেজে উঠে, সেজে উঠে শহরের অ্যাংলো পাড়াগুলো। শহরের রাস্তার দুপাশে নানান মাপের সান্টা ক্লজ, ক্রিসমাস ট্রি, জিঙ্গল বেল বিক্রির জন্য বিক্রেতারা পশরা সাজিয়ে বসেন। যুগ যুগ ধরে আমাদের শহরে হিন্দু-মুসলমানদের মন্দির-মসজিদের পাশাপাশি অবস্থান করে বহু গির্জা। এ যেন শহর কলকাতার এক সম্প্রীতির বন্ধন। কলকাতা তো সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শহর। নস্টালজিয়া বাঙালির শিরায় শিরায়। তাই তারা সব ধর্মের অনুষ্ঠানেই নিজেদের আনন্দটুকু ঠিকভাবে তুলে নিতে জানে। শহর জুড়ে শীতের আবহাওয়া। তাপমাত্রার পারদ এই সময় অনেকটাই নেমে যায়, লেগে যায় হিমের পরশ। বড়দিনের অপেক্ষায় প্রহর গোনে শহরবাসী। বাবা-মায়ের হাত ধরে কচিকাচারা সকাল থেকেই ভিড় জমান চিড়িয়াখানায় বা ইকোপার্কে বা অন্যান্য জায়গাগুলোতে। রংবাহারি আলোর সাথে উৎসবের মেজাজ মহানগরবাসীদের বরাবরই পছন্দের। সেজে ওঠে গির্জাগুলোর সাথে সাথে হগ মার্কেট, বো-ব্যারাক, অ্যালেন পার্ক ও সমগ্র পার্ক স্ট্রিট। এলইডি আলোর চাঁদোয়ায় ঢাকা, আলো ঝলমল করে অ্যালেন পার্ক্ ও পার্ক স্ট্রিট। উৎসব উদযাপনের ছাপ লক্ষ্য করা যায় পার্ক স্ট্রিটের আনাচে-কানাচে। পার্ক স্ট্রিটের আনন্দ বুক ভোরে নিতে আসে বাঙালিরা। বেলুন হাতে পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথ ও রাস্তাটিতে মাথায় লাল আলো জ্বলা সান্টা টুপি পরে বাচাদের বড়দের হাত ধরে ঘুরতে দেখা যায়। গান বাজনা, খাওয়া-দাওয়া আর হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে শহুরে জীবনগুলো। কারো সঙ্গে বন্ধু-বান্ধব, কারো সঙ্গে প্রিয় নারী। রাত যত বাড়ে তত সাহেবপাড়ার আলোগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বার-রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় উপচে পরে। বারগুলোতে ওঠে স্কচ-হুস্কির ফোয়ারা। কোনো কোনো বারে আবার নাচ-গানের এলাহী ব্যবস্থা থাকে। সুন্দরী নৃত্যপটীয়সীরা তাদের শরীরের চটুল ভঙ্গিতে অতিথিদের উষ্ণ শরীর করে তোলে উষ্ণতর। দলে দলে শহরের মানুষ সামিল হয় সাহেবপাড়াগুলোতে। সেলফি তোলার হিড়িক পরে যায়। আট থেকে আশি ভিড় জমান গির্জাগুলোতে ও পার্ক স্ট্রিটের বাহারি আলোর তলায়। সর্ব জাতি মিলেমিশে এক হয়ে যায়। যুবক-যুবতী ও বাচ্ছারা মাথায় লাল রঙের সান্টা টুপি আর চোখে বাহারি নকল চশমায় নিজেদের সাজিয়ে তোলে। তিলোত্তমা বড়দিনকে স্বাগত জানায়।
পাড়ায় পাড়ায় তৈরী হয় বড়দিনের নানারকমের সামগ্রীর সাথে কেকের দোকান। কেক ছাড়া বড়দিনের স্বাদটাই বিস্বাদ। তাই কেকের দোকানেও ভিড় উপছে পড়তে দেখা যায়। কেক বিলাসের অন্যতম পীঠস্থান হল হগ মার্কেট। গরম গরম কেকের গন্ধে বাজারটির চারদিক ম ম করে। নাহুমস, ক্যাথলিন এরকম বহু নামি-দামি ব্যান্ডের আঁতুরঘর এই জায়গাটি। হগ মার্কেটে বছরের পর বছর ধরে এই দোকানগুলো কেকের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। এখানে আসলেই আপনার সাধ্যের মধ্যেই হবে আপনার স্বাদ পূরণ। বড়দিনের কেক, হগ মার্কেট ও বাঙালি মিলেমিশে এই সময়টাতে যেন এক হয়ে যায়।
