Wednesday, March 17, 2021

সহেলীর কৌতুহল (পর্ব - ৪)

  সহেলীর কৌতুহল


(পর্ব - ৪)

আমাদের গ্রামে কয়েক ঘর মুসলিম পরিবার বাস করতো।   তারাও সমানভাবে  আমাদের সাথে পূজার আনন্দে  মেতে উঠতো। রহিম, আব্বাস ছিল আমার খুব ভালো বন্ধু। আব্বাস আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। রহিম এক ক্লাস উঁচুতে পড়তো।  আমাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদাভেদ ছিল না।  আমরা একসাথে খেলতাম, একসাথে ঘুরতাম, একসাথে স্কুলে যাতায়াত করতাম। পূজা এলেই সারা গ্রামে একটা সাজ সাজ রব উঠতো।  মাটির বাড়িগুলোতে  নতুন করে মাটির প্রলেপ দেওয়া হতো।  পাকা বাড়িগুলোতে বা বেড়ার বাড়িগুলোতে যার যেমন  ক্ষমতা তারা সেইভাবে  সারিয়ে নতুন রঙে রাঙাতো।  গ্রামটাও যেন নতুন সাজে সেজে উঠতো।  গ্রামের একমাত্র শিবমন্দিরটিকেও নতুন করে রঙের প্রলেপ দেওয়া হত।  গ্রামের চেহারাটাই পাল্টে যেত।  পূজায় নবীনদের সাথে গ্রামের প্রবীনেরাও সমানভাবে অংশগ্রহণ করত।  প্রতিবছর এই কটাদিন আমরা চুটিয়ে আনন্দ করতাম। সকাল থেকে রাত  পর্যন্ত আমাদের প্যান্ডেলেই কেটে যেত।  গ্রামের কাকা-জ্যাঠারা একজোট হয়ে গল্প-গুজব করত। তাঁদের মধ্যে  কেউ কেউ আবার শিব মন্দিরের চাতালে বসে তাস খেলত। গ্রামের  মেয়েরাও সবাই অনেকটা সময় প্যান্ডেলে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব ও খুনটুশি করে কাটাত। আমরা সব বন্ধুরা মিলে কখনো প্যান্ডেলে আবার কখনো দীঘির পাড়ে  বসে গল্প করতাম। আমাদের আনন্দের সীমা  ছিল না।  গ্রামের বাইরে যেসব দাদা-দিদি, কাকা-কাকিমারা  থাকতো তারাও এইসময় গ্রামে ফিরে আসত।  তারাও সমানভাবে সবার সাথে পূজার আনন্দে সামিল হতো।

ষষ্ঠীর দিন সকালে আমলকাকু একজন তরুণ সঙ্গীকে নিয়ে ঠিক সময় পূজা করার জন্য মণ্ডপে উপস্থিত হয়ে যেতেন। আমলকাকুর সঙ্গী নিবারণ দা ছিল আমলকাকুর ছেলে। সকলে বলে নিবারণদা  আমলকাকুর কাছ থেকে নাকি পূজার কাজের তালিম নিচ্ছে।

 ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। মাতৃবন্দনার আনুষ্ঠানিকতা এই  দিন সকাল  থেকেই শুরু হয়ে যায়। অশুভ শক্তির বিনাশে মঙ্গলময়ী দেবী দুর্গার জাগরণে জগতের সুখ, শান্তি  প্রতিষ্ঠার জন্য প্রার্থনা করেন সকলে।   
 
 দুর্গাপূজা হল মহাপূজা। এই পূজা ষষ্ঠী থেকে দশমী এই পাঁচদিনের পূজা। যাকে  ঘিরে তৈরী হয় এক মহা উৎসব।  প্রথমে কল্পারম্ভ অর্থাৎ সংকল্প করা হয়। কল্প মানে কল্পনা আর আরম্ভ মানে শুরু।  এই সঙ্কল্পবর্তী মানুষকে পূজার নিয়ম পালনে নিয়োজিত করে। দেবীর পূজাতেই সংকল্প করতে হয় কিন্তু দুর্গাপূজার সংকল্প খুবই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। বিভিন্ন হিন্দু পুরাণ ও নানারকম শাস্ত্রগ্রন্থে দেবীর সাতটি  কল্পের কথা বলা আছে। সেগুলো হল নবম্যাদিকল্প, প্রতিপদাদিকল্প, ষষ্ঠাদিকল্প, সপ্তম্যাদিকল্প, অষ্টম্যাদিকল্প,  অষ্টমীকল্প ও মহানবমিকল্প। কেহ কৃষ্ণনবমী, কেহ প্রতিপদ, কেহ ষষ্ঠী, কেহ সপ্তমী, কেহ অষ্টমী আবার কেহ শুধু কেবল মহাঅষ্টমী বা মহানবমীতে কল্পারম্ভ করে থাকে।  মহাষষ্ঠীর দিন সকালে মণ্ডপেও  ঘট স্থাপন করা হয় এবং সংকল্প করা হয়।  সেই সঙ্কল্পের সাক্ষী থাকে এই ঘটটি।  

