Friday, October 23, 2020

শেওড়াফুলি রাজবাড়ীর পূজা >P

 হুগলির ঐতিহ্যবাহী শেওড়াফুলি রাজবাড়ীর পূজা 






  পশ্চিমবঙ্গের উৎসব অনুষ্ঠান একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র সৌন্দর্য বহন করে, উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।  ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা বাংলার বিভিন্ন রাজা-জমিদারদের  পরিবারের পূজা ও তাদের ঐতিহ্যের কথা জানতে পারি, জানতে পারি তাদের পারিবারিক ইতিহাস। হুগলি জেলার শেওড়াফুলিতে তেমনি এক ঐতিহ্যবাড়ি জমিদার ছিলেন রাজা মনোহর রায়। আজ তাঁর পারিবারিক পূজার কথা বলবো।  
 

শেওড়াফুলি রাজবাড়ীর পূজা এবছর ২৮৭ বছরে পদার্পন করলো। এটা হুগলি জেলার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পূজা। দেবী এখানে সর্বমঙ্গলময় মাতা সর্বমঙ্গলা রূপে পূজিত হন। এই পরিবারের  আদি নিবাস  ছিল বর্ধমান জেলার পাটুলি গ্রামে। এই বংশের রাজারা প্রচার বিমুখ মাতৃসাধক ছিলেন। কলকাতা থেকে কাশীধাম পর্যন্ত বহু জায়গায় এঁনারা বহু মন্দির ও বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠা করেন। পুন্যহৃদয় রাজা মনোহর রায় বর্ধমান জেলার আঁটিসারা গ্রামে  প্রজাদের সুবিধার্থে একটি পুকুর খনন করার সময় স্বপ্নে মাতা সর্বমঙ্গলাকে দেখতে পান। দেবী তাঁর কাছে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে দেখা দেন। কয়েকদিন পরে ওই খননের সময় এক দিনমজুরের কোদালে উঠে আসে একটি  অষ্টধাতুর দূর্গা বিগ্রহটি (দেবী সর্বমঙ্গলা)। পরবর্তী কালে রাজবংশের পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায়। রাজা মনোহর রায় পাকাপাকিভাবে শেওড়াফুলিতে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী সময় জায়গাটা চলে আসে হুগলি জেলায়। তিনি শেওড়াফুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।  



১১৪১ সালের ১৫ই জ্যৈষ্ঠ (১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে) শেওড়াফুলির রাজবাটীতে তিনি বিগ্রহটিকে প্রতিষ্ঠা করেন।  সেই থেকে রাজবাটীর লক্ষ্মী জনার্দন মন্দিরে মায়ের নিত্যপূজা, জন্মতিথি পালন ও বিশেষভাবে দুর্গাপূজা করা হয়ে আসছে।  মায়ের নিত্য সেবায় আতপ চালের নৈবেদ্য ও ফল-মিষ্টান্ন থাকে। দুর্গাপুজোয়  পূর্বে ছাগবলি, মহিষবলি করা হতো বর্তমানে চালকুমড়া বলি করা হয়।  কথিত আছে, রাজবংশের বড়  তরফের সেবাইত  স্বর্গীয় নির্মল  চন্দ্র ঘোষ স্বপ্নে দেখেন পাঠাবলির সময় পাঁঠাটি বিকট শব্দে আৰ্তনাদ করছে।  সেই সময় পন্ডিতরা পশুবলি নিষেধ করে দেন।  তারপর থেকে আর কখনো এখানকার পূজায়  পশুবলি করা হয় না। দেবী এখানে কাত্যাযনিরূপী হওয়ায় দেবীর সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী লক্ষ্মী থাকে না। রাজবাড়ীর পুজোটি  সাধারণভাবে মহালয়ার সাতদিন পূর্বে কৃষ্ণনবমী তিথিতে বোধন দিয়ে শুরু হয়। এবছর তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এবছর  মল   মাস পড়ায়  মহালয়ার ৩৪ দিন পর দুর্গাপূজা মহাষষ্ঠী পড়েছে। এখানে দুর্গাপূজার ৪১ দিন পূর্বে দেবীর বোধন হয়ে গেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় চন্ডীপাঠ, সন্ধ্যারতি ও নিত্যপূজা  চলছে।    সকালে আতপচাল ও বিভিন্ন ফল এবং সন্ধ্যায় লুচি ও মিষ্টি ভোগ হিসেবে দেবীকে দেওয়া হয়।  মহাষ্টমীর দিন কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।  দশমীর দিন শুধু দেবী ঘট ও কলাবৌ বিসর্জন দেওয়া হয়ে থাকে।  পূর্বে এখানে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর রেওয়াজ  ছিল। জৌলুস  হয়তো আজ নিভন্ত।  তবে রীতি নীতি আজও যতটা সম্ভব মেনে চলা হয়।   


