Sunday, January 24, 2021

ফিরিঙ্গি কালী মন্দির >P

ফিরিঙ্গি কালী মন্দির 





বাঙালির কালী পুজোর ইতিহাস বহু  প্রাচীন। যদিও দুর্গাপুজোর মতোই কালী পুজো  ঠিক কবে থেকে প্রচলন হয়েছিল তা নির্ভুলভাবে বলা খুব কঠিন।  বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের  দ্বারা অনুমান করা হয়ে থাকে যে দুর্গাপুজোর পূর্বেই কালিপূজার প্রচলন হয়েছিল।  কালীক্ষেত্র হিসেবে শহর কলকাতার পরিচিতি বহু শতক পূর্বেই ঘটেছিলো। "কালী-কোলকাত্তাওয়ালী" এই প্রাচীন প্রবাদটি থেকে শহরের সাথে দেবী কালির সম্পর্কের প্রাচীনতা  অনুমান করা যেতে পারে।  বর্তমানে শহরের অলিতে-গলিতে বহু কালী মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

  



 মধ্য কলকাতার বৌবাজার অঞ্চলে একটা বহু প্রাচীন কালী মন্দির রয়েছে।  যার পোশাকি নাম  শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির কিন্তু লোকমুখে প্রচারিত ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি।  মন্দিরটি বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের জংশনে অবস্থিত। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী মন্দিরটি ৫০০ বছর অতিক্রম করে গেছে। এই মন্দিরটিতে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতার মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত পঞ্চমুন্ডি আসনে। ফিরিঙ্গি কালী বা সিদ্ধেশ্বরী কালিমন্দিরটি দক্ষিণমুখী।  দেবীমূর্তিটি সিমেন্ট ও মাটি দিয়ে নির্মিত।  দেবী এখানে চতুর্ভূজা ও ত্রিনয়নী।  মূর্তির উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট।  পায়ের নিচে শিব মূর্তি বিরাজমান। মূর্তিটির  দক্ষিণদিকে একটি অষ্টধাতু নির্মিত দুর্গামূর্তি রয়েছে।  এছাড়া দেবী শীতলা  ও দেবী মনসার মূর্তিও মন্দিরটিতে রয়েছে। এখানকার দেবী খুবই জাগ্রত। সেই সময় কোম্পানির ইংরেজরাও এখানে পূজা দিতেন। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ সেই প্রাচীন কাল থেকেই এখানে পূজা দিতে আসেন।  ১৮২০ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মন্দিরের পূজারী হিসেবে ছিলেন  শ্ৰীমন্ত পন্ডিত।  মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা সম্বন্ধে  কিছু জানা যায় না। 




এখানে চাল, মিষ্টি ও ফল দিয়ে মায়ের নিত্যপূজা হয়।  প্রতি মাসে দুবার বিশেষ অন্নভোগ দেওয়া হয়।  মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায়  কালী ও প্রতি পূর্ণিমায় নারায়ণের পূজা হয়।  কার্তিকী কালীপূজা ও শারদীযা দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।  এই বিশেষ পুজোগুলোতে মায়ের ভোগে সাধারণত থাকে খিচুড়ি, পোলাও, পাঁচ রকমের সবজি, ভাজা, আলুরদম বা ফুলকপির তরকারি, আমসত্ব ও খেজুর অথবা আমস্বত্ব ও আলুবখরা কিসমিসের চাটনি থাকে। আখ, চালকুমড়া ও শশা বলি দেওয়া হয়।   

১৪৯৭ সাল।  জোব চার্ণকের  পদধূলি তখনও কলকাতার মাটিতে পড়েনি। কলকাতা তখন মহানগরী নয়। একটা গন্ড গ্রাম।   আজকের সেন্ট্রাল এভেনিউ দিয়ে তখন গঙ্গা বয়ে যেত। একটা নির্জন এলাকা। পাশেই  ছিল অরণ্য। তখন সেখানে ছিল সাপখোপ ও হিংস্র পশুর বিচরণ ভূমি।   এই অরণ্যতে ছিল একটা শ্মশান। শ্মশানে ছিল একটা চলা ঘর।  এই ঘরের মধ্যে ছিল একটা কালী মূর্তি।  ফিরিঙ্গি সাহেবরা এই নির্জন এলাকাতে বসবাস করতেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কালীভক্ত কবিয়াল। উনিশ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগীজ বংশোদ্ভূত হ্যান্সম্যান এন্টোনি নামে একজন বসবাস করতেন। এন্টোনি সাহেব ওই চালা ঘরে শ্মশানকালীর কাছে নিয়মিত আসতেন।  সেখানে মায়ের কাছে বসে তিনি মায়ের পূজাপাঠ করতেন।  মাকে  একটার পর একটা গান শোনাতেন বলেও  কথিত রয়েছে।  তিনি ছিলেন সেইসময় বাংলার দাপুটে কবিয়াল। তিনি দিনরাত ডুবে থাকতেন হিন্দু ধর্ম ও বাংলার সংস্কৃতিতে। তাঁর ও ভোলা ময়রার গানের লড়াই ছিল খুবই বিখ্যাত। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে বহু স্রোত। অঞ্চলটি আজ কলকাতা শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। বিভিন্ন লোকগাথা ও এন্টোনি ফিরিঙ্গির গল্পকথা নিয়ে শহরের বৌবাজার এলাকার এই প্রাচীন মন্দিরটি আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