ক্রিস্টমাস ট্রি, আলো, মিষ্টি, খেলনা, তারা, ঘন্টা দিয়ে ঘর সাজানোর রেওয়াজ বহু প্রাচীন। প্রথম দিকে উত্তর ইউরোপের ফার গাছগুলোকে এভাবে সাজানো হতো। পরবর্তীকালে তা বিশ্বের সর্বত্রই ছড়িয়ে পরে। আমাদের শহরও এর থেকে বাদ যায় না। শহরের বহু মানুষকে এইদিন ক্রিস্টমাস গাছ ও রং-বেরঙের আলো দিয়ে নিজেদের ঘরে যীশুর মূর্তি সাজাতে দেখা যায়।
সান্টাক্লজ হল পাশ্চাত্য সংস্কৃতির রূপকথার এক কিংবদন্তি চরিত্র। সাধারণভাবে তিনি সান্টা নামে পরিচিত। উপকথায় বলে তিনি নাকি একজন অত্যন্ত দয়াবান ছিলেন। সান্টা সাধারণত হাস্যমুখর, সাদা দাঁড়িওলা একজন বৃদ্ধ মানুষের চিত্র। তার পরনে সাদা কলার ও সাদা আস্তিনের লাল কোর্ট ও সাদা আস্তিনের লাল রঙের ট্রাউজার্স, কালো চামড়ার বেল্ট ও বুট জুতো পরিহিত। তার পিঠের ঝোলাতে থাকে নানা রকমের উপহার সামগ্রী। প্রাচীন গ্রিসের লাইসিয়াতে চতুর্থ শতকে সন্ট নিকোলাসের উল্লেখ মেলে। প্রচলিত বিশ্বাস হলো তিনি নাকি বড়দিনের প্রাকাল্লে অর্থাৎ ২৪ তারিখ মধ্যরাত্রে ভালো ভালো ছেলে মেয়েদের নানারকম উপহার দিয়ে থাকেন। এই কিংবদন্তির উৎস হল ঐতিহাসিক উপহার প্রদানকারী চরিত্র সন্ট নিকোলাস। সন্তসুলভ অবদানগুলোর পাশাপাশি তিনি শিশুদের পরিচর্যা, দয়া ও উপহার প্রদানের জন্য খ্যাত ছিলেন। সন্তের পোশাকে তিনি শিশুদের খোঁজখবর নিতেন এবং বিচার করে দেখতেন কোন কোন শিশু উপহার পাওয়ার যোগ্য। সি সন্ত নিকোলাস সান্তাক্লজের আদি রূপ। নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামে খুবই জনপ্রিয় চরিত্র সিন্টারক্লাস ৬ই ডিসেম্বর তিনি উপহার দেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিসমাসের দিনও বেশ কিছু লোক উপহার দিয়ে থাকেন। যদিও আধুনিক সান্টাক্লজের রূপকল্পটি সৃষ্টি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। মার্কিন প্রেসে সান্তাক্লজ শব্দটি ১৭৭৩ সালে সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল। রূপকথা আছে কি নেই কারো সেভাবে জানা না থাকলেও আমরা দেখেছি বহু মা-বাবা তার শিশু ২৪ তারিখে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়লে তার মাথার কাছে একটি মোজার ভিতরে নানারকম খেলনা ও উপহার ভরে রেখে দেয়, পরের দিন সকালে শিশুটির ঘুম ভাঙলে সে যেন মোজাটি খুলে দেখতে পায় যে সান্টাক্লজ তার জন্য কি কি উপহার পাঠিয়েছে। শিশু মনের আনন্দে তৈরী হয় উৎসবের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। সারা পৃথিবীতেই পিতা-মাতার তাদের সন্তানদের সান্টাক্লজ ও অন্যান্য উপহারপ্রদানকারীদের সম্পর্কে শিক্ষা দিলেও, কেউ কেউ এগুলোকে কুসংস্কার হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। আবার অনেক দেশেই এই দিনে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে উপহার আদান-প্রদানের রীতি রয়েছে।