রাজবাড়ীর দুর্গাপূজা দেখতে বহু দূর-দূরান্ত থেকে বহু দর্শক আসেন। বহু ভক্ত তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য মায়ের পূজা দিয়ে থাকেন।  


 ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  
তারিখ :২৩-১০-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




Wednesday, October 21, 2020

দুর্গাপুজোকে উৎসবে পরিণত করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ>P

দুর্গাপুজোকে উৎসবে পরিণত করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ 

- সুদীপ্ত মুখার্জী 

কলকাতায় বাঙালির দুর্গোপূজো খুব বেশিদিনের নয়।  ১৬১০ সালে বেহালায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের হাত ধরে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আটচালায় শুরু হয়েছিল।  তার দেড়শো বছর পরে উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে বেশ ঘটা করে পুজো করা হয়েছিল।  মাঝে অবশ্য অস্টাদশ শতকের প্রথমভাগে ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের কুমারটুলির বাড়িতে পুজোর প্রচলন হয়েছিল।  পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়কে দুর্গাপুজোর মাধ্যমে উৎসবে পরিণত করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব।  ধীরে ধীরে তা সর্বজনীন উৎসবের রূপ নিয়েছে।  শহরের অলিতে গলিতে দুর্গোৎসবটি ছড়িয়ে পড়েছে। 

নবকৃষ্ণের পিতা রামচরণ দেব বাংলার তৎকালীন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর অধীনে তার সেরেস্তায় কাজ করতেন বলে শোনা যায়।  নবাব তাঁকে  হিজলি, তমলুক, মহিষাদল, ইত্যাদি স্থানের কলেক্টর পদে নিযুক্ত করেছিলেন। পরে তিনি কটকের দেওয়ান হয়েছিলেন।  মেদিনীপুরের জঙ্গলে মারাঠা দস্যুদের হাতে তিনি নিহত হয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যা রেখে গেছেন।  রামচরণের বিধবা পত্নী পুত্র-কন্যা নিয়ে খুবই কষ্ট করে গোবিন্দপুরে জীবনযাপন করতেন।  পরবর্তী কালে প্রথমে তিনি আড়িপুলিতে ও তারপরে শোভাবাজারে এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।  নবকৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন।  মায়ের চেষ্টায় ও অনুপ্রেরণায় প্রথমদিকে আরবি ও ফরাসি ভাষা শেখেন এবং পরবর্তীকালে নবকৃষ্ণ ইংরেজি ভাষাটিকেও বেশ রপ্ত করে নেন।  সেই আমলে ধনকুবের নকু ধরের  কাছে তিনি চাকরি নেন।  নকু ধরের  আনুকূল্যে তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের ফরাসি শিক্ষক নিযুক্ত হন।  তখন অবশ্য হেস্টিংস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য কর্মচারী ছিলেন।  বুদ্ধিমান নবকৃষ্ণ হেস্টিংস ও লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।  ধীরে ধীরে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেশ বিশস্ত কর্মী হয়ে ওঠেন।  কোম্পানি তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে মুন্সী পদে উত্তীর্ণ  করেন।  পলাশীর যুদ্ধের পর নবকৃষ্ণের ভাগ্যের  চাকা ঘুরে যায়।  তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হর্তাকর্তা ছিলেন লর্ড ক্লাইভ।  তিনি তার বন্ধু নবকৃষ্ণের  জন্য দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে "রাজাবাহাদুর" খেতাব নিয়ে আসেন। 