মহাষষ্ঠী হল দুর্গাপূজার প্রথম দিন। এই দিনে দেবী দূর্গা সপরিবারে মর্তে আবির্ভূত হন।  বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে দেবী মূর্তির আবরণ উন্মোচন করা হয়। সকালে বিলবৃক্ষে দেবীর মঙ্গল বোধন হয়।   বিল্ববৃক্ষকে বলা হয় শ্রীবৃক্ষ। প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এই শ্রীবৃক্ষকে দেবীর প্রতীকরূপে উপাসনা করা হয়। বোধনের অর্থ জাগরণ বা উদ্দীপন অর্থাৎ বোধনের ফলে দেবী জাগরিত হন।  আমন্ত্রণ মানে দেবীকে আমন্ত্রণ করা।  বোধন, আমন্ত্রণের পর  সন্ধ্যায় অধিবাস করা হয়।  অধিবাস মানে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা। নানারকম উপকরণ দিয়ে দেবীর অধিবাস সম্পন্ন হয়। এই উপকরণগুলোকে একটা থালায়  সাজানো থাকে।  সেই থালাটিকে  বরণডালা বলে অভিহিত করা হয়। ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়  সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। যা শারদীয়া দুর্গাপূজা নামে পরিচিত।  আনন্দময়ী দেবীর আগমনে পূজা মণ্ডপটি উৎসব মুখরিত হয়ে উঠতো।  ধূপ-ধুনোর গন্ধে আর কাঁসর-ঘন্টার সঙ্গে ঢাকের শব্দে ভক্তদের আরাধনায় একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী হত।   

 মহাষষ্ঠীর লগ্ন পেরিয়ে আসে মহাসপ্তমী। এইদিন পঞ্জিকার সূচি অনুযায়ী শুরু হয় নবপত্রিকার প্রবেশ ও সপ্তমীর পূজা। ধুপ-ধুনো, বেল-তুলসী, বস্ত্র, নৈবেদ্য, পুষ্পমালা, চন্দনসহ মোট ১৬টা  উপাচার দিয়ে দেবীকে পূজা করা হয়ে থাকে। ত্রিনয়নী দেবীর চক্ষুদান করা হয়ে থাকে। সপ্তমীর  দিন ভোরে  অমলকাকু ও নিবারণদা একটা কলাগাছকে নিয়ে ঢাক বাজাতে বাজাতে রায়বাবুদের দীঘিতে স্নান করানোর জন্য নিয়ে আসতো। শাস্ত্রবিধি মেনে  স্নান করানোর পর  কলা গাছটিকে নতুন লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা দেওয়া অবস্থায় ঢাক বাজাতে বাজাতে মণ্ডপে নিয়ে আসা হত। মণ্ডপে  কলাগাছটিকে গণেশের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। সমগ্র ব্যাপারটা আমি ও আমার বন্ধুরা বেশ কৌতূহল নিয়ে দেখতাম।  সকলে ওটাকে কলাবৌ বলত, বড়রা আমাদের বলত ওটা নাকি গণেশের বৌ  আমি মনে মনে ভাবতাম মাটির মূর্তির বৌ কি করে একটা গাছ হয়, মাটিরই তো হওয়া উচিত। পরে অবশ্য জেনেছিলাম এটাকে নবপত্রিকা বলে। সপ্তমীর দিন প্রথমে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে মণ্ডপে প্রবেশ ও স্থাপন করা হয়। এই দিনই মৃন্ময়ী হতে দেবী চিন্ময়ীরূপে পূজিত হন।  নবপত্রিকার প্রবেশের পরে দর্পণে দেবীকে স্নান করানো হয়। একে মহাস্নান বলা হয়। এই মহাস্নানে ব্যৱহৃত হয় ১৯টি স্থানের মাটি আর ২১ রকমের জল।  মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে চক্ষুদানের মাধ্যমে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।  এরপর শুরু হয় কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমীর পূজা হয়। দেহ শুদ্ধি, অঙ্গ শুদ্ধি সেরে শুরু হয় পূজার্চ্চনা, বেজে ওঠে ঢাক-ঢোল-কাসর ।  ঘটে, প্রতিমায় দেবীর আবির্ভাব হয়।  দেবী মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ীরূপে আবির্ভূত হন।     