তারিখ : ২৪-০১-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০




 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন। 



Friday, January 1, 2021

কল্পতরু উৎসব >P

কল্পতরু উৎসব 





ইংরেজি বছরের প্রথম দিন বাঙালিরা যেমন নতুন বছর পালন করে ঠিক তেমন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ  পরমহংসদেবের   অনুগামীরা দিনটিকে 'কল্পতরু দিবস' হিসেবে পালন করে থাকে।  বিশেষত কাশীপুর উদ্যানবাটী ও রামকৃষ্ণ মহাশ্মশান, দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির, বেলুড়মঠ,  আদ্যাপীঠ সহ ঠাকুরের নামাঙ্কিত বেশ কিছু পীঠস্থানে এই দিন নানা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।   
 

 এই দিনই কল্পতরু উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয় কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে এখানে ভক্তদের ঢল নামতে দেখা যায়।  দক্ষিনেশ্বর কালী মন্দিরে ও হুগলির কামারপুকুরে ঠাকুরের জন্মস্থানেও বহু ভক্তের  সমাগম হয়।  এছাড়া   রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন শাখায় প্রতিবছর  ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটি খুব ঘটা  করে কল্পতরু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। 

এখন প্রশ্ন হলো কল্পতরু উৎসবটি কি।  আজ থেকে বছর ৭৪ পূর্বে  অর্থাৎ ১লা জানুয়ারি ১৮৮৬   সালে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব  কল্পতরু রূপে ভক্তদের দেখা দিয়েছিলেন। তাঁর অনুগামীদের জীবনে  অভূতপূর্ব  তাৎপর্যপূর্ণ একটি  ঘটনা।  শুক্রবার ১১ই  ডিসেম্বর, ১৮৮৫ সালে ঠাকুর শুক্লা পঞ্চমীতে শ্যামপুকুর বাটি  থেকে কাশীপুরের বাগান বাড়িতে বসবাস করতে এসেছিলেন। তখন তিনি খুবই অসুস্থ।ঠাকুর সেই সময় দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন।  তাঁর গলায় ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। তবুও শয়নে-স্বপনে তিনি ভক্তদের চিন্তায় মগ্ন থাকতেন।   তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছিল। কলকাতার উত্তরের কাশীপুর অঞ্চলে একটা বাগানবাড়িতে তখন ঠাকুরকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই দিন ঠাকুর একটু সুস্থ বোধ করায়  তাঁকে বাড়িটির বাগানে হাঁটতে  নিয়ে আসা হয়েছিল।  সেই সময় তিনি তাঁর বিশেষ অনুগামী নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষকে জিজ্ঞাসা করেন "তোমার কি মনে হয় আমি কে?" গিরিশচন্দ্র তাঁকে বলেন তিনি বিশ্বাস করেন যে "মানবকল্যাণের জন্য মর্তে অবতীর্ণ ঈশ্বরের অবতার।" ঠাকুর গিরিশের কথা শুনে বলেন "আমি আর কি বলবো?  তোমাদের চৈতন্য হোক।" এর পর তিনি সমাধিস্থ হন এবং তার সমস্ত শিষ্যদের স্পর্শ করেন।  তাঁর অনুগামীরা মনে করেন এই স্পর্শে সেদিন সমস্ত অনুগামীদের একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল।  ঠাকুরের অন্যতম শিষ্য রামচন্দ্র দত্ত বলেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস হিন্দু পুরাণে বর্ণিত কল্পতরুতে পরিণত হয়েছিলেন।  তিনিই এই দিনটিকে 'কল্পতরু দিবস' নামে নামাঙ্কিত করেন। পরবর্তী সময় কল্পতরু দিবসটিতে কল্পতরু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  

ভোর বেলায় বিশেষ পূজার মাধ্যমে উৎসবের সূচনা হয়. ভোর থেকেই ভক্তদের ভিড় পরিলক্ষিত হয়।  বেলা যত বাড়ে ভক্ত সমাগম তত বৃদ্ধি পায়।  দক্ষিণেশ্বর ও কাশীপুর উদ্যানবাটীতে হাজার হাজার  ভক্তের সমাগম হতে দেখা যায়।  ভিড় সামাল দিতে প্রচুর সংখ্যায়  নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা হয়।  ভক্তরা মনে করে এই দিন ঠাকুরের কাছে  যা মনোস্কামনা করা হবে তাই পূর্ণ হবে।  দক্ষিনেশ্বরে ভোর চারটের  সময় ভবতারিণী মন্দিরে ও রামকৃষ্ণদেবের ঘরে মঙ্গলারতির মাধ্যমে পূজা শুরু হয়।  সকালে জিলিপি ও বোঁদে প্রসাদ দেওয়া হয়।  দুপুরে ঠাকুরকে ভাত , মাছ, ও পাঁচ রকমের ভাজা ও মিষ্টি ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে সকাল থেকেই মঙ্গলারটি কীর্তন ও ভোজন, বৈদিক মন্ত্রচারণ সহকারে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।  দিন দক্ষিনেশ্বর ও উদ্যানবাটী আলোক সজ্জায় সেজে ওঠে।  

তারিখ :০১-০১-২০২১

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০


 আমার এই লেখাটি ও ছবিটি  যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনার মূল্যবান      মতামত কমেন্টের  মাধ্যমে জানাবেন। পরবর্তী লেখাগুলো  পেতে  ব্লগটিকে ফলো করে রাখুন।