বড়দিন মানে ঈশ্বরের কাছে থেকে সঠিক পথের নির্দেশ পাওয়া। বড়দিন মানে খারাপ কাজ ছেড়ে ভালো পথে চলতে শেখার দিন। যীশু নামের অর্থ উদ্ধারকর্তা বা রক্ষাকর্তা। যীশু হলেন একজন মানবরূপী ঈশ্বর। পবিত্র বাইবেল বলে "যীশু খ্রিষ্টেই আমরা মুক্তি, পাপের মোচন প্রাপ্ত হয়েছি। ইনিই অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি"। আমাদের জীবনে বড়দিনের সার্থকতা শুধু ত্যাগস্বীকারে, ভোগবিলাসে বা উপহার দেয়া-নেয়াতে নয়। যদি আমরা সর্ব ধর্মের সকল মানুষকে ভালোবাসি, তবেই বড়দিন সমাজে সার্থক হবে।
কবিতা : শক্তিপদ ঘোষ
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ২৪-১২-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।
আমাদের শহর একসময় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। শহরের বুকে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের মধ্যে গির্জার সংখ্যাও কিছু কম নয়। প্রতিবছরই এইসব গির্জাগুলো বড়দিনের প্রাক্কালে নানারকম আলোকমালায় সজ্জিত হয়। ক্রিসমাস ইভের সন্ধ্যায় ও ক্রিসমাসের দিন মানুষের ঢল নামতে দেখা যায় এই গির্জাগুলোতে। অনুষ্ঠিত হয় প্রার্থনা সভার। এই বিশেষ দিনে বিভিন্ন গির্জা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় সেই সব চার্চগুলোর ছবি। এই দিন স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারী ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলো সাধারণত ছুটি থাকে। বাবা-মায়ের হাত ধরে কচিকাচারা সকাল থেকেই ভিড় জমান শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে। যদিও বাঙালির সাথে বড়দিনের কোনো সুদূর সম্পর্ক নেই, তবুও বাঙালিরা এই দিনটা উৎসব হিসেবেই পালন করে আসছে।
আমাদের তিলোত্তমা সেজে উঠে, সেজে উঠে শহরের অ্যাংলো পাড়াগুলো। শহরের রাস্তার দুপাশে নানান মাপের সান্টা ক্লজ, ক্রিসমাস ট্রি, জিঙ্গল বেল বিক্রির জন্য বিক্রেতারা পশরা সাজিয়ে বসেন। যুগ যুগ ধরে আমাদের শহরে হিন্দু-মুসলমানদের মন্দির-মসজিদের পাশাপাশি অবস্থান করে বহু গির্জা। এ যেন শহর কলকাতার এক সম্প্রীতির বন্ধন। কলকাতা তো সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শহর। নস্টালজিয়া বাঙালির শিরায় শিরায়। তাই তারা সব ধর্মের অনুষ্ঠানেই নিজেদের আনন্দটুকু ঠিকভাবে তুলে নিতে জানে। শহর জুড়ে শীতের আবহাওয়া। তাপমাত্রার পারদ এই সময় অনেকটাই নেমে যায়, লেগে যায় হিমের পরশ। বড়দিনের অপেক্ষায় প্রহর গোনে শহরবাসী। বাবা-মায়ের হাত ধরে কচিকাচারা সকাল থেকেই ভিড় জমান চিড়িয়াখানায় বা ইকোপার্কে বা অন্যান্য জায়গাগুলোতে। রংবাহারি আলোর সাথে উৎসবের মেজাজ মহানগরবাসীদের বরাবরই পছন্দের। সেজে ওঠে গির্জাগুলোর সাথে সাথে হগ মার্কেট, বো-ব্যারাক, অ্যালেন পার্ক ও সমগ্র পার্ক