পূজার তৃতীয় দিনে শুরু হয় মহাঅষ্টমীর পূজা। মহাঅষ্টমীর পূজা বিশেষ ভাবগম্ভীর্য ও মাহাত্ম্যপূর্ণ  পূজা। এইদিন সাধারণত পুষ্পাঞ্জলি, কুমারী পূজা ও সন্ধিপূজা করা হয়।  মহাঅষ্টমীর দিনে সকালে ষোড়শ উপাচারে অনুষ্ঠিত হয় দেবীর পূজা।  ১০৮ টি পদ্ম ও প্রদীপ দিয়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়। কোথাও কোথাও এইদিন কুমারীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর শুরু হয় পুষ্পাঞ্জলি। এইদিন  উপোস করে স্নান সেরে শুদ্ধ মনে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য আমি মণ্ডপে উপস্থিত হতাম। আমাদের গ্রামের প্রায় সকলে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য এই সময়  মণ্ডপে হাজির থাকত। সারা গ্রাম যেন  ভেঙে পড়তো মণ্ডপে।  এতো ভীড়  হতো যে  মণ্ডপে ঠিকমত দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যেত না। 

অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে করা হয় সন্ধিপূজা।  অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট আর নবমীর প্রথম ২৪ মিনিট মোট ৪৮ মিনিটকে  সন্ধিক্ষণ বলে ধরা হয়। সন্ধিক্ষণকেই শুভক্ষণ বলে ধরা হয়। এই সন্ধিক্ষণের মধ্যে সন্ধিপূজা সম্পন্ন করতে হয়। শ্রী শ্রী চন্ডী অনুযায়ী জানা যায়, এই মহাসন্ধিক্ষণেই অসুরদলনি দেবী দূর্গা অশুভ শক্তির প্রতীকরূপী মহিষাসুরকে দলন করেছিলেন। অন্যদিকে এই সন্ধিক্ষণেই  রামচন্দ্র কর্তৃক রাবন নিহত হয়েছিলেন বলে কথিত রয়েছে। সেই সন্ধিক্ষণেই অশুভ শক্তির প্রতীকরূপী পশুবলি দেওয়াই নিয়মে পরিণত হয়েছে।  সন্ধি কথাটির মধ্যেই এক গভীর ব্যঞ্জনা নিহিত রয়েছে।  সংঘাত ও সংঘর্ষের পরিণতিতেই যেমন সন্ধি তেমন মিলনের শুভ মুহূর্তও সন্ধি। তাই অষ্টমী ও নবমীর এই সন্ধিক্ষণেই সেই বিজয়ের দামামা বেজে ওঠে।  

মহানবমী হল দুর্গাপূজার শেষ দিন।  সন্ধিপূজার পর শুরু হয় মহানবমীর পূজা। এই দিনের পূজার অন্যতম অঙ্গ হল  বলিদান।  শাস্ত্র মতে ছাগ বা মহিষাদি বলির রীতি  আছে।  কিন্তু বর্তমানে আইনত পশুবলি করা যায় না। তার পরিবর্তে কুষ্মান্ড ও ইক্ষুদান বলি করা হয়।  তবে অনেক পারিবারিক পূজায় এই বলির সামগ্রীরও কিছু পরিবর্তন দেখা যায়।  এই দিন ষষ্ঠী থেকে যত দেব-দেবীর পূজা করা   হয়েছে তাঁদের প্রত্যেককে আহুতি দিতে হয়। এমনকি চৌষট্টি যোগিনীর আহুতি দিতে হয়। এইদিন অনেক জায়গায় কুমারী পূজাও অনুষ্ঠিত হয়।  

দাদু ,এই  যোগিনীরা আবার কে ?