ক্রমে ক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রপ হিসেবে কলকাতাকে গড়ে তোলে।  তারা বাংলার বহু জায়গায় বাণিজ্যকুঠি তৈরী করে।  সেই সময় কেউ কেউ ইংরেজদের বদান্যতায় হঠাৎ ধোনি হয়ে ওঠে।  এই নব্য ধোনিরা শহরে চালু করেছিলেন বাবু সংস্কৃতি। বাবু সংস্কৃতির প্রধান পথ প্রদর্শক ছিলেন অবশ্য নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র।  কলকাতার ধোনিদের মধ্যে রাজা নবকৃষ্ণের হাত ধরে বাবু কালচার শুরু হয়।  পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সহায় করার জন্য পুরস্কার হিসেবে প্রভূত ধনসম্পত্তি পেয়েছিলেন।  শোভাবাজারে তিনি একটি প্রাসাদোপম বাড়ি শোভারাম বসকের কাছ থেকে কেনেন।  বাড়িটি কেনার পর তিনি বহু টাকা ব্যয় করে সংস্কার করেন।  বাড়িটি ঠাকুরদালান সমেত কয়েক মহল ছিল।  ঐতিহাসিকদের মতে বাংলার শেষ নবাব সিরাজের বিপুল ধনসম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারায় তিনি প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেছিলেন।  

পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়কে স্মরণীয় করে রাখতে লর্ড ক্লাইভ বাঙালির দুর্গাপূজাকে হাতিয়ার করেন।  তিনি রাজা নবকৃষ্ণকে বিজয়ৎসব করার কথা বলেন।  রাজা তাঁর নবনির্মিত ঠাকুরদালানে এই উৎসবের আয়োজন করেন।  শুরু হল দেবী দুর্গাকে ঘিরে উৎসব।  এই পুজোয় আমন্ত্রিত হয়ে সাঙ্গপাঙ্গ সমত লর্ড ক্লাইভ এসেছিলেন।  মহামান্য ক্লাইভের ও আমন্ত্রিত সাহেবদের বসার জায়গা এমনভাবে করা হয়েছিল  যাতে তাঁরা সরাসরি দেবীর পুজো দেখতে পারেন।  কথিত আছে, লর্ড ক্লাইভ সঙ্গে করে কয়েক ঝুড়ি ফল নিয়ে এসেছিলেন।  এছাড়া তিনি ১০১ টাকা চাঁদাও দিয়েছিলেন।  

পূজা উপলক্ষ্যে লাগামহীন আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দ উচ্ছাসের  ব্যবস্থা করা হয়েছিল।  খানাপিনা ও বাইজি নাচের অঢেল ব্যবস্থা ছিল।  শোনা যায়,  লখনউ থেকে বাইজি ও বেনারস থেকে পুরোহিত নিয়ে আসা  হয়েছিল।  ১৮০১ সালে উইলিয়াম ওয়ার্ড শোভাবাজার রাজবাড়ীর দুর্গাপুজোর নবমী রাত্রির   বিবরণ লিখে গেছেন। তাঁর বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি, হিন্দু নর্তকীদের নাচ, মুসলমান বাঈজীরা হিন্দুস্থানী গান গেয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে সকলকে আপ্যায়ন করেছিল।  চারদিকে সাবেবরা বসে এই নাচের দৃশ্যগুলো উপভোগ করেছিলেন।  পূজামণ্ডপে নানারকম খিস্তিখেউড় ও বেলেল্লাপনা করা হয়েছিল, যা কলকাতার পুজোয় সর্বপ্রথম এখানেই দেখা গিয়েছিলো।  

