Wednesday, December 8, 2021

পেঁচার দেশ নতুনগ্রাম>P

পেঁচার দেশ নতুনগ্রাম 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 





পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার একটি ছোট্ট স্টেশন হল অগ্রদ্বীপ। অগ্রদ্বীপ গ্রামটি খুবই প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম।  ব্যান্ডেল কাটোয়া লাইনের স্টেশন হল এই অগ্রদ্বীপ। এই স্টেশনের দক্ষিণ দিকে কিছুটা দূরে আর একটি গ্রাম রয়েছে যার নাম 'নতুনগ্রাম'। এটি খুবই ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামটি ছোট হলেও শিল্পসুষমায় ভরপুর। বাংলার এক ঐতিহ্যের পীঠস্থান। বাংলার লোকশিল্পের জগতে গ্রামটির যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। বঙ্গীয় ঘরানার কাঠের পুতুলের জন্য গ্রামটি বিখ্যাত। বৈষ্ণব প্রভাবিত অগ্রদ্বীপ গ্রামের সন্নিহিত হওয়ার জন্য এখানকার শিল্পের মধ্যে একটা বৈষ্ণবীয় ধারার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।   




নতুনগ্রাম হল কাঠ খোদাই শিল্পের আঁতুরঘর। গ্রামটির একেকটা বাড়ি শিল্প সৃষ্টির আকর। আমরা বাংলার বিভিন্ন স্থানে মেলায় কাঠের তৈরী বিভিন্ন পুতুল দেখি  তার বেশিরভাগই এই  গ্রামে তৈরী  হয়। নতুনগ্রামে প্রায় ৫০টি পরিবার বাস করে। প্রায় প্রত্যেকটা পরিবারেই কাঠ খোদাইয়ের কাজ হয়।এখানকার শিল্পী স্বর্গীয় শম্ভুনাথ ভাস্কর মহাশয় ১৯৬৬ সালে তদকালীন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। তারপর থেকেই এখানকার শিল্পের কদর বহুগুন বেড়ে যায়।  




 কাঠ খোদাই করে এখানকার শিল্পীরা বিভিন্ন পুতুল তৈরী করে থাকে। বিস্ফারিত চক্ষুর পেঁচা, রাজা-রানী, হাত তোলা গৌড়-নিতাই এই  তিন ধরণের পুতুল এখানকার ঐতিহ্য। এছাড়া কাঠের পেঁচা দিয়ে বসার টুল, কাঠের টেবিলের উপর পেঁচা আঁকা, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, পেঁচার আদলে তৈরী রাজা-রানী। এছাড়া  গৃহসজ্জার সম্ভার  হিসেবে কাঠের তৈরী  বিভিন্ন পুতুল ও দেব-দেবীর মূর্তিও তারা তৈরী করে। আয়নার ফ্রেম, কলমদানি, মোবাইল স্ট্যান্ড, ইজিচেয়ার, টেবিল ল্যাম্পও তাঁরা তৈরী করে। এখানকার কাঠ খোদাই করে নির্মিত বিভিন্ন মাপের পেঁচা জগৎ বিখ্যাত। এখানকার তৈরী প্রত্যেকটা জিনিসেই এখানকার শিল্পীরা একটা নিজস্ব শিল্পরীতির ছাপ রাখে। 
 

নতুনগ্রামের সূত্রধর জাতিরা প্রথম দিকে পাথর খোদাইয়ের কাজ করতেন। বর্ধমান রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পাথর খোদাই কাজের একসময় এই অঞ্চলে  রমরমা ছিল।  বর্ধমান রাজার পতনের পর এখানকার পাথর খোদাইয়ের কাজ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এখানকার কারিগরদের অর্থনৈতিক অবস্থা ধীরে ধীরে খারাব হতে থাকে।   সেই সময় এখানকার শিল্পীরা এই কাজ ছেড়ে দারুশিল্প শুরু করে। 