 যোগিনীদের কথা তোকে পরে বলবো। 

 সন্ধিপূজার সময় বেশ ঘটা করে আমলকাকু নাচতে নাচতে সন্ধ্যা আরতি করতো। গ্রামের সকলে আমলকাকুর মনোমুগ্ধকর আরতি দেখার জন্য এইসময় মণ্ডপে হাজির থাকতো। আরতি সম্পন্ন হয়ে গেলে আমাদের মনটা বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ত কারণ পরদিন মাকে বিদায় জানাতে হবে। আমাদের আনন্দের দিনগুলো শেষ হয়ে যাবে,  শুরু হয়ে যাবে আবার লেখাপড়া, আবার শুরু হয়ে যাবে বাড়ির বড়দের চোখ রাঙানো। সেই গতানুগতিক জীবন চলতে থাকবে। মায়ের জন্য আবার একটা বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। 
 
চারদিনের পূজার আনন্দের পর দশমী হল বিষাদের দিন। দশমীর পূজা শেষ করে মহাস্নানের যে দর্পণ  ছিল, সেটিতে মাকে  চিন্ময়ীরূপে বিসর্জন দেওয়া হয়।  বেজে ওঠে বিসর্জনের বাদ্যি।  মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। পূজার কটা দিনের আনন্দ উচ্ছাসের পরই  বিষাদের সুর নিয়ে আসে দশমী।  শাস্ত্র মতে পুরোহিত মায়ের বিসর্জনের আনুষ্ঠানিক পর্ব শেষ করার পর মণ্ডপে মণ্ডপে শুরু হয় দেবীবরণ ও সিঁদুর খেলা। সিঁদুর, পান, সুপারি, মিষ্টি দিয়ে দেবীকে বরণ করা হয়।  দেবীবরণের মাধ্যমেই মাকে  জানানো হয় মনের কামনা-বাসনা। মায়ের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়।

 এইদিন কোথাও কোথাও দেবীর অভিন্ন মূর্তি অপরাজিতা পূজার রীতি রয়েছে। অপরাজিতা দেবী দুর্গার আর এক রূপ। বিজয়া দশমীর পর অপরাজিতা পূজা সম্পন্ন হয়। এই দিন দশমীর ঘট বিসর্জনের পর ঈশান কোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে তার ওপর অপরাজিতা লতা রেখে অপরাজিতা পূজার রীতি রয়েছে।দুর্গাপূজার সমস্ত রকম ত্রুটি নিরসনের জন্য ও বিজয় কামনায় এই পূজা করা হয়। দশমীর দিন একটি পরিষ্কার পাত্রে অপরাজিতা লতা রেখে তাতে দেবী দুর্গার অর্চনা করা হয়। পূজার শেষে ওই অপরাজিতা লতা টুকরো টুকরো করে কেটে শ্বেতসষর্প ও হলুদের সাথে হলদে রঙের  কাপড়ে ছোট ছোট পুটুলিতে বাঁধা হয়। হলুদ রঙের সুতোতে এক একটি পুঁটলিকে বেঁধে প্রত্যেকের ডান হাতে বেঁধে দেওয়া হয়।  দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনীর মতে চৌষট্টি যোগিনীদের অন্যতম। অপরাজিতা দেবীকে আবার মৎসোপুরাণে মাতৃকাগণের অন্যতম বলা হয়েছে। বামনপুরাণ অনুযায়ী দেবী অপরাজিতা গৌতম মুনি ও অহল্যার চার কন্যা জয়া, বিজয়া, অপরাজিতা ও জয়ন্তীর অন্যতমা। অপরাজিতা দেবীর মতো অপরাজিতা ফুল ও লতা দুর্গাপূজায় অপরিহার্য। 