১৮০২ সালে ফ্যানি পার্কস নবকৃষ্ণের পুজো সম্বন্ধে লিখে গেছেন - "পুজোমণ্ডপের পাশের একটা বড় ঘরে নানারকম উপাদেয় খাবার অঢেল পরিমানে সাজানো রয়েছে। সবই বাড়ির কর্তার সাহেব অতিথিদের জন্য।  খাবার সরবরাহ করেছেন বিদেশী পরিবেশক গান্টার আন্ড হুপার।  খাবার জিনিসের সঙ্গে বরফ ও ফরাসি মদ ছিল প্রচুর।  মণ্ডপের আর একদিকে একটা বড় হল ঘরে সুন্দরী বাঈজীদের নাচগান হচ্ছিলো।  সাহেব ও এদেশীও ভদ্রলোকেরা চেয়ার বসে সুরা পান করতে করতে সেই নাচ দেখছিলেন।  বাঈজীদের গান শোনার জন্য বাইরেও বেশ লোকের ভিড় হয়েছিল।  বাঈজীদের নাচগান সকলকে বেশ মাতিয়ে রেখেছিল।"

সেই থেকে বাবুদের দুর্গাপুজো মহাসমারোহে উদযাপিত হতে আরম্ভ করে।  শুধু নাচ নয়, পুজোর জাঁকজৌলুস, বিলাস,-বৈভব, খানাপিনার বহর, সাহেব-মেমদের আপ্যায়ন শুরু হয়েছিল।  দেবী দুর্গার পুজোকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উৎসব।  এই নিয়ে সেই সময়কার পত্রপত্রিকায় নানারকম মুখরোচক খবর ছাপা হত।  সাহেবরা কলকাতার দুর্গাপুজোকে "গ্রান্ট ফেস্ট"  নামে  অবিহিত করেছিলেন। 

বাবুদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল আভিজাত্যের লড়াই।  বিলাস-বৈভব ও বিপুল ব্যয়ের কারণে বর্তমানে বনেদি বাড়িগুলোর দুর্গাপুজোয় পড়তির চিহ্ন স্পষ্ট,  হারিয়ে গেছে বাবু কালচার।  সে যাই  হোক, রাজা নবকৃষ্ণের হাত ধরেই আমাদের শহরে ধুমধাম  সহকারে পুজো শুরু হয়েছিল।  দুগাপুজো তাঁর  হাত ধরেই পরিণত হয়েছিল দুর্গোৎসবে।  



ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  

তারিখ :২০-১০-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 




 










 

Sunday, October 11, 2020

গুমঘর লেন >P

গুমঘর লেন 



গুমঘর এই কথাটি শুনলেই সবার গা ছমছম করে ওঠে।  সেই গুমঘর নামে যদি একটা গলি রাস্তা হয় তাহলে তো  লোকে ভয় পাবে, সেই রাস্তায় পা দেবে না।  হ্যা আমাদের প্রাণের শহরের একটা ছোট্ট গলি রয়েছে যার নাম গুমঘর লেন।  গলিটি নানারকম বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানের ভিড়ে সারাদিন সরগরম থাকে।  কিন্তু রাত  যত বাড়ে পরিবেশ তত শুনশান হতে থাকে।  রাত  যত গভীর হয় গলিটি যেন তার নাম মাহাত্ম্য বজায় রাখে। মাত্র ৩০০ মিটার দৈঘ্য এই ছোট্ট গলিটি চাঁদনী চক  থেকে বেরিয়ে মিশেছে টেম্পলে স্ট্রিটে।  গলিটির দুধারেই বেশ কয়েকটা প্রাচীন বাড়ি রয়েছে। আবার কয়েকটা ভাঙাচোরা বাড়িও চোখে পড়বে।  

আজ থেকে প্রায় ২০০-২৫০ বছর পূর্বে এই  রাস্তাতেই গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোয়ারেন্টাইন সেন্টার।  অষ্টাদশ শতকে কলকাতায়  তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ছিল না বলা যায়।  চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামোও ছিল না,  ছিল মাত্র দু একজন ইংরেজ চিকিৎসক ও সেবিকা।  তারা সামান্য চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো।  কী নেটিভ, কী নেটিজেন কেউ কোনো  রোগে পড়লে উপযুক্ত  ঔষধ ও চিকিৎসার অভাবে বেশিরভাগেরই কপালে মৃত্যু অবধারিত ছিল। চিকিৎসা ব্যবস্থা না  থাকায় সাদা চামড়ার লোকেরা এমন পরিস্থিতিতে কাজ করতে খুবই অসুবিধায় পড়ছিলো।  তারা ভয়ে ভয়ে কাজ করে যাচ্ছিলো।  