স্ট্রিট। এলইডি আলোর চাঁদোয়ায় ঢাকা, আলো ঝলমল করে অ্যালেন পার্ক্ ও পার্ক স্ট্রিট। উৎসব উদযাপনের ছাপ লক্ষ্য করা যায় পার্ক স্ট্রিটের আনাচে-কানাচে। পার্ক স্ট্রিটের আনন্দ বুক ভোরে নিতে আসে বাঙালিরা। বেলুন হাতে পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথ ও রাস্তাটিতে মাথায় লাল আলো জ্বলা সান্টা টুপি পরে বাচাদের বড়দের হাত ধরে ঘুরতে দেখা যায়। গান বাজনা, খাওয়া-দাওয়া আর হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে শহুরে জীবনগুলো। কারো সঙ্গে বন্ধু-বান্ধব, কারো সঙ্গে প্রিয় নারী। রাত যত বাড়ে তত সাহেবপাড়ার আলোগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বার-রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় উপচে পরে। বারগুলোতে ওঠে স্কচ-হুস্কির ফোয়ারা। কোনো কোনো বারে আবার নাচ-গানের এলাহী ব্যবস্থা থাকে। সুন্দরী নৃত্যপটীয়সীরা তাদের শরীরের চটুল ভঙ্গিতে অতিথিদের উষ্ণ শরীর করে তোলে উষ্ণতর। দলে দলে শহরের মানুষ সামিল হয় সাহেবপাড়াগুলোতে। সেলফি তোলার হিড়িক পরে যায়। আট থেকে আশি ভিড় জমান গির্জাগুলোতে ও পার্ক স্ট্রিটের বাহারি আলোর তলায়। সর্ব জাতি মিলেমিশে এক হয়ে যায়। যুবক-যুবতী ও বাচ্ছারা মাথায় লাল রঙের সান্টা টুপি আর চোখে বাহারি নকল চশমায় নিজেদের সাজিয়ে তোলে। তিলোত্তমা বড়দিনকে স্বাগত জানায়।
পাড়ায় পাড়ায় তৈরী হয় বড়দিনের নানারকমের সামগ্রীর সাথে কেকের দোকান। কেক ছাড়া বড়দিনের স্বাদটাই বিস্বাদ। তাই কেকের দোকানেও ভিড় উপছে পড়তে দেখা যায়। কেক বিলাসের অন্যতম পীঠস্থান হল হগ মার্কেট। গরম গরম কেকের গন্ধে বাজারটির চারদিক ম ম করে। নাহুমস, ক্যাথলিন এরকম বহু নামি-দামি ব্যান্ডের আঁতুরঘর এই জায়গাটি। হগ মার্কেটে বছরের পর বছর ধরে এই দোকানগুলো কেকের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। এখানে আসলেই আপনার সাধ্যের মধ্যেই হবে আপনার স্বাদ পূরণ। বড়দিনের কেক, হগ মার্কেট ও বাঙালি মিলেমিশে এই সময়টাতে যেন এক হয়ে যায়।
ক্রিস্টমাস ট্রি, আলো, মিষ্টি, খেলনা, তারা, ঘন্টা দিয়ে ঘর সাজানোর রেওয়াজ বহু প্রাচীন। প্রথম দিকে উত্তর ইউরোপের ফার গাছগুলোকে এভাবে সাজানো হতো। পরবর্তীকালে তা বিশ্বের সর্বত্রই ছড়িয়ে পরে। আমাদের শহরও এর থেকে বাদ যায় না। শহরের বহু মানুষকে এইদিন ক্রিস্টমাস গাছ ও রং-বেরঙের আলো দিয়ে নিজেদের ঘরে যীশুর মূর্তি সাজাতে দেখা যায়।
সান্টাক্লজ হল পাশ্চাত্য সংস্কৃতির রূপকথার এক কিংবদন্তি চরিত্র। সাধারণভাবে তিনি সান্টা নামে পরিচিত। উপকথায় বলে তিনি নাকি একজন অত্যন্ত দয়াবান ছিলেন। সান্টা সাধারণত হাস্যমুখর, সাদা দাঁড়িওলা একজন বৃদ্ধ মানুষের চিত্র। তার পরনে সাদা কলার ও সাদা আস্তিনের লাল কোর্ট ও সাদা আস্তিনের লাল রঙের ট্রাউজার্স, কালো চামড়ার বেল্ট ও বুট জুতো পরিহিত। তার পিঠের ঝোলাতে থাকে নানা রকমের