বিজয়া বিষাদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে সিঁদুর খেলার নিয়ম। দেবীকে সিঁদুর পরিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয়। এটা হল স্ত্রী-আচার। মানুষের বিশ্বাস দুর্গা মায়ের সিঁথির সিঁদুর নিয়ে মাথায় ঠেকালে সধবাদের সিঁথির সিঁদুর দীর্ঘস্থায়ী হয়। মাকে  সিঁদুর দানের পর সধবারা একে অন্যের সিঁথি সিঁদুরে রাঙিয়ে দেয়। ভালোবাসার বন্ধনে একে অপরকে আবদ্ধ করে। দেবীবরণের মাধ্যমে কয়েকদিনের আনন্দময় উৎসবের সমাপন ঘটে।  চারদিনের  প্রাণঢালা আনন্দ স্রোত পৌঁছে যায় শেষ লগ্নে। বিষাদ সিন্ধুতে ডুবে যাওয়ার আগে সিঁদুর খেলার মাধ্যমেই অন্তরের আবেগ উজার করে দেওয়া হয়। 

 
(চলবে)



তারিখ :১৭-০৩-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 






Saturday, March 6, 2021

সহেলীর কৌতুহল (পর্ব - ৩)

সহেলীর কৌতুহল


(পর্ব - ৩)

আমাদের গ্রামটা ছিল খুবই ছোট। সব মিলিয়ে মোটামুটি চারশো জনের মত লোকের বসবাস ছিল।  তার মধ্যে সবাই যে হিন্দু ছিল তা নয়। কয়েকটি মুসলমান পরিবারও বসবাস করত।  প্রধানত কৃষিভিত্তিক গ্রাম ছিল। তবে কৃষক ছাড়াও কামার, কুমোর, জেলে  প্রভৃতি পেশার লোকেরাও  বাস করত।

 গ্রামটা ছিল আমার প্রাণ। হৃদয় কাড়া গ্রামের সেইসব দৃশ্য, গ্রামের প্রকৃতি, গ্রাম্য জীবন আজও  আমার স্মৃতির মণিকোঠায় অবচেতন সময় হানা দেয়। ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে করলে এক পরম সুখ অনুভব করি ও মনে মনে খুব তৃপ্তি পাই,  কারণ আমাদের জীবনের একটা রঙিন অধ্যায় হল শৈশব।  সেই শৈশবকালটা আমার গ্রামেই কেটেছে।

আমাদের গ্রামের থেকে দু কিলোমিটার দূরে প্রতি সোমবার, বুধবার ও শুত্রুবারে একটা 'গ্রামীণ হাট' বসতো।  'হাট'  কি তুই সেটা জানিসতো?

সেরকমভাবে না জানলেও কিছুটা শুনেছি। রবীন্দ্রনাথের লেখা 'হাট' নামের একটা কবিতা ছোটবেলায় পড়েছিলাম।  কবিতাটা আমার  খুব ভালো লেগেছিলো।  কবিতাটার কিছু অংশ আজও  মনে আছে। 
 
"কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি 
বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি 
গাড়ি চালায় বংশীবদন,
 সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন। 
হাট  বসেছে শুত্রুবারে  
বক্সীগঞ্জের পদ্দাপাড়ে।"


কবিতাতে বলা আছে হাট সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ শুধু শুত্রুবার বসত আর তোমাদের গ্রামের হাট সপ্তাহে তিন দিন বসত, তাই তো। 

হ্যা, সপ্তাহে তিনদিন বসত কারণ আমাদের ও আশপাশের গ্রামগুলোতে সেরকম কোনো দোকান ছিল না। ওই হাটটাই ছিল আমাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায়। এখানে দৈনন্দিন  প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন পাওয়া যেত তেমন গৃহস্থালি দ্রব্যও  পাওয়া যেত।  এটাই ছিল ক্রয়-বিক্রয়ের উপযুক্ত স্থান।  এই হাটের উপর আমাদের নির্ভর করতে হত। শুধু আমাদের গ্রাম নয়,  দূর-দূরান্ত থেকে বহু লোক এই হাটে আসতো।  হাটটা ছিল পরস্পরের দেখা-সাক্ষাতের ও কুশল বিনিময়ের উপযুক্ত স্থান। এরকম গ্রাম্য হাট পল্লীজীবনের এক উপযুক্ত যোগাযোগ কেন্দ্র, তাই তার গুরুত্ব অপরিসীম। একে বাদ দিয়ে গ্রামের লোকেদের জীবনযাত্রা, গ্রামের অর্থনীতি ভাবা যায় না। এখানে  একদিকে যেমন কাঁচা বাজার অর্থাৎ শাক সবজি, মাছ, মাংস পাওয়া যেত তেমন অন্যদিকে চাল, ডাল, লবণ  প্রভৃতি শুকনো দ্রব্যাদি বিক্রি করা হত। হাটে গাছের বীজ ও সার বিক্রি হত।  কামার-কুমোর-ছুতোরের তৈরী জিনিসপত্র, জামা কাপড়ের দোকান বসতো। এছাড়া গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিও বিক্রি হত।  

তোমাদের গ্রামে কোনো দোকান ছিল না? 