 শোনা যায় চাঁদনী চোখ অঞ্চলের এই ছোট্ট গলি  পথটিতে কোনো এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দুরারোগ্য ও ছোঁয়াচে রোগীদের এই রাস্তার একটি বাড়িতে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা ছিল, কারণ রোগের প্রাদুর্ভাব যাতে ছড়িয়ে না পড়ে।  ১৭৯২ সাল  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় কর্মীদের চিকিৎসার জন্য নেটিভ হাসপাতালের প্রস্তাব দেয়। তার  বছর দুয়েক পর কলুটোলা অঞ্চলে সেই হাসপাতাল গড়ে ওঠে। ১৭৯৬ সাল নাগাদ চাঁদনী চক  অঞ্চলের বর্তমান হসপিটাল  স্ট্রিটে হাসপাতালটি উঠে আসে।  সেই হাসপাতালের  লাগোয়া অংশই আজকের গুমঘর লেন।   

কলকাতা পুরসভার খাতায় আজ গলিটির নাম গুমঘর লেন বলেই উল্লেখ রয়েছে।  অতীতের সাক্ষাৎ যমপুরী আজ শহরের ব্যস্ততম রাস্তা।  কলকাতা বিশারদ শ্রীপান্থ তাঁর "ডাক্তার-বদ্যি"  শিক্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন " “লোক আসে আর মরে। মরে, তবুও আসে।… দিব্যি সুস্থ-সমর্থ জোয়ান ছেলে সন্ধ্যায় নেমেছে চাঁদপাল ঘাটে। রাত্তিরটাও কাটল না। ভোরবেলাতেই দেখা গেল কলকাতার অ্যাডভেঞ্চারে দাঁড়ি পড়ে গেছে তার।… লোক মরত। এখনও মরে, তখনও মরত। সাহেব-নেটিভ নির্বিশেষেই মরত।" এই নেটিভ শব্দটাই গুমঘর গলির দিকে এগোনোর প্রথম ক্লু। এখন যেমন নেটিজেনরা কোয়ারেন্টাইন, সেই সময়েও গুমঘর গলি নেটিভদের একঘরে রাখার একমাত্র ঠিকানা।"

ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  

তারিখ : 11-10-2020

যোগাযোগ : 98304 20750 




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 


Saturday, October 3, 2020

পোস্তা ও মন্দির> P

পোস্তা ও মন্দির 


পোস্তা অঞ্চলটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহরের মধ্যাংশে অবস্থিত একটা অঞ্চল। পূর্বে অঞ্চলটিতে বাঙালি ব্যবসায়ীদের বসতি অঞ্চল ছিল। বর্তমানে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। অঞ্চলটির নামকরণ হয়েছিল হুগলি নদীর পোস্তা ঘাটের নামানুসারে।  বাঙালি ব্যবসায়ী লাক্সক্ষীকান্ত ধার ওরফে নকু ধর ছিলেন এই অঞ্চলের একজন বিত্তশালী বাঙালি ছিলেন।  রাজা নবকৃষ্ণ দেব প্রথম জীবনে এই নকু বাবুর কাছেই চাকরি করেছিলেন।  নকু ধরের দৌহিত্র সুখময় রায় পরবর্তীকালে এখানে একটিবিশাল রাজবাড়ী নির্মাণ করেন।  পূর্বে অঞ্চলটিতে মগ জলদস্যু, চোর-ডাকাতের ভয় ছিল।  রাজবাড়ীর সদস্যরা নজস্ব শক্তি ও জনবলের সাহায্যে সেই ভয় অতিক্রম করে। তারপর অঞ্চলটিতে ধীরে ধীরে জন বসতি গড়ে ওঠে।  এখানে ডাল, আলু প্রভৃতির বিশাল পাইকারি বাজার রয়েছে। বর্তমানে অঞ্চলটি বাণিজ্যিক বাজার অঞ্চল। ২০১৬ সালের ৩১সে মার্চ আচমকাই এখানকার নির্মীয়মান বিবেকানন্দ সেতুটি ভেঙে পরে।  