 কোনো শিল্প গড়ে ওঠার পিছনে কিছু ভৌগোলিক, সামাজিক বা ধর্মীয় পটভূমি থাকে। এইসব পটভূমির জন্যই সেখানকার শিল্পের খ্যাতি একচেটিয়া হয়ে ওঠে। নতুনগ্রামের সূত্রধর জাতির প্রথমদিকে পাথর খোদাইয়ের কাজ করতেন। বর্ধমান রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পাথর খোদাই কাজের একসময়  রমরমা ছিল। বর্ধমান রাজার পতনের পর এখানকার পাথর খোদাইয়ের কাজ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এখানকার কারিগরদের অর্থনৈতিক অবস্থা ধীরে ধীরে খারাব হতে থাকে।   সেই সময় এখানকার শিল্পীরা এই কাজ ছেড়ে দারুশিল্প শুরু করে। 

নতুনগ্রামের নানা আকারের কাঠের তৈরী পেঁচা বিশ্ববন্দিত। এখানকার কাঠ খোদাই করা পেঁচার উৎস সন্ধান করলে দেখা যায় এইসব অঞ্চলগুলো পূর্বে কৃষিপ্রধান ছিল। এখানকার শিল্পীরা প্রথমদিকে সাধারণত কাঠ দিয়ে গরুর গাড়ির চাকা বানাতো। এইসব অঞ্চলে পূর্বে  বছরে বার তিনেক লক্ষ্মীপূজা হতো। পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসে লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হত। দেবী লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। পূজার  বিধান অনুসারে এক সের ধানের চারদিকে  চারটি পেঁচা রাখার নিয়ম ছিল। সেইসব পেঁচাগুলো পুরুষ শিল্পীরা নিজেরা বানিয়ে দিতো। বাড়িরই বাচ্চাদের আবদারে তারা কাঠ খোদাই করে তাদের বিভিন্ন পুতুল বানিয়ে দিতো।  পরবর্তীকালে তাদের সেইসব শিল্পকলা ছড়িয়ে পরে বিভিন্ন স্থানে। সময়ের তাগিদে চাহিদা বাড়ে। মানুষের রুচি বদলায়। তাই শুধু পুতুলেই আজ আর আটকে নেই নতুনগ্রাম। সেই কারণে উঠে আসে রাজা-রানী, গৌড় নিতাই, কৃষ্ণ ইত্যাদি মূর্তির  ভাবনা। বর্ধমান রাজ্যের কৃপাধন্য হয়ে পরে তাঁরা রাজা-রানীর মূর্তি নির্মাণ করে। এখানকার তৈরী প্রতিটা জিনিসেই রয়েছে শিল্পের সুষমা।এখানকার পুতুলগুলো রঙিন হওয়ার ফলে বেশ মনোগ্রাহী হয়।  বর্তমানে এখানকার এই শিল্প ধরে রাখার জন্য বেশ কয়েকবছর ধরে সরকার ও বেশ কয়েকটা সংস্থা বিভিন্ন জায়গায় মেলার আয়োজন করছে। সেইসব মেলায় এখানকার পুতুলের একটা আলাদা চাহিদা রয়েছে।শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকার নয়  ভারত সরকার ও ইউনেস্কো থেকেও এখানকার শিল্পীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। 

বিংশ শতাব্দীর এক গোড়ার দিকে বাজারে প্লাস্টিক নির্মিত বিভিন্ন পুতুল চলে আসে।  প্লাস্টিক পুতুলের সম্ভার যত বাজারজাত হয়েছে তত এখানকার কাঠের খোদাই করা পুতুলের কদর কিছুটা হলেও কমেছে। এখানকার লোকশিল্পীদের ইতিহাস কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে। ১৯৫৫ সাল নাগাদ এখানকার কাঠ খোদাই শিল্প ভারত সরকারের নজরে আসে।  

এখানকার শিল্পীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও শিল্প গরিমায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।  আধুনিকতার কাছে তাঁরা হয়তো কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়ছে তবুও তাঁরা তাঁদের শিল্পকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিচ্ছে। তাঁদের নিখুঁত হাতের স্পর্শে  এখানকার শিল্প কর্ম আজ বিশ্বের কাছে বাংলার ম্যান ও সম্মান অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। 


 

কিভাবে এখানে আসবেন :


নিজের গাড়িতে আসতে পারেন। এছাড়া হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে অগ্রদ্বীপ স্টেশনে নেমে অটো বা টোটো ধরে খুব সহজেই আসতে  পারবেন। 


তারিখ :০৯-১২-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০





 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।