না, সেই সময় ছিল না।  পরে  অবশ্য কয়েকটা হয়েছে বলে শুনেছি। এখন দিনকাল অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে।  মানুষের  চাহিদা ও রুচির পরিবর্তন ঘটেছে। দিনের সাথে সাথে গ্রামের চেহারাও অনেকটা বদলে গেছে।  

দূর্গাপুজোটা আমাদের দেশে শরৎ ঋতুতে করা হয়। বাংলায় বর্ষা গেলে আসে শরৎকাল। এই শরৎ ঋতুতে আমাদের দেশ শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে, কৃষকদের ঘর ভোরে ওঠে। শরতের আছে নিজস্ব বর্ণ ও গন্ধ। এই সময়  প্রকৃতি সেজে ওঠে কাশফুল ও শিউলি ফুলে। মাতাল হাওয়া, নীল আকাশে যেমন দেখা যায় সাদা মেঘের ভেলা তেমন খাল-বিলের  জলে শাপলা ফুটতে দেখা যায়।চলতে থাকে সময়-অসময়ে শুভ্র-সফেদ মেঘের আনাগোনা আবার কখনো কখনো রোদের ঝিলিক। ক্ষনে ক্ষনে ঋতুরানির দুরন্তপনা উচ্ছল কিশোরীকেও যেন হার মানায়। এমন প্রকৃতিতে রঙের খেলায় মেতে উঠতে চায় মন।  তাই প্রকৃতির রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে সকল বাঙালির মনও  বদলে যায়। 
 আমার গ্রাম, গ্রামের পূজা আমার সুখ স্মৃতির সঞ্চয়। অবসর জীবনের খোরাক।  আমাদের গ্রামে মাত্র একটা দুর্গাপুজো হতো।  গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট একটা টিনের চালার শিব মন্দির ছিল।  এই মন্দিরে শিবরাত্রির দিন খুব ঘটা করে বাবা মহাদেবের পূজা করা হতো। গ্রামের মহিলারা এইদিন উপোষ করে মন্দিরে এসে বাবা মহাদেবের মাথায় জল ঢালতো। আমাদেরও সেই সময় কিছু প্রসাদ জুটে যেত। শিবরাত্রির  দিন শিবমন্দির চত্বরটা সকাল থেকেই বেশ গমগম করত।  লোকে-লোকারন্য হয়ে থাকতো।
 
এই শিব মন্দিরের বাঁপাশে ছোট একটা মাঠ ছিল।  ওই মাঠে বাঁশ-কাপড় দিয়ে  কালু  কাকা প্যান্ডেল তৈরী করে দিত। সেই প্যান্ডেলে ছোট একচালা প্রতিমায় পূজা করা হত।  প্রতিমাটা  আমাদের গ্রামের অরুণকাকু বানাতো।  রথের দিন থেকে কাকু প্রতিমার কাঠামো বানাতে শুরু করত।  আমরা রোজ স্কুল যাওয়ার সময় ও  স্কুল থেকে ফেরার সময় একবার করে অরুণকাকুর বাড়িতে ঠাকুর দেখতে যেতাম।  লক্ষ করতাম প্রতিমার কাজ কতটা এগোলো। আমার খুব কৌতূহল ছিল অসুরকে নিয়ে। অসুরের গোঁফটা  এবার কতটা মোটা হল, তার গড়নটা কতটা তাকরাই  হল  সেদিকে আমার সজাক দৃষ্টি থাকতো।  গড়ন ভালো না হলে ওরকম তেজস্বীনি মহিলার সাথে যুজঁতে পারবে না তো।   ভাবতাম একজন নারী হয়ে কি করে ওইরকম একজন বলবান পুরুষকে পরাস্ত করলো। আসলে তখন তো পৌরাণিক ব্যাখ্যাগুলো আমার জানা ছিল না। মায়ের চোখ তিনটিও আমায় খুব আকর্ষণ করতো। অরুণকাকু যখন মায়ের চোখ আঁকতো, তখন উপস্থিত থেকে সবটা দেখতাম। 