এই অঞ্চলে দুটো খুব প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত মন্দির রয়েছে।  গত সেপ্টেম্বর  মাসের ৩০ তারিখে ওই অঞ্চলে একটা কাজের জন্য গিয়েছিলাম। মন্দির দুটো দেখার ইচ্ছে বহুকাল ধরে মনে বন্দি করে রেখেছিলাম।  এজ বহুদিনের ইচ্ছের কিছুটা লাঘব হলো। করণের জন্য একটি মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করতে পারলাম না, অন্যটির দ্বার বন্ধ ছিল।  যাই যোগ যতটুকু দেখেছি ও যতটুকু জেনেছি তাই সকলকে জানবার চেষ্টা করছি। 


পুঁটে কালী মন্দির 


হিন্দুদের প্রধান দেবী হলেন কালী বা কালিকা।  কালীকে শ্যামা ও আদ্যাশক্তি বলেও অবিবাহিত করা হয়।  শক্ত সম্প্রদায়ের কলকেরা সাধারণত কালী পূজা করে থাকে।  তন্ত্র অনুসারে দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবীই হলেন কালী।  তন্ত্র ও পূরণে কালির নানা রূপভেদ দেখা যায়।  সেই অনুসারে দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী , ভদ্রকালী চামুণ্ডাকালী শ্মশানকালী ও শ্রীকালী। কলকাতার উত্তর দিকে দক্ষিনেশ্বরে তিনি মা ভবতারিণী আবার দক্ষিণে কালীঘাটে দেবী কালিকা।  


পোস্তা অঞ্চলের কালী কৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিতে রাস্তার ধারে  ছোট্ট একটা লালা রঙের সুন্দর মন্দির বিদ্যমান। এটা  খুবই প্রাচীন মন্দির। স্থাপিত ৯৬৪ বঙ্গাব্দে। এই বিখ্যাত মন্দিরটির নাম পুঁটে কালী।  কেউ কেউ আবার পুঁটি কালী বলেও অভিহিত করে থাকে।  কালী মূর্তিটি খুবই ছোট।  উচ্চতা মাত্র ৬ ফুট। দেবীকে এখানে যোগমায়া রূপে পূজা করা হয়। কেউ কেউ ছোট মূর্তি বলে এরকম নামকরণ হয়েছে বলে থাকেন।  আবার কারো কারো মতে কালী ভক্ত আমার কৃষ্ণ ভট্টাচার্য স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন।  "পুঁটিমাছ ভাসছে তার নিচে পাওয়া যাবে আমাকে বলে কালী মায়ের সস্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন।  শহুদহু তাই নয় দেবী তাকে এই স্তনে পূজা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।  এছাড়া আরো একটা মোট শোনা যায়।  পূর্বে মন্দিরের পাশ দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত ছিল।  কোনো একদিন হমার সময়ে গঙ্গা থেকে একটা পুঁটিমাছ লাফিয়ে হ্মকুণ্ডের মধ্যে পরে যায়।  অর্ধ দগ্ধ মাছটিকে তুলে আবার জলে ফেলে দিতেই সেটি আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে।  এই কারণেই মন্দিরটির নাম পুঁটে কালী বলা হয়ে থাকে।  



বৈকুণ্ঠনাথ মন্দির 

এই অঞ্চলে অবস্থিত আর একটা অতীব সুন্দর মন্দির রয়েছে। নাম বৈকুণ্ঠনাথ মন্দির। বিখ্যাত ব্যবসায়ী রাম কুমারজি বাঙুর ও মাঙ্গানি রাম বাঙুর মন্দিরটিই নির্মাণ করেন। সালটা ছিল ১৯৬০। মন্দিরটির অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলে ত্রিদেবী ও ভূদেবী। মন্দিরটি দক্ষিণ  ভারতের মন্দিরের আদলে তৈরী।  মন্দিরটির বাইরে ও ভিতরে অসাধারণ কারুকার্যে নির্মিত। মন্দিরটির ভিতরে বেশ কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে।   দেবী মূর্তির পাথর আদি বৈকুণ্ঠনাথ মন্দির থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।   




ছবি ও  লেখার সত্ব  : সুদীপ্ত মুখার্জী  

তারিখ : 03-10-২০২০

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।