উপহার সামগ্রী। প্রাচীন গ্রিসের লাইসিয়াতে চতুর্থ শতকে সন্ট নিকোলাসের উল্লেখ মেলে। প্রচলিত বিশ্বাস হলো তিনি নাকি বড়দিনের প্রাকাল্লে অর্থাৎ ২৪ তারিখ মধ্যরাত্রে ভালো ভালো ছেলে মেয়েদের নানারকম উপহার দিয়ে থাকেন। এই কিংবদন্তির উৎস হল ঐতিহাসিক উপহার প্রদানকারী চরিত্র সন্ট নিকোলাস। সন্তসুলভ অবদানগুলোর পাশাপাশি তিনি শিশুদের পরিচর্যা, দয়া ও উপহার প্রদানের জন্য খ্যাত ছিলেন। সন্তের পোশাকে তিনি শিশুদের খোঁজখবর নিতেন এবং বিচার করে দেখতেন কোন কোন শিশু উপহার পাওয়ার যোগ্য। সি সন্ত নিকোলাস সান্তাক্লজের আদি রূপ। নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামে খুবই জনপ্রিয় চরিত্র সিন্টারক্লাস ৬ই ডিসেম্বর তিনি উপহার দেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিসমাসের দিনও বেশ কিছু লোক উপহার দিয়ে থাকেন। যদিও আধুনিক সান্টাক্লজের রূপকল্পটি সৃষ্টি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। মার্কিন প্রেসে সান্তাক্লজ শব্দটি ১৭৭৩ সালে সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল। রূপকথা আছে কি নেই কারো সেভাবে জানা না থাকলেও আমরা দেখেছি বহু মা-বাবা তার শিশু ২৪ তারিখে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়লে তার মাথার কাছে একটি মোজার ভিতরে নানারকম খেলনা ও উপহার ভরে রেখে দেয়, পরের দিন সকালে শিশুটির ঘুম ভাঙলে সে যেন মোজাটি খুলে দেখতে পায় যে সান্টাক্লজ তার জন্য কি কি উপহার পাঠিয়েছে। শিশু মনের আনন্দে তৈরী হয় উৎসবের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। সারা পৃথিবীতেই পিতা-মাতার তাদের সন্তানদের সান্টাক্লজ ও অন্যান্য উপহারপ্রদানকারীদের সম্পর্কে শিক্ষা দিলেও, কেউ কেউ এগুলোকে কুসংস্কার হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। আবার অনেক দেশেই এই দিনে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে উপহার আদান-প্রদানের রীতি রয়েছে।
বড়দিন মানে ঈশ্বরের কাছে থেকে সঠিক পথের নির্দেশ পাওয়া। বড়দিন মানে খারাপ কাজ ছেড়ে ভালো পথে চলতে শেখার দিন। যীশু নামের অর্থ উদ্ধারকর্তা বা রক্ষাকর্তা। যীশু হলেন একজন মানবরূপী ঈশ্বর। পবিত্র বাইবেল বলে "যীশু খ্রিষ্টেই আমরা মুক্তি, পাপের মোচন প্রাপ্ত হয়েছি। ইনিই অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি"। আমাদের জীবনে বড়দিনের সার্থকতা শুধু ত্যাগস্বীকারে, ভোগবিলাসে বা উপহার দেয়া-নেয়াতে নয়। যদি আমরা সর্ব ধর্মের সকল মানুষকে ভালোবাসি, তবেই বড়দিন সমাজে সার্থক হবে।
কবিতা : শক্তিপদ ঘোষ
ছবি ও লেখার স্বত্ত : সুদীপ্ত মুখার্জী
তারিখ : ২৪-১২-২০১৯
যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০
➧ আমার এই লেখাটি ও ছবিটি যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো পেতে ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।