মাটি, বাঁশ, খড়  ইত্যাদি দিয়ে তৈরী হত দশ হাতের দেবী দূর্গা।  আমার চোখের সামনে আস্তে আস্তে তা গড়ে উঠতো। ছোটোবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম প্রতিমা তৈরী। প্রথমে খড়ের সাহায্যে দেবীর আকার তৈরি করা হতো। তারপর তাতে মাটি লেপা হত। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতো দেবীর সব অঙ্গ। গড়ে তোলা হত তাঁর পুত্র-কন্যাদের। শুধু তাই নয় দেখতাম সবার বাহনগুলোকেও নির্মাণ করতে।  মাটির কাজ শেষ হলে অরুণকাকু প্রতিমায় রঙের কাজ শুরু করতো। আস্তে আস্তে মাটির ঠাকুরগুলো  নানারকম রঙে রঙিন হয়ে উঠতো। কারো গায়ের রঙ হলুদ, কারো সবুজ।  তারপর দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে কাপড় ও কার্তিককে রাজবেশে আর গণেশকে ধুতি পরিয়ে সজ্জিত করা শেষ হলে তাঁদের নানারকম অলংকারে অলংকৃত করা হত। এইভাবে চলতে চলতে একদিন প্রতিমা নির্মাণের কাজ শেষ হত।  দেবীর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র  উঠতো। দেবীর অস্ত্র ভান্ডারে দেখা যেত  ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বাণ, ঢাল, ধনুক, ঘন্টা, নাগপাশ ইত্যাদি। ঠিক সময় ঠাকুর চলে আসতো কালু কাকার তৈরী মণ্ডপে। বড়দের সাথে ছোটোরাও মন্ডপে ঠাকুর আনার জন্য যেতাম। ঠাকুর মন্ডপে নিয়ে আসার পর অরুণকাকু  প্রতিমাগুলোতে অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত করতো। এই সময় প্রায় এক মাসের জন্য আমাদের স্কুল বন্ধ থাকত।  ঢাকের শব্দে একদিন সকালে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত।  বুঝতে পারতাম আজ ষষ্ঠী, আজ দেবীর বোধন।  আমরা তখন ছোট, আমাদের কাছে কোনো ধর্ম ছিল না, ছিল না কোনো জাত-পাত,  আনন্দটাই প্রধান ছিল। গ্রামের সবাই একসাথে আনন্দে মেতে উঠতাম।  মা বলত দেবী সরস্বতী বিদ্যার দেবী, তাঁকে ভক্তিভরে ডাকলে নাকি লেখাপড়া খুব ভালো হয়।  তাই আমি মায়ের কথা মত প্যান্ডেলে গিয়ে সবার প্রথমে দেবী সরস্বতীকে ভক্তিভরে প্রণাম করতাম। মা আরো বলতো 'মা' শব্দটি যেমন যে কোনো সন্তানের কাছে সবচেয়ে প্রিয় শব্দ, ঠিক তেমন মা ও সন্তানের মিলনোৎসব হলো শারদীয়া দুর্গোৎসব।  এই উৎসব বাঙালি সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবনের সবচেয়ে বড় ও প্রিয় উৎসব।  
 
প্রতিবছর যে আমাদের নতুন জামা-কাপড় কেনা হত তা কিন্তু নয়, ধানের দাম মহাজন পূজার আগে ঠিকমতো মিটিয়ে দিলে সাধারণত নতুন জামা-কাপড় কেনা হত। যেবার মহাজন পূজার আগে দাম মেটাতে পারতো না, সেবার আর নতুন কিছু আমাদের কপালে জুটতো না। সেইসব বছরগুলোতে  আমাদের যে মন খারাপ হত না, তা বলব না, তবে সবকিছু ভুলে আমরা পূজার আনন্দে মেতে থাকতাম। ওই কটাদিন লেখা পড়া বন্ধ, শুধুই আনন্দ, শুধুই মজা। 


(চলবে) 



তারিখ :০৬-০৩-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।